(১)
২৮শে জানুয়ারি, ১৯৮৬, সকাল ১১টা ৩৯ মিনিট। নাসার স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার উৎক্ষেপণের দিন। সাতজন মহাকাশচারীকে নিয়ে চ্যালেঞ্জার উড়বে ফ্লোরিডা-র কেপ ক্যানাভেরাল থেকে।
স্পেস শাটল ইঞ্জিনিয়ার রজার বইসজলি কিন্তু দেখছেন না এই উৎক্ষেপণের ঐতিহাসিক দৃশ্য। আগের দিন-ই বইসজলি আর নাসার-ই আরেকজন কন্ট্রাকটর মর্টন থিওকল প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন নিজেদের ম্যানেজারদের, বসদের বোঝাতে – যদি কোনোভাবে পিছিয়ে দেওয়া যায় চ্যালেঞ্জারের লঞ্চ – ম্যানেজারদের বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, অতিরিক্ত ঠান্ডায় কীভাবে বিকল হয়ে যেতে পারে শাটলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কানে তোলেননি কেউ।
কেপ ক্যানারভালে সেদিন যেন একটু বেশিই ঠান্ডা পড়েছে; সাতজন মহাকাশচারী যখন স্পেস শাটলে উঠছেন, বাইরের লঞ্চপ্যাডের তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রি ফ্যারেনহাইট ( -০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। বইসজলি বারবার ফোনে খবর নিচ্ছেন ফ্লোরিডার সহকর্মীদের থেকে … কাউন্টডাউন শুরু হচ্ছে ওদিকে। চ্যালেঞ্জারের লঞ্চের এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত নাসা টিভি সরাসরি সম্প্রচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অ্যামেরিকার সমস্ত পাবলিক স্কুলে, লক্ষ-লক্ষ শিশু-কিশোরের চোখ টিভির পর্দায়। কারণ, মহাকাশচারীদের মধ্যেই আছেন ক্রিস্টা ম্যাকলিফ, সোশ্যাল স্টাডিজ-এর শিক্ষিকা, এবং প্রথম সাধারণ নাগরিক-ব্যোমযাত্রী, প্রথম “টিচার-ইন-স্পেস”।
উৎক্ষেপণের ঠিক ৭৩ সেকেন্ডের মাথায় চ্যালেঞ্জার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বিস্ফোরণে – সাতজন নভচরের সকলেই প্রাণ হারান মুহূর্তেই। উৎক্ষেপণের ২ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের মাথায় চ্যালেঞ্জারের ধ্বংসাবশেষ যখন আছড়ে পড়ছে ফ্লোরিডার মহাসমুদ্র উপকূলে, ছিন্নভিন্ন শাটলের গতি তখন ২০৭ কিমি/ঘণ্টা, ইমপ্যাক্ট মাধ্যাকর্ষণের প্রায় ২০০ গুণ।
চ্যালেঞ্জারের দুর্ঘটনার প্রভাব সুদূরপ্রসারী বললেও কম-ই বলা হয় বোধহয়। নাসার বিশ্বাসযোগ্যতা যে সাংঘাতিক টাল খেয়েছিল তা-ই শুধু নয়, প্রায় ৩২ মাস শাটল প্রোগ্রাম পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেছিল। সেই খাদ থেকে ফিরে আসতে সময় লেগেছিল আরও কিছু বেশি।
দুর্ঘটনার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ১৪জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে তৈরি করলেন “রজার’স কমিশন”, তাতে নভোচর নিল আর্মস্ট্রং, স্যালি রাইড যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন বোধহয় গত শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত এবং বিতর্কিত বৈজ্ঞানিক রিচার্ড ফাইনম্যান। ফাইনম্যানের আয়ু তখন বোধহয় আর বছর দুয়েক বাকি।
কমিটির রায় জানা গেল অল্পদিনেই। ফাইনম্যান ও সঙ্গীরা প্রমাণ করলেন যে দুর্ঘটনার প্রধানতম কারণ রাবারের তৈরি ও-রিং, রকেটের ফিল্ড জয়েণ্টে সেটি এমনভাবে লাগানো থাকে যে উৎক্ষেপণের সময় রিং-টি ঠিক জায়গায় আটকে থেকে ইগনিশনের প্রচণ্ড তাপমাত্রার গ্যাস পৌঁছতে দেবে না জ্বালানি ট্যাঙ্কের আশেপাশে। ফাইনম্যান সবার সামনে প্রায় ইস্কুলের সায়েন্স ফেয়ারের মতোই সহজ পরীক্ষায় এক গ্লাস বরফ-জলে একটি রাবারের ও-রিং চুবিয়ে দেখিয়ে দিলেন হিমাঙ্কের নীচে (০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে) গেলেই সেই রাবারের রিং কীভাবে ভঙ্গুর ও নষ্ট হয়ে যায়। আর সেই অভিশপ্ত দিনের কেপ ক্যানারভালের তাপমাত্রা আগেই লিখেছি, -০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ফাইনম্যান অবশ্য শুধু ঐ কার্যকারণ বের করেই থামেননি। নাসার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা নিয়ে বিস্তারিত একটি রিপোর্ট লিখে মতামত দেন, যে এই ভেঙে-পড়া ব্যবস্থা ঠিক না হওয়া অবধি মহাকাশযাত্রা স্থগিত থাকুক। বলেন, “For a successful technology, reality must take precedence over public relations, for nature cannot be fooled”। রজার’স কমিশনের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও সে রিপোর্ট শেষমেশ প্রকাশ পায়, তবে একেবারে শেষে অ্যাপেন্ডিক্স-এফ হিসেবে।
অথচ, এই মারাত্মক প্রাণের ঝুঁকির কোনোই আভাস ছিল না ঐ অভিশপ্ত চ্যালেঞ্জার সেভেনের। থিওকল, বইসজলি আর তাদের সঙ্গীদের সমস্ত সাবধানবাণী ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে, নাসার ম্যানেজমেন্ট উৎক্ষেপণের আগে যে প্রি-লঞ্চ এস্টিমেটটি কষেছিলেন, তাতে বলা ছিল, লঞ্চে শাটল ফেল করার সম্ভাবনা ১০০,০০০এ মাত্র ১ – প্রায় নেই বললেই চলে।
তাহলে?
(২)
তাহলে আর কী? অঙ্কে ডাহা ভুল, বলা ভাল, রাশিবিজ্ঞানের সাধারণ প্রয়োগের-ই গোড়ায় গলদ। এবং ছোটোখাটো নয়, ব্যাপক ভুল। ১৯৮৯ সালে তিনজন রাশিবিজ্ঞানী (সিদ্ধার্থ দালাল, এডওয়ার্ড ফোকস আর ব্রুস হোডলি) চ্যালেঞ্জার দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে একটি পেপার লেখেন জর্নল অফ আমেরিকান স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনে (অর্থাৎ জাসায়), “Risk Analysis of the Space Shuttle: Pre-Challenger Prediction of Failure” এবং সেই পেপারে ঠিকঠাক প্রোবাবিলিটির আঁক কষে দেখান যে ঐ ৩১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের লঞ্চ করলে ও-রিং বিকল হওয়ার সম্ভাবনা নেহাত কম নয়, প্রায় ১৩% – প্রায় ১/৮ ভাগ, আর একটু কয়েকদিন অপেক্ষা করে যদি উৎক্ষেপণ হত আরেকটু উষ্ণ দিনে? সিদ্ধার্থ দালালদের পেপারে বলা, “Postponement to 60°F would have reduced the probability to at least 2%”!
প্রোবাবিলিটি বা সম্ভাবনা অবশ্যই কনটেক্সট – প্রসঙ্গের উপর নির্ভরশীল এবং কিছুটা ব্যক্তিবিশেষের উপরেও নির্ভর করে। মানে ১৩% বৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনায় আপনি ছাতা না-ও নিতে পারেন, কিন্তু ধরুন আপনি গাড়ি নিয়ে লম্বা ট্রিপে বেরোবেন বা হাউইয়ে চড়ে মহাকাশে যাবেন, সঙ্গে আরও সাতজন মানুষ, আকাশে দৈবের বশে জীবতারা খসার সম্ভাবনা যদি হয় ১৩%, যাবেন? আর যদি হয় ১/১০০,০০০?
সিদ্ধার্থবাবুরা জাসার সেই পেপারে কী করে প্রোবাবিলিটির অঙ্ক কষেছিলেন, সে বিস্তারিতভাবে দেখানোর সুযোগ বোধহয় এই প্রবন্ধে নেই, যদিও চক-ডাস্টার হাতে মাস্টারের হাত যে নিশপিশ করছে না – এ কথা ঠিক নয়। একটু বলব সে গল্প। তার আগে, সহজ করে নাসা-র সেই ম্যানেজার-রা কী রকমভাবে সাঙ্ঘাতিক ভুল অঙ্কটা করেছিলেন, তার একটু ধরতাই দেওয়া যাক।
নীচের প্রথম ছবিটা দেখুন, উৎক্ষেপণের আগে নাসার ও-রিং পরীক্ষার ডেটা – x অ্যাক্সিসে তাপমাত্রা আর y-তে দুর্ঘটনার সংখ্যা। যদি খালি চোখে তাপমাত্রা আর দুর্ঘটনার মধ্যে একটা কোনো সম্পর্ক খুঁজতে বলি, বোধহয় খুব কিছু ধরা পড়বে না। সত্যি বলতে, মানসচক্ষে একটা মাঝ বরাবর লাইন টানলে (যদিও এরকম ডেটায় ওরকম সরলরেখা টানা উচিত নয় একেবারেই) কিন্তু তাও সাহস করে টানলে সেটা যে খুব উপর থেকে নীচের দিকে যাবে এমন হবে না।
নাসার ম্যানেজমেন্ট (ইঞ্জিনিয়ার নয়, ম্যানেজার) এই ডেটা দেখেই লাখে এক চান্স ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ওঁদের মনে হয়েছিল তাপমাত্রা আর দুর্ঘটনার মধ্যে তেমন কোনো জোরদার সম্পর্ক নেই।
কিন্তু সাংঘাতিক গোলমালটা এইখানে, যে ওঁরা পুরো ডেটাসেট দেখেননি, বা দেখতে হবে সে কথা মাথায় আসেনি। নাসার ম্যানেজাররা, শুধু যে শাটলগুলো বিকল হয়েছে পরীক্ষার সময়, সেইগুলো দেখছিলেন, যেগুলোর গোলযোগ হয়নি – সেইসব ডেটা পয়েন্ট ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি ওঁরা। আর এইখানেই হয়ে গেছে প্রাণঘাতী একটা ভুল।
এইবার এর পরের ছবিটি দেখুন। এইটি পুরো ডেটাসেটের – পরীক্ষায় পাশ আর ফেল দুইরকমের শাটল। এইবার যদি ভাল করে খেয়াল করে দেখেন, স্পষ্ট প্রতীতী হবে যে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে দুর্ঘটনার সংখ্যা, অতএব সম্ভাবনা – দুই-ই কমছে। যেমন, দেখাই যাচ্ছে ৬৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে দুর্ঘটনার হার বেশ কম (প্রায় ১৫% মত) আর খুব ঠান্ডায়, মানে রেখচিত্রের বাঁদিকে, প্রায় ১০০% ফেল।
এইবার ভেবে দেখুন, আপনি যিনি নাসার ম্যানেজার নন, যদি এই নীচের ছবিটি দেখতেন, কী সিদ্ধান্ত নিতেন? ফাইনম্যান তাঁর সেই রিপোর্টে এই ভুলের ব্যাখ্যা করে লিখেছিলেন, “When playing Russian roulette, the fact that the first shot got off safely is little comfort for the next!”
(৩)
এইবার শেষপাতে একটু শিশিবোতল।
একটু আগে বলছিলাম যে ঐ প্লটের মাঝবরাবর লাইন টানলে মোটেও কাজের কাজ হবে না। কেন? একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
সহজে বলতে গেলে, সোজা লাইন টেনে দিলে ইক্যুয়েশনের ডানদিক আর বাঁদিক মিলবে না। বাঁদিকে দুর্ঘটনার সংখ্যা, যাকে আমরা ব্যাখ্যা করতে চাইছি, বা যে জিনিসের পূর্বাভাস চাইছি, সেইটি ডিস্ক্রিট (বিযুক্ত, ছাড়াছাড়া, একটানা নয়)। দুর্ঘটনা তো ভগ্নাংশ হতে পারে না, সে সবসময়েই পূর্ণসংখ্যা এবং শূন্য বা তার বেশি, মানে যার ভ্যালু হতে পারে ০, ১, ২ ইত্যাদি। আর তাপমাত্রা কন্টিনিউয়াস স্কেল, মোটামুটি একটা রেঞ্জের মধ্যে যা ইচ্ছে তাই হতে পারে, মানে ধরুন, শূন্য থেকে আশি ফারেনহাইটের ভেতর সমস্তকিছু।
প্লটের মধ্যিখান দিয়ে লাইন টানার কথা বলছিলাম, সে ক্যামন জিনিস? ছোটবেলার নব গণিত মুকুলের (নাকি কে. সি. নাগের?) সরলরেখার চ্যাপ্টার মনে করুন: y = a + b x সমীকরণের ছবি আসলে খাতার পাতায় আঁকা একটি সরলরেখা। আর সে পাতায় ছড়ানো-ছেটানো বিভিন্ন পয়েন্টের মধ্যে দিয়ে যদি এমন একটা সরলরেখা আঁকার চেষ্টা করি, যে সমস্ত পয়েন্ট-এর সবথেকে কাছ দিয়ে যাবে, সেই ‘বেস্ট ফিটিং’ লাইন টানার রাশিবিজ্ঞানের নাম লিনিয়ার রিগ্রেশন। সে এক দারুণ কাজের জিনিস, বলতে গেলে বেস্ট থিং সিন্স হট কচৌরিজ। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জারের ডেটায় তাকে তলব করা যাবে না। কারণ ঐ y = a + b x সমীকরণে বাঁদিকে বসানোর কথা দুর্ঘটনার সংখ্যা – ডিস্ক্রিট, আর ডানদিকে তাপমাত্রা ইত্যাদি প্রভৃতি – কন্টিনিউয়াস।
তাই বলে আমরা কি মডেলিং করব না? মডেলিং করব না আমরা? অবশ্যি করব, কিন্তু আরেকটু অন্যরকম হাতিয়ার লাগবে, যেমন ধরুন লজিস্টিক রিগ্রেশন। তাতে কী করে? না, বুদ্ধি করে প্রথমে বাঁদিকের সংখ্যাটাকে ডিস্ক্রিট স্কেল থেকে কন্টিনিউয়াসে নিয়ে আসার জন্য, দুর্ঘটনার সংখ্যা না দেখে, সম্ভাবনা দেখে – যার মান ০ থেকে ১-এর মধ্যে যা ইচ্ছে হতে পারে। আর ডানদিকের ঐ a + b x সরলরৈখিক অংশের উপর চাপায় এমন একটা ট্রান্সফর্মেশন অথবা ফাংশন – যাতে সেও ঐ রেঞ্জ ছোটবড় করে ঠিক ওই ০ আর ১-এর মধ্যেই গিয়ে দাঁড়ায়।
এরকম ফাংশন/ ট্রান্সফর্মেশনের কোনো অভাব নেই পৃথিবীতে, তবে সবচাইতে বিখ্যাত যেটি, সেটির নাম লজিস্টিক সিগময়েড। এমন একটা কার্ভ – যা গোটা রিয়েল অ্যাক্সিস অর্থাৎ সেই মাইনাস থেকে প্লাস ইনফিনিটি-কে চেপ্পে ধরে ০ আর ১ এর মধ্যে ম্যাপ করে দেয়, আকৃতি যেন ইংরেজি S এর মতো – তাই পদবি সিগময়েড। ব্যস, হয়ে গেল, এইবার আপনার মডেলে ইনপুট নেবে বাঁদিকে যা ইচ্ছে – তাপমাত্রা, প্রেশার ও অন্যান্য যা ইচ্ছে, আর ডানদিকে বেরোবে সম্ভাবনা, একেবারে সোজা প্রোবাবিলিটি স্কেলেই। সিদ্ধার্থ দালাল-দের পেপারের মডেলটি অবশ্য এর থেকে আরেকটু জটিল ও বিস্তৃত, এবং আগ্রহী পাঠকরা নীচের তথ্যসূত্রে দেওয়া লিঙ্ক থেকে পড়ে দেখতে পারেন। তবুও এর থেকেও দিব্যি বোঝা যায়, কম তাপমাত্রায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি কীভাবে বাড়ে!
অঙ্কের ভাষায় সেই মডেলটির সহজতম রূপ লিখে ফেললে কেমনি দেখতে হয় নীচে দিলাম। এখানে exp() হচ্ছে অয়লারের এক্সপোনেনশিয়াল ফাংশন।
তা সেই কালবোশেখীর কান্না চেপে কলের মধ্যে মাড়ায়, বল তো সে কী দাঁড়ায়? নীচের ছবিটি দেখুন এইবার। এইবার y-axis, মানে উল্লম্ব অক্ষে (বাপস্!) প্রোবাবিলিটি: ০ থেকে ১, আর x-axis (অনুভূমিক অক্ষ?) বরাবর তাপমাত্রা, কিন্তু সেলসিয়াস স্কেলে। এক্কেবারে বাঁ-হাতে উপরের দিকের ডট-টি চ্যালেঞ্জার, শূন্যের সামান্য নীচে দুর্ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১ (অর্থাৎ ১০০%) ছুঁই-ছুঁই। এ কী নিছক দুর্ঘটনা না প্রাণঘাতী অবহেলা?
ভাবতে আতঙ্ক হয়, যে, এই প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর সম্ভাবনার বিন্দুবিসর্গ জানতেন না সেই অভিশপ্ত চ্যালেঞ্জার সেভেন। তারা জানতেন ১/১০০,০০০। যথার্থ-ই বলেছিলেন ফাইনম্যান, “[T]his has had very unfortunate consequences, the most serious of which is to encourage ordinary citizens to fly in such a dangerous machine, as if it had attained the safety of an ordinary airliner”
লিখতে ইচ্ছে করে, “এই ট্রাজেডির শেষ এখানেই”, কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। চ্যালেঞ্জারের ফলে মহাকাশযাত্রার সুরক্ষা যে অনেক বেশি আঁটোসাঁটো হয়েছিল, সে সন্দেহাতীত, কিন্তু শেষ শাটল-দুর্ঘটনা আমরা অতীতে ফেলে এসেছি কিনা জানা নেই। চ্যালেঞ্জারের দুর্ঘটনার সময় এই লেখকের বয়স দুইয়ের-ও কম, কিন্তু এই লেখার বছর কুড়ি আগের কলম্বিয়া মহাকাশযান ভেঙে পড়ার দিন তার মনে আছে স্পষ্ট, কলম্বিয়ায় সওয়ার ভারতীয় বংশোদ্ভূত কল্পনা চাওলার মুখ এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল ও দগদগে।
রাশিবিজ্ঞানের ভুল প্রয়োগ দেখাব বলেছিলাম, কিন্তু এই ট্রাজেডির খলনায়ক শুধুই সে একা নয়, যেন আরও কিছু গভীর। অনেকে মনে করেন, চ্যালেঞ্জারের দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ “গ্রুপথিঙ্ক”। আরভিং জ্যানিসের সংজ্ঞায়, গ্রুপথিঙ্ক সেই চেনা ঘটনা – যখন সবাই মিলে খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হয়ে দাঁড়ায় সকলের সাথে এক সুরে গাওয়ার – ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ, উর্ধ্বতনের কর্তৃত্বের ভয়ে যা হামেশাই যুক্তি-বুদ্ধি, সাধারণ বিবেচনা, ইত্যাদিকে অক্লেশে অতিক্রম করে যায়।
পাঠক, এইবার ভেবে দেখুন থিওকলের কথা, বইসজলির কথা, দলের অন্য ইঞ্জিনিয়ার/বৈজ্ঞানিকদের কথা, যাঁরা জানতেন কী সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটতে চলেছে, ওঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বইসজলির বাকি জীবন কাটে ভয়াবহ ডিপ্রেশন, পোস্ট-ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসওর্ডারে। লঞ্চের আগের দিন থিওকল ইঞ্জিনিয়ারস-দের একজন, অ্যালেন ম্যাকডোনাল্ড, নাসা-র প্রোডিউসার-দের বারংবার বলছিলেন ঠান্ডায় “major malfunction”-এর সম্ভাবনার কথা। নাসার ম্যানেজার তাদের ধমকে দিয়ে বলেন, “My God, Thiokol, when do you want me to launch — next April?”!
কিন্তু তাতেও কিছু পাল্টানোর না, কারণ মানুষ ইতিহাস থেকে শেখে না। সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ জেনেও মানুষ না জানার ভান করে, ভাবে, হয়তো কোনোভাবে আর যার হোক, তার কিচ্ছুটি হবে না। কেউ কেউ সাহস করে বিপদ-ঘণ্টি বাজান, তাদের পরিণতি কী হয় – সে নিয়ে আর খবর হয় না।
স্পেস শাটলের গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষ করব হ্যাঙ্ক পলসনের একটি উক্তি দিয়ে। ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী মন্দা-র সময়ে যিনি ছিলেন সেক্রেটারি অফ ট্রেজারি।
২০১৪ সালের একটি ওপ-এড কলামে পলসন লিখছেন, “This is a crisis we can’t afford to ignore. I feel as if I’m watching as we fly in slow motion on a collision course toward a giant mountain. We can see the crash coming, and yet we’re sitting on our hands rather than altering course.”
কী সেই অজানা পর্বত – যার দিকে অজান্তে, অলক্ষ্যে ধেয়ে যাচ্ছি আমরা? এইটা ভেবে বের করার দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম আপনাদের উপর, পাঠক!