
রাসের আলো নিভলেই যে গল্পের শুরু
অয়ন মুখোপাধ্যায়

রাত একটা পেরিয়ে গেছে। রাসের মেলার ভিড় তখনও কমেনি। আমি, রানা আর অরিন্দম — তিনজন বহুদিন পরে একসাথে মেলার ঢাকের আওয়াজের ভেতর দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম তারপর অনেক রাত্রে বাড়ি ফেরার পথে রাসের ভিড় দেখে মনে হল, গ্রামটা আর আগের মতো নেই। আমাদের শৈশবের শ্রীপুর বলাগড়কে মনে পড়লে আজকের এই ভিড়কে অচেনা লাগে — যেন গ্রামের শরীরে শহরের ছায়া ঢুকে পড়েছে এবং সেই ছায়াই এখন আসল রূপ নিচ্ছে। জনপদের অন্তর্গঠন বদলে যাচ্ছে — পোশাক আশাক হাঁটার ধরণ, কথার গতি, সম্পর্কের ভঙ্গি, উৎসবের ভাষা সবই আলাদা। গোপনে, অদৃশ্য সুড়ঙ্গ দিয়ে শহর প্রবেশ করেছে এই গ্রামে। তবু এই পরিবর্তনের আড়ালেও কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে — রাসের আলোয় সেই চিহ্নগুলোই জেগে ওঠে। মনে হয় আমি কেবল দর্শক নই; আমি একজন সাক্ষী — একটি জনপদের দীর্ঘ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে হাঁটছি। এই মেলার আওয়াজে পুরোনো জনপদের অসংখ্য ছাপ ভেসে ওঠে লোকধর্ম, পুরাণ, নদীপথ, কৃষির রুটিন, মানুষের অর্থনৈতিক সংগ্রাম, উৎসবের মায়াবী যৌথতা। রাস যেন এক লুকোনো সাংস্কৃতিক আর্কাইভ — যেখানে প্রতিটি মানুষের প্রতিদিনের জীবন খণ্ডিত টুকরো হিসাবে জমে আছে।

লোকধর্মের ভিতরে রাস — জনপদের গভীর শিকড়
শ্রীপুর–বলাগড়ের রাস উৎসব কখনোই কেবল বৈষ্ণবীয় আচার নয়। এটি লোকধর্ম, সমাজবিন্যাস এবং গ্রামীণ জীবনসংস্কৃতির একটি সহাবস্থান। ইতিহাসবিদ সুহৃদকুমার সরকার তাঁর Popular Cultures of Bengal–এ লিখেছেন — “গ্রামীণ ধর্মচর্চার শক্তি তার অভিযোজন ক্ষমতায়; বৈষ্ণব আখ্যান লোকা চারের হাতে নতুন অর্থ পায়।” আমাদের এই রাসের ক্ষেত্রেও তাই। রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা এই উৎসবের মুখ্য পুরাণ, কিন্তু মানুষ সেটিকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে এসেছে। কারও কাছে এটি কৃষি চক্রের সূচনা, কারও কাছে শীতের আগমনীর সঙ্কেত, কারও কাছে অশুভের বিরুদ্ধে আলোর মঙ্গলধ্বনি।লোকধর্ম কখনো একমাত্রিক নয়—এর নিচে থাকে বহুস্তরের অনুভূতি, স্মৃতি, ভয়, ইতিহাস। তাই রাসের বড়ো মোটিফের ভিতরে জন্ম নেয় আরও অসংখ্য ক্ষুদ্র মোটিফ এটি এক জীবন্ত সাংস্কৃতিক organism এ অঞ্চলের টপোগ্রাফিও রাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নদীর ভাঙন, চর গঠনের ইতিহাস, গ্রাম-স্থানান্তর — সবই মেলার লোকাচার ও বিশ্বাসে স্তর তৈরি করেছে। উৎসবের ভিড়ের মধ্যে এই মাটির ইতিহাসও নীরবে হাঁটে।
অর্থনীতির নীরব হৃদস্পন্দন — রাসের লুকোনো বাজার
রাস মানে কেবল আচার নয় — রাস হলো বাজার। ব্রিটিশ আমলের Hooghly Collectorate Papers (1894)–এ স্পষ্টভাবে লেখা “Rash gatherings in the Balagarh–Jirat belt serve not merely as religious congregations but as vital seasonal accelerators of rural trade.” তখন রাসের সময় ধান, গুড়, নারকেল, ছাতু, মাটির পুতুল, রান্নাঘরের সামগ্রী, নৌকার যন্ত্রাংশের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যেত। আজও সেই ঐতিহ্য রয়ে গেছে। রাসের মাঠে হঠাৎ করে জেগে ওঠা এই অস্থায়ী বাজার জনপদের অর্থনৈতিক রক্ত সঞ্চালনে বার্ষিক গতি এনে দেয়। এই অঞ্চলের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। রাসের সময় আমাদের এই অঞ্চলে আলোর আন্দোলনে নতুন ছন্দ তৈরি হয়। মনে হয় নদী নিজেই উৎসবের শব্দে সাড়া দিচ্ছে — তার ঢেউয়ে প্রতিফলিত আলোয় ইতিহাস যেন নীরবে ভেসে বেড়ায়। রাসের এই ভিড়, এই প্রবাহ, এই স্মৃতিকে বারবার নতুন করে দৃশ্যমান করে তুলছে।
সমাজের রূপান্তর — ritual inversion-এর moments
রাস উৎসব সমাজে এক বিশেষ দৃশ্যমানতা সৃষ্টি করে। বছরের অন্য সময় যে মানুষ অদৃশ্য থাকে — পটশিল্পী, বাউল, যাত্রাদল, জাদুকর, হকার — রাসের সময় তারাই জনপদের কেন্দ্রে। নৃতত্ত্বে এটিকে বলা হয় ritual inversion, যেখানে সমাজ নিজের কঠোর কাঠামো কিছুক্ষণের জন্য শিথিল করে। উল্টোদিকে আমরা অনুভব করি যে ৯০–এর দশকে যেখানে বন্ধু-বান্ধবীরা হাতে হাত রেখে মেলায় হাঁটা স্বাভাবিক ছিল না। মদ খাওয়া ছিল নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেখানে এখন উৎসবের শরীরী ভাষা বদলেছে — গ্রাম নিজের ভিতরের সংশয় ঝেড়ে আধুনিকতার দিকে সরে এসেছে। কিন্তু এই বদল মানুষকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে — হয়তো হঠাৎই দেখা যায়, রাসের ভিড় এক অস্থায়ী সমতা তৈরি করেছে, যেখানে সবাই সমান আলোয় দাঁড়িয়ে থাকে, উৎসবের অন্তর্গত শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে।
শরীর, অন্ধকার গলি, গোপন আকাঙ্ক্ষা — রাসের অদৃশ্য ভূগোল
রাসের আলোয় যতটা বোঝা যায়, তার চেয়েও বেশি বোঝা যায় আলো থেকে দূরে সরে গেলে। মেলার বাইরের সরু অন্ধকার গলিগুলো যেন উৎসবের অদৃশ্য মানচিত্র — যেখানে মানুষের মুখ নেই, আছে কেবল শ্বাসের স্পন্দন, ভেজা বাতাস, আর গ্রামজীবনের নীরব অবশিষ্টতা।এই গলিগুলোতে হাঁটলে মনে হয় — উৎসবের উচ্ছ্বাসের পেছনে আরেকটি স্তর আছে, এক নরম নিস্তব্ধ ঘনিষ্ঠতা। দূরে ঢাক বাজে, আলো ঝিলমিল করে; আর গলির স্যাঁতসেঁতে ইটে জমে থাকে মানুষের অচেনা অনুভূতির প্রতিধ্বনি। স্বাবলকত্বের প্রথম পাঠ ইতিহাসবিদ জয়ন্ত রায় তাঁর Everyday Lives of Rural Bengal বইতে লিখেছেন Festivals create counter-spaces where youth negotiate desire beyond the gaze of rural surveillance.” এই অচেনা অন্ধকার গলিই সেই counter spaceযেখানে মানুষ নিজের ভিতরের ভূগোল পড়তে শেখে। আলো নয় — অন্ধকারই সেখানে প্রকৃত পথ দেখায়।এই গলির ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, এই রাস মেলা এই জনপদ তার একটা গোপন স্তর খুলে দিচ্ছে — যেখানে মানুষ নিজের দমিয়ে রাখা অনুভূতি, স্মৃতি, আকাঙ্ক্ষাকে অন্যভাবে অনুভব করতে পারে। উৎসবের আলো যতটা উজ্জ্বল, তার সমান্তরাল অন্ধকারও ততটাই গভীর।
ব্যক্তিগত স্মৃতি ও জনপদের ইতিহাস — দুটি সমান্তরাল স্রোত
আজ রাসের ভিড় দেখলে মনে হয় — আমি এক বহুপর্দার আর্কাইভের মধ্যে হাঁটছি। একদিকে নদীর বদল, টালি শিল্পের উত্থান–পতন, নৌকার কারখানা, ইটভাটার ধোঁয়া, জমির বিবর্তন। অন্যদিকে ব্যক্তিগত স্মৃতি — আলো, অন্ধকার, বন্ধুত্ব, ছেলেবেলার আবেগ, উৎসবের উত্তাপ। ইতিহাস শুধু দলিল নয় মানুষের শরীরে, স্মৃতিতে, গন্ধে, আর্দ্রতায়, আলো–অন্ধকারে লেখা থাকে। দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী যেমন বলেছেন “Memory is history’s most intimate hand writing.” রাস সেই hand writing-এর বার্ষিক উন্মোচন বার্ষিক celebration।যেখানে জনপদ তার ভিতরের গোপন গল্প একরাতের জন্য প্রকাশ করে।
আধুনিক রাস — শহর, শরীর, আলো, স্ক্রিন
আজকের রাসে নতুন দৃশ্য DJ লাইট, ইউটিউবার, রিল-মেকারদের ভিড়, আধুনিক সাউন্ড-সিস্টেমের গর্জন আর তার পাশে বাউল, কবিগান, কীর্তন, যাত্রাদল — দুটি যুগ পাশাপাশি হাঁটে। গ্রাম এখন এক হাইব্রিড উৎসবের কেন্দ্র — শহরের গতি আর গ্রামের ধীরতা মিলেমিশে তৈরি করেছে এক নতুন ছন্দ। কিন্তু ভিতরের সুর বদলায় না।রাসের ধুলো, আলো, অন্ধকার, গলির স্যাঁতসেঁতে বাতাস — এগুলো একই থাকে। গ্রাম বদলায়, উৎসব বদলায়, মানুষ বদলায় — তবুও ভিতরের নদী একই থাকে।
আলো নিভে যাওয়া আর গল্প শুরু হওয়ার মুহূর্ত
রাস শেষ হলে, আলো নিভে গেলে, ভিড় সরে গেলে — মাটির উপর একটুকরো উষ্ণতা থেকে যায়। এই উষ্ণতাই রাসের প্রাথমিক সত্য — একটি ক্ষণস্থায়ী কিন্তু গভীর মানবিকতা। রাস আমাকে শেখায় মানুষের ভিড়ই জনপদ নয়; মানুষের গোপন আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, স্মৃতি, অন্ধকার — এগুলো মিলেই জনপদ তৈরি হয়। রাসের আলো নিভে গেলে যে গল্প শুরু হয় — সেটা আসলে আমাদের নিজেদের গল্প। গ্রামের নয়, শহরের নয়
মাঝামাঝি থাকা মানুষের গল্প। যেখানে আলো থেমে যায়, আর শরীর, স্মৃতি, আকাঙ্ক্ষা নিজেদের মতো করে কথা বলতে শুরু করে।এটাই শ্রীপুর বলাগড়ের রাসের প্রকৃত স্পিরিট। এটাই আমাদের জনপদের সংস্কৃতিক আত্মজীবনী।
লোপামুদ্রা শেঠ | 202.8.***.*** | ১২ নভেম্বর ২০২৫ ০৯:৩৭735710