এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পর্যালোচনা (রিভিউ)  সিনেমা

  • সাম্প্রতিক কিছু ফরাসি চলচ্চিত্রগুচ্ছ

    সন্দীপন মজুমদার
    পর্যালোচনা (রিভিউ) | সিনেমা | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৭৬০ বার পঠিত

  • বিংশ শতাব্দীর ফরাসি চলচ্চিত্রের মহীরূহ যাঁরা ছিলেন তাঁদের ছবি দেখার সুযোগ একসময় খুব কম ছিল। একমাত্র চলচ্চিত্র উৎসব এবং ফিল্ম সোসাইটির বিশেষ প্রদর্শন ছাড়া সেসব ছবি দেখার সুযোগ ছিল না। সে অধিকারও আবার মূলত সোসাইটির সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। তবে এঁদের অনেকের নাম আমাদের জানা ছিল। এমনকি বাংলা ভাষায় এদের কারো কারো সম্পর্কে বইও বেরিয়েছিল মূলত কলকাতার বাণীশিল্প প্রকাশন থেকে। এছাড়াও চিত্রবীক্ষণ, চিত্রভাষ, এফ ইত্যাদি বিভিন্ন চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা থেকেও অনেক আলোচনা পাওয়া যেত। অনেক সময় পাওয়া যেত কোনো চিত্রনাট্যের অনুবাদ। তার মাঝে ১৯৮২ সালে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে জাঁ লুক গোদারের রেট্রোস্পেকটিভ আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল বলে জানা যায়। এসব নিয়েই ফরাসি নিউ ওয়েভ আর তার বাইরে রেনোয়াঁ, ব্রেসো, অ্যালা রেনে, অ্যাগনেস ভার্দা নামগুলি আমাদের পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। মৃণাল সেনের কিছু রাজনৈতিক ছবিতে তথাকথিত গোদার রীতির কিছু প্রয়োগও আমরা দেখেছিলাম (পরে অশোক বিশ্বনাথনের শূণ্য থেকে শুরু ছবিতেও এরকম প্রয়োগ অনেক ছিল )। তারপর একসময় চলচ্চিত্র দেখার সু্যোগ বাড়ল ইনটারনেটের কল্যাণে, কিন্তু চলচ্চিত্র সংক্রান্ত আলোচনার পরিসর ও প্রভাব গেল কমে। ফলে সাম্প্রতিক ফরাসি চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমরা খুব একটা কিছু জানি না। কিন্তু শুধু ইনটারনেট নয় , এখন বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেও সেসব সুযোগ কিছুটা তৈরি হয়েছে। বিশেষত Mubi নামক প্ল্যাটফর্মটিতে এরকম ছবির আধিক্য আছে। সেখান থেকেই কয়েকটি ফরাসি ছবি বেছে নিয়ে আমার এই ঝাঁকিদর্শন প্রচেষ্টা।

    (১) Something in the Air : Dir. Olivier Assayas
    ৬৭ বৎসর বয়স্ক অলিভিয়ে অ্যাসাইয়াস ছবি করছেন ১৯৮৬ সাল থেকে। ২০১২ সালে তৈরি এই ছবিতে তিনি নিজের আত্মজৈবনিক উৎসের দিকে তাকিয়েছেন বাড়তি কোনো আবেগ ছাড়াই । ছবিটি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কার পায়। সময়টা ১৯৭১ সালের শেষের দিক। ফ্রান্সে ছাত্র আন্দোলন তখনও চলছে। ছবির প্রধান চরিত্র জিল শিল্পী হবার স্বপ্ন দেখে । সে তখন হাইস্কুলের ছাত্র। প্রথম থেকেই তাকে দেখি আরো কিছু বন্ধু বান্ধবীর সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিতে। বোঝা যায় এই আন্দোলনকারীরা কোনো পার্টি দ্বারা পরিচালিত নয়। কেই ট্রটস্কাইট, কেউ সিচুয়েশনিস্ট, কেউ বা নৈরাজ্যবাদী। তবে সবাই প্রতিষ্ঠানবিরোধী, এমনকি বড় কম্যুনিস্ট পার্টি বা ট্রেড ইউনিয়নেরও বিরোধী তারা। এদের মধ্যে কেউ আবার অ্যাজিট প্রপ ছবি বানায়, সেগুলি শ্রমিকদের মধ্যে দেখায়। আবার জিলের প্রথম প্রেমিকাকে দেখি এক বয়স্ক বোহেমিয়ান ব্যক্তি যে এক্সপেরিমেন্টাল ছবিতে টাকা ঢেলে নষ্ট করে তার ঘনিষ্ঠ হয়ে যেতে। জিলের মনে প্রশ্ন জাগে বিভিন্ন ইস্যুতে। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সমালোচনা পড়ে সে অন্যদের মত উড়িয়ে দিতে পারে না লেখককে সি আই এর এজেন্ট বানিয়ে দিয়ে।জিল ছবি আঁকে। তার মনে হয় এদের রাজনীতি এবং শিল্পবোধ , দু জায়গাতেই ঘাটতি আছে কিছু যার সঙ্গে সে মানিয়ে নিতে পারছে না। বুর্জোয়া বাবার সঙ্গে তর্ক করে সে, বাবার আমোদগেঁড়ে সিনেমা তৈরির ব্যবসায় সহায়ক হবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। শেষ দৃশ্যে একটি এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমার দর্শকের লাইনে তাকে দেখা যায়। পর্দায় উজ্জ্বল এক প্রেক্ষাপট থেকে এগিয়ে আসে তার প্রথম প্রেমিকা । জীবন আসলে এক নিরীক্ষা মাত্র। সেখানে কিছু স্মৃতি অনির্বাণ থাকে।বাতাসে ভেসে থাকে সেই স্মৃতির চূর্ণ।





    (২) Playlist :Dir. Nine Antico
    একচল্লিশ বছর বয়স্ক মহিলা পরিচালক নিনে অ্যানটিকোর এটাই প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাহিনীচিত্র (মুক্তি ২০২১)। শর্ট ফিল্ম এবং টিভি সিরিজ নির্মাণ করা ছাড়াও তিনি একজন কার্টুনিস্ট এবং ইলাস্ট্রেটর। এই ছবির প্রধান চরিত্র সোফিও ছবি আঁকে। আর্ট স্কুলের ডিগ্রী তার নেই। তাই তার লড়াইটা আরো কঠিন। কিন্তু রেস্তোরাঁয় ওয়েট্রেসের কাজ ছেড়ে সে প্রকাশকের বিপণন বিভাগে কম পয়সার চাকরি নেয় এই আশায় যে, যদি তার ছবি আঁকা সংক্রান্ত কাজে সহায়তা হয়। একবছর সহবাস করার পর ওই রেস্তোরাঁর সহকর্মী জাঁর কাছে সে জানতে পারে যে সে তাকে ভালোবাসে না। তার ফ্ল্যাটের পার্টনার তরুণীটি অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে এবং একটা ছোটো ছবিতে কাজও করে। ছারপোকা আক্রান্ত বিছানার ম্যাট্রেসটা পাল্টে একটা নতুন ম্যাট্রেস ইনস্টলমেন্টে নিতে গিয়ে যে সেলসবয়টির সাথে আলাপ হয় সোফির তার মধ্যে এক নতুন মানুষের সম্ভাবনা খুঁজে পায় সে । জীবন কোন অনিশ্চিতির ফাঁকে কোন সম্ভাবনা লুকিয়ে রাখে সেটা যাপনের মধ্যেই কখনও টের পাওয়া যায়। এই সরল গল্পকাঠামোটিকে ধরে আছে উপস্থাপনের যে ভঙ্গি সেটা কিন্তু খুব স্মার্ট। সাদা কালোতে নির্মিত হওয়ায়, বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপে মাঝে মাঝে ভ্রম হয় বুঝি নব্য তরঙ্গের কোনো পরিচালকের মাঝারি মানের কোনো ছবি দেখছি।





    (৩) Titane :Dir. Julia Docournau
    ১৯৮৩ সালে জাত জুলিয়া ডুকর্ণর এই ছবিটি , যেটি তাঁর কেরিয়ারের দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ চিত্র সেটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কার গোল্ডেন পাম পেয়েছে। এটি বডি হরর ঘরানার ছবি। জুলিয়ার প্রথম শর্ট ফিল্ম জুনিয়র এবং সাড়া জাগানো প্রথম কাহিনী চিত্র ‘র’ ও ছিল এই একই ঘরানার। শরীরের মধ্যে অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন ঘটলে যখন সেটাই আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ওই শরীরের বাহক এবং পারিপার্শ্বিকের কাছে তখন এই ঘরানার ন্যারেটিভ তৈরি হয়। হলিউডে এসব নিয়ে অনেক বাণিজ্যসফল কিন্তু অন্তঃসারশূণ্য ছবি হয়েছে। কিন্তু জুলিয়া এই ছবিতে সেটাকে নিয়ে এক আধুনিক অতিকথা তৈরি করেছেন। এই ছবি তাঁর আগের ছবি ‘র’ এর মত ভয়ংকর না হলেও এটিও বীভৎস রসের ছবি। আমাদের অলংকারশাস্ত্রে বীভৎস রসকেও কেন স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলো তা মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক বর্ণনায়, ভীম কর্তৃক দুঃশাসনের রক্তপাতের আখ্যান পাঠে বোঝা যায়। এ ছবিতে আছে সেই রস, আছে বাস্তব সময়কে এপিকের মতই অতিক্রম, আছে উত্তরণের আশ্বাস।

    এ ছবির নায়িকা আলেক্সিয়ার ছোটোবেলায় এক গাড়ি অ্যাকসিডেন্টের পর মাথায় একটা টাইটেনিয়ামের প্লেট বসানো হয়। প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তাকে দেখি গাড়ির মডেলের বিজ্ঞাপনে স্ট্রিপ শোর কাজ করতে। গাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক এতটাই গভীর যে সে একটা ক্যাডিলাক গাড়ির সঙ্গে সঙ্গম করে এবং গর্ভবতী হয় (এখানে মনে রাখতে হবে যে কোনো বাস্তব সময়ের কথা বলছেন না পরিচালক যেটি তিনি সাক্ষাৎকারেও বলেছেন )। অথচ পুরুষ বা নারী প্রেম নিবেদন করতে আসলে (মূলত শারীরিক টানেই তারা আসে) সে তাদের হত্যা করে এবং সিরিয়াল কিলারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। গর্ভবতী অবস্থাতেই তাকে পালাতে হয় ঐ শরীর নিয়ে। যে শরীরটা আসলে ক্ষতবিক্ষত, শরীরের ক্ষতর আড়ালে ধাতব অভ্যন্তর দেখা যায়, শরীর থেকে নিঃসৃত হয় জ্বালানি তেল। এই শরীরটা তাকে কষ্ট দেয়। একসময় সে নিজের পরিচিতি পাল্টে ফেলে। দশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সাত বছর বয়সের এক বালক অ্যাড্রিয়েন লেগ্রাঁ হিসেবে নিজেকে হাজির করে সে। তার আগে অবশ্য তাকে নিজের চুল ছাঁটতে হয়, নিজের লম্বা নাকটা ভাঙ্গতে হয় নিজের হাতে, আর বুকে পিঠে ভালো করে ব্যাণ্ডেজ জড়িয়ে স্তনযুগল আর ক্রমবর্দ্ধমান পেটকে ঢাকা দিতে হয়। অ্যাড্রিয়েনের বাবা ভিনসেণ্ট তাকে গ্রহণ করে এবং তার অধঃস্তন কর্মচারীদের কাছে (সে একটি অগ্নিনির্বাপক টিমের ক্যাপ্টেন) তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় একজন ভীত, সন্ত্রস্ত,নির্বাক, মেয়েলি ঢংয়ের ছেলে হিসেবে যে তার হারিয়ে যাওয়া সন্তান। পাখি যেমন ডানা মেলে তার শাবককে রক্ষা করে ভিনসেন্ট তার কল্পিত ( হ্যাঁ, কল্পিতই বলছি, কারণ বাস্তবত বোধহয় ভিনসেন্ট বুঝতে পেরেছিল যে এ তার সন্তান নয়) সন্তানকে সবরকম আশ্বাস দেয় নিরাপত্তার। এমনকি তাকে এও বলে ‘তোমার যদি কেউ ক্ষতি করতে চায় তাকে আমি হত্যা করব, সেই ব্যক্তি যদি আমি নিজেই হই তাকেও’।

    ভিনসেন্টের বয়স হলেও সে শরীরকে পোক্ত রাখতে চায়, ব্যায়াম করতে চায় কঠোর, আর সেই উদ্দেশ্যেই বোধহয় শরীরে কোনো স্টেরয়েড ইনজেকশন নেয়। একবার সেই ইনজেকশনের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে সে অজ্ঞান হয়ে যায় তখন আলেক্সিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে তার জন্য। ভিনসেন্টের প্রাক্তন স্ত্রী, অ্যাড্রিয়েনের মা তার সন্তানকে দেখতে এলে অ্যালেক্সিয়ার পরিচয় তার কাছে উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তিনি কথাটা গোপন রাখেন আর আলেক্সিয়াকে অনুরোধ করেন ভিনসেন্টের যত্ন নিতে। বোধহয় তিনি চাইছিলেন যে এটা যদি ভিনসেন্টের বিভ্রম হয় তবে তার মধ্যেই ও শান্তি পাক। আর ভিনসেন্ট তো পরে নিশ্চিতভাবেই বুঝেছিল অ্যালেক্সিয়ায় পরিচয়। এমনকি ঘটনাচক্রে তার আঢাকা স্তনও একবার সে দেখে ফেলেছিলো। কিন্তু তখন তার বক্তব্য ছিল ‘”তুমি যেই হও, তুমি আমার ছেলে।“ অ্যালেক্সিয়ার প্রসবের সময় উপস্থিত হলে তার সঙ্গে ভিনসেন্টের পরিচয়ের খেলাটা ভেঙ্গে যায়। কিন্তু অ্যালেক্সিয়া তখন অসহায়। সে কাতর আবেদন করে ভিনসেন্টকে যাতে সে তাকে ছেড়ে না যায়। ভিনসেন্ট তাকে আশ্বস্ত করে এবং প্রসবে সাহায্য করে। প্রসবের শেষে সম্ভবত টাইটেনিয়াম প্লেটটি খুলে যায় এবং অ্যালেক্সিয়া মারা যায়। কিন্তু তার আগে জেনে যায় যে তার সন্তান নিরাপদ আশ্রয়ে আছে। আমরা যদিও দেখতে পাই সদ্য জন্মানো শিশুটির চকচকে ধাতব শিরদাঁড়া এবং বিভিন্ন অংশ টাইটেনিয়াম দিয়ে তৈরি। ভিনসেন্ট সজল চোখে তাকে কোলে তুলে নিতে নিতে আশ্বস্ত করে বলে ‘ আমি আছি। আমি আছি ‘। এই হল জুলিয়ার ‘টাইটেন’। মানুষের যান্ত্রিকতা, আগত বিশ্বের ভয়াবহতা, সমস্ত নঙর্থক প্রতিবেশের মধ্যেও মানুষের সংযোগস্থাপনের ইচ্ছা—নানা নিহিতার্থ এ ছবি থেকে খুঁজে পেয়েছেন সমালোচকরা। তবে দর্শককে এক বাস্তবোত্তর অনুভূতির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় এই ছবি।






    (৪) Annette: Dir. Leos Carax
    অত্যন্ত প্রতিভাবান পরিচালক লিওস কারাক্সের বয়স এখন ৬২ হলেও হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি করেছেন তিনি। যাঁরা ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হোলি মোটোরস’ ছবিটি দেখেছেন তাঁরা বুঝতে পারবেন কোন উচ্চতাগামী তার চলচ্চিত্রবোধ ও দর্শন। তা এহেন পরিচালক যখন ছয় বছর ব্যবধানে একটি ছবি বানান এবং সেটি পুরো মিউজিকাল ঘরানার তখন সেটা আমাদের প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে ওঠে বৈকি। এক স্টার্ট আপ কমেডিয়ান হেনরি এবং এক বিশ্বখ্যাত অপেরা সিঙ্গার অ্যানের তুমুল প্রেম, তাদের প্রথম সন্তান অ্যানেটের জন্ম (যে বিস্ময়কর গায়নপ্রতিভার অধিকারী একটি পাপেট), হেনরির ঈর্ষা, রাগ, প্রায় তারই দোষে অ্যানের এক অতিপ্রাকৃতিক মৃত্যু—সবকিছু অপেরা এবং স্টাইলাইজেশনের অংশ। অ্যানের মৃত্যুর পর হেনরি বিস্ময়বালিকা অ্যানেটের (পাপেট) গায়নপ্রতিভাকে ব্যবহার করে বিশ্বজয় করতে বেরোয়। সঙ্গে থাকে ঐ অপেরার কনডাক্টর যে হেনরির আগে অ্যানকে ভালোবাসত। একসময় নেশাতুর, ঈর্ষাদগ্ধ হেনরি ওই কনডাক্টরকে জলে ডুবিয়ে মারে। হ্যাঁ, এই হত্যাদৃশ্যও মিউজিকালের, বলা ভালো রক অপেরার স্টাইলে উপস্থাপিত। অ্যানেট কিন্তু বোঝে বাবার এই কীর্তির কথা। এরপর জীবনের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানে অ্যানেট গান করতে উঠে গান গাওয়ার বদলে জানায় যে তার বাবা একজন খুনী। শেষে আমরা হেনরিকে দেখি তার সলিটারি সেলে। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে অ্যানেট যে এই সিকোয়েন্সে যুগপৎ পাপেট এবং মানুষবালিকা। হেনরিকে সে ক্ষমা করতে পারবে না জানিয়ে দেয়, সে আর গানও গাইবে না। হেনরি বলে সে অতলান্ত খাদ দেখেছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই খাদের দিকে না তাকিয়ে সে পারেনি। সে অ্যানেটকে বলে যেন সে খাদের তলদেশে না তাকায়। অ্যানেট স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে হেনরির আর কেউ রইল না এ দুনিয়ায় ভালোবাসার মত কারণ সেও হেনরিকে ভালোবাসতে পারবে না। ঘরে কোণায় মুখ লুকায় হেনরি। পড়ে থাকে পাপেট আর তার প্রিয় পুতুল। এ ছবি আমাদের আবিষ্ট করে। এর আবেগময় গল্পকাঠামোর সঙ্গে দূরত্বস্থাপনে সক্ষম হয় এর চূড়ান্ত স্টাইলাইজেশন এবং শ্বাসরোধকারী সৌন্দর্য। শিল্পীর ব্যক্তিসত্তায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা আত্মঘাতী প্রবণতা তাকে টেনে নামাতে পারে অতল খাদে। এই বিপর্যয়ের আখ্যানকে এভাবে রক মিউজিকের সাহায্যে উপস্থাপন করে আমাদের বিস্মিত করলেন পরিচালক। আরো আশ্চর্যের , এর বেশির ভাগ গান অভিনেতারা নিজেরাই গেয়েছেন। মুখ্য চরিত্রের দুই বহু গুণাণ্বিত অভিনেতা Adam Driver এবং Marion Cotillard দুজনেই অবশ্য অভিনয়ের পাশাপাশি গানও গাইতে পারেন। এই ছবি বোঝায় সিনেমার সম্ভাবনা এবং বৈচিত্রর শৈল্পিক সন্ধান অফুরান উদ্ঘাটন তুলে আনবে লিওস কারাক্সদের মত প্রতিভাবানদের হাত ধরে।






    (৫) Monopoly of Violence :Dir. David Dufresne

    এবার যে ছবিটি নিয়ে আলোচনা করছি সেটি ২০২০ সালে নির্মিত ১ ঘণ্টা ২৬ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র । মূল ফরাসি নামটি আরেকটু ব্যঙ্গাত্মক ছিল ; একটি সভ্যভব্য দেশ বা এরকম কিছু। প্রাক কোভিড পর্বে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনের ওপর চলা পুলিসি নিষ্পেষণকে ঘিরে বিতর্কই এই ছবির অন্তর্বস্তু। এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে । লকডাউন ঘোষণার প্রথম পর্যায় অর্থাৎ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত তা চলে। গোটা ছবি জুড়ে আমরা দেখি এই আন্দোলনকে ‘সামলাতে’ পুলিসের নির্মম ব্যাটন চার্জ, হ্যাণ্ড গ্রেনেড চার্জ ইত্যাদি যাতে বহু মানুষ আহত হন, অনেকে অঙ্গচ্ছেদ এবং দৃষ্টিহানি হয়। পরিচালক দুফ্রেস্নে সমাজের বিভিন্ন বর্গের মানুষকে এই নিষ্পেষণের যৌক্তিকতা নিয়ে তাঁদের মতামত দিতে বলেন। সরকার পক্ষের এবং পুলিসের অনেকে অস্বীকার করেন মতামত দিতে। কিন্তু বাকিদের বিশ্লেষণ থেকে এটা আরো কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয় যেমন (১) হিংসা যদি রাষ্ট প্রয়োগ করে তাহলে আক্রান্ত নাগরিক কী করবে? (২) হিংসার একচেটিয়া অধিকার পুলিসের হাতে থাকে কেন? (৩) জনগণের পুলিস বলে কি কিছু হতে পারে ? (৪) মানুষের প্রতিবাদের অধিকারকে দমন করার জন্য পুলিসকে কিভাবে ব্যবহার করে রাষ্ট ? (৫) যে অর্থনৈতিক আক্রমণের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ তাও কি একধরণের হিংসা নয় ? তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর অধিকার তার থাকবে না কেন? (৬) গণতন্ত্র মানে কি শুধু ঐকমত্য ? ভিন্নমত পোষণের অধিকার না থাকলে সেটা গণতন্ত্র কিসের ?
    এই জরুরী প্রশ্নগুলি যে বিমূর্ত আলোচনায় উঠে এসেছে এমন নয় । পুলিসি নির্যাতনের চিত্র, পাশাপাশি মানুষের প্রতিবাদস্পৃহা এবং সহমর্মিতার উদযাপন পরিচালকের ‘এনগেজড’ ক্যামেরায় ধরা পড়েছে এবং নিখুঁত সম্পাদনায় তা নতুন পরিপ্রেক্ষিত পেয়েছে। যে কাহিনীচিত্রের আলোচনা দিয়ে আমরা এই অবলোকন শুরু করেছিলাম সেখানেও বিষয় ছিল রাজনীতি, শিল্পবোধ এবং বিদ্রোহের রসায়ন। সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে তৈরি এই তথ্যচিত্রটি দেখলে আমরা বুঝতে পারি ফরাসি মানসবৃত্তে সেই রসায়নের ম্যাজিক আজও ক্রিয়াশীল। বস্তুত, এই ফরাসি চলচ্চিত্রগুচ্ছ আমাদের বিশ্বাস করতে শেখায় ফ্রান্স সৃষ্টিশীল থাকবে – হোক তা সে সিনেমায় বা জীবনের বিবিধ উদযাপনে।








    ছবিঃ লেখক। (কপিরাইট লঙ্ঘনের দায় সম্পাদকের নয়।)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পর্যালোচনা (রিভিউ) | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৭৬০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হা হা | 2401:4900:3825:1a2d:1:1:e8a5:***:*** | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:২৩503965
  • এর, কোন ছবি আমি দেখিনি। মতামত কি করে দেব? 
    পড়লাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন