এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা  শনিবারবেলা

  • মধুবাতা ঋতায়তে

    শারদা মণ্ডল
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২৩ আগস্ট ২০২৫ | ৪৯ বার পঠিত
  • ছবি - Imagen 3


    বন চিরে পিচ সড়ক, দুপাশে ঘন ছায়ায় ঢাকা বৃক্ষরাজি। জিপ ছুটছে দুরন্ত গতিতে। একঘেয়ে জীবন যেন মিথ্যে। সেই কবে ছোটবেলায় সিনেমা দেখেছিলাম আফ্রিকান সাফারি। কিংবা বেনহারের রথের দৌড়। সব মনে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু না না বনের মধ্যে এত জোরে গাড়ি চলা তো ভালো নয়। বনের বাসিন্দারা রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়তে পারে। আমার শখ, আমার থ্রিল, তার জন্য ওদের জীবন নিয়ে খেলতে পারিনা। কিছুতেই না। চালককে বললাম আমাদের তাড়া কম, একটু ধীরে চলতে। চালক বললেন শীতের বেলা এমনিতে ছোট, তায় জঙ্গলে ছায়া, খুব দ্রুত অন্ধকার নামে। শেষ বিকেলে জীবজন্তুর দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু অন্ধকার নেমে গেলে সব আশায় ছাই পড়বে, তাই তিনি তাড়া করছেন। আমাদের অতশত অভিজ্ঞতা নেই। যা হোক গাইডের ওপরে সব ছেড়ে আবার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে মগ্ন হলাম। আর একটু এগিয়ে জিপ এবার পিচ রাস্তার ওপাশের জঙ্গলে ঢুকল। আবার সেই সংকীর্ণ বনপথ। আমরা যেমন ঢুকছি, অনেকগুলো জিপ তেমন সাফারি সেরে বেরিয়ে আসছে। তাদের সময় শেষ।

    পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ওপাশের ফিরতি পথের জিপ থেকে প্রশ্ন ভেসে আসে, কিছু দেখতে পেলেন ভাই? আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের চটজলদি জবাব শুনে চমকে যাই - হ্যাঁ হ্যাঁ গাছে গাছে বুনো পিঁপড়ে দেখলাম প্রচুর। দুই জিপেই হাসির রোল ওঠে। হাসির রেশ শেষ হবার আগেই উল্টোমুখে চলতি জিপ দুটি পরস্পরের থেকে অদৃশ্য হয়। মনে ভাবি পুরোটাতো রসিকতা নয়। জঙ্গলকে বুঝতে হলে শুধু বড় বড় জন্তুজানোয়ার দেখাটাই সব নয়। বড় গাছ, ছোট গাছ, ঝোপঝাড়, লতাপাতা, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি সবাইকে নিয়ে পুরো সংসারটাকেই অনুভব করতে হবে। ছোট ছেলের মুখের কথা যেন একটা বড় শিক্ষা দিয়ে যায়। তবে চালক আশ্বাস দেন, যে আমরা যে সময়ে ঢুকেছি, সে সময়ে সচরাচর পর্যটকদের কপাল চওড়া থাকে। দেখি বনদেবীর কৃপা পাই কিনা।

    হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি। সম্বিত ফিরতে দেখি, চালক দাঁড়িয়ে উঠে ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে নিঃশব্দ থাকার ইশারা করছেন। ওনার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, পথের বাঁদিকে ঘন পাতার আড়ালে একটা কালো কিছু যেন রয়েছে। হাতি দেখার সময়ে যেমন ডালপালা নড়ছিল, এখানে তেমন নয়, বরং একটু যেন বেশিই স্থবির, কোনো নড়ন চড়ন নেই। ধীরে ধীরে চোখ সয়ে এলে মনে হল সামনের দিকে একটা বিশাল মুখ। তারপর পাতার আড়ালে দৃষ্টিগোচর হল একটা বাইসন রাস্তা থেকে সামান্য দূরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। নিবেদিতা স্কুলে আমাদের সন্ন্যাসিনী শিক্ষিকা বড় মিনুদির বাংলা ক্লাসের পড়া মনে পড়ে যায় - 'নিবাতনিষ্কম্পমিবপ্রদীপম্' বাতাস না থাকলে প্রদীপের শিখা যেমন নিষ্কম্প থাকে, তেমনই নিশ্চল এই বাইসন। অপেক্ষা করছে আমাদের সরে যাওয়ার জন্য। চালক জানালেন একটা যখন আছে, তখন আরো বাইসন কাছাকাছিই আছে। জিপ আবার স্টার্ট দিল। আরো বাইসন কাছাকাছি আছে, কথাটা মনের মধ্যে ঘুরছে। বেশি দূর যেতে হলনা। এবারে পথের ডানদিকে দেখা গেল একদল বাইসন। চালক দেখিয়ে দিলেন দলনেতা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে আছে পুরো দল। রাস্তা পেরোবে। একটু সরে গিয়ে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের কাছে ভালো ক্যামেরা ছিলনা। চালক নির্দেশ দিলেন ছবি তুলতে হলে ফোনের ভিডিও ক্যামেরা অন করে প্রস্তুত হয়ে থাকুন। আমার ভাই ভিডিও ক্যামেরা অন করেছে দেখে, আমি ফোনের স্টিল ক্যামেরা অন করে রাখলাম। বাইসন বেরোনো মাত্র ক্লিক মারব। এক এক করে তিনটি বিশালাকায় পূর্ণবয়স্ক বাইসন ঊর্দ্ধশ্বাসে রাস্তা পেরিয়ে ওপাশে চলে গেল। কিন্তু হায়, তিনবারই আমার রিফ্লেক্স ফেল। ফোনে ট্যাপ করার সময় দিলনা। বুঝলাম কেন গাইড বলেছিলেন ভিডিও ক্যামেরা অন করতে। এদের যা গতি, আমাদের মতো আনাড়িদের পক্ষে স্টিল ক্যামেরায় বন্দী করা অসম্ভব। একটাই সান্ত্বনা, ভাই ভিডিও করতে পেরেছে।

    আমাদের যে সৌভাগ্য হল, আমার কর্তার ভাগ্যে তা হলনা। কারণ তিনি ছিলেন অন্য জিপে। সে গাড়ির চালক অন্ধকারকে ভয় পান, তাই অনেক আগেই ফেরার পথ ধরেছেন। সত্যি, ট্যুরিস্টদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কোন গাইড দক্ষ, আর কে নয়। বনদেবীর কৃপার বিষয় তো আছেই, উপরি যদি অদক্ষ, আনাড়ি গাইড কপালে জোটে, দুর্ভাগ্যের আর আফসোসের সীমা থাকেনা। হরিদ্বারের উপকণ্ঠে রাজাজী ন্যাশানাল পার্কেও একই ঘটনা ঘটেছিল। আমরা পাহাড়ের গায়ে ছানা সমেত বিশাল হাতির দল দেখলাম, পথের ওপরে বসে থাকা চিতাবাঘ দেখলাম। অথচ আমার কর্তার জিপটি অন্ধকারের ভয়ে বহুক্ষণ আগেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কর্তা প্ল্যান করেন, ছুটোছুটি করে ট্রেনের টিকিট কাটেন, হোটেল বুকিং করেন, যাতায়াত, খাওয়া দাওয়ার সুবন্দোবস্ত করেন, অথচ বনদেবী ওনার ওপর কৃপাদৃষ্টি দেননা, দুবার প্রমাণ পেলাম। সূর্যদেব পাটে বসেছেন। জিপ ফেরার পথ ধরেছে। হঠাৎ আমাদের অবাক করে দিয়ে এক পথের বাঁকে গাড়ি উল্টোমুখে গভীর জঙ্গলের দিকে চলতে শুরু করে। কিছুদূর এগিয়ে দেখি বিশাল জলাশয়, ওধারে বোধহয় নদী আছে। আমাদের আগে থেকেই আরও তিনটি জিপ ছড়িয়ে, ছিটিয়ে নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। কিছুটা দূরে পাহাড়। গরুমারার পাহাড়ি অংশ আছে, একথা জানা ছিলনা। গোধূলির আলোর শেষ রেশ পাহাড়ের গায়ে। আমাদের চারপাশে আঁধার নামছে। জল-জঙ্গল-পাহাড়-গোধূলি-আঁধারের ছায়া, একি আমারই পরিচিত বঙ্গদেশ! একটা অপার্থিব অনুভূতি মনটাকে ছেয়ে ফেলছে। এখানে আসার জন্যই কি আমার জীবনটা এতদিন অপেক্ষায় ছিল? কানের কাছে চালকের চাপাস্বর শুনে চমকে উঠি। তিনি বলছেন। জলের ধারে ন্যাড়া গাছ। আপনি নিজেকে আর গাছ মনে মনে এক সরলরেখায় যুক্ত করে সেই রেখা বরাবর পাহাড়ের খাঁজটা দেখুন। জীবনে প্রথমবার এমন জায়গা। অনভিজ্ঞতায়, আর চরাচরব্যাপী ধূসর আলোয় ঠিক ঠাহর হয়না। শুধু মনপ্রাণ দিয়ে সরলরেখা খুঁজি। ধীরে ধীরে চোখ সয়ে আসে। যা অদৃশ্য তা দৃশ্যমান হয়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে জলের দিকে নামছে হস্তীযূথ। বড়দের শুঁড়ের তলায় শিশুরাও আছে। এপাশে পর্যটকরা বাক্যহীন, স্থবির। কন্যা ও দুই ভ্রাতুষ্পুত্র গা ঘেঁষে আসে। ওদের জড়িয়ে ধরি। ওপাশে হস্তীমায়ের সন্তান, এপাশে আমার। প্রকৃতির কোলে ওদের স্বাধীন বিচরণ মনে বড় বাজে, যন্ত্রণা দেয়। কারণ আমার নোঙর বাঁধা কিনারার কাছে। চমক ফেরে, হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা বার করে পাগলের মতো কর্তাকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। বলতে চাই ফিরে এসো, দেখে যাও। লাভ হয়না। এখানে ভোডাফোন, এয়ারটেল কারোর টাওয়ার নেই। জিওফাই বার করে, মেসেজ করার চেষ্টা করি। মেসেজ ডেলিভারি হয়না। ধীরে ধীরে অাঁধার নামে। নদী, পাহাড়, দূরের জঙ্গল সবই অদৃশ্য হয়। গাড়িগুলির হেডলাইটের তীব্র আলো জ্বলে ওঠে। সে আলোয় পথ চিনে যে যার গাড়িতে চুপচাপ উঠে বসি। রাতের জঙ্গলে নিরাপত্তা কম। এবারে বিদায় নেবার পালা।

    আঁধার বনপথ নিঝুম, শুধু গাড়ির শব্দ। ঘোর লাগা মন নিয়ে মাথা নিচু করে বসে ছিলাম। কী মনে হয় পিছন ফিরে ফেলে আসা বনপথের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে। মুখ তুলে গতির পিছন দিকে তাকাই। একলহমায় ছোটবেলার বাংলা পাঠ্য মনে পড়ে যায়, "আহা, কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিবনা"। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র, মেঘের চিহ্ন মাত্র নেই। গরুমারার চরাচরে জোছনার বান ডেকেছে। বনপথ অনেক দূর পর্যন্ত চোখের সামনে স্পষ্ট। শুধু বড় বড় গাছের ছায়াগুলো কাঁপতে কাঁপতে দূরে সরে যাচ্ছে। রাতের জঙ্গলের সেই অনির্বচনীয় সৌন্দর্য পান করতে করতে মনে কাঁটা বেঁধে, কর্তাতো কিছুই দেখতে পেলেননা। একযাত্রায় পৃথক ফল, বিধির ষড়যন্ত্র। তখনও জানিনা আরও কিছু বাকি আছে। আবার জিপ দাঁড়িয়ে যায়। চড়া হেডলাইটের আলোয় দেখি বাইসনের দল ঠিক আগের মতোই ঊর্দ্ধশ্বাসে রাস্তা পার হচ্ছে। তৃপ্ত, পূর্ণ মন নিয়ে বনের সীমানার বাইরে আসি। কর্তা জিজ্ঞাসা করেন, এত দেরী হল কেন? আমার বলার ছিল, তোমার গাড়ি এত তাড়া করল কেন? শেষ পর্যন্ত নীরবই থাকি, কিছুই বলা হয়না। বাচ্ছারা কিছু বলার চেষ্টা করে। শুনতে পাই ও গাড়ির অন্য সওয়ারিরা ছোটদের খেপাচ্ছে, কিচ্ছু দেখেনি, যত্ত সব বানানো। মনে মনে হাসি, যা দেখেছি তা বানানো না হলেও স্বপ্ন তো বটেই। ওরা কিছুই দেখতে পায়নি, তাই মনের ঝাল মেটাচ্ছে। বাচ্ছাদের বলি শান্ত হতে। দুপাশে জঙ্গল আর চা বাগানের মধ্যে পাকা সড়ক জোছনায় ভাসছে। কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। মাথায় উলের রুমালটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়েছি। আমরা এখন মূর্তি নদীর ধারে রিসর্টে ফেরত যাচ্ছি।

    পথ চলতে চলতে এই চালসা আর ডুয়ার্স ঘিরে কত যে স্মৃতি মনে ভিড় করে আসে। বহু বছর আগে জীবনে প্রথম বার গরুমারা জঙ্গলে ঢুকেছিলাম পায়ে হেঁটে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে। সামনে বাঁধা ছিল কুনকি হাতির দল। তার মধ্যে প্রবীণতম সদস্যকে দেখেছিলাম বিশালাকার, লোলচর্ম, আর সামনের খাবারের বালতি থেকে গোছা গোছা লম্বা লম্বা ঘাস মাথায় চাপিয়েছে। মাহুতেরা হাসছিলেন, রসিকতা করে বলছিলেন কীরে! খুব গরম লাগছে? আমরা পায়ে হেঁটে গিয়েছিলাম যাত্রাপ্রসাদ ওয়াচ টাওয়ারে। সেই যাত্রাপ্রসাদ - শৈশবে লীলা মজুমদারের কলমের ডানায় ভর করে যার পিঠে সওয়ার হয়ে মনে মনে তরাইয়ের জঙ্গলে অভিযানে বেরিয়ে পড়তাম, সেই যাত্রাপ্রসাদ যার মূর্তি তৈরি করার এক মাসের মধ্যেই হিংসুটে বুনো দাঁতালেরা এসে ভেঙ্গে দিয়েছিল। তখন তো মোবাইলের যুগ আসেনি। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নদীতে হাতি আর বাইসনের দল দেখেছিলাম। ছোট ছোট হট শট আর কোডাক ক্যামেরার ক্ষমতা ছিলনা যে সে অত দূর থেকে সেই দৃশ্যকে নজর বন্দী করবে। কিছুদিন আগে গিয়ে দেখলাম, হাতিদের জায়গা বদল হয়েছে। আর গরুমারার ভেতরে পাটের তন্তু বোনার জন্য তাঁত বসেছে। মাদুর, পাপোষ, আসন, ব্যাগ বন বস্তির মেয়েরা সরকারি আনূকুল্যে কত কীই না বানাচ্ছেন। আমরাও সুযোগ বুঝে তাঁতে বসে কীভাবে চালাতে হয়, শেখার চেষ্টা করেছিলাম। এছাড়াও ঐ মেয়েরা বন থেকে ধুনো সংগ্রহ করে মোটা মোটা ধুপকাঠির প্যাকেট বানান। ক্যাম্পাসের ভেতরে কটেজ, দুয়ারের বাইরেই চারতলা হোটেল। আশপাশের জমি সব পাঁচিল দিয়ে ঘেরা - সম্ভবত আরও রিসর্ট হবে। জঙ্গলটা বাঁচবে তো? আজকাল মনে বড় আশঙ্কা হয় আমার। সেবার সকালে যখন গরুমারা ঢুকেছি, যাওয়ার পথে চা বাগানে মেয়েরা কাজ করছিলেন, আবার দুপুরে যখন ফিরলাম, দেখি নিচু নিচু চা গাছের ছায়ায় শুয়ে তাঁরা অকাতরে ঘুমুচ্ছেন, পাশে কয়েকটা টিফিন বাক্স পড়ে আছে। দেখে ভারি মায়া হয়।

    মনের গতি চঞ্চল, খালি দিক ভুল করে - তাই আবার কী জানি কেন হঠাৎ মনে পড়ে যায় মাকনা হাতি নিয়ে আমাদের একবারের বিশেষ কীর্তির কথা। সেবারও ফিল্ড হয়েছিল চালসায়। আমার সহকর্মিনী বল্লরীদি আগে কোচবিহার কলেজে পড়াতো, তাই মাঝে মাঝেই কলেজের অন্যান্যদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তো জঙ্গল দেখতে। একবার মাকনা হাতির সামনা সামনি হয়েছিল ওদের গাড়ি, আর হাতিটা বেশ রেগে ছিল, ভগবানের কৃপায় আর চালকের দক্ষতায় সেবার ওরা রক্ষা পায়। আসলে মাকনা হাতিরা পুরুষ হলেও ওদের দাঁত থাকেনা তো, অনেক সময়ে অন্য দাঁতালের চাপে ওরা দলছুট হয়ে যায়। হাতিরা তো খুব সামাজিক প্রাণী, একা থাকলে ওদের মনটা খারাপ থাকে, অল্পতেই রেগে যায়। তা সেবারে সারাক্ষণই তুমুল মাকনা হাতির আলোচনা চলছিল। আবার সেই ব্যাচেই, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চার চার জোড়া প্রেমিক প্রেমিকা। কী জ্বালা! তাদের সামলাতে সামলাতে জুনিয়র সহকর্মী আমার গোপন নাম দিলেন টনি ব্লেয়ার। এমনিতে প্রকৃতির মাঝে এলে কাঁচা মনে নবরাগের উন্মেষ হয়, সেটা স্বাভাবিক। আমাদের কালেও হত। জুটির আভাস পেলেই আমরা বাপু তাদের গাড়িগুলো আলাদা করে দিই। আর যেদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রাইমারি সার্ভে হয়, সেদিন একসঙ্গে পাঠাই বটে, কিন্তু সঙ্গে দু একটা রসকষহীন কাবাব মে হাড্ডি সিরিয়াস টাইপের বন্ধু গুঁজে দিই। এমনিতে আমরা মানুষ ভালো, কিন্তু যেমন শান্তিতে এসেছি, তেমন ভাবেই বাবা মায়েদের হাতে ছানাপোনা তুলে দিতে হবে - এ বহুত চাপের ব্যাপার। তাই এসব ক্ষেত্রে একটু নিষ্ঠুর হতেই হয়। তা ওই বিশেষ ডোর টু ডোর সার্ভের দিন আমরা দুপুরের খাবার নিয়ে গ্রামেই থানা গেড়ে বসেছিলাম। ছোট ছোট দলে ভাগ করে ছেলেমেয়েদের পাঠানো হয়েছিল, যাতে কেউ একা না পড়ে যায়। দুপুরে খেতে আসার সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তখন মোবাইল ফোনের যুগ আসেনি, তাই কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে দলগুলো ফিরে এসে উত্তর জেনে নিয়ে আবার পরবর্তী কাজে বেরোচ্ছিল। কিন্তু একটি ছেলে, নাম - না আসলটা বলবোনা, ধরা যাক অসীম, সে যখনই আসছে, হনহনিয়ে একাই আসছে আবার তড়বড় করে চলেও যাচ্ছে। শেষে দুপুরে খেতে আসার সময়েও যখন দিগন্তে একলা অসীমের অবয়ব ফুটে উঠলো, হনহনিয়ে লম্বা পা ফেলে এদিক পানে আসছে, বল্লরীদি চিন্তিত মুখে বলে ফেলেছে - একী গো! ঐ যে আবার আসছে একা একা, ও কি মাকনা হাতি হয়ে গেল নাকি? মানে অন্য কিছু নয়, দুশ্চিন্তা থেকে ঐ উপমাটাই বেরিয়ে গেছে। ছাত্রছাত্রীরা ফিরতে শুরু করেছে। শহরে কর্ম জীবনে আমরা গম্ভীর, অত হাসি টাসি তখন পায়না। তবে ফিল্ডে গেলে আমাদের অন্য মূর্তি। ভেতরের ছেলেমানুষটা বাইরে উঁকি দেয়। অসীম মাকনা হাতি! - আমাদের পেটটা তখন হাসির বুড়বুড়িতে ফাটোফাটো, কিন্তু ওপরে সিরিয়াস মুখে কাজের হিসেব নিচ্ছি, খাবারের তদারক করছি।

    এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অজান্তেই ফিক ফিক করে হাসছিলাম। এখন যে আমি ফিল্ডে নেই, বাড়ির সঙ্গে - সেটা খেয়াল ছিলনা। পাশ থেকে কর্তার বিরক্ত গলা পেলাম - কীসের ঘোরে থাকো? নিজের মনে হেসে যাচ্ছে - যত্ত সব। গল্পটা বলতে পারতাম, কিন্তু টনি ব্লেয়ার আর মাকনা হাতির কম্বিনেশন বলাটা একটু ঝুঁকির হয়ে যাবে, পরিবারের অন্য আবহ, তারা এসব রসে বঞ্চিত। তাই চুপ চাপ চেপে যাই, একেবারে স্পিকটি নট।



    চলবে...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৩ আগস্ট ২০২৫ | ৪৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন