একটু উঁচু ক্লাসের অঙ্ক পড়তে গেলেই এক-ই লোকের নাম (অথবা পদবী) বার বার ফিরে আসে, বিভিন্ন উপপাদ্য, বা সমীকরণ বা অন্যান্যা গাণিতিক বিষয়ের নামে। যেমন গাউস, লেজান্ড্র, কশি, রীম্যান, লাপ্লাস ... ইত্যাদি প্রভৃতি [১]। কয়েকক্ষেত্রে অবশ্য এক-ই পরিবারের একাধিক লোকের নামে নানান কিছু, যার সবথেকে ভালো উদাহরণ বার্নৌলি - জ্যাকব, যোহান, ড্যানিয়েল, নিকোলাস ... কোন বার্নৌলির নামে কোন প্রিন্সিপল আর কার নামে সম্ভাবনার সূত্র - এই এক দারুণ ধাঁধার প্রশ্ন।
এই জিনিয়াসদের মধ্যে গাউস-কেই ধরুন না কেন। অ্যালজেব্রা, জ্যামিতি, নাম্বার থিওরি, রাশিবিজ্ঞান, কার্টোগ্রাফি, নট (গিঁট) থিওরি - আরও কিসে না কিসে ১০০-র উপরের অঙ্কের জিনিষের নামে Gauss উঁকি মারছেন। একটা আস্ত উইকি পেজ বরাদ্দ আছে শুধু "List of things named after Carl Friedrich Gauss"-এর নামে। পড়তে পড়তে আশ্চর্য লাগে যে এই একজন-ই লোকের নামে এতো কিছু? এরা কী এক-ই লোক? তাও গাউস এমন খুঁতখুঁতে পারফেকশনিস্ট মানুষ ছিলেন যিনি বিশ্বাস করতেন একদম নির্ভুল, সমালোচনার উর্ধ্বে থাকবে এমন জিনিষ নামানো না গেলে পাবলিশ করার-ই দরকার নেই। তার মোটো ছিল, Pauca sed Matura ("Few, but Ripe")। তাতেই এই। ভাগ্যিস এখনকার মত "পাব্লিশ অর পেরিশ" কালচার তিনি দেখেননি।
তবে, আমার গপ্পের নায়ক গাউস নন। বরং এমন একজন লোক যার সাথে গাউস দীর্ঘদিন "কে প্রথম কাছে এসেছি?", অর্থাৎ প্রায়োরিটি ডিস্পিউটে জড়িয়েছিলেন লিস্ট স্কোয়ারের আবিষ্কার নিয়ে। সেই নিয়ে বিস্তর চিঠিচাপাটি, মান-অভিমান, একশো বছর পরেও রাশিবিজ্ঞানের ইতিহাসের আগ্রহের ব্যাপার। তিনি আদ্রিয়ান-মারি লেজান্ড্র (নাকি লেজঁদ্র?) (জন্ম - ১৭৫২, মৃত্যু - ১৮৩৩।) অঙ্কের ইতিহাসে তার-ও কীর্তি কম নয়। চট করে ভাবলেই মনে পড়ছে - লেজান্ড্র পলিনমিয়াল, লেজাণ্ড্র ট্রান্সফর্মেশন, লেজাণ্ড্র ডিফারেনশিয়াল ইকোয়েশন, লেজান্ড্র সিম্বল, লেজান্ড্র কণ্ডিশন ফর ক্যালকুলাস অফ ভেরিয়েশন, লেজান্ড্র রিলেশন ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত কিছু। ভদ্রলোক এর-ই পাশাপাশি নাম্বার থিওরি, এলিপটিকাল ইন্টিগ্রাল, ক্যালকুলাসের উপর বই লিখেছিলেন বেশ কিছু, আর ইউক্লিডের জিওমেট্রির মালমশলা নিয়ে লিখেছিলেন বেশ জনপ্রিয় পাঠ্যবই, একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছিল সেটি। তাও লেজান্ড্র জীবদ্দশায় প্রচুর খ্যাতি পেয়েছিলেন এ কথা লিখলে মিথ্যা বলা হবে। অন্যান্য সমমানে বিখ্যাত গাণিতিকদের মত তার 'সমগ্র' বেরোয়নি। এমন কি, ব্যক্তি লেজান্ড্র কেমন ছিলেন সে বিষয়ে আমাদের জানা আজ-ও অতি অল্প। ছাত্র অথবা বন্ধুদের দু-একটি চিঠির ভেতর যেটুকু যা ধরা যায় তাইই।
তবে, সে এমন কিছু আশ্চর্য হয়তো না। কত বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কি অঙ্কবিদ সারাজীবন নিভৃতচারী হয়ে কাটান। অন্য এক আশ্চর্যতর জগতের বাসিন্দা হয়ে। তাদের রোজনামচা না-ই জানা থাকতে পারে। কিন্তু লেজাণ্ড্রের গল্পের সবথেকে আশ্চর্য বিষয় এই যে এক শতাব্দীর-ও বেশি সময় ধরে মানুষ অন্য এক লেজান্ড্র-র ছবি দেখে ভেবেছে এই সেই আদ্রিয়ান-মারি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেখানে যেখানে যে বইতে লেজান্ড্রর কথা পড়েছে, যে ওয়েবসাইটে অঙ্কের ইতিহাসে লেজান্ড্রর কীর্তি পড়েছে, সেই কীর্তির পাশে যাঁর ছবি দেখেছে তিনি আদৌ গণিতজ্ঞ লেজান্ড্র নন। আদ্রিয়েন-মারির সাথে তাঁর যে কোনোরকম বাহ্যিক সাদৃশ্য ছিলো এমন-ও না। তবে, মিল ছিল পদবীতে। যে ভদ্রলোকের রাজপুরুষোচিত চেহারা দেখে আমরা গড় করেছি তাঁর নাম লুই লেজান্ড্র। লুই অঙ্কের লোক ছিলেন না, ছিলেন ফরাসী বিপ্লবের সময়কার এক বিপ্লবী। আদ্রিয়ান-মারির সমসাময়িক লুয়ি (১৭৫৫-১৭৯৭) প্রথম জীবনে ছিলেন একজন কসাই (বুচার) - ফরাসী বিপ্লব যখন শুরু হচ্ছে, অর্থাৎ ১৭৮৯ নাগাদ তিনি La Montagne (অর্থ: পর্বত, the mountain) দলে যোগ দেন, বাস্তিল দুর্গ আক্রমণে অংশ নেন, এবং পরে রাজার মৃত্যুদণ্ডে সায় দিয়ে ভোট দেন। এই Montagne দলের লোকদের, অর্থাৎ Montagnards-দের মধ্যেই ছিলেন ইতিহাসের পাতায় কলঙ্কিত নায়ক রেইন-অফ-টেররের রোবস্পিয়ের। তবে, বিখ্যাত বা কুখ্যাত যাই হোন, লুই ছিলেন আগাগোড়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব - তার সাথে আদ্রিয়ান-মারির প্রায় কোনো সম্পর্কই নেই, শুধু ঐ পদবী বাদ দিয়ে।
এবং এইখানেই আরও আশ্চর্যের কথা। দুইজনেই কমবেশি বিখ্যাত না'হক ঐতিহাসিক চরিত্র, আমাদের কাছে না হলেও সেই দেশে তো বটেই। তবু, বছরের পর বছর ধরে এই দুই লেজান্ড্রর নামের পাশে এক-ই লোকের ছবি বসেছে বইতে আর সব জায়গায়, কিন্তু কারুর-ই এই অদ্ভুত ডাবল-রোল চোখেও পড়েনি। এর একটা কারণ হতে পারে এই যে যারা মন দিয়ে অঙ্ক পড়েছে তারা আর ইতিহাস পড়েননি, আর ভাইসি ভার্সা। আর দ্বিতীয় কারণ এই যে এতোসব শক্তিশালী সার্চ ইঞ্জিন তো এই কয়েকদিন আগেও ছিলো না আর পাশাপাশি রেখে দেখার কাজ-ও এতো সোজা ছিল না।
এই আশ্চর্য ভ্রান্তি বা অ্যানোম্যালি প্রথম ধরা পড়লো ২০০৫ সালে। ইউনিভার্সিটি অফ স্ট্রাবুর্গের দুই ছাত্রের চোখে ধরা পড়ল যে দুইজন সম্পূর্ণ ভিন্ন লোকের - প্রতিকৃতি এক-ই। ফরাসী ব্লগেও লেখালিখি শুরু হলো। অঙ্কের দুনিয়ায় শোরগোল পড়লো, "ছবি তুমি কার?" - আদ্রিয়ান-মারি না লুই না অন্য কেউ? সেই অনুসন্ধানে মুখ্য ভূমিকা নিলেন জাঁ বার্নার্ড ফ্রাসোয়াঁ, তার ওয়েবসাইটে রীতিমত গোয়েন্দা-তদন্তের মত পরপর সূত্রসহ ছবি দিয়ে। অচিরেই জানা গেলো যে হ্যাঁ ঐ ছবিটি লুই লেজান্ড্রর-ই। যে ছবিটি সবাই দেখে অভ্যস্ত সেটি একটি লিথোগ্রাফ প্রতিকৃতি। সমসাময়িক আরও অনেক ফরাসী ব্যক্তিত্বের সাথে এক-ই বইতে সেই ছবি। তাতে তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বৈজ্ঞানিক, শিল্পী, সেনানায়ক, এমন কি সেই ভাগ্যহত রাজা ষোড়শ লুইয়ের ছবি যেমন ছিল, ঠাঁই পেয়েছিলেন বেশ কিছু গণিতজ্ঞ-ও - লাগ্রাঞ্জ, কার্নট, কনডর্সেট (এই কনডর্সেটের কথা আগের পর্বে লিখেছিলাম, যার জুরি থিওরেম দিয়ে বোঝা যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের গতিপ্রকৃতি।) এরা সবাই রীতিমত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, যাদের খ্যাতি পড়াশুনোর জগত ছাড়িয়েও বেশ কিছুদূর যায়। কনডর্সেটের খ্যাতির কথা আগেই বলেছি, বাকিরাও হয় রাজনীতি না হলে সরকারি কাজের ভার পেয়ে স্বনামধন্য ছিলেন। যেমন ছিলেন, আমাদের লেজান্ড্র-ও, বিশেষতঃ ইউক্লিডের পাঠ্যরূপের জন্য। কাজেই ঐ তারকাখচিত বইয়ের প্রতিকৃতি দেখে ভুল হওয়া আশ্চর্য হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। যদিও বইয়ের শেষের সূচিতে জ্বলজ্বল করছে, "LEGENDRE (Louis), né à Paris, en 1756, mort à Paris, le 13 décembre 1797"। আরও খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় ছবির তলায় যে সই, সেটি "Legendre", আর আমাদের অঙ্কের স্যার সই করতেন "Le Gendre"। এ যেন সেই দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরি। ছবি ও সই না মিলিয়ে নিলে নকল দুলালের মিছরি খেয়ে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। লিথোগ্রাফের ছবিই যে লুইয়ের ছবি তার আরও অকাট্য প্রমাণ - ঐ মন্তানার্দদের সাথে লুইয়ের একসাথে গ্রুপ ছবি। তাতে যার ছবি দেখা যাচ্ছে তিনিই যে লিথোগ্রাফের মানুষ বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
তবে ইনি না হয় লুই, তাহলে আসল আদ্রিয়ান মারি কোনজন? এই ধাঁধার জট ছাড়াতে লেগে গেলো আরও দুই বছর। ২০০৭ সালে জেরার্ড মিশঁ নামে আরেক গণিতজ্ঞ ঐ জাঁ বার্নার্ড ফ্রাসোয়াঁর ওয়েবসাইট থেকে এই প্রতিকৃতি-বিতর্কের কথা জানতে পেরে নিজের ওয়েবসাইটে একটি নোটিশ ঝোলান, আর একটি রীতিমত দুষ্প্রাপ্য ওয়েবসাইটের গহ্বরে খুঁজে পান একটি ব্যঙ্গচিত্র অর্থাৎ ক্যারিকেচারের অ্যালবাম। তাতেই এক পাতায় পাশাপাশি পেন্সিল স্কেচে দুই বিখ্যাত লোকের ছবি - বাঁদিকে লেজান্ড্র আর ডানদিকে ফ্যুরিয়ের।
ঐ যে সামান্য কার্টুন-মার্কা একটি ছবি, দেখেই মনে হচ্ছে অল্প কুপিত, অথবা বিরক্ত, শীর্ণকায় লেজান্ড্র, যেন এই মাত্র গাউসের সাথে একচোট ঝগড়া সেরে এলেন। পাশে বেশ হাসিখুশি, সদাশয়, গোল-গাল ফ্যুরিয়ের। লেজান্ড্র মানুষ যে একেবারেই তিক্ত বা কুঁদুলে ছিলেন এমন না, কনিষ্ঠ গণিতজ্ঞ আবেল বা জেকবিকে লেখা তার চিঠি এখনো পাওয়া যায় আন্তর্জালে। সেই সব চিঠিতে তার স্নেহের ছাপ, এবং কনিষ্ঠ সহকর্মীদের উৎসাহ দেওয়ার ছাপ স্পষ্ট। তবে, দুঃখের কথা এই যে, ক্যারিকেচার যেমন-ই হোক, ঐটিই আজ অব্দি পাওয়া আদ্রিয়ান-মারি লেজান্ড্র-র একমাত্র প্রতিকৃতি। মনে করিয়ে দিই, লেজান্ড্র-র মৃত্যু হয় ১৮৩৩ সালে, আর ফটোগ্রাফির আসতে আসতে প্রায় ১৮৪০, অর্থাৎ তখনো সামান্য দেরি। এলেও বা কী হ'ত বলা শক্ত। লেজান্ড্র সত্যিই পছন্দ করতেন না কেউ তার ব্যক্তিজীবনে আগ্রহ দেখাক। ওঁর ফিউনেরালের পোয়াঁসো বলেছিলেন, "Our colleague often expressed the desire that in speaking of him it would be only a question of his works, which are in fact his whole life."
তাও যে পাওয়া গেছে এই ভাগ্যি, কারণ সেই ক্যারিকেচারওয়ালা বইয়ের ইতিহাস-ও চমকপ্রদ। ঐ আঁকাগুলো লেজান্ড্রদের সময়কার শিল্পী জুলিয়েন-লিওপোল্ড বয়লির। বয়লির বাবা ছিলেন Académie des Beaux-Art এর তৈলশিল্পী, ছেলে বরাত পেয়েছিলেন সেই সময় ঐ সংগঠনের সদস্যদের ক্যারিকেচার আঁকার। সে কাজ তার জীবদ্দশায় শেষ হয়নি। বয়লির মৃত্যুর পর অসম্পূর্ণ সেই ক্যারিকেচারের অ্যালবামটির ঠাঁই হয় নিলামের দোকানে - নিউ ইয়র্কের ক্রিস্টি'জ়-এর তোষাখানায়। খবর পেয়ে নিলাম জিতে সেটি হস্তগত করেন ও পরে ইন্সটিটিউট দে ফ্রান্সে দান করেন ড্যানিয়েল ওয়াইল্ডেনস্টাইন। যে ইন্সটিউটের ওয়েবসাইটে অ্যালবামের সন্ধান পেয়ে আদ্রিয়েন-মারি লেজান্ড্রর ছবি উদ্ধার করেন জেরার্ড মিশঁ। সেইদিন সেই নিলামের ফল অন্য হলে, অথবা ইন্সটিটিউটের একটি অবস্কিওর ওয়েবসাইটে অ্যালবামের স্ক্যান ঠাঁই না পেলে হয়তো আজ-ও অজানা থাকতো লেজান্ড্র-র আসল ছবি।
এতো অব্দি পড়ে প্রশ্ন উঠতে পারে পরের প্রজন্ম না-ই পারুক, লেজান্ড্রর সমসাময়িক কেউ-ই পারলেন না এতো বড়ো একটা ভুল ধরতে? এর উত্তর সহজ। আদ্রিয়েন-মারির নামের পাশে লুইয়ের প্রতিকৃতি দিয়ে প্রথম বই ছাপা হয় ১৯০০ সাল নাগাদ। বই ছেপে বেরোতে বেরোতে লেজান্ড্র-কে নিজের চোখে দেখেছেন এমন কেউ-ই প্রায় বেঁচে নেই।
শুরু করেছিলাম গাউস আর লেজান্ড্র-র প্রায়োরিটি ডিসপিউটের গল্প দিয়ে। শেষ করছি আবার সেই গাউস আর লেজান্ড্রর ঝগড়াঝাঁটির গল্পে ফিরেই। ঝগড়ার বিষয় “মেথড অফ লিস্ট স্কোয়ার”স”, যা রাশিবিজ্ঞান কিংবা অঙ্কের ছাত্রদের শেখানো হয় একেবারেই প্রাথমিক স্তরে। এখনও রাশিবিজ্ঞানের প্রথম ক্লাসেই রিগ্রেশনে শেখানো হয় অর্ডিনারি লিস্ট স্কোয়ারস এস্টিমেশন। ধরা যাক, দুটি চলরাশি আছে - Y আর X, যেমন রক্তচাপ আর বয়স। আর আমরা একাধিক লোকের নমুনা সংগ্রহ করে বেশ কতকগুলি (X, Y)-জোড় পেয়েছি। এইবার আমরা চাই এমনভাবে একটি সরলরেখা আঁকতে যা মোটের উপর সবকটা (Y, X) বিন্দুর-ই কাছাকাছি থাকে। সরল না হয়ে বক্র হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু সরল দিয়েই বোঝা যাক শুরুতে।
তা সেই যে সরলরেখা (Y = a + bX), সেইটা আঁকতে হলে কীভাবে জানা যাবে ঐ a আর b ঠিক কত নেওয়া উচিত?
এইরকম সমস্যা প্রথম উপস্থিত হয় বহুদিন আগের জ্যোতির্বিজ্ঞানে, রাতের আকাশের গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করতে, এবং জিওডেসি-তে। অষ্টাদশ শতক, যাকে আমরা এখন বলি 'এজ অফ ডিসকভারি', সেই সময়েই একে একে অয়লার, টোবিয়াস মেয়ার, বসকোভিচ, লাপ্লাস – সবাই এই এক-ই প্রবলেমে নিজেদের অবদান রাখছেন একে একে। গাণিতিক সমস্যার মূল কিন্তু সেই এক-ই। সেখানেও বেশ কিছু অবজ়ার্ভেশন আছে, সবেতেই অল্পবিস্তর পরিমাপের ভ্রান্তিও আছে, আমাদের কাজ সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে এমন একটি সরল কিংবা বক্ররেখা আঁকা যা ঐ তথ্যরাশির “নিকটতম”। এই নিকটত্ব বা দূরত্ব মাপার উপায় কি? যদি একটি সরলরেখা চান, তাহলে আপনি চট করে খাতার পাতায় আপনি গ্রাফ এঁকে ফেলবেন, অনুভূমিক অক্ষে X, আর উল্লম্ব অক্ষে Y – আর যা যা ডেটাপয়েন্ট পেয়েছেন সব ছকে ফেললেন ঐ গ্রাফের পাতায়। এবার ঐ (X,Y) পয়েন্ট-ক্লাউডের মধ্যে দিয়ে একটা সরলরেখা যদি কল্পনা করে নেন, তাহলে সেই রেখা থেকে ঐ পয়েন্ট-ক্লাউডের দূরত্ব মাপার একটি উপায় ‘লিস্ট স্কোয়ার্স’। প্রত্যেকটি বিন্দু থেকে সরলরেখায় একটি লম্বালম্বি লাইন টেনে ফেলুন – তাহলে যে একঝাঁক রেখাংশ পাওয়া যাবে, সেই রেখাংশগুলির দৈর্ঘ্যই ঐ বিন্দু থেকে সরলরেখার দূরত্ব, আর মোট দূরত্বের পরিমাণ ঐ প্রত্যেকটি দূরত্বের যোগফল – কিন্তু এমনভাবে যোগ নিতে হবে যাতে শুধু দৈর্ঘ্যর মান্ইটুকুই যোগ হয়, অভিমুখ নয়, না হলে রেখার উপরের বিন্দুর দূরত্ব আর নিচের বিন্দুর দূরত্ব কাটাকুটি হয়ে যাবে। সে এক বিশ্রী ব্যাপার। ‘মেথড অফ লিস্ট স্কোয়ারস’ দেখায় যে ঐ মোট দূরত্বের পরিমাপ হিসেবে আমরা যদি প্রত্যেকটি বিন্দু থেকে ঐ সরলরেখার লম্বালম্বি দূরত্বের বর্গের যোগফল (বা গড়) নিই, তাহলে চট করে একটু অঙ্ক কষে বের করে ফেলা যায় ঠিক কোন a আর b-এর জন্য ঐ যোগফল ন্যূনতম হবে, আর সেটাই বলে দেবে ঠিক কোনখান দিয়ে আঁকতে হবে সরলরেখা (নিচের ছবির 'ফিটেড লাইন') [২]।
ফিরে আসি গল্পে। এই লিস্ট স্কোয়ার্সের প্রথম বর্ণনা লেজান্ড্র পাব্লিশ করেন ১৮০৫ সালে। সেই গবেষণাপত্রর নাম "Nouvelles mehodes pour la determination des orbites des cometes" - যাতে বর্ণনা ছিল মেথড অফ লিস্ট স্কোয়ারসের, স্বনামেই। যদিও সেই লিস্ট স্কোয়ার্স মেথডের সাথে সম্ভাবনা-তত্ত্বের মিল দেখাননি লেজান্ড্র, কিন্তু তাতে তো আর ‘মেথড’ পালটায় না। ঐ এক-ই সময়ে, কেউ কেউ বলেন ‘হয়তো’ কিছু আগেই, এবং ‘হয়তো’ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে গাউস-ও কষে ফেলেছেন এই এক-ই অঙ্ক, এক-ই সূত্র বা পদ্ধতি। অঙ্কের ঐতিহাসিক রিচার্ড প্ল্যাকেটের মতে এই অনুমান সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়, গাউস যে ভেবেছিলেন এই পদ্ধতির কথা সেটা লিখে জানিয়েছেন একাধিক সহকর্মীকে, কিন্তু ঐ যে ওঁর "অল্প, কিন্তু পরিপক্ক" মোটো - ভেবে থাকলেও সঙ্গে সঙ্গে ছাপেন নি। ছাপতে ছাপতে লেগে যায় আরও চার বছর, গাউসের লিস্ট স্কোয়ার্সের বর্ণনা বেরোয় "Theoria Motus Corporum Coelestium"-এ, উপরি হিসেবে এইবার পাওয়া গেলো নর্ম্যাল ডিস্ট্রিবিউশনের সঙ্গে লিস্ট স্কোয়ার্সের সম্পর্ক। কিন্তু গোল বাধলো ঐ গবেষণাপত্রের-ই একটি বাক্যে। গবেষণাপত্রে গাউস লিখলেন, "On the other hand our principle, which we have made use of since the year 1795, has lately been published by LEGENDRE"। এ যেন একেবারে "আমারও ছিল মনে, কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে"-র কাণ্ড। গাউসের এই দাবী থেকেই শুরু হয় দীর্ঘ ও কিঞ্চিত তিক্ত বাগবিতণ্ডা। অঙ্কের বহু বহু প্রায়োরিটি ডিস্পিউটের মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত বোধহয় এইটিই।
দীর্ঘ তর্কের মধ্যে ঢুকে কাজ নেই। তবু, শেষ করি দুটি চিঠি দিয়ে। প্রথমটি ১৮০৬ সালের। গাউস লিখছেন ওলবার্স-কে। ৩০শে জুলাই, ১৮০৬। আর পরেরটি গসের বই প্রকাশের পরে।
৩১শে মে, ১৮০৯। লেজাণ্ড্র-র দীর্ঘ চিঠি গাউস-কে। আমি এই দুটি চিঠিই পড়েছি রিচার্ড প্ল্যাকেটের গবেষণাপত্রে, অনূদিত অবস্থাতেই। সেই দুটির-ই একটি করে অংশ, নিচে হুবহু তুলে দিলাম।
চিঠি ১) গসের চিঠি ওলবার্স-কে। (ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী জিনিয়াস গাউস বলছেন যে ওর এমন-ই কপাল যে যাতেই হাত দেন দেখেন লেজান্ড্র-ও সেই এক-ই প্রবলেমে কাজ করছেন। এই এখন যেমন ওঁর মেথড অফ লিস্ট স্কোয়ারস।)
“It seems to be my fate to compete with Legendre in almost all my theoretical works. So it is in the higher arithmetic, in the researches on transcendental functions connected with the rectification of the ellipse, in the fundamentals of geometry, and now again here. Thus, for example, the principle which I have used since 1794, that the sum of squares must be minimized for the best representation of several quantities which cannot all be represented exactly, is also used in Legendre's work and is most thoroughly developed.”
চিঠি ২) লেজান্ড্রর চিঠি গাউস-কে। (লাতিনে "principium nostrum" অর্থ "our method"। লেজান্ড্র ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন কারণ প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সমস্ত প্রায়োরিটি ডিস্পিউট সমাধা হওয়ার কথা শুধুমাত্র গবেষণাপত্র প্রকাশের সময়ক্রম অনুযায়ী। আর কিছুই বিবেচ্য নয়।)
"I will therefore not conceal from you, Sir, that I felt some regret to see that in citing my memoir p. 221 you say "principium nostrum quo jam inde ab anno 1795 usi sumus" etc. There is no discovery that one cannot claim for oneself by saying that one had found the same thing some years previously; but if one does not supply the evidence by citing the place where one has published it, this assertion becomes pointless and serves only to do a disservice to the true author of the discovery. In Mathematics it often happens that one discovers the same things that have been discovered by others and which are well known; this has happened to me a number of times, but I have never mentioned it and I have never called principium nostrum a principle which someone else had published before me. You have treasures enough of your own, Sir, to have no need to envy anyone; and I am perfectly satisfied, besides, that I have reason to complain of the expression only and by no means of the intention."
এই বড়োসড়ো গপ্পের শেষ এইখানেই। তবে, ঈশপের মত দুইটি নীতিবাক্য রেখে যাবো। এক, ব্যঙ্গচিত্র বা ক্যারিকেচার-কে অবজ্ঞা করবেন না। এই যে আমি ও আমরা মাঝেমাঝেই কাগাবগা ছবি আঁকি এঁর-ওঁর, বলা যায় না হয়তো একদিন এইই ওনাদের প্রামাণ্য প্রতিকৃতি হবে। আর দুই, প্রায়োরিটি ডিস্পিউটের ইতিহাস পুরনো হলেও সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। এই নিয়ে মজার ছলেই বিখ্যাত উপপাদ্য স্টিগলার'স ল' অফ এপোনিমি - যার অর্থ কোনো আবিষ্কার-ই, কোনো ল'-ই, আসল আবিষ্কারকের নামে নামাঙ্কিত হয় না। এমন কি স্টিগলারের সূত্র-ও স্টিগলারের নয়। তবুও, ঐ পর্বতপ্রমাণ প্রতিভাদের আদানপ্রদান দেখুন। দীর্ঘ বিতর্ক বা অনুযোগ, অভিযোগের ভাষাও ভদ্র হতে পারে। আজ এই দুশো বছর পরে, খেউড় যখন আমাদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় পর্যবসিত, এই সব ইতিহাস একবার মনে করে নেওয়া মন্দ না।
সূত্রনির্দেশ
[১] লজ্জার মাথা খেয়ে স্বীকার করে নেওয়াই ভালো যে আমি এই সমস্ত ফরাসী ও অন্যান্য দেশের গণিতজ্ঞদের নাম বইতে পড়েই শিখেছি, তাও শুধু ইংরেজিতেই, শুনে শেখার সুযোগ পাই নি। তাই এইবেলা প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে ফরাসী নামের বাংলা উচ্চারণ লিখতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই নাকের জলে চোখের জলে অবস্থা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উইকিপিডিয়া থেকে ফোনেটিক সিম্বলের সাহায্য নিয়েছি, এবং শুনে শুনে আন্দাজে কাছাকাছি বাংলা বানান লিখেছি। আর কয়েক জায়গায় পাতি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছি। এইটুকু নিজগুণে মাপ করে দেবেন। অবশ্য আমার ফরাসী বন্ধুরা আমার নামের যা দুর্গতি করেন, সেই তুলনায় এ তো তুশ্চু।
[২] বলাই বাহুল্য, এই প্রবন্ধের পাঠক এই সব নির্ঘাত জানেন, তাও দুটো 'ইয়ে মানে' জোড়া দরকার। প্রথমতঃ, সরল না হয়ে বক্র হলেও চলবে, দুইয়ের জায়গায় দু-কুড়ি চলরাশি হলেও, লিস্ট স্কোয়ার্স কাজ করতেই পারে, তবে খুব হাই-ডাইমেনশনে চলে গেলে সেই সব জ্যামিতি এক অন্য আশ্চর্য জগৎ, সেখানে আর আমাদের জ্যামিতিক ইনটিউশন কাজ করে না, এবং গাউস কি লেজান্ড্র-র প্রতিপত্তি-ও সামান্য কম। তাই ছেলেবেলায় শেখা সবকিছুই সেখানে অল্প গুবলেট হয়ে যায়। তবে সে এক অন্য দিনের গল্প। আর দুই, "ন্যূনতম দূরত্ব" মাপতে বর্গের সমষ্টি না নিয়ে অ্যাবসোলিউট ভ্যালুর সমষ্টি নিলেও হয়, তাকে বলা হবে 'লিস্ট অ্যাবসোলিউট ডেভিয়েশন' বা ল্যাড, এবং ঐতিহাসিকভাবে অঙ্কের লোকের মাথায় প্রথমে এসেছে ল্যাড, পরে লিস্ট স্কোয়ার্স। লিস্ট স্কোয়ার্সের সুবিধে যে যে জিনিষটাকে মিনিমাইজ় করতে চাই, সেটা ডিফারেনশিয়েবল, তাই সহজেই কষে বের করা যায়, আর অসুবিধে যে অনেক অনেক দূরে চলে গেলে বর্গের হারে এরর বেড়ে একটু ঝামেলা হয়, তার জন্য অন্য ব্যবস্থা।