

যেখানে একজন সম্ভাব্য খুনীর বাড়ির সামনে নজরদারিতে দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন করা হয়, সেই খুনী মহিলার পাঠানো ভয়েস রেকর্ডিং শুনে যখন স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এটা আত্মহত্যার আগের শেষ জবানবন্দী... তখন ড্রাইভারকে গাড়ি তাড়াতাড়ি চালাতে বলার সঙ্গে সঙ্গে বা তার আগে পরে সেই নজরদারিতে থাকা পুলিশদের ফোন করে মহিলার ফ্ল্যাটে গিয়ে আত্মহত্যা আটকানোর চেষ্টা করতে বলাই স্বাভাবিক হত হয়ত, হয় নি।
ভয়েস রেকর্ডিং এ যখন খুনী বলে যে, খুনটা করতে গিয়ে তার ভেতরে তোলপাড় হয়েছে... সেটাও খুব অকারণে চাপিয়ে দেওয়া জাস্টিফিকেশন মনে হয়েছে। এটার দরকার ছিলো না। কারণ গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি সেই বিষয়টাই বলা হয়েছে। এবং খুন হওয়া মেয়েটা যে আসলেই মরত, সেটা বলার মধ্যেও সেই একই খুনীর ভার লাঘবের কার্য কারণ পরম্পরা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং এখানেই একটু নীতিবোধ, একটু জ্ঞান...আমার ব্যক্তিগত ভাবে খুব একটা না পোষালেও খুব বাড়াবাড়ি রকম জ্ঞান সেটা বলা চলে না।
আসলে "ছোটলোক" সিরিজটা এককথায় খারাপ বা ভালোর খোপে ফেলে দেওয়াটা একটু মুশকিল।
আর পাঁচটা অন্য সিরিজের ক্ষেত্রে যেখানে ঠগ বাঁছতে গা উজাড় হয়ে যাবে বলে ছোট ছোট অসঙ্গতি নিয়ে মাথা মোটেই বিচলিত হয় না, সেখানে "ছোটলোক" এর কিছু কিছু দৃশ্যের অসঙ্গতি দেখে ব্যক্তিগত ভাবে খারাপ লাগবে কারণ কোথাও গিয়ে সিরিজটা একটা সামাজিক, রাজনৈতিক আর মানবিক একটা গল্প বলে।
একটা থ্রিলার দেখবো ভেবে দেখতে বসলে, ওয়েব সিরিজের ধর্ম অনুযায়ী প্রথম এপিসোড সেভাবে টানটান না লাগতেই পারে, এমন কী প্রথম এপিসোডের শেষে পরের এপিসোডের শেষে যাওয়ার যে অব্যর্থ "হুক" সেটাও আপনি পাবেন না প্রথম বা দ্বিতীয় এপিসোডে....আসলে এটা বর্তমানে বহুল প্রচলিত, অকারণ গুলি এবং গালি "সমৃদ্ধ" ওয়েব থ্রিলার সিরিজ নয়। এটা মাথায় রাখলে সিরিজ দেখতে বসার আগেই একটা প্রাক নির্ধারিত এড্রেনালিনের ক্ষরণ সম্ভাবনা সরিয়ে রেখে ধীরে ধীরে গল্পের ভেতরে ঢোকার পদ্ধতিটা আপনি উপভোগ করতে পারবেন হয়ত। কিছুটা বোরিংও লাগতেই পারে প্রথম দিকে। কিন্তু, যদি আপনি দেখেন শেষ অবধি, তাহলে আপনি একটু অন্যরকম, সারাদিন পরে একটু হাঁফ ছেড়ে, একটু থিতু হয়ে বসে দেখার মত একটা গল্প পাবেন।
পুরো সিরিজে অভিনয়ের গড় মান বেশ উঁচুর দিকেই। দামিনী বেনী বসু অভিনীত সাবিত্রী মন্ডল দু একটি সামান্য সময়ে পালিশবিহীন মোড়ক থেকে বেরিয়ে সফিস্টিকেটেড ব্যক্তি পরিচয়ে উঁকি দিয়ে ফেললেও, সেটুকু সহজেই ভুলে যাওয়া যায়। বিশেষ করে একটু দুর্বল, অসহায় মুহুর্তগুলোতে তিনি অনবদ্য। তাঁর অভিনয় নিয়ে অনেকেই বলছেন, আমার ব্যক্তিগত ভাবে ছোট পুতুল দাসের ভূমিকায় অভিনয় করা শায়েরি, ফারুক কাকার ভূমিকায় লোকনাথ দে, রাজা গৌরব চক্রবর্তী, রূপসা ঊষশি রায়, বাসু জিৎসুন্দর এঁদের প্রত্যেকের অভিনয় যথাযথ ও বেশ ভালো লেগেছে। সাবিত্রীর চরিত্রটি রূপায়ণে তার সহকারী জামিলের চরিত্রে প্রতীক দত্তর শান্ত সংযত সঙ্গতটুকুও প্রশংসার দাবীদার। খুব সহজ ও সাবলীল। গোটা সিরিজেই এই সহজ ভাবটাই ভালো লেগেছে আসলে। অকারণ কায়দা না করে একটা সহজ ভাবে গল্প বলাটা ভালো লেগেছে। ভাঁড়ামি বিহীন কৌতুক রসের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার একটা বড় পাওনা। এবং অবশ্যই সাবিত্রীর স্বামী ও শাশুড়িকে হিরো বা ভিলেন রূপে সংস্থিত না করার জন্য পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীকে ধন্যবাদ।
এই সিরিজ আসলে বহু দিক থেকেই পলিটিক্যালি কারেক্ট এবং সেটা হওয়ার একটা সচেতন প্রচেষ্টা আছে। আর প্রথমে উল্লিখিত ওই প্রান্তিক এবং সাব অল্টার্ন খুনীর অপরাধকে আলাদা করে ন্যায্য প্রতিপন্ন করতে যাওয়ার সমস্যা হয়ত সেখান থেকেই উদ্ভূত। তবু...
যে সিরিজে পুলিশ লাজুক হেসে জুনিয়রের কাছে স্বীকার করে যে মারতে গিয়ে তার নার্ভাস লাগছিল আর বুক ঢিপ ঢিপ করছিল... সেটা কোথাও গিয়ে যেন আমাকে একটু স্বস্তি দিলো!
আমার মত এরকম বাইরে খুব "স্ট্রং" কিন্তু আসলে ভেতরে নরম আর ভীতু ভীতু আরও অনেককেই দেবে আশাকরি। অনেক মেয়েকেই! মুচকি হেসে লড়াইটা জারি রাখবে যদিও তারা সব্বাই তবু কোথাও ওই বুক ঢিপ ঢিপানিটুকু স্বীকার করতে পারার সঙ্গে একাত্ম হতে পারার পরিসরটুকু খুব প্রয়োজনীয় ভরসা যোগায়। কে জানে হয়ত মা কালীরও কখনো কখনো বুক ঢিপঢিপ করে ...
একটু ঠিক করে লিখি আরেকবার... যে সিরিজে মহিলা পুলিশ... ইত্যাদি। ওই যে লিঙ্গ পরিবর্তন করতাম ছোটবেলায় ক্লাস থ্রি থেকে... কবি - মহিলা কবি, পুলিশ - মহিলা পুলিশ!!! হ্যাঁ, এখানে মহিলা শব্দটা আলাদা করে উল্লেখযোগ্য! কোন পুরুষ পুলিশ কি অপরাধ কবুল করানোর জন্য কারোর অফিসে গিয়ে তাকে মারার সময় হুমকির সম্মুখীন হয়ে উল্টে চাপ দিতে পারে এই বলে যে বড়জোর সাসপেন্ড হবে, চাকরি চলে যাবে? যাবে তো যাবে...তার স্বামী, শাশুড়ি তো দুই বাচ্চার মাকে সমানেই বলছে এই পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য! এখানেই এই সিরিজটা আমাকে কোথাও আশাপূর্ণা দেবী আর লীলা মজুমদারের কথা মনে পড়িয়ে দিলো। বারবার তাঁদের লেখায় এসেছে যে, যুগযুগ ধরে একটা জাতিকে যে সব অস্ত্রে দমিয়ে রাখা হয়েছে, তারা কখন যে সেটাকেই নিজেদের ঢাল এবং অস্ত্র দুটোই বানিয়ে ফেলেছে টেরটিও পাবে না! স্বামী শাশুড়ির এই চাকরি ছাড়তে বলায় কান্নাকাটি না করে এমন অব্যর্থ অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করতে একমাত্র এই মেয়েরাই পারে!
আরো বেশ কয়েকটা কেস আসুক না এস আই সাবিত্রী মণ্ডলের হাতে। উচ্চ বর্ণের উচ্চ বর্গের পুরুষের পরিবর্তে একজন ছাপোষা প্রান্তিক দুই সন্তানের মা, সংসারী মহিলা পুলিশ আর তার সঙ্গে আরেক তথাকথিত সংখ্যালঘু পুরুষের এই স্বাভাবিক সহকর্মী জুটি যত বেশি প্রকাশ্যে আসে ততই ভালো। ছোটখাটো ত্রুটি বিচ্যুতি অসঙ্গতি তো জীবনেও থাকে। জীবনের গল্প বলাতেও একটু আধটু থাকুক না হয়, সেসব শুধরে নেওয়ার অবকাশ তো থেকেই যাচ্ছে।
সৃষ্টিছাড়া | 103.85.***.*** | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১১:১১525983
r2h | 134.238.***.*** | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৫২526010
dc | 2401:4900:1cd1:2be5:d66:d9f1:f743:***:*** | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ২১:০৬526012
হে হে | 2a0b:f4c2:1::***:*** | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ২১:১৯526016
দীমু | 182.69.***.*** | ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ০১:২৭526029
r2h | 134.238.***.*** | ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৩:০০526031
দীমু | 182.69.***.*** | ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৪:৪৯526034
:|: | 174.25.***.*** | ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:০৪526042
দীমু | 106.2.***.*** | ১৫ নভেম্বর ২০২৩ ১২:২৫526080