‘All models are wrong, but some are useful!’
রাশিবিজ্ঞানের জগতে হাতে গোনা কয়েকটি যে সহজ অথচ গভীর উক্তি আছে, তার মধ্যে বোধ করি সবথেকে জনপ্রিয় জর্জ বক্সের এই কথাটিই। উক্তিটি অবশ্য কিছুটা ঘষেমেজে পালটে গেছে সময়ের সাথে; আসল উক্তিটি যদ্দূর জানা যায়, ১৯৭৬ সালে জর্নল অফ আমেরিকান স্ট্যাটিস্টিক্যাল এসোসিয়েশনের একটি পেপারের একটি উপদেশ:
“Since all models are wrong the scientist must be alert to what is importantly wrong. It is inappropriate to be concerned about mice when there are tigers abroad.” (Section. “Worrying selectively”)
সব জনপ্রিয় উক্তির বেলাতেই যা হয়, হয় ছেঁটেকেটে আসলটুকু বাদ দিয়ে, না হলে কথাটাকেই পালটে দিয়ে, লোকে ব্যবহার করেছে দেদার। তবে তার থেকেও বিপজ্জনক কাজ করেছেন আরেকদল – অনেক কসরৎ করে জটিল একটি মডেল ফিট করে সেইটেকেই ধরে নিয়েছেন ধ্রুবসত্য। সাইন-বোর্ড টাঙিয়েছেন দোকানের বাইরে, “ফলিবেই ফলিবে”।
তবে কে না জানে, ইতিহাস চক্রবৎ পরিবর্তন্তে – plus ça change, plus c’est la même chose – যতই পালটায়, ততই সেই এক-ই থেকে যায়। আজকের যদুবাবুর টিউশনে তাই সেইসব ভুল রাস্তা ধরে একটু পেছনপানে হাঁটা।
যদিও জর্জ বক্স-ই যে প্রথম এই কথাটা ভেবেছিলেন, সেটাও বলা শক্ত। ১৯৭৬-এর বক্সের লেখা পেপারের আগেও অনেক দার্শনিক, বিজ্ঞানী, এমনকি শিল্পীর কল্পনাতেও ঠিক এই এক-ই কথা ঘুরে ফিরে এসেছে। এই যেমন জিনিয়াস গণিতজ্ঞ-পদার্থবিজ্ঞানী-পলিম্যাথ জন ভন নিউম্যান বলেছিলেন, “truth... is much too complicated to allow anything but approximations…” সত্য যে কঠিন!
সত্যিই তো, আমাদের বোধের অতীত জটিল – আমাদের চারপাশের প্রকৃতি, তার মধ্যে জীবজন্তু, গাছপালা, মানুষ, এদের মধ্যে অনন্তকাল ধরে চলতে থাকা বিবর্তনের পায়ের ছাপ, সমাজের কাঠামো, জীবনের লেনদেনের হিসাব, এমনকি এর বহু বহু দূরের গ্রহ-নক্ষত্র-ও। সেই অনন্ত জটিল রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ কল্পনা করেছে মূল সূত্রের কথা; তার সীমিত কল্পনার নাগালের বাইরের জিনিস আস্তে আস্তে ধরা দিয়েছে সেই সূত্র ধরেই। আমাদের জ্ঞানের আদান-প্রদান, আমাদের যন্ত্রপাতি, আর আমাদের গণন-ক্ষমতা যেমন উন্নত হয়েছে – সেইসব চেষ্টা, সেইসব কল্পনারও আস্তে আস্তে উন্নতি হয়েছে।
‘মডেল’ কাকে বলে – সেই সংজ্ঞায় না গিয়েও তাই একটু ভাবলেই বোঝা যায়, সেই একেবারে ছোট্টবেলা থেকেই আমরা মডেল কাকে বলে জানি। নিজের ছোটবেলায় রঙিন বই মনে পড়ছে – ফ্র্যাঙ্ক স্কুলের আধুনিক পৃথিবীর মানচিত্র, কী সুন্দর পৃথিবীর ম্যাপ – ডানদিকে এশিয়া, বায়েঁ আম্রিকা, পাতার মাঝবরাবর বিশাল আফ্রিকা ইত্যাদি। ম্যাপ-পয়েন্টিং খেলছি পাতাজোড়া বিশাল পৃথিবীর উপর।
যদি আরও একটু তলিয়ে ভাবি, তাহলে দেখতে পাব – এই পাতাজোড়া ম্যাপ-ও আসলে একটা মডেল বই তো কিছু নয়, হয়তো আমার পাড়ার মোড়ের মাঠ নেই, বা হয়তো কোথাও কোনো উপকূলের তটরেখার কিছু বাঁক মিসিং, কিন্তু ঐ দেখে যে ধারণা হয় – এই বিশ্বের কোনখানে কে আর “কোনদেশে রাত হচ্ছে ফিকে”, মোটের উপরে তা ভুল নয়। বক্সের ভাষায়, দিব্যি ‘ইউজফুল’!
কিন্তু যদি ফিরে যাই ক্রিস্টোফো কলম্বো-র (অর্থাৎ ক্রিস্টোফার কলম্বাস) সময়ে, তাহলে দেখব তার সময়কার পৃথিবীর ম্যাপ, অর্থাৎ মডেল – একেবারেই ডাহা ভুল, আর সেইটিই বোধহয় ইউরোপিয়ান ইতিহাসের সবথেকে যুগান্তকারী ভুল।
কলম্বাস অবশ্যই তাঁর সমসাময়িক মানুষদের মতই ভাবতেন, পৃথিবী সুন্দর একটা গোলক – তবে সেটা খুব একটা কিছু বড় ভুল না। বড় ভুলের প্রথমটি এই, যে তাঁর মডেলের পৃথিবী বাস্তবের থেকে বেশ কিছুটা ছোট, কলম্বাসের ধারণার পৃথিবী-পরিসীমা, মাঝ-বরাবর দেখলে, প্রায় ৩০,০০০ কিমি, যেটি আসলে প্রায় ৪০,০০০ কিমি! এতে দুটো গণ্ডগোল হল – প্রথমত, ৪০,০০০ কিমি ধরলে ইউরোপ থেকে পশ্চিমপানে গিয়ে এশিয়া পৌঁছনো সম্ভব হত না, হয়তো কলম্বাস যাত্রাই শুরু করতেন না, আর দ্বিতীয়ত, দূরকে প্রতীতি হল নিকট – মাত্র ৩০,০০০ কিমি ধরলে সত্যিই এশিয়া এমন কিছু দূরে নয় – এই এখনকার ক্যালিফোর্ণিয়ার সামান্য পশ্চিমেই, কাজেই, ‘এই তো একটুখানি’।
অর্থাৎ, কলম্বাসের অভিযানের, বা বলা যায় প্রেডিকশনের, ভিত্তি তাঁর কল্পনার ক্ষুদ্রতর পৃথিবী (“স্মল ওয়ার্ল্ড”), কিন্তু আমাদের সত্যিকারের পৃথিবী তার চাইতে অনেকটাই বড়ো, লার্জ ওয়ার্ল্ড। কাজেই তাঁর পূর্বাভাষ যে মিলবে না – এ আর আশ্চর্য কী? কিন্তু কলম্বাসের ভাগ্য (এবং অ্যামেরিকার আদি-অধিবাসীদের চরমতম দুর্ভাগ্য) যে ওঁর ভুল-ই ওঁকে নিয়ে এল নতুন এক পৃথিবীতে – ইস্ট ইন্ডিজে। কলম্বাসের সময়কার ম্যাপের একটি ছবি দিলাম নীচে। সত্যিই যদি পৃথিবী সেইরকম হত, তাহলে ইওরোপ আর এশিয়ার মাঝে শুধুই মহাসমুদ্রের জল ছাড়া কিছুই চোখে পড়ত না কলম্বাসের, আর তার থেকেও আনন্দের কথা, মাঝ রাস্তায় খাবার-দাবার ফুরিয়ে সলিল-সমাধি হত মধ্যযুগের বর্বরতম ঔপনিবেশিক লুটেরার দলের।
কলম্বাসের এই ক্ষুদ্রতর আর বৃহত্তর বিশ্বের ফারাক-ই, আমাদের পরিভাষায়, ‘মডেল’ আর ‘রিয়েলিটি’ বা বাস্তবের ফারাক। প্রায় সব স্ট্যাটিস্টিক্যাল মডেল-এর এই দুটো বৈশিষ্ট্য – একটি স্মল ওয়ার্ল্ড – যার উপর ভিত্তি করে মডেলটি তয়ের হয়েছে, আর লার্জ ওয়ার্ল্ড – যাতে সেই মডেলটিকে কাজে লাগিয়ে আমরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেব, উপদেশ দেব – ইত্যাদি, প্রভৃতি।
বক্সের উক্তিটি আরেকবার দেখে নিই। উনি বলেছেন, “Since all models are wrong the scientist must be alert to what is importantly wrong. It is inappropriate to be concerned about mice when there are tigers abroad”!
কলম্বাসের মডেল যেমন আগাগোড়াই ভুল, কিন্তু – পৃথিবীর মাপ অনেক কম বলে ধরে নেওয়া কিংবা একটা গোটা মহাদেশের অস্তিত্ব না জানা – বেশি ভুল, আর – পৃথিবী কতটা বিশুদ্ধ গোলাকৃতি – সেইটা অত কিছু ভুল নয়। প্রথমটি যেন বক্স-বাবুর বাঘ, আর দ্বিতীয়টি ইঁদুর।
আবার, যেমন ফ্র্যাঙ্ক স্কুলের সেই মানচিত্রের বইয়ের ম্যাপ-ও ভুল। বস্তুত, ফ্র্যাঙ্ক বা অন্যান্য সব স্কুলের সব ম্যাপ-ই ‘ভুল’, এবং ঠিক ঠিক করে বললে, গোটা পৃথিবীর একমাত্র নির্ভুল কাঁটায়-কাঁটায় মিলে যাওয়া ম্যাপ তো আসলে পৃথিবী নিজে-ই। যেই তাকে ছোটোখাটো করে স্কেল-ডাউন করে এঁকেছেন, অমনি টুক করে ঢুকে গেছে ভুল। কিন্তু তার মানে এই নয়, যে সেই ম্যাপ ফালতু – সেই দেখেই না দিগবিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছি, দেশান্তরি হচ্ছি প্রতিদিন আর মানবসভ্যতা হুড়ুমতালে এগোচ্ছে।
ম্যাপ যে আসলে মডেল, সেই কল্পনা কিন্তু বিজ্ঞানীদের একার নয়, শিল্পী-সাহিত্যিকদের-ও। আমার অন্যতম প্রিয় সাহিত্যিক, হোর্হে লুই বোর্হেসের লেখায় (On Exactitude in Science) অদ্ভুত সুন্দরভাবে ধরা আছে এই চিন্তাটাই:
“… In that Empire, the Art of Cartography attained such Perfection that the map of a single Province occupied the entirety of a City, and the map of the Empire, the entirety of a Province. In time, those Unconscionable Maps no longer satisfied, and the Cartographers Guilds struck a Map of the Empire whose size was that of the Empire, and which coincided point for point with it. The following Generations, who were not so fond of the Study of Cartography as their Forebears had been, saw that that vast Map was Useless, and not without some Pitilessness was it, that they delivered it up to the Inclemencies of Sun and Winters. In the Deserts of the West, still today, there are Tattered Ruins of that Map, inhabited by Animals and Beggars; in all the Land there is no other Relic of the Disciplines of Geography.”
— Suarez Miranda, Viajes devarones prudentes, Libro IV,Cap. XLV, Lerida, 1658
বোর্হেসের গল্পের নীতিবাক্য-ও সেই এক-ই – একটি অঞ্চলের পারফেক্ট ম্যাপ সেই অঞ্চলটিই নিজে – অতএব সেই ‘পারফেক্ট’ ম্যাপটি কোনোই কাজের নয়। সেইরকম একটি ‘পারফেক্ট’ মডেল চেষ্টা করবে অনন্তকাল ধরে প্রত্যেকটি ডেটা পয়েন্টে নির্ভুলভাবে খাপে-খাপ করতে, ফলত, তয়ের হবে একটি সীমাহীন জটিল মডেলের, এবং তাই দিয়ে না হোমে না যজ্ঞে কিছুই কাজ হবে না কারুর। কার্যকরী মডেল, অতএব বাই ডেফিনিশন, জটিল সিস্টেমের একটি সরলীকৃত ছবি, এবং বাই ডেফিনিশন, সে ছবি এক চিলতে হলেও – ‘ভুল’।
বক্স নিজে সেই স্মরণীয় উক্তিটি করার বছর দুয়েক পরেই একটি ওয়ার্কশপে আরেকটু যেন বুঝিয়ে বলেছিলেন আসল উক্তিটির মর্মার্থ। সেইটি পড়লেই মনে পড়ে যাবে ক্লাস সেভেন কি এইটের ভৌতবিজ্ঞান বই – বাংলা মিডিয়ামের বন্ধুদের মনে পড়বে ৫ নম্বরের ‘টীকা’ – আদর্শ গ্যাস ও বাস্তব গ্যাসের তফাৎ লিখ। পরিচ্ছেদটি এইরকম:
“Now it would be very remarkable if any system existing in the real world could be exactly represented by any simple model. However, cunningly chosen parsimonious models often do provide remarkably useful approximations. For example, the law PV = RT relating pressure P, volume V and temperature T of an ‘ideal’ gas via a constant R is not exactly true for any real gas, but it frequently provides a useful approximation and furthermore its structure is informative since it springs from a physical view of the behavior of gas molecules.
For such a model there is no need to ask the question ‘Is the model true?’. If ‘truth’ is to be the ‘whole truth’, the answer must be ‘No’. The only question of interest is ‘Is the model illuminating and useful?’ ”
খেয়াল করে দেখুন বাক্যবন্ধটি, “cunningly chosen parsimonious models”, পার্সিমোনিয়াস মানে কেমন? শেষ করব সেই নিয়েই আর একটা গল্প বলে। আগেরটা পৃথিবীর ম্যাপ, এবারে আরো বাইরে বহির্বিশ্বের!
আবার মনে করুন সেই ছোট্টবেলার ভূগোল বই – সৌরজগতের ছবি আঁকা। প্লুটো তখন-ও লাইনের শেষে টিমটিম করে দাঁড়িয়ে আছে, আর বাকিরা আগে-পিছে উঁকি মারতে মারতে ঘুরে চলেছে – আমাদের দেখা সৌরজগতের প্রথম ‘মডেল’ এবং বলাই বাহুল্য, সেটিও খুঁটিয়ে দেখলে ‘ভুল’-ই। তবে এক্কেবারে ডাহা ভুল নয়, অন্তত সূর্য তো মধ্যিখানে, তাই না?
একটা সময় তা-ও ছিল না, যেমন ধরুন টলেমি আর কোপারনিকাস – টলেমি-র মডেল ‘জিওসেন্ট্রিক’ আর কোপারনিকাসের ‘হেলিওসেন্ট্রিক’। ‘জিওসেন্ট্রিক’ অর্থাৎ পৃথিবীর চারদিকে সূর্য বা অন্য গ্রহ প্রদক্ষিণ করে এমন কথা এখন বাচ্চারাও শুনলে হাসবে। আর বড়দের মধ্যে? সেই এক বিখ্যাত কন্সপিরেসি-থোরিস্ট কে-সি-পাল ছাড়া আর কেউ এ কথা বিশ্বাস করবেন, এমন ভাবনা-ই অসম্ভব, কিন্তু টলেমি নেহাত বোকা বা গোঁড়া মানুষ ছিলেন না। ছিলেন একজন জিনিয়াস!
টলেমির সেই মডেলের একটি ছবি নীচে দিলাম। সূর্যের কক্ষপথ বাইরের বিশাল বৃত্ত, আর তার ভেতরের কক্ষপথটি দেখুন – ঐটেই শুক্রগ্রহ – আমাদের শুকতারা। শুকতারার কক্ষপথের কেন্দ্রে একটি বৃত্ত – deferent – আর একটি ছোট্ট বৃত্ত – epicycle, শুকতারা সেই এপিসাইকেলে ঘুরতে ঘুরতে ঐ ডেফারেন্ট ধরে যেন চারদিকে ঘুরছে। টলেমির মডেলের সেই এপিসাইকেল আর ডেফারেন্টের প্রয়োজন ছিল – কারণ শুক্র আর বুধ – এই দুই গ্রহের ঘূর্ণন অন্যদের উল্টোদিকে, মানে শুক্রগ্রহের উপর জমে থাকা মেঘ একদিন কেটে গিয়ে রোদ উঠলে একজন ভেনুশিয়ান দিব্যি দেখবেন সূর্য পশ্চিমে উঠে, পূর্বে অস্ত গেল। এই রেট্রোগ্রেড মোশন ব্যাখ্যা করতে – বিভিন্ন বৃত্ত, বৃত্তের উপরে বৃত্ত – ইত্যাদির অবতারণা। কিন্তু টলেমি এইখানেই ছাড়েননি, প্রত্যেকটি গ্রহের গতি আরো নিখুঁতভাবে নির্ণয় করতে আরো কিছু এপিসাইকেল আঁকার দরকার ছিল – এদের নাম eccentrics আর equants! সেই ১৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে বসে কোনোরকম কম্পিউটার বা যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই, টলেমির মডেল যে আশ্চর্য প্রিসিশনে পৌঁছতে পেরেছিল – তা ভাবলে ব্যোম্কে যেতে হয় বইকি! এখন আমরা জানি – ঐ এপিসাইকেলের পিঠে এক্সেন্ট্রিক – এ শুনতে যতই বিদঘুটে লাগুক, আসলে সেই এনশিয়েন্ট গ্রীকরা যেটা আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন – সেটা একরকমের ফ্যুরিয়ার সিরিজ – কক্ষপথের মত পিরিওডিক ফাংশনকে সাইন-কোসাইন ইত্যাদি দিয়ে অ্যাপ্রক্সিমেট করার একটা দারুণ উপায়।
হ্যাঁ, টলেমির মডেল দেখে আপনি আকাশে হাউই অথবা মঙ্গলযান ছাড়লে সে কোথায় গিয়ে পড়বে দেবা ন জানন্তি, কিন্তু ঐ মডেল দেখে রাতের আকাশে কোথায় কী আছে দেখলে বিশাল কিছু ভুল হবে, এমন না। সেই জন্যেই, প্রায় হাজার বছরের-ও বেশি সময় ধরে ব্যবহৃত হয়েছে শুধু তা-ই না, সেই সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে-র মডেল-টিও প্রায় টলেমির মতন-ই – তিনি ভাবতেন, সূর্য পৃথিবীকে আর বাকি সব গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।
টলেমির মৃত্যু ১৭০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ, আর নিকোলাস কোপারনিকাসের জন্ম ১৪৭৩ খ্রীষ্টাব্দ – কলম্বাসের যাত্রাশুরুর বছর কুড়ি আগে। কোপারনিকাস বলেছিলেন জিওসেন্ট্রিক মডেলকে বদলে হেলিওসেন্ট্রিক মডেল ব্যবহার করা উচিত, কারণ তা বেশি ‘সঙ্গতিপূর্ণ’ (harmonious), যে মতবাদে বিশ্বাস করে কয়েক দশক পরেই চার্চের রোষের মুখে পড়বেন গ্যালিলিও। সে গপ্পো সবার জানা।
কী ভেবেছিলেন কোপারনিকাস? খুব সরল করে বললে, পৃথিবীর বদলে যদি রেফারেন্স ফ্রেমটাকে ফিট করি সূর্যের গায়ে, তাহলে যে ছবিটা দেখা যাবে, সেইটেই কোপারনিকাসের মডেল – সেই-ই আমাদের ছোটবেলার বইয়ের ছবি। মাঝে সূর্য – চারপাশে গ্রহের কক্ষপথ।
মজার কথা হচ্ছে এই, যে টলেমি আর কোপারনিকাসের মডেল যতই মূল ধারণাতেই আলাদা হোক, দুটোর যে কোনো একটা মডেল বিশ্বাস করলে যে পর্যবেক্ষণগুলো পাওয়া যাবে, সেইগুলো রীতিমত কাছাকাছি, অর্থাৎ এরা observationally equivalent। আর কোপারনিকাসের মডেলেও এপিসাইকেল ছিল, ডেফারেন্ট ছিল, জটিল বৃত্তের-উপর-বৃত্ত-ভেতরে-বৃত্ত ইত্যাদি-প্রভৃতি, তার উপরে কোপারনিকাসের মডেল মানুষকে বিশ্বাস করতে বলল – পৃথিবী প্রচণ্ড বেগে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে – যেটা বলাই বাহুল্য, পৃথিবীর উপরে দাঁড়িয়ে অনুমান করা অসম্ভব। সাধারণ মানুষ অথবা চার্চ যে হেলিওসেন্ট্রিক মডেল-কে সঙ্গে সঙ্গে আপন করে নেননি, সে ভাবা অসম্ভব নয়।
কোপারনিকাস কিন্তু শুধু ‘হারমনি’ নামে বায়বীয় কোনো ধারণার উপর ভিত্তি করে বলেননি যে তার হেলিওসেন্ট্রিক মডেলটিই বেশি উপযুক্ত। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, “We thus follow nature, who producing nothing in vain or superfluous often prefers to endow one cause with many effects” – প্রকৃতি-তে অনর্থক জটিলতা-র জায়গা নেই, আর ওঁর হেলিওসেন্ট্রিক মডেল জিওসেন্ট্রিকের সমতুল্য পূর্বাভাষ দিতে পারে, অনেক কম-সংখ্যক এপিসাইকেল-ডেফারেণ্ট ব্যবহার করে, অর্থাৎ অনেক সহজতর একটি মডেল দিয়ে। প্রকৃতি, অতএব, এইটিই বেশি পছন্দ করবেন, এবং এই-ই বক্সের ভাষায় সেই “cunningly chosen parsimonious model”।
দর্শন বা বিজ্ঞানের ভাষায় এই যুক্তি বা প্রিন্সিপলটির একটি নাম আছে, উইলিয়াম অফ ওকহ্যামের নামে ‘ওকহ্যাম’স রেজর’ (Ockham’s razor) – “Models with fewer assumptions are to be preferred” … টলেমি আর কোপারনিকাসের বেলায় এই রেজর-ই বলে দিচ্ছে কী করা উচিত – দুটো মডেলেই যেহেতু উত্তর দিচ্ছে কাছাকাছি, তাই যেটি বেশি সরল, সেইটি মেনে চলা উচিত। বলাই বাহুল্য, ওকহ্যাম বলছেন না – এদের কোনোটিই ঠিক কি না – খালি বলছেন, দুটোর মধ্যে কোনটা একটু বেশি ভালো।
কিন্তু যদি উত্তর বা জটিলতা (কমপ্লেক্সিটি) কোনোটাই না মেলে? সে উত্তর ওকহ্যাম দিয়ে যাননি। তবে, তাতে ভয়ের কিছু নেই, আধুনিক রাশিবিজ্ঞানের একটা বিশাল অংশের কাজ এই সমস্ত প্রশ্নের নিরন্তর উত্তরের তালাশ, আর এর পরের বা তার পরের কোনো এক সংখ্যায় যদুবাবুই বলে দেবেন দুই-একটি সূত্র।
তবে তার আগে, পরের সংখ্যায় বলব আরেকটি গল্প, মডেল একেবারেই ভুল হওয়ার অথবা না জেনেবুঝে রাশিবিজ্ঞানের একেবারেই ভুল প্রয়োগের করুণ পরিণতি – যে ট্রাজেডির নাম মহাকাশযান চ্যালেঞ্জারের দুর্ঘটনা।