(১)
“However big floods get, there will always be a bigger one coming; so says one theory of extremes, and experience suggests it’s true”
~ Presidents Water Comm. P. 141, taken from “Statistics of Extremes” – E. J. Gumbel
উপকূলের কাছাকাছি জন্মেছেন, আর জীবনে বন্যা দেখেননি এমন মানুষ পাওয়া অসম্ভব। ফি বছর বর্ষাকালে একদিন না একদিন তুমুল বৃষ্টি হবে, হয়তো চলবে টানা দু-তিন দিন, আর আস্তে আস্তে জল বেড়ে বেড়ে নর্দমা ছাপিয়ে গলি, গলি ছাপিয়ে বাথরুম, আস্তে আস্তে শোওয়ার ঘর। সেসব ছবিতে অভ্যস্ত হয়ে যায় মানুষ। কিন্তু তার মধ্যেও জ্বলজ্বল করে ভয়াবহ এবং বিরল প্রাণঘাতী বন্যার স্মৃতি, খবরের পাতায় ছবি দেখি কোনো রকমে হয়তো একটি পোষ্য বা শিশুকে নিয়ে, সর্বস্ব খুইয়ে গলা-জলে হাঁটছে গতিহীন, গৃহহারা মানুষ, জলে ডুবে গেছে গাড়িবাড়ি, ম্যাপ-কে ম্যাপ নিশ্চিহ্ন। হয়তো আসাম, কেরালা, হিমাচলের কোথাও, বা হয়তো বাংলাদেশ, পাকিস্তান অথবা মিসিসিপির তীর। হয়তো আগামী দিনে এমন কোনো জায়গা শিরোনামে উঠে আসবে, যেখানে এতো বড়ো বিপর্যয় হবে এমন ভাবতেই পারেন নি কেউ?
এইরকম ভয়াবহ বন্যার সম্ভাবনার কথা ভেবে তর-তম করেন ভূবিজ্ঞানীরা, হাণ্ড্রেড ইয়ার ফ্লাড, ফাইভ-হান্ড্রেড ইয়ার ফ্লাড, থাউজ্যান্ড … ইত্যাদি। কিন্তু, এই হাণ্ড্রেড-ইয়ারস ফ্লাডের মতো এমন ঘটনা যা হয়তো কোথায় একবার-ও হয়নি আগে, বা হলেও হয়তো সেই কোন মান্ধাতার আমলে, সেই বিরল থেকে বিরলতম দুর্ঘটনার মোকাবিলা করার পরিকল্পনা করবেন কেমনে? একটা নির্দিষ্ট প্রশ্ন ভাবলে সুবিধে হয়, ধরুন আপনি সেই ছোটোবেলার হান্স ব্রিঙ্কারের গল্পের মত এক ডাচ গ্রামের লোক, বন্যার জল আটকাতে চারদিকে এমন বাঁধ দিতে চান, যাতে আগামী একশো, কি হাজার বছরের বন্যার জল-ও কক্ষণো সেই বাঁধ টপকাতে না পারে, এইবার ভাবুন কত উঁচু বাঁধ বানাবেন হান্স? উচ্চতা মাপবেন কী করে সেই অনাগত বিপুল তরঙ্গের?
আধুনিক বিজ্ঞানের বহু বহু প্রশ্নের উত্তর যে রাশিবিজ্ঞান দিয়েছে সে তো বলাই বাহুল্য। সেসব প্রশ্নের উত্তর যোগানোর জন্য তথ্য (ডেটা)-ও তো আছে প্রচুর পরিমাণে, বরং দরকারের চেয়ে কিছু হয়তো বেশিই। কিন্তু এই ধরণের এক্সট্রিম ইভেন্টের (চূড়ান্ত?) সম্ভাবনা মাপার সূত্রটি ধরতে গেলে সেইসব অঙ্কের ভাঁড়ারেও কিছু কমতি পড়ে যায়। দরকার পড়ে অন্য একরকমে প্রোবাবিলিটি থিয়োরি – থিয়োরি অফ এক্সট্রিমস।
আজকে সেই সুন্দর শাখাটির দুইজনের গল্প বলব – প্রথম জন লেওনার্ড হেনরি ক্যালেব টিপেট, আর দ্বিতীয়জন আমার একজন ব্যক্তিগত নায়ক, এমিল জুলিয়াস গাম্বেল।
এল-এইচ-সি টিপেটের জন্ম ১৯০২ সালে লণ্ডনে, পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়ে স্নাতক করেন ১৯২৩-এ। পড়াশুনো করতে করতেই পদার্থবিদ্যার ছাত্র টিপেট লক্ষ করেন, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল পুরোপুরি যেন পদার্থবিদ্যার থিয়োরির সাথে মিলছে না আর সিদ্ধান্তে আসেন, যে সেই থিয়োরি ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার বদলে বরং উচিত আরও ভালো স্ট্যাটিস্টিক্যাল ডিস্ট্রিবিউশন কষে বের করা।
পাশ করে টিপেট চাকরি করতে শুরু করেন শার্লি ইন্সটিটিউটে, যার আরেক নাম ব্রিটিশ কটন ইন্ডাস্ট্রি রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন। কটন ইন্সটিটিউটে তখন প্রধান গবেষণার লক্ষঃ কী ভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে আরও শক্ত, মজবুত সুতো বানানো যায়? টিপেট গবেষণার সূত্রে দুটি জিনিষ লক্ষ্য করলেনঃ প্রথমত, দুটো আলাদা সুতো টেনে ছিঁড়তে আলাদা বলপ্রয়োগ করতে হচ্ছে যদিও দুটোই এক-ই প্রক্রিয়ায় বোনা হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি আরও কৌতূহলেরঃ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করে দেখলেন একটা সুতোর জোর নির্ভর করছে তার মধ্যে দুর্বলতম ফাইবারটির উপরে।
দুর্বলতম ফাইবার – উইকেস্ট কম্পোনেন্ট – কী ভাবে মডেল করা যায় দুর্বলতমের ব্যবহার, বা ডিস্ট্রিবিউশন? এক বছরের ছুটি নিয়ে টিপেট চলে গেলেন ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লণ্ডনে, কার্ল পিয়ারসনের কাছে।
কার্ল পিয়ারসনের বৈজ্ঞানিক জীবনের শেষের দিক তখন, ইউসিএলের পরিবেশ তখন স্বপ্নতুল্য। অনেক শিখলেন সেখানে টিপেট, তবুও দুর্বলতমের সূত্র তখনো অধরা। শার্লি ইন্সটিটিউটে ফেরার পরে হঠাৎই একদিন টিপেট আবিষ্কার করে ফেললেন সহজ একটি গাণিতিক সূত্র। লব্ধ তথ্য থেকে এক ধাপে যাতে পৌঁছে যাওয়া যায় দুর্বলতমের সমীকরণে।
তবুও আরও একটি ধাপ বাকী ছিলো – সমীকরণ থেকে সমাধানে পৌঁছনো। পিয়ার্সন পারলেন না সাহায্য করতে, রাশি-রাশি ইঞ্জিনিয়ারিং এর পুঁথির রাশি-রাশি জটিল ইকুয়েশনের সলিউশনের ভিড়েও পেলেন না। অবশেষে যা করলেন, তাকে গোদা বাংলায় বলে “ব্যাক ক্যালকুলেশন” – সমীকরণের সমাধান কি হবে সেইটে আগে আন্দাজ করে মিলিয়ে দেখলেন হ্যাঁ তাই তো মিলে যাচ্ছে একদম। কিন্তু এইটাই কি একমাত্র সমাধান? না আরও আছে? সেই উত্তর মিলিয়ে দিলেন ফিশার, আর-এ-ফিশার (যে জিনিয়াসের কথা আগেও বলেছি অন্য কিস্তিতে)। ফিশার প্রমাণ করলেন টিপেটের সমাধানটি ঠিক, এবং আরও ঠিক দুটি সমাধান সম্ভব সেই সমীকরণের, এবং সবমিলিয়ে এই তিনটে বই আর কোনো সমাধান থাকতে পারে না এই এক্সট্রিমের।
সেই বিখ্যাত পেপারটিই ফিশার অ্যাণ্ড টিপেট (১৯২৮), আর এই যে তিনটে সমাধান, এদের নাম “টিপেট’স থ্রি অ্যাসিম্পটোট অফ দ্য এক্সট্রিম”।
কী ভাবে কাজে লাগানো হয় এই সমাধান-সূত্র? ফিরে যাচ্ছি সেই “হান্ড্রেড ইয়ারস ফ্লাড” প্রবলেমেই। টিপেটের সূত্র বলে দেয় সাধারণ লব্ধ-রাশি/তথ্যের সাথে এক্সট্রিম / চরম রাশির সম্পর্ক – অর্থাৎ, যদি ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে প্রত্যেক বছরের বন্যার জলের উচ্চতার তথ্য থাকে, সেখান থেকে সহজেই পরিমাপ করা যাবে টিপেটের ডিস্ট্রিবিউশনের প্যারামিটারগুলো, আর সেই প্যারামিটার বলে দেবে এক্সট্রিম ভ্যালুর ব্যবহার।
বলাই বাহুল্য, শুধুই বন্যার জলের উচ্চতা নয়, এক্সট্রিম ভ্যালু থিওরির, সংক্ষেপে ইভিটি-র প্রয়োগ হয়েছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন, বিচিত্র শাখায়। যেমনঃ
২০১৮ সালের একটি পেপারে তিনজন প্রোবাবিলিস্ট অঙ্ক করে দেখালেন মানুষ কতোদিন বাঁচতে পারে তার সীমা বের করে ফেলা যায় ইভিটি লাগিয়ে। তারা ডেটা কালেক্ট করলেন ১৯৮৬ থেকে ২০১৫ অব্দি নেদারল্যাণ্ডের মানুষদের মৃত্যুকালীন বয়সের – আর সেই ডেটা থেকে গণনা করে বললেন মানবজীবনের সীমা ছেলেদের ১২৫, মেয়েদের ১২৪! অনন্তজীবন হবে সে গুড়ে মগরার ফাইন স্যাণ্ড।
এদের-ই মধ্যে একজন বৈজ্ঞানিক এর কিছু বছর আগে বের করে ফেলেছেন অ্যাথলেটিক রেকর্ডের এক্সট্রিম, মানে ধরুন ১০০ মিটারের অলিম্পিক রেস কিংবা হাই-জাম্প। সেরার সেরা রেকর্ড কতো হতে পারে এরকম একটা ইভেন্টে? উসেইন বোল্ট বা ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নারের থেকেও তাড়াতাড়ি শেষ করবে কেউ?
অথবা ধরেন গগনচুম্বী স্কাইস্ক্রেপার। যতো জনসংখ্যা বাড়বে ততো উর্ধ্বপানে ছুটবে সে, কিন্তু কতদূর? ২০১৮-র একটি পেপারে দুজন দাবী করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে অন্তত ৪১ হাজার স্কাইস্ক্রেপারের উচ্চতা হবে ১৫০ মিটার আর উচ্চতম – তা প্রায় হাজার খানেক মিটার তো বটেই।
টিপেটের কাজের প্রায় তিরিশ বছর পর এক্সট্রিম ভ্যালুর থিওরি নিয়ে প্রামাণ্য একটি বই লিখলেন আরেকজন। তার নাম এমিল জুলিয়াস গাম্বেল। তাতে টিপেটের থিওরি শুধু নয়, তার পরের বিভিন্ন রিফাইনমেন্ট, নিজের কিছু সংযোজন মিলিয়ে প্রায় যেটুকু জানার থাকে, সব-ই অত্যন্ত সুন্দর, সহজ ভাষায় গুছিয়ে লিখে দিলেন গাম্বেল। প্রোবাবিলিটি বা রাশিবিজ্ঞানের টেক্সট সাধারণতঃ দুরূহ কঠিন বলেই বদনাম, কিন্তু এই একটি বই যেন সেই বাঁশবনে একটি যত্নে কেয়ারি করা বাগান।
বইয়ের শুরুতেই উক্তি, “Blessed is he who expects nothing, for he shall never be disappointed” … আর তার কিয়ৎক্ষণ পরেই গাম্বেলের বিনয়ী নিবেদন, “"This book is written in the hope, contrary to expectation, that humanity may profit by even a small contribution to the progress of science."
(২)
এক্সট্রিম ভ্যালু থিওরি-র একজন অন্যতম রূপকার ছাড়াও আরেকটি সম্পূর্ণ অন্য কারণে গাম্বেলের নাম ইতিহাসে অমর থাকা উচিত, যদিও সেই দিকটিতে আলো পড়ে কম।
টিপেট যখন ছাত্র, সেই ১৯২২ সালে, গাম্বেল নিজে জার্মানির ইউনিভার্সিটিতে একজন অখ্যাত কিন্তু প্রতিশ্রুতিবান অধ্যাপক। সেই সময়ের জার্মানিতে নাৎসী শাসন আস্তে আস্তে থাবা গেড়ে বসছে – ন্যাশনালিস্ট সোশ্যালিস্ট সরকারীভাবে স্বীকৃত হলেও আসলে গুণ্ডাদের দল বৈ কিছু না, তাদের প্রত্যক্ষ মদতে এবং প্ররোচনায় ব্রাউন শার্টস-এর দল পার্টির ইচ্ছে বলবৎ করে – হয় ভয় দেখিয়ে, না হলে মারধর, তাতেও না হলে প্রকাশ্যে খুন, আর আদালতের বিচারে কোনোদিন-ই শাস্তি হয় না ব্রাউন শার্টদের, “উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে” ছাড়া পেয়ে দিব্যি দাপিয়ে বেড়ান তারা।
এমিল জুলিয়াস গাম্বেল
গাম্বেলের এক বন্ধুও একদিন খুন হয়ে গেলেন প্রকাশ্যে। গাম্বেল দেখলেন আদালতে বিচারের নামে নেহাত-ই প্রহসন হলো শুধু, বিচারক কোনো প্রমাণ-ই গ্রাহ্য করলেন না, আর উল্লাসে মেতে উঠলো নাৎসী গুণ্ডার দল। গাম্বেল বুঝতে পারলেন জার্মানির বিচারব্যবস্থাও পুরোপুরি নাৎসিবাহিনীর দখলে, আর বিচারকদের সবাই হয় নিজেই নাৎসী-সমর্থক, না হলেও নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছেন সেই নিষ্পেষণ যন্ত্রের কাছে। (এ অব্দি পড়ে চেনা ঠেকছে, পাঠক?)
যা হোক, গাম্বেল ভয় পেলেন না। সেই ১৯২২ সালেই একটি বই ছাপিয়ে ফেললেন সাহস করে, নাম Vier Jahre politischer Mord (Four Years of Political Murder)। ১৯১৮-র নভেম্বর ৯, অর্থাৎ জার্মান রেভোলিউশনের শুরুর দিন থেকে দক্ষিণপন্থী এবং বামপন্থী রাজনৈতিক হত্যার দলিল। এইখানে গাম্বেলের সেই রাজনৈতিক হত্যার দলিল থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করলে আশা করি খুব অন্যায় হবে না।
- “Correspondingly, the right is inclined to hope that it could annihilate the left opposition, which is carried by hopes for a radically different economic order, by defeating its leaders. And the right has done it: all of the leaders of the left who openly opposed the war and whom the workers trusted–Liebknecht, Luxemburg, Eisner, [Gustav] Landauer, [Leo] Jogisches, et al–are dead.
- The effectiveness of this technique is for the moment indisputable. The left no longer has any significant leaders, no more people toward whom the masses have the feeling: he has suffered so much for us, dared so much for us that we can trust him blindly. The working-class movement has thereby doubtlessly been set back by years. This success is all the greater since in no case has punishment occurred.
- The unbelievable leniency of the court is also quite well known to the perpetrators. . . . Today the [right wing] perpetrator risks nothing at all. Powerful organizations with an extensive network of confidantes over the whole country provide him with shelter, protection, and material sustenance. “Right-minded” bureaucrats and police chiefs supply falsified papers for potentially necessary trips abroad. . . . The beneficiaries live magnificently and happily in the best hotels.”
গাম্বেলের বইয়ের একটি টেবল (সারণী) নীচে দেওয়া থাক, অবস্থার ভয়াবহতা বোঝাতেঃ
| বামপন্থীদের দ্বারা | দক্ষিণপন্থীদের দ্বারা |
মোট রাজনৈতিক হত্যার সংখ্যা | ২২ | ৩৫৪ |
বিচারে শাস্তিপ্রাপ্তের সংখ্যা | ৩৮ | ২৪ |
কারাবাসের মেয়াদ | ১৫ বছর | ৪ মাস |
মোট প্রাণদণ্ডের সংখ্যা | ১০ | ০ |
গাম্বেলের ১৯২২ সালের বই থেকে মূল টেবল (উপরে যার থেকে একটি অংশ দেওয়া হলো)
১৯৩৩-এ নাৎসি বাহিনী ক্ষমতায় আসে যখন, গাম্বেল তখন সুইজারল্যাণ্ডে গেছেন সেমিনারে। খবর পেয়ে তক্ষুণি দেশে ফিরে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন বিরুদ্ধ-সংগ্রামে, বন্ধুরা বোঝান যে গাম্বেল বর্ডার পেরোনোর আগেই গ্রেফতার হবেন, খুন-ও।
সেই সময়েই আরও কিছু ইহুদি অধ্যাপক, যেমন বিখ্যাত প্রোবাবিলিস্ট রিচার্ড ভন মিসেস, আগে থেকেই পরিস্থিতি বুঝতে পেরে পালিয়ে যান ফ্রান্সে। গাম্বেল-ও পৌঁছন দক্ষিণ ফ্রান্সে, কিন্তু বেশীদিন নিরাপদ রইলেন না কেউ-ই, ’৪০-এই ফ্রান্সে নাৎসীবাদের থাবা এসে পৌঁছলো। গাম্বেল ও আরও বেশ কিছু মানুষ তখন ‘এনিমি অফ দ্য স্টেট’ – নাৎসিবাহিনী চায় ফ্রান্সের নাম-কা-ওয়াস্তে সরকার হস্তারন্তিত করুক তাদের। হয়তো তাই-ই হতো, রক্ষাকর্তার ভূমিকায় নামলেন মার্সেই-এর তৎকালীন আমেরিকান কনসাল হিরাম বিংগহ্যাম ফোর, স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দেশিকা অমান্য করে ভিসা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দিলেন গাম্বেল ও অন্যান্য জার্মান উদবাস্তুদের। বিংগহ্যাম চাকরিটি অবশ্য অচিরেই খোয়ালেন, কিন্তু সাক্ষাৎ মৃত্যুর শমন থেকে বাঁচিয়ে দিলেন অনেকগুলি মানুষের। অন্ধকারের মাঝে এও এক আলো। গাম্বেল এসে যোগ দিলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখান থেকেই কিছু বছর পরে প্রকাশিত হবে সেই এক্সট্রিম থিওরির বাইবেলটি।
গল্পের সুতো হাত থেকে পড়ে গেলে কোথা থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যায় সে বোঝা দায়, এই যেমন এখন এক্সট্রিম ভ্যালুর গল্প বলতে বলতে চলে এসেছি এক্সট্রিমিস্টদের ভয়ের গল্পে। গল্পের অবশ্য আর বেশী বাকি নেই, নাৎসী বাহিনীর কী হয়েছে সে ইতিহাস জানে, কিন্তু সেই যে ফকনার বলেছিলেন না, ‘the past is never dead, it is not even the past’ … দক্ষিণপন্থী ব্রাউন-শার্ট আর নেই, কিন্তু নাৎসীবাদ যে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ উড়ে গেছে এ কথা অমূলক। এই প্রতিবেদন লেখার সময়েই জানি শুধু টুইটারে কী ভয়ঙ্কর অ্যান্টি-সেমিটিক ঘৃণার মেসেজ আর হুমকি চলছে প্রতিনিয়ত – সে নিকষ অন্ধকারের কোনো শেষ নেই।
বা হয়তো আছে, আমাদের অন্তিম মূল্য হয়তো ঘৃণায় নয়, সত্যিই প্রেমে, তবে কোনো এক্সট্রিম ভ্যালুর থিওরির সাধ্য নেই সেই সম্ভাবনার ঠিকঠাক প্রেডিকশন করা। আর কী জানেন তো, গভীর-গভীরতম অসুখ তো আসলে পৃথিবীর নয়, মানুষের। গাম্বেলের সেই রাজনৈতিক হত্যার দলিল থেকে আরেকটি মর্মান্তিক উক্তি দিয়ে শেষ করবঃ
“Public opinion in general approves of this procedure. For clever propaganda has taught it that every enemy of militarism is a Spartacist, therefore an enemy of humanity, therefore open game.”
তবে তাও আশা রাখি, সেই মূঢ় ম্লান স্রোতের মধ্যে থেকেও একজন গাম্বেল উঠে আসবেন প্রত্যেকবার, আর রাজনৈতিক হত্যার রেখে যাওয়া দলিল আমাদের বলে দেবে আসলে ইতিহাস থেকে কিছুই কোনওদিন-ই শিখে উঠতে পারব না আমরা।
পুনশ্চ
- রিচার্ড ভন মিসেস আরেক জন বিরল প্রতিভা, যিনি এক-ই সাথে অঙ্ক, স্ট্যাটিসটিক্স, প্রোবাবিলিটি, সলিড মেকানিক্স, ফ্লুইড মেকানিক্স, এরোনটিক্স, এরোডায়নামিক্স - সবেতেই কোনো না কোনো অবদান রেখে গেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রো-হাংগেরিয়ান আর্মিতে যোগ দেন, এবং সেই সাম্রাজ্যের (মনার্কি-র) প্রথম বড় উড়োজাহাজ বানানোর মূল কারিগর। যুদ্ধের পরে ১৩ বছর বার্লিনে থাকার সময় প্রোবাবিলিটি এবং দর্শনশাস্ত্রে উৎসাহী ভন মিসেস যে বইটি লেখেন "Wahrscheinlichkeit, Statistik und Wahrheit", সেইটিই আমাদের লাইনে তার জনপ্রিয়তম কাজ। একটি জর্নল-ও শুরু করেন এই সময়েই, ফলিত গণিত ও বলবিদ্যার। ১৯৩৩ সালে হিটলারের ক্ষমতায় আসার পরে ভন মিসেস প্রথমে যান ইস্তানবুল, লিখতে শুরু করেন ফ্রেঞ্চে, তারপর ১৯৩৯ সালে হার্ভার্ড, যার পর থেকে সব লেখাই প্রায় ইংরেজিতে। বার্লিনের ১৩ বছর থাকার সময় ভন মিসেস মন দিয়ে কবি রাইনের মারিয়া রিলকের সমস্ত কাজ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। দেশ ছেড়ে আসার আগে তিনিই ছিলেন রিলকের বৃহত্তম ব্যক্তিগত কালেকটর, এবং বলাই বাহুল্য, একজন অথরিটি-বিশেষ।
- অঙ্কের জগতে বার্নৌলি পরিবারের নাম সবাই জানে, এবং বোধহয় এমন কোনো শাখাই নেই যেখানে তারা কিছু না কিছু ছাপ রেখে গেছেন, এক্সট্রিম ভ্যালু থিওরি-ও তার ব্যতিক্রম নয়। ১৭০৯ সালে নিকোলাস বার্নৌলি একটি অ্যাকচুয়ারিয়াল অঙ্ক সমাধান করেছিলেন - সেইটি এইরকমঃ "ধরা যাক, 'এন' সংখ্যক সমবয়স্ক মানুষ ঠিক 'টি' সময়ের মধ্যে মারা যাবেন। তাহলে যিনি সবার শেষে মারা যাবেন, অর্থাৎ, লাস্ট সারভাইভর, তাঁর গড় বয়স কতো হওয়া উচিত? বার্নৌলির সমাধানটি খুব সুন্দর - ধরে নেওয়া যাক, 'টি' দৈর্ঘ্যের একটি সরলরেখার উপর 'এন' খানা র্যান্ডম বিন্দু বসানো, তাহলে কষে বের করতে হবে মূলবিন্দু (অরিজিন) থেকে দীর্ঘতম দূরত্বের গড় কত?
ঋণস্বীকার
আমার অগ্রজপ্রতিম সিনিয়র ও বন্ধুমানুষ পার্থনীল-দা, যার হাতে লেখা লেকচার নোটস পড়ে এক্সট্রিম ভ্যালু থিওরির প্রতি আগ্রহ তৈরী হয়।
সূত্রনির্দেশ:
- Salsburg, D. (2001). The lady tasting tea: How statistics revolutionized science in the twentieth century. Macmillan
- Gumbel, E. J. (1958). Statistics of extremes. Courier Corporation.
- Gumbel, E.J.: Vier Jahre Politischer Mord. Berlin–Fichtenau: Verlag der Neuen Gesellschaft, Berlin (1922)
- Mathematician and chronicler of political murders, New facts on extreme value theoretician Emil J. Gumbel (https://www.sciencedaily.com/releases/2017/09/170919105203.htm)
- Einmahl, J. J., Einmahl, J. H., & de Haan, L. (2019). Limits to human life span through extreme value theory. Journal of the American Statistical Association, 114(527), 1075-1080
- Einmahl, J. H., & Magnus, J. R. (2008). Records in athletics through extreme-value theory. Journal of the American Statistical Association, 103(484), 1382-1391.
- Auerbach, J., & Wan, P. (2020). Forecasting the urban skyline with extreme value theory. International Journal of Forecasting, 36(3), 814-828.
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।