“In general, a law which has not been voted unanimously involves subjecting men to an opinion which is not their own, or to a decision they believe contrary to their interest. It follows that a very great probability of the truth of this decision is the only reasonable and just grounds according to which one can demand such submission.”
- Marie-Jean-Antoine-Nicolas de Caritat, Marquis de Condorcet (September 17, 1743–March 28, 1794)
এই লেখাটা যখন লিখছি, অর্থাৎ এই ২০২৪-এর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে, আমাদের চারদিকে ভোটের দামামা বেজে গেছে। সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে সমস্তরকম খবরের চ্যানেল ভরে গেছে ভোট-সংক্রান্ত খবরে, হয় দলবদলের অলীক কুনাট্যরঙ্গ, না হলে অপদার্থ রাজনীতি-ব্যাবসায়ীদের তামাশা, অথবা কাদা-ছোঁড়াছুঁড়ির মহড়া। ভোট যত এগিয়ে আসবে, নিউজ়-ফিড ভরে যাবে বিচিত্র-বিবিধ সব “ফলিবেই ফলিবে” গোছের ভবিষ্যদ্বাণীতে, আর সেই নিয়ে নিত্যি তুফান উঠবে চায়ের কাপে আর আড্ডায়-তর্কে।
ভোটের ফলের পূর্বাভাস অথবা প্রেডিকশন কিন্তু সেই সমস্ত জটিল ধাঁধার মত—পরীক্ষায় যেসব প্রশ্নের উত্তর মাথা খাটিয়ে হোক কিংবা হল-কালেক্ট করে বা স্রেফ আন্দাজে ঢিল মেরে একবার মিলিয়ে দিতে পারেন, কেউ খুব বেশি মাথা ঘামাবে না ঠিক কেমন করে, কোন মেথডে মিলিয়েছেন। আমাদের ভাষায়, ইন্টারপ্রিটেবিলিটির (“কী করে?”) চাইতে অ্যাকিউরেসির (“কতটা মিলেছে”) দর ও কদর অনেক বেশি। আবার এও ঠিক, যে এই প্রতিযোগিতার পুরস্কার-তিরস্কার দুইই একটু বেশির দিকে। মিলিয়ে দিতে পারলে রাতারাতি সেলিব্রিটি, সবাই এসে থানে গড় করবে—যেমনটা হয়েছে বাবু নেট সিলভারের বেলায়—আর ফস্কে গেলে পাড়ার লোকে এসে বলে যাবে ‘সব ঢপ!’ সেই সঙ্গে, শুধু আপনার না, আপনার গোটা ফিল্ডের পাৎলুন ধরে টানামানি ব্যাপার।
সে যাই হোক, আপনাদের যদুবাবু সেফোলজিস্ট নন, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ পোলিটিক্যাল পানডিট (পন্ডিত) – সেও নন। তবে নেট সিলভারের নামে ধন্যধন্য হয়েছিল যে বছর, যদুবাবুও সেই সময় কিঞ্চিৎ গৌরবে বহুবচ্চন হননি এ কথা বললে ডাহা মিথ্যে বলা হবে। তবে, আজ সে সব না। আজকে প্রেডিকশনের ধারকাছ দিয়েও যাবো না আমরা। বরং আমরা উত্তর খুঁজবো আরও গভীর, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে অতিসাধারণ একটি প্রশ্নের – গণতন্ত্র যে নির্বাচনের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে, সেই জনমত কি সবসময়েই অভ্রান্ত? Is the vox populi always correct? সহজ করে বললে, একদল মানুষ অর্থাৎ ভোটদাতা কি সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সবসময়েই ঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন? আরেকভাবে বললে, যে মেজরিটি ভোটিং-এর উপর আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোটিই দাঁড়িয়ে, সেই মেজরিটি কি সবসময়েই একটি অবজেক্টিভ (অর্থাৎ নৈর্ব্যক্তিক) সত্যতে পৌঁছুতে পারে? যদি পারে, তাহলে কখন পারে? আর যদি না পারে, তাহলে ঠিক কেমন ব্যাপার হয় সেটা? সামান্য এদিক-ওদিক দিয়ে কান ঘেঁষে না একেবারে বিচ্ছিরিভাবে ভুল? (এখানে ধরে নেওয়াই হচ্ছে যে একটি অবজেক্টিভ (অর্থাৎ বস্তুনিষ্ঠ বা নৈর্ব্যক্তিক) সত্যি আছে, অথবা, নির্বাচনের দিক থেকে ভাবলে সবার জন্যই (তর্কাতীতভাবে) মঙ্গলদায়ক এমন নীতি আছে।
এই যে সকলে মিলে ঠিক উত্তরে বা ঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর ফেনোমেনন বা ঘটনা, এর-ই পোশাকি নাম “উইজ়ডম অফ ক্রাউড”, বাংলায় “সমষ্টিগত প্রজ্ঞা”। দর্শনে বা বিজ্ঞানের ইতিহাসে উইজ়ডম অফ ক্রাউডকে ব্যাখ্যা করার অথবা সংজ্ঞায় বা সূত্রে ধরার চেষ্টা বহুদিনের। আরও বহু জিনিসের মতোই, এর-ও সুতো ধরে টানতে টানতে পৌঁছে যাই সেই প্রাচীনকালের দার্শনিক অ্যারিস্টোটলের কাছে। ইনফর্মেশন এগ্রিগেশনের, বা তথ্য একত্র করার উপযোগিতার কথা সেই যুগে যারা ভাবতেন, তাঁদের মধ্যে সম্ভবত উনিই প্রথম। তবে, রাশিবিজ্ঞানের ছাত্রের কাছে “উইজ়ডম অফ ক্রাউডের” অতিপরিচিত গল্প অবশ্যই স্যার ফ্রান্সিস গ্যালটনের সেই বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্ট, যেটি ছাপা হয়েছিল নেচার পত্রিকার মার্চ ১৯৪৯ সালের একটি নিবন্ধে, শিরোনাম “ভক্স পপুলি”। কীরকম ছিল সেই এক্সপেরিমেন্ট? গ্যালটন বর্ণনা দিয়েছেন প্লাইমাউথের একটি মেলার। সেখানে গেলে দেখা যেত একটি হৃষ্টপুষ্ট দুর্ভাগা ষাঁড় (ফ্যাটেনড অক্স) দাঁড়িয়ে আছে মেলার ঠিক মধ্যিখানে। দাঁড়িয়ে থাকার উদ্দেশ্য দর্শকদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা – এই ষাঁড়টিকে কেটেকুটে পরিষ্কার করার পর সেই মাংসের ওজন কত হবে আন্দাজ করার। প্রতিযোগিতার প্রবেশমূল্য ধার্য করা হল ছয় পেনি, আর সবথেকে কাছাকাছি উত্তরের জন্য একটি পুরস্কার। গ্যালটন লিখছেন, ঐ ছয় পেনি মূল্যের উদ্দেশ্য—যাতে কেউ ইয়ার্কি মেরে ভুলভাল আন্দাজ না করেন (‘prevent from practical joking’), আর পুরস্কার পাওয়ার আশায় যারা আন্দাজ করছেন, তাঁরাও যথাসম্ভব সেরা আন্দাজ-ই করবেন (‘put the best bet’)। আর লিখেছেন, প্রতিযোগীদের বেশিরভাগ হয় চাষি, না হলে পশুপালক বা কসাই – কাজেই একেবারেই অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মত ব্যাপার নয়। ফল কী হল? গ্যালটনের পেপারে পাই, সেইদিনের ৮০০খানা উত্তরের মধ্যে ১৩টি অসম্পূর্ণ উত্তর বাদ দিয়ে যা পড়ে থাকে, তার মধ্যমা (মিডিয়ান) নিলে দাঁড়ায় ১২০৮ পাউন্ড, আসল ওজন—১১৯৭ পাউণ্ডের—এক শতাংশের মধ্যেই, আর গড় (অর্থাৎ মিন) নিলে উত্তর একেবারেই মিলে যাচ্ছে খাপে-খাপ, যাকে বলে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ [Wallis, 2014]। উপসংহারে গ্যালটন মন্তব্য করছেন, “This result is, I think, more creditable to the trustworthiness of a democratic judgment than might have been expected.” …
শুধু আন্দাজ-মেলানো বা খেলা নয়, সমষ্টিগত প্রজ্ঞার বিভিন্ন ও বিচিত্র উদাহরণ কিন্তু দেখা যায় আমাদের প্রায় সমস্ত উদ্যোগেই, যেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া (ডিসিশন-মেকিং) আর কিঞ্চিৎ অনিশ্চয়তা (আনসার্টনটি) মিশে আছে এমন সব ক্ষেত্রেই। যদি সত্য ধ্রুবক হয়, আর সমস্ত ভ্রান্তি যদ্দৃচ্ছ, অর্থাৎ এক-একটি ভুল এক-একদিকে টানছে (অর্থাৎ এররগুলো র্যান্ডম, সিস্টেমিক নয়), তাহলে গড় নিলে সেই সব ভুলগুলি কাটাকুটি করে ফলাফলের খুঁতশূন্যতা বা অ্যাকিউরেসি বাড়তে বাধ্য। এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্য পাঠকদের “The Wisdom of the Crowds” [Surowiecki, 2005] বইটি সুপারিশ করে যাই।
কিন্তু আজকের গল্প আরও পুরোনো – এরও প্রায় দেড়শো বছর আগের ফ্রান্স যার পটভূমি। ইতিহাস বলে উইজ়ডম অফ ক্রাউডের প্রথম যথাযথ অঙ্কের সূত্র এসেছিল সেই ‘এজ অফ এনলাইটেনমেন্টের’ সময়, ফরাসি বিপ্লবের ঢেউ আছড়ে পড়ার অব্যবহিত আগে। সেই গল্পের নায়ক কনডরসে, পুরো নাম Marie Jean Antoine Nicolas de Caritat, Marquis de Condorcet! কনডরসে-কে বলা হয় “দি লাস্ট অফ দ্য ফিলোজ়ফস”, সেই “আলোকিত যুগের শেষ সাক্ষী” – ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাসের একজন অতিমানবিক এবং অবশ্যই ট্র্যাজিক হিরো। তার গপ্পো করতে গেলে গোটা একটা বই-ই লিখে ফেলা যায়, তবু ছোট্ট করে বলি। কনডরসে মানবাধিকার ও সাম্যবাদে বিশ্বাস করতেন – সাম্যবাদ শুধু সব বর্ণের মধ্যেই নয়, সমস্ত অর্থনৈতিক শ্রেণির, এবং পুরুষ ও নারীর মধ্যেও। স্বল্প জীবনকালেই তিনি ওকালতি করেছিলেন শিক্ষাগত সংস্কার, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, ঔপনিবেশিক দাসত্বের বিলুপ্তি এবং নারীর সমানাধিকার, বিশেষ করে সব জাতির সমতার জন্য এবং নারীদের ভোটাধিকার (উইমেন্স’ সাফ্রেজ) প্রশ্নের। এবং এই শেষতম প্রশ্নে, কনডরসে সেই আলোকিত যুগেও যেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম [Landes, 2009]। শেষ জীবনে, সেই কুখ্যাত রেইন অফ টেররের রোবস্পিয়েরের ভয়ে আত্মগোপন করা অবস্থাতেও তিনি লিখে চলেছেন তার সেরা কাজ Esquisse — লিখছেন সমাজের অগ্রগতির (“উন্নয়ন” বা “বিকাশ” আজকাল ব্যাঙ্গাত্মক শোনায়) কাঠামো, যার মূল স্তম্ভ মানুষের অসীম পরিপূর্ণতা (indefinite perfectibility of humankind and society)। কনডরসে-র আরও এক অন্যতম অবদান, “সোশ্যাল অ্যারিথমেটিক” – আজকে দাঁড়িয়ে মনে হয় সমাজের বিভিন্ন জটিল সমস্যায়, আর্থিক পরিকল্পনা থেকে জুরি-র সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অথবা জনস্বাস্থ্য, সর্বব্যাপী রাশিবিজ্ঞান বা সম্ভাব্যতা-তত্ত্বের প্রয়োগের এক্কেবারে শুরুর দিকে চিন্তক ও দার্শনিক উনিই।
উইজ়ডম অফ ক্রাউডের গল্পে ফিরে আসি আবার। গ্যালটনের ১৬৪ বছর আগে, এই কনডরসে-ই, প্রথম অঙ্কের সূত্রে বেঁধেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠের ব্যবহার – সমষ্টিগত প্রজ্ঞা অথবা মূর্খামি, দুইই। সেই বিখ্যাত উপপাদ্যটিই আজকে পরিচিত কনডরসে জুরি থিওরেম নামে, সংক্ষেপে CJT [Condorcet, 1785]। সেই উপপাদ্যটিই এখানে ছোট্ট করে, এবং সহজতম ভার্সনটিই, লেখার চেষ্টা করি। এই নিয়েও অবশ্য আস্ত বই আছে - Goodin and Spiekermann [2018], যদি পাঠকদের কারুর বিশদে পড়তে ইচ্ছে করে।
আবারও, ধরে নেওয়া যাক একটি অবজেক্টিভ অর্থাৎ বস্তুনিষ্ঠ সত্যি বা সেরা বিকল্প আছে, সেটা কী—না জানলেও চলবে, কিন্তু সে আছে, সেইটির জন্যেই ভোটাভুটি হচ্ছে। আর ধরা যাক আমাদের n-সংখ্যক ভোটার আছে, n বিজোড় সংখ্যা (অর্থাৎ “টাই” অসম্ভব)। প্রত্যেক ভোটারের ঠিক বিকল্পে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা ধরা যাক pc, এবং সবার ভোট পড়ে গেলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে “মেজরিটি রুল” অনুযায়ী, অর্থাৎ যে সবথেকে বেশি ভোট পাবেন, সেটিই আমাদের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। কনডরসে-র উপপাদ্যে এও ধরে নেওয়া হয়, যে, প্রত্যেক ভোটার ‘স্বতন্ত্র’, ‘দক্ষ’ এবং ‘আন্তরিক’। ‘স্বতন্ত্র’ – অর্থাৎ যে যার নিজের ভোট দিচ্ছেন বা একজনের পছন্দ আরেকজনকে প্রভাবিত করে না। ‘দক্ষ’ – অর্থাৎ, প্রত্যেকের ঠিক বিকল্প খুঁজে নেওয়ার সম্ভাবনা অর্ধেকের থেকে বেশি, যত সামান্যই হোক, এক্কেবারে র্যান্ডম গ্যেস অর্থাৎ ইকির-মিকির-চামচিকির করে আন্দাজে যা-ইচ্ছে-তাই একটা বোতাম টিপে দেওয়ার থেকে তার প্রজ্ঞা বা দক্ষতা একচুল হলেও বেশি। আর শেষ অ্যাজ়াম্পশনের কথা আগেও লিখেছি, ভোটার-রা ‘আন্তরিক’, সিরিয়াস-ও বলা যায়—কেউ ইচ্ছে করে ভুলভাল ভোট দিয়ে নষ্ট করছেন না।
কনডরসে-র উপপাদ্য বলে, এই সমস্ত অ্যাজ়াম্পশন সত্যি হলে, দুটো জিনিস হবেই – প্রথমত, মেজরিটি ভোটিং-এর মাধ্যমে ঠিক বিকল্প খুঁজে নেওয়ার সম্ভাব্যতা যেকোনো একজন ভোটারের ঐ এক-ই সম্ভাব্যতার থেকে বেশি হবে, আর যত ভোটারের সংখ্যা বাড়বে, ততই ঐ ঠিক উত্তরে পৌঁছনোর সম্ভাব্যতা ১-এর কাছাকাছি (অর্থাৎ ১০০%-এর কাছাকাছি) পৌঁছবে। সোজা বাংলায়, প্রচুর প্রচুর লোকে ভোট দিলে একেবারে ঠিক উত্তরে বা সেরা বিকল্পে পৌঁছনোর গ্যারান্টি দিচ্ছে CJT!
অঙ্কের ফর্মুলা এই নিবন্ধে না দিলেও চলে, এবং ইচ্ছে করলেই এই সূত্রটি সোজা টপকে পরের প্যারায় লাফিয়ে চলে যেতেই পারেন, তবে এত সুন্দর ফর্মুলা, যে না দিয়ে থাকতে পারছি না। CJT বলছে, যদি মেজরিটি ভোটিং-এর সিদ্ধান্ত “ঠিক” হওয়ার সম্ভাব্যতা হয় Pn আর এক-একজন ভোটারের “ঠিক” ভোট দেওয়ার সম্ভাব্যতা হয় pc, তাহলে অল্প অঙ্ক করলেই যে সূত্রটি পাওয়া যায় সেটা এইরকম:
অর্থাৎ, CJT বলছে pc >1/2 হলে, অর্থাৎ দক্ষ ভোটার হলেই,
১) Pn+2 > Pn (মানে একজনের থেকে তিনজনের গড় নিলে ঠিক উত্তরে পৌঁছনোর সম্ভাবনা বেশি) আর
২) Pn → 1 as n → ∞ (মানে যত বেশি দক্ষ ভোটার ভোট দেবেন, তত ১-এর দিকে ক্রমাগত এগিয়ে যাব, নিচের ছবির উপরের ভাগে যেমন দেখা যাচ্ছে।)
বলাই বাহুল্য, যে এইটি একটু থেঁতো করে লেখা। এই উপপাদ্য একটু এদিক-ওদিক করলেও টেঁকে, যেমন সবার ঠিক উত্তর দেওয়ার সম্ভাবনা সমান নয়, না হলেও চলে, প্রত্যেকের সম্ভাবনা “আধা সে জ্যায়াদা” হলেই কেল্লা ফতেহ। আরো কিছু খোল ও নলচে পাল্টানো যায়, তবে কিনা, সে রাস্তায় আমরা আজকে যাবো না।
এই আশ্চর্য সুন্দর অথচ সহজ আবিষ্কারটি কিন্তু বহুদিন হারিয়ে গেছিল ইতিহাসের গর্ভে। তাকে খুঁজে পাওয়া যায় দীর্ঘ সময় পরে, ডানকান ব্ল্যাক ও অন্যান্যদের ১৯৫৮ সালের একটি গবেষণাপত্রে। শুধু জুরি থিওরেম-ই নয়, কনডরসে-র বিখ্যাত ভোটিং প্যারাডক্সটিও। সেটা আবার আরেক আশ্চর্য জিনিস – ধরা যাক তিনটে পার্টি আছে, ক, খ আর গ। তাহলে, মেজরিটি ভোটিং-এর ফলে এমন হতেই পারে, যে মানুষ ক-র থেকে বেশি পছন্দ করে খ-কে, আবার খয়ের থেকে বেশি গ-কে, অর্থাৎ গ > খ, এবং খ > ক, কিন্তু অঙ্কের মত এর মানেই গ > ক ভোট পাবে তার গ্রান্টি নেই, সবাই ভোট দেওয়ার পর হয়তো দেখা গেল ক, গ-কে হারিয়ে দিয়েছে। খটোমটো করে বললে, ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ চক্রাকার নয়।
এই যেমন নিচের টেবিলটি দেখুন, আপনি যদি বলেন “গ”-ই সেরা, তক্ষুণি রাম আর শ্যাম বলবে – কেন, আমরা তো “গ”-এর থেকে “খ”-কে বেশি ভালোবাসি। আবার যেই বললেন – ঠিক আছে, তাহলে “খ”-কে জয়ী ঘোষণা করে দাও, তখন রাম আর মধু বলবে – সে কী! আমাদের চোখে তো “ক” অবশ্যই “খ”-এর থেকে ভালো। তাহলে কি “ক”-ই প্রধান-সেবক? নাঃ, শ্যাম আর মধু বলছে তাদের চোখে “গ”>”ক”! এ তো মহা মুশকিল!
এই ধাঁধার জট ছাড়াতেও আরেকটা গোটা লেখা দরকার, তবে কিনা, এই ছোট্ট ধাঁধার মধ্যেই লুকিয়ে আছে নোবেলজয়ী অ্যারো’জ় ইম্পসিবিলিটি থিওরেমের মূল সুর। যার মোদ্দা কথা – যে একদম সুষ্ঠুতম (ফেয়ারেস্ট) ভোটাভুটি হলেও এতোল-বেতোল লোকে জিতে যেতে পারে, মানে যাকে বলে ডেমোক্রেসির ফুটুরে একাধিক ডুমাডুম, অবশ্যই কিছু কিছু শর্ত সাপেক্ষে।
আবার লাইনে ফিরে আসি। এই যে উইজ়ডম অফ ক্রাউডের গপ্পো করে যাচ্ছি, এর প্রভাব বলুন বা প্রয়োগ – তা কিন্তু শুদ্ধু ভোটাভুটির ফলেই নয়, আরও অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়। যেমন, আমাদের এই মেশিন লার্নিং-এর লাইনের আনসাম্বল লার্নার, উদাহরণ র্যান্ডম ফরেস্ট, যার আসল কথা এই, যে অনেকগুলো মডেলের প্রেডিকশন নিয়ে গড় করলে অ্যাকিউরেসি হু-হু করে বেড়ে যায়, যদি সেই মডেলগুলোর প্রত্যেকে মোটামুটি কিছুটা স্বতন্ত্র (“কিছুটা” মানে আমাদের লবজ়ে একেবারে ইন্ডিপেন্ডেন্ট না হলেও ডি-কোরিলেটেড, হুবহু টুকলি নয়), আর ‘দক্ষ’ হয় (প্রত্যেকেটা মডেল-ই আন্দাজে ঢিল মারার থেকে ভালো।)
আরো একটা অঙ্কের ফর্মুলা দিয়ে যাই, এ-ও স্বচ্ছন্দে রাস্তায় জমে থাকা জলের মত ডিঙিয়ে যেতে পারেন, ক্ষতি নেই। এটা রোমান ভার্শিনিনের বইয়ের অঙ্ক। (রাশিবিজ্ঞানের ছাত্র হলে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেই পারো, দুই লাইনের প্রুফ।)
Consider a randomized algorithm for decision-making (e.g., determining if a number is prime) that gives correct answers with probability 1/2 + δ, where δ > 0 (i.e., assuming ‘competence’). By running the algorithm n times and taking the majority vote, the probability of obtaining the correct answer would be at least 1 − ε for any ε > 0, as long as,
এ তো গেল সব ভালো ভালো কথা, “আমরা চলব আপন মতে, শেষে মিলব তাঁরি পথে” বলে কোরাসে গান গাওয়ার মত জায়গায় পৌঁছে গেছি প্রায়। কিন্তু তাহলে এই যে চাদ্দিকে বিভিন্ন সব অদ্ভুত ঘটনা দেখি – এই যেমন ব্রেক্সিট দেখলাম, ট্রাম্প-ও দেখলাম, আর আমাগো দ্যাশে তো আর কথাই নেই। এরা তো মেজরিটির-ই পছন্দ, তাহলে কোথায় গেলো সেই উইজ়ডম? এই যদি সেই বেড়াল, তবে মাংস কই? আর এই যদি সেই মাংস, তবে বেড়াল কই? তাহলে কি ঐ কনডরসে-র জুরি থিওরেম বাস্তব জগতে আর খাটে না?
এবার তাহলে আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক কনডরসে-র উপপাদ্যের অ্যাজাম্পশনগুলো। ভোটার-দের হতে হবে “স্বতন্ত্র”, “দক্ষ”, এবং “আন্তরিক”। এর সবকটিই বিভিন্ন গবেষকের, বিভিন্ন মহলের প্রশ্নের মুখে পড়েছে বারংবার, যাদের কেউ-কেউ সত্যিই মনে করেন, যে এগুলো একসাথে সত্যি হওয়া প্রায় সোনার পাথরবাটির মত ব্যাপার।
এই যেমন ধরুন “দক্ষতা”! যদি সত্যিই এমন হয়, যে বেশির ভাগ লোকের-ই পছন্দ ভুল বিকল্পটিকে, অর্থাৎ অঙ্কের ফর্মুলায় ঐ pc < 1/2 হয়ে যায়? উপরের ছবিটির নিচের অর্ধেক দেখুন এইবার। হুহু করে কেমন গ্রাফ শূন্যের দিকে ছুটছে? অস্যার্থ, “ইনডিভিজুয়াল কম্পিটেন্স” অর্ধেকের কম হলে যত ভোটার বাড়বে তত বিপর্যয়, তত ভুল দিকে যাওয়ার রাস্তা মসৃণতর, সেইরকম কেসে শ্রেষ্ঠ জুরির সাইজ় মাত্র ১!
আর, “স্বাতন্ত্র্য”? ঐটিকে পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট ও অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানীরা আক্রমণ করেছেন মুহুর্মুহু। তাদের বক্তব্য, যদি সবার-ই এক-ই দিকে ‘সিস্টেম্যাটিক বায়াস’ থাকে, অথবা সবার কানে এক-ই প্রোপাগান্ডা পৌঁছয়? অথবা, সব ভোটারের খবরের সবটুকু অধিকার করে নেয় এক-ই উৎস থেকে আসা ফেক নিউজ বা মিসইনফর্মেশন? যদি সব্বার মধ্যেই এক-ই দিকে ধাবমান পক্ষপাত, একদেশদর্শিতা, এক-ই অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার? সংখ্যাগরিষ্ঠর মধ্যে বিষক্রিয়ার মতই যদি ছড়িয়ে পড়ে এক-ই বিদ্বেষ? তারা কি সকলে, প্রত্যেকে একা, না পুরোটাই কোনো একটা মতবাদের একটিই অঙ্গমাত্র? এ ভয় কনডরসে-রও ছিল, তিনি লিখেছিলেন গণতন্ত্রের রোগ এই, যে ‘masses suffer from great ignorance with many prejudices’! আজ থেকে আড়াইশো বছর পরেও সে কথা অশ্লীল রকমের সত্যি বলে মনে হয়। তবুও, সেই ‘শেষ সত্য’ নয়!
আগেই লিখেছি, আবার-ও মনে করাই। কনডরসে-র জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ Esquisse যখন লিখছেন, তখন তিনি শাসকের চোখে দেশদ্রোহী। আত্মগোপন করে আছেন পরিবারের থেকে বহু দূরে কোথাও, মাথার উপর সাক্ষাৎ গিলোটিন। ভেবে আশ্চর্য লাগে, যে সেই অকল্পনীয় অবস্থায় নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় বসেও তিনি বলে যাচ্ছেন মানব সভ্যতার সামনে একটিই রাস্তা, সে রাস্তায় সাময়িক বাধাবিঘ্ন থাকলেও রাস্তাটার মুখ সোজা উপরের দিকে, যার শেষে আল্টিমেট পারফেকশন, অন্তিম পূর্ণতা, সে যেন এক ‘অন্তহীন নক্ষত্রের আলো’। এবং সেই শেষ সোপানে পৌঁছলে দেখা যাবে সেই বিশ্বে কোনো অসাম্য নেই, দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে মারামারি নেই, কারণ সেই সব-ই তো আসলে সভ্যতার প্রগতির পরিপন্থী! এই আকালেও তাই, আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, ‘এই পথে আলো জ্বেলে—এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে’।
১৭৯৪ সালের ২৯শে মার্চ, ঠিক আজ থেকে ২৩০ বছর আগে, কনডরসের মৃত্যু হয় কারারুদ্ধ অবস্থায়, মৃত্যুর কারণ আজও অজানা, কেউ বলেন আত্মহত্যা, কেউ রাজনৈতিক খুন।
এই লেখাটার আর কোথাও যাওয়ার নেই আপাতত, অতএব এখানেই ইতি টানছি। শেষ করবো কনডরসে-র একটি অসামান্য উক্তি দিয়ে, এই লেখকের ঘিঞ্জি আপিসের ঘিঞ্জি বোর্ডের এক কোণে যেটি জ্বলজ্বল করে অজস্র আঁকিবুকি আর ভুল থিওরেমের মাঝে। অন্ধকার ও ক্লান্ত রাত্রে নির্জন হাইওয়ে ধরে একলা বাড়ি ফেরার রাস্তায় বহুদূর দিগন্তের জনপদের টিমটিমে আলোর মত সে যেন আমাকে পথ দেখায়।
“The truth belongs to those who seek it, not to those who claim to own it.”
সূত্রঃ