আমাদের ছোটোবেলায় ক্যামেরা ছিল না। ক্যামেরার স্বপ্ন ছিল। ছিল ইয়াশিকা ক্যামেরার বিজ্ঞাপন। ৩৩০ টাকা দাম। কতদিন যে নিজস্ব ক্যামেরার স্বপ্ন দেখেছি। ডাকযোগে ৩৩০। মূলদাম ৩০০ টাকা।
১৯৮১ তে প্রথম নিজের ছবি তুলি স্টুডিওয়।
সেহারাবাজারে। তপুদার স্টুডিও। ছয় কপি পাশপোর্ট সাইজ ছবি ১৬ টাকা।
১৬ টাকা তখন এক ভরি রূপার দাম।
১৬ টাকায় ষোলটা ভাতের ফুল মিল পাওয়া যেতো।
একজন খেতমজুরের ষোলো দিনের বেতন।
আর ছিল পত্রবন্ধুর বিজ্ঞাপন। কাগজে।
আমাদের দুই সহপাঠী তাদের ভাবীদের নামে নানাজনকে পত্র বন্ধু বানিয়ে এটা সেটা অনেক উপহার জুটিয়ে ফেলেন।
কাগজে, ত্রিশ টাকা দিলে বইয়ে কবিতা ছাপার বিজ্ঞাপনও বের হতো।
মাঝে কিছুদিন, ১৯৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে অ্যামওয়ে স্টাইলে বড়োদের প্যান্ট পিস বিক্রি চললো। তিনটে বিক্রি করতে পারলে একটা ফ্রি। ৯০ টাকা দিলে চারটে ফুলপ্যান্টের টেরিকট পিস। ওই সময় আমাকে যা টানতো তা যাত্রা থিয়েটারের বিজ্ঞাপন। প্রাচী মিত্রা ছবিঘর, উজ্জ্বলা ...
সিনেমার ওপরে লেখা থাকতো অনন্যা, অজন্তা। ওগুলো যে হলের নাম পরে বুঝেছি। আমি ভাবতাম লেখিকার নাম। ভাবতাম, এই বই তিনজন চারজন লিখেছে? কাউকে জিজ্ঞেস করতেও পারতাম না, লজ্জায়। একটা বিজ্ঞাপন ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। শট গান। পাখি মারার ছররা বন্দুক। ৬০ টাকা দাম। ডাকযোগে পাঠানো হয়।
শোনা গেল, দু একজন ঠকেছে। অন্যজায়গার। শুধু পাইপ এসেছে।
তখন শট গান দিয়ে বিপ্লব করবার স্বপ্ন দেখতাম।
শট গানের অভাব পূরণ করতো গ্রামের মেলার ফট বন্দুক। কালো চশমা আট আনা। আর বন্দুক আট আনা থেকে এক টাকা। টোটার দাম ১০ পয়সা। মাঘ মাসে মেলা। সবার হাতেই পয়সা।
মেলা ও যাত্রা দেখতে আসতো বড়দি,পিসি, মাসি জামাইবাবু, আত্মীয়স্বজনরা। চার আনা, আট আনা, এক টাকা দু টাকা বরাদ্দ। মেলায় পাঁচ টাকা জোটা মানে বিরাট বড়লোক।
১৯৭১-৭২ এর দাম
ঘুগনি ১০ পয়সা।
চপ ৫ পয়সা
বেগুনি ৫ পয়সা
জিলিপি ৫ নয়া
চশমা খুব বেশি হলে এক টাকা।
আংটি চার আনা থেকে শুরু। খুব ভালো হলে দু টাকা। সিনেমার গল্প আর গানের বই চার আনা।
দস্যু মোহন, স্বপনকুমার, গোয়েন্দা দীপক আট আনা। নীল ছবির বই গ্রামের মেলায় কোনোদিন দেখিনি।
তবে জুয়ার আসর বসতো।
আপত্তিও হতো।
মেয়েদের চুড়ি ইত্যাদির দাম বলতে পারবো না। রান্নার সব সরঞ্জাম মিলতো মেলায়।
মিনি শান্তিনিকেতন মেলা। একবার বোধহয় বাইক বিক্রি দেখেছি।
কাঠের নাগরদোলা এলো সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে।
একদিনের মেলা। চলতো তিনদিন।
যাত্রা দু রাত বাঁধা। একবার সাতদিন চলেছিল। যাত্রাভিনেতার ৯৫% মুসলিম। তাঁরাই উদ্যোক্তা। তাঁদের উৎসাহ ওলাইচণ্ডী পূজা ও মেলাকে ঘিরে ষোলো আনা। ঘরে ঘরে কুটুমে ভর্তি।
হইচই আনন্দ।
ছেলে মেয়েরা প্যাঁ পোঁ করে করে বাঁশি বাজাতো।
আর তাদের দায়িত্ব পড়তো যাত্রার আসরে আসন রাখা।
চট/ তালাই/ সতরঞ্জি দিয়ে জায়গা দখল। দৈনিক দৈনিক জায়গা বদল। যাত্রা শুরু হতো অনেক রাতে। অভিনেতারা সব হিরো। মেকাপম্যান খুঁজেই যায়। পায় না। ১০ টায় মেকাপে বসে। ১১টা সাড়ে ১১ টার আগে শুরু হতো না। প্রথম দু চার দৃশ্যের পর চোখ খুলে রাখা কঠিন হতো ছোটোদের। ঐতিহাসিক পালা হলে বলতো, ক্যাঁরিচো ক্যাঁরিচো ক্যাঁ বাজলে তুলে দিও।
ক্যাঁরিচো ক্যাঁরিচো বাজা মানে যুদ্ধের দৃশ্য।
সে ভারি মজা। কেউ হারতে চায় না সহজে।
পরের দিন বাঁশের কঞ্চি বা বাঁশের তলোয়ার নিয়ে ছোটোরা এক একটা অভিনেতা সেজে পার্ট করতো।
আমাদের এক বন্ধু ছিল, সে ভিলেনের অভিনয় খুব পছন্দ করতো। বলতো, ও আমার মেট। মেট মানে তাঁর ভাষায় বন্ধু। আট বছরের ছেলের ১৮ বছরের বন্ধু।
আমার পিসি ছিলেন সায়রা বানুর মতো দেখতে। বাবার সৎ বোন। কিন্তু আমরা বহুকাল তা জানতাম না। ভাইবোনে এতো ভাব দেখা যায় না। আমার মা অন্ত প্রাণ ছিল পিসি। দুজনে খুব ভাব।
পিসি কেঁদে ভাসিয়ে দিতো।
বাবা মূলত ভিলেনের অভিনয় করতেন।
মেয়েদের অত্যাচারের দৃশ্য এলে পিসি মুখ চাপা দিয়ে বলতেন, ভাই এ-রকম করো না। এ-রকম করো না।
পরের দিন সকালে উঠে ভাইকে বলতো বোন, ভাই আর ভিলেন করো না তুমি। খারাপ লাগে। এতো ভালো লোক তুমি। ভালো লোকের পার্ট নিতে পারো না।
বাবা বলতেন, ভালো লোক না হলে ভিলেন করা কঠিন।
মেলোড্রামা হয়ে যাবে। অভিনয় হবে না।
অমিত বিশ্বাসদার সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি বললেন, যতদূর জানি, আগে চৌষট্টি পয়সায় এক টাকা হতো। চার পয়সায় এক আনা। ষোল আনায় এক টাকা। এরপর ১০০ পয়সায় এক টাকা করা হয়। সে পয়সায় লেখা থাকতো নয়া পয়সা বা . এনপি।
মানুষ তখনো আনা- র হিসেবে আটকে ছিলো বলে, ছ পয়সায় এক আনা নিজেরাই ঠিক করে নেয়।
সরকারি হিসেবে ২৫ নয়া পয়সায় চার আনা আর ৫০ নয়া পয়সায় আট আনা।
এখন চার আনায় এই যে এক পয়সা বাড়তি, তা নিয়ে সমস্যা ও মজা হতো। একটা চপ বা পিঁয়াজি চার পয়সা। এবার চার আনায় ছ টা। ঐ এক পয়সা নিয়ে ঝামেলা!! দোকানদার ফেরত দিতে চায় না, খদ্দের ফেরত নেবেই।
তামার এক পয়সা অচল। সরকার দস্তার চৌকো এক নয়া পয়সা বার করলো। আর ফুল কাটা দু নয়া পয়সা। তাদের বড় সংস্করণ পাঁচ নয়া পয়সা ও দশ নয়া পয়সা। ওই সময়ে পুরোনো লোকেদের এই নয়া পয়সার হিসেব বোঝাতে হিমসিম খেতে হতো। একই সমস্যা হয়েছিল, সের ও কেজির ক্ষেত্রে, পোয়া ও লিটারের ক্ষেত্রে।
লুজ তেল বিক্রি হতো বেশি। বোতলের তেলে বিশ্বাস ছিল না মানুষের। বহুদিন যাবৎ কেজি র ওজনেই তেল বিক্রি হতে দেখেছি। কেরোসিন বরাবর লিটারের মাপেই কেনা হতো। এটা কলকাতার বেহালা অঞ্চলের ঘটনা।
এই বেহালাতেই আশির দশকের শুরুর দিকে বিষ তেল কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে।
বহু মানুষ পঙ্গু হয়ে যান।