ছবি: রমিত
সল্টলেকের বাড়ি
সল্টলেকের জীবন আমার যুগপৎ আনন্দ ও দুঃখের কাহিনি। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি – অলীক স্বপ্ন, অবাস্তব স্বপ্ন, অকল্পনীয় ইচ্ছার রূপায়ণ। আমি তখন ইংল্যান্ড পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম। অত্যন্ত আশাবাদী ও কল্পনাবিলাসী হয়েও আমি কখনো কলকাতায় বাড়ি করার স্বপ্ন দেখিনি। শুনেছিলাম মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় কলকাতার সল্টলেকে এক নতুন শহর গঠনের পরিকল্পনা করছেন এবং সেখানে জমি কেনার জন্য সরকার আবেদন করার বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
একদা আমাদের বাড়িতে খোকনের (বিমলেন্দু) এক বন্ধু কনক আসত। কনক মজুমদার সরল, পরোপকারী, সদা হাস্যমুখ। মাকে মাসিমা বলত, আমাকে ডাকত ‘দাদা’ বলে। হাঁদি, চিমু, খুকু ও নিমুর কাছে সে কনকদা। ক্রমে কনক আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেল। মায়ের যেন আর এক ছেলে। কনক সকলের প্রিয়। অসময়ে কনক এসে দাঁড়িয়েছে এই পরিবারের পাশে। মা যখন গৃহহীন অসহায়, হালদার কাকিমার বাড়িতে পরাশ্রয়ী, সেই সময় কনক অসুস্থ বাবা ও মা হাঁদি চিমু খুকু নিমুর জন্য সামান্য ভাড়ায় একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। অবশ্যই খোকন ছিল কনকের সঙ্গে।
তার অনেকদিন পরে আমরা তখন কলকাতায় চলে এসেছি। কনক রাইটার্স বিল্ডিং-এ কাজ করত। একদিন হঠাৎ এসে বলল, “দাদা, কলকাতায় যাদের বাড়ি নেই তাদের জন্য সল্টলেকে জমি দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। ওখানে জমি নেওয়ার তোমার কি কোনো ইচ্ছা আছে? যদি থাকে তবে বলো আমি তোমার জন্য একটা আবেদন পত্র (Form) এনে দেব।” সল্টলেক সম্পর্কে সাধারণের মতামত তখন ইতিবাচক ছিল না। জলাজমির ওপর বাড়ি কি করা যাবে? তাছাড়া আমি তখন কোনরকমে সংসার চালাই; কোনোদিন বাড়ি করার মত সামর্থ্য যে হবে না তা প্রায় নিশ্চিত। তবু আমি তো স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। অসম্ভবের নৌকো আমি চিরদিনই জলে ভাসিয়েছি। কনককে বললাম ফর্ম এনে দিতে। কনক দুটো ফর্ম এনে দিল, একটা আমার আর একটা খোকনের। আমরা দু’জনেই ফর্ম জমা দিলাম।
কনক আরও একটা অভাবনীয় কাজ করে ছিল। আমি তখন ইংল্যান্ডে আসার জন্য জাহাজের টিকিটের টাকা যোগাড় করছিলাম। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন সকলের কাছে হাত পাতছি। কনককে এ কথা কোনোদিন বলিনি, কেন না বলতে ইচ্ছা করেনি। তবে কনক জানতে পেরেছিল। একদিন হঠাৎ এসে সাড়ে চারশো টাকা এনে আমার হাতে দিল। “দাদা, এটা তোমাকে নিতেই হবে।” কি আশ্চর্য্য ছেলে, কি উদার মন! কনকের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।
কনক অনুরও প্রিয়ভাজন ছিল।
বহুদিন পর প্রথমবার যখন ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় গেলাম তখন কনকের অর্থঋণ শোধ করে দিলাম। কিন্তু মানবিকতার ঋণটা ররেই গেল। কনক সেদিন ফর্ম এনে না দিলে সল্টলেকে আমার কোনোদিন বাড়ি হত না। বড় দুঃখের কথা অকালে কনক আমাদের ছেড়ে চলে গেল।
ইতিমধ্যে আমি ইংল্যান্ডে এসেছি, সল্টলেকের কথা ভুলে গেছি। একদিন হঠাৎ খোকনের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। সরকার জানিয়েছে সল্টলেকে আমি জমি পেয়েছি। আমি ও খোকন একইসময়ে একইসঙ্গে আবেদন পত্র পাঠিয়েছিলাম এবং আমাদের দু’জনেরই আবেদন সফল হয়েছিল। আমরা দুজনেই জমি পেয়েছিলাম। আমি যথাসময়ে নির্ধারিত টাকা জমা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে নিলাম। এ ব্যাপারে খোকন আর অন্যান্য ভাইরা এবং মা যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। সল্টলেকে বাড়ি করার উদ্যোগ ও উৎসাহ সব চেয়ে বেশি মা-র। একবার বাড়ি হারানোর পর আবার যে কোনোদিন নিজের বাড়ি হবে তা বোধহয় মা কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি। তাই বোধহয় এত আনন্দ এত উৎসাহ। বাড়ির ভিত পত্তনের শুরু থেকে শেষ ইট গাঁথা পর্যন্ত মা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করেছে। ঝড়-বাদল অগ্রাহ্য করে, ভরা গ্রীষ্মে কাঠফাটা রোদে বসে থেকেছে বালি-ভরা খোলা মাঠে। ও বাড়িটা মায়ের আরেকটা প্রাণ। দুঃখের বিষয় খোকন জমিটা পেয়েও ছেড়ে দিল।
খোকন তখন লেকটাউনে একটা ভাড়ার ফ্লাটে থাকত। মা ও খুকু, নিমুও খোকনের পরিবারের সঙ্গে থাকত। অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে সাত জন মানুষ। খোকন, ইলা, পিউ ও ছোটন আর মা, খুকু ও নিমু। যতদূর মনে পড়ছে হাঁদি ও চিমু ওদের চাকুরিসূত্রে অন্যত্র থাকত। লেকটাউন থেকে সল্টলেক আসার কোনও সহজ ও সোজা রাস্তা ছিল না। একটা সেতু পেরিয়ে হেঁটে বা রিক্সা করে সল্টলেকের জমির বাড়ি দেখতে আসতে হত যতদিন বাড়ি শেষ না হয়েছে ততদিন মা কষ্ট করে এই কাজটি করে গেছে।
ইরান থেকে ফিরে আসার পর হাতে কিছু টাকা জমেছিল। সেই টাকা আর সাউথ হ্যারোর বাড়ি বিক্রি করে একটা বড় ফোর-বেডরুম ডিটাচড বাড়ি কিনলাম লন্ডনের হ্যারোতে।
আমাদের লন্ডনের বাড়ি। ৯ নর্থউইক এভেন্যু, হ্যারো। বরফে ঢাকা। আশির দশকে।
আমাদের লন্ডনের বাড়ি। ৯ নর্থউইক এভেন্যু, হ্যারো। ২০২৫ সালে।
একই সঙ্গে সল্টলেকের গৃহ নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। লন্ডনে বাড়ি কিনতে গিয়ে জমানো টাকা সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সল্টলেকের বাড়ি, সি এফ ২৩১, একতলা সমাপ্তির পর, ১৯৮১ সালের ছবি
রাত্রে সল্টলেকের বাড়ি , সি এফ ২৩১, ২০১৬ সালের ছবি
সুতরাং সল্টলেকের বাড়ি আমাদের মাসিক নিয়মিত আয় দিয়েই করতে হচ্ছিল। অনু ইতিমধ্যে বাইরে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছিল। সেই সময় অনুর রোজগার সল্টলেকের বাড়ি করতে খুব সাহায্য করেছিল। তা না হলে হয়ত আরও দেরি হত বা অনেক টাকা ধার করতে হত। বাড়ির নকশা করা হয়েছিল দু’তলার, কিন্তু একতলা শেষ হয়ে গেলে মাকে বললাম সল্টলেকের বাড়িতে চলে আসতে, পরে ধীরেসুস্থে দু’তলা করা যাবে। ঠিক হল মা খুকু নিমুকে নিয়ে নতুন বাড়িতে চলে আসবে। মায়ের এতদিনের সাধ পূর্ণ হবে। আমি ভাগ্যবান, মাকে বাড়ি করে দেওয়ার মত সামর্থ্য হয়েছিল বলে। বাবার কথা বার বার মনে পড়ছিল। শেষ জীবনে একটা
নিকৃষ্ট ভাড়া বাড়িতে রোগশয্যায় দিন কাটাতে হয়েছে। আমি বাবার জন্য কিছু করতে পারিনি, আমি বাবাকে শান্তি দিতে পারিনি। এ আফসোস আমার কোনোদিন যাবে না।
মা নতুন বাড়িতে আসার জন্য প্রস্তুত কিন্তু খোকন মনস্থির করতে পারছে না মার সঙ্গে সল্টলেকের বাড়িতে আসবে কিনা। কিছুদিন দোটানায় থাকার পর শেষপর্যন্ত খোকন সিদ্ধান্ত নিল যে ও-ও মার সঙ্গে নতুন বাড়িতে চলে আসবে। কথা হল, খোকন ওর কোম্পানি থেকে বাড়ি ভাড়ার যে টাকা পায় সেটা মাকে দেবে। হাঁদি, চিমু মাকে নিয়মিত টাকা পাঠায়, আমিও দিই। তাছাড়া দেশ (গোকুলপুর) থেকেও মাঝে মাঝে আম বিক্রি, মাছ বিক্রি, জমি বিক্রির টাকা আসে। সুতরাং সব মিলে মায়ের তিন জনের সংসার ভালোমতো চলে যাবে।
কিন্তু যেমন ভাবা গিয়েছিল তেমন হল না। অচিরেই সংসারে ফাটল দেখা দিল। মা আর ইলার মধ্যে কোনো সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। প্রায়ই সংসারের ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে অশান্তির সৃষ্টি হত। কারণ হয়ত অনেক ছিল। দু’জনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চরিত্রগত পার্থক্য ছিল। মা চুপচাপ থাকত কিন্তু মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পারতাম। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। একটা কারণ অবশ্য স্পষ্ট ছিল। এক রান্নাঘর, দুই সংসার। এক রান্নাঘর, দুই নারী মনমালিন্যর সম্ভাব্য উপকরণ। তাছাড়া রান্নাঘরের চাবিকাঠি ছিল তখন ইলার হাতে। ইলার সঙ্গে খুকুর সম্পর্কও মধুর ছিল না।
খুকু আমাদের বড় আদরের। পাঁচ ভাইয়ের এক বোন, আমাদের সকলের প্রিয় তো বটেই। অথচ ওর জন্য মায়ের চিন্তার শেষ নেই। বি-এ পাস করে ঘরে বসে আছে। মা ওর বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক সম্বন্ধ আসছে কিন্তু কোনোটাই পাকা হচ্ছে না। শরীরটাও ঠিক ভালো নেই ওর। আইবুড়ো ননদকে ইলা বোঝা মনে করেছিল - ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিতে পারেনি। সংসারের কাজ আর সকলের ফাই-ফরমাস খেটে খুকুর দিন কাটছিল। ইলা দক্ষিণেশ্বরের একটা স্কুলের শিক্ষিকা ছিল। খোকন ই এম সি নামে এক ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে উঁচু পদে কাজ করত। দুজনেই সকালে উঠে কাজে বেরিয়ে যেত। দুটি ছেলেমেয়ে, পিউ ও ছোটনকে রেখে যেত মা আর খুকুর কাছে। মা ও খুকু ওদের ছেলেমেয়েকে সারাদিন দেখশুনো করত।
আমরা সবাই খুকুর জন্য চিন্তায় ছিলাম। অনু আমাকে বলল খুকুকে লন্ডনে নিয়ে আসার জন্য। মা ওর বিয়ের জন্য দেশে চেষ্টা করছে আমি তাই অনুর কথায় খুব একটা উৎসাহ দেখাইনি। কিন্তু অনু আমাকে প্রায় প্রতিদিন আমাকে খুকুকে এখানে আনার কথা বলতে থাকল। আমি মাকে বললাম, মা রাজি হল, খুকুও। শেষ পর্য্যন্ত খুকু লন্ডনে এলো। এবং বেশকিছু দিন ছিল আমাদের সঙ্গে এই নর্থউইক আভেন্যুর বাড়িতে। বোধহয় মাস ছ’য়েক ছিল। অনেকদিন পরে মা ও খোকনের মেয়ে পিউকেও এনেছিলাম লন্ডনে।
কিছুকাল লন্ডনে কাটিয়ে খুকু দেশে ফিরে গেল।
খুকুর বিয়ের চেষ্টা চলতে থাকল। মেজমামা ঘটকালিতে সিদ্ধহস্ত। কত মেয়ের যে বিয়ে দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। সেই মেজমামাই অনেক বার অসফল হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত খুকুর জন্য পাত্র পেলেন – পাত্র উকিল, পাবলিক প্রসিকিউটর, হাওড়াবাসী। বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। খুকুর বিয়ের জন্য আগেই আমি টাকা পাঠিয়েছিলাম, আবার পাঠালাম। হাঁদি চিমু সবাই দিল। খুকুর বিয়ে হবে আর আমি থাকব না, অনু থাকবে না, এটা ভাবা যায় না। কিন্তু আমার কোনও উপায় নেই। অনু আমি বুবাই গৌতম সকলকে নিয়ে দেশে যাওয়ার মতো সামর্থ্য নেই আর। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। অনু বারবার বলতে থাকল, “তুমি একাই যাও।” কিন্তু আমার মন তাতে সায় দিচ্ছিল না। মনকে বোঝালাম যাওয়া হল না বলে আফসোস কোরো না। বিয়ের দিন এগিয়ে এলো। শেষ মুহুর্তে হঠাৎ একদিন অনু আমার হাতে একগোছা টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, “এই নাও, এখনই টিকিট কাটো। খুকুর বিয়েতে তুমি যাবেই।”
আমি তো অবাক। অনু টাকা পেল কোথা থেকে। ওর নিজস্ব কোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। আমাদের দু’জনের একটাই জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। ওর মাইনের টাকাও আমাদের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টেই জমা পড়ে। ওর কাছে কোনও চেক বই নেই। ও চেক বই রাখতে চায়নি। বলত, “আমার দরকার হলে তোমার কাছ থেকে চেয়ে নেব।” আমি অবশ্য কোনোদিন ওর কোনো অভাব রাখিনি। আমার অনেক আপত্তি সত্বেও একটা টিকিটই কাটা হল। আমি জানতে চেয়েছিলাম ও টাকা পেল কোথা থেকে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর ও বলেছিল ওর এক সহকর্মিণীর কাছ থেকে টাকাটা ধার করেছিল। আশ্চর্য!
কলকাতায় এলাম। সল্টলেকের বাড়িতে সাড়ম্বরে খুকুর বিয়ে সারা হল। খুকুর বিয়ে হয়ে গেল দেখে আমার খুব ভালো লাগল। না এলে সারা জীবনের জন্য একটা আফসোস থেকে যেত। অনুর অনুপস্থিতিটা মাঝে মাঝে অস্বস্তির কাঁটা ফোটাচ্ছিল। একা আসার অপরাধ বোধ দূর করতে সেকালে এক নতুন ভিডিও ক্যামেরা কিনে অনুষ্ঠানের পুঙ্খানুপুঙ্খ ভিডিও দেখাবার প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলাম অনুকে।
সল্টলেকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েও খুকু মেজবৌদি, অর্থাৎ ইলার তির্যক উক্তি ও দুর্ব্যবহারের হাত থেকে রেহাই পায়নি। খুকুর কাছে যেসব গল্প শুনেছি তা অকল্পনীয়।
সল্টলেকের বাড়ির সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে এ বাড়িতে বিবাহবাসর হয়েছে অনেক। আমার মেজ কাকা সাতটি নাবালক ছেলেমেয়ে রেখে অকালে মারা গিয়েছিল, তিন ছেলে আর চার মেয়ে। মা কাকিমাকে খুবই ভালবাসত। মনে হয় সেই জন্যই কাকিমার থেকে মায়ের চিন্তা ছিল বেশি কেমন করে চারটে মেয়ের বিয়ে হবে। ভাবলে অবাক হয়ে যাই, নিজের মেয়ের বিয়ের চিন্তা ও সংসারের এত সব সমস্যা সামলানোর পরেও কাকিমার মেয়েদের বিয়ের চিন্তা করার সময় ও মানসিকতা পেল কোথা থেকে মা। মায়ের উদ্যোগে ও তত্বাবধানে একে একে কাকিমার চার মেয়ের বিয়ে এই সল্টলেকের বাড়ি থাকেই সম্পন্ন হয়েছিল। মায়ের জীবিতকালে অনেক বিবাহবাসরের আয়োজন হয়েছে এ বাড়িতে। হাঁদি, চিমু, খুকু, নিমু, আমার ছেলে বুবাই – সকলেরই ফুলশয্যা হয়েছে এই বাড়ির এক বিশেষ ঘরে। মা চলে যাওয়ার পর কিছুকাল আগে এ বাড়ির শেষ বিবাহ বাসর চিমুর মেয়ে তুলির।
কাগজে-কলমে সল্টলেকের বাড়িটা আমার, কিন্তু কার্যত বাড়িটা মায়েরই। মা ওটাকে নিজের মনের মতো করে তৈরি করে নিচ্ছে। এমনকী মা আমার তৈরি নকশা পর্যন্ত পালটে দিয়েছিল এক জায়গায়, আমাকে জিজ্ঞসা না করেই। আমি কিছু মনে করিনি, মা যাতে খুশি হয় তাই করুক। সোয়া পাঁচ কাঠা জমির ওপর বাড়িটা বেশ সুন্দর হয়েছিল। তিনটে বড় বড় শোবার ঘর, একটা বড় বসার ঘর, বড় রান্নাঘর যেখানে জনা ছ’য়েকের এক খাবার টেবিল, আর মাঝখানে বিরাট ডাইনিং হল। আমার জন্য যে শোবার ঘর করেছিলাম তার সংলগ্ন স্নান ও শৌচাগার ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ ঘরে আমার কখনো থাকা হয়নি। প্রধান শোবার ঘরে খোকন ইলা থাকত ওদের দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে। এছাড়া বাড়িতে ছিল মা, খুকু, নিমু। যতদূর মনে পড়ছে চিমু-তপতীও থাকত তখন সল্টলেকে। সুতরাং বাড়ি ভরতি, খালি ঘর নেই একটাও। আমি অনু যখন দেশে যেতাম ছুটিতে তখন আমাদের থাকার জায়গা থাকত না। বুবাই গৌতম বড় হয়ে ইউনিভার্সিটিতে চলে গিয়েছিল। আমরা তাই দু’জনেই যেতাম দেশে প্রায় এক মাসের জন্য। আমাদের কোনো থাকার ঘর ছিল না। মা তার খাট ছেড়ে দিত আমাদের জন্য। কিন্তু অনু সেটা পছন্দ করত না। মনে আছে বসার ঘরে মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়েছি আমরা অনেক দিন।
এক ঘরে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে খোকনেরও বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। তাছাড়া রান্নাঘর একটা, ইলার সঙ্গে খুকু ও মার বনিবনার অভাব ইত্যাদি তো ছিলই। মা আমাকে বলতে লাগল, “খোকা, তুই দু’তলায় দুটো ঘর ও রান্নাঘর করে দে। খোকনরা ওপরে চলে যাক।” আমার তখন আর খরচ করার সামর্থ্য নেই, একেবারে কপর্দকশূন্য। আমার ইচ্ছা দোতলায় অনেক খরচ করে উচ্চ মানের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সুন্দর ফ্লাট তৈরি করব নিজের জন্য। কিন্তু সেটা তো এখনই হবে না। তারজন্য সময় লাগবে, অপেক্ষা করতে হবে।
গয়াদা অনেক দিন ধরে মাসিমাকে (গয়াদার মাকে) লন্ডনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মাসিমা তো একা আসতে পারবে না। কারোর সঙ্গে আসতে হবে। কিন্তু কে? গয়াদা যদি গিয়ে নিয়ে আসে তবে গয়াদাকে দু’বার যাতায়াত করতে হবে। খোকনকে আমি বলেছিলাম আমি ওকে লন্ডনে নিয়ে আসব। কিন্তু হয়ে উঠছিল না। গয়াদা প্রস্তাব দিল খোকন যদি মাসিমাকে নিয়ে আসে তবে গয়াদা খোকনের টিকিটের অর্ধেকটা দেবে। আমি এ সুযোগ ছাড়লাম না। খোকন রাজি হয়ে গেল। তবে ইলাও আসবে। ঠিক হল ইলার টিকিটের ব্যবস্থা ওরাই করবে। খোকন ও ইলা মাসিমাকে সঙ্গে করে লন্ডনে চলে এলো। গয়াদার বাড়িতে গয়াদার ইংরেজ জায়া মেরিলীন ও তিন কন্যা, কেউই বাংলা বলে না। মাসিমার খুব স্বস্তিতে দিন কাটত। মাসিমা সময় পেলেই শান্তিদির বা আমাদের বাড়ি চলে আসত। খোকন ইলা কয়েকদিন লন্ডনে থেকে ইউরোপ বেড়াতে গেল। ইউরোপ ঘুরে খোকনরা লন্ডনে ফিরে এলো আবার। বুবাই তখন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনিভার্সিটিতে, গৌতম কার্ডিফে। খোকনদের নিয়ে গাড়ি করে ইংল্যান্ড ঘুরতে বের হলাম। বুবাই গৌতমের সঙ্গে দেখা করতে ম্যাঞ্চেস্টার, কার্ডিফেও গেলাম। পিক ডিসট্রিক্ট, শেক্সপীয়রের বাড়ি ইত্যাদি বেড়িয়ে গল্প করে দিনগুলো ভালই কাটছিল।
এমনই এক দিনে খোকন বলল, “দাদা, সল্টলেকের অনেকে তাদের বাড়ির ছাদ বিক্রি করছে। তোমার বাড়ির ছাদটা আমাকে বিক্রি করবে?” খোকন অনেকদিন থেকেই একটা ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিল না। কিছুদিন আগে একটা ফ্ল্যাটের জন্য টাকা জমা দিয়েও সেটা হাতছাড়া হয়ে যায়। ও মরিয়া হয়ে বাড়ি খুঁজছে আর আমরা সকলেই মনে প্রাণে চাই খোকনের নিজস্ব একটা বাড়ি হোক। খোকনের কথা শুনে আমি অবাক! এমন হয় নাকি?
আমি ভাবতে লাগলাম, আমার চিরদিনের ইচ্ছা আমি দোতলায় ঘর করে চলে যাব আর খোকনরা নিচে যেমন আছে তেমনি থাকবে। খোকনের এই প্রস্তাবে রাজি হলে আমার সব পরিকল্পনা ওলট পালট হয়ে যাবে। অন্যদিকে খোকনের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল লন্ডনে পাড়ি দেওয়ার পর থেকেই। ওকে আমি ভালোবাসি, অনুও। ও কিছু চাইলে আমি কোনোদিন না করিনি। তাছাড়া আমার মনের মধ্যে ওর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ কাজ করছে। আমার ইংল্যান্ড আসার ঠিক হয়ে গেলে ও হাসিমুখে বলেছিল, “দাদা, তুমি যাও। আমি আছি।” ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে সায় না দিলে আমি দ্বিধায় পড়তাম। অবশ্য আমি যখন একবার মনস্থির করে ফেলেছিলাম তখন আমি আসতামই। হাঁদি চিমু তখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। শুধু খুকু নিমুর পড়াশুনা শেষ হয়নি তখনও। মায়ের একটু কষ্ট হত। তবে একটা ব্যবস্থা হয়ে যেত ঠিকই। মা তো বাধা দেয়নি।
অনুর সঙ্গে পরামর্শ করব। খোকনের কথা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। মা কাছে নেই যে মার সঙ্গে পরামর্শ করব। তবে মা তো আগেই বলছিল, “ওপরে খোকনকে দুটো ঘর করে দে।”
তবে সেটা বোধ হয় একেবারে দিয়ে দেওয়ার কথা মনে করে বলেনি। অনুকে জিগ্যেস করেছিলাম। ও কি বলেছিল আজ আর মনে নেই। তবে নিশ্চয়ই আপত্তি করেনি, করলে আমি খোকনকে কি বলতাম জানিনা। সাধারণত অনু যা বলে হয়ত তাই বলেছিল, “তুমি যা ভাল বোঝ, তাই কর।”
খোকনকে বললাম, “আমি যদি দিই তবে এমনি দেব। পয়সা নেব না।”
লন্ডনের বাড়িতে এই নিয়ে আরও কয়েকবার কথা হল খোকনের সঙ্গে। ফিরে যাওয়ার আগে আমি ওকে কথা দিলাম। “দোতলাটা তুই করে নে, তবে আমার জন্য দুটো ঘর রেখে দিস।”
কলকাতা গিয়ে খোকন আর সময় নষ্ট করেনি। বিদ্যুৎগতিতে কাজ শুরু করে দিয়েছিল। আর্কিটেক্ট, উকিল, ও বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করতে আরম্ভ করল। টেলিফোন, চিঠি ও সাক্ষাতে এই নিয়ে কথাবার্তা হত নিয়মিত। খোকন বলল ওর অংশটা ওকে লিখে দলিল করে দিতে হবে। আমি যখন ওকে দেব বলেছিলাম তখন ভাবিনি যে আমাকে দলিল করে দিতে হবে। ভেবেছিলাম আমার কথাই তো যথেষ্ট। আমি তো আমার বুদ্ধির পরামর্শ নিয়ে ওকে কথা দিইনি, আমার হৃদয় বলেছিল তাই ওকে দিয়েছিলাম। আমি দ্বিধায় পড়লাম। কিন্তু কথা যখন দিয়েছি তখন তা আর ফেরত নেওয়া যায় না। আমি বললাম, “ঠিক আছে, আমি তোকে লিখে দেব।” এরপর আরো খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা শুরু হল। ওর অংশ কিভাবে নির্ধারিত হবে। আমি বললাম তুই নক্সা করে পাঠিয়ে দে আমি তাতে তোর ফ্লাটের সীমানা নির্ধারিত করে দাগ দিয়ে দেব। কিছুদিন পরে উত্তর এলো, ওর উকিল বলেছে সরকারের আইন অনুযায়ী সল্টলেকের কোনও জমি বা বাড়ি ভাগ করা যাবে না। সল্টলেকের জমি বিক্রি বা হস্তান্তরিত করা যাবে না ভাই, বোন, বাবা, মা, পুত্র, কন্যা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তিকে। বাবা, মা, ভাই, বোন, পুত্র কন্যাকে সমগ্র বা কিছু শতাংশ অর্থের বিনিময়ে বা দান হিসেবে দেওয়া যেতে পারে।
আমি ক্রমশ এক অজানা জগতে পৌঁছে যাচ্ছি। এদিকে লন্ডনে আমার কাজের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে; ও তার সঙ্গে ডিপার্টমেন্ট সঙ্কুচিত হওয়ার জন্য চাকরির অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সল্টলেকের বাড়ি নিয়ে চিন্তা করার মত সময় ও মানসিক অবস্থা নেই। এই সমস্যা আমার প্রায় নিজের তৈরি; নিঃস্বার্থ, উদার হওয়ার আকাঙ্ক্ষার ফল। এত ঝামেলা নেওয়ার আমার কোনও প্রয়োজন ছিল না। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মায়ের জন্য বাড়ি করা। সে উদ্দেশ্য সারা হয়েছে। এবার একটু স্বস্তিতে থাকি। মনে হল পেছিয়ে আসি। কিন্তু খোকন অনেক আশা নিয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। এখন যদি ফিরে আসি তবে ওর সঙ্গে আমার একটা তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হবে যা আমি চাই না। আমার সব সম্পত্তির থেকে ওর ভালবাসা আমার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান; আমি তা হারাতে চাই না। আমি খোকনের কথায় রাজি হলাম।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। খোকন সল্টলেকের জমিরও এক-তৃতীয়াংশ চাইল অর্থাৎ তেত্রিশ শতাংশ। এবার মনে হল আমার ভালোবাসাকে ও আমার দুর্বলতা মনে করে ওর চাহিদা বাড়াচ্ছে। ওর প্রস্তাবে আমি দৃঢ় ভাবে না করলাম। আমি বলেছিলাম কুড়ি শতাংশের বেশি নয়। শেষ পর্যন্ত পঁচিশ শতাংশে রাজি হই। খোকন মহা উদ্যমে কাজ শুরু করে দিল। আর্কিটেক্ট, ল-ইয়ার, রাজমিস্ত্রি – কাজে লেগে গেল। নকশা তৈরি হল। দলিল তৈরি হল, ফ্ল্যাট তৈরি হল। আমার আর্কিটেক্ট নেই, ল-ইয়ার নেই, সারভেয়ার নেই, সময় নেই। আমি খোকনকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলাম। যা যা কাগজ পত্র পাঠাত তাই সই করে দিতাম – কারো সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই।
ফ্ল্যাট তৈরি হল। আমি দেশে গেলাম দলিল সই করতে। খুব সুন্দর ফ্ল্যাট হয়েছে। তিনটে শোবার ঘর, দুটো বাথরুম, রান্নাঘর আর মাঝখানে নিচের তলার মত মস্ত হল যা একসঙ্গে লাউঞ্জ ও খাবার জায়গা। সারা ফ্ল্যাটে মার্বেল পাথরের মেঝে। দক্ষিণে দুটো ব্যালকনি। ফ্ল্যাটের প্রবেশদ্বার সেগুন কাঠের, সাধারণ দরজার তুলনায় অনেক প্রশস্ত এবং বৃহৎ। ফ্ল্যাটটি বেশ ছিমছাম, উচ্চমানের। খোকন গর্বের সঙ্গে আমাকে সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। আমার ভাল লাগল। খোকন মহাখুশি। তবে খোকন কথা রাখেনি। নিজের ফ্ল্যাটটা বেশ বড় করে করেছে – পঁচিশ শতাংশের থেকে অনেক বেশি - প্রায় তিরিশ শতাংশের মতো। পঁচিশ শতাংশ হলে নিচেরতলার অর্ধেকের বেশি হত না। আমি লক্ষ্য করলাম কিন্তু খোকনকে কিছু বললাম না; সেদিন ওর আনন্দ-মুহূর্তকে আমি নষ্ট করতে চাইনি।
জন্মকাল থেকেই খোকনের সঙ্গে আমার একটা বিশেষ ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। ওর জন্য আমার মনের কোণে একটা কোমল স্থান ছিল। দেশ ছেড়ে আসার পর ওর সঙ্গে আমার অজস্র চিঠিপত্র ও ইমেলের আদান প্রদান হত। সেদিন চিঠি পত্রের বাক্সটা দেখতে দেখতে একটা পুরোনো ইমেল পেলাম। সে ইমেলে ও দুটো ঘটনার উল্লেখ করেছে - একটা কলকাতার ছাত্রাবস্থা কালে, অন্যটা ছেলেবেলার। ইমেলটা নিচে দিলাম।
তখন আমি কলেজে পড়ি এবং সেই সঙ্গে একটা টিউশনি করি - মাসে পনেরো-কুড়ি টাকা পাই (ঠিক অঙ্কটা মনে নেই)। পুজোর আগে একদিন খোকন ও আমি কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে ফুটপাথের দোকানে একটা ঝকমকে ফ্রক দেখলাম। আমাদেরর দু’জনেরই এত পছন্দ হল যে আমরা জামাটা থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। শেষপর্যন্ত আমি আমার মাসিক আয়েরও বেশি দিয়ে ফ্রকটা কিনলাম খুকুর জন্য। খোকন লিখেছে জামাটা পেয়ে খুকু আনন্দে লাফালাফি করেছিল।
দ্বিতীয় ঘটনা খুব ছোটোবেলায়। কালী পুজোর রাতে আমাদের পাড়ায় তুবড়ি বাজির প্রতিযোগিতা হত। আমি ভালো বাজি তৈরি করতে পারতাম। হাঁদি চিমু তখন খুবই ছোট। আমি খোকন ও হাঁদি চিমুকে নিয়ে তুবড়ী তৈরী করলাম। সেই তুবড়ি খোকনের নামে প্রতিযোগিতায় দিলাম।
আমাদের তুবড়ি দ্বিতীয় হল। খোকন খুশিতে গদগদ। আমার কথা আমি কাউকে বলিনি – এই সাফল্যর কৃতিত্ব ষোলো আনাই খোকনের।
এ সব কাহিনি আমার কিছুই মনে ছিল না। খোকনই ওর ইমেলে এ সব গল্প আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল।
আর খোকন লিখেছিল, “আমি নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করি যে আমি তোমার মতো ভাই পেয়েছি। তুমি আজকের পৃথিবীর মানুষের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ যুগে আমি যখন জীবনকে দেখি তখন আমার মনে হয় তোমার মতো ভাই রামায়ণ মহাভারতের কালেই সম্ভব।
... ... এখন যদি স্বয়ং ঈশ্বরও সামনে এসে দাঁড়ায় এবং বলে তুমি পরের জন্মে কি বর চাও তবে আমি বলব আমি তোমার মতো এক জ্যেষ্ঠভ্রাতা চাই।”
(নিচে ইমেলের হাই-লাইটেড অংশ)
খোকনের ইমেলটা
সেই খোকন, আমার প্রাণের ভাই, এখন আমার বাড়ির পঁচিশ শতাংশের মালিক অর্থাৎ এ বাড়ি এখন আর আমার একার নয়। আমি স্বেচ্ছায় দান করে দিয়েছি। দানপত্র বা Gift Deed-এ আমি সই করে দিলাম। খোকন কাউকে কিছু জানায়নি। গিফট ডিডে সাক্ষী হিসেবে পিউ সই করেছিল। দলিলে বাড়ির কোনো অংশ খোকনের নামে চিহ্নিত করা ছিল না। শুধু উল্লেখ ছিল অমলেন্দু বিশ্বাস তার ভ্রাতা বিমলেন্দু বিশ্বাসকে পঁচিশ শতাংশ দান করিতেছে। আক্ষরিকভাবে তার অর্থ হল, এই জমি CF231-র প্রতিটি ইঞ্চির পঁচাত্তর ভাগ আমার আর পঁচিশ ভাগ খোকনের। কিন্তু কার্যত দেখা গেল খোকন তিরিশ ভাগ অংশ অধিকার করে ফ্লাট করেছে। এবং তাছাড়া নিচের বসার ঘরটা পুরোপুরি নিজের মতো ব্যবহার করে ওর কনসালটেন্সির (consultancy) কাজের জন্য এবং নিজের ও পারিবারিক বন্ধু বান্ধব, অতিথি ও অনাহূত সাক্ষাতকারীদের জন্য। এবং প্রয়োজনে নিচের বাথরুম ও রান্নাঘরও। সুতরাং কার্যত খোকন সমস্ত বাড়িটাই ভোগ করে। খোকন হয়ত ওর ভাগ্যের কেরামতিতে চমকে গিয়েছিল। অনেক পরে একদিন কোনও এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তে আমাকে লিখেছিল “দাদা, তুমি ভগবানের মতো, এমন করে এযুগে কেউ কাউকে দেয় না।” তোষামোদ তখন আমাকে এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে আপ্লুত করেছিল।
মনে আছে দলিল সই করে বাড়ি ফিরে এলে মা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলেছিল, “খোকা এটা তুই কি করলি? এবার তো খোকন-ইলা আমাকে একদিন এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে।”
ক্রমশ: