পশ্চিমবঙ্গের এবারের ভোট এমন উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পেরেছিল, আমরা অন্য রাজ্যগুলোর দিকে ঠিকঠাক তাকাবার সুযোগই পাইনি বলা চলে। তবু কেরালার দিকে বাঙালির একটা বিশেষ নজর ছিল। সেই রাজ্যটার বামভোটের জন্যই। পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বে কেরালায় ইতিহাস তৈরি করেছে বামেরা। অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিপুল গরিষ্ঠতা পেয়ে। কিন্তু সেই বামেরাই আবার বাঙলায় নিশ্চিহ্ন হবার পথে।
প্রতিটা রাজ্যই তাই আলাদা। ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোর এ রাজ্যে তৃণমূলের ভোট কৌশল নির্ধারণের সঙ্গে এবার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-র ভোট পরিকল্পনারও। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গের লড়াইটা কঠিন, আর তামিলনাড়ুতে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সির হাওয়ায় ভেসে ডিএমকে তুড়ি মেরে জিতবে বিপুল ভাবে। এক্সিট পোলগুলোর অনেকেই মোটামুটি তেমন ছবিই দেখাচ্ছিল। কার্যত কিন্তু বেশির ভাগ এক্সিট পোলই মুখ থুবড়ে পড়েছে। দু’রাজ্যেই। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে বড়সড় ব্যবধানে ক্ষমতায় এলেও যতটা বিপুল জয় তাদের হবে বলে ধরা হচ্ছিল, তা কিন্তু হয়নি। এমনিতে দশ বছরের শাসনের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে তৈরি হওয়া অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সিকে অতিক্রম করা কখনোই খুব সহজ নয়। বাঙলায় মমতা ব্যানার্জি পারলেও তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে নেতৃত্ব তা সামলে উঠতে পারেন নি।
আসলে প্রত্যেক রাজ্যের ভোটই আলাদা। এবং তার অনেকটাই বোধহয় নির্ধারিত হয় স্থানীয় ইস্যুর দ্বারা। তামিল রাজনীতি যেমন অনেকটাই নির্ধারিত হয় দ্রাভিড়িয় ভাবাবেগকে আশ্রয় করেই। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে করুণানিধি এবং জয়ললিতার মত দুই রাজনৈতিক মহীরুহর অবর্তমানে প্রথম বিধানসভা নির্বাচন চরিত্রগত ভাবে খানিক আলাদা হতে বাধ্য। যদিও এই দুই রাজনীতিকের লেগাসিকে সম্বল করেই যে এবারের ভোট হয়েছে, সে বিষয়েও সন্দেহ কম। এবারের তামিলনাড়ুর ভোটের এবং তার ফলাফলের কিছু বিষয় আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় বলেই মনে হয়েছে।
তামিল রাজনীতি রুপোলি পর্দার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে বহু বছর ধরে। এই ভোটের আগে পর্যন্ত দ্রাভিড়িয়ান পার্টিগুলি থেকে হওয়া সাতজন মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে পাঁচজনই রুপোলি পর্দার গ্ল্যামারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবু এবারের ভোটে কি তামিল ভোটারদের ভোটিং স্টাইলের সেই ধারায় কিছু বদল এল? সুপারস্টার রজনীকান্ত বহুদিন ধরে নতুন দল গড়ে ভোটে দাঁড়াবেন দাঁড়াবেন করেও সরে দাঁড়ালেন ভোটের আগে। রজনীকান্ত এই ভোটের ময়দানে তাঁর বিপুল গ্ল্যামার এবং স্পিরিচুয়াল রাজনীতি সহ থাকলে তামিল রাজনীতি কীভাবে আবর্তিত হত, বা আদৌ বিরাট কোনও পরিবর্তন হত কিনা, তা জানার কোনও সুযোগ আমাদের নেই। তবে কমল হাসানের মত অভিনেতা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়লেন ভোটের ময়দানে। যদিও কমল হাসান নিশ্চয়ই রজনীকান্ত নন।
তামিলনাড়ুর ভোটে ৬৮ বছর বয়সী এমকে স্টালিনের ক্ষমতায় আসা নিঃসন্দেহে এক পরিবর্তন। ভোটে এআইএডিএমকে অবশ্য যতটা খারাপ ফল করবে বলে ভাবা হয়েছিল, ততটা হয়নি। স্থানীয় স্তরে অবশ্যই এর কারণ বিশ্লেষণ করবেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আপাতভাবে এআইএডিএমকে সরকারের শেষ মুহূর্তের বেশ কিছু জনদরদী সিদ্ধান্ত তাদের ফলটাকে খুব খারাপ হতে দেয়নি বলে মনে করছেন অনেকেই। যেমন শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে ভান্নিয়ার জনগোষ্ঠীর জন্য সাড়ে দশ শতাংশ সংরক্ষণ করা শুধু ভান্নিয়ার অধ্যুষিত অঞ্চলে এআইএডিএমকে-র ভোটই বাড়ায় নি, পিএমকে-র সঙ্গে তাদের জোট হতেও সাহায্য করেছে। কৃষকদের শস্যঋণ এবং স্বর্ণঋণ মকুবের সিদ্ধান্তও সাহায্য করেছে শাসক দলকে। খানিকটা হলেও।
এআইএডিএমকে-র এই ফল কিন্তু আগামী দিনে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তামিল রাজনীতিকে। নানাভাবে। পশ্চিমবঙ্গে যেমন দুই প্রধান দল মিলে ভোট পেয়েছে ৮৬%-এর মত, তামিলনাড়ুতেও ছবিটা একই রকমের। সেক্ষেত্রে দুই প্রধান জোট ভোট পেয়েছে ৮৫%-এর বেশি। দুই প্রধান দ্রাভিড়িয়ান পার্টির মধ্যেই তাই প্রধানত ওঠাপড়া করেছে তামিল সমর্থনের ভিত্তি। এবারে এইআইএডিএমকে-র জোটসঙ্গী হিসেবে ভোটে লড়লেও বিজেপি যে ভবিষ্যতে তামিলনাড়ুতে জমি শক্ত করতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। আসলে আমাদের রাজ্যগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই লড়াইটা হয়ে পড়ে প্রধানত দ্বিমুখী। পলিটিক্যাল সায়েন্সের থিওরি মেনেই। অনেক ক্ষেত্রেই তৃতীয় শক্তির খুব একটা প্রাসঙ্গিকতা থাকে না ভোটের লড়াইতে। বিজেপির পক্ষে তাই এরপর তামিলনাড়ুতে প্রভাব বিস্তার করা সহজ হতে পারত যদি এবারের ভোটে এআইএডিএমকে শক্তি হারিয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়ত। রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই রাজ্যে বিরোধী শক্তির সেই প্রায় শূন্যতা তাহলে ভরাট হতেই হত কোনও না কোনও ভাবে। আর সেই জায়গাটা নেওয়া তুলনায় হয়ত সহজ হত বিজেপি-র পক্ষে। ঠিক যেমন হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। বামেরা এখানে প্রধান বিরোধী শক্তির জায়গাটা খুইয়েছে। আর সেই জায়গাটা ভরাট করা সহজ হয়েছে বিজেপির পক্ষে। এআইএডিএমকে কিন্তু অতটা শক্তি হারায় নি এবারের ভোটে। তাই বিজেপির কাজটা আপাতত হয়ত কঠিনই রইল।
সেই সঙ্গে বড় প্রশ্ন-- শশীকলার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কী হবে? জয়ললিতা-ঘনিষ্ঠ শশীকলা বেঙ্গালুরুর জেল থেকে বেরিয়েছেন ফেব্রুয়ারিতে। বিধানসভা ভোট তখন সমাসন্ন। অবশ্যই এআইএডিএমকে-র নেতৃত্ব দেবার স্বপ্ন তাঁর থাকাটাই স্বাভাবিক। ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ জয়ললিতার জন্মদিনে জয়ললিতার অনুগামীদের একযোগে লড়ার ডাক দেন শশীকলা। এআইএডিএমকে নেতৃত্ব অবশ্য তাতে সাড়া দেয় নি। তাই ভাইপো দীনাকরনের দলের হয়ে এবারের ভোটে লড়াটাই যখন শশীকলার অবশ্যম্ভাবী পদক্ষেপ বলে সবাই মনে করছেন, সেই সময় সকলকে স্তম্ভিত করে শশীকলা রাজনীতি থেকে আপাতত সরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন, এআইএডিএমকে-র স্বার্থের কথা বলে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই একে মনে করেছেন মাস্টারস্ট্রোক-- এক অসম্ভব কুশলী রাজনৈতিক পাশার দান। এআইএডিএমকে-র অবশ্যম্ভাবী আসন্ন পরাজয়ের প্রেক্ষিতে এই পদক্ষেপ তাঁকে এআইএডিএমকে-সমর্থকদের মধ্যে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে নিঃসন্দেহে। যার ডিভিডেন্ড তিনি তুলতে পারেন এআইএডিএমকে-র ভোটে পরাজয়ের পরে কোনও এক সুযোগ্য সময়ে। এআইএডিএমকে-র নেতৃত্বে তাঁর ফিরে আসা, এমনকী শীর্ষ নেতৃত্বেও তাঁর অভিষেক হয়ত সম্ভব-- সময়ের পথ ধরে। সেক্ষেত্রে অবশ্য এআইএডিএমকে-র পরাজয়টা যত বড় হত, ততই সুবিধে ছিল শশীকলার। তাঁর পক্ষে সহজ হত বিধ্বস্ত দলের হাল তুলে নেওয়া। আপাতত পালানিস্বামীর পরাজয়টা অতটা সাঙ্ঘাতিক না হওয়ায় তা হয়ত পার্টি নেতৃত্ব বদলের মত বড়সড় পরিবর্তন নাও ঘটাতে পারে। যাই হোক, এআইএডিএমকে-র এই নেতৃত্বের সম্ভাব্য সংঘাতের দিকে আগামী দিনে অবশ্যই নজর থাকবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। এবং নতুন মুখ্যমন্ত্রীর দিকেও।