এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  গপ্পো  শনিবারবেলা

  • মুড়কিদিদির রামায়ণ

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ২৯ নভেম্বর ২০২৫ | ৮৩ বার পঠিত
  • ৭ম এবং শেষ পর্ব


    সেই যে লঙ্কার অরিষ্ট পাহাড়ের থেকে লাফ দিল হনুমান, নামল একেবারে মহেন্দ্রর চূড়ায়। নামতে নামতেই আকাশ থেকে সে দেখতে পায় জাম্বুবান দাদা আর তার বন্ধুরা সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে হনুমানের জন্যে অপেক্ষা করছে। কোন কোন বাঁদর সবা'র আগে হনুমানকে দেখবে বলে উঁচু গাছে চড়েছে, আকাশপানে তাদের মুখ। আবার আশপাশের নানা সাইজের পাহাড় আর টিলাতেও উঠেছে অনেক ভল্লুক আর বাঁদর। হনুমানকে দেখতে পেয়েই সবাই মিলে এমন হৈ-হল্লা শুরু করল, হনুমানের মনে হল নিশ্চয়ই লঙ্কায় অশোক বনে মা সীতাও শুনতে পাচ্ছেন এদের উল্লাসের শব্দ, জানতে পারছেন এই এখন-ই হনুমান নামল ওপারে!

    সবাই মিলে হনুমানের জন্যে এ-কদিন ধরে সংগ্রহ করে রেখেছিল তার প্রিয় ফল-পাকুড়, সদ্য শাঁস-গজানো ডাব, যার মিষ্টি জলে হনুমানের খুবই লোভ। একটু দূরে দুই ভল্লুক মিলে ভাঙছে একটা সদ্য পেড়ে-আনা মৌচাক, চাকের প্রথম মধুটা খাবে বীর হনুমান। সুগ্রীবের ভাইপো, বালীর ছেলে অঙ্গদ এখন যুবরাজ। তাকেই এই দলের নেতা করে দিয়েছে সুগ্রীব। হনুমান যে সীতার কাছ থেকে রামের জন্যে দিব্য চূড়ামণি নিয়ে এসেছে, সেই খবরটা হনুমানের মুখে শুনে অঙ্গদ বলল, আমার আর তর সইছে না, এই মণি হাতে পেলে রাম যে কী খুশি হবেন ভাবতেও আমার ভালো লাগছে। চল, আমরা এখনই সবাই মিলে কিষ্কিন্ধ্যা যাই। রাম-লক্ষ্মণ আর রাজাবাবু সুগ্রীবকাকাকে লঙ্কার খবর না দিয়ে আমার রাতের খাবার হজম হবে না, চোখেও ঘুম আসবে না!

    সবাই বলল, চল চল চল কিষ্কিন্ধ্যা!

    হুপ হাপ শব্দ করতে করতে তৈরি হয় সব বাঁদরের দল। হনুমানের মতো অতটা না হলেও মোটামুটি কয়েকডজন বাঁদর লাফ দিতে পারে অনেকটা দূরত্বই। প্রতিটি দলে একজন করে এক্সপার্ট লাফনদারের নেতৃত্বে কয়েকজন নেতা নিয়োগ করল অঙ্গদ। আর ভাল্লুকদের দায়িত্বে রইল জান্ববান। প্রায় বিদ্যুৎগতিতে সবাই পৌঁছল কিষ্কিন্ধ্যায়।

    যেমনটা ভাবা গিয়েছিল ঠিক তেমনই রামের উচ্ছ্বাস। দিব্য চূড়ামণি নামের পাথরটাকে দেখে চোখে জল এসে গেল তাঁর। তিনি হনুমানকে জড়িয়ে ধরে বললেন, অযোধ্যার বাইরে আমি তো ভিখারি এখন; আমার অন্য কিছুই নেই তাই আলিঙ্গনই দিলাম তোমায়। চোখ মুছতে মুছতে নীরবে হনুমান প্রণাম করে রামকে। অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকে সুগ্রীব আর অন্যরা।

    স্থি্র হল শুভস্য শীঘ্রম।

    এতক্ষণ চুপচাপ বসে বসে গল্প শুনছিল উচ্ছে, এখন নড়েচড়ে বসল সে; বলল, এটা কী হল?

    কোন্‌টা?– জিজ্ঞেস করে মুড়কি।

    ওই যে, শিকগরম না কী বললে তুমি?

    শিকগরম? মানে গরম শিক? তুই বুঝি এখনো ঘৃতপিণ্ড পাখির শূলপক্কের কথা চিন্তা করছিস? কী পেটুক রে বাবা!

    তুমিই তো বললে, প্রতিবাদ জানায় উচ্ছে।

    আমি বলেছি শীঘ্রম্, শিকগরম নয়। সাধারণ বাংলা ভাষায় আমরা যাকে বলি তাড়াতাড়ি, সেটাকেই পণ্ডিত লোকরা বলেন শীঘ্র। আর সংস্কৃত নামে একটা ভাষা আছে জানিস তো, সেই ভাষায় শীঘ্র হচ্ছে শীঘ্রম্‌।

    আর শুভ? মুড়কি দিদি বলে, আমি জানি তুই বলবি শুভ তো আমার মাসতুতো দাদার নাম। সে কথাটাও ঠিক, বলতে থাকে মুড়কি দিদি, কিন্তু ওই সংস্কৃত ভাষায় ওটার মানে হল, ভালো। যেটা হলে প্রায় সবায়েরই ভালো, সেটাই শুভ।

    তার মানে, শুভদাদা ভালো?

    ভালো হতেই পারে। নামটা যিনি দিয়েছিলেন তিনি হয়তো সেরকমই ভেবেছিলেন। এই যে ছেলেটার জন্ম হল, তা ভালোই হল, শুভ হল; সবা'র পক্ষেই ভালো!

    যাই হোক, আবার গল্পে ফিরে আসে মুড়কি দিদি। রামচন্দ্র ভাবলেন, হনুমান যখন লঙ্কা বেশ ভালোভাবেই চিনে এসেছে, সীতার সঙ্গে দেখা করে বুঝে এসেছে রাক্ষসরা এখনো অবধি সীতার কোন ক্ষতি করেনি, অতএব এখনই তাড়াতাড়ি লঙ্কায় পৌঁছে যাওয়া ভালো হবে। শুভস্য শীঘ্রম্‌। সুগ্রীবকে তিনি তাই তখনই সব সৈন্যদের ডাকতে বললেন। এখনই যাত্রা শুরু হোক লঙ্কার দিকে।

    খুব তাড়াতাড়ি হাঁটতে দৌড়োতে আর লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, এমন কোটিখানেক বাঁদর চলল সবার আগে আগে। এমন রাস্তা দিয়ে যেতে হবে যেখানে গাছে গাছে প্রচুর ফলমূল, ঠাণ্ডা জল আর মধু পাওয়া যাবে। খুব সতর্ক থাকতে হবে এই দলকে, কারণ হনুমান একাই যে-কাণ্ড করে এসেছে লঙ্কায়, তাতে যুদ্ধের ঘোষণা প্রায় হয়েই গেছে। রাবণের গুপ্তচররা হয়তো এরই মধ্যে রাস্তার ক্ষতি করেছে, জলে বিষ মিশিয়েছে। এই দলেই তাই এমন বাঁদরদের নেওয়া হল যারা সহজেই গুপ্তচরদের ধরতে পারে, জলে বা গাছের ফলে বিষ থাকলে বুঝতে তাদের বেশি সময় লাগে না। এমনিতেই অবিশ্যি গ্রাম বা নগরের মধ্যে দিয়ে বানর সেনার চলা বারণ। এমনকি স্বয়ং রামচন্দ্র ছোটখাট জনপদও তাদের এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছেন । যাবার পথে দুটো পাহাড়, সহ্য আর মলয়। সেই পাহাড়ে উঠতে উঠতেই সৈন্যদল দূরে সমুদ্র দেখতে পেল। পাহাড় পেরিয়েই সমুদ্রের বেলাভূমি।

    বেলাভূমি কী?– প্রশ্ন করে উচ্ছে।

    সমুদ্রে যখন জোয়ার আসে – বলে মুড়কি – তখন অনেকটা জল গড়িয়ে চলে আসে সমুদ্রের তীরও ছাড়িয়ে। এরকম অনেক দিন ধরে আসতে আসতে সমুদ্র যখন খানিকটা দূরে সরে যায়, তখন দেখা যায় ওখানকার মাটিটা একটু অন্য রকমের হয়ে গেছে, সেখানে বালিই বেশি। জল সরে যাওয়ায় এই বালি শুকনো। শুকনো বালিভর্তি এই জায়গাটাকেই বলা হয় বীচ বা বেলাভূমি। তুই তো আমার বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক করতে বকখালি গিয়েছিলি, অনেক হুটোপাটিও করেছিলি বীচ-এ সারি দিয়ে ছুটে যাওয়া লাল কাঁকড়াদের পেছন পেছন দৌড়িয়ে। ওটাই বেলা, বেলাভূমি। অনেকে ভুল করে বেলাকে বলে ব্যালা। আসলে, বানানটা একই, ব-এ এ-কার বে আর ল-এ আ-কার লা, বেলা। ব্যালা নয়। বাংলায় ব্যালা বানানের কোন শব্দই নেই, তবুও অনেক লোক বেলাকে ভুল করে ব্যালা বলে। আসলে তাদেরও দোষ নেই: "দুপুর গড়িয়ে বেলা পড়ে এসেছে,” অথবা "এল যে শীতের বেলা" যখন বলি তখন এই দু' জায়গাতেই উচ্চারণটা হবে ব্যালার মতো। কোন্‌টা যে ব্যালা বলব আর কোন্‌টা বেলা সেটা বোঝা যাবে মানে বুঝলে আর ঠিকঠাক উচ্চারণ প্রথম থেকেই ভালোভাবে শিখলে।

    এর উত্তরে উচ্ছে বলে, বাবা তো আমাকে ওইজন্যেই তোমার স্কুলে পড়তে বলল। বলল, আমাদের মুড়কির উচ্চারণ এক্কেবারে ঠিকঠাক।

    মুড়কি হেসে ফেলে। তারপর বলে, ততক্ষণে সৈন্যদল প্রায় সবাই পৌঁছিয়ে গেছে। রামচন্দ্র এসে ওই বেলাভূমিতে একটা আসন পেতে বসে সমুদ্রের দিকে একমনে তাকিয়ে আছেন, এমন সময় সুগ্রীব তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। তাকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল, রাম জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? সুগ্রীব বলল, মনে হচ্ছে রাবণের কয়েকজন চর এখানে ঘোরাঘুরি করছে।

    চর? কীভাবে জানা গেল?– জিজ্ঞেস করলেন রাম।

    সন্দেহ হল, বলে সুগ্রীব। ওদের মধ্যে একজনের বেশ রাজপুত্রের মতো চেহারা যদিও রাক্ষসই মনে হয় – আর তার সঙ্গে বর্মধারী চার অনুচর। অনুচরদের সঙ্গে অনেক অস্ত্রশস্ত্র। লোকটা বলল, তার নাম বিভীষণ। সে নাকি রাবণের ছোট ভাই, আর প্রথম থেকেই সে সীতাদেবীকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেবার পক্ষপাতি। সে নাকি রাবণকে যুক্তি দিয়ে বারবার বলেছে সীতাকে ফিরিয়ে দিলে সে যে শুধু আপাতত নিজে বাঁচবে এবং লঙ্কাকে বাঁচাবে তা-ই নয়, রামের মতো বীরের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হলে একমাত্র রাম ছাড়া এই স্বর্গ-মর্ত্য-নরকে তার চেয়ে বড় বীর আর কেউ থাকবে না। রাবণ তার কথা মানেনি, রাজসভায় অন্যান্য রাক্ষসদের সামনেই তাকে অপমান করেছে। সে তাই তার চার সহচরকে সঙ্গে নিয়ে লঙ্কা ত্যাগ করে এসেছে এবং এমনকি নিজের স্ত্রীপুত্রদেরও ত্যাগ করে রামের শরণাগত হয়েছে।

    রাম বললেন, শরণাগতকে আশ্রয় দেওয়াই রাজধর্ম, কিন্তু এই যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি সুগ্রীবের মনে হচ্ছে রাবণের কোন আত্মীয়ই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের অন্যান্য সেনাপতিদের সঙ্গেও আলোচনা করা উচিত হবে মনে হয়। নানা সেনাপতির নানা মতের মধ্যে হনুমান বলে ওঠেন, স্বয়ং রামের অজ্ঞাত কিছুই নেই, তবুও তিনি আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত মত জানতে চাইছেন কেন? আসলে, তিনি আমাদের সবাইকেই তাঁর বন্ধু মনে করেন, আর তাই, বিশেষ সম্মান দিয়ে সবা'র মত জানতে চাইছেন। এই কথা বলার পর হনুমান কীটের ছদ্মবেশে তাঁর নিজের রাবণের রাজসভা দর্শনের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিলেন এবং বললেন, বিভীষণ অসময়ে বা অস্থানে আসেননি, রাবণের দৌরাত্ম্য দেখে আর রামের বিক্রম বুঝতে পেরেই পরাজিত রাবণের মৃত্যুর পর রাজ্যকামনায় রামের কাছে এসেছেন।

    শেষ পর্যন্ত সবাই মিলেই বিভীষণকে আশ্রয় দেওয়া সমর্থন করলেন।

    রাম বিভীষণকে জিজ্ঞেস করলেন, সবাই তো আর হনুমান নয় যে লাফ দিয়ে সাগর পেরিয়ে যাবে, এখন এত সৈন্য নিয়ে সাগর পার করি কীভাবে বলুন তো।

    বিভীষণ বললেন, আপনার পূর্বপুরুষরাই তো সমুদ্র খুঁড়েছিলেন, সমুদ্রকে বলুন না সাহায্য করতে।

    সমুদ্রের কাছে প্রার্থনা জানাতে রাম পূবের দিকে মুখ করে হাত জোড় করে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তাঁর মনে পড়ল জলের দেবতা বরুণের কথা। বরুণকে মনে করে একটা স্তোত্র পাঠ করতে শুরু করলেন তিনি।

    স্তোত্র পাঠ মানে?– আবার প্রশ্ন করে উচ্ছে।

    স্তোত্র হচ্ছে এক ধরণের কবিতা, অনেকটা পুজোর মন্ত্রর মতো। পুজো তো যেখানে-সেখানে যখন-তখন করা যায় না, পুজোর অনেক বায়নাক্কা। গঙ্গাজল অথবা নর্মদার পবিত্র জল অথবা অন্য কোন পবিত্র জল আনো, নানা রকমের খাবার জিনিষের ভোগ দাও, ভোজ্য সাজাও। গোছা গোছা ফুল জোগাড় কর, পুরুত আনো, পারলে পুরুতের চেলাদেরও নিয়ে এসো। তার বদলে স্তোত্রপাঠ অনেক ভালো, নির্ঝঞ্ঝাট! কিন্তু রামের মতো লোক অত গমগমে গলায় ভক্তিভরে স্তোত্রপাঠ করলেন, তবুও জলের দেবতা, মানে সমুদ্রেরও যিনি দেবতা, যাঁর নাম বরুণ, তাঁর দেখাই নেই।

    যে বরুণের দেখাই নেই তারই উদ্দেশে রাম গম্ভীর স্বরে বললেন, বরুণদেব, আমি জানি আপনি আমার ডাক শুনতে পেয়েছেন, তবুও সাড়া দিলেন না। নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। আমি আরেকবার পড়ব স্তোত্রটা, এবার
    না-এলে বিপদ হবে, তখন আমাকে দোষ দেবেন না কিন্তু। আরও একবার স্তোত্র পড়লেন রাম, এবারও অনুপস্থিত বরুণ। লক্ষ্মণকে নিজের ধনুকটা ধরতে দিয়েছিলেন রাম, এবার বললেন, ধনুকটা আমাকে দে, দেখি কত বড় মাতব্বর হয়েছে বরুণ। এবার তূণ থেকে একটা বাণ তুলে নিয়ে ধনুকে জুড়লেন রাম। তখন হঠাৎ পড়ি-কি-মরি দৌড়োতে দৌড়োতে হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির বরুণ, বললেন, আমার কথাটা আপনি ভাবুন শ্রীরামচন্দ্র।

    কী ভাবব আপনার কথা? আপনি আমার কথা ভেবেছেন? আপনি ভালো মতোই জানেন, এই বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আমাকে সমুদ্র পেরোতে হবে। সমুদ্রের মালিক আপনি, আপনি সাহায্য না করলে আমার পক্ষে এ কি সম্ভব? তাই পরামর্শ করার জন্যে আপনাকে ডাকছিলাম। কিন্তু সব কিছু জেনেশুনেও আপনি চুপ করে বসে রইলেন। কাজেই আমাকে
    একা-একাই সিদ্ধান্ত নিতে হল। ধনুকের ছিলায় একবার আঙুল বুলিয়ে রাম বললেন, এই বাণের মন্ত্র পড়া হয়ে গেছে,
    এ-বাণ এখন আর ফিরিয়ে নেবার উপায় নেই। আপনার সমুদ্রের যাবতীয় জল শুকিয়ে, সমুদ্রের একেবারে নীচের শেষ ফোঁটা জলটাও শুকিয়ে দিয়ে, বাণ ফিরে আসবে আমার তূণে।

    আপনি বুঝতে পারছেন শ্রীরামচন্দ্র তার মানে? শুধু যে সমুদ্রের এত প্রাণী মারা পড়বে তা-ই নয়, সারা পৃথিবীর উপর এর প্রতিক্রিয়া হবে। ঝড় ভূমিকম্প বজ্রপাত এসব তো আছেই, মহাদেশগুলোরও সব এলোমেলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সম্ভাবনা।

    তাতে আমার কী ক্ষতি, বলেন রাম, সীতা উদ্ধারের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় আর কিছুই নেই আমার কাছে। পৃথিবীকে বাঁচাতে চান তো সমুদ্র পেরিয়ে আমার সৈন্যদল নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন, যদি না পারেন আমার কিছুই করার নেই।

    আমি কথা দিচ্ছি, বলেন বরুণদেব, আপনার সমস্যার সমাধানের ব্যবস্থা আমি করিয়ে দেব – তীর এখনো আপনার ধনুকের ছিলা থেকে বেরোয়নি – চাইলেই তার গতিপথ আপনি বদলিয়ে দিতে পারেন। তাতে সবায়ের মঙ্গল হবে।

    বলুন কোন্‌দিকে ঘোরাব গতিপথ, আর পৃথিবীর কী উপকারটাই বা হবে তাতে, বলেন রাম।

    যেখানে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল সেখান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে আঙুল দেখালেন বরুণ, বললেন, হে রামচন্দ্র, আপনি সমুদ্রের শেষ যেখানে খালি-চোখে দেখছেন তার চেয়েও অনেক দূরে ওই উত্তর পশ্চিমে দ্রুমকুল্য নামে একটা জায়গা আছে, সেখানে থাকে আভীর নামে একদল ভয়ঙ্কর নৃশংস দস্যু, সেই জায়গাটাকে নিশানা করুন আপনি, আভীরদের অত্যাচারে যারা অতিষ্ঠ সেই মানুষরা আপনাকে আশীর্বাদ করবে।

    রাম হাসলেন, এবং বললেন, আশীর্বাদটা পড়ে-পাওয়া চোদ্দ আনা, বাণকে তূণে ফেরাতে হলে কোন এক জায়গায় ফেলতেই হয়; আপনার এই সমুদ্রকে আমি মুক্তি দিচ্ছি, আপনি কিন্তু এখনই যাবেন না, আপনার পরামর্শটা শুনব।

    মুড়কির গল্পকে আর এগোতে না দিয়ে উচ্ছে বলে, ওই যে চোদ্দ না কী যেন আনা তুমি বললে – মা-ও বলতো – ওই কথাটার মানে কি?

    আনা মানে তুই জানিস?– মুড়কি জিজ্ঞেস করে, আর উচ্ছেকে কোন জবাব দেবার সুযোগ না দিয়েই বলে, আনা হল টাকা পয়সার হিসেবের একটা মাপ, কিছুদিন আগে পর্যন্তও লোকে বলতো এসব। যেমন আমরা এখন বলি টাকা আর পয়সা, একশো পয়সায় এক টাকা, এই হিসেবে। কিন্তু পড়ে-পাওয়া ব্যাপারটা খুব মজার। ধর, তুই আমাদের বাড়ির পাশে যে ছোট্ট দোকানটা আছে সেখানে গেলি একটা লজেন্স কিনতে। আজকাল আর লজেন্স কিনতে গিয়ে কেউ একটা চায় না, একটু বেশিই চায়। কিন্তু তুই একটাই চাইলি। দোকানদার তোকে একটা দিল, তুই সেটা মুখে পুরলি, একটা টাকা পকেট থেকে বের করে দিলি দোকানদারকে। যেই তুই ফেরবার জন্যে অ্যাবাউট টার্ণ করেছিস দোকানদার তোকে বলল, এইটা নিয়ে যাও খোকাবাবু। তুই ফিরলি দোকানে, তোকে সে দিল একটা পঞ্চাশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা একটা, একটা দশ আর একটা পাঁচ। মোট নব্বই পয়সা। তুই তো অবাক, বললি এগুলো কী? ফেরৎ পয়সা, বলল দোকানদার। একটা লজেন্স দশ পয়সা, নব্বই পয়সা ফেরৎ।

    তুই তো ভাবিসইনি কোন পয়সা ফেরৎ পাবি! অথচ, দশ পয়সার একটা লজেন্স কিনে, লজেন্সের দামের ন' গুণ – মানে নব্বই পয়সা – চলে এল তোর হাতে! হিসেবের প্রায় বাইরেই, যেন ম্যাজিকের মতো! আগে-থেকে-না-ভাবা অনেকগুলো পয়সা এরকম পাওয়া গেলে তাকে বলে পড়ে-পাওয়া পয়সা, যেন কুড়িয়ে পাওয়া! টাকা-আনার হিসেব ছিল যখন, ষোল আনায় এক টাকা, তখন যদি দু' আনা দামের একটা কিছু কিনে এরকম হিসেবের বাইরে চোদ্দ আনা পেয়ে যেতিস, সেটা হত পড়ে-পাওয়া চোদ্দ আনা! রামচন্দ্র ভাবলেন বাণটা যদি উত্তর-পশ্চিমে দ্রুমকুল্যতে ফেলা যায়, আপাতত বাণটার একটা গতি হবে আর কয়েকজন খারাপ লোককেও শাস্তি দেওয়া যাবে। বরুণদেব যখন বললেন, আপনার বাণ দ্রুমকুল্যতে পড়লে আভীরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষেরা আপনাকে আশীর্বাদ করবে, তখন রামের মনে হল শুধু যে বাণটা আবার তূণীরে ফিরে পাওয়া যাবে তা-ই নয়, অন্য মানুষের আশীর্বাদ পাবার কথাটা তিনি তো আগে ভাবেনইনি! তাই ওটা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা!

    তো, বাণটা শেষ পর্যন্ত ফেলা হল ওই দ্রুমকুল্যতেই! তারপর কী হল বল্‌তো। মাটি ফুঁড়ে বাণটা ঢুকে গেল, সঙ্গে এমন আওয়াজ যে মাথা ঘুরে পড়ে গেল অনেক মানুষ! পৃথিবী যেন কেঁপে উঠল! ওই জায়গাটা দিয়ে ভারী সুন্দর একটা নদী বয়ে যেত। সেটা ঢুকে গেল মাটির গভীরে কত যে নীচে তার হিসেব পাওয়া দায়, শুধু ছোট্ট একটু জায়গা দিয়ে পিচকিরির মতো একটা জলের ফোয়ারা একটুখানি উঠেই আস্তে আস্তে ফোঁটা ফোঁটা জলে-ভেজা একটা জায়গা রইল পড়ে! আর কোথা থেকে রাজ্যের বালি উড়ে এসে ঢেকে দিল সমস্ত জায়গাটাকেই। সমস্ত জায়গাটা মানে কতটুকু ভাবতে পারিস? বেশি নয়, দু' লক্ষ স্কোয়ার কিলোমিটার! কতটা, তুই কি আন্দাজ করতে পারবি? এটাই এখন দ্য গ্রেট ইণ্ডিয়ান ডেসার্ট – আমরা যাকে বলি থর মরুভূমি।

    থর? রাজস্থানে? আমাদের রাজস্থানে? উচ্ছের গলায় একই সঙ্গে বিস্ময় আর খুশি।

    হ্যাঁ, তোদের রাজস্থানেই। কাকা বলেছে এবার পুজোয় তোকে আর আমাকে নিয়ে যোধপুরে বেড়াতে যাবে। যোধপুর মানে শুধু যোধপুর শহর আর সেখান থেকে জয়সলমীরে গিয়ে সোনার কেল্লা দেখাই নয়; আমরা এবার যাব যোধপুরের একটা গ্রামে, গ্রামের নাম মোকলাবাস, সেখানে আর্ণা ঝরনা নামে একটা মিউজিয়ম আছে। তুই বোধ হয় দেখিসনি। মরুভূমি থেকে পাওয়া অনেক কিছুই আছে সেই মিউজিয়মে, আর আছে একটা সুরবাঁধা তারের বাদ্যযন্ত্র। এখন আর বাজানো যায় কিনা জানিনা, কিন্তু ওখানকার মানুষরা ওটাকে রাবণহাট্টা নামে ডাকে। ওইটা দেখার আমার বড় ইচ্ছে!

    যাই হোক, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নিজের কাজ শেষ করে যখন তীর ফিরে এল তূণীরে রামের কাছে, আশ্বস্ত হয়ে বরুণ বললেন, এখন বলুন রামচন্দ্র, আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি। রাম বললেন, আমাদের হনুমান গিয়েছিল লঙ্কায়।

    লঙ্কায়? গিয়েছিল?– বিস্মিত বরুণ।–হনুমান? কীভাবে?

    হনুমানের পক্ষে যেভাবে সম্ভব, বলেন রাম, মন্দার পর্বত থেকে লাফ দিয়ে। সে সীতার সঙ্গে দেখা করে এসেছে। সীতাকে অশোক বনে কিছু রাক্ষসীর জিম্মায় বন্দী করে রাখা হয়েছে, মনে হয় তার বিশেষ কোন ক্ষতি রাক্ষসরা করতে পারেনি। হনুমান রাবণের সঙ্গেও দেখা করেছিল। রাবণকে সে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল সীতাকে বন্দী করাটা তার ঠিক কাজ হয়নি। এখন যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে যথাশীঘ্র সীতাকে তার ফিরিয়ে দেওয়াই উচিত। এর উত্তরে রাবণ রাবণোচিত ব্যবহারই করেছে। সে হনুমানের ল্যাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। হনুমান নিজের শরীর বাড়িয়ে আগুনও বাড়িয়েছে। আর সেই বাড়ন্ত আগুনের সাহায্যে লঙ্কার বিস্তর ক্ষতিও করেছে। অতএব নতুন করে আর যুদ্ধ ঘোষণার দরকার নেই। আগামী
    পাঁচ-ছ'দিন যুদ্ধ-যাত্রার পক্ষে ভালো সময়। আপনি ওই সময়ের মধ্যে এই বিশাল সৈন্যদল নিয়ে ওপারে আমাদের লঙ্কায় পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে দিন।

    বরুণ বললেন, একটাই উপায়। আপনারা সমুদ্রের ওপারে যেখানে পৌঁছতে চাইছেন, আর যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছি, এই দুটো জায়গার মধ্যে একটা ব্রীজ – মানে একটা সেতু – করে দিলে হয় না? তাহলে সেতুর উপর দিয়ে দিব্যি হেঁটে হেঁটে সবাই পৌঁছে যাবে।

    রাম বললেন, করতে পারলে মন্দ হয় না, কিন্তু কাজটা সহজ হবে না। আপনি দেখাশোনা করে করিয়ে দিতে পারবেন?

    আমি? না আমি পারব না, এ কাজটা ইঞ্জিনীয়রের, বলেন বরুণ। কিন্তু মনে হল আপনার সৈন্যদলের মধ্যে নলকে দেখলাম। নলকে জানেন তো? সে স্বর্গের ইঞ্জিনীয়র বিশ্বকর্মার ছেলে। সেই বিশ্বকর্মা যাঁর হাতে তৈরি হয়েছে শুধু স্বর্গই নয়, এমনকি এই লঙ্কাও। সেই লঙ্কার ধ্বংসটা শুরু হোক না তাঁরই ছেলের হাতে।

    নলকে ডাকা হল। সে মাথা চুলকিয়ে বলল, কিন্তু আমাদের হাতে তো সময় মাত্র পাঁচ দিন। এত বড় একটা সেতু যদি সত্যিসত্যিই তৈরি করতে হয় তাহলে কমপক্ষে হাজারখানেক থাম গড়ে তুলতে হবে। থাম – পিলার! সমুদ্রের একেবারে তলা থেকে গাঁথতে গাঁথতে তুলতে হবে একটা-একটা করে থাম। এ তো কয়েক বছরের কাজ!

    তাহলে?–প্রশ্ন করেন রাম, কী করতে চাও?

    আমি একটা নতুন ধরণের সেতুর কথা ভাবছি, সেটা হয়তো চেষ্টা করলে পাঁচ দিনেই হতে পারে।

    তুমি চেষ্টা কর, রাম বলেন, নিশ্চয়ই পারবে। হনুমান এমন অসাধ্য কাজ করল, তুমিও পারবে।

    সে ক্ষেত্রে বরুণদেবের কাছ থেকে একটা বিশেষ সাহায্য চাই।

    বল নল, বরুণ বলেন, আমার সাধ্যের মধ্যে যা আছে সবই করব।

    নল বলল, আমি একটা ভাসমান সেতুর কথা ভাবছি। সমুদ্রের একেবারে উপরে যে জল, সেখানে আমরা কাজ করব।
    যে-কদিন কাজ চলবে, হাওয়া যথাসম্ভব কম আর সমুদ্র তরঙ্গহীন থাকলে আমাদের সুবিধে হবে।

    তাই হবে, তোমরা যে অংশে কাজ করবে সমুদ্রের সেই অংশে হাওয়া এবং তরঙ্গ এখন থেকে বন্ধ। নলকে আশীর্বাদ এবং রামকে নমস্কার করে বিদায় নিলেন বরুণ।

    বানর-সেনাপতিদের ডেকে রাম বললেন, আগামী পাঁচদিন তোমরা সবাই নলের আজ্ঞাবহ। সৈন্যদের বলে দাও, নল যা চাইবে তা-ই করতে হবে সবাইকে। এখন যুদ্ধজনিত আপৎকাল।

    নলের উপদেশে সবাই লেগে গেল চারদিকের পাহাড় থেকে বড় বড় শিলা সংগ্রহ করতে। সমুদ্রের যে-প্রান্তে রামসেনারা, সেই প্রান্তে দাঁড়িয়ে নল নিজে, আর তার পাশেই লাইন করে বড় বড় পাথরের শিলা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে বাঁদরের দল। নল নিজে দেখিয়ে দিচ্ছেন ঠিক কোন জায়গাটায় ফেলতে হবে পাথরখানা। কিন্তু, এ কী কাণ্ড! একটা করে পাথর জলে পড়ে, আর কোন দিকে না-তাকিয়ে সটান ডুবে যায় সমুদ্রে!

    তাহলে উপায়?

    অ্যাঁ, আমাকে বলছেন? নলের পাশেই দাঁড়িয়েছিল হনুমান, তার হাতে একটা কাপড়ের থলের মতো, সে গুনগুন করে গান গাইছিল।

    আমাদের এরকম একটা বিপদ, নল বলে, রামচন্দ্রকে কথা দিয়েছি পাঁচ দিনের মধ্যে সেতু গড়ে দেব, আর আপনি এখন গান গাইছেন?

    এর উত্তরে হনুমান হাসে, আর গান গেয়ে বলে, শিলা জলে ভাসি যায়, বাঁদরে সঙ্গীত গায়!

    মানে?

    মানে, দেখুন না, এই যে আমি গান গাইছি, এ কি গানের মতো গান হচ্ছে? মনের আনন্দে গাইছি ঠিকই, কিন্তু আমাকে যদি সত্যিসত্যিই কেউ ভালো করে গান শিখিয়ে দিত তাহলে কি ভালো গাইতে পারতুম না? আপনি রামচন্দ্রের কাজ করছেন, সেই রামচন্দ্র যিনি ইচ্ছে করলে যা চাইবেন তা-ই করতে পারেন। আপনি তো তাঁরই সাহায্য নিলেন না, তাহলে শিলা ভাসবে কেমন করে?

    হনুমান তার থলের মধ্যে থেকে একটা বড় থালার মতো পাথর বের করে বলে, এই পাথরটা ভালো করে লক্ষ্য করুন। নল দেখল, গোল পাথরটাকে বেড় করে চারদিক ঘিরে রাম রাম রাম রাম লেখা আছে। হনুমান বলে, ওই যে বড় বড় পাথরগুলো আপনি জলে ফেলছেন, আমিও ওই রকমের একটা বড় পাথর নিয়েছিলাম। তারপর সেটার একেবারে উপরের দিকে – এবার ওই কাপড়ের থলের থেকে একটা চকচকে ছোরা বের করে সে – বলে, এটা একটা হীরের ছোরা যা দিয়ে আমি পাথরটাকে বেড় করে একটা লাইন এঁকে নিয়েছিলাম। আর ওইরকমেরই আর একটা লাইন তার একটু নীচেই।

    তার পর?– প্রশ্ন করে নল।

    তার পর আর কী, দুটো দাগের মাঝখানে – হনুমান তার থালার মতো পাথরটা আরেকবার দেখায় নলকে – এই দেখুন না, রামের নাম লিখে ভর্তি করে দিলাম, দেখছেন তো? ওই ছোরাটা দিয়েই!

    আপনি তো জানেন নল, হনুমান বলতে থাকে, হীরের ছোরার জোর কত সে তো আপনি জানেনই। লোহাই হোক বা
    যে-কোন ধাতু, পাহাড়-পর্বতের যে কোন পাথর তা-সে যা-কিছু দিয়েই তৈরি হোক না কেন, হীরের ছোরা সহজেই তাকে কেটে ফেলতে পারে। সেই ছুরি এক পাক ঘুরিয়ে দিয়ে লাইন আঁকার পর দেখা গেল এক পাক ঘোরানো দাগের ওপরের অংশটা আগের মতো শক্ত করে বসে নেই আর, হাতুড়ির ঠুকঠুকেই ওপরের অংশটা কেটে বেরিয়ে গেল। আর একই রকম ভাবে নীচের অংশটাও। পড়ে থাকল শুধু থালার মতো এই পাথরটা, যার বেড়টা ঘিরে শুধু রামের নামই লেখা।

    থালাটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নল, বলে, এটা ভাসবে?

    চলুন না, একবার পরীক্ষা করেই দেখা যাক।

    যদিও আশেপাশে আর কারো সঙ্গে কথা বলেনি হনুমান বা নল, অনেকেই বুঝতে পারছিল পাথরের জলে-না-ভাসা নিয়ে কিছু একটা আলোচনা চলছে নল আর হনুমানের মধ্যে। তারাও ওদের সঙ্গ নিল।

    জলের মধ্যে খানিকটা হাঁটার পর যখন নলের মনে হল এখানে যথেষ্ট জল আছে, সে হনুমানকে বলল, তাহলে এখানে ভাসাবার চেষ্টা করি। হনুমান বলে, তার আগে একটু রামনাম। বলেই, উচ্চকণ্ঠে জয় রাম বলে ওঠে হনুমান। তার দেখাদেখি নলও। এবং যারা ওদের সঙ্গ নিয়েছিল তারাও। পাথরটা জলের নীচে খানিকক্ষণ ধরে রেখে তলা থেকে তার দু'হাত সরিয়ে নেয় নল, পাথর ভাসতেই থাকে। হনুমান বলে, দেখলেন তো, ভরসা রাখুন রামের নামে।

    সে ভরসা তো সব সময়েই আছে, বলে নল, তবু দায়িত্ব যখন নিয়েছি আর একটু দেখি চাপের মুখে কী হয়।

    নিশ্চয়ই, একশোবার, বলে হনুমান।

    আর একটু গভীর জলের দিকে এগিয়ে যায় নল, জলে ডুব দিয়ে একেবারে যেখানে প্রায় মাটি সেই পর্যন্ত থালাটকে নামিয়ে এনে কিছুক্ষণ ধরে থেকে তারপর ছেড়ে দিয়ে আবার জলের বাইরে উঠে এসে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে লক্ষ্য করে, নিজের মুখটা জলের বাইরে বের করে আনার আগেই থালাটা ভেসে উঠেছে।

    খুশিতে ডগমগ নল হনুমানকে জড়িয়ে ধরে, আপনি আমায় দ্বিতীয়বার প্রাণ দিলেন হনুমান, আপনাকে কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব ভেবে পাইনা। হনুমান বলে, আমাকে নয়, কৃতজ্ঞতা রামনামকে।

    এতক্ষণ খুবই মনোযোগ দিয়ে উচ্ছে শুনছিল গল্পটা। এবার বলল, এই গল্পটা বাবাকে বলতে হবে।

    বাবাকে? কেন? জিজ্ঞেস করে মুড়কি।

    বাবা আমায় রোববার দিন অ্যাণ্ডারসন ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিল সাঁতারে ভর্তি করবে বলে। ওরা নিল না। ওরা বলল, আর একটু লম্বা হোক তারপর নিয়ে আসবেন। ফেরার সময় আমি বাবাকে বললুম, সাঁতার তো কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটে না, হয় উপুড় হয়ে, আর নয়তো চিৎ হয়ে। তাহলে ওরা আমাকে নিল না কেন?

    বাবা বলল, তুই খেয়াল করেছিলি পূলের একেবারে সামনের দিকে কয়েকটা বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে দেয়ালে গাঁথা একটা হ্যাণ্ডেল ধরে জলে শুয়ে সমানেই ওদের জলে-ডোবানো পা ছুঁড়ে চলেছিল – ওদের ভাষায় পেডালিং – খেয়াল করেছিলি? আর যখন হাঁপিয়ে যাচ্ছিল তখন হ্যাণ্ডেলটা ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল ওরা। এখন যদি তোকে ওরা নেয়, যখন হাঁপিয়ে যাবি, তুই কিন্তু দাঁড়াতে পারবি না, ডুবে যাবি, কারণ তোর হাইটে জলের নীচে থাকবি তুই। তাই সাঁতার শিখতে হলে তোকে আর একটু লম্বা হতে হবে। আচ্ছা মুড়কি দিদি, এখন তো আমি বাবাকে বলতেই পারি আমার সারা গায়ে রামের নাম লিখে দিতে?

    গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে উচ্ছের দিকে তাকিয়ে থাকে মুড়কি, তার ঠোঁটে আর চোখে মৃদু হাসি। তারপর উচ্ছেকে বলে সে, জেঠামার কাছ থেকে একটা শসা চেয়ে আনতে পারবি?

    তোমার খিদে পেয়েছে?– উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জিজ্ঞেস করে উচ্ছে। তারপর দৌড়িয়ে বেরিয়ে যায় সে, পেছন থেকে মুড়কি দিদি চেঁচিয়ে বলে, একটা ডেকচিও নিয়ে আসবি, খালি ডেকচি।

    ডাক্তার কাকার পরামর্শ মতো আজকাল মুড়কির ঘরেই একটা কুঁজোতে জল ভরা থাকে। ডেকচি আর শসা নিয়ে উচ্ছে ফিরে এলে কুঁজোর জলে ডেকচিটা ভরা হয়। তারপর উচ্ছেকে বলে মুড়কি, শসাটা এই জলে ফেলে দে। উচ্ছে ফেলে, শসা ডুবে যায়। মুড়কি বলে, চিৎ করে ফেলেছিলি না উপুড় করে?

    ধ্যাৎ, শসার আবার চিৎ-উপুড় হয় নাকি?

    তাহলে সোজা করে ফেল। দাঁড় করিয়ে, বলে মুড়কি।

    যতবারই দাঁড় করাবার চেষ্টা করে উচ্ছে, শসাটা ঠিক শুয়েই পড়ে, আর ডুবে একেবারে চলে যায় জলের নীচে।

    মুড়কি এবার বলে, শসাটা আমাকে দে তো।

    বইয়ের র‍্যাক থেকে পেনসিল কাটবার ছুরিটা নিয়ে এবার শসাটাকে চাকা-চাকা করে কাটতে শুরু করে মুড়কি, বেশ পনের-কুড়িটা টুকরো হয়। এবার টুকরোগুলোর কয়েকটা উচ্ছেকে দেয় সে, বলে, এগুলো এবার ওই জলে রাখ, দেখ, কী হয়। আর এবারটা উচ্ছের সঙ্গে হাত মেলায় সে নিজেও।

    সবক'টা টুকরোই জলের একেবারে ওপরে!

    ভাসছে!

    প্রায় মিনিটখানেক কথাই বলতে পারে না উচ্ছে, ওর চোখদুটো গোল গোল হয়ে যায় আর ও তাকিয়ে থাকে ভাসতে-থাকা শসার চাকাগুলোর দিকে। তারপর, কেমন যেন আপন মনেই বলে ওঠে, ঠিক যেন ওই পাথরের চাকার মতো! শুধু রামের নামটা লেখা নেই!

    মুড়কি বলে, বুঝতেই পারছিস সেই সমুদ্রের বেলাভূমিতে কী হল তারপর।

    এত বড় একটা সমস্যার সমাধানের পর প্রথমেই উৎসব। ঘন্টাখানেক উৎসব চলার পর নল হেঁকে বলে, ভাইসব, মনে রাখতে হবে পাঁচ দিনের মধ্যে এই সেতুবন্ধের কাজ শেষ করতে আমরা সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমি অঙ্ক কষে দেখেছি, আমাদের এই সেতুর দৈর্ঘ্য হবে একশো যোজন। এসো ভাইসব, অন্য সব কিছু ভুলে গিয়ে আমরা এবার কাজে হাত লাগাই।

    প্রথম দিনে চোদ্দ যোজন সেতুপথ তৈরি হল। দ্বিতীয় দিনে কুড়ি যোজন। তৃতীয় দিনে হল একুশ, তার পরের দিন বাইশ, আর শেষ দিনে তেইশ যোজন। ভাসমান সেতু, কাজ শেষ হবার পর এ-পার থেকে দেখলেন রাম। নলকে ডেকে বললেন, তোমার এই একশো যোজন দীর্ঘ আর দশ যোজন প্রস্থের ভাসমান সেতু যেন সমুদ্রের উপর শিল্পীর আঁকা রাজপথ বলে মনে হচ্ছে। সুগ্রীবকে রাম বললেন, আমাদের এই বিশাল সৈন্যদল আজই পায়ে হেঁটে ও-পারে যেতে শুরু করুক। সকলেই প্রবল পরিশ্রমে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। ওপারে পৌঁছিয়ে এদের ভোজন এবং শয়নের যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে তো?

    এর মধ্যে হনুমানের সঙ্গে একবার ওপারে গিয়ে পরিস্থিতি ভালো করে বুঝে এসেছিল সুগ্রীব। সে দেখে এসেছিল এমন একটা জায়গা যেখানে ফল-মূল-জলের অভাব ছিল না।

    অতএব ব্যবস্থা ছিলই। সানন্দে যাত্রা শুরু করল সবাই।

    উচ্ছেকে এবার মুড়কি বলে, এই যে সেতু পেরিয়ে লঙ্কায় বানরসেনা সমেত পৌঁছল রাম, এখানেই আমার রামায়ণের গল্প শেষ হয়ে যাওয়া উচিত। কারণ, লঙ্কায় গিয়ে রাম যে জিতে সীতাকে নিয়ে ফিরল তা তো মা'র কাছে শুনেইছিস তুই।

    তা শুনেছি, বলে উচ্ছে, কিন্তু যুদ্ধের শেষটা অন্তত আর একবার বল তুমি। রাবণ কীভাবে মরল?

    আচ্ছা বলব। শুধু রাবণ কীভাবে মরল তা-ই নয়, যুদ্ধের প্রায় শুরুতেই রাবণের পুত্র ইন্দ্রজিতের হাতে রাম-লক্ষ্মণ দুজনেই যে প্রায় মরতেই বসেছিল সেটাও বলব তোকে, বলে মুড়কি। অঙ্গদের কথা মনে আছে তোর?

    হ্যাঁ, বালীর ছেলে তো। রাজত্ব পেয়ে তাকেই তো প্রথম যুবরাজ করল সুগ্রীব?

    যুদ্ধটা রাম শুরু করেছিলেন সেই অঙ্গদকে দিয়েই। আকাশপথে সে রামের আদেশে লাফ দিয়ে লঙ্কার প্রাসাদে রাবণের কাছে পৌঁছল। মুড়কি বলে, সত্যি কথাটা এই, যে তার কাজ ছিল রাবণকে খানিকটা অপমান করা আর উত্তেজিত করা। উত্তেজিত রাবণ অঙ্গদের কথাবার্তায় রেগে গিয়ে তার পেছনে লাগিয়ে দিল চারজন রাক্ষসকে। সেই চার রাক্ষসকে সঙ্গে নিয়ে অঙ্গদ উঠে গেল আকাশপথে। ফেরবার সময় রাবণের প্রাসাদের সবচেয়ে উঁচু শিখরটাকে ধ্বংস করে আর ওই চার রাক্ষসকে পোকা-মাকড়ের মতো আকাশ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে ফিরে এল রামের কাছে।

    এবার লেগে গেল যুদ্ধ। অঙ্গদের করা অপমানটা বড্ড গায়ে লেগেছে রাবণের। লঙ্কার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা তার নিজের ছেলে ইন্দ্রজিৎকে সে পাঠাল অঙ্গদের সঙ্গে লড়তে। ইন্দ্রজিৎ সঙ্গে এনেছিল একটা বিশাল গদা, প্রথম সুযোগেই সেই গদা ছুঁড়ে সে মারতে গেল অঙ্গদকে। এক্সপার্ট উইকেটকীপারের মতো অঙ্গদের হাতে এখন সেই গদা। তাই দিয়েই প্রথমে সে শেষ করল ইন্দ্রজিতের রথ, তারপর তার ঘোড়া আর সারথিকে। পায়ে হেঁটে যুদ্ধ করার অভ্যেসই নেই ইন্দ্রজিতের, সে মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করার জন্যে বিখ্যাত। আর এদিকে হনুমান সুগ্রীব সুষেণ আর লক্ষ্মণ নিজেরা একটার পর একটা
    নাম-করা রাক্ষস-যোদ্ধাকে খতম করে চলেছে। দিনের আলোয় কোনরকমে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখল ইন্দ্রজিৎ। তারপর যুদ্ধটাকে টেনে নিয়ে গেল অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত। অন্ধকার হতেই মেঘের আড়াল থেকে সে তীরের পর তীর – মারাত্মক সব তীর – ছুঁড়তে লাগল রাম আর লক্ষ্মণকে লক্ষ্য করে। তার সুবিধে, মেঘের আড়ালে তাকে দেখতে পাচ্ছে না কেউ। হা হা করে হাসতে হাসতে ইন্দ্রজিৎ ঘোষণা করল, আমি যখন মেঘের আড়াল থেকে লড়াই করি স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রও দেখতে পান না আমাকে! তোমরা তো বাঁদর ভল্লুক আর মানুষ! হোঃ! হাসতে হাসতেই এবার ইন্দ্রজিৎ নাগপাশ বাণ দিয়ে বেঁধে ফেলল রাম আর লক্ষ্মণকে।

    এক্সপার্ট উইকেটকীপারের তুলনাটা শুনে হাততালি দিয়ে একবার শুধু হেসে উঠেছিল উচ্ছে, তারপর থেকে সে এক মনেই শুনছে। এবার তাকে জিজ্ঞেস করে মুড়কি, নাগপাশ বাণ বুঝলি?

    উচ্ছে মাথা নাড়ে, সে বোঝেনি।

    মুড়কি বলে, নাগ মানে হল সাপ। আর পাশ মানে দড়ি। বড় বড় সব বিষাক্ত সাপরা তীরের মতো চেহারা নিয়ে উড়ে এসে শত্রুকে এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে যে মনে হয় দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে তাদের। সেই সাপদের নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে ভয়ঙ্কর বিষ। সেই নিশ্বাসে যে-কোন জীবিত প্রাণী প্রথমে অজ্ঞান হয়, তারপর মরে। রাম-লক্ষ্মণও অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তাঁদের পক্ষের সৈন্যরা হতবাক। তাদের মৃত ঘোষণা করে ইন্দ্রজিৎ ফিরে গিয়ে রাবণকে জানাল, তার হাতে
    রাম-লক্ষ্মণের মৃত্যু হয়েছে!

    রাম-লক্ষ্মণের মৃত্যু! এর চেয়ে ভালো খবর আর কী হতে পারে!

    লঙ্কায় রাবণের রাজপ্রাসাদে যখন উৎসব চলছে, যুদ্ধক্ষেত্রে তখন রামসেনাদের শোক। ঠিক সেই সময়ে বীর সেনাপতি সুষেণ, যিনি বাঁদরদের চিকিৎসকও বটে, বললেন, তিনি পুরাকালে দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধে দেবতাদের গুরু বৃহস্পতিকে একটা গাছের শিকড় দিয়ে অজ্ঞান দেবতাদের চিকিৎসা করতে দেখেছেন। এই গাছ পাওয়া যাবে হিমালয়ের উত্তরে। এর নাম মৃতসঞ্জীবনী বিশল্যা। হনুমান যদি এই গাছ নিয়ে আসতে পারে, তিনি রাম-লক্ষ্মণের চিকিৎসা করতে পারেন। হনুমান তড়িঘড়ি প্রস্তুত হয়ে বেরোতে যাচ্ছে এমন সময় হঠাৎ আকাশে ঘন মেঘ, তার মাঝে মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, প্রবল হাওয়ায় বড় বড় গাছ ভেঙে ভেঙে পড়ছে এক্কেবারে সমুদ্রে। ঠিক সেই সময়েই দেখা গেল বিশাল এক পাখি তার পাখা দুটোতে ঝড়ের মতো হাওয়া আর শব্দ তুলে দূর আকাশ থেকে নেমে আসছে। সে মাটিতে নামার আগেই যে সাপরা রাম-লক্ষ্মণকে নাগপাশে জড়িয়েছিল, ভয়ে কোনরকমে কিলবিল করে পালিয়ে গিয়ে বাঁচল তারা। পাখিটা শুধু ঠোঁট দিয়ে রামলক্ষ্মণকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই রামলক্ষ্মণ সুস্থ হল। গায়ে ক্ষতের কোন চিহ্ণও আর রইল না। রাম আর লক্ষ্মণ হাত জোড় করে বলল, প্রভু, আপনি কে? পাখি বলল, আমার নাম গরুড়। আপাতত শুধু এইটুকুই জানো। আমি তোমাদের পরম বন্ধু। তোমাদের পিতা দশরথেরও। তাঁর পিতা অজেরও। আমি খবর পেলুম ইন্দ্রজিৎ মায়ার জোরে তোমাদের নাগপাশ দিয়ে বেঁধেছে। তাই কোনমতে এসে তোমাদের মুক্ত করলুম। আমার অন্য কাজ আছে, পরে দেখা হবে।

    উচ্ছে বলল, আমি কিন্তু জানি গরুড় কে।

    কে বল্‌তো – হেসে প্রশ্ন করে মুড়কি।

    অরুণের ছোট ভাই। সূর্যের সারথি সেই অরুণ, যাকে তার মা কোমরের-তলা-থেকে-পা-তখনও-তৈরি-হয়নি-অবস্থায় ডিম ভেঙে বের করে এনেছিল।

    গূড, বলে মুড়কি, তুই সব মনে রাখতে পারিস, তাই তোকে গল্প বলতে এত ভালো লাগে।

    মুড়কি দিদি প্রশংসা করলে খুবই ভালো লাগে উচ্ছের, কিন্তু তবুও বলল, তার পরে কী হল বলো না।

    কীসের পর?– মুড়কি যেন অবাক। গরুড় তো চলেই গেল। ও হ্যাঁ, আকাশবাতাস কাঁপিয়ে তখন হৈ হৈ করে উঠল রামের সৈন্যরা। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাঁদরদের খুশির উল্লাসের আওয়াজ শুনে ঘাবড়িয়ে গেল রাক্ষসরা – তবে কি রামলক্ষ্মণ মরেনি!

    মরেনি যে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল পরের দিনের লড়াইয়ের সময়। রেগেমেগে রাবণ নিজে এসেছিল সেদিনের লড়াইতে, আর এমন সেদিন একখানা ঘুঁষি খেল সে হনুমানের হাতে যে অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে মরো মরো। পরে জ্ঞান হতে আবার রামের মুখোমুখি। রাম বললেন, নাঃ রাবণ, আজ তুমি বড়ই ক্লান্ত। আজ ছেড়ে দিচ্ছি তোমায়। বাড়ি যাও। সুস্থ হয়ে আবার আসবে যখন তখন দেখা যাবে।

    পরপর দু-দুবার রাবণ ছাড় পেল রামের কাছ থেকে! একবার নিজের বাড়িতে বসে বসেই, সেই অঙ্গদ না কী যেন নামের এক বাঁদরের হাতে, আর দ্বিতীয়বার খোদ রামের অতিরিক্ত ভদ্রতার কাছে! বেঁচে গেল ঠিকই, কিন্তু অপমানে গা জ্বলে উঠল তার। ঠিক আছে, এই অপমানের জবাব আমি দেব কালই, যুদ্ধক্ষেত্রে! – বলতে বলতে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে রাবণ ফিরল বাড়ি!

    ঠিক পরের দিনেই যে রাবণ এল তা নয়, কিন্তু অনেক রকমের প্রস্তুতি নিয়ে এর পরে যেদিন যুদ্ধে এল সে সেদিন যা যুদ্ধ হল সে একেবারে ভয়ানক। রাবণ আগের দিনের অপমানের রাগ চেপে প্রচুর অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিশাল রথে যুদ্ধক্ষেত্রে ঢুকতে-না-ঢুকতেই রামের ধনুকের ভয়ঙ্কর টঙ্কার শোনা গেল। রামের মুখোমুখি হবার আগেই লক্ষ্মণ আক্রমণ করল রাবণকে। রাবণ লক্ষ্মণকে উপেক্ষা করে ভয়ানক সব অস্ত্রে আক্রমণ করল রামকে। সেই সুযোগে রাবণের একাধিক ধনুক, রথের ধ্বজা আর সারথিকে খতম করল লক্ষ্মণ। একই সঙ্গে গদার আঘাতে রথের ঘোড়াদুটোকে খতম করল রাবণেরই ভাই বিভীষণ। রথ থেকে নেমে বিভীষণকে বজ্রের মতো জ্বলন্ত এক বাণ দিয়ে আঘাত করতে গেল রাবণ, কিন্তু বিভীষণের কাছে পৌঁছবার আগেই সেটাকেও খতম করল লক্ষ্মণ। রেগেমেগে রাবণ বলল, ওহে লক্ষ্মণ, তুমি দেখি পদে পদে বিঘ্ন, এসো, তুমিই খতম হও আগে। বলেই, রাবণ শক্তিশেল বাণ নিক্ষেপ করল লক্ষ্মণের বুকে, লক্ষ্মণ পড়ে গেল মাটিতে।

    আশপাশ থেকে বাঁদর-সৈন্যরা এল দৌড়িয়ে। তারা লক্ষ্মণকে ঘিরে দাঁড়াল, আর প্রাণপণে লক্ষ্মণের বুক থেকে বাণটা টেনে তোলবার চেষ্টা করতে থাকল। এই সুযোগে তাদেরও কয়েকজনকে বাছাই-করা শর দিয়ে হত্যা করল রাবণ। রাম তখন দু'হাতে লক্ষ্মণের বুক থেকে টেনে তুললেন সেই শক্তিশেল, সুগ্রীব হনুমান আর কয়েকজনকে বললেন লক্ষ্মণকে ঘিরে থাকতে। বললেন, আজ তোমরা আমার পরাক্রম দেখবে। পৃথিবী আজ অরাবণ বা অরাম হবে।

    তখন তাঁর বিরাট ধনুক দিয়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের মতো রাশি রাশি শর ছুঁড়তে শুরু করলেন রাম, তাঁকে দেখে মনে হল এই পৃথিবীতে তাঁর একমাত্র কাম্য রাবণের মৃত্যু! ঘাবড়িয়ে গিয়ে রাবণ কোনরকমে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাল।

    এতক্ষণ যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন রাম, রাবণ পালাতেই এবার হুঁশ যেন ফিরল তাঁর, তিনি কাঁদতে কাঁদতে সুষেণকে বললেন, লক্ষ্মণ ছাড়া যুদ্ধে জিতেই বা কী করব আমি! মা সুমিত্রার সামনে দাঁড়াবই বা কীভাবে!

    সুষেণ বললেন, অতিরিক্ত স্নেহের মোহে লক্ষ্মণের আঘাতকে আপনি মৃত্যু মনে করছেন। লক্ষ্মণ মরেননি। ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখুন, মুখ বিকৃত হয়নি, শরীরের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্যও দেখা যাচ্ছে। এই দূর থেকেও আমি এমনকি ওঁর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনিও দেখতে পাচ্ছি। হনুমান এখনই ওষধি পর্বতে যাবেন, সেখান থেকে তিনি বিশল্যকরণী, সাবর্ণ্যকরণী, সঞ্জীবকরণী আর সন্ধানী – এই চার রকমের মহৌষধি নিয়ে আসবেন। চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন লক্ষ্মণ।

    মায়ের কাছে রামায়ণের গল্প শুনেছিল উচ্ছে, কিন্তু যুদ্ধের এইসব খুঁটিনাটি মা বলেনি ওকে। হয়তো মুড়কিও বলতো না, কিন্তু রাবণ কীভাবে মরল তা শোনবার জন্যে বিশেষ উৎসাহ উচ্ছের। ডাক্তারকাকা মুড়কিকে বলেছিলেন, ছোটদের কাছে গল্প বলার সময় মনে রাখবি, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাবার মতো করে সব কিছু যদি না-ও বোঝে অথবা না-ও মুখস্থ রাখতে পারে ছোটরা, নিজেদের মনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সব কিছুই একরকম বুঝে নেয় তারা। তাই, গল্প শুনেছে যেসব ছোটরা, বারবার গল্প শোনার জন্যে বায়না করে তারাই। রূপকথার অসম্ভব কাণ্ডকাহিনী সব দেশের বাচ্চারাই ভালোবেসে শোনে। আর ওদের কাছে ওই গল্পটাই শুনতে চাস, দেখবি, নিজের বোধ অনুযায়ী কেমন চমৎকার লজিকাল সিকোয়েন্সে গল্প শোনাবে ওরা!

    উচ্ছে বলল, মহৌষধি মানে কি ওষুধ?

    ঠিক মহৌষধি মানেই ওষুধ নয়, বলে মুড়কি, কিন্তু মহৌষধি হচ্ছে সেই সব ছোট-বড় উদ্ভিদ বা গাছ, যার থেকে খুব ভালো, খুব কাজের, ওষুধ তৈরি করা যায়। ওই উদ্ভিদগুলো যদি নিয়ে আসতে পারে হনুমান তাহলে সুষেণ লক্ষ্মণের চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরি করে নেবেন। কিন্তু মুশকিল হল, ওষধি পর্বতে গিয়ে, হাজার হাজার উদ্ভিদের মধ্যে কোনগুলো যে কী, বুঝতেই পারল না হনুমান। সুষেণ তাকে বলেছিলেন ওই পর্বতের দক্ষিণ, মানে একেবারে ডানদিকের শিখরে, এই ওষধিগুলো পাওয়া যাবে। সময় নষ্ট না করে হনুমান পর্বতের গোটা দক্ষিণ শিখরটাই উঠিয়ে মাথায় করে নিয়ে এল।

    বেছে বেছে ওই চারটে মহৌষধি তুলে নিলেন সুষেণ, তৈরি করলেন ওষুধ, আর সেই ওষুধের জোরে লক্ষ্মণের উঠে বসতে প্রায় সময়ই লাগল না। উঠে বসে এমনভাবে যুদ্ধক্ষেত্রের চারদিকে চোখ কচলিয়ে তাকাল লক্ষ্মণ মনে হল যেন সে ঘুমোচ্ছিল এতক্ষণ। একটা হাই তোলার পর সামনেই দাঁড়ানো রামের সঙ্গে তার চোখাচোখি। রামের চোখ থেকে অবিরাম বেরিয়ে আসা জল দেখল লক্ষ্মণ। বলল, তোমার না আজই পৃথিবীকে অরাবণ করার কথা ছিল? সূর্যাস্তের আর দেরি নেই। চল, তোমার প্রতিশ্রুতি তো রাখতেই হবে।

    ততক্ষণে আবার ফিরে এসেছে রাবণ। রাম তার গলা তাক করে বাছাই-করা এক তীক্ষ্ণ শর ছুঁড়লেন। দশমুণ্ড রাবণের একটা মুণ্ডু পড়ল খসে। বাঁদররা জয়ধ্বনি দেবার জন্যে ঠিক যখন লাফিয়ে উঠেছে, তখনই দেখল গলার যেখান থেকে মুণ্ডুটা খসে পড়েছিল, সেখানেই আর একখানা অবিকল একই রকমের মুণ্ডু! পরপর কয়েকবার শর ছুঁড়লেন রাম, প্রতিবারেই ফাঁকা জায়গাটায় কোথা থেকে যেন লেগে যায় আর একটা মুণ্ডু! সেই মুহূর্তেই! রাম বুঝলেন, রাবণকে এভাবে মারা যাবে না। তাহলে? কীভাবে পৃথিবীকে অরাবণ করবেন তিনি?

    এবার রাবণের বুক লক্ষ্য করে ব্রহ্মাস্ত্র ছুঁড়লেন রাম। বুক ফালা-ফালা হয়ে গেল। ধপাস করে পৃথিবী কাঁপিয়ে রাবণের মৃতদেহ পড়ল মাটিতে!

    বিভীষণ তো রাবণের ছোটভাই। যতই মতের অমিল থাক দু'ভাইয়ের মধ্যে, বিভীষণের চোখ থেকে দেখা গেল টপটপ করে পড়ছে জল। রাম তাকে সান্ত্বনা দিয়ে লক্ষ্মণকে বললেন, লঙ্কা এখন অভিভাবকহীন হয়েছে। তুমি বিভীষণের অভিষেক সম্পন্ন করে তাকে লঙ্কার সিংহাসনে বসাও।

    যুদ্ধ তো শেষ। বিভীষণ নতুন রাজা। রাজা হয়ে সে রামকে অনুরোধ করল রাম যেন অযোধ্যায় ফিরে যাবার আগে নলের তৈরি-করা ওই সেতুটা ভেঙে দিয়ে যান।

    সেতুটা? কেন হে?– বললেন রাম, অমন চমৎকার সেতু, ওটা তো একটা গর্ব করার মতো সৃষ্টি। আমার মনে আছে, রাম বলতে থাকেন, পাঁচদিনের পর যখন সেতুর কাজ শেষ হল, খবর পেয়ে স্বর্গ থেকে দলে দলে দেবতারা ওটাকে দেখতে এসেছিলেন।

    তা এসেছিলেন জানি, বললেন বিভীষণ, দেখতে আসার মতোই সৃষ্টি যে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই, কিন্তু লঙ্কার সুরক্ষায় অসুবিধে করবে ওটাই। আপনি তো জানেন শ্রীরাম, পুরো লঙ্কারাজ্যটাই স্বর্গের বাস্তুবিদ – বাস্তুবিদ মানে বুঝলি তো, ইঞ্জিনীয়র বা আর্কিটেক্ট, বলে মুড়কি – বিশ্বকর্মার নিজস্ব সৃষ্টি। সমুদ্রের স্বাভাবিক সুরক্ষাকে তিনি এমন ভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন যে ত্রিকূট পাহাড় কেটে তৈরি করা এই রাজ্যে ইচ্ছে করলেই যে কেউ ঢুকতে পারত না। এখন এই সেতুটা যদি থাকে, পায়ে হেঁটে যে-কেউই লঙ্কায় ঢুকে পড়বে।

    তা মানছি, রাম বলেন, কিন্তু সেতু ভাঙলে আমরাই বা লঙ্কা থেকে বেরোব কেমন করে? আমি তো এখন যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি অযোধ্যায় পৌঁছতেই চাই।

    তা কি আমি জানি না শ্রীরাম?– বলেন বিভীষণ, আমাদের দাদা কুবেরের যে পুষ্পক রথটি জোর করে এখানেই নিয়ে এসেছিলেন রাবণদাদা, যুদ্ধের ফলাফল শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা পরিষ্কার-টরিষ্কার করে ভালো করে ফুল-টুল দিয়ে পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে রাক্ষসদের মধ্যে আপনার যারা ভক্ত, তারা। সেই রথে আপনি একদিনেই এখান থেকে অযোধ্যায় পৌঁছিয়ে যাবেন।

    অনেকক্ষণ কথা বলেনি উচ্ছে, এবার সে বলে, পুষ্প মানেই তো ফুল, তাহলে পুষ্পক রথ মানে ফুলের রথ, তাই না?– ফুল দিয়ে তৈরি রথ, সে তো খেলবার জন্যে আর ঘর সাজাবার জন্যে, তাই তো? তাহলে সেটা চলবে কী করে? পৌঁছবেই বা কী করে অযোধ্যায়?

    হেসে ফেলে মুড়কিদিদি, বলে, তোর আন্দাজটা প্রায় ঠিক, কিন্তু পুরোটা নয়। ফুল দিয়ে সাজানো হতেও পারে পুষ্পক, কিন্তু তৈরি ফুল দিয়ে? নাঃ, তা নিশ্চয়ই নয়। রামায়ণের গল্পে পুষ্পক রথ শুধু রথটারই নাম; আকাশে ওড়ে, আর খুবই তাড়াতাড়ি এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে পারে।

    তাহলে কি এয়ারোপ্লেনের মতো?– উচ্ছের প্রশ্ন।

    এবার তুই সম্ভবত ঠিকই বলেছিস, বলে মুড়কি, যত রকমের গাড়ির কথা আমরা জানি, তার মধ্যে এয়ারোপ্লেনের সঙ্গেই পুষ্পক রথের সবচেয়ে বেশি মিল। সে তো ফুলের তৈরি হতেই পারে না। পণ্ডিতরা নানা হিসেব করে দেখিয়েছেন, বাল্মীকি – যাঁকে ভারতবর্ষের প্রথম কবি, আদিকবি, বলা হয় – তিনি আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে রামায়ণ রচনা করেছিলেন। তামা থেকে শুরু করে লোহা পর্যন্ত প্রায় সব রকমের ধাতুরই আবিষ্কার হয়ে গেছে সেই সময়, যদিও এয়ারোপ্লেন আবিষ্কার হয়নি নিশ্চয়ই। কিন্তু কবির কল্পনায় এয়ারোপ্লেন আবিষ্কার হতে বাধা কোথায়, যখন নানা রকমের শকট বা গাড়ি – রথ সমেত – খুবই পরিচিত এবং দিব্যি অনেকেই ব্যবহার করছে! খেয়াল করে দেখিস, রামায়ণের গল্পের দেবতা-টেবতারা স্বর্গের মধ্যেই ভ্রমণের জন্যে, অথবা স্বর্গ আর মর্ত্যের মধ্যে যাতায়াত করতে হলে, রথই ব্যবহার করতেন! সে-রথ চলতো কীভাবে?

    আপাতত, মুড়কি বলতে থাকে, দেবতা বা স্বর্গের কথা বাদ দিয়ে আমাদের পৃথিবীর কথাই ভাবা যাক। পৃথিবীতে গাড়ি চলছে যে ঠিক কতদিন আগের থেকে তা বলা মুশকিল। মনে হয়, যেদিন মানুষ চাকা তৈরি করতে শিখল, সেদিন থেকে গাড়ি চলতে বেশি দিন সময় লাগেনি। শুধু গাড়িই বা বলি কেন, মুড়কি বলে, চাকার আবিষ্কার এক ধাক্কায় মানুষের সভ্যতাকে প্রায় লাফ দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেল অন্তত কয়েক হাজার বছর। কুমোরের চাকার কথা একবার ভাব! যে-মানুষ সেই সময় কিছুদিন এখানে, তারপর এখানকার খাবার-দাবার সব ফুরিয়ে গেলেই দলবল বেঁধে আবার অন্য কোথাও কিছুদিন – এভাবে যাযাবরের মতো থাকত, তারা হাতের সামনের জল দিয়ে পায়ের নীচের সাধারণ মাটি মেখে চাকা ঘুরিয়ে রোজকার বাসনপত্র (এমনকি বাচ্চাদের পুতুলও) তৈরি করতে শিখল যেই, সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের একটা স্থায়ী ঠিকানা হল তার, চাষবাসও শুরু করল সে। আর, ওই কুমোরের চাকাটাকেই সোজা যে দিন খাড়াই দাঁড় করালো মানুষ, সে দিন থেকে আর ঠেলাগাড়ি তৈরি হতে কতক্ষণ? প্রথমে মানুষের ঠেলা বা টানা গাড়ি, তারপরেই নানা জীবজন্তুকে দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া গাড়ি একেবারে নতুন করে সভ্য তৈরি করে দিল মানুষকে। এক জায়গার মানুষের সঙ্গে অন্য আরেক জায়গার মানুষের মেলামেশা-বন্ধুত্ব হল, আমার জমিতে তৈরি ধান তোমার পুকুরের মাছের সঙ্গে মিলে দু' জায়গার মানুষেরই মাছভাত খাওয়া অভ্যেস হল।

    আমি জানি না, মুড়কি দিদি বলতে থাকে, মানুষ আগে ডাঙায় গাড়ি চালিয়েছে না জলে চালিয়েছে নৌকো। তবে আকাশের এয়ারোপ্লেন চালাতে যে সময় লেগেছে আরো অনেকটাই, সে-ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই। জল ফুটিয়ে বাষ্পের ইঞ্জিনে রেলগাড়ি চালানো বা তেল গরম করে তেলের ইঞ্জিন দিয়ে গাড়ি চালানো শিখেও আকাশে, যেখানে চাকা দিয়ে গাড়ি টানা যাবে না, সেখানে গাড়ি চলবে কীভাবে মানুষ ভাবতেই পারেনি। ভাবতে পারেনি বলছি বটে, নিজেকে শুধরে একটু হেসে মুড়কিদিদি বলে, আবার ভেবেছেও। তা না হলে পৃথিবীর সব দেশের রূপকথার গল্পেই ডানাওয়ালা পরী বা পক্ষীরাজ ঘোড়ারা আসে কোথা থেকে? অনেক বড় বড় পাখিদের গল্প – এই দেখ্‌ না আমাদের এই রামায়ণেই – গরুড় জটায়ু বা সম্পাতিরাও – তো আছে!

    এই পর্যন্ত বলার পর মুড়কি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে উচ্ছেকে, তুই ব্রহ্মার নাম শুনেছিস?

    ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর?–মা'র কাছে শুনেছি তো, উচ্ছে বলে, মা বলেছিল এরা তিনজন সবচেয়ে পুরোনো, সবার চাইতে বড় দেবতা। শুধু যে সবার চেয়ে বড় তা-ই নয়, এই তিনজন হলেন দেবতাদেরও দেবতা। আবার এদের মধ্যেও ব্রহ্মাই আরও বড়, কারণ সব কিছুই তাঁরই সৃষ্টি।

    তাহলেই বোঝ, এবার হেসে বলে মুড়কি, ব্রহ্মা যখন একাই সব কিছু সৃষ্টি করছেন তখন কত ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে তাঁকে! ব্যস্ত মানুষ, স্যরি, মুড়কি বলে, ব্যস্ত দেবতা, তাঁর তো তখন নিজের একটা বাহন চাই। অতএব, অনেক ভেবেচিন্তে নিজের জন্যে এমন একটা বাহন তৈরি করলেন তিনি, যে জলে-স্থলে-আকাশে সব জায়গাতেই স্বচ্ছন্দ! সৃষ্টি হল হাঁস: পাতিহাঁস রাজহাঁস সারস আর বক। এরা যেমন সাঁতারে পটু, তেমনই প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে ডাঙায় দৌড়োয় যখন, বিশেষ করে হেলতে দুলতে মরালগমনে যখন চলে মরাল – রাজহাঁস যার ডাকনাম – সেটা রীতিমতো দেখবার মতো দৃশ্য একটা! গ্রামের আকাশে সারস আর বক সূর্যকে যদি অস্ত যেতে হুকুম দেয় তখন সাধ্য কী সূর্যের ওদের অবাধ্য হবার! সূর্য যদি না মানতে চায় ওদের হুকুম, তখন পাখা মেলে উড়তে থাকে ওরা, আর যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত নামে এক কবি বলেছেন তখন বকের পাখায় আলোক লুকায়! বেচারা সূর্য!

    বাল্মিকী যখন পুষ্পক রথের কথা ভাবলেন – ইঞ্জিন তো ছিল না, মুড়কি দিদি বলে – তিনি তখন হাঁসকে জুড়ে দিলেন পুষ্পকের সঙ্গে, হাঁসই উড়িয়ে নিয়ে চলল পুষ্পককে। ফুল দিয়ে চমৎকার করে সাজানো পুষ্পকে উঠলেন লক্ষ্মণ সীতা আর রাম।

    বিভীষণকে রাম বললেন, সমুদ্রের ওপারে একবার দাঁড়াব আমরা। তোমাদের এই পুষ্পক থেকে নেমে পাড়ের সঙ্গে যেখানে সেতুর পাথরগুলোর জোড় লাগানো হয়েছে সেখানটা আমি বাণ মেরে ভেঙে দেব। জোড়-ছাড়া পাথরগুলো আপন মনে সমুদ্রে ঘোরাঘুরি করুক, সেতুর প্রয়োজন তো মিটেই গেছে!
     


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৯ নভেম্বর ২০২৫ | ৮৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন