বিষয়টা অত্যন্ত গুরুতর। খিল্লি করার মতো নয় মোটেই। যাঁরা এই সিরিজটি দেখে ফেলেছেন, তাঁদের মধ্যে কাউকে যদি এর পরে কোনও পূর্বতন সমস্যা নিয়ে মনোবিদের দ্বারস্থ হতে হয়, তবে অপেক্ষমান অবস্থায়, চেম্বারে বসে চার রকম সম্ভাবনায় ঘুরপাক খাবেন তাঁরা—১) আমি আছি, ডাক্তার নেই ২) ডাক্তার আছে, আমিও আছি, ৩) আমি নেই, ডাক্তার আছে, ৪) আমিও নেই, ডাক্তারও নেই।
শেষোক্তটি যদি সত্যি হয়, তবে এই সিরিজ দেখার পরে ডাক্তার ও রোগী, দুজনেই বেঁচে গেলেন। কিন্তু যদি না হয় তবে তাঁরা এমন একটি অস্তিত্ববাদী রুমাল চোর খেলার প্রতিযোগী, যেখানে আসলে কোনও রুমালই নেই।
কিন্তু রুমাল, ডাক্তার, আমি-আপনি না থাকলেও কিরণময়ী আছে। কারণ সে বাঁচিয়া প্রমাণ করিয়াছে যে সে মরে নাই। কারণ সে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও ব্লাউজের অর্ধেক-খান উন্মোচিত রাখতে পটীয়সী। কারণ সে পরিচালকের মিউস। কারণ সে ওটিটি-র ভিউ-পয়া দেবী। কারণ তার কনট্র্যাক্ট সম্ভবত এখনও ফুরোয়নি।
পাঠকের যদি মাথা ঘুরন্তি হয় এই সব হাবিজাবি পড়ে, তবে এই ব্যাপারে আরও কিছু উৎকৃষ্ট মানের কটকটিভাজা পেতে তাঁরা একবার দেখে ফেলতে পারেন সিরিজটি। আর কিছু না হোক, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য পাঁচমিশেলি আমোদ তো পাবেন। যে যাই বলুক, বুদ্ধি করে, শারীরিক ইনটু-মিন্টু দেখানোর ব্যাপারে হইচই বাংলা বাজারে সুপ্রসিদ্ধ।
বিশেষ করে চরিত্রহীন ফ্র্যাঞ্চাইজিতে শরীর পণ্য, যৌনতা পণ্য, কিন্তু কী যে মিষ্টি একটা অর্ধসিদ্ধ দর্শনের মাংসের ঝোলে জারানো কী বলব। আবার সেটাকে জাস্টিফাই করতে, হঠাৎ একটি চরিত্র ফোর্থ ওয়াল ভেঙে ফেলে দাঁত বার করে হেসেও ওঠে। এই দাঁত কার হ্যায় ঠাকুর?
তৃতীয় সিজনের গল্পে, এই দর্শনের জিবারিশ ব্যাপারটা ভারী উপাদেয় কারণ মাথা এখানে খাটে না, খাটে শুধু মুখ। মানুষ, প্রেম, সভ্যতা, ধর্ম, অনর কিলিং, দাঙ্গা, পরকিয়া কিয়া না-কিয়া-- কয়েকটি কি-ওয়ার্ডকে ছেড়ে দিতে হয় বালিতে। তারা যেমন খুশি দৌড়ে-হেঁটে একটা প্যাটার্ন তৈরি করে। ওদিকে মিলেনিয়ালরা আবার আর কিছু না হোক, কেওস তত্ত্বটি বেশ বোঝেন। তাই গল্পের সাপ-ব্যাং-ছুছুন্দরীদের একটা কেওসের হ্যালুসিনেশনে ফেলে দিলেই হল-- কিছুটা তো অগভীর পুষ্করিণী ঢাকা যায় আর কী।
অতঃপর সতীশের মতোই দর্শক সেই হ্যালুসিনেশন ধাওয়া করতে করতে সিরিজটি বিঞ্জওয়াচ করে ফেলবেন। বাকিটা কেয়াবাত সিনেমাটোগ্রাফি! ওখানে আর কিছু পাঁয়তারা করার জায়গা তেমন নেই- ওটা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বিশুদ্ধ লজিক এবং অবশ্যই নন্দনতত্ত্বের চেতনা। সেখানে চড়চড় করে ভালই নম্বর তুলে ফেলেছে এই সিরিজ।
কিন্তু আইসিং দিয়ে কেকটি ঢেকে ফেললেও, তলায় কি ধন আছে, তা এক কামড়েই বোঝা যায়। বলি, গল্পে একটু কম গা ঘিনঘিনেমি না দিলে কি ভাত হজম হত না বাছা? একজন স্বাধীন উপার্জনক্ষম নারী মনোবিদ মানেই কি তাঁকে দর্শন চোবানো আইটেম বানিয়ে ফেলতে হবে, যিনি রোগ সারাতে সারাতে নিজের অরগাজমে ভেসে যান? মানছি যে কোনও অ্যাকমপ্লিশমেন্টের মধ্যেই অরগাজমের সমতুল্য সুখ লুকিয়ে থাকে।
রোগীর কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা সফল হলে মনোবিদের পরমানন্দ হওইয়ারই কথা। কিন্তু ভাই, এমন মনোবিদে কাজ নাই। এই সিরিজে একা অভয়ে রক্ষে ছিল না, আঠেরো ঘা দশা। কিন্তু সিজন ৩ দেখে বোঝা গেল, মনোবিদ ছুঁলে একশো আট ঘা। প্রয়োজনে তিনি সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তুলতে পারেন। সত্যি বলছি, এই সিরিজ দেখার পরে চিকিৎসকদের একাংশ নিজের মাথায় স্টেথো ঠুকে আহত হবেন। কিন্তু সবচেয়ে করুণ পরিণতি হতে পারে মনোবিদদেরই। এমনিতেই সাধারণত মানুষ সাইকোলজিস্ট ও সাইকিইয়াট্রিস্টের পার্থক্য বোঝেন না। তার ওপর সবাইকেই এক ব্র্যাকেটে ফেলে, পাগলের ডাক্তার বলে এঁদের অবমাননা করার সংস্কৃতিটি বিদ্যমান। হরি, হরি করে সিরিজটি দেখার পরে দর্শকের মধ্যে N সংখ্যক সম্ভাবনা দেখা দেবে—
১) সিরিজ দেখে মুগ্ধ কিন্তু মাথা ঠিক মাথার জায়গাতেই আছে
২) সিরিজ দেখে মুগ্ধ, মন মনের জায়গাতেই আছে কিন্তু মাথা গুলিয়ে গেছে
৩) সিরিজ দেখে মুগ্ধ, মাথা ঠিক মাথার জায়গাতেই আছে কিন্তু মন গুলিয়ে গেছে
৪) সিরিজ দেখে মুগ্ধ, মাথা ঠিক মাথার জায়গাতেই আছে কিন্তু মন গুলিয়ে গেছে তাই মনের ডাক্তার দেখাতে যাবেন না
৫) সিরিজ দেখে মুগ্ধ, মাথা-মন কোনওটাই জায়গায় নেই, তাই মন না মাথা, কোন ডাক্তার আগে দেখাবেন তা ঠিক করে উঠতে পারছেন না।
………………………………………………………………।
n) @##$$%*&~!@${><:???}
এই সিরিজ দেখার পরে যদি বহু মানুষ মনোবিদের কাছে যেতে শঙ্কিত বোধ করেন, তবে একদম আশ্চর্য হব না। কেউ কেউ যদি দিদি-জামাইবাবুর বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেন, তা হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই কারণ সেই যে কথায় বলে, জন-জামাই-ভাগনা, তিন নয় আপনা। এই সিরিজের গল্প তা অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দিয়েছে।
আর জামাইবাবুর বাড়ি যদি শহরে উনষাট তলায় হয়, তবে তো একবারেই নয়! এই আর এক ন্যাকা স্টিরিওটাইপ—শহর বিষাক্ত, শহরের মানুষ বিষাক্ত আর গ্রাম রূপকথা। যে সব লেখক-চিত্রনাট্যকার এসব লেখেন, তাঁদের শুধু একবার একটা নন-গাইডেড টোকা দিতে হয় স্পর্শকাতর গ্রামীণ এলাকাগুলিতে।
গল্পের খাতিরে গল্পকে এমন একটা নিদারুণ বিষে ভরা পানপাত্রে পরিণত করা হয়েছে, যা মননে-মগজে কোন মূল্য যোগ করে না। কিন্তু আবার ওই যে বিষের একটা হাতছানি আছে। সব জেনেশুনেও না দেখলে উইথড্রয়াল হবে। তাই জনতা-জনার্দন দেখবে। আমরাও দেখব।
সিরিজের মূল চরিত্রের সঙ্গে তাল তাল মিলিয়ে বলে উঠব, সতীশ পুড়ছে, কিরণময়ী পুড়ছে, নিরুপমা পুড়ছে, আমরা পুড়ছি, ডেটা পুড়ছে।
ঠিক ঠিক
এই মতের ভঙ্গি ও প্রকাশটি গুরুসুলভ।
এই গুরুসুলভ ব্যাপারটি ঠিক কী বটেক ?
"তবে তাঁরা এমন একটি অস্তিত্ববাদী রুমাল চোর খেলার প্রতিযোগী, যেখানে আসলে কোনও রুমালই নেই।" এসব কথার মানেই বা কী বটেক ? নাকি এই আপনাদের গুরুসুলভ প্রকাশভঙ্গি ?
নায়িকা পরিচালকের মিউজ কি না , ব্লাউজের অর্ধেক খান উন্মোচিত কিনা ,সেই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণও বুঝি গুরুসুলভ প্রকাশ ?
আর লেখাটি পড়ে আর কিছু না গুলোক লেখকের মন মাথার ধারণা যে গুলিয়ে গেছে আর পাঠকের মাথা গুলিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু পাওনা নাই, সেইটি বিলক্ষণ বোঝা গেল !
চিত্রনাট্যকার হিসেবে পরিচালকের সঙ্গে কল্লোল লাহিড়ীর নাম থাকায় এই সিরিজটি দেখার চেষ্টা করেছিলাম। লেখক কল্লোল এবং চিত্রনাট্যকার কল্লোল যে আলাদা, সেটা এবার থেকে মাথায় থাকবে। সিজন ১ এবং ২ ছিল ঘোমটা বিনে খ্যামটা আর সিজন ৩ পুরোটাই অদ্ভুত এক সিউডো আঁতলামির শ্বাসরোধী কুয়াশায় মোড়া। পরিচালক দেবালয় বাবুর 'Dracula স্যার'-এর মতোই।
সিরিজটি দেখে আমার মাথা মন সবই তালগোল পাকিয়ে গেছে