‘সমুদ্র কত দূর?’
এক্ষুনি যেন ছুটে যেতে চায় মেয়ে। অনেক অনেক ধকলের পর শরীরে ও মনে অনেক অনেক নির্যাতনের দাগ নোনা জলে ভিজিয়ে মুছে ফেলতে ফেলতে যেন জলের মতোই সহজ অথচ দুর্বার ছুটে যেতে চায় সামনের দিকে। তার দুই চোখে যেন সে কথাই প্রতিভাত হতে থাকে।
‘খুব কাছে তো নয়। অন্তত দু থেকে তিন দিন সময় থাকলে ভাল করে এনজয় করা যাবে।’, মেয়ের হতাশ মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থাকি।
‘কোনদিন সমুদ্র দেখিনি!’, হতাশ মুখ নওদীপ কৌর-এর।
হতাশ মুখ কেননা রাত পোহালেই হাওড়া থেকে দিল্লির ট্রেন ধরে ফিরতে হবে কৃষক আন্দোলন ভূমিতে। মাত্র একদিনের জন্য কলকাতায় আসা, ‘জনতার সাহিত্য উৎসব’-এ ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাহিত্য বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিতে। সঙ্গে অর্পণ, অঙ্কিত, জগজিৎ ওরফে নিক্কি। শেষ তিনজন যখন সংগ্রামের গান শোনাতে মঞ্চে উঠলো নওদীপ-ও গলা মেলালো। ফ্যাসিবাদ বিষয়ে তার স্পষ্ট ধারণার পাশাপাশি গানের কণ্ঠেও চমৎকৃত শ্রোতা।
‘তাহলে তো তোমাকে সমুদ্রে নিয়ে যেতেই হচ্ছে।’, আমি নাছোড়।
ওল্টানো ঠোঁটের ওপর খানিক বিষণ্ণতা মাখিয়ে নওদীপ, ‘ক্যা করু, ইতনা কাম…’
এত কাজ-এর পরবর্তী না-বলা বাক্যাংশ বাতাসে ছেড়ে দেওয়া দীর্ঘ শ্বাসে গুম হয়ে থাকে যেন, আর তার দু চোখের নীচে লেপ্টে থাকা ক্লান্তির মাঝেও মণি দুটো চকচক করে ওঠে। দিল্লি ফিরেই আবার মঞ্চে ওঠা, আবার বক্তৃতা, আবার সহশ্রমিকদের নিয়ে কৃষক আন্দোলনের পাশে থাকা, আর সারাক্ষণ সাক্ষাৎকার দেওয়ার চাপ।
সাহিত্য উৎসবের আগে তো বটেই পরেও নওদীপ-এর সামনে তাক করা ক্যামেরাগুলো সরছেই না। সব কাজ শেষ হয়ে গেলেও আমরা কজন ওর জন্য অপেক্ষা করছি। নিরলস নওদীপ কাউকে ‘না’ করছে না। শেষে প্রায় টেনে নিয়ে গাড়িতে তুলতে হল। রাত বাড়ছে। ঘরে ফিরতে তো হবেই।
কিন্তু ঘরে ফিরেও কি নিস্তার আছে? মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতে করতেই দেখলাম আমার বিছানায় বসে বালিশে হেলান দিয়ে আরেকটা ভিডিও ইন্টারভিউ-এ ঢুকে পড়েছে মেয়ে। ইন্টারভিউ যা-তা রকমের দীর্ঘ। এতক্ষণ মোবাইল ক্যামেরা হাতের পাতায় স্থির ধরে আছে কী করে!
অর্পণ, অঙ্কিত, নিক্কি ওর আশেপাশেই। ফিসফিস করে কথা বলছে যাতে নওদীপ –এর সমস্যা না হয়। রাতের খাবার বিষয়ে আমাকে হেল্প করতে করতে আমাদের কলকাতার তরুণ বন্ধু অয়নও দেখি অঙ্কিতের সঙ্গে দিব্যি গল্প জুড়ে দিয়েছে। পর দিন সকালে ওর অঙ্ক পরীক্ষা বোঝাই যাচ্ছে না।
আমি আর অয়ন কেউই রাতের খাবার বানাচ্ছি না মোটেও। টুকিটাকি দু’তিনটে জিনিস কিনে আনালাম ওকে দিয়ে। ভাত ফুটিয়ে নিলাম। আমাদের গৃহকর্মী অঞ্জনাদি সবকিছু রান্না করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে গেছেন। তাঁরই পরিকল্পনা মাফিক বাজার করে দিয়েছি। এখন ফ্রিজ থেকে বের করে সব গরম করার পালা।
নওদীপ এখনও ইন্টারভিউ দিয়েই যাচ্ছে। প্লেটে এখনও ওর মিষ্টিগুলো পড়ে। ‘সাথী’রা (সহযোদ্ধাদের এই সম্বোধন) কেউ বিরক্ত হচ্ছে না। নওদীপ-এর এই এনগেজমেন্টে ওরা অভ্যস্ত বোঝা যাচ্ছে।
‘চা বানাই?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করতেই সবাই এক কথায় রাজি। অয়ন আবার হেল্প করতে লেগে গেল। কিছুক্ষণ পর দুধ-চা, চিনিবিহীন চা ইত্যাদি বানিয়ে ঘরে এসে দেখি অঙ্কন, অর্পণ এবং নওদীপ ঘুমিয়ে পড়েছে। এতটুকু জায়গার মধ্যে প্রায় কুণ্ডলি পাকিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে নওদীপ। ঘুমোক। এ ঘরের আলো বন্ধ করে আমি, অয়ন ও নিক্কি অন্য ঘরে চা সহযোগে আড্ডা জমালাম।
ওরা চারজনেই দিল্লির চলমান কৃষক আন্দোলনে প্রথম থেকে যোগ দিয়েছে। অভিজ্ঞতার ঝুলিও ভরে উঠেছে। নিক্কি ও অয়ন মুজফ্ফরনগর দাঙ্গা, রাকেশ টিকাইত, কৃষক আন্দোলন, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, কলকাতার ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদি আলোচনায় মশগুল। আড্ডা একটা বিষয়ে বেশিক্ষণ থাকছে না।
‘প্রথম থেকেই কৃষক আন্দোলনে অনেক মেয়ে ছিল?’, আমি জানতে চাই।
‘অনেক মেয়েই ছিল। ২৬ জানুয়ারির পরে পরেও অনেকে ছিল। এখন জান তো আন্দোলন স্থলে মেয়েরা একেবারেই কমে গেছে।’, নিক্কি জানায়।
‘কেন বল তো?’
‘বলা মুশকিল। তবে নিজের নিজের ঘরে মেয়েদের অনেক কাজ থাকেই। রান্নাবান্না শুধু নয়, কৃষি সংক্রান্ত প্রচুর কাজ মেয়েরা করে। কিন্তু দেখ, কৃষক মানেই পুরুষ মনে করে সবাই। এটা ঠিক নয়।’
‘কৃষির আদিম ধারণাটা মেয়েদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল।’
‘হ্যাঁ। কিন্তু কৃষক মানেই পুরুষ- এই ধারণা এখনও বদলায়নি।’
‘তোমরা প্রথম থেকেই কৃষি আন্দোলনে আছো, বাথরুমের বিষয়ে কী ব্যবস্থা?’
‘প্রথমে আমরা মেয়েরা আশেপাশের বাড়ির বাথরুমে যেতাম। প্রথম দিকে গ্রাউন্ডের মাঝখানে ছাড়া কোথাও বাথরুম ছিল না। এখন অনেক ব্যবস্থা হয়েছে। তো প্রথমে দেখতাম সব বাথরুম ছেলেরা ব্যবহার করছে। পরে মেয়েদের জন্য একটা বাথরুম নির্দিষ্ট করি আমরা। কিন্তু দেখা যায় মেয়েরা গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে তবু বাথরুম খালি হচ্ছে না। তখন আমরা একটা ব্যবস্থা নিলাম। আমরা বললাম যে, তোমরাও ব্যবহার কর ঠিক আছে। কিন্তু মেয়েরা এলেই মেয়েদের বাথরুমটা ছেড়ে দিতে হবে।’
‘মেনে নিল?’
‘হ্যাঁ, মানল। তবে সে অনেক টুকিটাকি গল্প…’
এরই মধ্যে পাশের ঘর থেকে উঠে এসেছে অঙ্কিত আর অর্পণ। নওদীপ তখনও অঘোর ঘুমে। ওদের চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম করে দিতে চাইলাম। অঙ্কিত আপত্তি জানিয়ে নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে গরম করে আনলো।
‘আমাদের সমাজে ‘মেয়েদের কাজ’, ‘ছেলেদের কাজ’ অদ্ভুতভাবে ভাগাভাগি করা হয়। এই বিষয়টা আন্দোলনের জায়গাতেও কি থেকে গেছে?’
অর্পণ জানায়, ‘ভীষণভাবে ছিল। জান, আন্দোলনের প্রথম দিকে আমরা যে ক’জন মেয়ে ওখানে যোগ দিয়েছিলাম আমাদের বেশ্যা ভাবা হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল আমরা ছেলেদের ভুলিয়ে ভালিয়ে আন্দোলন বানচাল করতে গিয়েছি। ওরা ভেবেছিল স্টেট থেকে আমাদের পাঠানো হয়েছে আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার জন্য। তবে এটাও ঠিক যে কিছু মেয়েকে পাঠানোও হয়েছিল। ওই মেয়েরা খুঁজে খুঁজে একা ছেলেদের প্রভাবিত করতে চায়তো।’
‘তোমাদের বিষয়ে এই ধারণা বদলালো?’
‘হ্যাঁ, এখন সবাই বুঝেছে।’
‘কী ভাবে?’
‘আমাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে, আমাদের কাজকর্ম দেখতে দেখতে বুঝে গেছে।’
‘ব্যাপারটা খুব মজার না? সেই যে ভারতীয় মিথে অপ্সরাদের পাঠানো হত ধ্যানরত ঋষিদের ধ্যান ভাঙাতে? এখনও কিন্তু সেই স্টিরিওটাইপটা থেকেই গেছে। রাষ্ট্রও সেটা কাজে লাগাচ্ছে। মানে ভাল করে ভেবে দেখ মেয়েদের যৌনতা নিয়ে রাষ্ট্র থেকে সাধারণ মানুষ সবাই খুব ঘাবড়ে থাকে বা ব্যবহার করতে চায়। মানে স্টেটের রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠছে যৌনতা।’, আমার কথায় সবাই হেসে ওঠে।
‘আর যেটা বলছিলে’, অর্পণ শুরু করে, ‘প্রথম দিকে ছেলেরা কিছুতেই বাসন মাজতে চায়তো না, রান্নার কাজেও হাত লাগাতে চায়তো না। আমরা ঠিক করি যে সবাইকেই সব কাজ করতে হবে। যার যেটা অপছন্দ তাকে সেই কাজটাই বেশি বেশি করে করতে দেওয়া শুরু হল। এখন ছেলেমেয়ে সবাই মিলেমিশে কাজ করে। আরে আন্দোলন মানে তো শুধু আন্দোলন নয়, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটাও তো তার মধ্যে পড়ে। পাঁচ’ছ জনের রান্না করতে গেলেও কত খাটনি হয় রান্না যে করেনি সে বুঝবে কী করে?’
অঙ্কিতের কাছে জানতে চাই, ‘তোমাকে দেখছি বাসন ধুয়ে নিলে, গ্যাস জ্বালিয়ে চা-ও গরম করে নিলে। বাড়ি থেকেই এগুলো শিখেছিলে?’
লাজুক হাসে অঙ্কিত, ‘না না। আমার মা কারখানায় কাজ করে। বড় বোনের যখন বিয়ে হয়ে গেল তখন বাধ্য হয়ে বাড়ির অনেক কাজ করতে হত। কিন্তু যখন প্রথম পড়াশোনা করতে গিয়ে শিক্ষার্থী কমিউনে থাকতে শুরু করি দেখি কি মেয়েরা বসে আছে আর ছেলেরা রান্নাবান্না করছে, বাসন মাজছে। খুব অবাক লাগতো। ব্যাপারটা নিতেই পারতাম না। কিন্তু ধীরে ধীরে এটাকে আমি আয়ত্ব করি। এখন ওই মানসিক বাধা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয়।’
কখন মধ্যরাত পার হয়ে গেছে আর নিক্কির মোবাইলে একের পর এক ফোন কল। টুকরো কথা থেকে বোঝা গেল ওর জন্মদিন। ফাঁক পেতেই আমরা সবাই ওকে শুভেচ্ছা জানালাম।
ফিরে গেলাম কথায়। যদিও সবাই একই কথায় যোগ দিচ্ছে তা নয়। অদিকে দু’জন, এদিকে তিনজনের আলাদা আলাদা কথার বৃত্ত তৈরি হচ্ছে। ওভারল্যাপ করে যাচ্ছে কখনও। কখনও বিচ্ছিন্ন।
‘কৃষক আন্দোলনে তোমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা কী রকম?’
নিক্কি জানালো, ‘খাওয়ার অঢেল ব্যবস্থা। খাপ পঞ্চায়েত থেকে খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে। আর জানো, একেক জায়গায় একেক রকম খাবার। একটা তাবুর খাবার পছন্দ না হলে তুমি আরেকটায় গিয়ে পছন্দের খাবার ঠিকই পেয়ে যাবে। এমনকি পিৎজ্জারও স্টল আছে। সঙ্গে সঙ্গে বানিয়ে গরম গরম দিয়ে দেবে।’
গণ আন্দোলনে খাপ পঞ্চায়েত শুনে খানিক চমকেই উঠলাম। মাঝে মাঝেই খাপ পঞ্চায়েত বিষয়ে যে সব খবর পাই ভীষণভাবে নারী বিদ্বেষী, জাতপাত লালন করে আর সভ্যতার পরিপন্থী মনে হয়। তবে সাম্প্রতিক দুএকটা লেখার কথা আবছা মনে পড়লো যেখানে কৃষক আন্দোলনে খাপ পঞ্চায়েতের ভূমিকা, তার ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে লেখা হয়েছে।
‘তুমি ঠিকই বলেছ’, অর্পণ বলে। ‘প্রথম দিকে মেয়েরা এই আন্দোলনে কেন এসেছি, মেয়েরা তো জমির মালিক নয়-এইসব বলেছিল। অসম্ভব জাতপাত বিদ্বেষও আছে। কিন্তু কি জান তো, খাপ পঞ্চায়েত আর এর সদস্যরা কোনও না কোনভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। কৃষি বিলের প্রতিবাদ তাই ওরা করবেই। আর যদি এইসব পিছিয়ে পড়া বিষয়গুলোকে সরিয়ে ভাবি তো এই কৃষি আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে খাপ পঞ্চায়েতের বিশাল ভূমিকা।’
খাপ পঞ্চায়েত প্রেম, বিয়ে, জাতপাত, নারী বিষয়ক অবস্থান থেকে সরে খানিক অন্য ধারণায় উপনীত হবে কিনা আড্ডা আর সেদিকে গড়ায় না। নওদীপ ঘুম থেকে উঠে আমাদের মাঝে এসে বসে। ওকে নিয়ে ‘সাথী’রা রসিকতা করতে থাকে, ‘হামারে নওদীপ সেলিব্রিটি বন গ্যায়ি।’
সবাই মিলে হো হো হেসে ওঠে। নওদীপ–এর হাসিতে মিশে থাকে লাজুক আভা।
রাতের খাবার এখনও খাওয়া হয়নি। ওর জন্যই সবাই অপেক্ষা করছিলাম। ও ফ্রেশ হতে হতে সব খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে দিলাম। যে যার নিজের থালায় খাবার নিয়ে খাওয়া শুরু হল।
‘এত রোগা তুমি। ভাল করে খাও। আন্দোলনের তাকত্ বাড়াতে হবে তো!’, নওদীপকে বলি। হাসে মেয়ে। আরও ভাত বা রুটি দিতে চাই। নেবে না। এইটুকু মাত্র খাচ্ছে।
কেমন আনমনা হয়ে যায় নওদীপ। চিকেনের ঝোলে ভাত মাখতে মাখতে বলে,
‘জেল মে শুখা রোটি মিলতা থা।’
আমি ওই অঞ্চলে ঢুকতে সাহস করি না। দেড় মাস জেলের মধ্যে শুকনো রুটির সঙ্গে কী খেয়েছে মেয়ে, ঘাঁটাই না আর।
‘জান, ট্রাক্টর র্যালির সময় ট্রাক্টর ভর্তি মাস খানেকের খাবার মজুত ছিল। গ্রাম থেকে খাবার উপকরণ নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে এত খাবার আসতে লাগলো যে সেসব খোলারই দরকার হল না। আর কত যে শুকনো ফল। আমরা কিছুতেই নেব না। অত ফল কী করবো! কিন্তু জোর করে কেজি কেজি ফল হাতে ধরিয়ে দেয়।’, নিক্কি হাসে।
অর্পণ যোগ করে, ‘শেষে আমাদের ওড়নায় বেঁধে নিজেদের তাবুতে নিয়ে আসতে হয়েছিল। বলে কিনা, ‘খাও, না হলে আন্দোলন কী করে জোস পাবে?’’
নিক্কি দেখি ডাল-সব্জি দিয়ে ভাত-রুটি খাচ্ছে। অর্পণের মাংস কম, মাছ বেশি পছন্দ। অঙ্কিত সবই খেল। নওদীপও খুব কম করে হলেও সবকিছুই নিল। খাওয়া শেষ করে নওদীপের মনে পড়লো কিছু।
‘মেরি রসগুল্লা!’, মজার মুখ করে জানতে চায়লো। ওর মুখের ভঙ্গি দেখে সবাই হাসছে।
‘রাখা আছে তোমার জন্য।’, আমি বাটিতে করে দুটো রসগোল্লা দিই।
একটা খেয়ে আরেকটা সে রেখে দেয়।
খাওয়া শেষে আমাকে বিশেষ কিছুই করতে হয় না। ওরা সবাই মিলে বাসন মাজামাজি পর্ব শেষ করে ফেলে। নওদীপ ঘরে এসে বইপত্র দেখতে থাকে। গঁগা-র ‘হেল মেরি’ এবং ‘ল্যান্ডস্কেপ উইথ পিকক’ দু’পাতায় ছবি দুটো খোলা একটা বই হাতে নিয়ে ভাল করে দেখে মেয়ে যেটা আমি সাজিয়ে রেখেছি বই-পড়া স্ট্যান্ডের ওপর। পাতা উল্টে উল্টে গঁগার তাহিতি দ্বীপের জীবনের ভেতর দিয়ে যেন হাঁটতে থাকে মেয়ে, বুঝি ছবির ভেতর লেগে থাকে তারও দলিত-শ্রমিক-মেয়ে জীবনের দ্রোহকাল। বইটা সে যথাস্থানে রেখে দেয়।
কয়েকটা ছবি তুলি। অপছন্দ হওয়া ছবিগুলো ডিলিট করে দেয় নওদীপ। আমরা দুজনে খুনসুটি করতে করতে একটা বালিশে শুয়ে পড়ি। আমাদের সেলফি তোলে নওদীপ। ছবিগুলো বার বার দেখে।
‘এহ্! আজ যেন কেমন একটা লাগছে নিজেকে! ছবি ভাল আসছে না।’
‘তুমি খুব সুন্দর।’, বলি আমি।
হাসে মেয়ে।
‘তোমার ক্লান্ত লাগছে না? এত ইন্টারভিউ, এত ছোটাছুটি, এত বক্তৃতা, মিছিল…’
‘লাগে বটে। কিন্তু হঠাৎ করে ব্যাপারটা এরকম…… আমাদের সংগঠনের ভাল হবে ভেবে, গণ-আন্দোলনের ভাল হবে ভেবে করি।’
সাহিত্য উৎসবের মঞ্চে বক্তব্য, অনেক লেখা, ইন্টারভিউ-এ মেয়ের রাজনৈতিক অবস্থান সবারই জানা হয়ে গেছে। ওর চোখে-মুখে ফুটে ওঠা ক্লান্তি আমাকে চুপ করিয়ে রাখে। এতক্ষণে আমার সঙ্গে খানিক আলাদা করে কথা বলার ফুরসৎ পেয়েছে মেয়ে।
‘তোমার ঘরে কত গাছপালা!’, বলে নওদীপ।
‘না গো, মাত্র গুটিকয় এসে পৌঁছেছে এখানে। নতুন করে সব শুরু করতে হচ্ছে। বেশিরভাগই মরে গেছে।’
‘তবুও আমার মনে হচ্ছে কত গাছ!’
‘তাহলে আমাকেও কৃষক বলতে পারো।’, মজা করি আমি।
নওদীপের হাসিতে লেগে থাকে সেই মজার রেস। আমাদের সংগ্রহ করা বা নিজের হাতে বানানো খুব ছোট ছোট কিছু নান্দনিক জিনিস উপভোগ করে আর উল্লেখও করে সেগুলো। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি খুব ছোট বিষয়ও ওর অনুভূতিদেশে ধরা পড়ে।
এর মধ্যে সবাই মিলে ছবি তোলা পর্ব শুরু হল। ও ঘর থেকে এসে পড়ে সবাই। কিন্তু অর্পণ কই? ওকে আপাতত পাওয়া যাবে না। বেচারি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ওকে ছাড়াই…
কিছুক্ষণ পর।
ঘুমিয়ে পড়লো নওদীপ-ও। ফলে এ ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে আড্ডা শুরু হল। অর্পণ ইতিমধ্যেই উঠে পড়েছে। চা পানের প্রস্তাবে সবাই রাজি। রাত সাড়ে তিনটেয় চা আর মুড়ি মাখা নিয়ে বসলাম সবাই। নিক্কির পড়াশোনার বিষয় মিউজিক। গান সবাই জানে। কিন্তু কাউকেই গান করার অনুরোধ কেউই করিনি। নিক্কি নিজেই অনুচ্চ স্বরে গান ধরে। অয়নও। দুজনে একসঙ্গে গলা মেলায়। প্রতিবেশীরা গভীর ঘুমে সে আর বলে দিতে হয় না। এবার সংগ্রামের সুর নয়, প্রেম। নিক্কি শুরু করে, ‘আপকি নজ্রোঁ মে সামঝা প্যার কি কাবিল…’
ফ্রেমের কম্পোজিশন ঠিক করে নিয়ে ভিডিও রেকর্ড করতে থাকি।
যতই ট্রেনের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সময় এগিয়ে আসতে থাকে ততই একজন একজন করে ঘুমের মধ্যে চলে যেতে থাকে। আমি আর অয়ন একেকজনকে ঘুম ভাঙিয়ে রেডি হওয়ার কথা বলতে থাকি। এত ক্লান্তির ভেতর বিছানা ছেড়ে ওঠা সহজ হয় না। একেবারে বেরনোর মুখে দেখি অয়নও ঘুমিয়ে পড়েছে।
‘তোমরা যদি সত্যিই দিল্লি ফিরতে চাও এবার রেডি হতেই হবে। ট্রেন মিস হলে প্রচুর ঝক্কি। না হলে চলো নওদীপকে সমুদ্র দেখিয়ে আনি।’, আমি বলি।
নওদীপ একবার বলে, ‘পরে ট্রেন নেই?’
‘আছে তো। কিন্তু রিজার্ভেশন?’
অগত্যা রেডি হয় সবাই। রেডি হওয়ার পরেও আমার ঘরের দেয়ালে টাঙানো মুর্শিদাবাদের কৃষকের বাঁশের টুপি (মাথল) নিয়ে ফটোসেশন চলতে থাকে। আবার সবাই মিলে ছবি তোলা শুরু হয়। এর মধ্যেই ক্যাব এসে যায়। হাওড়ার উদ্দেশে রওনা দিই সবাই।
ট্রেন আসতে অনেক দেরি। এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব ভাবিনি। নওদীপ প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে গুছিয়ে বসে পড়ে।
‘জান তো, আমরা দিল্লির কৃষক আন্দোলনের ভূমিতে নতুন এক পৃথিবী পেয়েছি। প্রথম দিকে খানিকটা সমস্যা থাকলেও এখন যে কোনও মেয়ে গভীর রাতেই হোক বা দিনে যখন ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পারে। আন্দোলন শেষ হয়ে গেলে সবাইকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। আবার সেই আগের পৃথিবী। দুঃখ হয়।’
‘কাস্, পুরা দেশ অ্যাইসাই হো যাতা।’
কলকাতার মাটিতে আগামি ভারতবর্ষের এই স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে দিতে ওদের ট্রেন দিল্লির দিকে ছুটে চলে।
সঙ্গে আছি।
খুব ভালো লাগল। ছবিগুলোও।
হুঁ খুব ভালো।
টেরিফিক, থ্যাঙ্ক ইউ।
খুব ভালো লেখা।
খুব সুন্দর হয়েছে ।
এসব অনেক কে পড়াতে হবে। লাল সেলাম কমরেড।
ভাল লাগলো...
খুব ভালো লিখেছো...পড়তে পড়তে হারিয়ে গেছিলাম। সেলাম জানাই বাঘিনীদের।
স্যলিউট, কমরেড !
সঙ্গে আছি।
অত্যন্ত উপভোগ্য।