সেবার যখন পরিবারের সবাই মিলে জলদাপাড়ার বনে বেড়াতে এসেছিলাম, ছিলাম মাদারিহাটে জলদাপাড়া সরকারী ট্যুরিস্ট লজে। জঙ্গলে হাতি সাফারি, বক্সা জয়ন্তী শর্ট ট্রিপ সম্পন্ন হয়েছে। একদিন পড়শি দেশ ভূটানের ফুন্টশিলিং এও ঘুরে আসা গেল। হাতে সময় আছে, তাই বনের ধারে সেল্ফ হেল্প গ্রুপের হস্তশিল্পের দোকানে কিছু কেনাকাটা করা হল। সময়টা ডিসেম্বরের শেষার্ধ। শীত ভালোই। কিন্তু ঋতুটা পোস্ট মনসুন তাই পূর্ব ডুয়ার্সের এই দিকটায় শ্যামলিমার কমতি নেই। নদীতে জলও আছে, শুকোয়নি। বাড়িতে থাকলে কাজের ঠেলায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দরকারী কথা ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ থাকেনা। গল্প করা, আড্ডা মারা তো ভুলতে বসেছি। এখানে সন্ধ্যে গুলো বেশ অলসভাবেই কাটছে। কতদিন যেন এমন ভাবে সকলের সঙ্গে কথা বলা হয়নি। এমনই এক সন্ধ্যেবেলায় পতিদেব খবর আনলেন খুব কাছেই নাকি একটা চমৎকার জায়গা আছে। আমাদের যদি ইচ্ছে থাকে, তিনি যাওয়ার বন্দোবস্ত করবেন। খবরটা তিনি যোগাড় করেছেন স্থানীয় গাড়ি চালকদের কাছ থেকে। সাউথ খয়েরবাড়ি টাইগার অ্যান্ড লেপার্ড রেসকিউ সেন্টার। চা বাগানে একা হয়ে যাওয়া চিতাবাঘের ছানা, মা হয়তো মারা পড়েছে মানুষের হাতে, অথবা জখম বাঘ বা চিতাবাঘদের ওখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে শুশ্রূষা করা হয়। শুনে খুবই কৌতূহলী হলাম। কিন্তু মুখে অতটা উচ্ছাস প্রকাশ না করে বললাম যাওয়া যেতে পারে। এইটুকু ছলনার একটা কারণ আছে। পতিদেব সবসময় অনুযোগ করেন, আমি যখন কলেজের সঙ্গে কোথাও ফিল্ড সার্ভেতে যাই, তখন পাথরও রসসিক্ত মনে হয়। আবেগের প্রাবল্যে তখনই লিখতে বসে যাই। কিন্তু যখন বাড়ির সঙ্গে যাই (অর্থাৎ উহ্য কথাটা হল ওনার সঙ্গে যখন যাই) তখন সেই আবেগ থাকেনা, আর আমার কলমও সরেনা। এখন কৌতূহল পুরো দেখালাম না কারণ, জায়গাটি যখন এক্ষেত্রে ওনার আবিষ্কার, তখন পরীক্ষা করে দেখতে হবে স্থানটি লেখার জন্য যথেষ্ট আবেগ তৈরি করতে পারে কিনা।
ট্যুরিস্ট লজ থেকে পাকা সড়ক ধরে গাড়ি চলল মূর্তি নদীর দিকে মুখ করে। পুব থেকে পশ্চিম অভিমুখে চলেছি তাই ডানহাতে হিমালয়ের বরফ ঢাকা শ্রেণীও রয়েছে সঙ্গে। কিন্তু বেশি দূর নয় বড় জোর দু তিন কিলোমিটার পরেই আমাদের গাড়ি কাঁচা রাস্তায় নেমে পড়ল। দুপাশে গাছের সারি। জিজ্ঞাসা করে জানলাম আমরা খয়েরবাড়ি জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। বন এখানে মিশ্র প্রকৃতির। ডানদিকে মধ্যে মধ্যে লম্বা ঘাসের বন। বাঁদিকে অনেক বাঁশঝাড়। এত বড় জায়গা জুড়ে এত ঘন সবুজ বাঁশঝাড় আমি কখনো দেখিনি। দূরে দূরে ছোট ছোট গ্রামও আছে। কোথাও খানিকটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে গরু চরছে। আমার ঠাকুরদার ভিটে উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাট মহকুমার বাদুড়িয়ায়। আর শ্বশুরবাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামে। তাই জানি যে বাংলার গ্রামগুলির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভালো রাস্তা হয়েছে। যানবাহনের সুবিধে বেড়েছে, কল খুললে জল। সকালে খবরের কাগজ, স্লাইস পাঁউরুটি আর প্যাকেটের তরল দুধ দশ বছর আগেও যা মিলতনা, এখন সবই দোকানে সাজানো। এই সব উন্নয়নের স্রোতে তাল মিলিয়ে বেড়েছে ঘরবাড়ি। বসিরহাটে আমাদের বাড়ির পাশে একটাও জমির টুকরো ফাঁকা পড়ে নেই। বিখ্যাত আমের বাগানগুলি এখন ইতিহাস। আদি বাসিন্দারা নগরের পথে হারিয়ে গিয়েছে। পড়শি দেশের মানুষেরা সেখানে সংসার পেতেছে। এসবের সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে গাছপালা। দক্ষিণ বঙ্গের পল্লীগ্রামগুলি কবির ভাষায় আর ছায়া সুনিবিড় নেই। কিন্ত উত্তর বঙ্গের বনের মাঝের এই গ্রামগুলি দেখে মনটা কেবলই ছোটবেলায় ফিরে যাচ্ছে। রাস্তা খারাপ, কাদা কাদা। জায়গায় জায়গায় জল জমে আছে। যতই এগোচ্ছি জঙ্গল ক্রমশ ঘন হচ্ছে। প্রায় বারো কিলোমিটার এগোনোর পরে লোকজনের দেখা মিলল। দেখা গেল ওটা গাড়ি পার্কিং এর জায়গা। এসে গিয়েছি তাহলে?
গাড়ি থেকে নেমে মনটা বেশ ভালো লাগলো। আসল প্রবেশদ্বার পর্যন্ত পৌঁছতে এখন প্রায় আধ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। শুকনো লাল হলুদ পাতায় ঢাকা বনপথ। মাথার উপর সবুজ পাতার চাঁদোয়া। চড়া রোদ আছে। মাথায় রোদ লাগলে আমার মাথার যন্ত্রণা হয়। তাই সবসময় টুপি, রোদচশমার আশ্রয় নিই। গাড়ি থেকে নামার সময় সব উপকরণ সঙ্গে নিয়েছি। কিন্তু বনপথে প্রয়োজন পড়লনা। হাওয়ায় হাওয়ায় গাছের পাতার গান, পায়ের নিচে শুকনো পাতার মর্মর, কতরকম পাখি ডাকছে। একটা অদ্ভুত বন্য গন্ধ। নিজেকে হারিয়ে ফেলি। একটা আশ্চর্য চিন্তাশূন্য অনুভূতি মনটাকে ছেয়ে ফেলে। মনে হয় আজ কতকাল আমি হাঁটছি। এসময়ে ভাবতে ইচ্ছে করেনা যে অপার্থিব আলো-আঁধারি মাখা এই বনভূমি মাত্র দেড়শো বছরের পুরোনো। মদেশীয় কুলি কামিনদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে, এলাকার স্বাভবিক নিবিড় অরণ্য নির্বিচারে ধ্বংস করে, চা বাগান আর লম্বা গাছের বন সাজিয়েছে ইংরেজ।
সামনে পথের বাঁক। বাঁকের মুখে সিমেন্টের পিলারের উপর নাম লেখা সাউথ খয়েরবাড়ি লেপার্ড রেসকিউ সেন্টার। বাঁক ঘুরে কিছুটা পথ। তারপরে সেন্টারের বড় লোহার গেট। গেটের বাঁ পাশে টিকিট কাউন্টার।
গেট দিয়ে ঢুকে বেশ অনেকটা ফাঁকা জায়গা। একধারে নলকূপ ও একটি ছোট শৌচাগার। কিছুদূরে তিন চারটি ঘর দেখতে পেলাম। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এটা পিকনিক স্পট। আড়াইশ টাকা ভাড়া জমা দিয়ে এখানে পিকনিক করা যায়। কিন্তু চারিদিকে গাছপালা আর শুকনো পাতা। তাই এখানে কাঠ, কয়লা বা পাতা জ্বালিয়ে উনুন করা নিষিদ্ধ। নির্দিষ্ট ঘরে গ্যাস ওভেনে রান্না করা যায়। আরও কিছুদূর এগিয়ে যাই। এবারে বেশ বড় জায়গা জুড়ে ছোটদের খেলার পার্ক। দোলনা, ঢেঁকি, চড়ার মতো রেলিং সব আছে। অনেক জীবজন্তুর মডেল বানানো আছে। একটা দারুণ গণ্ডারের মডেল আছে। বাচ্ছারা তার পিঠের উপর চাপছিল।
এই জায়গাটা পেরোলে বন আবার অন্যরকম। একটা ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। ওপরে উঠে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। টাওয়ার থেকে দেখি সামনে নদী। নাম বুড়ি তোর্সা। সোনা গলা রোদ বুড়ি তোর্সার বুকে সোনালি রুপালি জরির সাজ পরিয়ে দিয়েছে। কে যে এমন চপল নদীর নাম রেখেছে বুড়ি, কে জানে। বুঝলাম ও অরণ্যের বড় আদরের বালিকা, তাই বুঝি বুড়ি নাম। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে নদীর দিকে এগোই। নদীর ওপর একটা কাঠের ব্রিজ। ছোট, তবু বড় সুন্দর। ব্রিজ থেকে নদীর দিকে ঝুঁকে দেখি। স্বচ্ছতোয়া তোর্সা। জলের গতি পাহাড়ী নদীর মতো দুরন্ত না হলেও, তরাইয়ের নদী হিসেবে যথেষ্ট। জলের নিচে আর একটা অরণ্য। অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ, নানা আকৃতির, নানা রঙের। জলজ গাছের ফাঁকে অজস্র মাছের চলাচল। অনেকটা বড় বড় বাটা মাছের মতো দেখতে। কিন্তু স্থানীয় মানুষ জানান, এত ঠাণ্ডা জলে বাটা মাছ বাঁচেনা। এগুলো সব বোরোলি। জলদাপাড়ার সরকারী ট্যুরিস্ট লজের ক্যান্টিনে বোরোলি মাছের ঝাল খেয়েছি। পেঁয়াজ কুচি দিয়ে কষে রান্না করেছিল। দারুণ স্বাদ। হলুদ, পাঁচফোড়ন, বা সামান্য সর্ষেবাটা দিয়েও অসামান্য লাগবে আশা করি। কর্তার ইচ্ছে ছিল, সকালে কাঁচা বোরোলি মাছ বাজার থেকে কিনে রাস্তার ধারে, আদিবাসীদের পাইস হোটেলে অর্ডার মাফিক রান্না করাবেন। তিনি বাংলার সাগরতটের বাসিন্দা এবং মৎস্যবিলাসী। কিন্তু কপাল খারাপ। এলাকার অর্থনীতি অনেকটাই বোরোলি নির্ভর। তাই যে কজন নদী থেকে বোরোলি পান, তাঁদের সঙ্গে সব হোটেল, লজের বন্দোবস্ত থাকে। তাঁরা সরাসরি সেখানেই মাছের যোগান দেন। সেইজন্য খোলা বাজারে বোরোলি পাওয়া আর রথযাত্রা বাম্পারের ফার্স্ট প্রাইজ জেতা কতকটা একইরকম। কপালের জোর লাগে। গতকাল কর্তামশাই কাকভোর থেকে চড়া রোদ বেরোনো পর্যন্ত গলদঘর্ম হয়ে ঘুরে একটিও বোরোলির দেখা পাননি। আজ নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে বোরোলি দেখে অপাঙ্গে তাঁর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করি। কন্যার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। দুজনেই হাসি গোপন করি। না, তাঁর চোখে কোনো হাহুতাশ নেই। বরং একদৃষ্টিতে দেখছেন বোরোলি মাছের চলাচল। সে দৃষ্টিতে গভীর তৃপ্তির সঙ্গে আছে অনুসন্ধিৎসা। কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে দেখি খানিকটা দূরে একটা ছোটো বনবিভাগের বিট অফিস রয়েছে। আরও ওপাশে কর্মচারীদের থাকার কোয়ার্টার। বনপথ ডানদিকে বাঁক নেয়। কর্তা, কন্যাকে বোঝাতে বোঝাতে চলেছেন, অন্য ছোট মাছের সঙ্গে বোরোলি মাছের গড়নে কি তফাৎ। আমার শ্বশুর বাড়িতে সাকুল্যে আটখানি পুকুর। সেখানে ছিপ ফেলা আর জাল ফেলা নিত্য কর্মের মধ্যে পড়ে। আমার কর্তা পুকুরে নেমে, খালি হাতে কই মাছ ধরে ধরে ছুঁড়ে দিচ্ছেন, আর মেজো ননদ হাঁড়ি হাতে দৌড়ে দৌড়ে সেগুলি হাঁড়িতে পুরছেন, এই দৃশ্য আমি স্বচক্ষে দেখেছি। এছাড়াও গাঁয়ের বাজারে ওঠে নানা আকার ও আকৃতির অদ্ভুত দর্শন সমুদ্রের মাছ। অন্যান্য কুলীন মাছের তুলনায় দাম বেশ কম। পুষ্টিকর ও স্বাদু। বাজার থেকে ব্যাগ ভর্তি হয়ে সেগুলিও আসে। এই ধরণের মাছ সম্পর্কে বিয়ের আগে কোনো ধারণাই ছিলনা আমার। এগুলি উপকূল অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের শরীরে প্রোটিনের যোগানদার। তাছাড়াও ঐ এলাকা চিংড়ি চাষের জন্য বিখ্যাত। আবার দীঘা মোহনায় ইলিশের ঢল নামলে বাড়িতে ফোন চলে আসে। ভোররাতে আমরা ঘুম থেকে ওঠার অনেক আগেই কর্তার নেতৃত্বে বাহিনী মৎস্য অভিযানে বেরিয়ে পড়ে। বাড়িতে লোক এলে তো কথাই নেই। সাধারণ দিনেও গ্রামের বাড়িতে তিন চার রকম মাছ রান্না হওয়াটাই দস্তুর। বিয়ের আগে আমি মাছ এড়িয়ে চলতাম। আমার সেজজ্যাঠামশাই কৌতুক করে বলতেন, এ মেয়ের মেছো বাড়িতে বিয়ে হবে। সে কথা যে এমনভাবে সত্যি হবে, কে জানতো!!
ডানদিকে এগোতেই চোখ আটকে যায়, প্রায় দু মানুষ সমান জাল। তবে আমার মতো চার ফুট দশ ইঞ্চি মানুষের মাপে দু মানুষ নয়। ছ ফুট লম্বা মানুষের মাপে ভাবতে হবে। কাছে গিয়ে দেখি লোহার জাল সিঙ্গল নয়, ডবল। জাল দিয়ে ওপাশের ঘন জঙ্গল আলাদা করা আছে। একজন গাইড এগিয়ে আসেন। ঠিকই ধরেছি। এটা সেই জায়গা, যেটা দেখতে আসা। ওপাশে অসুস্থ, জখম, অনাথ বন-বাসিন্দাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। কেউ কেউ মানুষখেকোও আছে। তবে ওরা যদি নিজে থেকে ধরা না দেয় জালের এপার থেকে ওদের দেখতে পাওয়ার আশা বৃথা। জালের ধারে রাস্তা তিন হাত সমান চওড়া হবে। বাঁদিকে জাল। ডানদিকে খয়ের, চন্দন, শিরীষ, সেগুন, ওদলা, দারুচিনি, রুদ্রাক্ষ গাছের সারি। কাকে ছেড়ে কাকে দেখব। গাইড এক এক করে চিনিয়ে দিচ্ছেন। বনের বাসিন্দাদের নিভৃতে থাকার অধিকারকে সম্মান জানিয়ে বলছি, যদি একজনকেও না দেখি শুধু গাছ দেখার জন্য এখানে বার বার আসা যায়। জলদাপাড়া গেছি, গরুমারা, এমনকি সুন্দরবনেও ঘুরেছি। কোথাও গাছের গায়ে গায়ে এমন নিশ্চিন্তে ঘোরা যায়না। যদিও এটা পুরোটা স্বাভাবিক বন নয়, তবু বনপথে হাঁটা আর নিরাপত্তা দুটো একসঙ্গে পেতে গেলে এটুকু কম্প্রোমাইজ করা যেতেই পারে।
গাইড ভদ্রলোকের কাছে বেশ চমকপ্রদ সব তথ্য পাওয়া যায়। এই কেন্দ্র শুরু হয় ২০০৫ সালে। ঐ সময়ে সার্কাসে জীবজন্তু রাখা নিষিদ্ধ হয়। অলিম্পিক সার্কাসের এগারোটি বাঘ সরকার বাজেয়াপ্ত করেন। তাদের প্রথমে হলং নদীর পাশে, পরে এই বুড়ি তোর্সার ধারে নিয়ে আসা হয়। সেই থেকে কেন্দ্রটি চলছে। ঐ বাঘগুলি মারা গেছে। কেন্দ্র খালি হয়নি। বন কেটে বসত করে, রাস্তা বানিয়ে, বন চিরে দ্রুত বেগে রেলগাড়ি চালিয়ে মানুষ কেবলই নামানুষদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। তাই জখম, অনাথ পশুদের সংখ্যাও বেড়ে চলে। কথা বলতে বলতে অনেকটা এগিয়ে এসেছি। গাইড বললেন আপনাদের কপাল ভালো। ঐ দেখুন রকি এসেছে। জালের নিচের দিকটা সলিড পাত। সেই ছায়ায় বসে আছে একটি চিতাবাঘ। সন্তর্পণে জালের কাছে গিয়ে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করি। জালে হাত দেওয়া কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। ওপারের বাসিন্দারা মোটেই পোষা নয়। এজায়গাটাও চিড়িয়াখানা নয়। এদিক থেকে হাত বাড়ালে ওপাশ থেকেও হাত বাড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে এপাশের হাতটি খোয়া যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। রকি আমাদের দেখলেও বিশেষ পাত্তা দিলনা। পর্যটক দেখে বোধহয় অভ্যাস হয়ে গেছে। আর একটু এগিয়ে বিরাট জলের ট্যাঙ্ক। তারপরে দেখি ওমা একটা বিরাট উঁচু ঘর, আকারেও বিশাল। যদিও ফাঁকা, ভিতরটা দেখতে ঠিক বাথরুমের মতো। ব্যাপারটা কী? এত বড় ফাঁকা বাথরুম কি কাজে লাগে রে বাবা। গাইড যা শোনালেন, তাতে আমাদের চক্ষু চড়ক গাছ। এই কেন্দ্রের পরম মাননীয় বাসিন্দাদের চানঘর এটি। চানঘর ফাঁকা ছিল, তাই চানঘরে গান তাঁরা কেমন গাইবেন সেটি কল্পনা করে নিতে হল। স্বকর্ণে শোনার সুযোগ হয়নি। গাইড আর একবার গতিরোধ করলেন। ঐ দেখুন মিঠু এসেছে। তাঁর কন্ঠে স্নেহ ঝরে পড়ে। কই মিঠু কই! তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাই। আর একটি চিতাবাঘ ঘাসের মধ্যে বসে আছে। শুনলাম ক্ষুদ্র একটি মানবক তার পেটে গিয়েছে। সেই থেকে এখানে বন্দী। আশ্চর্য এই পৃথিবী। আরও অদ্ভুত মানুষের আচরণ। কোথাও সে অসহায় প্রাণীকে খুঁচিয়ে মারছে। আর এখানে মানবশিশুর হত্যাকারীকেও সে পরম যত্নে রক্ষা করছে। কন্যা অন্যদিকে ছিল। তাকে ডাকি এদিকে আয় চট করে, মিঠু চলে গেলে আর দেখতে পাবিনা। গাইড আশ্বাস দেন, চিন্তা নেই, এখন খাবার দেওয়ার সময় হয়েছে। বিরক্ত না করলে এখানেই থাকবে।
চিতাবাঘের এলাকা শেষ হল। কিছুটা ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে একটা বড় বাঘের মূর্তি। আরও সামনে বিরাট গোলাকার এনক্লেভ, ঠিক চিড়িয়াখানার মতোই। এটা বনাঞ্চল নয়। সিমেন্টের খাঁচা ঘর, তবে বেশ বড় বড় সেগমেন্ট। হাঁকডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। কাছে গিয়ে দেখি, একি এযে সোঁদরবনের দক্ষিণ রায়। খিদে পেয়ে গেছে, বিরক্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। কিন্তু মহারাজ খোঁড়াচ্ছেন কেন? হায় ভগবান, মহারাজের তিনটি পা। চতুর্থটি শুনলাম কুমীরে কেটে নিয়েছে। বাকি খোপে খোপেও বাঘ বা চিতাবাঘ আছে, আবছা দেখা যাচ্ছে, সব ভিতরে ঢুকে বসে আছে। বুঝলাম এজায়গাটা একটু বেশি অসুস্থ বা প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত।
কেটে গেল অনেকটা সময়। এবার যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সে পথ দিয়েই ফেরার পালা। আবার বুড়ি তোর্সা, বোরোলি মাছ। কন্যার মনোভাব পিতৃকুলের মতোই। মাছধরায় উৎসাহ। বাপ-বেটি যতক্ষণ পারা যায় নদীতে ঝুঁকে রইল। যাওয়ার সময় খেয়াল করিনি। ফেরার সময় দেখলাম এক বিশাল যজ্ঞডুমুর গাছ, তার দুটো গুঁড়ি। গুঁড়ি থেকে নিচের দিকে ডানার মতো অনেকগুলো প্রক্ষিপ্ত অংশ বেরিয়ে এসেছে। নেহাত বাড়ি থেকে এসেছি তাই, আমার ছাত্রছাত্রীরা যদি সঙ্গে থাকত, আমি নিশ্চিত ঐ গাছটা ঘিরে তাদের লুকোচুরি খেলা চলত বেশ কিছুক্ষণ। প্রকল্প এলাকায় নদীতে বোটিং এর ব্যবস্থা আছে। ব্যাটারি চালিত গাড়িতে লেপার্ড সাফারিও করা যায়। তবে পায়ে হেঁটে যে অনুভূতি পেলাম, তা গাড়িতে বসে হত বলে মনে হয়না। তাই পায়ের জোর থাকলে হেঁটে ঘোরাই ভালো।
লোহার গেটের বাইরে আবার সেই ছায়াঘেরা বনপথ। টোটো দাঁড়িয়ে আছে। চালকদের ইচ্ছে বাকি পথটুকু আমরা না হেঁটে টোটোয় সওয়ারি হই। কিন্তু এই বনপথে হাঁটার লোভ ছাড়তে পারিনা। কি জানি, আর কোনোদিন সুযোগ হবে কিনা। জীবনের অর্ধশতক অতিক্রান্ত। আবার এলেও যদি হাঁটুর জোর না থাকে। যখন প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করেছিলাম, তখন ভোরবেলা না হলেও বেশ সকাল। এখন বেলা বেড়েছে। পথের দুধারে গ্রামের লোকেরা হরেকরকম পসরা সাজিয়ে বসেছে। পর্যটকদের নজর কাড়ার জন্য নানান সুরে ডাকাডাকি করছে। ডাব, ঝালমটর, ঘুগনি, পেয়ারা, শসা কত কী। গরম চা চাইলে তাও পাওয়া যাবে। সবাই মিলে ডাব খাওয়া হল। গাড়ির দিকে এগিয়ে চলি। হঠাৎ পিছন থেকে কাতর ডাক শুনতে পেলাম। আমার থেকে নাও না গো দিদি, কেউ কিনছেনা। আমার গাছের, নিজে বানিয়েছি। থমকে পিছন ফিরি। ঘোমটা মাথায় লাজুক বধূ। মায়া মাখা চোখ দুটি ছলছল। অন্য দোকানিদের মতো হাঁকাহাঁকি করতে পারছেননা। সামনে খয়েরি রঙের ছোট ছোট বুনো কুল, মশলা মাখা। আমি রাস্তায় এভাবে কুল খাইনা। কলেজে পড়তে লেডি ব্রেবোর্নের সামনে বড় বড় টোপা ঝাল কুল বিক্রি হত, তখনও খাইনি। ভাতের সঙ্গে কুলের অম্বল হলে আলাদা কথা। কিন্তু এখানে All women solidarity এর কথা মাথায় রেখে কুল কেনার সিদ্ধান্ত নিই। বধূর মুখে স্বর্গীয় হাসি। একমনে মশলার ফাইন টিউনিং করছেন। কুড়ি টাকায় এক বড় ঠোঙা কুল। এক গাল হেসে বধূ বলেন, খেয়ে দেখো দিদি কেমন লাগে। মন রাখতে হেসে দুটো কুল মুখে দিই। ওঃ জিভে অমরাবতীর ঝংকার ওঠে। গুড় মিষ্টি কুল, সামান্য একটু টকের ভাব, সঙ্গে ঝালঝাল চটপটা মশলা। দলের সদস্যদের কিছু কিছু বিলি বাঁটোয়ারা করে ঠোঙাটা নিজের হাতে সাবধানে রাখি, ছোটদের দল যে কোনো মুহূর্তে ছিনতাই করতে পারে। মুখের গুলো শেষ হলেই আরও দুটো দুটো মুখে পুরতে থাকি। অবশেষে গাড়ি ফেরার পথ ধরে। জানলা দিয়ে নজরে পড়ে হাতির মল। আসার সময় তো দেখিনি। দেখে তো খুব পুরোনো মনে হচ্ছেনা। তবে কি হাতির দল সদ্য সদ্য এ পথ দিয়ে গেছে! স্নায়ু টানটান করে বসি। গাড়ি বড় রাস্তায় উঠে পড়ে। মনের মধ্যে অনেক ভাবনা ভিড় করে আসে। আমার এই এক জ্বালা। যখন কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ফিল্ড সার্ভেতে আসি, তখন আমার কন্যা এগুলো দেখতে পেলনা ভেবে মনটা খচখচ করে। এখন ওকে নিয়ে ঘুরছি, তবু মনে কাঁটা বেঁধে। এখানে বায়োডাইভার্সিটি রেজিস্টারটা করাতে পারলে কত ভালো হত। তুষার মুকুটপরা হিমালয়কে ডান পাশে রেখে শিলিগুড়ির দিকে চলেছি। কলেজে ফিরেই এই বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।