বিজেপি তো এই সেদিন এল, তামিলনাড়ুতে কোনওদিনই কোনও সর্বভারতীয় পার্টির জায়গা ছিল না। কংগ্রেস ১৯৫২, ৫৭ ও ৬২-র ভোটে জিতেছে বটে, কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে তামিলনাড়ুতে সম্ভবত তাদের ভোট শতাংশের পরিমাণ সবচেয়ে কম। ৬-এর দশকের পর থেকে তারা ক্ষমতা থেকে চ্যুত হয়েছে, তারপর থেকে তাদের অস্তিত্ব টিকে থেকেছে শুধু জোট করে।
এখন প্রশ্ন হল, বিজেপি তামিলনাড়ুতে অন্য রাজ্যের মত তা তা থৈ থৈ নেচে উঠতে পারল না কেন!
সাধারণভাবে তামিলদের দুর্নীতি নিয়ে তত সমস্যা নেই। জনতা জানে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল দুর্নীতিগ্রস্ত, এবং সে নিয়ে তাদের খুব কিছু যায় আসে না। এ ব্যাপারে কামাল হাসানের উদাহরণ উপযুক্ত হতে পারে। তিনি স্বচ্ছ রাজনীতির কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন বিকল্প রাজনীতির কথা। তিনি নিজে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন, তাঁর দল একটি আসনও পায়নি। তাঁদের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ২.৫ শতাংশ। এমনকী ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও একটি তৃতীয় ফ্রন্ট হয়েছিল, কিন্তু তামিল জনগণ দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে অন্য কোনও রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে তাঁরা ডিএমকে ও এআইডিএমকে-র পক্ষে প্রায় সমহারে ভোট দেন, যদিও শেষ পর্যন্ত জেতে এআইএডিএমকে। তামিলনাড়ুর ভোট এবং এখানে দ্রাবিড় দলগুলিই কেন শক্তিশালী তা বোঝার জন্য, সামান্য ইতিহাস, আলগোছে হলেও জেনে নেওয়া দরকার।
স্বাধীনতার পরেও তামিলনাড়ুতে মূল অক্ষ থেকে জাতপাত। তামিলনাড়ুতে কংগ্রেস ভাঙার পিছনেও সেই ইস্যুই কাজ করেছে। ই ভি রামস্বামীর কথা মনে করুন, যিনি পেরিয়ার নামে সমধিক পরিচিত। পেরিয়ার প্রাথমিক ভাবে ছিলেন কংগ্রেসি। দ্রাবিডর কাজাঘাম তিনি শুরু করেছিলেন কংগ্রেসের মধ্যেকার জাতিদ্বন্দ্বের পশ্চাৎভূমি থেকেই। পেরিয়ারই ডিকে, ডিএমকে ও এআইএডিএমকে-র মতাদর্শের নায়ক।
এরপর সময় আসে সি এন আন্নাদুরাইয়ের। তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জিতেছিলেন স্রেফ একটিই কারণে, পেরিয়ার নির্বাচনে কংগ্রেসকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ডিএমকে সম্পর্কে একটি কথা স্পষ্টই বলা যায়, যে এমনকি আন্নাদুরাইয়ের সময়েও, (যিনি ডিএমকের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম ডিএমকে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন) দল যে কলেবরে ও গুণমানে বর্ধিত হয়েছিল, তার কারণ ছিল এমজিআর-এর মুখ।
এম জি আর দল ভেঙে এআইডিএমকে প্রতিষ্ঠা করার পর করুণানিধি কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হন। তের বছর তিনি ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে ছিলেন। এমজিআর যখন মারা যান, তখন তিনি সত্তরোর্ধ্ব। করুণানিধি আয়ুতে এমজিআরকে হার মানিয়েছিলেন বটে, কিন্তু জয়ললিতার কাছে তিনি ক্রমাগত হারতে থাকেন। জয়ললিতার ভোট শতাংশ একমাত্র নেহরুর সঙ্গেই তুলনীয়।
এর কারণ খুব সহজ। প্রতিটি তামিল, গোপনে হলেও ঈশ্বরবিশ্বাসী, এবং ডিএমকে ও এআইডিএমকের রাজনীতিবিদরা ঈশ্বরভীরু।
সাধারণ ঈশ্বরবিশ্বাসী, মন্দিরগামী জনতা ডিএমকের ভগবানবিরোধী রাজনীতিকে মোটেই ভাল চোখে নেয়নি এবং সে কারণে তারা ডিএমকে কে কখনওই তেমন বিশ্বাস করেনি। ভোটের হার সে কথা প্রমাণ করে।
ডিএমকে যতবারই সরকার গঠন করেছে, সেগুলি জোট সরকার। এআইডিএমকে-র ক্ষেত্রে কিন্তু তেমন নয়। এ ছাড়াও সাধারণভাবে ডিএমকের দলগত ভাবে অশিষ্ট আচরণকেও মানুষ ভালভাবে নেয়নি। এবারেও ভোটের ফল বেরোনোর পর অব্যবহিত পরে আমরা ডিএমকে-র গুণ্ডামি প্রত্যক্ষ করেছি, তাও তাদের নেতার শপথগ্রহণের আগেই।
এবারের, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তামিলনাড়ুতে মোদী ও সাধারণভাবে উত্তরভারতীয়দের সম্পর্কে প্রবল আশঙ্কা কাজ করেছে। এ ঘটনা প্রবলতর হয়েছে গত ৬-৭ বছরে, নোটবন্দির পর থেকে। মনে রাখতে হবে, এখানে যে কোনও হিন্দিভাষীই নর্দি বলে পরিচিত, সে মহারাষ্ট্রের হলেও। ভাষা রাজনীতি তামিলদের পছন্দসই মিঠে বিষ। এখানকার প্রতিটি মানুষের নিজের ভাষা নিয়ে দুর্বলতা রয়েছে। দ্রাবিড় দলগুলি তা নিয়ে ভারী চমৎকার খেলাধুলো করে। এরা বিভাজনের রাজনীতিতে এতই পটু যে তামিলনাড়ুতে যে কোনও রকমের কমিউনিজমকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, করে রাখা হয়েছে মৃতপ্রায়। রাজ্য জুড়ে বলার মত কোনও ধর্মঘট হয়েছে এআইএডিএমকে-র আমলে, ডিএমকে-র এম করুণানিধির নির্দেশে।
সিনে জগতের জনপ্রিয় তারকারা, যাঁরা এখনও রাজনীতিতে আসেননি, মোদী ও বিজেপির বিরুদ্ধমত তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। ঐতিহাসিকভাবে, এই রুপোলি জগতের ব্যক্তিত্বদের খেয়ার রাখতেন করুণানিধি। জয়ললিতা এঁদের আদৌ খাতির করতেন না। এমজিআরের সময়ে সিনেমা জগতের লোকজন জানতেন এমজিআর ছাড়া তাঁদের গতি নেই এবং তাঁরা সেইমত রামচন্দ্রনের নির্দেশ পালনে প্রস্তুত থাকতেন।
এসব ছাড়াও, তামিল জনগণ ভুগেছে জ্বালানির দাম ও জিএসটি নিয়ে, যার জন্য বিজেপি সরাসরি দায়ী। এ ছাড়া ছিল নিট পরীক্ষা, এনআরসি-সিএএ এবং আরও নানাবিধ সত্যিকারের ইস্যুও। যদি কেউ সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, তাহলে বলার, এখানে সংখ্যালঘুরা তামিলনাড়ুর অন্যদের মতই, নিজেদের জাতের জন্য ভোট দেন।
এবারে, ২০২১ সালের নির্বাচনে এআইএডিএমকে জোট করে বিজেপির সঙ্গে। বিজেপির খারাপ ভাবমূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এআইএডিএমকের ফল খুবই খারাপ হয়েছে। মনে রাখতে হবে, জয়ললিতা পরবর্তী কালে এআইএডিএমকে-কে অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।
জালিকাট্টু ও স্টারলাইটের বিরোধিতা, দুটি সাইক্লোন, একটা বড়সড় বন্যা এবং তারপর কোভিড-১৯ পরিস্থিতি। এআইডিএমকে কেন্দ্রের সহায়তায় এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রায় সর ক্ষেত্রেই সাফল্যলাভ করেছে। ফলে তাদের পক্ষে জোটে বিজেপিকে বাদ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। প্রশ্ন হল বিজেপি তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক প্রকৃতি থেকে কতটা ভিন্ন। চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার-সমালোচকদের মতে বিজেপি আর ডিএমকে একই প্রকারের। দু দলের রাজনীতিই বিভাজনের। মোদী, ইন্দিরা গান্ধীর মতই দেশে জরুরি অবস্থা এনেছেন, নাম জরুরি অবস্থা দেননি কেবল। বিশেষ করে নোটবন্দির পর থেকে সমস্ত রাজ্যের প্রধানরা বিজেপির মাথাদের আওতাধীন হয়ে পড়েছেন। ওড়িশার ক্ষেত্রেই দেখা যাবে, দীর্ঘতম কাল মেয়াদে থাকা মুখ্যমন্ত্রীকে বিজেপি সহায়ক ভূমিকা নিতে হয়। এই বিরোধীহীনতার বিজেপি রাজনীতি একেবারেই ডিএমকে-র মত। ঐতিহাসির ভাবে ডিএমকে, অন্য যে কোনও দল শক্তিশালী হয়ে উঠলে, তাকে দাবিয়ে রেখেছে। এমজিআরের ভাঙা ডিএমকে ছাড়া তামিলনাড়ুতে আর কোনও দলের অস্তিত্ব এখনও নেই।
নিজের দলের নেতাদের খুশি থাকায় উৎসাহ প্রদান বা নীরবে সে খুশিয়ালির জোগান দিয়ে যাওয়া. ডিএমকে ও বিজেপির আরেকটি মিল। আমরা জানি জয়ললিতা তাঁর দলের সদস্যদের জন্য কী করেছিলেন।
তামিলসাই সৌন্দর্যরাজনের উদাহরণ এ ব্যাপারে লাগসই হতে পারে। তাঁর বাবা কুমারী অনন্তন ও ভাই এইচ বসন্তকুমার কংগ্রেসের সদস্য। গত লোকসভা ভোটে এইচ বসন্তকুমারের ছেলে বিডয় বসন্ত কন্যাকুমারী লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের হয়ে জেতেন। তিনি হারিয়েছিলেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্যের শীর্ষ নেতা পন রাধাকৃষ্ণনকে। পন অত্যন্ত স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ বলে পরিচিত, তাঁর ভাবমূর্তিও পরিচ্ছন্ন। তামিলসাই যতদিন তামিলনাড়ুতে ছিলেন, ততদিন তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন। তার কারণ তাঁর জাত, এবং তিনি কন্যাকুমারী থেকে যে অর্থের জোগানের বন্দোবস্ত করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, কন্যাকুমারীর নিজস্ব রেভিনিউয়ের এক তৃতীয়াংশ আসে কন্যাকুমারী থেকে (সৌজন্য- কামরাজ)। ডিএমকে-র মত হয়ে ওঠার জন্য এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা প্রয়োজন! শেষ পর্যন্ত তাঁকে যে তেলুগুল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হল, তার কারণ তাঁর হেয়ারস্টাইলের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান যথেষ্ট নিন্দিত হচ্ছিল, এবং তাঁর জনপ্রিয়তাও হ্রাস পাচ্ছিল। তামিলসাই সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের দ্বিতীয় কারণ হল, অন্যান্য বিজেপি নেতা-নেত্রীদের মতই তামিলনাড়ুতে থাকাকালীন তিনি সংবাদমাধ্যমের সামনে যা প্রাণে চায় তাই বলতেন।
বিজেপি-ডিএমকে-র মধ্যে মিল আরও রয়েছে। যেমন পুলিশ-প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপ - এ একেবারে ক্লাসিকাল ডিএমকে সুলভ। নির্বাচনের সময়ে নির্বাচন কমিশনের কারসাজি- এ ব্যাপারে ডিএমকে-র চূড়ান্ত দক্ষতা তামিলনাড়ু আগে প্রত্যক্ষ করেছে।
তাহলে বিজেপি কেন ক্ষমতায় এল না এখনও, তাদের সম্ভাবনা কতটুকু?
এআইএডিএমকের ইস্যুগুলি প্রায় সবই সমাধিত। শশিকলা অবসর নিয়েছেন। টিটিভি দিনাকরণের দল, এএমএমকে শূন্য পৌঁছিয়েছে এবং তাঁর ও তাঁর জাতের দিক থেকে যে শঙ্কা, তাও এই নির্বাচনে স্থিতি পেয়ে গিয়েছে। এআইএডিএমকে উত্তর ও উত্তরপশ্চিম তামিলনাড়ুর জমি নিজেদের দিকে টানতে পেরেছে। দক্ষিণে তারা প্রায় সব হারিয়েছে।
জয়ললিতার মৃত্যুর পর দলের যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, তাও প্রায় পুরোটাই সামাল দেওয়া গিয়েছে। হাস্যমুখ, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ইপিএস, স্বপক্ষে জনসমর্থন আনতে পেরেছেন, এবং এআইএডিএমকে-র প্রধান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। বিজেপির পক্ষে এর চেয়ে ভাল সময় আর কী হতে পারে!
তামিলনাড়ুর জনগণ ধর্ম ও জাতের পক্ষে ভোট দেবে, প্রায় উত্তর ভারতের মতই- যদি তাদের ঠিক মত উস্কানি দেওয়া যায়। দলিতভিত্তিক রাজনীতি ইতিমধ্যেউ যথেষ্ট জায়গা পাচ্ছে এবং তার থেকে লাভবান হচ্ছে বিজেপি। দলিতদের মধ্যে তারা বিভাজন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে, মোদী নিজে এখানে সুযোগসুবিধার কথাও ঘোষণা করে তাকে আরও জলহাওয়া দিয়েছেন।
তামিলনাড়ু বিজেপির পক্ষে সহজ নয়। তবে তাদের পদক্ষেপ দৃঢ় হচ্ছে। এখন থেকে তারা যে তামিলনাড়ুতে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই।