রাবণের নাম রাবণ হল কেন? মহাভারতের বনপর্বে ষটসপ্ত্যধিকদ্বিশততম অধ্যায়ের ৪০ তম শ্লোকে বলা হয়েছে:
রাবয়ামাস লোকান যৎ তস্মাদ্ রাবণ উচ্চতে।
দশগ্রীব কামাল দেবানাং ভয়মাদধ্যৎ।।
ইচ্ছানুসারে শক্তিবর্ধন করতে সমর্থ দশানন সমস্ত লোককে রোদন করিয়েছিল, এজন্য তার নাম হল রাবণ। সে (রাবণ) দেবতাগণের ভয়ের কারণ হল।
আমাদের মনুবাদ প্রভাবিত সমাজে সবকিছু খারাপকেই অসুর বলে গাল দেওয়ার রীতি।
অথচ অসুররা যথেষ্ট উন্নত জাতি।
অসুররা লৌহ উৎপাদন করতে জানতেন। সভ্যতার দিশারী তাঁরা। 'মহাভারতে' ঝকঝকে চকচকে চোখ ধাঁধানো ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি করেন ময়দানব। শল্যচিকিৎসা করতে জানতেন অসুররা। এইজন্য অস্ত্রোপচার পদ্ধতিকে আসুরিক চিকিৎসা বলা হয়। সুর ও অসুর একই বংশধারা। সুররা চালাক। অসুররা সরল। সহজেই বিশ্বাস করেন। তাই সমুদ্র মন্থন করে সুরা, অমৃত এবং লক্ষ্মী নিলেন সুররা। যদিও কথা ছিল অসুররা সমান অংশ ও অধিকার পাবেন।
অসুররা এদেশে বিজিত। ইরানে বিজয়ী।
দাস মানে ছিল যেমন আদিতে দাতা।
এখন দাস মানে চাকর। যাই হোক, আজকাল সংবাদমাধ্যমে বৃষ্টিকে অসুর বলা হচ্ছে।
একবার ডাক্তারদের অসুর বলায় মহম্মদ আলি পার্কের পূজা কমিটির ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ডাক্তাররা।
এবার তো এক অসুরের দাড়ি রেখে মুসলমান সাজানো হয়েছে। (বোঝা যাচ্ছে, অমৃতকালে শুধু একজনের দাড়িই নিরাপদ)
বছর দুয়েক আগে গান্ধিজিকে অসুর সাজানো হয়েছিল।
বৃষ্টি গত মঙ্গলবার ২৩ সেপ্টেম্বর কলকাতাবাসীদের কাঁদিয়ে ছেড়েছিল।
রাবণ নামের অর্থ জানলে লোকে বৃষ্টিকে রাবণ বলেই ডাকতো।
একটাই সমস্যা আমাদের পড়াশোনা বড়ই কম। শিশুপাঠ্য কাহিনিতে থাকি মুখ শুধু নয় মন মনন চিন্তা ঢাকি।
তাই অনাসৃষ্টির লোকরা লোকলজ্জাহীনভাবে ঢাক বাজায় সংসদীয় খাল বিলে।
২৬ সেপ্টেম্বর 'আজকাল' দৈনিকে আমার প্রিয় স্যার, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ছেলে কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তী বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ এলাকায় জল জমা নিয়ে একটা বড় লেখা লিখেছেন ।
একাধিকবার নৌকা চড়ার কথাও লিখেছেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি লিখেছেন, এক পংক্তির আশ্রয়ে।
১৯৬৫তে ভিআইপি রোড নির্মাণের আগে বাঙ্গুরে কোনওদিন জল জমতো না।
জল জমা যত না বৃষ্টির জন্য তার চেয়ে বেশি তথাকথিত কুপরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য।
১৯৭৮ ছাড়া আমাদের গ্রামে কখনও জল জমতে দেখিনি।
গ্রামের নিকাশি ছিল পূর্ব দিকে।
এখন পূর্ব দিকে গ্রাম বাড়ছে। জলও জমছে অল্প স্বল্প।
বর্ধমান শহর ছিল স্বাস্থ্য কেন্দ্র।
গিরিডি মধুপুর শিমুলতলার আগে কলকাতার লোকে স্বাস্থ্য উদ্ধারে বর্ধমান বা দার্জিলিং যেতেন।
বিদ্যাসাগরের এক পয়সা দু পয়সা দিয়ে ফুল কেনার গল্প বর্ধমান শহরের।
বর্ধমান শহরে ছিল তাঁর বাসভবন। প্রথমে ঢলদিঘি পরে সদ্যপ্রয়াত বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরের দাদু আবুল কাশিমের দেওয়া জায়গায়।
ভারতের প্রথম বৃদ্ধাশ্রম গড়েন বিদ্যাসাগর । বর্ধমান শহরের পার্কাস রোডে। একথা আমাকে একাধিকবার বলেছেন বদরুদ্দীন উমর। দেখিয়েছেনও জায়গাটা। সেটা তখন এফ সি আইয়ের গুদামঘর। এখন? বোধহয় রাজনৈতিক দলের লাল দপ্তর।
বর্ধমান শহর স্বাস্থ্য উদ্ধারের শহর ছিল। বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এই শহরে এসেছেন স্বাস্থ্য ভালো করবার আশায়। স্বাস্থ্য শহর থেকে মশা মাছি ধানের শহর কবে হল বর্ধমান?
দিনক্ষণ লেখা নেই।
তবে হল, একদিকে সিপাহি মহাবিদ্রোহ দমনের জন্য ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে সেনা শিবির অন্যদিকে রেল লাইন নির্মাণের জন্য কৃষি জমি দখল করে মাটি উঁচু রেলপথ নির্মাণ।
জল নিকাশীর সহজ বন্দোবস্ত গেল ধ্বংস হয়ে।
ম্যালেরিয়া এল।
পথের পাঁচালী-র ইন্দির ঠাকরুণের দল বেঘোরে মরতে লাগলেন। জল নিকাশী ব্যবস্থা গড়ে না তোলায়।
আর তারপর তো এল সর্বনাশা নদীবাঁধ প্রকল্প।
একটার পর একটা।
নদীতে বাঁধ দেওয়ার বিরোধিতা নিয়েই বুদ্ধদেবের গৃহত্যাগ। বলা ভালো তাঁকে দেশত্যাগী হতে বাধ্য করা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মুক্তধারা' নাটকে এই ঘটনার কিছুটা ছাপ আছে। অন্যভাবে।
বুদ্ধদেবের ঘটনাটি একটু বলা যাক!
কত অসম্পূর্ণ শিক্ষা আমাদের।
যদি আমাদের বিদ্যালয় স্তরে এইসব সত্য কথা পড়ানো হতো।
বুদ্ধদেব তথা শাক্যরাজপুত্র সিদ্ধার্থকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। কারণ তিনি ছিলেন নদীর জলের সমবণ্টনের পক্ষে, গায়ের জোরে নদীর জল আটকে কেবল নিজেরা ভোগ করার বিরুদ্ধে।
রোহিণী নদীর জল ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্ব বাধে দুই গণ সম্প্রদায় শাক্য এবং কৌলিয়দের।
নদীর জল কমে এলে দুই সম্প্রদায়ের নারী বা কৃষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধে যেত। প্রসঙ্গত, সিদ্ধার্থের শাক্য বংশের রীতি অনুযায়ী সকলকেই একদিন চাষে অংশ নিতে হতো।
সিদ্ধার্থের ২৫ বছর বয়সে এই দ্বন্দ্বে শাক্যদের সভায় সিদ্ধান্ত হল, আর কৌলিয়দের জলের অধিকার নয়।
সিদ্ধার্থের মত হল ভিন্ন। তিনি দু পক্ষের দুজন করে এবং সভা থেকে আরেকজনকে নিয়ে বিরোধ মেটাতে বললেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠরা প্রত্যাখ্যান করল তাঁর মত। সেকালের শাক্য প্রথা অনুযায়ী বিরোধীকে দেওয়া হত তিন শাস্তি।
ফাঁসি, পরিবারের সম্পত্তি নিলাম অথবা নির্বাসন।
সেকালে ছিল অধিকার। নিজের শাস্তি বেছে নেওয়ার।
তিনি বেছে নেন নির্বাসন।
নিজের মতবাদ প্রকাশ করার স্বাধীনতা নিয়ে।
তিনিই প্রথম অনাগরিক।
বিশ্বনাগরিক।
আমাদেরও সেই পথ নেওয়া উচিত।
এবার কথা বলা যাক, আমাদের ছোটবেলা ও এখনকার জীবন্ত সমস্যা নিয়ে।
আমরা দামোদর এলাকার মানুষ। একটু সঠিকভাবে বললে, দক্ষিণ দামোদর এলাকার বাসিন্দা। এই এলাকায় বন্যা ছিল অভিশাপ। যদিও আমাদের গ্রামে বঙ্গাব্দ ১৩২০ বা সাধারণ শতক ১৯১৩ ছাড়া বন্যা সেভাবে দেখেনি। ১৯৭৮ এর বন্যাতেও গ্রামে কারও মাটির বাড়ি বা কুঁড়েঘর ভেঙে পড়েনি। যদিও সাতদিন ধান জমি জলে ডুবে ছিল।
তবে ১৯১৭-য় আগস্ট মাসে ডিভিসির ছাড়া জলে গ্রামের মধ্য দিয়েও জলের স্রোত বয়ে যায়।
এবার ২০২৫ এর তেসরা অক্টোবর ৬৫০০০ কিউসেক জল ছেড়েছে। কী হবে বোঝা যাচ্ছে না। তবে বীরভূম বর্ধমান হুগলি হাওড়া মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা বিভিন্ন নদীবাঁধ থেকে জল ছাড়ার ফলে ডুবে যাবে। ২০১৭ এবং ২০২৪ এ বন্যাত্রাণে হাওড়া হুগলি মেদিনীপুর গিয়ে দেখেছি মানুষের কী চরম দুর্দশা। মাসখানেক ধরে জল জমেছিল। ১৯৪৮ এ প্রতিষ্ঠিত
ডিভিসি বা দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের আওতায় মাইথনে বাঁধ নির্মাণ ভারতের প্রথম নদীবাঁধ প্রকল্প।
হাজার হাজার মানুষ গৃহ ছাড়া হন।
যে মহিলা নদীবাঁধ প্রকল্পের উদ্বোধন করতে আসা জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়েছিলেন তাঁকে সাঁওতাল সমাজ জাতিচ্যুত করে। তাঁর বিয়ে হয়নি।
নদীবাঁধ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল সেচ, জলবিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নৌচলাচল এবং জল সরবরাহ।
কিন্তু কার্যত কী হয়েছে?
চাষের খানিকটা সুবিধা হয়েছে। দামোদরকে বলা হতো 'দুঃখের নদী'। বন্যার জন্য। কিন্তু বন্যার জলের পলিতে বর্ধমান ছিল ভারতের সবচেয়ে উন্নত কৃষি জেলা। ভারতের শস্য ভাণ্ডার বলা হতো।
এখন বন্যা হয়। ডিভিসির ছাড়া জলে। মানুষ মরে। ধান সব্জি শস্য পচে। মাটির উর্বরতা কিন্তু বাড়ছে না। সার দিয়ে দিয়ে জমির সর্বনাশ করা হচ্ছে।
বর্ধমান শহর যেতে পেরোতে হতো দামোদর। ১৯৭৭ র আগে সারা বছর ছিল নৌকা ভরসা। কংগ্রেসের পূর্তমন্ত্রী ভোলা সেন এবং রায়নার গান্ধীবাদী এবং পরে দলত্যাগী দাশরথি তায়ের উদ্যোগে দামোদর নদের ওপর কৃষক সেতু গড়ে ওঠায় নৌকার গুরুত্ব আর নেই।
এবং ছোটবেলায় দেখা ভয়াবহ জল ভরা দামোদর এখন শুখা থাকে বছরের ১১ মাস। চড়া পড়ছে। কাশ ফুল দেখে শহুরে মন খুশি হতে পারে, কৃষকরা পারেন না।
আমেরিকার টেনেসি নদী প্রকল্পের আদলে তৈরি দামোদর উপত্যকা প্রকল্প এখন খানিকটা অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছোটবেলায় আমরা বলতাম, ডিভিসি মানে ডোবানো ভাসানো চোরপোরেশন। ডিভিসির জল ছাড়া বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে কেন্দ্র সরকারের লড়াই চলতো।
এখন আবার শুরু হয়েছে। ২০০০ এর বন্যাকে এক বিরোধী নেত্রী বলেছিলেন ম্যানমেড। এখনও বিরোধী নেতা তাই বলেন। পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা এই, রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে রাজ্যের জনগণের সমস্যা নিয়ে সরকার বিরোধী কোনও দিন এক হয়ে কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে লড়েনি।
কোনও দিন লড়বে কি?
বাঙালির অনেক গুণের মধ্যে চরম দোষ --এই কুচুটে স্বভাব -- কি আর কোনও জাতির আছে? যদি কেউ জানান।
রাবণ, সব লোককে কাঁদিয়েছিলেন! এখন কে কাঁদায়?