২০২৪ লোকসভা ভোটের তৃতীয় দফায় ভোট কেন্দ্রে এসেও ভোট দিতে পারলেন না রাজকোট লোকসভা কেন্দ্রের ভোটার উর্বশী কাঁপারিয়া – কারণ তিনি সাথে ভোটার কার্ড আনেন নি। ভোট দিতে এসেও কেন ভোটার কার্ড আনেন নি, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানাচ্ছেন যে, সরকার স্বীকৃত ডিজি লকারে তাঁর সমস্ত ডকুমেন্টের কপি জমা করা আছে। প্রয়োজন মাফিক তিনি সেই ডিজিটাল কপিতেই সব জায়গায় কাজ চালান, কোথাও কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। এক্ষেত্রেও তিনি ডিজি লকারের ভরসাতেই সাথে কোনও ডকুমেন্ট না নিয়েই ভোটকেন্দ্রে চলে এসেছিলেন ভোট দিতে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কড়া নির্দেশ – ভোটকেন্দ্রে মোবাইল ফোন, ক্যামেরা বা অন্য কোনও বৈদ্যুতিন যন্ত্র নিয়ে ঢোকা যাবে না। ফলে এ যাত্রায় উর্বশী তাঁর হকের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাননি।
বিএলও (বুথ লেভেল অফিসার) – এর তরফে প্রত্যেক ভোটারের জন্য যে ‘ভোটার তথ্য স্লিপ’ দেওয়া হচ্ছে তার পেছনে পরিষ্কার লেখা আছে – ভোট কেন্দ্রের ভেতরে মোবাইল ফোন ও ক্যামেরার মতো গ্যাজেট নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু কেন এই নির্দেশিকা?
সম্ভবত, কোনও ভোটার যাতে পোলিং বুথে ঢুকে ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে না পারেন, সেই জন্যই মোবাইল ফোন, ক্যামেরা বা এই ধরনের কোনও রকম বৈদ্যুতিন যন্ত্র নিয়ে বুথে প্রবেশের ওপরে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু, ভিডিও বা ছবি তো নির্বাচনী স্বচ্ছতার জন্য আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরায় বুথের অভ্যন্তরের বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপের দৃশ্য ধরা পড়েছে। পোলিং অফিসারদের হুমকি দিয়ে সম্মিলিত ভাবে বুথ জ্যাম, দেদার ছাপ্পা – এসব ঘটনা তো আমাদের কাছে অতিপরিচিত। তাই বুথের ভেতরে যদি কেউ বা কয়েকজন মিলে গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করে, ভোটারদের কাছে ফোন থাকলে সেটার ছবি তোলা বা ভিডিও করা যাবে তৎক্ষণাৎ, যেটা পরে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করে অপরাধীদের ধরার ক্ষেত্রে সেগুলো কাজে লাগতে পারে। শুধু ইভিএম মেশিনে একজনের ভোটদানের দৃশ্য যাতে অন্য কেউ না তুলতে পারে, সে বিষয়ে কড়া নজর রাখতে হবে।
তাছাড়া, ভোটকেন্দ্রে মোবাইল নিয়ে ঢুকে কোনও ভোটার নিজের ভোট দেওয়ার পদ্ধতি যদি ভিডিও করে এবং ইভিএম বা ভিভিপ্যাটের মধ্যে কোনও অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে, তৎক্ষণাৎ সেটার হাতে-নাতে প্রমাণ পাওয়া যাবে।
ভোটারদের যদি মোবাইলে নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়, এবং ভিডিও বা ছবি তোলার ক্ষেত্রে কোনও নিষেধাজ্ঞা না থাকে, তাহলে ভোটের কাজে নিযুক্ত পোলিং অফিসাররাও নিজেদের কাজটি আরও ভাল ভাবে করার চেষ্টা করবেন, কারণ তাঁদের ত্রুটিগুলো ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকবে; এমনকি তাঁদের কাছেও এটা একটা বড় হাতিয়ার হতে পারে। ভোটকেন্দ্রের মধ্যে বুথ জ্যাম বা ছাপ্পা ভোটের মতো কোনও রকম অনাকাঙ্খিত ও অনৈতিক ঘটনা ঘটলে বা সেই সম্ভাবনা তৈরি হলে, যেহেতু যে কোনও ভোটারের সুযোগ থাকছে সেটার ভিডিও করার, ফলে পোলিং অফিসাররা আরও দৃঢ় ভাবে ও নির্ভয়ে সেই দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলা করে উক্ত পরিস্থতি সামলাতে পারবেন।
এর পরেও যদি মোবাইল বা ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ করার নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হয়, তাহলে বুথের মধ্যেই ভোট প্রক্রিয়া এমন ভাবে ভিডিও রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থা করা উচিত যাতে ইভিএমে মূল ভোটদানের অংশটুকু বাদে বাকি সবকিছুর যেন রেকর্ড থাকে। কারণ বুথ জ্যাম বা কোনও গণ্ডগোলের সময় পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনী অনেক ক্ষেত্রেই যে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকেন, সে দৃশ্য আমরা প্রায় সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দেখেছি বা শুনেছি।
অনেকের আবার বিভিন্ন কারণে ফোন নিয়ে বেরোনোর বাধ্য-বাধকতা থাকে। তাই ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে এসে তাঁদের ফোন রাখার কোনও ব্যবস্থা না করে নির্বাচন কমিশনের এহেন নির্দেশিকা বড়ই বেমানান।
যে বিষয়টি নিয়ে প্রবন্ধটি শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরি – ডিজি লকার। প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরেই ২০১৫ সালের জুলাই মাসে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে “ডিজিটাল ইন্ডিয়া” পরিকল্পনা চালু করে। তারই একটা অংশ হিসাবে চালু হয় সরকার স্বীকৃত ডিজি লকার অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট। যে কোনও নাগরিক সেখানে তাঁর নিজের সব ডকুমেন্ট জমা করে রাখতে পারবেন, এবং যে কোনও সময় প্রয়োজন মাফিক সেই ডকুমেন্টগুলো ডিজিটাল কপি হিসাবেই যেকোনো জায়গায় ব্যবহার করতে পারবেন। সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে বহু মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের অনেকে ডিজি লকার ব্যবহার করে যেকোনো দরকারি নথির ডিজিটাল কপি দিয়েই বিভিন্ন জায়গায় কাজ মেটাতে শুরু করেন। কিন্তু মোবাইল ফোন নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করার সময় নির্বাচন কমিশনের এই নিষেধাজ্ঞা সরকারের ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ পরিকল্পনাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
এসবের মধ্যেই, ভারতীয় গণতন্ত্রকে একপ্রকার ‘নেতাতন্ত্রে’ পরিণত করা আমাদের দেশের “মহান” নেতাদের বদান্যতায় মনের মধ্যে বুড়বুড়ি কেটে ওঠা একটা আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভোটকেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশ করে ইভিএমের সামনে নিজের ভোটদানের ছবি তুলতে পারলে, কোনও ব্যক্তি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছেন তার প্রমাণ স্বরূপ ছবি তুলে আনার জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা অনৈতিক চাপ দিতে পারে, এমনকি সরকারি প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার হুমকিও দেওয়া হতে পারে।
তবে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন অন্তত পকেটে নিয়েও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারির নির্দেশিকা ভোটারদের অনেকেরই তাঁদের ছাত্রজীবনে পরীক্ষার সময় ক্লাসরুমের বাইরে মোবাইল রেখে প্রবেশের কথা মনে করিয়ে দেবে। তবে পার্থক্য একটাই – এখন যাঁদের এই বিধিনিষেধ মানতে হচ্ছে, তাঁরা মোটেই পরীক্ষার্থী নন, বরং তাঁরাই পরীক্ষক।