এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পর্যালোচনা (রিভিউ)  সিনেমা

  • ৩১-তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখা কিছু বিদেশি ছবি

    শুভদীপ ঘোষ
    পর্যালোচনা (রিভিউ) | সিনেমা | ০১ ডিসেম্বর ২০২৫ | ২৯৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৪ জন)


  • সম্প্রতি শেষ হল এ-বছরের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। প্রতিযোগিতা মূলক এই উৎসবে প্রতিযোগিতার বিভাগটি বাদে যে বিভাগটির উপর সিনেমা-প্রেমীদের বিশেষ নজর থাকে তা হল 'সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল'। কারণ এই বিভাগেই দেখান হয় সাম্প্রতিক সময় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি গুলি। এবছর আরেকটি বিভাগ অত্যন্ত নজর কেড়েছে, 'বিয়ন্ড বর্ডারস: ডিসপ্লেসমেন্ট, মাইগ্রেসন,....'। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আমাদের এই সময়কালে এই বিভাগটি তুলে ধরেছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির প্রকৃত ছবি। এই সব বিভাগ থেকে দেখা কিছু ছবি নিয়েই আজকের এই আলোচনা।



    দা ভয়েস অফ হিন্দ রাজব - এটা ঘটনা যে, হামাসের নৃশংস কাজকে মেনে রেখেও এটা বলতেই হয়, তার প্রতিক্রিয়ায় ইস্রাইল ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গাজায় যে নরসংহার যজ্ঞ চালায় তার তুলনীয় কিছু হলোকাস্টের পর পৃথিবীর মানুষ আর দেখেনি। এককালে যে হলোকাস্টের শিকার হয়েছিলেন ইহুদীরা, দ্বিতীয় আর একটি হলোকাস্ট তাদের হাতেই রচিত হয় গাজা ভূখণ্ডে। যতটুকু জানা যায়, গাজায় মৃত শিশুর সংখ্যা প্রায় কয়েক হাজার। এরকমই এক ছ-বছরের শিশু হিন্দ রাজব। ছবিটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তা শুরুতেই বলে দেওয়া হয়। চারপাশে পড়ে থাকা মৃতদেহের মধ্যে বেঁচে থাকা শিশুটি প্যালেস্টাইনের উদ্ধারকারী রেড-ক্রসের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ছবিটির বিশেষত্ব হলো, শিশুটির সঙ্গে রেড-ক্রসের কথোপকথনের সত্যিকারের ভয়েস কল ছবিটিতে ব্যবহার করা হয়েছে। রেড-ক্রসের লোকজন প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন শিশুটিকে বাঁচানোর। একটি উদ্ধারকারী দল শিশুটির কাছে পৌঁছায়ও, কিন্তু ইজরায়েলের ইনফ্রা-রে ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ধারকারী দল ও শিশুটিকে চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেয়। ছবির শেষে উদ্ধারকারী দলের ও শিশুটির ধ্বংস প্রাপ্ত গাড়ির সত্যিকারের ছবি যখন পর্দায় ফুটে ওঠে, তখন আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীতল স্রোত নেমে যায়। মাথা নিচু করে সমবেত ভাবে প্রেক্ষাগৃহ ত্যাগ করা ব্যাতিরেকে ছবিটি নিয়ে কোনো কথা বলার মতো মানসিকতাও তখন আর অবশিষ্ট থাকে না। তিউনিসিয়ার পরিচালক কাউথার বেন হানিয়ার এই ডকু-ফিচার ছবিটি পৃথিবী-জুড়ে বিপুল সাড়া ফেলেছে বিষয় ও নির্মাণ-শৈলীর এই সমসত্ব মিশ্রণের গুণে।



    টেলস অফ দা উন্ডেড ল্যান্ড - লেবাননের পরিচালক আব্বাস ফাহদেল পরিচালিত এই তথ্যচিত্রটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দক্ষিণ লেবাননের উপর নির্মিত। ইস্রাইল এখানেও ধ্বংস-লীলা চালায়। যুদ্ধ-বিরতি চলাকালীন ছবিটি তোলা হয়। একটি পরিবারকে দেখানো হয়, কপাল জোরে যাদের গৃহটি অক্ষত আছে এবং তাঁরাও বেঁচে আছেন। স্বামী ভদ্রলোক (আব্বাস ফাহদেল নিজেই সম্ভবত, যদিও তাঁকে দেখানো হয় নি) সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া দক্ষিণ লেবাননের বিভিন্ন অংশকে গাড়ি থেকে ক্যামেরা বন্দি করতে থাকেন। তাঁর ছোট্ট সন্তানটিকে মনে হয় মৃত একটি অঞ্চলের নতুন প্রাণের একমাত্র স্পন্দন যেন। স্ত্রী শহরের বিভিন্ন অংশ নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকেন। বোঝা যায় একমাত্র স্মৃতিতে ছাড়া তাদের প্রিয় শহরের প্রায় কোনো অংশেরই আর কোনো জীবন্ত অস্তিত্ব নেই। দাফন করতে নিয়ে যাওয়া সারি সারি কফিন ও তৎসংলগ্ন শোক-গাঁথার ভিতর দিয়ে শেষ হয় ছবিটি। একটা চরম শূন্যতায় আবিষ্ট হয়ে যায় আমাদের মন।


    দা কন্ডর ডটার ছবির দৃশ্য



    দা কন্ডর ডটার – বলিভিয়ার আলভারো ওলমোস টোরিকো পরিচালিত এই ছবিটি বলিভিয়া, পেরু এবং ইকুয়েডোর অঞ্চলে বসবাসকারী কেচুয়া সম্প্রদায়ের উপর নির্মিত কাহিনীচিত্র। যুবতী ক্লারা ও তার মা এই কাহিনীর প্রধান দুটি চরিত্র। ক্লারার মা দাই-মার কাজ করেন এবং চান ক্লারাও ভবিষ্যতে সেই কাজই করুক। এই কেচুয়া সম্প্রদায় ঐতিহ্যকে প্রচণ্ড মূল্য দেয় এবং নুন্যতম ঐতিহ্যের বিচ্যুতি বা বড়দের কথা না শোনার জন্য প্রধান-কর্তৃক ছোটদের নির্মম শাস্তির ব্যবস্থা আছে এদের মধ্যে। এছাড়াও এই ট্রাইবটি নানারকম কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। ক্লারার মা-কে পরিচালক রক্ষণশীলতার প্রতীকে স্থাপন করেছেন, যেখানে ক্লারা আধুনিকতার হাতছানিতে সাড়া দিতে উন্মুখ। এক সময় সে সংগীতকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য কেচুয়াদের গ্রামকে ত্যাগ করে ও মা-কে উপেক্ষা করে শহরের পথে পা বারায়। কন্ডর হল শকুন জাতীয় একধরনের পাখি এবং সম্ভবত কেচুয়া সম্প্রদায়ের টোটেম। ছবিটি শেষ হয় অভিনব ভাবে। বেশ কিছু কালের ব্যবধানে ক্লারা গ্রামে ফিরে আসে, ততদিনে তার মা মারা গেছেন। ক্লারাকে দেখে এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলা বলেন ক্লারা একদম ঠিক সময়ে এসেছে। ছবির শেষ দৃশ্যে তার মায়ের মত দাই-মার ভূমিকায় আধুনিকা ক্লারাকে আমরা দেখতে পাই। তার হাতেই মহিলাটির সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। পরিচালক ওলমোস যেন বলতে চান ঐত্যিহ্য ও আধুনিকতার সহাবস্থানই সর্বার্থে কাম্য। বলিভিয়ার গ্রামটি যেখানে আধুনিকতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে (ছবিতে এক জায়গায় দেখানো হয় তারা শহরের ডাক্তারদের চিকিৎসা গ্রহণ করতে চায় না), আধুনিকা ক্লারা কিন্তু সেখানে ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে না। বিশেষত ঐতিহ্যের সেই অংশটিকে যার মধ্যে মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতার ছোঁয়া আছে। এই কেচুয়াদের প্রাচীন ইনকা সভ্যতার মানুষদের উত্তরসূরি হিসেবে মনে করা হয়। বলিভিয়ার পাহাড়ে ঘেরা গ্রামটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ওলমোসের চিত্রগ্রহণে হয়ে উঠেছে আরো অপরূপ। একটি সুপ্রাচীন জনজাতির ধীর লয় জীবনের ছন্দে পরিচালক বেঁধে নিয়েছেন ছবিটিরও লয়-তাল-ছন্দ।



    দা স্ট্রেঞ্জার - আলবেয়ার কামুর বিখ্যাত উপন্যাস 'দা স্ট্রেঞ্জার'-র অভিযোজন এই ছবিটি। ফ্রাঁসোয়া ওঁজো ('সুইমিং পুল' খ্যাত) উপন্যাসটির প্রতি শুধুমাত্র বিশ্বস্তই থাকেন নি, সাদা-কালোয় নির্মাণ করেছেন চিত্রভাষার এমন এক বুনট যা আমাদের বার্গম্যান বা ব্রেস-র শ্রেষ্ঠ সাদা-কালো ছবিগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। উপন্যাসটিতে 'হতাশা' আসলে অস্তিত্বের বিপন্নতার বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু সেটা যন্ত্র-সভ্যতা জাত নয়। বরং, কামুর অস্তিত্বের বিপন্নতা জাঁ পল সাত্রের 'অস্তিত্ববাদ'-র সমগোত্রীয়। কিন্তু প্রটাগনিস্ট মুরসল্ট এখানে সাত্রে প্রস্তাবিত জীবনের ফ্রী চয়েসকে 'জীবন অৰ্থহীন' এই ধারণার দিকে নিয়ে গেছেন কিনা উপন্যাসটিকে ঘিরে সেই প্রশ্নটিই যেন প্রধান। মুরসল্ট অনুভূতিহীন, নাকি অনুভূতি প্রকাশে অপারগ, নাকি অনুভূতি প্রকাশে অনিচ্ছুক? এই ধাঁধা অমীমাংসিত। কোর্টের প্রশ্নের উত্তরে সে যখন জানায়, বস্তুত প্রখর সূর্যালোক তাকে বাধ্য করে আরবী মানুষটিকে হত্যা করতে, তখন আইন ও সমাজ মুরসল্টের এই শারীরিক অস্বস্তিকে খুনের মত গর্হিত কাজের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত বলে মনে করে না এবং তাঁর মায়ের মৃত্যু-কালীন বিভিন্ন সাক্ষীকে জোগাড় করে ক্রমাগত প্রমাণের চেষ্টা হতে থাকে যে মুরসল্ট আসলে কতটা অমানবিক এবং অনুভূতি-শূন্য। কেননা উপন্যাসটির শুরুতেই আছে, “Maman died today. Or yesterday maybe, I don't know. I got a telegram from the home: "Mother deceased. Funeral tomorrow. Faithfully yours." That doesn't mean anything. Maybe it was yesterday.”। ফ্রাঁসোয়া ওঁজো এই ব্যাপারটাকে তাঁর ছবিতে দুর্দান্ত ভাবে ধরেছেন। ছবিটি সাদা-কালোয় নির্মিত। বোঝা যায় মনোক্রমে ছবিটি তোলার কারণ উপন্যাসের অতীত সময়কালটি শুধুমাত্র নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে উপন্যাসের গাম্ভীর্যকে চিত্রভাষায় রূপান্তরিত করার একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। বহুকাল বাদে কোনো ক্লাসিকের এত ভালো অভিযোজন দেখলাম আমরা এ কথা বলতেই হয়। শেষ হওয়ার পরেও থেকে যায় ছবিটির ঘোর।



    লা গ্রাজিয়া - বিশ্ব-চলচ্চিত্রে ইতালি একটা বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। সেই নব্যবাস্তববাদের সময় থেকে তো বটেই, এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মাত্তিও গারোনে বা মিকেলাঞ্জেলো ফ্রামার্তিনো কিংবা পাওলো সরেন্টিনোর ছবি দেখলেও এই প্রত্যয় জন্মায় যে, আজও ইতালি বিশ্ব-চলচ্চিত্রের প্রধান পাওয়ার-হাউস গুলির একটি। গত বছর সরেন্টিনোর 'পার্থেনোপ' দেখে মনে হয়েছিল, পার্থেনোপের মতো সাধারণ নারীর জীবনে সরেন্টিনো নিয়ে এসেছেন মিথিক সংযুক্তি ও ব্যক্তি-নিরপেক্ষ যে আবহমান জাগতিক ও মহাজাগতিক গ্র্যান্ড ডিজাইন, তার আশ্চর্য ছোঁয়া। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে দেখা 'লা গ্রাজিয়া' নিজের পথ থেকে সরে এসে এক ভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা। পার্থেনোপ-এর বিপরীতে এখানে ইতালির বিশিষ্ট মানুষ প্রেসিডেন্ট মারিয়ানো সান্তিসের মধ্যে সরেন্টিনো নিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষের মত ছোট ছোট অভিমানের নানা অনুষঙ্গ। পর্তুগালের প্রেসিডেন্টের আসার মুহূর্তটিও অসামান্য ভাবে নির্মিত। বৃদ্ধ সান্তিস বৃষ্টিপাতের মধ্যে বৃদ্ধ পর্তুগালের প্রেসিডেন্টকে দেখে তাঁর সেক্রেটারিকে জিগ্যেস করেন তিনিও কি এতটাই বৃদ্ধ হয়ে গেছেন! সরেন্টিনোর স্লো-মোশন ক্যামেরা ঝড়-বৃষ্টির আবহে নিয়ে এসেছে মৃত্যু নামক আসন্ন নিয়তির অমোঘ ব্যঞ্জনা। প্রেসিডেন্ট সান্তিস ‘ইচ্ছা-মৃত্যু’ বা ‘ইউথনেসিয়া’-র বিলে সই করবেন না করবেন না, ছবির এই মূল সংকটটির সঙ্গে পরিচালক জুড়ে দিয়েছেন সান্তিসের নিজেরই বার্ধক্যের নানান মানসিক অসহায়তা এবং মৃত স্ত্রীয়ের চল্লিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের দ্বন্দ্বকে। সরেন্টিনোর ছবির একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো অদ্ভুত প্রাণবন্ত একটা ভাব ও অ-ফেলিনি-সুলভ এক ধরনের কার্নিভালেস্ক স্পিরিট। কিন্তু এই ছবি গঠনগত দিক থেকে আগের গুলির তুলনায় অনেক বেশি ধীর ও আত্মমগ্ন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ১২২ মিনিটের মূলত সংলাপনির্ভর এই ছবি মনোযোগ ধরে রাখে। কখন সময় কেটে গেল, টেরই পাওয়া যায় না।



    ফ্রাঞ্জ - অগ্নিয়েস্কা হল্যান্ড-র 'ইউরোপা ইউরোপা' দেখেছিলাম বহু বছর আগে। হলোকাস্ট নিয়ে অসামান্য সেই ছবির স্মৃতি এত বছর বাদেও উদ্বুদ্ধ করল হল্যান্ড-রই 'ফ্রাঞ্জ' ছবিটি দেখতে। এ ছবির গঠন চমকে দেওয়ার মত। ফ্রাঞ্জ কাফকার খণ্ডিত সত্তার আদলে এছবির কাঠামো-শরীরও টুকরো টুকরো। আখ্যান-শৈলী অরৈখিক। ক্যামেরার ছটফটানির সঙ্গে কিছুক্ষণ পরে অভ্যস্ত হয়ে গেলেই বুঝতে অসুবিধে হয় না, বিচ্ছিন্নতা, যৌন-উদ্বেগ ও ভঙ্গুরতা - কাফকার এই ত্রিবিধ বৈশিষ্ট্যের অনুরূপে হল্যান্ড নির্মাণ করতে চাইছেন ছবিটির শরীর ও মন। এ ছবিটি কোনো ভাবেই বায়োপিক নয়, একে বরং বলা যেতে পারে কাফকার মনোজগতের চলচ্চিত্রীয় অন্বেষণ। ল্যারিঞ্জিয়াল টিউবারকুলসিসে মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে কাফকার মৃত্যু হয়। ছবিটি যত শেষের দিকে এগোয় ছবির গঠনগত ছটফটানি তত কমতে থাকে। একদম শেষে অসমর্থ কাফকাকে যখন প্রায় পাঁজাকোলা করে স্যানাটোরিয়ামে নিয়ে আসা হয় এবং পাশের একজন রুগী তাঁকে যখন জানান - তিনি যতটা ভাবছেন, মৃত্যু আসলে তার চাইতে অনেক বেশি সন্নিকটে রয়েছে, তখন গোটা ছবি জুড়ে ছড়িয়ে পরে একটা আত্মস্থ ভাব! মৌলিক গঠন-কাঠামোর জন্য ছবিটি বহুকাল মনে থাকবে।



    দা সিক্রেট এজেন্ট - ক্লেবার মেন্ডোন্সা ফিলহো পরিচালিত ব্রাজিলের এই ছবিটি এবছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালক ও সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতে নিয়েছে। ছবিটিকে পিরিয়ড ছবি বলা যেতে পারে। ১৯৭৭ সালের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছবিটি ক্রাইম ড্রামা হয়েও সূক্ষ্ম ভাবে সেসময়ের ব্রাজিলের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিকে তুলে ধরে। ৭৭-র ব্রাজিল মিলিটারি ডিক্টেটরশিপে থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট গেইসেলের সরকার ব্যবস্থায় কিছু উদারীকরণ আনেন। যদিও সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও টোটালেটেরিয়ান রেজিমের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিক্ষোভে তখন ব্রাজিল উত্তাল। এরকম সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রধান চরিত্র ক্লভিস শান্তির খোঁজে রেসিফ শহরে আসেন। শুরুতেই আমরা দেখতে পাই, ক্লভিস পেট্রল-পাম্পে তেল ভরছেন আর অদূরে একটি মৃতদেহ পরে আছে। দু-তিনদিন হয়ে গেছে কিন্তু মৃতদেহটির সৎকারে কেউ আসে নি। পুলিশ আসে, কিন্তু মৃতদেহটির জন্য নয়। আসে ক্লভিসের গাড়ি সার্চ করতে। পরিত্যক্ত মৃতদেহ না ক্লভিস, এই দ্বন্দ্বে ছবিটি শুরু হয়। ধীরে ধীরে ক্লভিসের অতীত উন্মোচিত হতে থাকে। ক্রমে পরিষ্কার হয় তার অতীতের একটি ঘটনার জন্য দুজন হিট-ম্যান তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আঁটসাঁটও গঠন, কৌতুকপূর্ণ চিত্রনাট্য ও ব্রাজিলের আঞ্চলিক সংগীতের ব্যবহারে তৈরি হতে থাকে অভিনব একটি চিত্রভাষা। কিছু কিছু ছবির ক্ষেত্রে স্লো-বার্নিং কথাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ফিলহোর 'দা সিক্রেট এজেন্ট' সেই গোত্রের ছবি। ক্লভিসের বর্তমান থেকে ছবিটি যখন তার অতীতে প্রবেশ করে তখন নিখাদ ক্রাইম-থ্রিলার না থেকে ছবিটি হয়ে ওঠে ইদানীং তুলনামূলক ভাবে কম আলোচিত ৭০ দশকের লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক-সামাজিক পরিসরের চিত্ররূপ। সদ্য প্রয়াত প্রখ্যাত জার্মান অভিনেতা উদো কিয়ের অভিনীত হান্স চরিত্রটিও অভিনব। দুর্নীতিগ্রস্থ পুলিশ-প্রধান সদলবলে এই হান্সের কাছে মাঝে মাঝেই আসেন তাঁর সর্বাঙ্গের যুদ্ধ-জনিত ক্ষতগুলি পরিদর্শনের জন্য! হান্স পেশায় একজন দর্জি এবং প্রকৃতই হলোকাস্টের শিকার। পূর্বে আলোচিত হল্যান্ডের ছবি 'ফ্রাঞ্জ'-র মত এছবির গঠনশৈলীও আমাদের ভাবায়। 'ফ্রাঞ্জ'-এর বিপরীতে এছবির চিত্রভাষা অনেক অ্যাবজর্বিং। আসতে আসতে চরতে থাকা নেশার মত ছবিটি আপনাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পর্যালোচনা (রিভিউ) | ০১ ডিসেম্বর ২০২৫ | ২৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Amitava Mukherjee | ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ ২২:১০736381
  • প্রত্যেক বছর টার্গেট থাকে কিছু সিনেমা দেখার, কিন্তু সব দেখা হয় না। আপনার চমৎকার প্রতিবেদনটি পড়ে খুবই ভালো লাগলো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন