("Alle Dinge sind Gift, und nichts ist ohne Gift; allein die Dosis macht, dass ein Ding kein Gift ist.")
"What is there that is not poison? All things are poison and nothing is without poison. Only the dose makes a thing not a poison”
(প্যারাসেলসাস, ১৪৯৩-১৫৪১)
বিষ এবং বিষক্রিয়া নিয়ে মানুষের কৌতূহল ঠিক কবে থেকে শুরু তার কোনো ঠিক নেই। প্রাগিতিহাস থেকে এই গতকালের খবরের কাগজ অব্দি প্রায় নিঃশব্দে তার পদচারণা। কিন্তু সেই ইতিহাস রহস্যময়, আকর্ষণীয়, অন্তহীন এবং কিঞ্চিৎ জটিল। “জটিল”, কারণ, বিষ ঠিক কাকে বলে, সেই কড়া সংজ্ঞা দেওয়াই একটু মুশকিল। টক্সিকোলজি, অর্থাৎ বিষবিজ্ঞানের বইয়ের শুরুয়াতেই লেখা, “Toxicology is often regarded as the science of poisons or poisoning, but developing a strict definition for poison is problematic”। শুধু তাই-ই নয়, যে উপাদান খুব সামান্য পরিমাণে দিলে হয়তো জীবনদায়ী ওষুধ হতে পারে, সেই এক-ই বস্তু মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী বিষ।
আর্সেনিক ট্রাইঅক্সাইডের কথাই ধরুন, সামান্য বেশি মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে বিষক্রিয়ায় গা গোলাবে, বমি হবে, তারপর দাস্ত, ক্রমে অর্গ্যান ফেইলিওর, শেষে মৃত্যু। স্বয়ং নেপোলিয়ঁর মৃত্যুর (নাকি হত্যার?) কারণ খুঁজতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন সংরক্ষিত চুলের নমুনায় আর্সেনিকের ঘনত্ব সেই সময়ের একজন সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রায় ৪০-গুণ বেশি। আবার এই আর্সেনিক ট্রাই-অক্সাইডের সাথে অন্য ওষুধের (ট্রিটিওনিন) মিশেলেই তৈরি হয় একটি বিরল ক্যান্সারের (অ্যাকিউট প্রোমাইলোসাইটিক লিম্ফোমা) ওষুধ। আর্সেনিক ছাড়ুন, আপনি রোজ-ই খাচ্ছেন, এই ধরুন জল, কফি, ভাগ্যবান হলে চিনি, সেই সব-ই মাত্রা ছাড়িয়ে খেলে একসময় বিষক্রিয়া হবেই। এই ক্যাফেইন-ই ধরুন, এক কাপ এসপ্রেসোয় ক্যাফেইন থাকে কমবেশি ৬৪ মিলিগ্রাম, আর ক্যাফেইনের ফেটাল ডোজ, অর্থাৎ প্রাণঘাতী মাত্রা ৫০০০ মিলিগ্রামের কাছাকাছি, অর্থাৎ, শুধু কফি খেয়েই পটল তুলতে গেলে আপনাকে খেতে হবে প্রায় ৭৮ কাপ! কিন্তু ঐ সকালে এক কাপ গরম কালো কাপ্পা – ওতে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।
অথবা, যে সব ফলমূল কি শাকসব্জি আমরা প্রায়-ই বাজার থেকে থলে ভরে আনি, তাদের কথাই ভাবুন না কেনে? আপেলের বীজে থাকে অ্যামিগডালিন (০.৬ গ্রাম/কেজি), পেয়ার অর্থাৎ ন্যাসপাতিতে থাকে ফর্ম্যালডিহাইড (~০.০৬ গ্রাম/কেজি), আলু – বিশেষত সবুজ আলুতে থাকে সোলানিন (~০.২ গ্রাম/কেজি), কুর্গেট, যাকে আম্রিকায় বলে যুকিনি (আর বাংলায় ঝিঙের ট্যাঁশভাই) – তাতেও থাকে কিউকারবিটাসিন ই। এই সবকটিই মানুষের দেহের জন্য বিষাক্ত অর্থাৎ “টক্সিক”, কিন্তু তবুও তো দিব্যি আলু[1], আপেল, ঝিঙে খেয়েও বেঁচে থাকে মানুষ, কারণ এই সবকটিই ফলমূল-শাকসব্জিতে এতো কম পরিমাণে থাকে যে তাতে কারুর কোনো ক্ষতিবিশেষ হয় না। অর্থাৎ, কোনো একটি রাসায়নিক যৌগ কোনো খাবারে থাকলেই যে সেটা ক্ষতিকারক পরিমাণে আছে এমন না। এই সারসত্যটিই হয়তো সমস্ত টক্সিকোলজিক্যাল অনুসন্ধানের মূলকথা, যা সেই সুদূর রেনেসাঁর সময় অনুধাবন করেছিলে সুইস চিকিৎসক/বিজ্ঞানী প্যারাসেলসাস। যাঁর পুরো নাম, অরিওলাস থিওফ্রাস্টাস বোম্বাস্টাস ফন হোহেনহাইম, আর ছদ্মনাম “প্যারাসেলসাস”, সম্ভবত প্রাচীন রোমের চিকিৎসক সেলসাসের সঙ্গে মিলিয়ে। প্যারাসেলসাস বলেছিলেন, “Only the dose makes a thing not a poison”, অর্থাৎ শুধু মাত্রার তফাত-ই ঠিক করে দেয়, কোনটা বিষ, আর কোনটা বিষ নয়। আজকের দিনে এই কথাটার তাৎপর্য বোঝা বোধহয় আরও একটু বেশিই দরকারি হয়ে পড়েছে আমাদের সবার জন্যেই, কারণ বিজ্ঞাপন কিংবা মিডিয়া থেকে শুরু করে খবরের বিভিন্ন সূত্রে প্রায়-ই শোনা যায় ভয়-ধরানো সব বিশেষণ, “সাঙ্ঘাতিক বিষ”, “দ্য মোস্ট টক্সিক সাবস্ট্যান্স” ইত্যাদি প্রভৃতি। যা থেকে আমাদের মনে হয় যেন আসলে প্রকৃতিতে একটা দুর্দান্ত বাইনারি ব্যবস্থা আছে - কিছু পদার্থ বিষাক্ত আর বাকি সব নির্বিষ। কিন্তু আরেকটু তলিয়ে দেখলে বোধহয় প্যারাসেলসাসের মতই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনো খুব কঠিন না। আরও সহজ করে বললে, যত বিষাক্ত পদার্থই হোক না কেন, যদি তার একটিমাত্র অণু, একটি মলিকিউল প্রবেশ করে কারুর শরীরে, বাজি রেখে বলা যায় তার কিস্যু হবে না, আবার অন্য দিকে মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে, এমন কী জল-ও প্রাণহানির কারণ হতে পারে। আর তাই, আজকের আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা দূষকের মাত্রা পার্টস পার বিলিয়ন অর্থাৎ পিপিবি এককে মাপতে পারছি যখন, আবার-ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন ‘বিষবিজ্ঞানের জনক’ প্যারাসেলসাস।
মাত্রা তবে মাপবো কী করে? কাকে বলে বায়ো-অ্যাসে, অথবা ডোজ-রেস্পন্স কার্ভ? কাকেই বা বলে LD-50? সেই সব গল্পে আসতে গেলে আমাদের রেনেসাঁ পেরিয়ে এসে অপেক্ষা করতে হবে সেই ১৯৩৫ অব্দি। ওহায়োর স্প্রিংফিল্ডের একজন সাধারণ কিন্তু অসামান্য মানুষ চেস্টার ব্লিসের গল্প বলবো। ব্লিসের গল্পে আসবেন ফ্র্যাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট, আসবে গ্রেট ডিপ্রেশন, রোনাল্ড ফিশার এবং স্তালিন-জমানার লেনিনগ্রাদের গল্প। এবং একটু অঙ্ক, আর নির্বিষ অঙ্কের সাথে একটু বিষাক্ত ইতিহাস। যদিও অঙ্কের মত, ইতিহাস আদৌ আমার বিষয় নয়, তাই আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ইতিহাসবিদ পাঠকদের কাছে।
কতটুকু চাই?
যে কোনো রাসায়নিকের তাৎক্ষণিক বিষক্রিয়া মাপার জন্যে বৈজ্ঞানিকরা মূলত যে পদ্ধতিটি অবলম্বন করেন, সেটির নাম ডোজ়/রেস্পন্স স্টাডি – ডোজ় = মাত্রা অর্থাৎ মুখ, অথবা ফুসফুস অথবা ত্বক দিয়ে মোট যেটুকু পদার্থ শরীরে প্রবেশ করেছে, অর্থাৎ যেটুকু পদার্থে একজন মানুষ “এক্সপোজ়ড” হচ্ছেন। সে খাবারের মাধ্যমে হতে পারে, অথবা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে, অথবা আপনার স্নানের জলে বা সাবান/শ্যাম্পুতে। আর রেস্পন্স = প্রতিক্রিয়া, মাত্রা যত বাড়বে, প্রতিক্রিয়াও বাড়বে তার সাথে পাল্লা দিয়ে। আর সেটাই মাপার জন্য পরীক্ষাগারে বৈজ্ঞানিকরা যে পরীক্ষাটি করেন, তার পোষাকি নাম বায়ো-অ্যাসে। সাধারণত, ইঁদুর বা অন্যান্য প্রাণীদের উপরেই এই বায়ো-অ্যাসে হয়, অনেকগুলি হতভাগ্য ইঁদুর একত্র করে, কয়েকজনের উপর এক্কেবারে সবথেকে কম মাত্রা, আর বাকিদের উপর মাঝারি বিভিন্ন স্তর, আর কয়েকজনের উপর সর্বোচ্চ। আর এর পাশে থাকে আরেকটি ‘কন্ট্রোল’ গ্রুপ যাদের বাকি সব এক, শুধু তাদের এই রাসায়নিক এক্সপোজারটি হয়নি, অর্থাৎ তাদের সবার ডোজ় শূন্য। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাপা উদ্দেশ্য হলেও সাধারণত ১৪ দিন ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয় বেচারি ইঁদুরদের, যাতে কিছুটা সময় পাওয়া যায়। ১৪ দিন পেরিয়ে গেলে গোনাগুনতি হয়, কোন ডোজ়ের গ্রুপে কতগুলো হতাহত? এবং, এখান থেকেই প্রশ্ন আসে, যে মাত্রা বাড়াতে থাকলে ঠিক কী ভাবে প্রতিক্রিয়াটি বাড়ে বা কমে? কোন সূত্র ধরে?
এই ধাঁধাটাই সমাধান করেন আমাদের গল্পের দ্বিতীয় প্রোটাগনিস্ট চেস্টার ব্লিস। ব্লিস এন্টমোলজ়ি নিয়ে পড়াশুনো শেষ করে ১৯২০-র দশকে যোগ দেন ইউ-এস-ডি-এ, অর্থাৎ আমেরিকান সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচারে। ওঁর কাজের অন্যতম একটি বিষয় ছিলো আঙুর পাতার পোকার জন্য উন্নত কীটনাশক তৈরি করা, কিন্তু কাজে যোগ দেওয়ার পর ব্লিস অচিরেই বুঝতে পারেন যে বাইরের উন্মুক্ত পরিবেশে কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা না করে, ল্যাবোরেটরির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে করাই শ্রেয়। এবং, সেই পরীক্ষাগুলি করতে করতে ব্লিস দুটো জিনিষ খেয়াল করেন। প্রথমত, যত বেশি ডোজ়েই কীটনাশক দেওয়া হোক না কেন, দু-একটা পোকা কেমন করে যেন বেঁচে যাচ্ছে, আবার উলটো দিকে যত কম ডোজ়-ই দেওয়া যাক, দু-একটা ঠিক তাতেও পটকে যাচ্ছে। অর্থাৎ, সব পোকার সহ্যক্ষমতা এক-ই নয়, কেউ অল্পেই কুপোকাৎ, কেউ নাছোড়বান্দা। রাশিবিজ্ঞানের ভাষায় একে আমরা বলবো ইনডিভিজুয়াল ভ্যারিয়েবিলিটি। আর ব্লিস এ-ও খেয়াল করেন, যে একটা কাগজে যদি একটি রেখচিত্র এঁকে তার অনুভূমিক অক্ষে (এক্স-অ্যাক্সিস) ডোজ় বা মাত্রা, আর উল্লম্ব অক্ষে (ওয়াই-অ্যাক্সিস) শতকরা মৃত্যুর হার প্লট করি, তাহলে তার আকৃতি হবে অনেকটা লম্বাটে S অক্ষরের মতন, যাকে আমরা বলি সিগময়েড কার্ভ। তাই, মাত্রা বাড়লে মৃত্যুর হার বাড়ে, কিন্তু সরলরৈখিক ভাবে নয়, বরং কিছুটা এই এস-আকৃতির রেখায়, শুরুতে খুব আস্তে, মাঝে চড়-চড় করে, আবার একটা মাত্রা পেরিয়ে গেলে আবার আস্তে। ১৯৩৪ সালে ব্লিস বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালে একটি গবেষণাপত্রে এই ধরণের তথ্য-উপাত্ত মডেল করার একটা নতুন মডেল প্রস্তাব করেন, আর সেই মডেলের নাম দেন প্রবিট – প্রোবাবিলিটি ইউনিটের সংক্ষেপিত রূপ। বলাই বাহুল্য, এই গ্রাফের উল্লম্ব অক্ষে যে চলরাশিটি সেটি প্রোবাবিলিটি – মৃত্যুর সম্ভাব্যতা। ব্লিসের প্রবিট পদ্ধতিতে ঐ প্রোবাবিলিটি-র সংখ্যাটিকে মডেল করা হয় নর্ম্যাল ডিস্ট্রিবিউশনের সাহায্যে। এখানে বলে রাখা উচিত, যে ব্লিসের আবিষ্কার অন্তত সেই প্রাক-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কালে রাশিবিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এক বিশাল লাফ। এই রকমের তথ্যে অন্যান্য যে সব মডেল দেখতে আমরা অভ্যস্ত – সেসবের আসতে তখন-ও ঢের বাকি। আর এটাও বলা উচিত যে ব্লিসের সেইসময়কার অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন স্বয়ং রোনাল্ড ফিশার। প্রবিট মডেল ফিট করার একটি সহজ উপায় বাতলে দেন ফিশার – এবং, ১৯৩৫ সালের অ্যানালস অফ অ্যাপ্লায়েড বায়োলজ়ি-তে প্রকাশিত ব্লিসের পেপারে একটি অ্যাপেনডিক্স লেখেন ফিশার।
এইরকম সিগময়েড কার্ভ ফিট করানোর অন্যতম লাভ যে এর ফলে ডোজ়-রেস্পন্স স্টাডি থেকে জানা যায়, যে ঠিক কতটা মাত্রায় একটি পদার্থ একটা অর্গ্যানিজ়মের জন্য কতটা মারাত্মক। এর-ই একটি বিশেষ মাত্রা - এল-ডি-৫০, LD50 - মিডিয়ান লিথাল ডোজ়, যার ব্যবহারিক অর্থ: যদি অনেকগুলি প্রাণীর উপরে ঐ পদার্থ ‘প্রয়োগ’ করা হয়, তাহলে ঠিক ঐ LD50 মাত্রার পদার্থ শরীরে প্রবেশ করলে ঐ দলের ৫০% বা অর্ধেক বেঁচে থাকবে। নিচের ছবিটি দেখলে LD50 ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে, আমরা Y = 50% থেকে একটা সোজা লাইন টেনে ঐ লম্বা S-পানা বক্ররেখাটিকে ফুটো করে ঠিক সোজা নিচে নেমে X-অক্ষের যেখানে পা রাখবো, সেটাই LD50। এই ছবিতে যেমন সায়ানাইডের জন্য এই মাত্রা ~১.৫ মিগ্রা/কেজি। বলাই বাহুল্য, যে পদার্থে LD50 যত কম, সে তত-ই বিষাক্ত।
এই যেমন, বটুলিন – ঠিক করে ক্যান না করা খাবারে অথবা পচা মাছ-মাংসে ক্লস্ট্রিডিয়াম বটুলিনাম নামে একটি ব্যাক্টেরিয়া এই টক্সিনটি তৈরি করে – ফল বটুলিজ়ম। বটুলিনের ক্রিয়ায় মাংসপেশীতে স্নায়বিক সংকেত যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়, ফল প্যারালাইসিস, আর চরম পরিণতি শ্বাসরোধ, এবং মৃত্যু। ইঁদুরের উপর করা পরীক্ষায় বটুলিনের LD50 0.00001 মিগ্রা/কেজি, আর একজন ৭০ কেজি পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য ০.৩৫ গ্রামের কিছু কম (আন্দাজ)। বটুলিনকে তাই ক্লাসিফাই করা হয় “সুপার টক্সিক” হিসেবে। আবার ধরুন অ্যাস্পিরিনের মূল উপাদান অ্যাসিটাইলস্যালিসাইলিক অ্যাসিড, তার LD50 ৫০০-৫০০০ মিগ্রা/কেজি, অর্থাৎ, একজন ঐ সত্তর কেজির মানুষের জন্য ৩৫-৩৫০ গ্রাম, আর একটা বড়ির ওজন? মাত্র ৩২৫ মিলিগ্রাম। তাই, টক্সিনের ক্যাটেগরিতে বটুলিনের দলের নাম “সুপার টক্সিক”, আর অ্যাস্পিরিন নেহাত-ই “মডারেটলি টক্সিক”। আবার চিনির জন্য ঐ LD50 ১৫০০০ মিগ্রা/কেজির-ও কিছু বেশি। ঐটি তাই “প্র্যাকটিক্যালি নন-টক্সিক”, কার্যত নির্বিষ। এইরকম বেশ কিছু যৌগের নাম আর মাত্রা দেওয়া রইল পুনশ্চ-র একটি সারণিতে।
এখানে দুটো মন্তব্য বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এক, এক-ই পদার্থ কোনো প্রাণীর জন্য খুব-ই ক্ষতিকর কিন্তু অন্য প্রাণীর জন্য একেবারেই নয় এমন আকছার ঘটে। কারণ এক-এক প্রাণীর বিপাক অর্থাৎ মেটাবলিজ়ম এক-এক রকমের। মানুষের জন্য চকোলেটের LD50 অনেক বেশি, কুকুরের থেকে। ফলে, শুধু চকোলেট খেয়ে একজন মানুষের আত্মহত্যা করা বেশ কঠিন, কিন্তু বেচারি কুকুর কয়েকটা চকোলেট বার খেয়ে ফেললেই আর রক্ষে নেই। চকোলেটের থিওব্রোমিন যৌগের LD50 কুকুরদের জন্য ২০-১০০ এমজি/কেজি আর মানুষের আন্দাজ প্রায় ১০০০। আবার ডাইওক্সিনের জন্য – হ্যামস্টারের LD50 গিনিপিগের থেকে ৫০০০ গুণ বেশি! কোনো মানে হয়? (ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত কুখ্যাত এজেন্ট অরেঞ্জের অন্যতম একটি উপাদান এই ডাইওক্সিন।)
আর দুই, মানুষ বা এমনকি কুকুর আজেবাজে কিছু খেয়ে ফেললে বমি করে উগরে দিতে পারে, রোডেন্ট-জাতীয় কোনো প্রাণীর সেই ক্ষমতা নেই। বেচারিদের ডায়াফ্রাম কমজোরি, এবং পেটটিও নাদাবিশেষ। ভাবলে খুব-ই কষ্ট লাগে, অস্বীকার করবো না। কে জানে হয়তো এই পাপেই আমরাও বাধ্য হচ্ছি বিভিন্ন রকমের বিষ ক্রমাগত গিলে যেতে, যা ওগরানোর আর কোনো জায়গা নেই। আর হ্যাঁ, শুধুমাত্র নিরাবেগ বৈজ্ঞানিক দিক থেকে দেখলেও এর একটা বাজে দিক এই যে কোনো কোনো ওষুধ পরীক্ষাগারে সফল হলেও মানুষের আর কাজে লাগে না। রোলিপ্র্যাম নামে একটি অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট এই দলে – ইঁদুর মস্তিষ্কে দিব্য কাজ করলেও, মানুষ সে জিনিষ খেলেই অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে চলে আসে।
মোদ্দা কথা, ইঁদুর বা অন্য অ্যানিম্যাল স্টাডি থেকে পরীক্ষালব্ধ LD50 থেকে বিভিন্ন রাসায়নিকের ক্ষমতার একটা আন্দাজ পাওয়া গেলেও, ইঁদুরের থেকে মানুষে লাফ দিয়ে পৌঁছনোর কাজটা সহজ নয়। বাস্তবে, এইসব পরীক্ষাগার ছাড়াও আমরা বিভিন্ন সার্ভে, হাসপাতালের এমার্জেন্সি বা করোনার’স অফিস থেকে পাওয়া রিপোর্ট, বা ফরেন্সিক রিপোর্ট থেকেও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করি। বলাই বাহুল্য, সেই সব বিকল্প পদ্ধতির-ও প্রচুর সীমাবদ্ধতা আছে, বিশেষ করে যদি একাধিক দ্রব্য এক-ই সাথে প্রবেশ করে শরীরে, তবে সে আলোচনা অন্য একদিন।
তবুও, এটা বলে রাখা উচিত যে এই LD50 অর্থাৎ মিডিয়ান লেথাল ডোজ় শুধুই সমষ্টির কথা বলে, ব্যক্তির নয়, তার একটা অন্যতম কারণ যে এক-এক মানুষের (বা প্রাণীর) বিপাক-ক্রিয়া এক-এক রকম। যে মাত্রার ‘বিষ’ একটি ইঁদুরের জন্য প্রাণঘাতী, সেই এক-ই বিষে অন্য একটি হয়তো শুধুই ঝিমোবে। এই ‘ভুল’ কি মানুষের-ও হয় না? দলের একজন প্রভূত নেশা করেও দণ্ডায়মান মানেই আমিও যে ঐ এক-ই নেশা করে এমার্জেন্সিতে পৌঁছে যাব না চৌদোলায়, এর কোনো গ্যারান্টি-ই নেই। এই যেমন ধরা যাক ইথাইল অ্যালকোহলের মিডিয়ান লিথাল ডোজ় প্রায় ৩৩০ গ্রাম, আর এফেক্টিভ ডোজ় তার দশভাগের এক ভাগ প্রায় ৩৩ গ্রাম। মানে দুই শট ভদকা বা দু-ক্যান বিয়ার খেলে হাল্কা ঝিল আসতেই পারে (যাকে বলে ‘রিল্যাক্সড অ্যাফেবিলিটি’), কিন্তু, খালি পেটে মোটামুটি অল্প সময়ের মধ্যেই কেউ তার দশগুণ খেয়ে ফেললে?
এই যে ‘লিথাল’ আর ‘এফেক্টিভ’ ডোজ়ের অনুপাত, রিক্রিয়েশনাল ড্রাগসের বেলায় এইটিও ব্যবহার করা হয় বিপদের মাত্রা বুঝতে। এই যেমন হেরোইন – বেশ বিপজ্জনক, লিথাল আর এফেক্টিভের অনুপাত ১০-এরও কম। কোকেইন বা এমডিএমএ ইত্যাদি একটা বেশ বড়সড় গ্রুপের জন্য এই অনুপাত ১০ থেকে ২০-র মধ্যে। এদের পরের গ্রুপে রোহিপনল, যার ডাকনাম রুফি, ঐ ২০ থেকে ৮০, আর সবথেকে কম বিপজ্জনক রিক্রিয়েশনালের দলে সাইলোসিবিন মাশরুম আর আমাদের ভোলেবাবা, এদের রেঞ্জ ১০০ থেকে ১০০০! সত্যি বলতে, ফুঁকে খাওয়া গাঁজার সত্যিকারের লিথাল ডোজ় কত, সেটা এই প্রবন্ধ লেখার সময় আমার জানা নেই, তবে ১০০০-এর বেশি এমন আন্দাজ করা হয়। বিভিন্ন নেশাদ্রব্যের লিথাল/এফেক্টিভ অনুপাত নিচের ছবিতে দেওয়া হ’ল।
ব্লিসে বিষক্ষয়
বলাই বাহুল্য, এই ডোজ় রেসপন্স কার্ভ ফিট করার যে কলটি চেস্টার ব্লিসের অক্লান্ত চেষ্টার ফসল– অর্থাৎ প্রবিট রিগ্রেশন - সেটি টক্সিকোলজ়ির এবং রাশিবিজ্ঞান – দুইটি শাখার জন্যই যথেষ্ট যুগান্তকারী আবিষ্কার। ব্লিসের সময় যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করে তথ্য-উপাত্ত-র বিশ্লেষণ করা হত, তাতে এমন প্রায় একটিও অস্ত্র ছিলো না যাতে সহজে বিষের মাত্রা মাপা যায় পরীক্ষামূলকভাবে।
কিন্তু কেমন ছিল ব্লিস-সায়েবের জীবন? সে গল্প কিছুটা ভয়ের, তবে অনেকটাই আমাদের চেনা, অন্তত, এই ২০২৫-এর এপ্রিলে দাঁড়িয়ে। ১৯৩২ সালে অর্থাৎ প্রায় একশো বছর আগে, ফ্র্যাঙ্কলিন রুজ়ভেল্ট প্রেসিডেন্ট-পদপ্রার্থী হলেন। সাধারণ মানুষের তখন ব্যুরোক্রেসি, অর্থাৎ আমলাতন্ত্রের উপর প্রবল অনাস্থা। রুজভেল্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা কমাবেন (আরেকভাবে বলতে গেলে, গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি বাড়াবেন, এখন মাস্ক যা করছেন)। সে প্রতিশ্রুতি রাখতেই ঐ ইউ-এস-ডি-এ’র কোনো এক কেষ্টুবিষ্টু, অর্থাৎ, সহকারীর-সহকারীর-সহকারী কর্তা সিদ্ধান্ত নিলেন - যেহেতু কীটনাশক মাঠে ব্যবহার হওয়ার কথা, তাই এগুলোর ওপর ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কোনো প্রয়োজন নেই। ফলে ১৯৩৩ সালে চাকরি হারান চেস্টার ইটনার ব্লিস। ঠিক সেই সময়ে আমেরিকায় চলছে প্রবল মন্দা - গ্রেট ডিপ্রেশন—বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দার সময়। ১৯২৯ সালের শেয়ারবাজার ধস দিয়ে যার শুরু, ১৯৩০-এর দশকজুড়ে দুর্ভিক্ষ, বেকারত্ব আর অর্থনৈতিক অস্থিরতা যার পরিণাম। এই সময়ে আমেরিকায় নতুন চাকরি পাওয়া কার্যত অসম্ভব - চাকরিচ্যুত ব্লিস চলে গেলেন ইংল্যান্ডে, রোনাল্ড ফিশারের (১৮৯০–১৯৬২) পরিবারের সাথে থাকতে। ফিশার নিজের কর্মক্ষেত্রে ব্লিসের জন্য ল্যাবরেটরির ফেসিলিটির ব্যবস্থা করতে পারলেও চাকরি-বাকরি জোটাতে পারেননি সঙ্গে-সঙ্গে, তবুও ব্লিস লণ্ডনে থেকে প্রবিট মেথডের উপরেই ফিশারের সাথে আরও কিছুদিন কাজ করেন, কিছু ফাঁক-ফোঁকর ভরাট করেন কয়েক মাসে।
এর কিছুদিনের মধ্যেই ফিশার ব্লিসের জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করেন—লেনিনগ্রাদে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ)। অতএব, ১৯৩৫ সালে ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যান্ট প্রোটেকশন - তিন বছরের চুক্তিতে কাজে যোগ দেন ব্লিস। গোটা ইউরোপ ট্রেনে অতিক্রম করে, একটিমাত্র স্যুটকেসে কয়েকটি জামাকাপড় নিয়ে লেনিনগ্রাদে এসে পৌঁছলেন তিনি। সারাজীবনে ইংরেজি ছাড়া একটিও ভাষা না শেখা, চূড়ান্ত অরাজনৈতিক, একেবারেই আমেরিকান মিড-ওয়েস্টার্ন মানুষ ব্লিস এসে পৌঁছলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রে, যেখানে ধীরে ধীরে সমস্ত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীদের একে একে সরিয়ে ক্ষমতায় আসছিলেন যোসেফ স্তালিন। ইন্সটিটিউটের কাছেই যে বাড়িতে ভাড়া উঠলেন ব্লিস, সেই বাড়ির মালকিন জানেন না ইংরেজি, ব্লিস জানেন না রুশী ভাষা। ভাগ্যক্রমে আলাপ হয়ে গেলো এক স্বেচ্ছাসেবী আমেরিকান তরুণীর সাথে, আদর্শের প্রেরণায় (বা তাড়নায়) সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই বৃহৎ যৌথ খামারের দুনিয়ায়।
কিন্তু, মারে হরি, রাখে কে? চাকরিতে যোগ দেওয়ার অল্পদিনের মাথায়, লেনিনগ্রাদে ব্লিসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে মস্কো ডেকে পাঠানো হয় সামান্য প্রশ্নোত্তরের জন্য। সে বস ঘরে ফেরে নাই। তারও কিছুদিন পর, যে ভদ্রলোক ব্লিস-কে চাকুরি দিয়েছিলেন, তাকেও ডেকে পাঠানো হয় মস্কো। ফেরার পথে অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে আত্মহত্যা করেন তিনিও। ব্লিস-ও সন্দেহাতীত ছিলেন না – কমিউনিস্ট পার্টির অচিরেই ধারণা হয় ঐ আপাত-নিরীহ বৈজ্ঞানিকের বেশে ব্লিস আসলে একজন আমেরিকান গুপ্তচর। মস্কোয় সেই কুখ্যাত ইন্টারোগেশন অর্থাৎ "জবাবদিহির ট্রায়াল"-এর মুখোমুখি হতে হয় ব্লিসকে। ডেভিড স্যালসবার্গের বইতে এই অংশের মজাদার বর্ণনা আছে, এবং সেটি স্বয়ং ব্লিসের জবানিতে শোনা গল্প। সেই গল্প অনুযায়ী, জিজ্ঞাসাবাদ-কক্ষে কারা থাকবেন, ব্লিস তা আগে থেকেই জানতেন বান্ধবীর সূত্রে, কারণ সে বান্ধবী পার্টির সদস্যা। কিন্তু শত সাবধানবাণী সত্ত্বেও, ব্লিস ঢুকেই একজন অধ্যাপককে চিনতে পারেন, এবং তাকে সপাটে বলে বসেন, যে ঐ ভদ্দরলোকের সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রটি তাঁর পড়া, তো সেই পত্রে যে ডিজাইনটি অধ্যাপক প্রস্তাবনা করেছেন, সেটিই কী সন্ত লেনিন ও সন্ত মার্ক্সের মহান বাণীর অনুসারী? আগেই বলেছি, ব্লিস ছিলেন মোনোলিঙ্গুয়াল, দোভাষী ভয়ে প্রশ্নের অনুবাদ করতে পারছেন না সেখানে। ব্লিস আবার-ও বলেন, ঐ ডিজাইন-ই কি তাহলে ‘অফিশিয়াল পার্টি লাইন?’ ঐভাবেই[2] এগ্রিকালচারাল ডিজাইন করতে হবে এমন কথা কী লেখা আছে পার্টির কেতাবে? যদি থাকে, তাহলে ব্লিস স্বীকার করেন নিচ্ছেন যে উনি ঐ মহান কমিউনিস্ট ধর্মের অবমাননার দায়ে দোষী, এবং সেই অর্থে তিনি একজন প্রকৃত নাস্তিক। শেষমেশ কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, ব্লিস শুধু একজন নিরীহ, অজ্ঞ আমেরিকান বৈ কিছু নন – এরকম লোককে গবেষণা করতে দেওয়া যেতেই পারে, শুধু শর্ত এই —কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে হবে। এই সদস্যপদ থাকার দোষে, অনেক পরে ১৯৫০-এর দশকে আমেরিকান সরকার ব্লিস-কে পাসপোর্ট দিতে অস্বীকার করবে, তবে সে গল্প অন্য। ব্লিস লেনিনগ্রাদে ফিরে প্রবিট মডেলের উপরেই গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন, পেপার লেখেন এক-এক করে, যতক্ষণ না রাশিয়ায় বিজ্ঞানীদের পক্ষে টিকে থাকাই বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। একদিন সেই আমেরিকান বান্ধবী আচমকা উপস্থিত হন ব্লিসের সেই ল্যাবটিতে, প্রায় জোর করে ঐ সুটকেস বগলদাবা করেই সেইদিন-ই লেনিনগ্রাদ থেকে পালিয়ে আসেন ব্লিস - রিগা, লাটাভিয়াতে।
১৯৩৮ সালে শেষমেশ আমেরিকায় ফেরেন ব্লিস। প্রথমে যোগ দেন কানেক্টিকাট এগ্রিকালচারাল এক্সপেরিমেন্ট স্টেশনে। তারপর ১৯৪২-১৯৬৭, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে। এর-ই মধ্যে ১৯৪৭ সালে ব্লিস আরও কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে তৈরি করে ফেলেন ইন্টারন্যাশনাল বায়োমেট্রিক সোসাইটি – আই-বি-এস। কারণ? সেই বছরের ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটের (আই-এস-আই, কিন্তু এ বড় আই-এস-আই) কনফারেন্সে গিয়ে ব্লিস দেখেন যে কনফারেন্সে বায়োমেট্রিক কাজের প্রায় কিছুই নেই। “It seemed to me outrageous that the field which led all others should have been treated so shabbily."। আনন্দের কথা এই যে, বায়োমেট্রি, বায়োস্ট্যাটিস্টিক্স, বায়োইনফরম্যাটিক্সের সে দুর্দিন বহুদিন হল ঘুচেছে। এখন সেই আই-বি-এস বৃহৎ একটি সংস্থা, প্রায় পাঁচ-ছ’হাজার সদস্য নিয়ে উত্তর আমেরিকার অন্যতম রাশিবিজ্ঞানের কনফারেন্স ইনারের আয়োজক। স্যালসবার্গ জানিয়েছেন, এই সব ঘটনার অনেক-অনেক পরে, ১৯৬০-এর দশকে রাশিয়াতে ব্লিস ফেরৎ যান। ততোদিনে ব্লিস আই-এস-আইয়ের ফেলো, স্বনামধন্য মানুষ। লেনিনগ্রাদ গিয়ে দেখেন সেই সময়কার চেনা কেউ-ই আর বেঁচে নেই, কেউ মারা গেছে স্তালিনিস্ত পার্জ-এ, কেউ বিশ্বযুদ্ধের আগুনে। শুধু সেই রাশান বাড়িউলি তখনও বেঁচে, আবার বছর কুড়ি পরে সেই সেই এক-ই ভাবে দেখা হয় তাদের।
শুরু করেছিলাম প্যারাসেলসাসের গল্পে। শেষ করবো আবার তাঁর-ই গল্পে। তিনিও এক বিচিত্র বর্ণময় চরিত্র। প্রচণ্ড বুদ্ধিমান এবং পণ্ডিত - কিন্তু ভয়ানক কুঁদুলেও। প্রায় কখনই এক জায়গায় থিতু হতে না পেরে নানা দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারাজীবন, কিন্তু সেই ভ্রাম্যমাণ অবস্থাতেই লিখে গেছেন একের পর এক প্রামাণ্য গ্রন্থ। যদিও স্বভাবদোষে প্রকাশ করতে দেরি হয়েছে অনেক। বিষ যে শুধু মাত্রা-নির্ভর, সেই বিখ্যাত উক্তিটি যে বইতে সেটিই লেখা হয় ১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দে-এ আর প্রকাশিত হয় ১৫৬৪। প্যারাসেলসাসের দর্শন তবুও ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দুনিয়ায়। শুধু পশ্চিম গোলার্ধের গজদন্তমিনার নয়, প্যারাসেলসাসের উল্লেখ পাই স্বয়ং বঙ্কিমের লেখায়, বঙ্গদর্শনে।
“প্যারাসেলসাস আজ বুঝিয়াছেন, “সময় বহিয়া যায়” এ কথার অর্থ কি ? জীবন সম্বন্ধে প্যারাসেল্সাস কি লিখিয়াছেন ? পৃষ্ঠা উল্টাইয়া দেখা গেল, লেখা রহিয়াছে -- “সময় বহিয়া যায়, যৌবন চলিয়া যায়, জীবন স্বপ্নমাত্ৰ—কালের এই অবিরাম ধ্বনি। যত লোক জন্মিয়াছে, সবাই এ কথা শুনিয়াছে এবং বলিয়াছে । তবু, ঋতুর পর ঋতু আসে-যায়, মানুষ হাসিয়া খেলিয়া সময় কাটায়—হঠাৎ একটা মুহূৰ্ত্ত আসে, যখন চকিতে কথাটার অর্থ পরিষ্কার হইয়া যায়— এবং সেই মুহূৰ্ত্ত হইতে চিরকাল তাহার কুঞ্চিত ললাট, তাঁহার নিষ্প্রভ চক্ষু বলিয়া দিতে থাকে যে, ঐ প্রবাদবাক্যটির অর্থ সত্যসত্যই সে বুঝিয়াছে।”—এইরূপে প্যারাসেলসাস তাহার সাধনা ও সিদ্ধির মোট শিক্ষাটি লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।“
সময় সত্যিই বহিয়া যায়, লেখাও দীর্ঘতর হতে থাকে, তবু গল্পের কী শেষ আছে? তাই এই প্রবন্ধ এইখানে শেষ। বিষের ইতিহাস অথবা ইতিহাসের বিষ - কিছুই ঠিক করে লেখা হ'লো না। আশা করি সে-ও আরেকদিন হবে।
যাওয়ার আগে, মনে করিয়ে দিয়ে যাই, প্যারাসেলসাসের মোটো, প্রতিকৃতির উপরেও যেটি উৎকীর্ণ। এই বিষাক্ত সময়ে, এই গড্ডলিকা প্রবাহের মধ্যে যে কথাটা ভুলে গিয়েছি সক্কলেই!
"Alterius not sit, qui suus esse potest." অর্থাৎ, “Who can be himself, shall not belong to someone else."
পরিশিষ্ট:
[1] আলু খেলে যে ঘিলু ভেস্তিয়ে যায়, আর বুদ্ধি গজায় না, এ কথা বলেছেন সুকুমার রায়, আশা করি সোলানিন তার কারণ নয়।
[2] ব্লিসের এই সময়ের গল্প দুর্দান্ত বর্ণনা আছে ডেভিড স্যালসবার্গের লেখায়। স্যালসবার্গের গল্পে, ব্লিসের দেখা সেই পেপারটিতে চাষের জমির সমস্ত প্লটেই এক-ই ট্রিটমেন্ট, অর্থাৎ, এক-ই সার/কীটনাশক/অন্যান্য জিনিষ, প্রয়োগ করা উচিত বলে দাবী করা হয়েছিল, সাম্যবাদের সূত্র মেনে, আর ব্লিস ফিশারের স্কুলে দীক্ষিত – উনি জানতেন যে ঐভাবে এক্সপেরিমেন্ট ডিজ়াইন করে না, এক-একটা প্লটে এক-এক রকমের ট্রিটমেন্ট না দিলে বোঝার উপায় নেই কোনটা কেমন ফসল দেবে। তবে, এই গল্পটা আমার কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। অগত্যা, পাদটীকা।
বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের মিডিয়ান লিথাল ডোজ় তালিকা
LD₅₀ (মিডিয়ান লেথাল ডোজ) বলতে বোঝায় এমন মাত্রা—যা একটি নির্দিষ্ট প্রাণীদলের অর্ধেককে (৫০%) একক ডোজে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এটি সাধারণত মিগ্রা/কেজি (মিলিগ্রাম প্রতি কেজি শরীরের ওজন) এককে প্রকাশ করা হয়। টেবিলের LD₅₀ মানগুলি ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে প্রাপ্ত। এই মানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে নির্ধারিত হয় এবং মানুষের ক্ষেত্রে আনুমানিক হিসেব দেওয়া হয়। মূলসূত্রঃ https://www.chemicalsafetyfacts.org/wp-content/uploads/ATR_Chapter1_X.pdfপদার্থ (Substance) | মন্তব্য (Comments) | LD₅₀* (মিগ্রা/কেজি) |
বটুলিন (Botulin) | অত্যন্ত বিষাক্ত একটি যৌগ। ঠিক করে ক্যান না করা খাবারে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি হয়; খাদ্য বিষক্রিয়ার মারাত্মক রূপ ‘বোটুলিজম’-এর কারণ। | 0.00001 |
আফ্লাটক্সিন (Aflatoxin) | শস্য ও বাদামে mold থেকে তৈরি ক্যানসার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক, কিছু পিনাট বাটার ও অন্যান্য বাদামজাত দ্রব্যে পাওয়া যায়। | 0.003 |
সায়ানাইড (Cyanide) | অতিবিষাক্ত পদার্থ, যা এপ্রিকট ও চেরির বীজে পাওয়া যায় এবং প্লাস্টিক, ইলেক্ট্রোপ্লেটিং ও রাসায়নিক উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় | 10 |
ভিটামিন ডি (Vitamin D) | মানবদেহের খাদ্যতালিকায় অপরিহার্য, তবে স্বাভাবিক খাদ্যমাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় গ্রহণ করলে বিষক্রিয়া ঘটায় | 10 |
নিকোটিন (Nicotine) | প্রাকৃতিকভাবে তামাকে পাওয়া যায়। সিগারেটে আসক্তি বাড়াতে যোগ করা হয়। | 50 |
ক্যাফেইন (Caffeine) | কোকো ও কফি বীজে পাওয়া যায়; একটি সাধারণ খাদ্য উপাদান | 200 |
অ্যাসিটাইলসালিসাইলিক অ্যাসিড (Acetylsalicylic acid) | অ্যাসপিরিনের সক্রিয় উপাদান | 1,000 |
সোডিয়াম ক্লোরাইড (Sodium chloride) | সাধারণ লবণ | 3,000 |
ইথানল (Ethanol) | বিয়ার, ওয়াইন ও অন্যান্য মদ্যপ পানীয়ের অ্যালকোহল | 7,000 |
ট্রাইক্লোরোইথিলিন (Trichloroethylene) | একটি দ্রাবক এবং ভূগর্ভস্থ ও পৃষ্ঠজলের সাধারণ দূষক | 7,200 |
সিট্রিক অ্যাসিড (Citric acid) | কমলা, জাম্বুরা, লেবু ইত্যাদি সাইট্রাস ফলে পাওয়া যায় | 12,000 |
সুক্রোজ (Sucrose) | চিনি; আখ বা চিনি বিট থেকে পরিশোধিত | 30,000 |