এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা   ইতিহাস

  • গণহত্যার ইতিহাস 

    দীপ
    আলোচনা | ইতিহাস | ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ | ২৪ বার পঠিত
  • অগণিত মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছে বাংলাদেশ।
    মৌলবাদী শক্তি ও তাদের নির্লজ্জ সহযোগীকুল এই ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চায়!
    আমরা যেন এই ইতিহাস ভুলে না যাই! 
    -------------------------------------------------------------------
     
    খাবার খেয়ে, গান শুনে গুলি করে হত্যা

    আপ্যায়নের কোনো ঘাটতি রাখেননি ভূপতিনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী। সকালবেলায় পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন বোখারির নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন সেনাসদস্য তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। ক্যাপ্টেন বীরদর্পে নানা রকম হুকুম চালাচ্ছিলেন। যথাসাধ্য তা তামিল করছিলেন প্রবীণ শিল্পী ভূপতিবাবু। বিস্তর খানাপিনার আয়োজন করলেন। পানাহার শেষে ক্যাপ্টেন আদেশ দিলেন গান শোনানোর।

    শিল্পী ভূপতিনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুরের গাঙ্গাটিয়া এলাকার জমিদার। বহুগুণের অধিকারী দয়ালু স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেছেন চারুকলা বিষয়ে। গত শতকের চল্লিশের দশকে কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে চারুকলায় শিক্ষা সমাপন করে স্বাধীনভাবে শিল্পচর্চা করতেন। শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ওয়াস পদ্ধতিতে প্রাচ্যকলা রীতির কাজ করতেন ভূপতিবাবু। কলকাতায় প্রশংসিত হয়েছিল তাঁর কাজ। শিল্পকলাচর্চার পাশাপাশি উচ্চাঙ্গসংগীতেরও নিয়মিত চর্চা করতেন। খুব ভালো গাইতে ও এসরাজ বাজাতে পারতেন। তাঁর গানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল কিশোরগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায়। সে কারণেই হানাদার ক্যাপ্টেন গান শোনানোর হুকুম করেছিলেন তাঁকে।
    ভূপতিনাথের অসম্মত হওয়ার প্রশ্নই ছিল না। প্রাণের ভয় কার না আছে। হানাদার পাকিস্তানি সেনারা তখন সারা বাংলায় মেতে উঠেছে বর্বর গণহত্যায়। শিশু, নারী, বৃদ্ধ কোনো বাছবিচার ছিল না তাদের। ভূপতিনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী প্রাণ বাঁচাতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন আরও লাখ লাখ ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের মতোই। আশ্রয় নিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামের জ্ঞাতি সুধীর চন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়িতে। রাজাকাররা তা জানত। তারা সেখান থেকে ভূপতিনাথকে আটক করে গাঙ্গুটিয়ার বাড়িতে হানাদার সেনাদের কাছে নিয়ে আসে।

    পাকিস্তানি সেনাদের আদর-আপ্যায়ন করে, গানবাজনা শুনিয়ে ভূপতিনাথ চক্রবর্তী ভেবেছিলেন, তাঁর বিপদ কেটে গেছে। খানিকটা স্বস্তি এসেছিল তাঁর মনে। কিন্তু অচিরেই তাঁর সেই ভুল ভেঙেছিল চরম মূল্যে। বিকেল চারটার দিকে ফিরে যাওয়ার সময় হানাদার সেনারা ভূপতিনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তপনকুমার চক্রবর্তী ও দুই কর্মচারীর হাত বেঁধে ফেলে। বাড়ির উঠানে মন্দিরের সামনে কদমগাছের তলায় তাঁদের দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ঠান্ডা মাথার এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ৭ মে।

    শহীদ শিল্পী ভূপতিনাথ চক্রবর্তীর ছবি ও প্রাচ্যকলা পদ্ধতিতে আঁকা তাঁর দুটি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিদর্শনের সঙ্গে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে গ্রামের দোকানে কেনাকাটা করছে খদ্দের। অন্য ছবিটি একান্তই ঘরোয়া মুহূর্তের। এক প্রবীণা নানি বা দাদি হতে পারেন, পরম যত্নে চুল বেঁধে দিচ্ছেন এক তরুণীর। ছবি দুটির পাশে শিল্পী ভূপতিনাথ চক্রবর্তী চৌধুরীর হত্যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

    শহীদ ভূপতিনাথ চক্রবর্তীর বড় ছেলে মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরীর সঙ্গে গত শুক্রবার কথা হলো মুঠোফোনে। তিনি গাঙ্গুটিয়ায় তাঁদের বাড়িতেই থাকেন। বয়স প্রায় ৯০ বছর। নিঃসন্তান। স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে প্রায় ৭ বছর আগে। এখনো তিনি ও জ্যাঠাতো বড় ভাই তপনকুমার চক্রবর্তীর বিধবা স্ত্রী এই বাড়িতে থাকেন। তিনি জানালেন, ঘটনার দিন ৭ মে মা ও দুই ভাই বাড়িতেই ছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন আত্মগোপনে। এরপর তিনি সেদিনের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচারণা করেন ও বাবার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দেন।
    শিল্পী ভূপতিনাথ চক্রবর্তী চৌধুরীর জন্ম ১৯০৮ সালে। তাঁর স্ত্রী মিলন বালা দেবী। ভূপতিনাথ চক্রবর্তীর বাবা রাজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী ছিলেন গাঙ্গুটিয়ার জমিদার। মা প্রাণদা সুন্দরী দেবী। ভূপতিরা ছিলেন চার ভাই ও তিন বোন। কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে ভূপতিনাথ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। ইতালিতে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু দেশ ছেড়ে যেতে চাননি। কলকাতায় তাঁর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হয়েছিল। ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিলেন। ছবি আঁকার পাশাপাশি উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা করতেন। হোমিও চিকিৎসার শিক্ষা গ্রহণও করেন। অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দিতেন গ্রামের লোকেদের। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন। এ কারণে রাজাকাররা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। একটা পর্যায়ে তিনি বাড়ি থেকে সরে গিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন।

    মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী জানালেন, তাঁরা চার ভাইবোন। বড় ভাই তপনকুমার চক্রবর্তী চৌধুরী। দাদা-বউদি প্রয়াত। তাঁরাও নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর দুই বোন। জয়ন্তী চক্রবর্তী ও বাসন্তী চক্রবর্তী। কলকাতায় থাকেন। তাঁর বাবাকে হত্যা করে ঘাতকেরা চলে গেলে স্বজনেরা সন্ধ্যার পর বাড়িতেই মরদেহ সমাহিত করেন। এরপর প্রাণভয়ে তাঁরা বাড়ি ছেড়ে চলে যান। মাস দেড়েক লুকিয়ে থাকেন প্রতিবেশীদের বাড়িতে। এর মধ্যে তাঁদের বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বাড়িতে তাঁর বাবার অনেক শিল্পকর্ম ছিল। সব পুড়ে যায়। একপর্যায়ে তাঁদের দুই ভাইয়ের জীবনেও সংশয় সৃষ্টি হয়। তখন আত্মীয়দের নিয়ে তাঁরা চলে যান ভারতে। ফেরেন দেশ স্বাধীন হলে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তাঁর বাবার আঁকা যে দুটি ছবি আছে, তা ছিল কলকাতায় তাঁর বোন বাসন্তী চক্রবর্তীর বাড়িতে। এ কারণে এই ছবি দুটি রক্ষা পায়। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে ছবি দুটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দেওয়া হয়েছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Mridha | 2601:803:8081:5e50:fcfa:67bb:2f90:***:*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ২১:৪৭746361
  • আমি ভদ্রেশ্বরের যেই পাড়ায় বড় হয়েছি তারা প্রায় সবাই বাংলা দেশের ঢাকা জেলার দিঘলী গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসা কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মানুষ। আমার ছোট বেলা থেকে দেখে আসা, পশ্চিমবাংলার বাঙাল পাড়ায় বড় হওয়া জীবনে দেখেছি, সব অতীত ভূলে নির্ঝঞ্ঝাট নিচিন্ত জীবনই সবথেকে বেশী কাম্য ছিল সব পরিবারেই। ঝামেলার থেকে দূরে থেকে ভাল মানুষ হয়ে বসে থাকব আর অন্যের বিচার করব সঙ্গে কোন এক উটোপিয়ান জীবন নিয়ে ত্বাত্তিক আলোচনা করা, এটাই ছিল এভারেজ বাঙালীর অবস্থান ঘটি বাঙ্গাল নির্বিশেষে। আশার আলো এটাই, সেটার পরিবর্তন হচ্ছে।
  • আশার আলো | 76.13.***.*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ২২:৫১746362
  • " ঝামেলার থেকে দূরে থেকে ভাল মানুষ হয়ে বসে থাকব আর ... আশার আলো এটাই, সেটার পরিবর্তন হচ্ছে।"
     
    মানুষ ঝামেলা চাইছে, আর ভালো মানুষ হতে চাইছে না - এটা তো সত্যিই এত আশাব্যঞ্জক, ঠিকই তো, মারপিট দাঙ্গা করার চেয়ে আশাব্যঞ্জক আর কিই বা আছে 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন