একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায়, কজালিটি অর্থাৎ কীসের থেকে কী হয়, এ যেমন একদিকে একেবারেই স্বাভাবিক, সহজ প্রশ্ন, একজন-ও মানুষ পাওয়া যাবে না যে প্রতিনিয়তঃ নিজের মনে ভেবে এবং বানিয়ে চলেছে নতুন নতুন কজ-অ্যাণ্ড-এফেক্ট মডেল – কখনো সচেতনে, বেশির ভাগ সময়েই অবচেতনে, প্রতিবর্তক্রিয়ার মতো। মেঘ দেখলে ছাতাটা সঙ্গে নিয়ে বেরোনোর সময় কি আর অতোশত ভাবি? না, খালিপেটে আলুর চপ খাওয়ার আগে মনে মনে ডায়াগ্রাম আঁকি চপ -> গ্যাস? কিন্তু দেশের পলিসি নিয়ে ভাবি, দুম করে কদিন জোর করে কেউ কিছু করতে বললেই বলি, ‘ধুর ওতে কিছু হয় না’। আবার এ-ও সত্যি যে পুরোপুরি ভাবে কার্যকারণ নির্ণয় করা এতোই কঠিন হয়ে যায় সময় সময় যে তৈরি হয় বিশাল বিতর্কের, যার কোনো কোনোটার শেষ নেই, বা শেষ হয়েও শেষ হয়না এমন।
কজেশন তাহলে কী? আমরা বরং শুরুই করি কজেশন কী নয়, তাই বলে। স্ট্যাটিস্টিক্সের ক্লাসে পা রাখলেই যে বাঁধা বুলি শোনা যায় সেইটে দিয়ে, ‘কোরিলেশন ইজ নট কজেশন’। অর্থাৎ, দুটো জিনিসের মধ্যে সম্পর্ক থাকতেই পারে, হয়তো প্রায়-ই দেখা যায় তাদের একটা বাড়লে/কমলে অন্যটাও বাড়ে/কমে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে একটার জন্যে আরেকটা হয়েছে। ইংরেজিতে একে বলে স্পুরিয়াস কোরিলেশন, আর বাংলায় বোধকরি কাকতালীয় সম্পর্ক?
বাচ্চাদের মত খেলনা উদাহরণ রোজ সকালে মোরগ ডাকার পরেই সূর্য ওঠে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে মোরগবাবুই সূর্যকে ডেকে তুললেন। উল্টোদিকে ভাবলে, আপনি যদি মাঝরাতে মোরগকে ঘুম থেকে তুলে মন কি বাঁত শোনান আর সে কঁকর-কোঁ করে ডেকে ফেলে, তক্ষুনি কি সূর্য উঠবে?
একটু নন-ট্রিভিয়াল উদাহরণ-ও চারদিকে রাশি রাশি। যে কোনো দুটো ঘটনা ধরুন যারা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে মোটামুটি এক-ই রকম হারে কিন্তু আপাতসম্পর্কহীন, টাইলার ভিগেনের একটা গোটা বই আর ওয়েবসাইট-ই আছে এইসব উদাহরণের (লিঙ্ক রইলো এখানে)। এই যেমন মার্জারিনের বিক্রি আর আমেরিকার মেইন রাজ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার – কোরিলেশন ৯৯%, বা ধরুন নৌকো থেকে পড়ে ডুবে মৃত্যুর হার আর কেনটাকিতে বিয়ের হার – ৯২.৪%। বলাই বাহুল্য, এই সব ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়া পণ্ডশ্রম।
তবে সব সময় তা-ও নয়। কখনো কখনো দুয়ের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন এক তৃতীয়জন, ‘লার্কিং ভেরিয়েবল’ অথবা ‘কনফাউন্ডার’। চাদ্দিকে এর মেলা উদাহরণ, এই যেমন আপনার মাইনেও বাড়ছে আর পাল্লা দিয়ে ব্লাড প্রেশার, হয়তো দেখা যাবে, মাইনে বাড়ছে বয়সের সাথে, রক্তচাপ-ও তাই ... আবার কিছু মাথামুন্ডু নেই এমন জিনিসেও কোরিলেশান বেশি হতেই পারে, Zআনতি পার না।
আই-এস-আই-এর একটা মজার গল্প আছে এই নিয়ে। দেবপ্রিয়বাবুর কোর্স, মিড-সেমেস্টারে প্রশ্ন এসেছে, 'মানুষের উচ্চতাও যেমনি বাড়ছে, মাথার চুলের ঘনত্ব তেমনি কমছে ... ক্যায়সে?' আমার এক প্রিয় জুনিয়র দুর্ধর্ষ উত্তর লিখে এলো, 'লম্বা লোকের টাক সূর্যের অনেকটাই কাছে, সেখানে গরম বেশি, খুব ঘাম ... ঘেমো টাকে অল্প চুল যদি না-ই পড়লো, তা'লে আর ঘেমে লাভ কি?' (বলাই বাহুল্য, আসলে উচ্চতা আর লিঙ্গের সম্পর্ক আছে, লিঙ্গ অর্থাৎ ‘সেক্স’ এখানে লার্কিং ভেরিয়েবল।)
স্বাস্থ্য (বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য), সমাজবিজ্ঞানে বা অর্থনীতিতে এমন সম্পর্ক প্রায়-ই চোখে পড়ে, এই যেমন ভ্যাকসিন নিলে গুরুতর অসুস্থতার সম্ভাবনা অনেক কম। এখানে প্রশ্ন করতেই পারেন, জানলো কি করে? কোনো কোনো ব্যাপারে, যেমন ভ্যাকসিন, সুন্দর পরীক্ষামূলকভাবেই কার্যকারণ বের করা সম্ভব। সহজে বললে ধরুন একদল মানুষকে আপনি দুটো “র্যান্ডম” দলে ভাগ করলেন, এমন ভাবে যে ঐ দুই দল বিভিন্ন দিক থেকে – বয়স, লিঙ্গ, অন্যান্য অসুখ, জাতি-পরিচয় – এক-ই রকম, নিক্তির কাঁটা কোনোদিকেই বেশি হেলে নেই। এইবার সেই দলের একটিকে ভ্যাকসিন দিলেন, আরেকদলকে দিলেন ‘প্ল্যাসিবো’ (হয়তো স্যালাইন), কিন্তু তারা কেউ জানলো না কে কী পেয়েছেন। আর আপনি পরে মেপে দেখলেন কোন দলের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কতোটা বেড়েছে। এইরকম পরীক্ষা-পদ্ধতির পোষাকি নাম ‘র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল’ বা আর-সি-টি। জনস্বাস্থ্য শুধু নয়, বিভিন্ন বিজ্ঞানের ও হিউম্যানিটিজের শাখায়, এমন কি অর্থনীতিতেও এর প্রয়োগ চমৎকার – এস্থার ডাফলো আর অভিজিতবাবুর নোবেলজয়ী কাজের ভিত্তিতেও এই আর-সি-টি।
তবে সব জায়গায় আর-সি-টি করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে যদি সম্ভাবনা থাকে যে বা যাঁরা বাদ পড়লেন তাঁদের ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা। তখন আমাদের নির্ভর করতে হয় যা তথ্য এমনিই পাওয়া যায় পরীক্ষা বা ট্রায়াল না করেই, তার উপরে – অর্থাৎ ‘অবজার্ভেশনাল ডেটা’র উপরে। আন্দাজ করা কঠিন নয়, যে পৃথিবীতে এইরকম তথ্যই বেশি, ট্রায়াল তো কোটিকে গুটিক, আর অবজার্ভেশনাল ডেটায় সম্পর্কটা কার-কার মধ্যে সেটা কষে বের করা যে সহজ কাজ এমন-ও নয়, সহজ নয় বলা কোথায় কী লুকিয়ে রয়েছে, আর সেই থেকেই কখনো কখনো জন্ম হয় ভয়ানক বিতর্কের।
সেইসব গল্পে যাওয়ার আগে একটা ছোট্ট ছবি এঁকে ফেলি, যেটা বারবার এই আলোচনায় ফিরে আসে। ধরা যাক দুটো ঘটনা দেখছি “ক” আর “খ”, এদের মধ্যে কার্যকারণসম্বন্ধ বোঝাতে একটা সহজ ডায়াগ্রাম একেঁ নেবো (ক → খ)। লক্ষ করুন, তীরের অভিমুখ একদিকে, অর্থাৎ ‘ক’ আমাদের ‘কজ’ আর ‘খ’ হলো ‘এফেক্ট’। যদি মাঝে ঘাপটি মেরে ‘ঘ’ বসে থাকেন, তাহলে লেখা যায়, (‘ক’ ← ‘ঘ’ → ‘খ’), যেমন, (‘মাইনে’ ← ‘বয়স’ → ‘রক্তচাপ’)। আরও অনেকানেক জটিল ছবিও আঁকাই যায়, স্কট কানিংহ্যামের টেক্সটবই থেকে একটা বিখ্যাত উদাহরণ রইলো নিচে। এটার ব্যাখ্যা করবো না ইচ্ছে করেই, একটু মন দিয়ে দেখলে আস্তে আস্তে একটা গল্প ফুটে উঠবে, সেটা খুব অচেনা নয়।
এই স্পুরিয়াস রিলেশন, লার্ক-করা রাশি ও কজেশন নিয়ে বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত একটি বিতর্কের গল্প বলি এবার।
এই ২০২১-এ, যেখানেই থাকুন না কেন, সিগারেটের প্যাকেটের উপরে-নীচে আশে-পাশে হয় সার্জন জেনারেল অথবা কর্তৃপক্ষের সতর্কবাণী চোখে পড়বেই। ‘ধূমপান কর্কটরোগের কারণ’। এবং এ-ও প্রায় সারা বিশ্বেই স্বীকৃত যে সত্যিই ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সারের রিস্ক বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়*। একরকম তর্কাতীত কার্যকারণ-সম্পর্ক বলেই ধরে নেওয়া যায় (‘ধূমপান’ → ‘লাং ক্যান্সার’)। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই সামান্য কদিন আগেও লোকে তর্ক করতেন এই নিয়ে, আর যে-সে লোক নয়, স্ট্যাটিশটিশিয়ানদের মাইবাপহুজুর স্বয়ং ফিশার-সাহেব।
পিছিয়ে যাই আগের শতাব্দীতে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শেষের দিক অব্দি হুহু করে ফুসফুসে ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে, শুধু ১৮৬০ থেকে ১৯৫০ অব্দিই ক্যাডাভারে লাং ক্যান্সারের হার শূন্য থেকে বেড়ে প্রায় ৭% এর কাছে চলে আসে, মানে একসময় যা ছিলো বিরল একটি ক্যান্সার, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সে প্রায় এপিডেমিক।
সেই সময়েই একের পর এক স্টাডি বেরোতে থাকে, তাতে দেখানো হয় বিভিন্ন দেশেই লোকে কতো বেশি ধূমপান করেন (দিনে কপ্যাকেট ওড়ান), তার সাথে-সাথেই বেড়ে যায় লাং ক্যান্সারের হার। ১৮৯৮-তে এক জার্মান ছাত্র দাবি করেন, তামাকের গুঁড়ো শ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢোকাই তামাক-শ্রমিকদের লাং টিউমরের কারণ, ১৯১২-তে আইজ্যাক অ্যাডলার গোটা একখানা মোনোগ্রাফ লিখে ফেলেন, যাতে অন্যান্য কারণের মধ্যে একটি ছিলো ‘অ্যাবিউজ অফ টোব্যাকো অ্যাণ্ড অ্যালকোহল’। তখনও অব্দি কিন্তু লাং ক্যান্সার যথেষ্ট বিরল, নিয়ন্ত্রণের-ও দরকার বোধ করেনি কেউ। ১৯৩০ থেকে ’৫০ এর দিকে এগোচ্ছি আমরা, আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে ক্যান্সারের হার, সেইসাথে বিভিন্ন গবেষণাপত্রে দুইয়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা। ১৯৫৪-এ রিচার্ড ডল ও ব্রাডফোর্ড হিল দেখান, ‘smokers of 35 or more cigarettes per day increased their odds of dying from lung cancer by a factor of 40’!
কিন্তু তামাক কোম্পানিরা কি এতো সহজে ছেড়ে দেবেন? তাঁরা দাবি করলেন, কন্ট্রোলড ট্রায়াল ছাড়া শুধু অবজার্ভেশনাল ডেটায় ভিত্তি করে তামাক-কে দোষ দেওয়া যাবে না, আর দুর্ভাগ্যের ব্যাপার তাদের সপক্ষে দাঁড়ালেন বিখ্যাত সব স্ট্যাটিশটিশিয়ান - রোন্যাল্ড ফিশার, জার্জি নেইম্যান, জোসেফ বার্কসন। কেটেছেঁটে বাদ দিলে মূল আপত্তির জায়গা ছিলো এই যে হতেই পারে এমন কোনো জিনগত বৈশিষ্ট্য আছে মানুষের যার জন্য তার ধূমপান করার প্রবণতাও বেশি হয়, আবার সেই এক-ই জিনগত বৈশিষ্ট্যর জন্যই তাঁর ক্যান্সারের সম্ভাবনাও বাড়ে। আরেকভাবে বললে, ধূমপায়ী আর অধূমপায়ীদের মধ্যে পার্থক্য এমন-ই, যে সেই পার্থক্যগুলোই তাদের ক্যান্সারের সম্ভাবনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। আর এ তো সত্যি কে না জানে, এই দুই দলের মধ্যে পার্থক্য থাকা এমন কিছুই অস্বাভাবিক নয়, একদল হয়তো বেশি এক্সট্রোভার্ট, হয়তো একদলের বয়েস, আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষা সব-ই আরেকদলের থেকে একটু হলেও আলাদা?
আর তা ছাড়া ভেবে দেখুন, এমন একটা জিনিসে কি সম্ভব দীর্ঘদিন ধরে র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল? মানে প্রায় সমান-সমান বাকি সবকিছু এমন এক দলকে দীর্ঘদিন সিগারেট খাইয়ে রোগ বাঁধাবেন আরেকদলকে না খাইয়ে নীরোগ রেখে দেবেন, প্রমাণ করতে এফেক্ট আছে কি নেই? অকল্পনীয়!
আশার কথা এই যে, শেষমেশ ফিশারদের যুক্তি ধোপে টেঁকেনি। ক্যান্সার ও ধূমপানের যোগসাজশ বিশ্বাস করে না এমন লোক এখন সম্ভবতঃ বিরল, প্রোফেসর কানিংহামের ভাষায়, ওর চাইতে বেশি লোক যদি বিশ্বাস করে পৃথিবী গোল নয়, চ্যাপ্টা, তাহলেও চমকাবো না। ডল আর হিলের সেই গবেষণাপত্রের প্রায় এক দশক পরে ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয় স্যার অস্টিন ব্র্যাডফোর্ড হিলের ন-খানা ‘ভিউপয়েন্ট’, যেগুলো মিলে গেলে কার্যকারণ-সম্বন্ধটা সত্যিই আছে না নেই বোঝার ব্যাপারে খানিকটা দিশা পাওয়া যাবে – এই ন-খানা সূত্রের নাম ‘ব্র্যাডফোর্ড হিল ক্রাইটেরিয়া’।
কিন্তু তবুও, বায়াসের ফাঁদে পা দেওয়া এমন কিছুই কঠিন নয়। দুটো টেবল দেখাই খোলসা করে বোঝাতে। ককরান (১৯৬৮) থেকে নেওয়া।
প্রথম টেবল-টা লক্ষ করুন। সংখ্যাগুলো ‘ডেথ রেট পার ১০০০ পার্সন-ইয়ার’। চট করে দেখলে মনে হয় সিগার/পাইপ সবথেকে ক্ষতিকারক, কারণ ওই ক্যাটেগরিতে মৃত্যুর হার বাকিদের থেকে বেশি। কিন্তু তার সাথে তো যুক্তি মেলে না, ক্যান্সারের মূল কারণ যে টার (আলকাতরা), সে তো সবথেকে বেশি ঢোকে সিগারেট খাওয়ার সময়, বরং পাইপ লোকে ইনহেল করে না। তাহলে?
গ্রুপ / মৃত্যুর হার | কানাডা | ইউ-কে | ইউ-এস |
অধূমপায়ী | ২০.২ | ১১.৩ | ১৩.৫ |
সিগারেট | ২০.৫ | ১৪.১ | ১৩.৫ |
সিগার/পাইপ | ৩৫.৫ | ২০.৭ | ১৭.৪ |
তাহলে, এখানেও আছে অন্ততঃ একটি ‘লার্কিং ভেরিয়েবল’, লুকিয়ে থাকা রাশি। পরের টেবলে দেখুন, ঐ ৩টে গ্রুপের গড় বয়স। সিগার/পাইপের সবথেকে বেশি, অস্বাভাবিক কিছুই না, বয়স্ক লোকেরাই হয়তো বেশি পাইপ-টাইপ খেতেন ককরানের সময়ে (হয়তো এখনো খান), আবার ধূমপান কারণ হোক বা না হোক, তাদের মৃত্যুর হার-ও বেশিই হবে, তাই প্রথম টেবিল থেকেই ঝপ করে কিছু বলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
গ্রুপ / গড় বয়স | কানাডা | ইউ-কে | ইউ-এস |
অধূমপায়ী | ৫৪.৯ | ৪৯.১ | ৫৭.০ |
সিগারেট | ৫০.৫ | ৪৯.৮ | ৫৩.২ |
সিগার/পাইপ | ৬৫.৯ | ৫৫.৭ | ৫৯.৭ |
তাহলে তুলনা করবো কী করে? এইখানে একটু ছোট্ট অঙ্ক লাগবে। আমরা বয়েস-কে ভাগ করবো কয়েকটি ক্যাটেগরিতে, আর প্রত্যেক ক্যাটেগরিতে কজন সিগারেট, কজন সিগার ইত্যাদির সংখ্যাকে গুণ করবো কজন মানুষ সেই বয়সের ক্যাটেগরিতে পড়েন। সহজ কথায়, বয়সের হার দিয়ে মৃত্যুর হার অ্যাডজাস্ট করতে হবে এমনভাবে যাতে দুটো গ্রুপের তুলনা করলে সেটা ঐ বয়সের ভারে একদিকে হেলে না যায়। আনন্দের কথা সেই খাটনিটাও ককরান-ই খেটে দিয়েছেন, আমরা শুধু সেই টেবলে একবার চোখ বুলিয়ে নিই?
গ্রুপ / বয়স-অ্যাডজাস্টেড মৃত্যুর হার | কানাডা | ইউ-কে | ইউ-এস |
অধূমপায়ী | ২০.২ | ১১.৩ | ১৩.৫ |
সিগারেট | ২৯.৫ | ১৪.৮ | ২১.২ |
সিগার/পাইপ | ১৯.৮ | ১১.০ | ১৩.৭ |
বলাই বাহুল্য, এই নতুন টেবলে দেখাই যাচ্ছে বয়স দিয়ে ‘অ্যাডজাস্ট’ করলে হতভাগা সিগারেটের মৃত্যুর হার বাকিদের থেকে ভালোই বেশি। এখন আর আশ্চর্য লাগে না বটে, তবে সেই সময়ে লাগতো কি না হলফ করে বলতে পারবো না।
আপাততঃ এই রচনার এক্কাগাড়ি এখানেই থামাবো, তবে কজালিটি নিয়ে আরও দুটো গল্প না করলে পাপ হবে, দুইটি অদ্ভুত আবিষ্কার ও লক্ষ মানুষের প্রাণ-বাঁচানোর গল্প। প্রথম গল্পের সময় ১৮৫৪, নায়ক এক তরুণ ব্রিটিশ ডাক্তার জন স্নো, যিনি লন্ডনের মহামারী কলেরার উৎস আবিষ্কার করেছিলেন ব্রড স্ট্রিটের একটি পাম্পে। আর দ্বিতীয়টি সেই তুলনায় এই গতকালের, কিউবার রহস্যজনক অন্ধত্বের উৎস আবিষ্কার করেছিলেন এক আমেরিকান বিজ্ঞানী, ধরতে পেরেছিলেন, ভাইরাস নয়, আসল কারণ মদের বিষক্রিয়া, আর বৈজ্ঞানিক/ডাক্তারদের আগেই তাকে বিশ্বাস করেছিলেন স্বয়ং ফিদেল কাস্ত্রো!
পরের এপিসোডে সেই দুজনের গল্প, আর আজকে শেষ করবো ব্র্যাডফোর্ড হিলের সেই বিখ্যাত ১৯৬৫-র প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাড্রেসের শেষ দুই প্যারা দিয়ে। এতো বছর পরেও যা অম্লান ও উজ্জ্বল।
“All scientific work is incomplete - whether it be observational or experimental. All scientific work
is liable to be upset or modified by advancing knowledge. That does not confer upon us a freedom to ignore the knowledge we already have or to postpone the action that it appears to demand at a given time.
Who knows, asked Robert Browning, but the world may end tonight? True, but on available evidence, most of us make ready to commute on the 8.30 next day.”
১) স্যার রোনাল্ড আইমার ফিশার-কে ‘আধুনিক রাশিবিজ্ঞানের জনক’ বলা হয়, এবং কথাটা একফোঁটাও অত্যুক্তি নয়, আমাকে এক বিখ্যাত অধ্যাপক বলেছিলেন, ফিশার সম্ভবতঃ স্ট্যাটিস্টিক্সের একমাত্র “ট্রাবলড জিনিয়াস”। তবে এ-ও সত্যি কথা যে ধূমপান ও ক্যান্সারের কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে ওনার সেইসময়কার মতামত আজকে ভ্রান্ত বলেই ধরা হয়। ফিশার নিজেও ধূমপায়ী ছিলেন, রীতিমত ইনভেটারেট পাইপ স্মোকার, এবং ওঁর তাম্বাকু সেবনের উপকারিতা গবেষণার পেছনে অর্থসাহায্য করেছিলো তামাকের-ই কোম্পানি। ফিশারের গল্প-ও অনেক অনেক, এবং তাঁর কিছু আলো, কিছু অন্ধকার, এবং বেশ কিছুটা জুড়ে আমার শহর ও আমার কলেজ – সেইসব অন্য কোনোদিন। এখানে আপাততঃ ফিশারের চিঠিটা দিলাম।
"এখানে লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে আমিও এক বিড়িখোর এবং ‘আমি জেনেশুনে-ই বিষ করেছি পান’,"
--- irrational behaviour of a rational man.
কথাটা চুরি করেছি পিপলস সায়ন্স মুভমেন্টের এক মালয়ালি অ্যাক্টিভিস্টের থেকে।
আমার পক্ষে বলা সহজ,কারণ উনিশ বছর বয়সে ফুসফুসের যক্ষা ও হাঁপানি ধরিয়ে সিগারেট ছাড়তে হোল। আট ন'বছর আগে কোলকাতায় এসে পুরনো স্মৃতিতে পানের দোকান থেকে ঝুলন্ত পাটের দড়ির আগুনে সিগ্রেট ধরালাম। রোজ দুপুরে কলেজ স্ট্রিট থেকে লালবাজার যাবার রাস্তায়। একমাসের মাথায় টের পেলাম-- এ জীবনে আর চেষ্টা না করাই ভাল।
সে যাকগে, কজালিটি ও লার্কিং ভ্যারিয়েবল চলুক। কয়েক মাস আগে যদুবাবু, অভ্যুবাবু, অরিনবাবু, ডিসিবাবু , রমিতবাবু ইত্যাদির আলোচনার সূত্রে বেইজ থিওরেম আগে ক হলে খ হওয়ার সম্ভাবনা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এবং কাহনেম্যানের সেই লেকচারের লিংক।
আবার অমনই কিছু ঘটবে সেই আশায়।
একটু ইতস্তত করে বলছি এই পর্বটা তেমন জমল না আমার কাছে।
বিজ্ঞান নিয়ে লেখার কিছু প্রচেষ্টা বাংলায় করেছি বলে একটা কথা শেয়ার করতে চাই। আমার কাছে সব থেকে চ্যালেঞ্জিং লাগে উপকথা, বিষ্ময় কথা, গল্প এর থেকে খুটে নিয়ে নিজে কি বিষয়টা নিয়ে লিখছি তার থেকে যেন ফোকাসটা সরে না যায়। আসলে এত এত ইন্টারেষ্টিং গল্প ছেয়ে থাকে, তাই কাজটা তত সহজ হয় না।
সরি, এটা কিন্তু জ্ঞান দেবার জন্য বলছি না, জাষ্ট শেয়ার করলাম
আর বলবেন না রঞ্জন-দা, এক-ই নৌকোর যাত্রী। ঐ পাটের দড়ি-ই কাল। ফড়িয়াপুকুরের একটা গলিতে ঢোকার মুখে দোকান, ঠিক গলির কোণে। তবে আমি র্যাশনাল কি না ঘোর সন্দেহ আছে। র্যাশনাল কাজ-টা কোনটা হবে জানি, জেনেও করি না। জ্ঞানপাপী।
কজালিটি নিয়ে একটা লেখার ইচ্ছে ছিলো অনেকদিন-ই। শুধু কোরিলেশন ইজ নট কজেশন লিখে ছেড়ে দিলে কেমন লাগে তাই গপ্পোটপ্পো জুড়ে দিলাম।
(বেইজ থিয়োরেম দুর্দান্ত জিনিষ, আর ঐ প্রোসিকিউটর ফ্যালাসির সত্যি শেষ নেই, 'যত্র যত্র নেত্র পড়ে' একটা করে দেখি।)
@সুকিঃ আরে না না আপনি পড়েছেন সেটাই দারুণ ব্যাপার, 'সরি' বলছেন কেন। চেষ্টা করবো আপনার কথাগুলো মনে রেখে পরে একবার রিভাইজ করার।
তা ছাড়া, এটা আসলে একটা বড়ো লেখার প্রথম ভাগ, মনে হয় ইন্টারেস্টিং গল্পগুলো ঠেলেঠুলে পরের ভাগে চলে গেছে। হয়তো ঐ জন স্নো-এর গল্প আরেকটু জমবে। দেখা যাক।
সুকি
এখানেই বলে দিই।
স্বেতলানা আলেক্সিয়েভিচের "লাস্ট উইটনেসেস" -আনচাইল্ডলাইক স্টোরিজ কি আপনি সাজেস্ট করেছিলেন? আজ শেষ করলাম। তারপর আর কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
অনেক ধন্যবাদ
যথার্থ, লজিক্যাল এবং অনেকটা গভীরে গিয়ে লেখ।। এটার হদিশ জানতাম না। এবার বাকি কিস্তিগুলো পড়বো।
অভিনন্দ!!
অনেক ধন্যবাদ জয়ন্তবাবু। আগের গুলোও পড়ে জানাবেন।
আমি চেষ্টা করবো এই ধারাবাহিক-টা আরও কয়েকটা পর্ব লিখতে, স্ট্যাটিস্টিক্স ও প্রোবাবিলিটি-ঘেঁষা টপিকেই। :)