

সম্প্রতি শেষ হল এ-বছরের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। প্রতিযোগিতা মূলক এই উৎসবে প্রতিযোগিতার বিভাগটি বাদে যে বিভাগটির উপর সিনেমা-প্রেমীদের বিশেষ নজর থাকে তা হল 'সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল'। কারণ এই বিভাগেই দেখান হয় সাম্প্রতিক সময় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি গুলি। এবছর আরেকটি বিভাগ অত্যন্ত নজর কেড়েছে, 'বিয়ন্ড বর্ডারস: ডিসপ্লেসমেন্ট, মাইগ্রেসন,....'। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আমাদের এই সময়কালে এই বিভাগটি তুলে ধরেছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির প্রকৃত ছবি। এই সব বিভাগ থেকে দেখা কিছু ছবি নিয়েই আজকের এই আলোচনা।
দা ভয়েস অফ হিন্দ রাজব - এটা ঘটনা যে, হামাসের নৃশংস কাজকে মেনে রেখেও এটা বলতেই হয়, তার প্রতিক্রিয়ায় ইস্রাইল ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গাজায় যে নরসংহার যজ্ঞ চালায় তার তুলনীয় কিছু হলোকাস্টের পর পৃথিবীর মানুষ আর দেখেনি। এককালে যে হলোকাস্টের শিকার হয়েছিলেন ইহুদীরা, দ্বিতীয় আর একটি হলোকাস্ট তাদের হাতেই রচিত হয় গাজা ভূখণ্ডে। যতটুকু জানা যায়, গাজায় মৃত শিশুর সংখ্যা প্রায় কয়েক হাজার। এরকমই এক ছ-বছরের শিশু হিন্দ রাজব। ছবিটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তা শুরুতেই বলে দেওয়া হয়। চারপাশে পড়ে থাকা মৃতদেহের মধ্যে বেঁচে থাকা শিশুটি প্যালেস্টাইনের উদ্ধারকারী রেড-ক্রসের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ছবিটির বিশেষত্ব হলো, শিশুটির সঙ্গে রেড-ক্রসের কথোপকথনের সত্যিকারের ভয়েস কল ছবিটিতে ব্যবহার করা হয়েছে। রেড-ক্রসের লোকজন প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন শিশুটিকে বাঁচানোর। একটি উদ্ধারকারী দল শিশুটির কাছে পৌঁছায়ও, কিন্তু ইজরায়েলের ইনফ্রা-রে ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ধারকারী দল ও শিশুটিকে চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেয়। ছবির শেষে উদ্ধারকারী দলের ও শিশুটির ধ্বংস প্রাপ্ত গাড়ির সত্যিকারের ছবি যখন পর্দায় ফুটে ওঠে, তখন আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীতল স্রোত নেমে যায়। মাথা নিচু করে সমবেত ভাবে প্রেক্ষাগৃহ ত্যাগ করা ব্যাতিরেকে ছবিটি নিয়ে কোনো কথা বলার মতো মানসিকতাও তখন আর অবশিষ্ট থাকে না। তিউনিসিয়ার পরিচালক কাউথার বেন হানিয়ার এই ডকু-ফিচার ছবিটি পৃথিবী-জুড়ে বিপুল সাড়া ফেলেছে বিষয় ও নির্মাণ-শৈলীর এই সমসত্ব মিশ্রণের গুণে।
টেলস অফ দা উন্ডেড ল্যান্ড - লেবাননের পরিচালক আব্বাস ফাহদেল পরিচালিত এই তথ্যচিত্রটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দক্ষিণ লেবাননের উপর নির্মিত। ইস্রাইল এখানেও ধ্বংস-লীলা চালায়। যুদ্ধ-বিরতি চলাকালীন ছবিটি তোলা হয়। একটি পরিবারকে দেখানো হয়, কপাল জোরে যাদের গৃহটি অক্ষত আছে এবং তাঁরাও বেঁচে আছেন। স্বামী ভদ্রলোক (আব্বাস ফাহদেল নিজেই সম্ভবত, যদিও তাঁকে দেখানো হয় নি) সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া দক্ষিণ লেবাননের বিভিন্ন অংশকে গাড়ি থেকে ক্যামেরা বন্দি করতে থাকেন। তাঁর ছোট্ট সন্তানটিকে মনে হয় মৃত একটি অঞ্চলের নতুন প্রাণের একমাত্র স্পন্দন যেন। স্ত্রী শহরের বিভিন্ন অংশ নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকেন। বোঝা যায় একমাত্র স্মৃতিতে ছাড়া তাদের প্রিয় শহরের প্রায় কোনো অংশেরই আর কোনো জীবন্ত অস্তিত্ব নেই। দাফন করতে নিয়ে যাওয়া সারি সারি কফিন ও তৎসংলগ্ন শোক-গাঁথার ভিতর দিয়ে শেষ হয় ছবিটি। একটা চরম শূন্যতায় আবিষ্ট হয়ে যায় আমাদের মন।
দা কন্ডর ডটার ছবির দৃশ্য



