

ছবি: রমিত
বিদেশী রবীন্দ্রপ্রেমী
হোসে প্যাস রদ্রিগেস José Paz Rodríguez (স্পেন)
টেগোর সেন্টারে থাকাকালীন আমি অনেক বিদেশী অভারতীয় রবীন্দ্র পণ্ডিত, বিশেষজ্ঞ, উৎসাহী, ভক্ত, অনুরক্ত মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। কিন্তু হোসে প্যাস রদ্রিগেস-র মত এমন বিদেশী রবীন্দ্র-‘পাগল’ আমি দেখিনি। ইনি এক রবীন্দ্র-নিবেদিত প্রাণ। হোসে প্যাসের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ২০০০ সালে টেগোর সেন্টার আয়োজিত এক ‘সিম্পোসিয়াম’ সভায়। হোসে প্যাস আমাদের অতিথি ছিলেন। প্রায় দুদিন বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গ পেয়েছিলাম আমি।

হোসে প্যাস রদ্রিগেস (José Paz Rodríguez)
হোসে প্যাস রদ্রিগেস স্পেনের গ্যালিসিয়া অঞ্চলবাসী। সেখানে সান্তিয়াগোর নিকটে ওরেনসে (Ourense) শহরে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন, প্রথমে স্কুলে এবং পরে ইউনিভার্সিটিতে। তিনি বললেন, ১৯৬১ সালে যখন পৃথিবী জুড়ে রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছিল তখন রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। স্প্যানিশও বাদ পড়েনি। তিনি বলে চললেন, “সেই সময় (by chance) হঠাৎ আমি রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি বই পড়ি। সেই লেখাগুলি আমাকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করে। যতদূর মনে পড়ছে আমি রবীন্দ্রনাথের প্রথম যে বইটা পড়ি তার নাম The Wreck (নৌকাডুবি)। পড়ে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। So far, it is, in my opinion, the most beautiful novel I have ever read. (আমার মতে, আমি আজ পর্যন্ত যত বই পড়েছি তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে সুন্দর উপন্যাস।)”
তিনি জেনোবিয়া কাম্প্রুবির (Zenobia Camprubi) নৌকাডুবির অনুবাদ পড়েছিলেন। স্প্যানিশ ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলীর বহু অংশ অনূদিত হয়েছে। অনুবাদকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি নাম জেনোবিয়া কাম্প্রুবি ও হুয়ান রেমন হিমেনেস (Juan Ramon Jimenez)।
অধিবেশনে তাঁর বক্তৃতায় তিনি বলেন :
“ In 1963 I started what would become, all through these years, an important private collection of Tagore’s works. Today I am honoured to own one of the best collection of Tagore’s works in Europe with books written by and about him in all languages. A collection done with utmost affection and pleasure thought out all these years, more than thirty-five. At the same time, I managed to study in depth this great, remarkable, world-known thinker whose ideas are yet to be comprehended to the full. The success achieved by my students when they staged The Post Office (July 1969 and December 1971) still echoes in my mind. Because of my admiration of many of Tagore’s ideas, I consider myself a wholehearted Tagorean. Along with Jesus, Tagore is for me the best and the greatest educator in history. Surprisingly, this role is hardly mentioned in books dealing with the history of education. A gap which, as far as I know, has not been filled yet.”
“ ১৯৬৩ সালে আমি একটি কাজ শুরু করি যা এতদিন পরে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির এক মূল্যবান ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা হয়ে উঠে। আজ আমি নিজেকে আদৃত মনে করি যে আমি ইউরোপের একটি উৎকৃষ্ট রবীন্দ্র সংগ্রহশালার অধিকারী যেখানে রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সৃষ্টি এবং সকল ভাষায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত যত বই লেখা হয়েছে সব আছে। এই সংগ্রহশালা গত পঁয়ত্রিশ বছরেরো বেশী সময় ধরে অতি যত্ন সহকারে ও আনন্দের সঙ্গে তৈরি করা হয়েছে। এবং এই একই সময়ে আমি গভীরভাবে এই মহান, অসাধারণ, বিশ্ব-বিদিত চিন্তকের সৃষ্টি অধ্যয়ন করেছি, যাঁর চিন্তাধারা এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণ অনুধাবন করা যায় নি। আমার ছাত্রদের ‘দ্য পোস্ট অফিস’ প্রযোজনা করার সাফল্য (জুলাই ১৯৬৯ ও ডিসেম্বর ১৯৭১) এখনো আমার হৃদয়ে অনুরণিত হচ্ছে। যেহেতু রবীন্দ্রনাথের বহু আদর্শকে আমি শ্রদ্ধা করি আমি তাই নিজেকে একজন আন্তরিক ‘টেগোরিয়ান’ বলে মনে করি। আমার মতে যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে টেগোরও সর্বকালের সেরা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। আশ্চর্যের বিষয় যে তাঁর এই কীর্তি শিক্ষার-ইতিহাস সংক্রান্ত বইতে কদাচিৎ উল্লিখিত হয়। আমি যতদূর জানি এই শূণ্যস্থান এখনো পূর্ণ হয় নি। “
তিনি বললেন স্পেনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক গভীর ও নিবিড়। জেনোবিয়া কাম্প্রুবি (Zenobia Camprubi) ও হুয়ান রেমন হিমেনেস (Juan Ramon Jimenez)-র অনুবাদ স্পেনকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। কবির সঙ্গে এই দম্পতির ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। হোসে প্যাস যখন তাঁর পি এইচ ডির জন্য গবেষণা করছিলেন তখন তিনি অনেক চিঠি পত্র, অনুবাদ ও পাণ্ডুলিপি দেখেছিলেন। হুয়ান রেমন নিজে বিশদ পরিকল্পনা ও কার্যক্রম তৈরি করেছিলেন ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে কবির স্পেন ভ্রমণের জন্য। দুঃখের বিষয় সেই ভ্রমণ শেষ পর্যন্ত কার্যকরী হয়নি। তিনি বললেন ইউরোপে স্পেনই বুঝি একমাত্র দেশ যেখানে স্পেনের মানুষ প্রজন্মের পর প্রজম্ন যতিহীন ভাবে রবীন্দ্র চর্চা করে গেছে। কাম্প্রুবি ও হুয়ান রেমনের রবীন্দ্র অনুবাদ মাদ্রিদ তথা স্পেনের বহু স্কুল লাইব্রেরী ও পাবলিক লাইব্রেরীতে রাখা হত। এখানে মনে রাখা দরকার যে কাম্প্রুবি ও হুয়ান রেমনের রবীন্দ্র অনুবাদ স্পেনের “ Generation of 1927” (১৯২৭-র প্রজন্ম)-র বুদ্ধিজীবীদের উপর এক বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। এদের মধ্যে আছেন রাফায়েল আলবের্টি (Rafael Alberti), ফ্রেদেরিকো গারসিয়া লোরকা (Frederico Garcia Lorca), ভিসেন্তে আলেক্সান্দ্রে (Vicente Aleixandre – 1977 Nobel Prize); এবং লাতিন আমেরিকান নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল ও পাবলো নেরুদা (Gabriela Mistral and Pablo Neruda – Nobel Prize 1945 and 1971 respectively) এবং চিত্র পরিচালক লুই বুনুয়েল (Luis Bunuel)। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পো কাহিনীও উল্লেখযোগ্য।
বাংলা ভাষার উপর তাঁর ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। তাঁর নিজের কথায় বলি :
“ I hope two important wishes related with Tagore come true. The first one is to travel in December 2001 to Santiniketan to celebrate the centenary of the creation of the school. The second one is to learn, as soon as I can, Bengali, a heavenly language in which, according to Spanish writer Ramon Gomes de la Serna, “colourful birds sing’. My idea is to enjoy Tagore’s original works, written in the lovely language of West Bengal (India) and Bangladesh. “
“আমি আশা করি রবীন্দ্র বিষয়ে দুটি প্রয়োজনীয় ইচ্ছা যেন পূরণ করতে পারি। প্রথম – ২০০১ সালে শান্তিনিকেতনের শতবার্ষিকী উৎসবে আমি যেন যেতে পারি। দ্বিতীয় – আমি যেন, যত শীঘ্র সম্ভব, ঐশ্বরিক বাংলা ভাষা শিখতে পারি। যে ভাষাকে স্পেনের সাহিত্যিক রেমন গোমেস (Ramon Gomes) আখ্যা দিয়েছেন ‘রঙ্গিন পাখির গান’। আমার অভিলাষ আমি রবীন্দ্র সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের সেই মধুর ভাষায় উপভোগ করব, যে ভাষা পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) ও বাংলাদেশের।“
হোসে প্যাস রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা বিষয়ে তাঁর আদর্শ ও দর্শন নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন এবং তার প্রভাব স্প্যানিশ ভাষাভাষী জগতকে কত প্রভাবিত করেছে তা নিয়ে অতি দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন টেগোর সেন্টারের সিম্পোসিয়ামে। আমি এই আলেখ্যে যা লিখলাম তা আমার তাঁর সঙ্গে অল্প সময়ের আলাপচারিতা।
হোসে প্যাস রদ্রিগেস তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি উদ্ধৃতি দিয়ে :
“I was sleeping and dreamt that life was just joy. I woke up and saw that life was serving people. I served people, I saw that it was joy.“
“আমি নিদ্রামগ্ন ছিলাম ও স্বপ্ন দেখছিলাম যে জীবন কেবল আনন্দ। আমি জেগে উঠলাম ও দেখলাম যে জীবন মানুষের সেবার জন্য। আমি মানুষের সেবা করেছি, আমি অনুভব করলাম সেটাই আনন্দ। “
হোসে প্যাস আমাকে তাঁর অসাধারণ রবীন্দ্র সংগ্রহশালা দেখতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা কাজের ব্যস্ততার মধ্যে আর সময় করে উঠতে পারিনি।
মার্টিন কেম্পশেন Martin Kampchen (জার্মানি)
২০১১ সালে টেগোর সেন্টার লন্ডন ইউনিভারসিটিতে এক আন্তর্জাতিক টেগোর অধিবেশনের আয়োজন করে।
কেতকী কুশারি ডাইসন সেই অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন। এর কথা আমি অন্যত্র লিখেছি। তদানীন্তন বিশ্বের বেশ কয়েকজন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সেই অধিবেশনে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মার্টিন কেম্পশেন (Martin Kampchen)।

মার্টিন কেম্পশেন (Martin Kampchen)
অধিবেশনের দিনে টেগোর সেন্টার প্রকাশিত ‘ RobIndranath Tagore: A Timeless Mind ‘
বইটিরও উদ্বোধন হয় (এর কথা আমি অন্যত্র বলেছি)। একই সঙ্গে অধিবেশন ও বই উদ্বোধনের তত্বাবধান আমাকে ব্যস্ত রেখেছিল। আমি সব অতিথিদের সঙ্গে বেশী সময় কাটাতে পারিনি। মার্টিনের সঙ্গে তাই যথেষ্ট সময় পাই নি গল্প করার। তবে যেটুকু সময় পেয়েছিলাম কথা বলার তাতেই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। মার্টিনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ও তাঁর সম্বন্ধে বিশদ জেনে আমি আশ্চর্য না হয়ে পারিনি। আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে অনেক বিদেশী ভারতবর্ষকে ভালবেসেছে, নানাভাবে তাঁরা ভারতবর্ষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কিন্তু এমনভাবে ভারত তথা বাংলাকে ভালবেসে জীবন উৎসর্গ করতে বিরল কয়েকজন মানুষকে দেখেছি। মার্টিন কেম্পশেন সেই মানুষ। আমি সিস্টার নিবেদিতাকে অবশ্যই ভুলিনি।
বোধহয় ২০১৫ সালে মার্টিন কেম্পশেন ও ইমরে বাঙ্গা সম্পাদিত ‘ Rabindranath Tagore ঃ One Hundred Years of Global Reception’, বহু অমূল্য তথ্য সমৃদ্ধ একটি অনবদ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। লন্ডনের নেহেরু সেন্টারে এই বইটির উদ্বোধন হয়েছিল। ইমরে বাঙ্গা মহাশয় এসেছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। আমি ছিলাম অনুষ্ঠানের সভাপতি। আজ আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না সেই অনুষ্ঠানে মার্টিন এসেছিলেন কি না। যাই হোক মার্টিন কেম্পশেন সম্বন্ধে দুকথা বলি।
মার্টিন কেম্পশেনের ভারত যোগাযোগ শুরু হয়েছিল কলকাতা থেকে। তিনি কলকাতার রামকৃষ্ণ ইন্সটিটিউট অফ কালচারে জার্মান ভাষার শিক্ষক রূপে যোগদান করেন। তিনি ভিয়েনা ও প্যারিসে শিক্ষা শেষ করে প্রথম ডক্টরেট করেন ভিয়েনা থেকে। দ্বিতীয় পি এইচ ডি করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর বিষয় ছিল রামকৃষ্ণ ও সেন্ট ফ্রান্সিসের তুলনামূলক ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের উপর গবেষণা। অচিরে তিনি শান্তিনিকেতনকে ভালবেসে ফেলেন ও ১৯৮০ সালে শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে চলে আসেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ ও দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি সমাজ সেবায় ব্রতী হন।
শান্তিনিকেতনে তিনি বাংলা ভাষায় বুৎপত্তি লাভ করেন। এবং এই সময়ে তিনি সরাসরি বাংলা থেকে জার্মান ভাষায় রামকৃষ্ণ কথামৃত অনুবাদ করেন। মার্টিন পরে অনেক রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নাটক ও গল্প জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনুবাদ ‘স্ফুলিঙ্গ’ ‘লেখন’ ও ‘ক্ষণিকা’ থেকে একশত কবিতা।
শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীতে বাস করতেন কিন্তু ১৯৮৪ সাল থেকে তিনি নিকটবর্তী ঘোষালডাঙ্গা ও বিষ্ণুবাটি অঞ্চলে আদিবাসী ও সাঁওতালী গ্রামে গিয়ে তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের কাজ শুরু করেন। মার্টিনের উদ্যোগে উত্তরকালে ২০০৭ সালে “ঘোষালডাঙ্গা ও বিষ্ণুবাটি সুহৃদসঙ্ঘ“ ("Friends of Ghosaldanga and Bishnubati" association) স্থাপিত হয়। এই সংস্থা ইউরোপে বিশেষ করে জার্মানি ও অস্ট্রিয়াতে আদিবাসী সংস্কৃতি -- নৃত্য সঙ্গীত ও শিল্পকলা – প্রচারে উদ্যোগী হয়।
যতদূর জানি মার্টিন কেম্পশেন ১৯৮০ সাল থেকে ভারতে বাস করছেন এবং অক্লান্তভাবে রবীন্দ্র চর্চায় ও আদিবাসী গ্রাম উন্নয়নের কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে, ভারতবর্ষকে ভালবেসে নি:স্বার্থ মার্টিন এত বছর ধরে যে অসাধারণ কাজ করেছেন তা অনুভব করে আমি যুগপৎ আশ্চর্য ও বিস্মিত না হয়ে পারিনি। বাংলায়, ভারতে ও আন্তর্জাতিক মহলে মার্টিন অনেক সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৯২ তিনি রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এবং ২০১২ সালে তিনি জার্মানিতে Merck Tagore Award পেয়েছেন।
মার্টিন কেম্পশেনকে আমি শ্রদ্ধা করি। ২০১১ সালের পর মার্টিনের সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। শুনেছি 2023 সালের পর থেকে তিনি স্বাস্থ্যের কারণে বেশী সময়ই জার্মানিতে তাঁর নিজের শহর বোপার্ডে থাকেন। কামনা করি তিনি যেখানেই থাকুন সুস্থ থাকুন।
নাটিক-ডানিল’ চুক A.P. Gnatyk-Danil’chuk (রাশিয়া)
ডানিল’চুকের সঙ্গে কথা হয়েছিল অতি অল্প সময়ের জন্য। লন্ডনে ২০০০ সালে টেগোর সেন্টার আয়োজিত আন্তর্জাজিক রবীন্দ্র সিম্পোসিয়ামের অবসরে চায়ের টেবিলে।
ডানিল’চুক কথা শুরু করেছিলেন রাশিয়াতে রবীন্দ্রনাথের সেদিনের ও বর্তমানের অবস্থান প্রসঙ্গে। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পর নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন নতুন সমাজ ব্যবস্থার স্বীকৃতির জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল আর সেই কারণে পৃথিবীর বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এবং বিজ্ঞান শিল্প কবিতা ও সাহিত্য জগতের বিখ্যাত মানুষের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। স্বভাবতই তারা এই সব ব্যক্তিদের কাছ থেকে এই সমাজ ব্যবস্থায় দেশের উন্নয়ন, প্রগতি ও সাফল্যের গুণগান আশা করেছিল। যারা তা করেনি তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের শত্রু বলে বিবেচিত হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণে এসেছিলেন। তিনি সামগ্রিকভাবে রাশিয়ার সমাজব্যবস্থার প্রশংসা করেছিলেন কিন্তু কিছু কিছু জিনিষ পছন্দ করেন নি, বিশেষ করে শিক্ষা পদ্ধতি। সেই কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নে তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’ (Letters From Russia) সেন্সর করে (censored form) প্রকাশিত হয়েছিল। এবং তাঁর সাক্ষাৎকারও সেন্সর করে সংবাদ পত্র ইজভেসতিয়াতে (Izvestia) ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩০ প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর প্রায় ৫৮ বছর তাঁর সমস্ত কর্মকান্ড ও সৃষ্টি রাশিয়াতে অপ্রকাশিত ছিল। এই দীর্ঘ ৫৮ বছর পর সম্পূর্ণ রাশিয়ার চিঠি ও সাক্ষাৎকার আবার সংবাদপত্রে দেখা গেল জুলাই ১৯৮৮-তে।
ডানিল’চুক মনে করিয়ে দিলেন যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ তাঁর জীবনের এক উল্লখযোগ্য ঘটনা। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩০ সালে প্রোঃ মহলানবিশকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “ I am now in Russia, had I not come my life’s pilgimage would have remained incomplete.” “ আমি যদি রাশিয়া ভ্রমণ না করতাম তবে আমার জীবনের তীর্থযাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যেত।“
তিনি বললেন রাশিয়াতে রবীন্দ্রনাথের বইয়ের ইতিহাস আজব। সে যুগেও রাশিয়াতে বহু রবীন্দ্রভক্ত ও অনুরাগী ছিল। ইংরেজি থেকে তাঁর বইয়ের অনুবাদ হয় ১৯১৩-১৯২৭ সালে এবং মূল বাংলা থেকে অনুদিত হয় ১৯২০ সালে। প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ট্রুবিয়ান্সকি (M. Trubyansky), রাশিয়ার প্রথম বাংলা ভাষা ও টেগোর বিশেষজ্ঞ। সেই সময় এই বই ১০০ বারের বেশি প্রকাশিত হয়েছিল। অথচ, আশ্চর্যের বিষয়, ১৯২৮ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের একটিও বই রাশিয়াতে দেখা যায় নি।
এই অধিবেশনে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক রাশিয়া বিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
শেষে তিনি আমায় বলেছিলেন, “ Tagore will for ever remain our contemporary “ টেগোর চিরদিন আমাদের সমসাময়িক রূপে অবস্থান করবেন। “ আধুনিক রাশিয়াতে তিনি চিরদিন পঠিত হবেন এবং জীবিত থাকবেন।
এই প্রসঙ্গে একটা আকর্ষণীয় গল্প বলি। বহু বছর ধরে রবীন্দ্রনাথ সংক্রান্ত সমস্ত নথি পত্র, তাঁর বই, অঙ্কন শিল্প, ডকুমেন্টারি চিত্র ইত্যাদি রাশিয়ার সংগ্রহশালায় বন্দী করা ছিল। কারো অধিকার ছিল না সেগুলো দেখার। রাশিয়ার মানুষের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের নাম মুছে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আধুনিক রাশিয়া এখন আবার জনসাধারণের কাছে সব রবীন্দ্র তথ্যের দ্বার মুক্ত করে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্ম বার্ষিকীর সময় আমাদের টেগোর সেন্টার লন্ডনের রাশিয়ান দূতাবাস থেকে এক আবেদন পায়। ওরা রাশিয়াতে রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্ম বার্ষিকী পালন করছে। আমাদের সংগ্রহশালা থেকে যদি কিছু ওদের দিতে পারি তাহলে ওরা কৃতজ্ঞ হবে। আমরা কিছু একটা দিয়েছিলাম কিন্তু আজ মনে পড়ছে না সেটা কি। (সম্ভবতঃ ‘ডাকঘর’ সংক্রান্ত কিছু)। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রাশিয়া আমাদের এক অমূল্য দু মিনিটের মুভি ফুটেজের ভিডিও কপি দিয়েছিল। সেই ভিডিও টেপে আমি যা দেখলাম তা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথের অনেক ছবি আছে, অনেক তথ্য চিত্র আছে। সত্যজিৎ রায়ের অনন্য ডকুমেন্টারির কথা আমি ভুলিনি। কিন্তু কখনো কোথাও রবীন্দ্রনাথের হাসির ছবি দেখিনি, কেউ দেখেছেন বলে শুনিনি। আমরা রবীন্দ্রনাথকে হাসতে দেখলাম সেই ভিডিও টেপে। রবীন্দ্রনাথ রাশিয়াতে তাঁর এক চিত্রশিল্প প্রদর্শনী উদ্বোধন করছেন। উদ্বোধনের সময় তাঁর হাসিমুখ দেখলাম।
আমি টেগোর সেন্টারে যতদিন ছিলাম, সেই টেপটি সযত্নে রক্ষিত ছিল। আমি আর টেগোর সেন্টারের কার্যকরী সমিতিতে নেই। সেই লাইব্রেরী ও সংগ্রহশালাও আর নেই। জানিনা সেই দুষ্প্রাপ্য অমূল্য সম্পদটি এখন কোথায় আছে।
প্রোফেসর ডানিল’চুক রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Di.Litt. পেয়েছেন। তিনি একজন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ এবং লেখক, সম্পাদক ও অনুবাদক। তিনি শতাধিক বই বাংলা থেকে রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছেন এবং বাংলা পাঠ্যপুস্তকও লিখেছেন। তিনি মস্কোর Institute of International Relations-এ বাংলার অধ্যাপক।
তপতী বিশ্বাস, সিংগাপুর। | 27.125.***.*** | ০২ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:০৩735411