ছবি: রমিত
ছেলেবেলা
স্মৃতি আবছা হয়ে আসছে। ঘটনার কালক্রম মিলবে না হয়ত। ঠিক মনে নেই হয়ত কোন ঘটনার সময় আমার মানসিক অবস্থা কেমন ছিলো। যা লিখছি তা আজকের বহু দিনের অভিজ্ঞতাপুষ্ট চর্চিত মননের আলো দিয়ে। সত্তর বা পঞ্চাশ বছর আগে আমার মনের অবস্থা কি ছিলো তা বোধ হয় অবিকল বলা হবে না। ঘটনার বিবরণ হুবহু মিলবে না হয়ত এবং সে সময়ের মনের আবেগের প্রকারভেদ হওয়াও অসম্ভব নয়।
আমার জন্ম ১৯৩৭ সনের ২৫শে জুনে, হাওড়ায় মাতুলালয়ে। বাবা পেশায় উকিল ছিলেন। সম্মানিত সফল আইনজীবী। ভাল পসার ছিল। ২৪ পরগনার বসিরহাট শহরে আমাদের বাস ছিলো। বাবা ঐ শহরের আদালতে প্রাকটিস করতেন। যতদূর মনে পড়ে আমাদের অবস্থা বেশ স্বচ্ছল ছিল।
আমদের বসিরহাটের বাড়ীতে অনেক মানুষ থাকত। আমি প্রথম সন্তান --- আমরা পাঁচ ভাই ও এক বোন। আমি যেসময়ের কথা বলছি তখন আমরা শুধু চার ভাই। আমরা ছাড়াও আমাদের বাড়ীতে থাকতেন আমার ঠাকুমা, আমার এক পিসিমা ও কাকা ( বাবার খুড়তুত বোন ও ভাই ), ও মুহুরিমশাই – যিনি বাবার আদালতের কাজকর্ম ও বাড়ীর বাজার হাট করতেন।
বাবার আদি বসত বাড়ী বসিরহাট থেকে প্রায় আট মাইল দূরে গোকুলপুর নামে এক গ্রামে। আমরা প্রায়ই সেখানে যেতাম, বিশেষ করে গ্রীষ্মের ছুটিতে ও পুজোর ছুটিতে। ছোটবেলায় গোকুলপুরের দিনগুলো আনন্দে ভরপুর ছিল। সেই মধুর স্মৃতি আমাকে এখনো আমার বিরস দিনে কোমল হাতে জড়িয়ে রাখে।
গোকুলপুরের বাড়ীর পরিবেশ, মানুষজন, পুকুর, বাগান, বাজার, ক্ষেত খামার, আম-লিচু-জাম-কাঁঠাল, সদ্য ধরা মাছ --- সব মিলিয়ে বাল্য ও কৈশোরের সেই দিনগুলো আমার জীবনের অনেকখানি জুড়ে আছে – সময়ের মাপকাঠিতে নয়, আবেগের মাপকাঠিতে। মনে ও হৃদয়ের যাদুঘরে কতখানি জায়গা আছে জানি না, আর সে জায়গাগুলো কেমন করে ভাগ করা আছে তাও জানি না। তবে এটুকু জানি সময়ের অংশ নিয়ে তা দেয়াল তুলে দেয় নি। এক মুহূর্তের এক অনুভুতি, এক আনন্দ বা দু;খের দিন হয়ত বিশাল অংশ ভরে আছে। আবার হয়ত দশ বছরের কোনো নিরবিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা দখল করে আছে সূচগ্র মেদিনী।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাত ধরে ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার মধ্যগগনে বাংলায় অনেক জমিদার পরিবারের উত্থান হয়েছিল। এমনই এক মধ্যস্তরের জমিদার পরিবারে বাবার জন্ম। এই পরিবারের পরিচয় না দিয়ে আমার জীবনী শুরু করলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমার প্রাক যৌবন পর্যন্ত আমার মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচারে এই পরিবারের প্রভাব যথেষ্ট ছিল। পরে আমার অবশ্য একটা স্বকীয় নিজস্ব সত্তা গড়ে উঠেছিল। আমার শৈশবে আমার বাবার এই পরিবারে যে আধিপত্য দেখেছি, এবং যা দেখে আমি আযৌবন বড় হয়ে উঠেছি তার রূপ ও বাবার বাবা, মা, কাকা-কাকিমা, ভাই বোন ও নিকট আত্মীয় স্বজন মিলে যে বিরাট পরিবার ছিল তার পরিচয় এখনে অপরিহার্য। বাবার অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব ছিল। সে বাড়ীতে বাবার কথার উপর আমি কাউকে কথা বলতে দেখিনি, এমন কি দাদু বা ঠাকুমাদেরও না, কাকারা তো দূরের কথা। বাবা যখন দেশে যেতেন তখন প্রজারা বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসত। অনেকে তাদের জমিজমা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আসত, খাজনা দেওয়ার অক্ষমতা জানাতে। আবার অনেকে আসত তাদের পারিবারিক সমস্যা নিয়ে। আসত বাবার কাছে উপদেশ নিতে, তাদের সমস্যার সমাধান করতে।
গোকুলপুরের সেই বিশাল পরিবার সেই অর্থে আমারও বৃহত্তর একান্নবর্তি পরিবার, যেখানে সদস্য সংখ্যা প্রায় পঁচিশ তিরিশ। সবাই এক ছাদের নীচে। বাবার জন্মকালে বিশ্বাস পরিবারের স্বর্ণ যুগ। কলকাতায় বাগানবাড়ী – প্রমোদ ভবন। সে সব আমি দেখেনি। মা দেখেছিলেন, মায়ের মুখে গল্প শুনেছি। কিন্ত আমি যা দেখছি তাও কিছু কম নয়। তারপর আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনে অবক্ষয় একে গ্রাস করল, বিশাল অট্টালিকা ভেঙ্গে পড়ল, বিরাট একান্নবর্তি পরিবার ছোট ছোট নিউক্লিয়ার পরিবারে পরিণত হল।
বাল্যে এবং শৈশবে আমার পৃথিবীটা ছিল মোটামুটি তিনটি স্থানের মধ্যে আবদ্ধ। তখন আমি আমার কাছের সেই পৃথিবীটাকে আবিষ্কারের জন্য সর্বদাই উৎসুক হয়ে থাকতাম। এই তিন স্থান ছিল -- বাবার কর্ম ক্ষেত্র ও আমার স্কুল -- বসিরহাট, গোকুলপুরের বাড়ী, যাকে বলতাম আমাদের দেশ, আর আমার মাতুলালয়, হাওড়া। হাওড়া মানে কলকাতা – তখন আমার কাছে বিস্ময়কর শহর, এক আশ্চর্য নগর। কত কিছু যে করার আছে, দেখার আছে সে শহরে।
শীতে ও গ্রীষ্মে দেশে যেতাম। বসিরহাট থেকে গোকুলপুরের দূরত্ব মাত্র আট মাইল। দু উপায়ে যাওয়া যেত তখন – জলপথে নদী দিয়ে বা নদী পেরিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়ী করে। দূরত্ব যাই হোক না কেন, দিনক্ষণ ঠিক করে পরিকল্পনা করে যেতে হত; সুতরাং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আজকের দিনের মত হুট করে যাওয়া যেত না। নদী দিয়ে যেতে হলে আগে থেকে একটা নৌকো ভাড়া করতে হত, তারপর জোয়ার ভাঁটার সময় দেখে যাত্রা শুরু হত। দেশ থেকে কেউ না কেউ আসত আমদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য। জোয়ার শুরুর সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিতে হবে নইলে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভাঁটা পড়ে যাবে – দেশের ঘাটে নামতে অসুবিধা হবে। আর জোয়ার আসত শেষ রাত্রির দিকে; সুতরাং মাঝ রাতে উঠে প্রস্তুত হয়ে থাকতে হত। জোয়ার এলেই নৌকো ছাড়বে। নৌকোতে বিছানা করা থাকত, উঠেই শুয়ে পড়তাম। শিশুকালে নিশ্চয়ই মায়ের কোলে চড়ে এই নৌকোয় উঠেছি।
নদীর নাম ইছামতী। খুব বড় নদী নয়, খুব ছোটোও নয়; এপার ওপার দুপারই পরিষ্কার দেখা যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে এই শান্ত নদী মাতাল হয়ে উঠে। কালবৈশাখী ঝড়ে এর রূদ্র রূপ চমক লাগায়। বর্ষায় এ হয়ে উঠে ভয়ংকর – পাড়ের জমি ভেঙ্গে পড়ে নদীর বুকে, গাছপালা বাড়ী ঘর কারো রেহাই নেই। বসিরহাটে আমাদের বাড়ী ছিল এই নদীর ধারে। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়ীর সামনে বেশ বড় একটা বাগান, গাছ পালা ভর্তি। সেই বাগানে আমরা খেলাধুলা করতাম। বাগানের শেষে নদীর পাড়। প্রতি বছরই ইছামতী এই বাগানের ভাগ নিত একটু একটু করে। প্রতি বর্ষায় নদীর পাড় ভাঙত; ইছামতী গ্রাস করত জমি। নদীর ধারে একটা বকুল গাছ ছিল। গ্রীষ্ম কালে প্রচণ্ড গরমে গুমোট ঘরে থাকা যেত না; পড়ায় মন বসত না। সন্ধ্যাবেলা এই বকুল গাছের নীচে মাদুর বিছিয়ে হারিকেনের আলোতে পড়শুনা করতাম। নদীর ধারে মৃদু হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দিত --- কি অভাবনীয় প্রশান্তি! একদিন সকালে উঠে দেখি সেই বকুল গাছটার শিকড় উপড়ে গেছে; পদচ্যুত বৃক্ষ মুখ থুবড়ে ইছামতীর জলে পড়ে আছে। মনটা আমার খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। পরে সরকার নদীর পাড় বাঁধাবার কাজে উদ্যোগী হয়েছিল। ইছামতী করুণা করে আমদের বাড়ী গ্রাস করে নি; কিন্তু মানুষ করেছিল। মানুষের হাত থেকে আমরা রেহাই পাই নি। সে কথা পরে।
শীতকালে সাধারণতঃ ইছামতী শান্ত লজ্জাবতী। আমারা তাই শীতকালেই নৌকো করে দেশে যেতাম। মাঝারি গোছের নৌকো, মাঝখানে খড়ের ছাউনি দেওয়া গোল ছাদের ঘর, দুজন মাঝি। ঘরের ভিতর বালিশ বিছানা – আরামের শয্যা। মা সঙ্গে যথেষ্ট জলখাবার নিয়ে যেত। কয়েক ঘণ্টা জলে ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছতাম গোকুলপুরে আমাদের ঘাটে। ঘাটে কাকারা লোকজন নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকত।
ডাঙ্গাপথে দেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অন্য। বসিরহাটের ওপারে গ্রাম, সংগ্রামপুর। ফেরী করে নদী পার হয়ে সংগ্রামপুর যেতে হত, তারপর গরুর গাড়ী করে যাত্রা। দেশের বাড়ীতে কাজ করতো মংলা ও হায়দার আলি; ওদের কেউ না কেউ গরুর গাড়ী নিয়ে চলে আসত। আমরা সেই গাড়ীতে করে গোকুলপুরে যেতাম। গাড়ীর মধ্যে বিছানা পাতা থাকত। আমরা গাড়ীতে উঠেই বিছানায় শুয়ে পড়তাম। সংগ্রামপুর থেকে গোকুলপুর মাত্র আট মাইল পথ। কিন্তু গরুর গাড়ীতে যেতে বেলা গড়িয়ে যেত।

পিতা: ক্ষেত্র মোহন বিশ্বাস

মাতা:বিদ্যুৎ লতা বিশ্বাস
আমার ছেলেবেলা ও কৈশোর কেটেছে বসিরহাটে। জীবনের প্রথম ষোল বছর এই মহকুমা শহরের আকাশ বাতাস শীত গ্রীষ্ম বর্ষা আমাকে আস্তে আস্তে পুষ্ট করে তুলেছে। বাবা মা-র ভালবাসার ছত্রছায়ায় আদরে ও স্নেহে বড় হয়ে উঠেছি। সেই দিনগুলো আমার সবচেয়ে সুখের ও আনন্দের।
আমাদের বসিরহাটের বাড়ীটার দুটো অংশ ছিল, অনেকটা ইংরাজী অক্ষর “এল” (L) আকারের মত। বড় অংশটাতে ছিল দুটি শোবার ঘর, একটি ছোট ভাঁড়ার ঘর আর একটা বেশ বড় অসমাপ্ত ঘর ছিল। এ ঘরে মাটির মেঝে, এটা ব্যবহার করা হত না। এ অংশটা ইঁটের তৈরী, চুন-সুরকির পেটানো ছাদ। অন্য অংশে একটা বিরাট ঘর। এর দেয়ালগুলো ইঁটের গাঁথা কিন্তু ছাদ ছিল খড়ের। এটা বাবার অফিস ঘর। ঘরের একদিকে একটা মস্তবড় টেবিল আর চেয়ার। টেবিলের উল্টোদিকে গোটা দুই চেয়ার ও একটি কাঠের বেঞ্চ – মক্কেল ও আগতদের বসবার জন্য। বাবার চেয়ারের পিছনে বাবার লাইব্রেরী – সারি সারি কাঠের তাকের উপর আইনের বই ও দরকারী কাগজ পত্র।
ঘরের এক কোনে মুহুরি মশায়ের স্থান। মুহুরি মশায় মাটিতে চাদর পেতে বসত। সামনে একটা কাঠের চৌকি ছিল, তার উপর লেখা লিখির কাজ কর্ম করত। মুহুরি মশায় বাবার ডায়েরি রাখত, আদালতের কেস ও সব কাগজ পত্র দেখাশোনা করত। রাত্রে চৌকি সরিয়ে মুহুরি মশায় সেখানেই বিছানা পেতে শুয়ে পড়ত। মুহুরি মশায় আমাদের পরিবারের মানুষ। বাবার আদালতের কাজ ছাড়াও বাড়ির সব কাজে মা-কে সাহায্য করত। বাজার-হাট দোকান-পাট ফাই-ফরমাস সব কিছুতেই মুহুরি মশায়, মায় ছেলেদের দেখা শোনাও। আমরা তো মুহুরি মশায়ের কোলে-পিঠে মানুষ হয়েছি।
এই ঘরেরই অন্য অর্ধে একটা বড় তক্তাপোষ পাতা ছিল। দিনের বেলা এটা ছিল মক্কেলদের বসার জায়গা, সন্ধ্যায় আমার পড়ার জায়গা আর রাত্রে খোকা কাকা (দেবীরঞ্জন, বাবার খুড়তুত ভাই) বা কোন অতিথির শয্যা।
দুটি শোবার ঘরের যে ঘরটা বড়, সেই ঘরটাতে আমরা ভাইরা ও বাবা মা এক বিছানায় মেঝেতে শুতাম। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন খুকু নিমুর জন্ম হয়নি। পরে অবশ্য আমি যখন প্রায় চোদ্দ তখন নতুন ঘরে চলে যাই। সে কথায় পরে আসছি। অন্য ঘরটাতে হাম্মা (আমার ঠাকুমা), পিসিমা (শেফালি, বাবার খুড়তুত বোন) ও বেলা (আমার মেজ কাকার মেয়ে) থাকত। এই ঘর গুলোর সামনে ছিল এক প্রশস্ত বারান্দা। প্রয়োজনে এই বারান্দাতেও বিছানা করে শোয়ার ব্যবস্থা হত।
বাড়ীর মাঝখানে একটা বড় সান-বাঁধানো চত্বর। সেখানে ছিল একটা পাতকুঁয়া। এটা বেশ গভীর ছিল, প্রায় সারা বছরই এতে জল থাকত। এর জল শীতল ও মিষ্টি। এই জলই আমাদের একমাত্র জলের উৎস – এই জলই আমাদের পানীয়, এর জলই বাড়ীর সব কাজে ব্যবহার করা হত। আমাদের বাড়ীতে আরো একজন প্রয়োজনীয় মানুষ ছিল – সে মাদারি --- আমাদের বাড়ীর সব কাজ করত --- ঘর মোছা, বাসন মাজা, বাসি কাপড় কাচা ইত্যাদি। মাদারি সকালে বিকালে দুবার আসত। মাদারি আমদের খুব ভালবাসত, নিজেকে বাড়ির কত্রী বলে মনে করত; বাড়ীর পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে লক্ষ্য রাখত এবং একটু এদিক ওদিক হলে বকাবুকি করত। যতদূর মনে পড়ছে আমার যমজ ভাই হলে তাদের মাদারিই প্রথম হাঁদি-চিমু বলে ডাকতে শুরু করে। সেই থেকেই ওদের ডাক-নাম হাঁদি-চিমুই থেকে গেল।

নীচের সারিতে বসে: অনু, মা কোলে বুবাই, আমি (লেখক)
উপরের সারিতে দাঁড়িয়ে: খোকন, স্বাগতা (আমার খুড়তুত বোন) হাঁদি, খুকু, নিমু, চিমু
বারার এক ধনী জমিদার মক্কেল ছিল। তাদের যখন কেস থাকত তখন সেই জমিদারের নায়েব আসত বাবার কাছে। তাকে আমরা রতনকাকা বলে ডাকতাম। রতনকাকা এলে দুএক দিন থেকে যেত আমাদের বাড়ীতে। রতনকাকা এসেই বাজারে চলে যেত, আর বাজার থেকে বড় বড় মাছ ও অনেক মিষ্টি নিয়ে আসত। সেদিন মায়ের রান্না ঘরের কাজ বেড়ে যেত --- অন্য দিনের তুলনায় বিশেষ ভুরি ভোজ হত।
বাড়ীতে নিয়মিত নাপিত আসত। চুল কাটতে আমার একেবারেই ভাল লাগতো না। কিন্তু নাপিত এলে তার সামনে গিয়ে বসতেই হত। খবরের কাগজ কেটে মাথার মধ্যে গলিয়ে দিয়ে খবরের কাগজের জামা পরে চেয়ারে বসতাম আর নাপিত তার কাজ করে যেত। একটু বড় হয়ে অনুমতি নিয়ে যেদিন প্রথম সেলুনে চুল ছাঁটতে গিয়েছিলাম সেদিন যে আমার কি আনন্দ হয়েছিল! প্রতি সপ্তাহে রজক আসত ময়লা কাপড় চোপড় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম সকলের বাড়ী থেকেই তো ও এমনি করে কাপড় নিয়ে যাচ্ছে, কি করে মনে রাখে কার জামা কাপড় কোনটা। আমার জামাটা হারিয়ে ফেলবে না তো?
একদিন এক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল যার কথা মনে হলে এখনো আমার গা ছম ছম করে। সেটা ভরা দুপুর, চারিদিক নিস্তব্ধ। বাড়ীতে যে দু চারজন ছিল তারা দিবানিদ্রায় মগ্ন। আমি একটা রবারের বল নিয়ে খেলা করছিলাম। আমাদের বাড়ীর ছাদ বেশ নীচু। বলটা জোরে ছুঁড়েছিলাম, সেটা ছাদের উপর উঠে যায়। একটু পরে বলটা আবার ফিরে এল। আমি ভাবলাম নিশ্চয় ছাদে খোকন, আমার মেজ ভাই, আছে, ও-ই বলটা আমাকে ছুঁড়ে দিয়েছে। এরকম দুবার হল। আমি ভাবলাম এই বল ছোঁড়াছুঁড়ি খেলাটা তো বেশ মজার। আমি আবার বলটা ছুঁড়লাম কিন্ত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও বলটা ফিরে এলো না। আমি অধৈর্য হয়ে পড়লাম। চিৎকার করে বললাম, “খোকন, বলটা ছুঁড়ে দে।” আমার চিৎকার শুনে খোকন শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, বলল, “চিৎকার করছ কেন? কি হয়েছে?” আমি বললাম কি হয়েছে। ও বলল, “কই, আমি তো ছাদে যাইনি”। আমি অবাক! তবে বলটা কে ছুঁড়ে দিল? এর উত্তর আমি আজও খুঁজে পাইনি। পরে মায়ের কাছে শুনেছিলাম --- এ বাড়ীতে আগে যারা থাকত তাদের এক ছেলে ওই ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়। দুর্ঘটনায় মৃত সেই বালকের অশরীরি অস্তিত্বর আনাগোনা নাকি আছে ওই ছাদে। এই দুই বিভিন্ন কালে দুই বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে কোন যোগাযোগ সম্ভব কিনা আমি জানি না।
ছোটবেলার দিনগুলো ছিল নিয়মে বাঁধা, ঠিক রুটিনের মত। সকালে উঠে একটু পড়তে বসা, তারপর খেয়েদেয়ে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে ফিরে জলখাবার। মা সবকিছু প্রস্তুত করে মুখের সামনে এগিয়ে দিত। বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা। সন্ধেবেলা খেলার পর ফিরে হাত-পা-মুখ ধুয়ে পড়তে বসা। আর পড়তে বসলেই আমার সারাদিনের সব ক্লান্তি এসে মাথায় ভর করত। ঘুমে দুচোখের পাতা জড়িয়ে আসত। মুহুরি মশাই বলত, দাদাবাবুর পড়ার নামেই ঘুম। তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করে খেতে বসতাম। খেয়েদেয়ে সটান বিছানায়।
আমরা একটা ঘরে থাকতাম। বাবা মা আমি এবং ভাইরা সবাই এক বিছানায় শুতাম। মাটিতে বিছানা পেতে। মা খুব ভাল গল্প বলতে পারত। রামায়ণ মহাভারত পুরাণের গল্প। মা-র মুখে রাম রাবণ ভীম অর্জুন কৃষ্ণ শকুনি ভীষ্ম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। বড় হয়ে যখন প্রথম রাজশেখর বসুর রামায়ণ মহাভারত পড়লাম তখন মনে হয়েছিল এদের সবাইকে তো আমি জানি। শুধু ছাপার অক্ষরে এদের দেখলাম প্রথম। খুব ছোট বয়স থেকেই আমার পৃথিবীতে রামায়ণ মহাভারত পুরাণের চরিত্র ছাড়াও বাঙ্গালী ভারতীয় ও অন্যান্য দেশের নানা মনিষীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আমার মা।
স্কুলের জীবনটা এমন এক স্বছন্দ নিয়মবদ্ধ সুশৃঙ্খল আবহাওয়ার কেটেছিল। একটা সহায়ক সংযুতি (Support structure) আমাকে সর্বদা ঘিরে ছিল। আমার সকল জাগতিক প্রয়োজন বাবামায়ের সেই সহায়ক সংযুতি মিটিয়ে দিত। ফলে পড়াশুনা আর আমার কল্পনার রাজ্য ছাড়া আমাকে অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে হত না। স্কুল শেষ করে যখন কলকাতার কলেজে ভর্তি হলাম তখন সেই নিয়ম নিয়ন্ত্রিত দিন, সেই রুটিন, সেই সহায়ক সংযুতি, ভেঙ্গে গেল। আর যখন সেই রুটিন ভেঙ্গে গেল তখনই টলমল করে উঠল আমার সাফল্যের ভিত।
আমি বসিরহাট হাই স্কুলে পড়তাম। জীবনের প্রথম ষোল বছর এই বসিরহাট শহরে কেটেছে আর কেটেছে এই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী থেকে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত।
তিনজন মাস্টারমশায়ের কথা আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে। প্রথমজন সুধীরবাবু, আমাদের ভূগোল পড়াতেন এবং স্পোর্টস বিভাগ দেখাশুনা করতেন। মনে আছে কেননা তিনি আমাকে দেখলেই বলে উঠতেন,
“অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া,
দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।।“
দ্বিতীয় জন দুর্গাদাসবাবু, ইতিহাসের শিক্ষক। তিনি খুব ভাল আবৃত্তি করতে পারতেন। আমাদের পুরস্কার বিতরিণী অনুষ্ঠানে যে সব ছাত্ররা আবৃত্তি বা নাটিকা করত তাদের তৈরী করার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর। আমার আবৃত্তি করার প্রথম পাঠ তাঁর কাছ থেকেই। দুর্গাদাসবাবু ভাল শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রাইভেট টিউশনিও করতেন। তাঁর সুনাম ছিল এবং তাঁর নিজস্ব ছাত্ররা স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় ভাল ফল করত। আমার মেজ ভাই খোকন (বিমলেন্দু) তাঁর কাছে পড়েই বৃত্তি নিয়ে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল।
তৃতীয়জন অবনীবাবু – বাংলার শিক্ষক। মৃদুভাষী ও অতি নীচুস্বরে কথা বলতেন, খুব মনোযোগ দিয়ে না শুনলে বোঝা যায় না কি বলছেন। শিক্ষক হিসাবে তাঁরও খুব সুনাম ছিল এবং তিনিও প্রাইভেট টিউশনি করতেন। দশম শ্রেণীতে উঠে আমি অবনীবাবুর কাছে প্রাইভেটে পড়েছিলাম। অবনীবাবু আমাকে বোধহয় একটু অন্য ভাবে প্রস্তুত করেছিলেন।
বলেছিলেন, “তোমার স্কুলে গিয়ে কিছু লাভ নেই। আমি যা কাজ দেব তোমাকে তুমি সেগুলো ভালভাবে কর, তাহলেই পরীক্ষায় ভাল ফল করবে। আমি হেডমাস্টারমশায়কে বলে দেব যে আমি তোমার ভার নিচ্ছি। মাঝে মাঝে স্কুলে না গেলে উনি যেন তোমাকে বকাবুকি না করেন।” অবনীবাবু আমাকে যত পড়া (Homework) দিতেন তা আমি দিন রাত পরিশ্রম করেও শেষ করতে পারতাম না। উনি সব বিষয়েই পারদর্শী ছিলেন – অঙ্ক থেকে ভূগোল, বাংলা থেকে ইতিহাস। পরীক্ষায় কি ধরণের প্রশ্ন আসতে পারে সে সম্বন্ধে তাঁর এক বিশেষ জ্ঞান ছিল এবং আমাকে সেইভাবে প্রস্তুত করতে লাগলেন। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় আমি প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম।
একটা আফসোস আছে --- আমি অবনীবাবুর জীবিতকালে তাঁকে যথেষ্ট সম্মান দিতে ও কৃতজ্ঞতা জানাতে পারিনি। এর একটা কারণ হয়ত উনি আমার কাছ থেকে যে সাফল্য আশা করেছিলেন আমি কলেজ জীবনে তেমন সফল হতে পারিনি। লজ্জায় তাই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। সে কথায় পরে আসছি। তার জন্য সারাজীবন আমার একটা অপরাধবোধ থেকে গিয়েছে।

বসিরহাট হাই স্কুল
এইসময়ে অনেক কিছু ঘটেছে যা আমার জীবনকে প্রত্যক্ষভাবে এবং পরোক্ষভাবে নাড়া দিয়েছে। দুটি ঘটনার উল্লেখ করি। প্রথম ঘটনা শুধু আমাকে নয় সারা দেশের প্রতিটি মানুষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে স্পর্শ করেছে। যদিও আমি যখন এ ঘটনার সাক্ষী হয়েছি তখন এর গুরুত্ব বা এর ক্ষত কত গভীর ও মারাত্বক হতে পারে সেটা বোঝার মত জ্ঞান বা বোধ আমার ছিল না। তখন আমার বয়স প্রায় দশ বছর। শুনতে পাচ্ছি দেশ স্বাধীন হবে। দেশে আনন্দের ঢেউ উঠেছে। আবার সেইসঙ্গে সকলের মনে যেন উদ্বেগ, আশঙ্কা, ব্যাথা। বিশেষ করে আমাদের আশেপাশের মানুষের মধ্যে। দেশ নাকি ভাগ হয়ে যাবে। মুসলমানদের জন্য নাকি একটা অন্য দেশ হবে। সেই অন্য দেশের নাম হবে পাকিস্তান। আমাদের শহর বসিরহাট সম্ভবতঃ পাকিস্তানে চলে যাবে। তা যদি হয় তবে কি হবে সেটা বোঝার মত বুদ্ধিমত্তা একটা দশ বছরের কিশোরের মাথায় ছিল না। শুধু লোকের মুখে শহরে বাজারে কথায় বার্তায় একটা ভয়, একটা উদ্বেগ। কি বুঝি বা হয়। ঘোষিত স্বাধীনতার দিন যত এগিয়ে আসতে থাকল তত সকলের মনে উত্তেজনা, আতঙ্ক ও প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করল। শহরের যে অংশে আমরা থাকতাম সে পাড়া গুলো হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ। অন্য দিকে অন্য অংশে মুসলমানের সংখ্যা বেশী। একদিন সন্ধ্যে বেলায় হঠাৎ দেখি ওদিকে মুসলমান গরিষ্ঠ অঞ্চলের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে – আগুন জ্বলছে। আর সেই সঙ্গে ভেসে আসছে ‘আল্লা-হো-আকবর’ ধ্বনি। আর এই দিক থেকে হিন্দুরা উচ্চস্বরে ধ্বনি তুলচ্ছে ‘বন্দেমাতরম’। সেদিন আমার সত্যি ভয় লেগেছিল।
কিছুদিন পরে দেশ বিভাগের সীমানা নির্ধারিত হল। আমাদের শহর আমাদের জেলা ২৪ পরগনা ভারতবর্ষের মধ্যে থেকে গেল। প্রায় কান ঘেঁসে পড়ল দেশ বিভাজনের তরবারির আঘাত। তিন চার মাইল দূরে টাকি শহরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। সেই ইছামতী নদী দুই দেশের সীমানা – এখানে এরই জল ভাগ করে দিয়েছে ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান। এ পারে ভারতবর্ষ ওপারে পাকিস্তান। এই ইছামতী নদী ধরে একটু উপরে উঠে এলে বসিরহাট শহর। আর সেই শহরেই ইছামতী নদীর ধারে আমাদের বাড়ি।
ভারতবর্ষের মানচিত্রের উপর সিরিল র্যাডক্লিফ (Cyril Radcliffe) সাহেব কলম দিয়ে দাগ টেনে নির্ধারিত করে দিলেন ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানের সীমানা রেখা। তাঁর এক কলমের আঁচড়ে ঠিক হয়ে গেল কোন গ্রাম, কোন শহর, কার বাড়ী, কার ঘর, কোন দেশে যাবে। আজ মনে করলে চমকে উঠি; যদি র্যাডক্লিফ সাহেবের কলম ইছামতী নদীর কাছাকাছি এসে একটু সরে গিয়ে নদীর উত্তর দিক দিয়ে যেত তবে আমার এবং আমার পরিবারের জীবনের দিক পরিবর্তন হত এবং তা যে আমাদের কোথায় নিয়ে যেত তা ভাবতে ভয় হয়। রাতারাতি লক্ষ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ আঁকা হয়ে গেল এক কালির দাগে। কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, কোন যুদ্ধ নয় তবু লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন বাস্তুচ্যুত হল।
আমার চোখের সামনে কিছু হয় নি, এই দুর্যোগ প্রত্যক্ষভাবে আমাকে ছোঁয় নি। শুধু দেখেছিলাম আমার এক মুসলমান বন্ধু সপরিবারে বাড়ি ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেলো। পরের দিনই এক হিন্দু পরিবার সেই বাড়িতে এসে উঠেছিল। এই দুই পরিবার স্ব ইচ্ছায় নিজ নিজ বসত বাড়ি শান্তিপূর্ণ ভাবে বদল করেছিল। কিন্তু অন্যত্র সে রকম হয় নি। আগুন জ্বলেছে, রক্ত ঝরেছে, হিংসা গ্রাস করেছে মনুষ্যত্বকে। কুখ্যাত নোয়াখালি-কলকাতার দাঙ্গা, হিংসায় উন্মত্ত মানুষ শুধু ধর্মের নিরিখে একে অন্যকে নির্বিচারে হত্যা করছে। মৃতদেহ ছড়িয়ে রাস্তায়, ঘাটে, বাড়ির দরজার সামনে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ট্রেনে বাসে গরুর গাড়িতে, বা শিশুরা বাবা মায়ের কোলে চড়ে, বৃদ্ধেরা সবলের পৃষ্ঠে বা স্কন্ধে চেপে পদযাত্রায় চলেছে গন্তব্যের দিকে। কিন্তু গন্তব্যের শেষ কোথায় কেউ জানে না। ভয় আর অনিশ্চয়তা তাদের পথে নামিয়েছে। নিজেদের জন্মভূমি ঘর বাড়ি সম্পত্তি আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব পরিচিত সব পিছনে ফেলে নিরুদ্দেশে পাড়ি দিয়েছে। প্রধানতঃ হিন্দুরা ভারতবর্ষের দিকে, মুসলমানরা পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে। সেই বয়সে সব কিছু বুঝিনি। বড় হয়ে উদ্বাস্তু বন্ধুদের মুখে, ছবিতে ফিল্মে গল্পে উপন্যাসে শুনেছি দেখেছি পড়েছি সেই রোমহর্ষক দুর্দশার দৃশ্য। আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে গৃহহীন শরণার্থী অগণিত মানুষের এমন যাত্রার নজির নেই।
এতকাল পরে আজ-ও আমার চোখের সামনে জেগে উঠে সেই লাল আকাশ আর কানে ভেসে আসে সেই আল্লা-হো-আকবর ও বন্দেমাতরম ধ্বনি।
কলকাতায় কলেজ জীবনে প্রাকযৌবনের দ্বন্দ্ব ও এইসব অভিজ্ঞতা আমাকে পীড়িত করেছিল। সেই সময়ের লেখা আমার এক কবিতার অংশে ধরা আছে আমার সেই যন্ত্রণা।
যুগ চেতনা ও যুবকটি।।
এক,
অর্বাচীন
তোমার জন্মকালে কুলীন
আকাশ ছিল ক্লিন্ন, ধুমার্ত
হিরোশিমা নাগাসাকির আর্তনাদে আর্যাবর্ত
শিহরিত, লজ্জায় স্তব্ধ ছিল
তোমার জন্মমুহূর্তের মঙ্গল শঙ্খ ।
উত্তীর্ণ যৌবন রক্তস্নাত হল হিংসুক দাঙ্গায়
শরণার্থী মানুষের আর্তরোলে চাপা পড়ল
বিপ্রলব্ধ স্বাধীনতার দুন্দুভি ধ্বনি
বিবৎসায় দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল
নষ্টনীড় পাখিরা ।
ভয়ে আর ডামাডোলে বিস্ফারিত প্রাকযৌবন
মলিন হল, রুদ্ধ হল , মরল শেষে গুমরে ;
যুগল বিপ্লব অতিক্রান্ত পৃথিবী
নরমেধ যুদ্ধদৃস্ট পৃথিবী
বিবর্তনে বিবর্তনে বৃদ্ধ পৃথিবী
তোমার যৌবন শেষের আগেই অনুর্বর হল ঋণে ঋণে
দিনে দিনে
তাই ভারসাম্য হারা যৌবন নৈরাজ্যের চক্রাবর্তে
চূর্ণ হল, বাচাল হল
হতাশার চক্রবৃদ্ধিতে দেউলিয়া হলো সৃজনী ।
দুই,
যদ্যপি মনসি বিদ্ধ
শান্তি পাব না শান্তি পাব না কদাপি
অনিবার্য কামনায় মিলতে চাই তথাপি,
অথচ প্রায় স্বতঃসিদ্ধ স্তিমিত উৎসাহে উদ্দেশ্য বেপথু
যৌথ জীবনের ফসলে ভবিষ্যৎ পেতে চাই যেহেতু।
কখনো বা শুচিনিষ্ঠ দৃঢ় সংকল্প প্রত্যয়
শপথ নিই দুরত্যয় বাধা ভাঙবার
পরক্ষণেই সমস্ত সত্তা ঘিরে আসে হতাশা ,
সংকল্পের দিশা হারাই কর্তব্যের দোহাই দিয়ে।
মায়া বাদে বিশ্বাস স্থিতি হয় অচিরাৎ ।
সবই মায়া, অসার সংসার
তুমি কার কে তোমার ।
অন্তঃস্থ প্রেমে অন্বয়ী জীবন
কদাচিৎ উৎক্ষিপ্ত প্রদাহে । সংযত বিনিময়ে
অবিশ্বাসী অর্বাচীন মন
চার্বাক মন্ত্র জপে সময়ে সময়ে ঃ
নাস্তি প্রেম, নাস্তি দেব ,
ইষ্ট শুধু উষ্ণ মেদ ।।
একঘেয়ে জীবন, বৈচিত্র্যহীন অধুনা
মাঝে মাঝে নৈশ কক্ষে হানা দেয়
সুচরিতা, গ্রুশেঙ্কা, নানা,
গঁগ্যার তাহিতির মেয়ে,
অবনীন্দ্রনাথের শকুন্তলা,
মোনালিসা , ম্যাডোনা –
আদিমতা প্রেম দাঁতের যন্ত্রণা ।
জীবনের অর্থ পর্যন্ত জানিনা ।
বাঁচা নয়, এসো তবে টিঁকে থাকি
টিঁকে থাকি শুধু সব ফেলে দিয়ে
তোমার রুচি আমার বুদ্ধি
আমার স্বাতন্ত্র্য তোমার প্রতীতি
তুমি আমি শুধু টিঁকে থাকি
জীবনের বিকল্পে হিমস্বপ্ন স্থবিরতা নিয়ে ।।
তিন,
হঠাৎ কখনো নীল হয়েছে আমার আকাশ
চরাচরে আভাতি আলোর রোশনাই
সূর্যরং চাঁদরং গোধূলিরং
একাকার হয়েছে দিগন্তে ;
আমার সত্তা ঘিরে আবেশ নেশা
মৃত্যু নেশা জীবন নেশা সৃষ্টি নেশা তাই ।
অশান্ত সীমান্তে নীল হিমালয় শুভ্র নীল
নীল নেশাতুর ক্লান্ত গণিকার চোখে নীল রাত
কামনায় নীল, সমুদ্র নীল , নীল ডানিয়ুব ,
নীলরক্ত মমতায় হিংস্র নাৎসি , মৃত্যুদংশনে
নীল লক্ষিন্দর , কৃষ্ণপ্রেমে রাধা নীল ।
নীলাক্ষি ইঙ্গিতে জর্জরিত স্বপ্ননীল বণিক
নীলাঞ্চলে বাঁধা লজ্জানীল প্রেমিক
নীল মেঘের দীপ্তিতে উল্লসিত নীলগাই
শেষহীন নীলে আনত বিশ্ব ঠাঁই ।
শ্যামলে শ্যামলে তুমি
নীলিময় নীল
তোমার নিখিলে মম বেধ ব্যাপ্তি নিমেষে বিলীন ।।
----
লেখকের সংবেদন গ্রন্থের অন্তর্গত কবিতা ‘যুগ, চেতনা ও যুবকটি’।
পুনশ্চ:
আমাদের বাড়ির কাছাকাছি একটা ক্লাব ছিল। নাম ব্যায়ামপীঠ। এখানে একটা ছোট জিম ছিল – ওয়েটলিফটিং, পারালেল বার, রিং ইত্যাদি নানারকম ব্যায়ামের জিনিষ পত্র ছিল। সেইসঙ্গে এখানে বক্সিং, লাঠিখেলা, ছুরিখেলা শেখানো হোতো। প্রায়ই যেতাম আমি এই ক্লাবে। বেশ কিছুদিন আমি এখানে বক্সিং ও লাঠিখেলার তালিম নিয়েছিলাম। স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে বসিরহাট শহর খুবই সক্রিয় ছিল। এই শহরেরই এক যুবক আমাদেরই পাড়ার ছেলে দীনেশ মজুমদার স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিল এবং শহীদ হয়েছিল। এই শহরের যুবকদের উপর তাই ইংরেজ সরকার সতর্ক চোখ রাখত। ব্যায়ামপীঠও তাই ইংরেজ কর্তাদের কড়া নজর এড়াই নি। এই ক্লাবে অনেক লোকের আনাগোনা ছিল --- পুরানো সদস্য, পার্টির লোক, কাউন্সিলার, ইত্যাদি নানা রঙের মানুষ। এদের মধ্যে একজনের কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে। সবাই তাকে তারাপদদা বলত। ছোটখাট বলিষ্ঠ চেহারা। তিনি এলে ছেলেরা তাকে ঘিরে থাকত। তিনি একটু অন্য রকমের কথা বলতেন — দেশের অবস্থার কথা, সমাজের কথা, আদর্শের কথা।
ক্রমশ:
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।