এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  গপ্পো  শনিবারবেলা

  • মুড়কিদিদির রামায়ণ

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ২৩ আগস্ট ২০২৫ | ৩০ বার পঠিত
  • পর্ব ১ | পর্ব ২


    বাঃ, দারুণ গল্প, খুব খুশি উচ্ছে।

    তোর ভালো লাগল? – খুশি মুড়কি দিদিও – গল্পের পেছনের গল্পটা ভালোই, কী বলিস?

    তা ভালো, বলে উচ্ছে, কিন্তু তার পেছনেও তো একটা গল্প আছে, তাই না?

    তার পেছনে মানে? কীসের পেছনে?

    একটা বিরাট পাখি, উচ্ছে বলে, অসুখ করে একা-একা শুয়ে আছে বিন্ধ্য পাহাড়ে, কিন্তু সেখানে সে এল কোথা থেকে? রাবণকে চেনে এমন একটা পাখি, সীতাকে চুরি করে রাবণের আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া দেখেওছে, তার বাড়ি কীভাবে যেতে হবে তা-ও জানে, এত কিছুর পেছনে একটা গল্প নেই?

    তা আছে, ঠিকই ধরেছিস তুই।

    তাহলে সেই গল্পটা বল।

    সে গল্পটা, বলে মুড়কি দিদি, একটু বড়, অনেকগুলো চরিত্র। চরিত্র কাকে বলে জানিস?

    গল্পের চরিত্র? জানব না কেন? মা তো বলেছে আমাকে। গল্পে যে সব মানুষরা থাকে – আর শুধু মানুষই বা কেন হবে – পশুরা পাখিরা – তোমার এই নতুন গল্পটাতে তো সম্পাতি পাখিই একটা চরিত্র হবে।

    উচ্ছের পাকা-পাকা কিন্তু একেবারে ঠিকঠাক কথায় খুবই মুগ্ধ মুড়কি। বলে, তাহলে তো তুই জানিসই, কিন্তু এতগুলো চরিত্রওয়ালা গল্পটা তুই মনে রাখতে পারবি? ভালো লাগবে তোর?

    কতো চরিত্র? মা আমাকে হযবরল পড়ে শুনিয়েছিল। পঁচিশটা চরিত্র। আমার সব মনে আছে। শুনবে?

    বলেই জোরে একটা শ্বাস টেনে শুরু করে উচ্ছে, বেজায় গরম, গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে শুয়ে আছি......

    হেসে ফেলে মুড়কি, ঠিক আছে, তোকে এখন আর বলতে হবে না, পরে শুনব। এখন আমিই বলি–

    এই গল্পটার শুরু একজন মুনিকে নিয়ে, বলতে থাকে মুড়কি। মুনির নাম কশ্যপ, তাঁর দুই বউ, কদ্রু আর বিনতা। মুনি একদিন জিজ্ঞেস করেন তাদের, তোমাদের কার কী ইচ্ছে বলো। আমি ইচ্ছে পূরণ করবো।

    এক হাজারটা ছেলে চাই আমার, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় কদ্রু, তবে ছেলে চাই বলে মানুষ চাই তা ভেবো না। হাজারটা খুব গায়ের জোরওয়ালা সাপের মা হতে চাই আমি।

    ঠিক আছে, হাজারটা সাপ, তা-ই হবে, জবাব দেন কশ্যপ, আর তুমি? বিনতার দিকে ফিরে বলেন কশ্যপ, তোমার? তোমার কী চাই?

    দুটি ছেলে চায় বিনতা, দুটি মাত্র। মানুষ পাখি সাপ যা হয় হোক, কিন্তু ওর ছেলেদের গায়ের জোর যেন কদ্রুর সাপ-ছেলেদের চেয়ে বেশি হয়।

    ঠিক আছে, বলেন কশ্যপ, বলে চলে যান কোথায় যেন তপস্যা করতে।

    কিছুদিন পর হাজারটা ডিম পাড়ে কদ্রু।

    ডিম? – অবাক উচ্ছে।

    অবাক হচ্ছিস কেন? বলে মুড়কি। সাপ চেয়েছিল তো কদ্রু, সাপরা তো ডিমের মধ্যেই হয়। কিন্তু কদ্রুর একার নয়, ডিম হল বিনতারও, দুটো মাত্র। কদ্রুর হাজারটা ডিম ফুটে বেরোলো হাজারটা কালো কালো সাপ, কিলবিল করতে করতে তারা বড় হতে থাকল। বিনতার দুটো ডিম কিন্তু পড়েই আছে। পাঁচশো বছর হয়ে গেল, ডিমও ফোটে না, বাচ্চাও বেরোয় না। এদিকে কশ্যপ মুনি যে কোথায় গেছেন, কে জানে! রাগে দুঃখে অধৈর্য বিনতা একদিন ভেঙেই ফেলে একটা ডিম, আর তার থেকে বেরিয়ে আসে একটা বাচ্চা; কোমরের ওপর থেকে ঠিকঠাক, কিন্তু নীচের দিকটা এখনো তৈরি হয়নি।

    খুব রেগে আছে বাচ্চাটা, তুমি আমাকে পুরোপুরি তৈরি হতেও দিলে না মা! আমি আর বাড়িতে থাকব না, আমি চললুম, নিজের ব্যবস্থা নিজেই দেখে নেব। যাবার সময় মাকে সাবধান করে যায় সে, অন্য ডিমটা আবার ভেঙে ফেলো না তাড়াতাড়ি করে।

    নাম অরুণ, কোমরের নীচ থেকে বাকিটা তার অপুষ্ট। অপুষ্ট মানে কী?– প্রশ্ন করে মুড়কি যেন নিজেকেই। তারপর বলে, মানে, ঠিক মতো বাড়তে সুযোগ পায়নি। কী আর করবে বেচারা, ভেবে দেখল, এমন একটা কাজ তার চাই যেটা বসে বসে করা যায়। জোগাড়ও হয়ে গেল কাজ, সূর্যের যে সাত ঘোড়ার রথ, তার সারথি হল সে।

    সারথি মানে কী? – প্রশ্ন করে উচ্ছে।

    রথ হল ঘোড়ায় টানা গাড়ি, বলে মুড়কি। সেই গাড়ি যে চালায়, ড্রাইভার, তাকে বলে সারথি। আচ্ছা, তুই অরুণ মানে জানিস?

    না তো।

    অরুণ মানে লাল। ভোরবেলায় যদি ছাদে উঠে পুব আকাশে তাকাস, দেখতে পাবি আকাশটা প্রথমে হবে লাল। তারপরে দেখা যাবে সূর্যকে। ঠিক যেমন চলন্ত গাড়িতে ড্রাইভার বসে সামনে, সেই গাড়িটা চলতে শুরু করে যখন, প্রথমেই দেখা যায় কাকে? – ড্রাইভারকে, তাই না? তার পর দেখা যাবে আরোহীকে, মানে গাড়িতে ড্রাইভারের পেছনে যে বসেছে, তাকে। পৃথিবীর আকাশে সূর্য ঢোকবার আগে পুরো পুব-আকাশটা লাল হয়ে যায়, তার মানে অরুণ দেখা দেয় আমাদের; সে যেন বলতে থাকে, আমার পেছনেই বসে আছেন আমার মনিব সূর্য, গনগনে আগুন-রঙা তিনি, খালি চোখে দেখতে যেওনা তাঁকে, একেবারে ঝলসে যাবে তাহলে তোমাদের চোখ! যাই হোক, বলে চলে মুড়কি, হেসে হেসে মজা করে নিজের লাল রঙ দেখিয়ে যতই মজার কথা বলুক অরুণ, চাকরিটা তার তেমন ভালো নয়, ছুটি নেই একদিনও, ফলে পৃথিবীতে তার আর আসাই হয় না, আকাশেই থাকতে হয় তাকে।

    একদিনও ছুটি নেই? রবিবারেও?

    কী করে থাকবে বল্‌। সূর্যের নিজেরও কি ছুটি আছে একদিনও? সূর্য যদি মনে করে, আজ রোববার, আজ আর আকাশে আসব না, আলো দেব না পৃথিবীকে, তাহলে চলবে? আর, সূর্যের যদি ছুটি না থাকে, তার সারথির থাকবে কেমন করে?

    উচ্ছে জবাব দেয় না, কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝা যায়, সে একমত মুড়কি দিদির সঙ্গে।

    মুড়কি বলতে থাকে, কাজেই আকাশেই থেকে গেল অরুণ, আর কিছুদিন পর আকাশেই এক বিরাট বড় বাজপাখির সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল তার। সেই বাজপাখির হল দুটো ছানা, মায়ের চেয়েও আরো অনেক অনেক বড়। বড়টার নাম সম্পাতি, ছোটটার জটায়ু।

    জটায়ু? – উত্তেজিত হয় উচ্ছে, জটায়ুর নাম তো জানি। রামায়ণের গল্প বলার সময় মা বলেছিল এই নামটা। কিন্তু কী যে বলেছিল এখন আর ঠিক মনে নেই।

    তুই ভাবিস না কিছু, সে আমি বলে দেব তোকে। এখন রামায়ণের গল্পে জটায়ু ঢুকলো কী করে সেটা বলি।

    মুড়কি বলে, সে অনেকদিন আগের কথা। রামও জন্মায়নি তখন। রামের বাবা দশরথের রাজ্যে এলো ঘোর আকাল। আকাল মানে জানিস তো? আকাল হচ্ছে সেই সময় যখন রাজ্যের মানুষজন খেতে পাচ্ছে না ঠিক মতো। কেন পাচ্ছে না? কারণ চাল ডাল গম এইসব শস্য হয়নি যথেষ্ট। হয়নি কেন? বৃষ্টি হয়নি ঠিক মতো, কাজেই জল পাওয়া যায়নি। বৃষ্টি হয়নি কেন?

    ঝড়বৃষ্টির দেবতার নাম ইন্দ্র। এই ইন্দ্র আবার দেবতাদের রাজাও বটে। দশরথ ঠিক করল, তার এই প্রশ্নটা, এই বৃষ্টি ঠিক মতো হয়নি কেন সেই প্রশ্নটা, সে জিজ্ঞেস করবে সরাসরি ইন্দ্রকেই।

    যেই ভাবা, সেই কাজ। দশরথ তার রথ চালিয়ে সোজা চললো স্বর্গপানে, এক্কেবারে ইন্দ্রর রাজসভায়। হঠাৎ দশরথকে দেখে ইন্দ্র তো ভ্যাবাচাকা। এই দশরথেরই এক পূর্বপুরুষের হাতে একবার মোক্ষম হার হয়েছিল ইন্দ্রর। আচ্ছা, পূর্বপুরুষ কাকে বলে তুই জানিস?

    ঠোঁট উলটিয়ে আর মাথা নেড়ে উচ্ছে বোঝায়, জানে না সে।

    পূর্ব মানে হচ্ছে আগে, তাই পূর্বপুরুষ মানে, আগে জন্মেছে যারা। যেমন ধর, তোর বাবা তোর পূর্বপুরুষ। তোর বাবার বাবা তোরও পূর্বপুরুষ তোর বাবারও পূর্বপুরুষ। আবার তার বাবা তোদের সবায়েরই পূর্বপুরুষ, বুঝলি?

    তার মানে, দশরথের বাবা বা তার বাবা বা তারও বাবা অথবা বাবার বাবা ইন্দ্রকে হারিয়েছিল? উচ্ছে শুধোয়, কিসে, লড়াইয়ে?

    খুব খুশি হয়ে মুড়কিদিদি বলে, এক্কেবারে ঠিক বলেছিস তুই, তোকে গল্প বলে খুব আরাম, চট করে সব কিছু বুঝে যাস তুই।

    তার মানে, দশরথের সেই বাবার বাবার বাবার সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গিয়ে যে অপমানটা হয়েছিল ইন্দ্রর, সে মনে রেখেছে সেই অপমানটার কথা?– জিজ্ঞেস করে উচ্ছে।

    একদম ঠিক, বলতে থাকে মুড়কি। তখন মাথা চুলকোতে চুলকোতে, কী ব্যাপার? আপনি যে হঠাৎ? – প্রশ্ন করে ইন্দ্র।

    আমার রাজ্যে বৃষ্টি হল না কেন এ বছর?

    আমি কী জানি? – মাথা চুলকিয়ে বলে ইন্দ্র, শনিকে জিজ্ঞেস করুন, পৃ্থিবীর বৃষ্টির দায়িত্ব তো শনিকে দেওয়া আছে।

    শনি? সে কোথায়? স্বর্গের লোকজনের সাহায্যে শনির বাড়ির দরজায় পৌঁছোলো দশরথ, শনি আছ?

    দরজা খোলে শনি। প্রথমেই তার চোখ পড়ে দশরথের রথের ওপর। তখন কী হল বল্‌ তো?

    কী হল?

    শনির চোখ পড়তেই রথের দড়িদড়া সব গেল কেটে, ঘুরপাক খেতে খেতে আকাশ থেকে পড়তে থাকলো রথ, দশরথ সমেত।

    কেন? পড়তে থাকলো কেন? – প্রশ্ন করে উচ্ছে।

    পার্বতী, মা দুগ্‌গার আর এক নাম পার্বতী, মুড়কি বলে, মজা করে শনিকে একবার বলেছিলেন, তুই যার দিকে তাকাবি, সেই খসে পড়বে।

    খসে পড়বে মানে?

    মানে তো সহজ, বলে মুড়কি, যা খসে পড়ার তা খসে পড়বে, যা খসবার নয়, সেটা বিকল হয়ে যাবে। মানে, আগের মতো থাকবে না, হয়তো নষ্টই হয়ে যাবে। গণেশের মূর্তি তো দেখেছিস, দেখিসনি?

    হ্যাঁ, দেখেছি তো, মাথাটা হাতির।

    মুড়কি বলে, গণেশের যখন জন্ম হল, স্বর্গের সবাইকেই নেমন্তন্ন করা হল গণেশকে দেখতে আসবার জন্যে। শনি প্রথমে আসতে চায়নি, কিন্তু সবাই মিলে জোরাজুরি করায় এল শেষ পর্যন্ত। আর যেই না গণেশের দিকে তাকানো, গণেশের মাথাটা গেল খসে। শেষ পর্যন্ত একটা হাতির মাথা তার ধড়ে বসিয়ে রক্ষে! সেই শনির চোখ দশরথের রথের দড়িতে পড়লে ছিঁড়ে যাবে না দড়ি? আর, ঘুরপাক খেতে খেতে রথে-বসা দশরথ পড়তে থাকবে না আকাশ থেকে?

    কিন্তু, মুড়কি বলতে থাকে, পড়তে পড়তেও শেষ পর্যন্ত পড়ল না দশরথ। হঠাৎ কেমন যেন আলতোভাবে থেমে গেল রথটা। কেউ যেন খুব যত্ন করে ধরে রেখেছে রথটাকে, পড়তে দিচ্ছে না। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দশরথ দেখে, পৃথিবী অনেক নীচে। তাহলে আকাশের মাঝখানে মাঝপথে কীভাবে থামলো রথটা? হঠাৎ তখন জানলায় ভেসে ওঠে একটা মুখ। হাসি হাসি, বিশাল বড় পাখির মুখ একটা। পাখিটা বললো, আমি জটায়ু। অনেক দূর থেকে লক্ষ্য করছিলাম আপনার রথটা পড়ছে। তাড়াতাড়ি উড়ে এসে ডানায় ধরে নিয়েছি রথটাকে। আপনি কি আবার ফিরতে চান স্বর্গে? তাহলে নিজের পিঠে বসিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

    এবার যখন আবার শনির বাড়িতে পৌঁছলো দশরথ, দরজা খুলতে খুলতে শনি বলে, আমি তোমার দিকে তাকাচ্ছি না দশরথ, পেছন ফিরে আছি। বল, কী করতে পারি তোমার জন্যে।

    সবটা শুনে খানিকটা আপসোস করে শনি, ছি ছি বড্ড ভুল হয়ে গেছে। আসলে পৃথিবীতে বৃষ্টি দেবার দায়িত্ব ছিল রোহিণী নামের একটা তারার ওপর। আমি তাই ওই তারাটার ওপর নজর রাখছিলাম। কিন্তু খেয়াল করিনি, আমার নজর তো, বেচারা বিকল হয়ে গেছে। এই আমি নজর ফিরিয়ে নিচ্ছি। আপনি এখন ফিরে যান দশরথ, আপনি বাড়ি ফিরতে-না-ফিরতেই শুরু হয়ে যাবে বৃষ্টি।

    বাড়ি ফিরেই জড়িয়ে ধরে দশরথ জটায়ুকে। জটায়ু, বলে দশরথ, আজ থেকে তুমি আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড। যতদিন বেঁচে থাকব, এই বন্ধুত্ব অটুট থাকবে আমাদের।

    দশরথ পৃথিবীর সবচাইতে বড় রাজা, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব জটায়ুর! জটায়ু ঠিক করে, তারও একটা রাজা হওয়া দরকার। কিন্তু, কোন্‌ দেশের রাজা হবে সে? আচ্ছা, স্বর্গের রাজা হলে কেমন হয়? এই তো, দশরথকে সঙ্গে নিয়ে সে ঘুরে এল স্বর্গ থেকে, জায়গাটা তো মন্দ নয়। রাজা হলে এমন জায়গারই হওয়া উচিত। তা ছাড়া আরও একটা কথা আছে। তার কাকা, তার বাবার নিজের ভাই, স্বর্গে একটা বিরাট বড় চাকরি করে।

    এই পর্যন্ত বলে মুড়কি তাকায় উচ্ছের দিকে, জটায়ুর কাকা কে, বুঝতে পারলি তো?

    না তো, বলে উচ্ছে, তুমি তো জটায়ুর কোন কাকার কথা বলনি।

    অরুণের কথা মনে আছে তোর, উচ্ছেকে জিজ্ঞেস করে মুড়কি, সেই অরুণ? যার মা বিনতা ধৈর্য রাখতে না পেরে ডিমটা ফাটিয়ে দিয়েছিল? আর সেই ডিম থেকেই বেরিয়েছিল তখনো-কোমরের-তলা-থেকে-পা-তৈরি-হয়নি-যার – সেই অরুণ? মনে আছে তোর? সম্পাতি আর জটায়ুর বাবা যে অরুণ সে-ই। মনে আছে? ডিম থেকে বেরিয়ে যে তার মা বিনতাকে বলেছিল অন্য ডিমটা ফুটতে সময় দিও, ভেঙে ফেলো না তাড়াহুড়ো করে? ঠিক না? সেই সময় কিছুদিন পর অন্য ডিমটা ফুটে যার জন্ম হয়েছিল তার নাম গরুড়। তাহলে গরুড় সম্পাতি-জটায়ুর কাকা হলো না? অরুণের ছোটভাই তো। এক মায়ের পেটের ভাই!

    এদিকে ইন্দ্র, বলতে থাকে মুড়কি দিদি, স্বর্গের রাজা হতে সে নিশ্চয়ই পারে, কিন্তু ইন্দ্রর চেয়েও বড়ো তিনজন দেবতা আছে স্বর্গে; ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর শিব। গরুড় হচ্ছে বিষ্ণুর রথের স্পেশ্যাল সারথি। ওই রথে বিষ্ণুর মাথার ওপর পতপত করে যে পতাকাটা ওড়ে, তাতে কার ছবি আছে জানিস?

    উচ্ছে জিজ্ঞেস করে, কার?

    গরুড়ের।

    মনের বাসনাটা জটায়ু বলে সম্পাতিকেও, আর তারপর একদিন উড়তে শুরু করে স্বর্গের দিকে।

    সম্পাতি বারণ করেনি জটায়ুকে, কিন্তু সূর্য কী করে যেন টের পেয়ে গেছিল ব্যাপারটা। ঠিক দুপুর বেলা সূর্য যখন মাথায়, তখন সে এত জোর রোদ্দুর ফেললো জটায়ুর ওপর যে সব শক্তি যেন শেষ হয়ে গেল জটায়ুর। সে নিস্তেজ হয়ে পড়লো। ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে সম্পাতি কি আর থাকতে পারে? সে তার বিরাট পাখনা দুটো মেলে ছায়া তৈরি করলো জটায়ুর ওপর। দেখে, সূর্য তো রেগে আগুন। আগুনের হলকা বাড়িয়ে সূর্য পুড়িয়ে দিল সম্পাতির পাখনা দুটো। পাখনা হারিয়ে, ঘুরতে ঘুরতে বমি করতে করতে ধপাস করে সম্পাতি পড়লো বিন্ধ্য পর্বতের ওপর। তার গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে; সে বাঁচে, কি না-বাঁচে!

    বিন্ধ্যে তখন সাধনা করতেন নিশাকর নামে এক জ্ঞানী তপস্বী। তিনি সেবা শুশ্রুষা করলেন সম্পাতির, তার জ্বর কমলো, একটু সুস্থও বোধ করলো সে। সম্পাতিকে সাহস দিয়ে বললেন তিনি, এই বিন্ধ্য পর্বতে বড় বড় হিংস্র যত প্রাণী আছে, সবাইকে আমি অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেব, তোমার কোন ভয় নেই, কেউ ক্ষতি করবে না তোমার। বহুদিন পর দশরথের ছেলে রামের দূত আসবে এখানে। তাদের মনে অনেক প্রশ্ন থাকবে, সব প্রশ্নের উত্তর তুমি ঠিকঠাক দিও। তখন তোমার আবার নতুন করে পাখনা গজাবে, গায়ের জোরও ফিরে পাবে তুমি। এই বলে বিন্ধ্য ছেড়ে চলে গেলেন নিশাকর নিজেও।

    পাখনা গজিয়েছিল? – জিজ্ঞেস করে উচ্ছে।

    গজিয়েছিল তো, নিশ্চয়ই গজিয়েছিল, বলে মুড়কি।

    কই, তুমি তো আগের দিন বলনি সেটা।

    আগের দিন যদি সবই বলে দিতুম, তুই কি শুনতিস আজকের গল্পটা?

    পাখনা গজাবার পর কী করল সম্পাতি?

    নিজের মনে মনে বললো, অনেক দিন আকাশ থেকে দেখিনি পৃথিবীটা। যাই, একটু ঘুরে ঘুরে দেখি কেমন লাগে।

    বিরাট পাখনা মেলে ওপর দিকে উড়তে থাকে সম্পাতি।



    চলবে...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    পর্ব ১ | পর্ব ২
  • ধারাবাহিক | ২৩ আগস্ট ২০২৫ | ৩০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন