শহরের বিকাশের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে ব্যবসা বাণিজ্য। চিৎপুর, শোভাবাজার, আহিরিটোলার মত শহরের বেশ কিছু জায়গায় ব্যবসার আড়ৎ গড়ে উঠেছে। রেল পরিষেবা চালু হওয়ার পর শিয়ালদহ স্টেশনে বাইরে থেকে আসছে প্রচুর মালপত্র। স্টেশনে আসা মালপত্র শহরের নানা প্রান্তে পৌঁছানর ব্যবস্থা করাটা হয়ে উঠল নগরকর্তাদের প্রধান সমস্যা। সমস্যার কথা জানানর পর ভারত সরকারের কাছ থেকে ট্রাম চালাবার পরামর্শ আসে। কোলকাতার Justice for the Peace পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য একটি কমিটি তৈরি করলেন। কমিটি, গ্রামের থেকে আসা পণ্য বিভিন্ন গুদামে পৌঁছে দেওয়ার উপযোগী করে একটি রুট ঠিক করল। পরিকল্পনা মঞ্জুর হল। দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে শেয়ালদা থেকে বৈঠকখানা রোড, বৌবাজার স্ট্রিট, ডালহৌসি স্কোয়ার হয়ে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত লাইন পাতা হল। আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত লাইন পাতা হয়েছিল কারণ, ওইখানে ছিল তখনকার ইষ্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের হাওড়ার টিকিটঘর। শিয়ালদহ এবং হাওড়ার মধ্যে পণ্য পরিবহণের সুবিধার কথা চিন্তা করেই ওই স্থান নির্বাচন করা হয়। ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কোলকাতায় চলল প্রথম ট্রাম।
সেদিন শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দুটি ‘ট্রাম ট্রেন’ রওনা হয়। প্রথম ট্রেনে ছিল একটি প্রথম শ্রেণীর এবং দুটি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ি। দ্বিতীয়টিতে ছিল একটি প্রথম এবং একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ি। ট্রেন বলা হলেও গাড়িগুলি কিন্তু একটি অপরটির সাথে জোড়া ছিল না। একটি গাড়ির পিছনে আর একটি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটি গাড়ি টানার জন্য সামনে ছিল দুটি করে বলিষ্ঠ ঘোড়া। ৯.১৫তে শিয়ালদহে ইস্টবেঙ্গল রেলওয়ের ট্রেনটি ঢোকা মাত্র যাত্রীরা ছুট লাগাল প্রথম ট্রামে সওয়ারি হওয়ার জন্য। পণ্য পরিবহনের উদ্দেশ্যে ট্রামের পত্তন হলেও মানুষের ভিড়ে পণ্য ওঠার আর কোন জায়গা রইল না। প্রথম শ্রেণী অবশ্য ফাঁকা ছিল, কিন্তু সেখানে দামী মানুষদের মাঝে পণ্য রাখার প্রশ্নই ওঠে না। ট্রামের বড় কর্তা মিঃ সি এফ অ্যাব্রো এবং ইঞ্জিনিয়ার মিঃ ক্লার্ক ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তদারকি করছেন। ৯.৩০ মিনিটে গাড়ি ছাড়ার সংকেত দেওয়া হল। প্রথম শ্রেণী সংকেতের সাথে সাথেই স্টেশন থেকে রওনা হল। যাত্রী মাত্র পাঁচ জন, তিনজন সাহেব আর দুজন স্থানীয়। গোল বাঁধল দ্বিতীয় শ্রেণী দুটি ছাড়ার সময়। ট্রামে বসার আসন ছিল ৪৫টি। ভিড়ের ঠেলায় মুহূর্তে বসার আসন ভরে গিয়ে ছাতে পর্যন্ত লোক উঠে গেছে। তাগড়া ওয়েলার ঘোড়াগুলো সাধ্যমত চেষ্টা করেও গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। তারপর বিস্তর ঠেলাঠেলি এবং বেশ কয়েক ঘা চাবুক মারার পর গাড়ি ধীরে ধীরে রওনা হল। শয়ে শয়ে মানুষ সেদিন কলকাতার রাস্তায় ভিড় করে এই নতুন গাড়ি চলা দেখেছিল।
প্রথম পর্যায়ের এই ট্রাম পরিষেবার পরমায়ু খুব কম ছিল। লোকসানের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ৯মাস পরে ১৮৭৩ এর ২০ নভেম্বর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। কলকাতায় ট্রাম চালাবার মূল উদ্দেশ্য ছিল পণ্য পরিবহণ। কিন্তু লোকের ভিড়ে তা বাস্তবায়িত হল না। সামান্য যাত্রী ভাড়ায় বিপুল খরচ সামলান সম্ভব ছিল না। কিছুদিন চলল দোষারোপের পালা। কেউ দুষলেন জাস্টিস অফ পিসদের, জাস্টিসরা দুষলেন সরকারকে। মিউনিসিপ্যালিটির মাথা হগ সাহেব জাস্টিসদের পাশে দাঁড়ালেন। সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করলেন। সরকার সে আবেদনে কর্ণপাত করেনি। অগত্যা ট্রামের লাইন, গাড়ি এবং যাবতীয় কিছু বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ম্যাকলিস্টার নামে এক সাহেব কেনা দামে সব কিছু কিনতে সম্মত হলেন। বাংলা সরকারের আপত্তিতে তাঁকে বিক্রি করা গেল না। অবশেষে বিক্রি করা হল Dillwyn এবং Alfred Parish ও Robinson Souttar নামে তিনজন ইংরাজের কাছে।
১৮৭৮ সালে কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কলকাতা শহরে নিয়মিতভাবে ট্রাম চালাবার প্রস্তাব সরকারের কাছে আসে। তার মধ্য থেকে মেসার্স প্যারিস অ্যান্ড সাউদারের প্রস্তাব গৃহীত হয়। অনুমতি পাওয়ার পর তাঁরা প্রস্তাব রূপায়ণের জন্য ‘ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি’ গঠন করেন। ১৮৭৯ সালের ২ অক্টোবর কলকাতা কর্পোরেশনের সাথে ট্রাম কোম্পানির একটি চুক্তি হয়। কলকাতা কর্পোরেশন এই চুক্তি অনুসারে ট্রাম কোম্পানিকে শহরের বেশ কিছু রাস্তায় ট্রামলাইন পাতার অধিকার দেয়। ঠিক হল, কোম্পানি কর্পোরেশনকে একটি লাইনের জন্য বছরে ২ হাজার টাকা এবং জোড়া লাইনের জন্য ৩ হাজার টাকা দেবে। ১৯০১ সালে এই ভাড়া বেড়ে হবে যথাক্রমে ৩ ও ৪ হাজার টাকা। এ ছাড়া ট্রামের ভাড়া ঠিক করার অধিকার সম্পূর্ণভাবে কোম্পানির হাতে থাকবে।
শিয়ালদহ- বৌবাজার লাইনে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম ট্রাম চলে ১৮৮০ সালের ২৯ অক্টোবর। শিয়ালদহ-বৌবাজার—ডালহৌসি-হেয়ার স্ট্রিট লাইনে ট্রাম চলাচল শুরু হয় ১৮৮০ সালের ১৯ নভেম্বর। চিৎপুর রোডে ট্রাম চলে ১৮৮১ সালের মার্চে, চৌরঙ্গি রোডে ওই বছরের নভেম্বরে, ধর্মতলা স্ট্রিটে ১৮৮২ সালের মার্চে, স্ট্র্যান্ড রোডে ১৮৮২ সালের জুনে, শ্যামবাজারে ১৮৮২ সালের নভেম্বরে, খিদিরপুরে ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বরে এবং ওয়েলেসলি স্ট্রিটে ১৮৮৪ সালের এপ্রিল মাসে। ১৯০৪ সাল থেকে কয়েক বছরের মধ্যে টালিগঞ্জ, বেলগাছিয়া, হ্যারিসন রোড এবং সার্কুলার রোডে ট্রাম লাইন পাতা হল। চিৎপুর রোডে প্রথমে সক স্ট্রিট(বর্তমানে দুর্গা চরণ ব্যানার্জী স্ট্রিট) পর্যন্ত লাইন পাতা হয়েছিল, পরে তা বাগবাজার পর্যন্ত বাড়ান হয়।
প্রথম দিকে ট্রাম লাইন ছিল ৩ ফুট ৩/৮ ইঞ্চি চওড়া। ১৯০২ সালে তা বেড়ে হয় ৪ ফুট ৮-১/২ ইঞ্চি। সেকালে ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর মাথায় লাল পাগড়ি পরত। ট্রামগাড়ি ছিল ধূসর রঙের, ইংরাজিতে বলা হত CTC Grey। ১৮৯৬ সালে কলকাতায় ট্রামের ৬টি ডিপো ছিল—শ্যামপুকুর, চিৎপুর, শিয়ালদহ, কলিঙ্গা(ওয়েলেসলি স্কোয়ার), ভবানীপুর এবং খিদিরপুর। ট্রাম গাড়িতে দুদিকে পাঁচটি করে মোট দশটি খোলা দরজা থাকত। লোকে দুদিক দিয়েই ওঠানামা করত। তখন ট্রামের কোন রুটে কত ভাড়া তা জানিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। ট্রাম রাস্তায় এক মাইল বাদে বাদে থাকত একটি করে স্টেশন। এখানে যেমন যাত্রীরা নামাওঠা করত তেমনই প্রয়োজনে ঘোড়া বদল করা হত। রাস্তার ধারে ঘোড়ার জল খাওয়ার জন্য বড় বড় জলাধার ছিল। ট্রামে ঘোড়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও অনেক কাল রাস্তার ধারের সেই জলাধারগুলি স্মরণ করাত ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতাকে।
দ্বিতীয় দফায় ট্রাম চলাচল শুরু হওয়ার পর লাইন নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। শহরের বেশ কিছু জায়গায় ট্রাম লাইন রাস্তার থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠে ছিল। পথচারী এবং যানবাহনের পক্ষে তা বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝে ছোটখাট দুর্ঘটনাও ঘটছিল। আলাপ আলোচনায় সমস্যা না মেটায় ১৮৮৫ সালে ব্যাপারটা আদালত অব্দি গড়াল। আদালতের দীর্ঘসূত্রতা তখনো ছিল। চার বছর পর আদালত কোম্পানিকে লাইনগুলি ঠিক করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ১৮৯০ সালে, অর্থাৎ লাইন বসার ১০ বছর পরে ত্রুটি মেরামত করা হয়।
ঘোড়ার লালন পালন ছিল সেই সময় ট্রাম পরিষেবার সব থেকে বড় সমস্যা। ঘোড়াগুলো সব আনা হত শীতের দেশ থেকে। একে আমাদের দেশের গরম তাদের কাছে কষ্টকর ছিল, তার ওপর টানতে হত মানুষ বোঝাই ভারি গাড়ি। পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে ১৮৮১ সালের গরমকালে অনেকগুলো ঘোড়া মারা যায়। শুরু হল বিকল্পের সন্ধান। ১৮৭৯ সালের ২৪ জুলাই P.W. Fleury & Co. বিজলি বাতির প্রথম প্রদর্শন করে কলকাতা শহরে সাড়া ফেলে দিয়েছে। ১৮৮১ সালে Mackinnon & Mackenzie Cotton Mill এর মত অল্প কিছু জায়গায় বিজলি বাতির আলো ঝলমল করছে। তবে সেই সময় তা একেবারেই বিরল দৃশ্য। কলকাতার রাস্তায় কিন্তু তখনো গ্যাসের বাতি জ্বলছে। বিদ্যুতের ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হতে তখনো দুই দশক দেরি আছে। তাই ঘোড়ার বিকল্প হিসাবে, রেলের মত ট্রামের জন্য তৈরি হল বাষ্পীয় ইঞ্জিন। ১৮৮২ সালে ট্রাম কোম্পানিকে পরীক্ষামূলকভাবে একমাসের জন্য চৌরঙ্গির রাস্তায় বাষ্পীয় ইঞ্জিনের সাহায্যে ট্রাম চালাবার অনুমতি দেওয়া হল। একমাস শেষ হওয়ার পর জনগণের ইচ্ছায় আরো এগার মাস ঐ লাইনে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের সাহায্যে ট্রাম চলে। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আসায় ট্রামের গতি বেড়েছিল এবং হয়ত সেই কারণেই বেড়েছিল দুর্ঘটনা। কিছুটা দুর্ঘটনা এবং কিছুটা প্রশাসনিক সমস্যার কারণে স্টিম ইঞ্জিনের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ হলেও, প্রতি বছর দুর্গা পুজোর সময় তীর্থ যাত্রীদের কালিঘাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালাবার বিশেষ অনুমতি দেওয়া হত। খিদিরপুর লাইনেও কিছু সময় ট্রামে বাষ্পীয় ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়েছিল। বাষ্পীয় ইঞ্জিন বাতিল হওয়ার পর থেকে বিদ্যুতায়ন পর্যন্ত এক দশক, শত সমস্যা সত্ত্বেও, ঘোড়াই সচল রেখেছিল কলকাতার ট্রাম। ১৮৯০-৯১ সালে ট্রাম কোম্পানিতে ২২৫০ জন কর্মচারী ছিল আর ঘোড়া ছিল ১০০০টি।
সময়ের সাথে সাথে কলকাতা শহরে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়তে থাকে। কিলবার্ন কোম্পানি ১৮৯৬ সালে বিদ্যুতের সাহায্যে ট্রাম চালাবার অভিপ্রায়ে সরকারের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করে। ট্রাম কোম্পানির সাথে কিলবার্নের এই মর্মে আলাপ আলোচনা এবং সমঝোতা হয়। ১৮৯৭ সালে কর্পোরেশন বিদ্যুতের সাহায্যে ট্রাম চালান সংক্রান্ত নতুন কিছু শর্তাবলী যুক্ত চুক্তিপত্র ট্রাম কোম্পানিকে দিলে কোম্পানি তা মানতে অস্বীকার করে। পরবর্তীকালে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে খসড়ায় কিছু পরিবর্তন করা হয় এবং ১৮৯৯ সালে চুক্তিটি কার্যকর হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ট্রাম কোম্পানিকে ৯ ডিসেম্বর ১৯০২ এর মধ্যে বিদ্যুৎ চালিত ট্রাম পরিষেবা শুরু করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে সেরে ফেলতে হবে পরিকাঠামোগত সমস্ত পরিবর্তন। লাইন পাতা, নতুন কামরা বানান, বিদেশ থেকে ইঞ্জিন আনা, বিদ্যুতের খুঁটি পোতা, বিদ্যুতের তার লাগান, ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজে বিপুল শ্রম এবং অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়েছিল। তবু নির্ধারিত সময়ের কয়েক মাস আগেই শহরে এসে গেল বিদ্যুৎ চালিত ট্রাম। ট্রামে বিদ্যুতের সংযোগ হওয়ার পর কলকাতার পরিবহণ অনেকটাই আধুনিক রূপ পেয়েছিল।
১৯০২ সালের ২৭ মার্চ প্রথম বিদ্যুতের ট্রাম চলল খিদিরপুর লাইনে। এরপর একে একে চালু হল চৌরঙ্গি কালীঘাট, ওয়েলিংটন স্ট্রিট- বৌবাজার- ডালহৌসি স্কোয়ার এবং ধর্মতলা লাইনে। ১৯০২ সালের মধ্যেই পুরনো সব কটি রুটেই বৈদুতিক ট্রাম এসে গেল। যাতায়াতের সময় কমে গেল, কোম্পানির আয় বেড়ে গেল। যাত্রীরাও খুশি, কোম্পানিও খুশি। মুনাফায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ট্রাম কোম্পানি কয়েক বছরের মধ্যে শহরে পেতে ফেলল আরো কটি নতুন লাইন। ১৯০৩ সালে খোলা হয় টালিগঞ্জ, বেলগাছিয়া, হ্যারিসন রোড, ১৯০৪ সালে বাগবাজার এবং ১৯০৮ সালে চালু হয় লোয়ার সার্কুলার রোড, আলিপুর এবং বেহালা লাইন। ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে শিয়ালদহ থেকে হ্যারিসন রোড, স্ট্র্যান্ড রোড হয়ে হাইকোর্ট পর্যন্ত ট্রাম চলাচল শুরু হয়। ১৯১০ সালে শিয়ালদহ থেকে রাজাবাজার পর্যন্ত লাইন পাতা হয় এবং ১৯৪১ সালে তা শ্যামবাজার অব্দি সম্প্রসারিত করা হয়। ১৯২৫ সালে পার্ক সার্কাস এবং ১৯২৮ সালে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ এ ট্রাম চলাচল শুরু হয়। পার্ক সার্কাস-বালিগঞ্জ লাইন চালু হয় ১৯৪৩ সালে। ১৯১৪ সালে কলকাতা এবং শহরতলি মিলিয়ে ৩১ মাইল ট্রামলাইন ছিল। ২৪৫টি করে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা ছিল। কেবল কলকাতা শহরেই নয়, মিউনিসিপ্যালিটির অনুমতিক্রমে ১৯০৭ সালে হাওড়াতেও ট্রাম পরিষেবা শুরু হয়।
গাড়ি রাখার জন্য কালীঘাট, শিয়ালদহ, শ্যামবাজার এবং খিদিরপুরে তৈরি হল ডিপো। মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তৈরি হল কারখানা। ট্রামগাড়ির চেহারাও পালটে গেল। তখন গাড়ির সামনে এবং পিছনে দুদিকেই দরজা থাকত। মুনাফার সন্ধান পেয়ে ট্রাম কোম্পানি যাত্রীদের সুখ সুবিধার দিকে নজর দিতে শুরু করল। ফার্স্ট ক্লাসে পাখা লাগান হল, বসার জায়গায় লাগান হল গদি। ট্রামের ভাড়া সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই ছিল। তাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে নানা রকম সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা ছিল। দুপুর বেলা, ফাঁকা সময়ে ভাড়া কম লাগত। ছিল ‘ট্রান্সফার টিকিট’ এর ব্যবস্থা। এক জায়গা থেকে ট্রান্সফার টিকিট কিনলে অন্য রুটের ট্রামে চাপলেও আর নতুন করে টিকিট কিনতে হত না। ছিল ‘অল ডে টিকিট’ আর ‘মান্থলি টিকিট’। নামেতেই বোঝা যাচ্ছে, প্রথমটি ছিল সারাদিন ঘোরার জন্য আর দ্বিতীয়টি সারা মাসের জন্য। ট্রামের টিকিট এমনিতেই সস্তা ছিল, ওই টিকিটে আরো ছাড় দেওয়া হত। ‘অল ডে টিকিট’ এর দাম ছিল ৬ আনা। এই সুবিধেগুলি অনেকদিন পর্যন্ত বলবৎ ছিল। কেবল আদিপর্বেই নয়, আজও ট্রামই কোলকাতা শহরের সব থেকে সস্তার পরিবহণ। অল্প খরচে সুখকর পরিষেবা দিয়ে ট্রাম হয়ে উঠেছিল শহরের মানুষের অত্যন্ত প্রিয় যান। দুঃখের কথা, গতির দৌড়ে পিছিয় পড়ে এখন অন্তিম প্রহর গুনছে। পুজোর আগেই হয়ে যাবে বিসর্জন। তবে একেবারে অন্তর্জলী যাত্রা নয় ১৫১ বছরের পুরনো এই যানটিকে রাখা হবে স্মারক হিসাবে। এসপ্ল্যানেড থেকে ময়দান পর্যন্ত চলবে হেরিটেজ ট্রাম। নতুন প্রজন্মের জন্য চলমান ইতিহাস।