আইএসএফ পশ্চিমবঙ্গের ভোটে অংশ নিচ্ছে। মুসলিম মেয়েদের কোনও উপকার হবে?
খুবই সহজ উত্তর। আমাদের এই সমাজে মুসলিম নেতা হিসেবে সেজে এসে যদি কেউ বলে যে মুসলিমদের উন্নয়ন করবো, কিম্বা দলিত নেতা এসে যদি বলে দলিতদের আলাদা করে উন্নয়ন করবো, কেউ যদি বলে শিডিউল কাস্ট-শিডিউল ট্রাইবদের আলাদা করে উন্নয়ন করবো – এভাবে বিভাজন করে এইসব সেকশনের উন্নয়ন বাস্তবে কোনও মতেই সম্ভব নয়।
কেন?
কারণ, এক্ষেত্রে প্রথম মুসলিম পার্সোনাল ল পাল্টাতে হবে। সেটা পারবে আইএসএফ? মুসলিম নারীদের নিয়েই আমাদের কাজ। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার এতদিন পরও যদি মুর্শিদাবাদ জেলা দেখি… এই একটা জেলা দিয়েই পুরো ভারতবর্ষ বিচার করা যায়… মুসলিমদের উন্নয়নের প্রথম ধাপ হচ্ছে শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতা… শিক্ষা মানে শুধু অ্যাকাডেমিক শিক্ষা নয়, চিন্তা-চেতনায় মুসলিমরা বিশেষ করে মেয়েরা যাতে এগিয়ে আসতে পারে তেমন করে শিক্ষা… আমরা গ্রামে গ্রামে দেখছি আজও ৭২% বাল্যবিবাহ চলছে। তার মধ্যে সংখ্যায় বেশি মুসলিমরা। বারো, তেরো, চৌদ্দ বছরে যদি মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় তাহলে তার উন্নতি কী ভাবে সম্ভব? বাল্যবিবাহ তো নিষিদ্ধ। তাহলে হচ্ছে কেন?
আর তালাক?
তালাক বিল পাস হয়ে গেল। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে তালাক নিষিদ্ধ। আমি কাজ করছি তালাক-প্রাপ্ত মেয়েদের নিয়ে। সেখানে আজও আমরা দেখতে পাচ্ছি, ব্যাপক হারে গ্রামে গঞ্জে এখন বরেরা তালাকনামা বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। একতরফা তালাক হয়ে যাচ্ছে।
এই যে তালাকনামাটা, এটা কি কোর্টের মাধ্যমে হচ্ছে?
না না, ভারতীয় আইন অনুযায়ী এই তালাকনামার কোনও কার্যকারিতা নেই। কোনও উকিলকে দিয়ে লিখিত বয়ান লিখিয়ে তালাকনামাটা পাঠিয়ে দেয়। দেখে মনে হবে নিয়ম মান্য করে তালাক পাঠাচ্ছে। কিন্তু এটা তালাক দেওয়ার পদ্ধতি নয়। তালাক বা বিচ্ছেদ দিতে গেলে তার বহু মেজারস্ আছে সেগুলো গ্রহণ করতে হয়, অনেকগুলো পদ্ধতি পার হতে হয়। ফলে ভারতীয় সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী তালাক হচ্ছে না। ‘তালাক’ একটা আরবি শব্দ। মানে রিজেক্ট, বয়কট। মানে একটা তালাকনামা পাঠিয়ে স্ত্রীকে বয়কট করা হল। এটা হিন্দুদের হচ্ছে না, হচ্ছে মুসলিমদের। মুখের কথায় তালাক ধর্মে, হাদিসে, কোরাণে কোথাও লেখা নেই। কিন্তু বাস্তবে তাই হচ্ছে। এটা কেউ জানেই না প্রদীপের তলায় অন্ধকার। মেয়েরা শুধু ধর্মীয় কারণে কত নির্যাতনের শিকার। সতীদাহ প্রথায় আমরা দেখেছি মেয়েদের জ্যান্ত পুড়ে যেতে। আর মুসলিম মেয়েদের তালাক দিয়ে, ঘর থেকে বের করে দিয়ে সন্তানসহ মেয়েদের পথের ভিখিরি করে দিচ্ছে। খাদ্যহীন, আশ্রয়হীন এইসব মেয়েদের বুকের যন্ত্রণা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
মুর্শিদাবাদ জেলার কোন অঞ্চলে সব থেকে বেশি তালাক হচ্ছে?
সব থেকে বেশি তালাক হচ্ছে ডোমকলের সারাংপুর অঞ্চলে। এই অঞ্চলের শ্রীপতিপুর গ্রামেই ষাট জন তালাক প্রাপ্ত নারী আছেন। এছাড়া হরিহরপাড়া অঞ্চলের অনেক গ্রামেও আছেন। গ্রামে গ্রামে ঢুকলে আমরা দেখতে পাই তালাক প্রাপ্ত মেয়েদের কি করুণ অবস্থা! আইএসএফ পার্টি যদি মুসলিম মেয়েদের উন্নয়ন করতে চায় তাহলে তো আগে তালাক বন্ধ করতে হবে।
‘নিকাহ-হালালা’ রীতি বিষয়ে যদি একটু আলোকপাত করেন…
রীতিটা সত্যি খুব জঘন্য। সেটা কী? স্বামী যদি ভুল করে ‘তালাক’ বলে দিয়ে অনুতপ্ত হয়ে স্ত্রীকে আবার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে চান তা আর পারবেন না। স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে এই নতুন স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন হওয়ার পর এই স্বামী যদি তালাক দেন তবেই আগের স্বামী স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবেন। এটা মুসলিম পার্সোনাল ল- এর আওতায় সিদ্ধ হয়ে আছে।
আর বহুবিবাহ?
মুসলিম পার্সোনাল ল- অনুযায়ী বহুবিবাহ আইন সিদ্ধ অর্থাৎ একজন স্বামী চারজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন। গ্রামে গঞ্জে ব্যাপক হারে হচ্ছে। স্বামীরা অন্য রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে বউ থাকতে আবার বিয়ে করে নিচ্ছে। এসব মেয়েদের চোখের জল আর ব্যথা-বেদনা দেখতে দেখতে আমরা পাগল হয়ে গেলাম। বহুবিবাহ বন্ধ করতে গেলে হাদিসের বিরুদ্ধে যেতে হবে। যদিও হাদিসে এমন করে কোথাও লেখা নেই। কিন্তু আমাদের দেশে মুসলিম পার্সোনাল ল এটাকে কার্যকর করে দিয়েছে।
মুসলিম মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার বিষয়টা ঠিক কেমন?
যে সব মেয়েরা বিধবা হয় তার শ্বশুর-শাশুড়ি যদি জীবিত থাকে তাহলে সেই বিধবার সন্তানরা সম্পত্তির কোনও অধিকার পায় না। এটা ভারতীয় মুসলিম পার্সোনাল ল- এর আইন। ফলে বিধবার সন্তানরা বাবাকে হারায় এবং আশ্রয়হীন হয়। পিতার বাড়িতে নিজের বাড়ি ভেবে সে থেকেছে। পিতা মারা গেলে পিতার বাবা অর্থাৎ দাদো যদি বেঁচে থাকে তাহলে পিতার সম্পত্তিতে তার কোনও অধিকার থাকছে না। এই আইন ভারতীয় আর কোনও ধর্মে নেই। অন্যদিকে মুসলিম আইনে পিতার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষ সম-অধিকার নেই। বেশিরভাগ সম্পত্তি ছেলেরা পায়। মেয়েরা কিন্তু তা পায় না। নিঃসন্তান নারী তার স্বামীর সম্পত্তির পুরো ভাগ পায় না। শুধু যদি কন্যা সন্তান থাকে সে পিতা-মাতার সম্পত্তির সম্পূর্ণ অধিকার পায় না, এক্ষেত্রে সম্পত্তি ভাগ বাঁটোয়ারা হয় আত্মীয়দের মধ্যে। অর্থাৎ সম্পত্তিতে সম-অধিকার হিন্দু নারী-পুরুষের থাকলেও মুসলিম মেয়েদের নাই।
বিধবা মেয়ে ও তার সন্তানদের সব পরিবারই কি তাড়িয়ে দেয় নাকি কেউ কেউ আশ্রয়ও দেয়?
এটা পরিবার বিশেষে একেক রকম। এক্ষেত্রে বিধবা বা তার সন্তানদের আইনি অধিকার তো নেই। ব্যতিক্রমী কয়েকটা ক্ষেত্রে দেখেছি এদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে একেবারেই মানবিক কারণে। এই বিষয়টা নিয়ে আমরা হাইকোর্টে মামলা করতে যাচ্ছি। বাঁকুড়ার ঘটনা। বর মারা যাওয়ার পর পরিবারের গোয়াল ঘরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাটাতে বাধ্য হয়েছে স্ত্রী। সমস্ত সম্পত্তি পেয়েছে মৃত বরের ভায়েরা। তো ওই বিধবা স্ত্রীর বড় ছেলে যে ওই গোয়াল ঘরে বড় হয়েছে সে আজ বড় হয়ে বলছে, ‘এরকম অমানবিক আইন ভারতবর্ষে কেন থাকবে?’ সে স্বতঃস্ফুর্ত এগিয়ে এসেছে মামলা করার জন্য। আমরা আছি ওর পাশে। কিন্তু লকডাউনের জন্য পুরো বিষয়টা পিছিয়ে গেছে। এটা একটা ঘটনা নয়, গ্রামে গ্রামে এরকম হচ্ছে।
দত্তক সন্তানের ক্ষেত্রে মুসলিম আইন কী বলে?
নিঃসন্তান দম্পতি দত্তক নিতে চায়লে তার কোনও আইনি অধিকার নেই। দত্তক সন্তান বাবা-মায়ের সম্পত্তির অধিকার আইন অনুযায়ী পাবে না। এটাও মুসলিম পার্সোনাল ল দ্বারা পরিচালিত।
এতকিছু যখন আইনসিদ্ধ হয়ে আছে তাহলে মুসলিম মেয়েদের উন্নতি কীভাবে সম্ভব?
ভারতীয় সংবিধানে যেসব আইন অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে আছে সেইসব অধিকার মুসলিম মেয়েদের ক্ষেত্রে নাই। আমরা লড়ছি যাতে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে নারী-পুরুষ সমান অধিকার পেতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভারত সরকার মুসলিম মেয়েদের সমান অধিকার দিতে পারেনি।
মুসলিম মেয়েদের উন্নতির মূল চাবিকাঠি কোথায় বলে আপনি মনে করেন?
শিক্ষা আর স্বনির্ভরতা। এই দুটো বিষয় মেয়েদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়। আমি যদি মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল অঞ্চলের কথা ধরি… যেখানে অষ্টাশি শতাংশ মুসলিম… কজন মুসলমান মেয়ে এখানকার গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষকতা করে? কিম্বা হসপিটালে চাকরি করে? কিম্বা কোর্টে ওকালতি করে? কিম্বা এসডিও-বিডিও অফিসে চাকরি করে? এত মেজরিটি থাকা সত্বেও শুধু ডোমকল না, পুরো মুর্শিদাবাদ জেলায় যেখানে ৭৩% মুসলিম সেখানেও চাকরির ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি মেজরিটি কিন্তু হিন্দুরা, মুসলিমরা নন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এটা দেখছি। মেয়েরা তো আরও পিছনে, অ-নে-ক পিছনে। দু’একজন মেয়ে ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে।
তালাক বা বহুবিবাহ-র যে অবস্থা আপনি তুলে ধরলেন তার ব্যতিক্রম আছে?
হ্যাঁ। শিক্ষিত পরিবারে এগুলো অনেক কম। শিক্ষার আলো আছে বলেই হয়তো। কিন্তু সম্পত্তির অধিকার প্রশ্নে শিক্ষিত পরিবারগুলোও একই অবস্থান নেয়, মেয়েদের কোনও অধিকার থাকে না।
আপনারা কী ভাবে মেয়েদের পাশে দাঁড়ান?
নানান রকম ওয়ার্কশপ করাই, শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতার। বেশিরভাগই ভীষণ দরিদ্র মেয়ে। নির্যাতিতা মেয়েদের বিনা পারিশ্রমিকে আইনি পরামর্শও আমরা দিই। তাদের বাচ্চাদের শিক্ষার খরচ চাঁদা তুলে চালাই। এই লকডাউনে মেয়েদের খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল। আমরা পাশে দাঁড়িয়েছি। তিন তালাক নিয়ে আমরা দীর্ঘ আন্দোলন করছি। কিন্তু যেখানে আইনই নেই সেখানে সবটাই খুব সমস্যার হয়ে দাঁড়ায়। তবু আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ভারতীয় সব নাগরিকের জন্য এক আইন হওয়া সম্ভব?
‘নানা ভাষা নানা মত, নানা পরিধান/ বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’। ভারতবর্ষে এত জাতি, এত পোশাক, এত ভাষা; তাদের খাদ্য আলাদা- এই ভারতবর্ষকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক করে দিতে চেয়েছিলেন। মহান মনীষীরাও এক করে দিতে চেয়েছিলেন। সকলেই আমরা দেশের মানুষ, ভারতীয়। আমরা একই আইন নিয়ে চলবো। কিন্তু সেটা তো বাস্তবে দেখছি না। আমাদের কাঠামোর মধ্যেই এত দুর্নীতি এক আইনের পক্ষে কোনও রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয় না। ফলে কোনও পার্টি কোনও নির্দিষ্ট জনতার জন্য আলাদা করে উন্নয়ন করতে পারবে না। আইএসএফ পার্টিও না। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এই আইনগুলো পরিচালনা করছে মুসলমান ধর্ম রক্ষা করার নামে। ফলে ধর্মের নামে মুসলিম নারীরা বহুগুণ বেশি নির্যাতিত হচ্ছে।
আসন্ন নির্বাচনে সিপিএম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
একটা বামপন্থী দল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বামপন্থার ইমেজটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। অর্থাৎ বামপন্থার প্রতি মানুষের যে আবেগ ছিল, শ্রদ্ধা-ভালবাসা ছিল সেটাকে নষ্ট করেছে। একটা মুসলিম মৌলবাদী শক্তি, যারা মিমের সঙ্গে একাধিক বার মিটিং করেছে তাদের পার্টনার আইএসএফ, এদের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত যে গড়ে তুললো এর বিষময় ফল যেটা দাঁড়াবে… বিজেপি একটা সাম্প্রদায়িক দল, তারা গোটা দেশে যেভাবে প্রভাব বিস্তার করছে… আজ যদি সিপিএম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট মুসলিম মৌলবাদী শক্তির পক্ষে যায় তাহলে হিন্দু মন রাগ-দুঃখ থেকে বিজেপি-র শক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে। আমরা চাই সেকুলার দেশ অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ফলে বিজেপি-র মতোই এই জোটও ভয়ঙ্কর ক্ষতি করবে সাধারণ মানুষের।
খুবই দামী লেখা।
'এক্ষেত্রে প্রথম মুসলিম পার্সোনাল ল পাল্টাতে হবে' - এই আইন বদলানোর চেষ্টা হচ্ছে কিনা, হলে কিভাবে সেই প্রয়াস চলছে , এ নিয়ে লিখলে ভাল লাগবে
এসব কন্ঠস্বর পাবলিক স্পেসে জায়গা পায় না। গুরুকে ধন্যবাদ এই ইন্টারভিউ প্রকাশের জন্য।
ইউনিফর্ম সিভিল কোড হওয়া দরকার
মানে হিন্দু সিভিল অ্যাক্ট এবং মুসলিম অ্যাক্ট তুলে দিয়ে একটাই আইন? কঠিন, কারণ তাতে বিয়ের নিয়মও আছে। সপ্তপদী ও নিকাহনামা একসঙ্গে তুলে দেয়া?
এই কথাগুলো উঠে আসুক আরও বেশি করে।
Uniform civil code চাই । কিন্তু সব ধর্মর ভাল
টুকু নিয়ে সেটা তৈরি হোক। বিয়ে শুধু রেজিস্ট্রি করে হোক না।
শেষ paragraph টাই আসল কথা। যেখানে তৃণমূলের সাথে থাকা সিদ্দিকুল প্রগতিশীল কিন্তু isf যেহেতু জোটে গেছে তাই প্রগতিশীল নয়