

দাঁত মাজা…
আজ্ঞে হ্যাঁ, দাঁত মাজার সূত্রে বিষয়টা কেমন করে জানি শুরু হয়ে গেল।
একটু খোলসা করে বলি। খাতার শেষ পাতা খরচ হওয়ার আগে নতুন খাতা পাওয়ার কোনো নিয়ম বাড়িতে ছিল না। স্কুলের সোয়েটার ছোট হতে হতে যতদিন না বোতাম ছেঁড়ার উপক্রম হয়েছে, তদ্দিন নতুন সোয়েটার কেনার কথা উচ্চারিত হয়নি। এসব নিয়ে কোনোদিন কিছু মনেও হয়নি। কিন্তু সমস্যা ছিল মাজনের টিউব নিয়ে। টিউবকে যথাসাধ্য টিপেটুপে একেবারে শেষ অব্দি মাজন নিংড়ে নেওয়ার যে মধ্যবিত্ত যাপন, তা নিয়ে মায়ের বিরুদ্ধে ছোটবেলায় আমার বিস্তর অভিযোগ ছিল। কিন্তু যখন আমি নিজে মায়ের জায়গায় পৌঁছলাম, দেখা গেল, আমিও সেই মধ্যবিত্ত যাপনকেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলাম; যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ ছিল, তাকেই আপন করে নিলাম।
এবারে অবশ্য বিষয়টা আরেকটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছিল; শেষতম মাজনের ফোঁটাও তখন নিঃশেষিত। তখন বাধ্য হয়ে প্রাচীন সময়ে ফিরতে হল, তেল-নুনের আশ্রয়ে। আমার পুত্র রোদ্দুরকে তখন বোঝাতে হল, তেল-নুন, পেয়ারা গাছের ডাল বা নিমের দাঁতন এসব যথেষ্ট ভালো জিনিস। এসব সত্যিই ভালো, প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ এসবের কথা বলেছে। কিন্তু এসব কি আমাদের চলতি দাঁতের মাজনের চেয়েও ভালো? এসব কি সব সমস্যার সমাধান করে? সেসবের জন্য উত্তর অবশ্যই ‘না’।
শুরুটা দাঁত মাজা দিয়ে হলেও, ভাবনায় ভর করে হুস করে চলে গেল বহুদূর। কথায় বলে না, মনের বেগ আলোর চেয়েও বেশি! মনে হল, কেবল আয়ুর্বেদ তো নয়, প্রাচীনকাল সংক্রান্ত অনেক প্রচলিত ধারণাকেই যে আমাদের প্রশ্ন করা দরকার, ঠিক না ভুল, সেসব নিয়ে চর্চা দরকার! অন্ধকার না পেরোলে যেমন আলোয় পৌঁছনো যায় না, তেমনই চর্চা না করে কোনোকিছুকে গ্রহণ করা বা অস্বীকার করাও ঠিক নয় মোটেই।
একটা গল্প দিয়ে বিষয়টা বোঝানো যাক। পুরাণের গল্প। রাজা দক্ষের ২৭ কন্যার গল্প। কন্যারা বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠলে তাদের সঙ্গে বিবাহের কথা বলতে গিয়ে দক্ষ পড়লেন মহা ফাঁপরে। কারণ এই ২৭ জনের প্রত্যেকেই মনে মনে চাঁদকে ভালোবাসেন। তা কন্যাদের তেমন দোষ দেওয়াও যায় না। অন্ধকার আকাশের প্রেক্ষাপটে চাঁদ দেখতে কার না ভালো লাগে! অগত্যা তেমনই বিবাহের ব্যবস্থা হল। এরপরেই সমস্যার সূত্রপাত। চাঁদ কেবল রোহিণীর সঙ্গেই থাকেন, বাকিদের কাছে মোটেই যান না। কন্যারা দক্ষের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানালেন। সব শুনে চাঁদকে তলব করলেন দক্ষ। চাঁদ ব্যাপারটা অস্বীকার করলেন না। অতঃপর দক্ষ অভিশাপ দিলেন, চাঁদের সুন্দর দেহ ক্ষয়রোগ প্রাপ্ত হয়ে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে। তাই হল। চাঁদ ভয় পেলেন। ক্ষমা চাইলেন দক্ষের কাছে। দক্ষ বললেন, তার অভিশাপ মিথ্যা হবে না। তবে হ্যাঁ, চাঁদ ক্ষমা চেয়েছেন যখন, তিনি বিষয়টা পুনর্বিবেচনা করে বিধান দেবেন। অনেক ভেবেচিন্তে দক্ষ জানালেন, এই ২৭ কন্যার প্রত্যেককেই চাঁদকে সময় দিতে হবে। রোজ একেকজনের কাছে যেতে হবে চাঁদকে। এই অনুযায়ী চললে, চাঁদের দেহ ক্ষয় পেতে পেতে ফুরিয়ে যাবে, ঠিকই, কিন্তু পরবর্তী সময়ে আবার একটু একটু করে বেড়ে উঠবে; নব কলেবর ফিরে পাবেন চাঁদ।
এবার আকাশে চাঁদের চালচলনের বিষয়টা বিজ্ঞানের ভাষায় দেখে নেওয়া যাক। আকাশ পরিক্রমা করতে করতে এক নক্ষত্র থেকে শুরু করে আবার সেই নক্ষত্রে ফিরতে চাঁদের সময় লাগে মোটামুটি ২৭ দিন; অনুপুঙ্খ বিচারে ২৭১/৩ দিন (৩-এর গুণিতক নয় এমন কোনোকিছুকে ৩ দিয়ে ভাগ করা খুবই জটিল বিষয়, সে কথা অন্য কোথাও বলা যাবেখন)। এক নক্ষত্র থেকে শুরু করা, সেই নক্ষত্রে ফেরা, এর কোনোটাই আক্ষরিক অর্থে নয়। কারণ আমরা তো জানিই, চাঁদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রটি আমাদের আদরের সুয্যিমামা, যার চারপাশে চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের ধরিত্রী এবং নিজের নিজের চাঁদ নিয়ে সৌরপরিবারের অন্য সব গ্রহেরা বনবন করে ঘুরে চলেছে। বাকি সব, সব নক্ষত্রগুলি চাঁদের থেকে বহু বহু দূরে। তাই চাঁদের এ নক্ষত্রে শুরু করা, ও নক্ষত্রে ফেরা ব্যাপারটা আসলে পৃথিবীর ওপর থেকে আমরা রাতের আকাশকে কীভাবে দেখছি, তার উপর নির্ভর করছে। কোনো নক্ষত্র চাঁদের কাছে দেখতে পাওয়াকেই চাঁদের ওই নক্ষত্র বা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে থাকা বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেক দিন চাঁদ একটি করে বিশেষ নক্ষত্র বা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে অবস্থান করে, এদের নাম অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা এরকম; এবং তার সঙ্গে অবশ্যই রোহিণী। অর্থাৎ অন্য সকলের মত রোহিণী নক্ষত্রের কাছেও চাঁদ ২৭ দিন পরপর আসে। গল্পটির সঙ্গে কী চমৎকার মিল! আসলে এই যে ২৭ দিনের বিষয়টা বা এক নক্ষত্র থেকে আরেক নক্ষত্রে যাওয়ার বিষয়টা, এগুলো কোনো জটিলতায় না গিয়ে কত সহজে একটা গল্প দিয়ে আমাদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হল! কারণ, এই যে পুরাণের গল্প, তাতে আমরা অনেক বেশি রোমাঞ্চিত হই, তাই চট করে মনেও রাখতে পারি।

এখানেই আমাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে। সতর্কতা মানে, যা হয় না, সেরকম কোনো গল্প বা পুরাণকথা শুনলে, আমাদের তার সঙ্গে এখনও অব্দি বিজ্ঞান যা তথ্য পেয়েছে, তা মিলিয়ে দেখতে হবে, বুঝতে হবে; তারপর গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে। যেমন ধরুন, আমাদের কাছে এখন ঘড়ি আছে, একটু ভালো ঘড়িতে আমরা সেকেণ্ডের ভগ্নাংশ বা fraction দেখতে পারি। শুধু এই! জানেন কি, কত ছোট সময় মাপা গেছে এখনও অব্দি? ২৪৭ যেপ্টোসেকেণ্ড (zeptosecond)। কতটা ছোট এই যেপ্টোসেকেণ্ড? ১-এর পিঠে ২১ টা শূন্য বসালে যে সংখ্যাটা হয়, ১ সেকেণ্ডের তত ভাগের ১ ভাগ। আলোর কণা এই ২৪৭ যেপ্টোসেকেণ্ডে একটা হাইড্রোজেন অণুকে পেরোতে পারে। এটা এখন পরিমাপযোগ্য। ভাবতে পারেন! প্রাচীনকালে যখন ঘন্টা, মিনিট, সেকেণ্ডের ধারণা নেই, সেসময় আকাশে চাঁদকে দেখেই, বিভিন্ন নক্ষত্রের গতিবিধি দেখেই সময় নির্ধারণ করা হত। সে মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সেটাই আধুনিক বিজ্ঞান। কিন্তু আজকেও যদি আমরা সেভাবে সময় নির্ধারণের উপর নির্ভর করি, তবে আমাদের এগোনোর পথে অন্ধকার, এ বিষয়টা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পুরাণের গল্প শুনব নিশ্চয়ই, গল্প শুনে রোমাঞ্চিত হব এও স্বাভাবিক, কিন্তু এ গল্পের চেয়ে বিজ্ঞান আসলে ঢের বেশি রোম্যান্টিক। হয়ত সেসব তথ্য সহজ গল্প হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছয় না, হয়ত যেভাবে পৌঁছয় তা সাধারণের কাছে কঠিন।
আবার সেই ২৭ দিনের বিষয়েই একটু এগোনো যাক। এই যে আমাদের বাংলার বিভিন্ন মাসের নাম, সেগুলো কোত্থেকে এল! আশ্বিন মাস পেরোলো, তাই আশ্বিন দিয়েই শুরু করা যাক। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় চাঁদ অশ্বিনী নক্ষত্রের কাছে থাকে; কাছে থাকার মানে, আগেই বলেছি, চাঁদের কাছাকাছি অশ্বিনী নক্ষত্রকে দেখা যায়। কার্তিক পূর্ণিমায় চাঁদ থাকে কৃত্তিকার কাছে। এবারে বাকি কোন পূর্ণিমায় কোন নক্ষত্রে থাকে বললেই বোঝা যাবে মাসের নাম। এরা হল পুষ্যা, মঘা, পূর্ব ফল্গুনী ও উত্তর ফল্গুনী, চিত্রা, বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, পূর্বভাদ্রপদ ও উত্তরভাদ্রপদ। অগ্রহায়ণের নক্ষত্র খুঁজে পেলেন না? না, সেই প্রিয়তমা রোহিণীর কাছে অগ্রহায়ণ পূর্ণিমায় আসা চাঁদের কপালে নাই। অগ্রহায়ণ পূর্ণিমার নক্ষত্রের নাম মৃগশিরা। নামের সঙ্গে মাসের নামের মিল নেই তো? আসলে মাসের নাম মার্গশীর্ষ। এবার মিল পেলেন? আগে এই মাস থেকে বছর শুরু ধরা হত, অগ্র (আগে) হায়ণ (বছর) থেকে অগ্রহায়ণ বা অঘ্রাণ।
আবার ২৭ নক্ষত্রে ফেরা যাক। আগেই বললাম ২৭ নক্ষত্রের প্রত্যেকের কাছে একদিন করে দেখা যায় চাঁদকে। তাই একজনকে ভিসিট দিয়ে তাকে নেক্সট ভিসিট দিতে ২৭ দিন পেরিয়ে যায়। এর সঙ্গে আরেকটা বিষয় হল পূর্ণিমার দিনটা, যেটা কিনা প্রায় সাড়ে ২৯ দিন পরপর আসে। এমনিতে আমরা তো জানি, যে পূর্ণিমার দিন, সূর্য পৃথিবীর যে দিকে থাকে, চাঁদ ঠিক তার উলটো দিকে। না, এক রেখায় নয়, এক রেখায় এলে তো আবার চন্দ্রগ্রহণ হয়ে যেত; সে তো কালেভদ্রে ঘটে। কিন্তু পৃথিবীর যেদিকে সূর্য, তার উল্টোদিকে চাঁদ। তাই তো চাঁদের একপিঠের প্রায় ৯৯.৯% অংশে আলো পড়ে। তো এই পূর্ণিমায় কোন নক্ষত্রকে ভিসিট করা হল, সেটা জরুরি, কারণ তাকে দিয়েই মাসের নাম। এরপরের বিষয়টা আরো রোমাঞ্চকর। এই যে ২৭ দিন পরপর অশ্বিনীর কাছে বা কৃত্তিকার কাছে ফিরে আসা, ততক্ষণে পৃথিবী কিন্তু তার কক্ষপথে ২৭° এগিয়ে গেছে। কেন? কারণ পৃথিবী তো সূর্যের চারপাশে একটা কক্ষপথে ঘুরছে। এই পুরো কক্ষপথ মানে মোট ৩৬০° ঘোরা। এটা পৃথিবী করে ৩৬৫ দিনে। প্রতিদিন তাই প্রায় ১° করে এগোয় পৃথিবী, ২৭ দিনে ২৭°। পৃথিবী যেহেতু এগিয়ে গেল, তাই চাঁদ আর সূর্য পৃথিবীর ঠিক দুই পাশে হওয়াটা সম্ভব নয়। তাই সেদিন আর পূর্ণিমা হবে না। পূর্ণিমা হতে আরো দিনদুয়েক লাগবে। ততক্ষণে চাঁদ চলে যাবে অন্য নক্ষত্রের কাছাকাছি। তাই চাঁদের কলেবর বৃদ্ধি এবং হ্রাস কিন্তু মোট ২৯১/২ দিনের মামলা। কলেবর হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টা পুরোপুরি ঘটতে সময় লাগে সাড়ে ২৯ দিন, মানে প্রায় ৩০ দিন, যা কিনা এক চান্দ্রমাস।
তবে, ২৭-এর এখানেই শেষ নয়। বাকি ২৭-এর কথা, চাঁদের কলেবর হ্রাস-বৃদ্ধির সময় চাঁদের আকারের পরিবর্তন এবং আরো অনেক বিষয় নিয়ে, গল্প নিয়ে আসব আবার। সেই সূত্রে দেখে নেব বিজ্ঞান ও না-বিজ্ঞানকে। দেখে নেব, বিজ্ঞান যে পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি, সে পর্যন্ত পৌঁছনোর আকাঙ্খায় কেমন করে তৈরি হল কল্পবিজ্ঞানের গল্প বা কখনো বিজ্ঞানের কথা সাধারণকে বোঝানোর গল্প। তবে সবক্ষেত্রেই তার উদ্দেশ্য আসলে বিজ্ঞানকে ছুঁতে চাওয়া, এই ছুঁতে চাওয়া যেন কবিগুরুর ভাষায় ‘অতি ইচ্ছার সঙ্কট’ বা ‘আধা ইচ্ছার সঙ্কট’ না হয়, তা দেখার দায়িত্ব আমাদেরই।
. | ১৫ নভেম্বর ২০২৫ ১৩:৪৭735783