মধুসূদনের প্ল্যান অনুযায়ী মাদারিহাটে সমীক্ষা ও জরিপের ফাঁকে একদিনের আধবেলা রাখা হয়েছিল জলদাপাড়ার জঙ্গল ঘোরার জন্য। ঠিক একমাস আগে এই অরণ্যে এসেছিলাম বাড়ির লোকের সঙ্গে। সেবার হাতির পিঠে চড়ে ঘুরেছিলাম। কিন্তু এবারে আর হাতি সাফারি নয়, জিপে করে ঘোরা। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষিকা সব মিলিয়ে দলের সদস্য একচল্লিশ। একদিনে ভোর থেকে তিনবার হাতি সাফারি হত তখন। তখন মানে সালটা ২০১৮। এক একবারে তিনটে তিনটে করে হাতি একসঙ্গে যেত। প্রতি হাতিতে হাওদার উপর চারটি করে বসার জায়গা। আবার অন্য পর্যটকেরাও তো টিকিট কাটবেন। তাই একদিনে এত বড় দলের টিকিট পাওয়া অসম্ভব। তাছাড়া হাতি সাফারির খরচও বেশী। জঙ্গলে মাথাপিছু প্রবেশ মূল্য একশ টাকা। আবার হাতিতে চড়ায় মাথাপিছু খরচ তখন আটশ টাকা। প্রতি হাতিতে মাহুত ওরফে গাইডের জন্য খরচ আড়াইশ টাকা। ছোটো গাড়ি করে হলং বাংলো পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়। তার জন্য গাড়িপিছু প্রবেশ মূল্য ৩০০ টাকা। ছাত্রছাত্রীদের জন্য এই খরচের পরিমাণটা অনেক বেশি। আর শিক্ষামূলক ভ্রমণে এসে সাফারির জন্য দুদিন খরচ করা চলেনা। অগত্যা জিপ সাফারিই বেছে নিতে হল। বনবিভাগের ছটি হুড খোলা জিপ যখন আমাদের হোটেল থেকে তুলে নিয়ে রওনা হল, হাতঘড়িতে সময় দেখলাম ভোর সাড়ে পাঁচটা। প্রিন্সিপালের চিঠি জমা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রবেশমূল্য একশ টাকা থেকে কমিয়ে দশ টাকা করা গেছে। জিপের ভাড়া মানে জিপ পিছু এগারোশ টাকা, আর জিপের প্রবেশ মূল্য তিনশ টাকা ট্রাভেল এজেন্সির ট্যুর প্ল্যানে ধরাই ছিল, তাই এবিষয়ে চিন্তা নেই। কেবল গাড়ি পিছু গাইড-ভাড়াটুকু আমাদের দিতে হল। জিপগুলো যখন অভয়ারণ্যে প্রবেশ করল, তখনও বেশ অন্ধকার। আমাদের জিপ গাড়িটা সোজা ঢুকে পড়লো জঙ্গলের ভিতরে, থামলো ঠিক হলং বাংলোর সামনে। বাংলোর সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা, যাতে জীবজন্তু বাংলোর খুব কাছে না আসে। ওখানে একটা চায়ের দোকান রয়েছে।
সামনে হলং নদীর ওপারে গাছ কেটে ফাঁকা করা আছে। কাটা গুঁড়ি গুলোর ওপরে পুরু করে নুনের স্তর করা রয়েছে। ওপারে নুন খেতে পশুপাখি এলে এপার থেকে দর্শকেরা তাদের দেখতে পাবে। সকালের আলোয় হলং নদীর জলের তলায় নুড়ি পাথর স্পষ্ট দেখা যায়। আর গাছে গাছে টিয়া পাখির ঝাঁক - কি তাদের ব্যস্ততা আর কতো কথা। দুই মরা ডালের মাঝে বসে আছে এক সারপেন্টাইন ঈগল - তার ডানার রঙ আর গাছের ডাল মিলে মিশে একাকার। বসে আছে নিশ্চুপ। খুব খেয়াল না করলে বোঝা মুশকিল। দেখলাম খুব বিশাল বিশাল ময়ূর, এছাড়াও মাছরাঙা, নানান রকম পায়রা, বুলবুলি, শালিক। আর আছে ঝকঝকে কাঁচের মত নালার জলে বোরোলি মাছের আনাগোনা। নিজেরা চুপ থেকে একমনে ভোরের জঙ্গলের নানা শব্দ শুনতে লাগলাম।
গাইড নিচু স্বরে জানিয়ে দিলেন, জঙ্গলের তিনটি নিয়ম।
১. জঙ্গলে নিঃশব্দ থাকতে হবে। অর্থাৎ কোনরকম হৈচৈ, চীৎকার করা যাবেনা। গাড়ির হর্ন ও ব্যবহার করা হয়না।
২. কোনো গাছপালা বা জীবজন্তুর ক্ষতি করা যাবেনা। অর্থাৎ পশুপাখির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তার দিকে কিছু ছুঁড়ে মারা, তাদের আহত করা চলবেনা। গাছপালার ফুলপাতা ছেঁড়া যাবেনা। প্রতিটি অপরাধ আইনত দণ্ডনীয়।
৩. জঙ্গলে কোনো প্লাস্টিক বা অন্য কোনো ধরণের ময়লা ফেলা যাবেনা। আর কোনো কারণেই অগ্নি সংযোগ করা যাবেনা। শুকনো পাতায় আগুন লেগে বিরাট দাবানল লেগে যেতে পারে।
এই ফাঁকে বলে নিই, দাবানল প্রতিরোধ করার বিষয়ে আমার একটা দারুণ অভিজ্ঞতা আছে। আমরা সাধারণত শীতকালে ফিল্ড সার্ভেতে বেরোই, কিন্তু একবার তালেগোলে নানান ঝামেলায় বেরোতে বেরোতে এপ্রিল পড়ে গেলো। কলকাতায় তখন আবার তাপপ্রবাহ চলছে, আর আমরা কলেজের বাকি ডিপার্টমেন্টকে কলা দেখিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চললাম উত্তরবঙ্গ। কমার্স বিভাগের এক সহকর্মিনী বললেন - পরের বার মায়ের পেট থেকে বেরিয়েই ভূগোল বই নিয়ে বসে যাব। আর ভুল হবেনা। কিন্তু বাবা সে সব হবে পরের জন্মে। এ জন্মে আর কিছু হিল্লে হবার জো টি নেই। সেবার গরুমারা অভয়ারণ্যে ভোরবেলা ঢুকে দেখি বনের মধ্যে জায়গায় জায়গায় গাছপালা কেটে সব সমান - যেন কোন দৈত্যের কালাজাদুতে এক লহমায় ঘন বন অদৃশ্য হয়েছে। বিশাল বনে অনেক জায়গায় এমন কাণ্ড দেখে আমরা রাগে অস্থির, শোকে মুহ্যমান। এমন হলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং আটকাবে কেমন করে? ছেলেমেয়েদের এমন দশা যে সেই মুহূর্তে মোবাইলে টাওয়ার নেই তাই। টাওয়ার পেলেই ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটা আর কীসবে ঝড় তুলবে। ওদের কোনরকমে শান্ত করে, একটু খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কারণ শীতে যতবারই এসেছি, এমন কখনও দেখিনি। সেবারই শিখলাম যে গরমকালে বনে আগুন লাগা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সেই আগুন যাতে পুরো বনকে খেয়ে ফেলতে না পারে, সেজন্য মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গা তৈরি করা হয়। ছোট করে বন কাটা হয়, বড় বনটাকে আগলানোর জন্য। মাঝে মাঝে গাছের জটা বিচ্ছিন্ন করে দিলে একদিকের আগুন, অন্যদিকে ছড়ায়না। আর আগুন ছোট থাকলে নেভানোর ব্যবস্থা করা সহজ। বর্ষায় ঐ গাছ কেটে ফাঁকা করা জায়গাগুলো বন নিজেই ভরিয়ে নেয়।
যাই হোক, এখন জলদাপাড়ায় ফিরে আসি। গাইডের মুখে নিয়মগুলো শুনে ছেলেমেয়েরা সতর্ক হল। গাইড ভদ্রলোক নেপালি। কাছেই বনের ধারে গ্রামে থাকেন। আমাদের সঙ্গে কিন্তু অনর্গল বাংলায় কথা বলছেন। এই বিষয়টা আমরা যে গ্রামে সার্ভে করলাম, সেখানেও খেয়াল করেছি। গ্রামের মানুষেরা নিজেদের মধ্যে পূর্ববঙ্গীয় বাংলায় কথোপকথন করছেন। আমাদের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলায় উত্তর দিচ্ছেন। আবার কোনো দরকারে জড়তাহীনভাবে নেপালি বলছেন। আসলে সীমান্ত এলাকায় মিশ্র সংস্কৃতির মানুষ এঁরা। সেই কারণেই এমন গুণ। আর একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, এখানকার স্থান-নাম। মাদারিহাট, খয়েরবাড়ি, ওদলা বাড়ি এসব জায়গা গাছের নামে নাম, আবার জলদাপাড়া জলদা উপজাতির নামে নাম। সবই প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু অদ্ভুত হল গাইড যে গ্রামে থাকেন তার নাম মেঘনাদ সাহা নগর। যে গ্রামে সার্ভে হল, তার নাম সুভাষ নগর। এলাকার নামের সাথে ঠিক মেলেনা। এগুলি কি সরকারের তত্ত্বাবধানে বসানো কলোনি? জিজ্ঞাসা করেছিলাম। গ্রামবাসীরা এড়িয়ে গেলেন। আশ্চর্য হল, তাঁরা কোন অঞ্চল থেকে অভিবাসী কিনা সে প্রশ্নের উত্তরে সকলেই নিজেদের স্থানীয় বলেছেন। উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ মানুষের ভাষা পূর্ববঙ্গীয়। দক্ষিণবঙ্গের বেশিরভাগ মানুষের ভাষা পশ্চিমবঙ্গীয়। ভাবতে গেলে সব দিক গুলিয়ে ঘেঁটে ঘ হবার দশা - ছেঁড়া দেশের মানুষ আমরা - পদে পদে কাটা জায়গা থেকে রস গড়ায়, শুকোনোর নাম নেই। এখন যেটা চলছে বরং সেই জঙ্গল দর্শনে মনোনিবেশ করি।
জিপ চলেছে জঙ্গলের সরু পথ ধরে, একটু একটু করে আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু সূর্য উঠতে এখনো অনেক দেরী। পথের মধ্যে কিছুটা পর পরই ঝোরা, নালা বা হলং নদীর ওপরে কাঠের ব্রিজ। গাইড জানালেন, জঙ্গলে যদি কোনো লোক বা গাড়ি হাতির সামনে পড়ে যায়, তবে নিরাপত্তার জন্য খুব দ্রুত কাঠের ব্রিজে উঠে পড়তে হয়। কারণ হাতি কাঠের ওপরে ওঠেনা। জানে ব্রিজ ভেঙে নীচে পড়ে যাবে। হঠাৎ এমনই এক কাঠের ব্রিজের ওপরে আমাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। গাইড তর্জনীর ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বলে, নীচে নুড়ি পাথরে ভরা নদীখাতের দিকে নির্দেশ করলেন। ভোরের হাল্কা আলো, কুয়াশায় আরো আবছা। তার মধ্যে চোখ সয়ে এলে দেখলাম, অনেক কালো কালো বিন্দু নদীখাতে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। কী ওগুলো? সবার মনে উত্তেজনা। নিচু স্বরে গাইড জানালেন, নদীতে বিশাল বাইসনের পাল নেমেছে। একে আলো আঁধারি তায় দূরত্ব। হায় আমাদের হাতে থাকা যন্ত্র ক্যামেরার সাধ্য নেই এদৃশ্য ধরে রাখার। তাই মন ক্যামেরায় যতক্ষণ পারা যায় আপ্রাণ ছবি তুলে রাখলাম। চাইছিলাম আরো আরো বেশীক্ষণ প্রকৃতির কোলে এই স্বাধীন বিচরণ দেখি। কিন্তু বন দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী আড়াই ঘণ্টায় জিপ যাত্রা শেষ হবে। তাই গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। সূর্য উঠে পড়েছে। ভোরের আলোয় গাছের গায়ে, ঘাসের ওপর শিশির ঝিলমিল করে। মনে হয় যেন হিরে বসানো কার্পেটে জড়ানো গাছপালা। তার মধ্যে খোলা রথে চলেছি কেউ রাজা কেউ রাণী, কেউ পাত্র, মিত্র, অমাত্য। কত যে পাখির ডাক। ভাবি একটা জায়গায় চুপ করে বসে প্রকৃতির শব্দ অনুভব করি। ও আমায় কী বলছে শুনে বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু উপায় তো নেই।
বিরাট ঠোঁটওয়ালা হর্নবিল দেখলাম। আর চারিদিকে কত যে ময়ূর। গাছের মাথায় গম্ভীর মুখের সার্পেন্টাইল ঈগলেরা নিশ্চুপ বসে আছে, ঠিক যেন মূর্তি এক একটা, জীবন্ত নয়। এক ঘণ্টা পরে মানে ঠিক সকাল সাড়ে ছটায়, আমরা এলাম প্রথম ওয়াচ টাওয়ারে। ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলা কাঠের রেলিংঘেরা টাওয়ার। পাশে ছোটো একটা শৌচাগার আছে। ওপর থেকে জঙ্গলের অনেকটা এলাকা দেখতে পাওয়া যায়। নজরে পড়ল এক, দুই, তিনটি কুনকি হাতির পিঠে ফরেস্ট গার্ডরা চলেছেন পাহারাদারির কাজে। যেখান দিয়ে আমরা এলাম সেই রাস্তার ধারে ধারে জঙ্গল একটু হাল্কা। কিন্তু ওয়াচ টাওয়ার থেকে গভীর জঙ্গল দেখতে পেলাম। হাতি সাফারি করলে ঐ ঘন বনের ভিতর কিছুটা পর্যন্ত যাওয়া যায়। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে এলাম। গাড়ি এবার ঘাসবনের রাস্তা ধরল। মাঝে মাঝে গাঢ় বেগুনি বন তুলসীর ঝোপ। এই সেই বন, যেখানে পরিবারের সঙ্গে এসে হাতি সাফারির সময়ে তিনটি গণ্ডারের দর্শন পেয়েছিলাম। কিন্তু একে জিপের ঘড় ঘড় শব্দ, তায় মোটোরেবল রোডের সীমানার মধ্যে থাকার বাধ্যবাধকতা। জলদাপাড়ার মহারাজ কি দেখা দেবেন? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি রাস্তার বাঁকের মুখে সামনের দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। গাইডের দৃষ্টি সামনের ঘাস ঝোপের ওপরে স্থির, ঠোঁটে তর্জনীতে নিঃশব্দ থাকার নির্দেশ। ঝোপ আর গাড়ির মধ্যে দূরত্ব বড়জোর ২ মিটার হবে। হাতির পিঠে বসে অনেক উপর থেকে দেখা নয়। একেবারে সামনে। ঝোপ দুলছে, মহারাজ রাস্তা পেরোবেন। গাড়ি দেখে থমকে গেছেন। হাতে সময় তো বেশি নেই। প্রার্থনা একবার, একবার যদি বেরিয়ে আসেন। কিছুক্ষণ রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পরেই দেখি একটি পূর্ণবয়স্ক বিশালকায় গণ্ডার দৌড়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে পাশের জঙ্গলে অদৃশ্য হল। ভোররাত থেকে এত আয়োজন সার্থক হল। ২০২৩ সালে এমনই এক পরিস্থিতিতে একটি গণ্ডার জীপ গাড়িকে আক্রমণ করে উলটে দিয়েছিল। ইউটিউবে, ফেসবুকে পিছনের গাড়ি থেকে তোলা ভিডিও ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। দেখেছিলাম পর্যটকেরা গাড়ি থেকে চীৎকার করে উল্লাস করছেন। জঙ্গলে নীরব থাকতে হয়, বনের জীবনকে সম্মান করতে হয়, এসব নিয়ম সকলকেই বনে ঢোকার সময়ে শেখানো হয়। কিন্তু লোকে শোনে কই? গণ্ডারের সঙ্গে ছানা ছিল, অত হৈ চৈ করলে মায়ের মন, ভয় তো পাবেই।
এবার দ্বিতীয় ওয়াচ টাওয়ার। আগেরটার মতো প্রায় একরকম, কিন্তু এখানে শৌচাগার নেই। এখান থেকে দুরকম হরিণ দেখা গেল। সকাল সাড়ে সাতটায় আবার পৌঁছলাম হলং বাংলোর সামনে। বাংলোর সামনে খানিকটা পরিষ্কার চাতাল। একটা ছোটো চা বিস্কুটের দোকান। ছেলেদের, মেয়েদের আলাদা শৌচাগার। আর আছে একটা দেড়তলা সমান উঁচু টাওয়ার। এখান থেকে সাফারির জন্য হাতির পিঠে উঠতে হয়। বোর্ডে পর্যটকদের জন্য লেখা রয়েছে সতর্কীকরণ। পর্যটকরা যাতে এখানে সাবধানে চলাফেরা করেন। কারণ এই স্থানটি গণ্ডার এবং অন্য বন্য জন্তুদের বিচরণ ক্ষেত্র।
সামনে হলং নদীর বড় বাঁকের এপারে ঘাট বাঁধানো। সিঁড়ি করা আছে। আমরা চুপচাপ স্বচ্ছতোয়া হলং- এর স্রোতের নিচে নুড়ি পাথর আর বোরোলি মাছের ঝাঁক দেখছিলাম। বাঁকের ওপারে যে জায়গাটায় বন কেটে পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে, সেখানে ছোটো ছোটো কাটা গাছের গুঁড়িতে লবণ ছড়ানো - এটা আগেই দেখেছিলাম, এখন খেয়াল করলাম মাটিতে নানারকমের শস্যদানাও ছড়ানো আছে। বনের পশুরা হলং নদীতে জল খেতে আসে। সে সময়ে গাছের গুঁড়ির প্রাকৃতিক রেকাবিতে নুন চেটে খায়। এতে তাদের শরীরের নুনের ঘাটতিও পূরণ হয়। আবার সেই অবসরে পর্যটকদের চোখের পিপাসাও মেটে। মাটিতে ছড়ানো শস্যের স্বাদ নিতে আসে নানান পাখি। যেমন আমাদের সামনে কয়েকশ টিয়ার ঝাঁক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এপাশে ওপাশে ময়ূর নাচছে পেখম তুলে। যতই দেখি মন ভরেনা। গাইড জানালেন এখন ওদের মধু ঋতু। তাই ময়ূরীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এত চেষ্টা। এই নয়নলোভন দৃশ্যের মাঝে একটা ঘটনা ঘটল, যা আমরা কখনই চাইনি। আমরা যখন হলং নদীর দিকে এগোচ্ছি, তখন ওপারে একটি বড়সড় আকারের বাইসন নদীতে জল খাচ্ছিল। বাইসন দেখব বলে আমরা একসঙ্গে দৌড়ে গেলাম। যদিও পশু আর মানুষের মাঝে নদীর স্রোতের আড়াল, তবুও আমাদের দৌড় দেখে বাইসনটা এত ভয় পেয়ে গিয়েছিল, জল খাওয়া ছেড়ে সে উল্টোমুখে দৌড়তে শুরু করল। কিন্তু মানুষের তৈরি সল্ট প্যান পেরিয়ে ঘন বনে পৌঁছনো অনেকটা সময়ের ব্যাপার। পুরো সময়টা সে পিছন ফিরে ফিরে দেখছিল আমরা ধাওয়া করছি কিনা। আর তার বিশাল শরীরটা প্রাণভয়ে থরথর করে কাঁপছিল। কাছ থেকে ওয়াইল্ড লাইফ দেখার উল্লাসে আমাদের চোখমুখ ঠিক কতটা হিংস্র হয়ে উঠেছিল সেটা ঐ বাইসনের কাতরতা স্পষ্ট করে দিল। আমরা তো ওকে আঘাত করতে চাইনি। কিন্তু ওর নিভৃতে থাকার অধিকারকে মর্যাদাও দিইনি। যদিও এবিষয়ে আমরা উচ্চকিত আলোচনা করিনি, কিন্তু মানবিক আচরণের প্রতি এই পাশবিক অবিশ্বাস, দলের সব সদস্যেরই মর্মস্থলে আঘাত করেছিল। কিছুক্ষণ পরে অবশ্য আরো দুটো বাইসন এল। আর নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে নুন চেটে চেটে খেতে লাগল। আগের ঘটনার পরে ছেলেমেয়েরাও শান্ত ভাবে সামনের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল। আড়াই ঘণ্টা প্রায় শেষ। মূল প্রবেশদ্বারের দিকে জিপে চড়ে রওনা দিলাম। এবার বেরিয়ে আসার পালা। মনে মনে বনদেবীর কাছে মাপ চাইলাম অল্প হলেও অসংযত আচরণের জন্য। আর আশীর্বাদ চাইলাম মানুষ হয়ে যেন মানবিকতার মর্যাদা রাখতে পারি। আসলে বন আর বন্যপ্রাণী - এদের স্বার্থে মানুষের কী কী করা উচিত সেসব নিয়ে আলোচনার শেষ নেই, কিন্তু আলোচনা ছেড়ে বাস্তবে কতটুকুই বা করতে পারি আমরা। উল্টে একটু মজার জন্য এমন কাজ করে বসি যে পরে আফশোস হয়। আমার জীবনেও এমন একটা বড় আফশোস আছে।