এখানে আমি মূলত কথা বলব ইসলাম ধর্ম ও সংশ্লিষ্ট মৌলবাদ প্রসঙ্গে আমাদের সমাজের মূলস্রোত ধ্যানধারণা নিয়ে, এবং তার ঠিক-বেঠিক নিয়েও। এ নিয়ে কথা বলব কারণ, আমার ধারণা, ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে যাঁরা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়তে চান, তাঁদের এ বিষয়টি এড়িয়ে যাবার কোনও উপায় নেই। ... ...
‘মৌলবাদ’ বস্তুটি যে আধুনিকতার বিরুদ্ধে এক প্রতিক্রিয়া এবং সেইহেতু তারই এক উপজাত, সে ব্যাপারে বোধহয় আর সন্দেহ থাকার কথা না। মৌলবাদ যতই ধর্মের সনাতন, মূল ও বিশুদ্ধ সারবস্তুতে ফিরে যাবার কথা বলুক, মূল্যবোধে যতই সংরক্ষণশীল হোক, এবং যতই প্রাচীন এক স্বর্ণযুগের মিথ নির্মাণ করে তাতে ফিরে যাবার ডাক দিক, তা আসলে নিতান্ত আধুনিক এক ‘ফেনোমেনন’ বা প্রপঞ্চ। শুনতে অসম্ভব লাগলেও, ভেতরের সত্যি এটাই। এ প্রপঞ্চ নির্মিত হয় আধুনিক পৃথিবীতে ধর্মের অপ্রাসঙ্গিক ও বিলুপ্ত হয়ে যাবার উদ্বেগের অভিঘাতে। ... ...
বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর সময়কাল ধরে ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ বা ‘মৌলবাদ’ সারা পৃথিবী জুড়ে এমনই এক ‘ফেনোমেনন’ হয়ে দেখা দিয়েছে, কোনও চিন্তাশীল মানুষই যাকে আর উপেক্ষা করতে পারেন না। ইউরোপে রেনেসাঁ, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব, এনলাইটেনমেন্ট, শিল্প বিপ্লব এইসব ঘটে যাবার পর থেকে আলোকপ্রাপ্তদের মনে ক্রমশ এই ধারণাটাই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছিল যে, জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি অর্থনীতি এইসবের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের প্রভাব আস্তে আস্তে কমে আসবে, এবং এক সময়ে হয়ত তা পুরোপুরিই অবলুপ্ত হয়ে যাবে। সমাজতন্ত্রের ধ্যানধারণার প্রচার ও প্রসারের ফলে এ প্রত্যাশা আরও অনেক জোরালো হয়েছিল, শেষতক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক বা না-ই হোক। সেদিক থেকে দেখলে, বিশ শতকের শেষে ধর্মের রমরমা বেড়ে ওঠা এবং মৌলবাদের উত্থান প্রায় এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এখন, বিষয়টি নিয়ে চর্চা করতে হবে, গভীরভাবে ভাবতে হবে যুক্তি সহকারে, এবং পৌঁছতে হবে কোনও এক বুদ্ধিগ্রাহ্য উপলব্ধিতে। বোঝার চেষ্টা করতে হবে, সমকালীন সমাজবিজ্ঞান এ নিয়ে কী ভাবছে। ... ...
আমি গত ১৭ জানুয়ারি ‘গুরুচণ্ডাঌ’ ব্লগ সাইটে একটি লেখা লিখেছিলাম কোভিড-অস্বীকারপন্থী এবং ভ্যাকসিন-বিরোধী ভুয়ো গুজব ও হিড়িকের বিরুদ্ধে, কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়েই। ‘চারনম্বরপ্ল্যাটফর্ম’-এ যে এর বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় একটি লেখা বেরিয়েছে, আমি তা মোটেই টের পাইনি, কয়েকদিন আগে আমার বন্ধুরা সে দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার আগে পর্যন্ত। লেখাটি লিখেছেন জনৈক চিকিৎসক, আমার অপরিচিত। লেখাটির মধ্যে ‘সাত জার্মান, জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে’ গোত্রের বেশ এক রকমের একটা বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গি আছে। তাবৎ বিশ্বের বিলিয়নেয়ার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্তা, বড় বড় ওষুধ কোম্পানির মালিক আর পৃথিবীর সমস্ত দেশের সরকারি স্বাস্থ্য-কর্তারা সব একযোগে ভ্যাকসিনের সিরিঞ্জ উঁচিয়ে তেড়ে আসছে, আর তিনি ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের ছাতার বাঁট বাগিয়ে একা লড়ে যাচ্ছেন, এই রকম আর কি! সে লেখার প্রেক্ষিতেই, আমার এই জবাব। ... ...
চিকিৎসক ও গবেষক অমিতাভ নন্দীর একটি ভিডিও গত কয়েক দিন ধরে সোশাল মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে ছড়ানো হচ্ছে। তাতে তিনি বলছেন, কোভিড আসলে সাধারণ ফ্লু ছাড়া আর তেমন কিছুই নয়, এবং তা আটকাবার জন্য যে ভ্যাকসিনটা দেওয়া হচ্ছে সেটাও অকেজো, কাজেই কোভিড এবং তার ভ্যাকসিন --- কোনওটিকেই নাকি বিশেষ পাত্তা দেবার দরকার নেই। তাঁর মতে, ভ্যাকসিন বানিয়ে ভাইরাস-জাত ব্যাধিকে আটকাবার দাবি করা নাকি আসলে এক রকমের প্রকৃতি-বিরোধী দম্ভ (আবার একেবারে শেষে যদিও বলেছেন, তিনি নাকি ‘সত্যি ভ্যাকসিন’ এর জন্য অপেক্ষা করছেন)। তিনি আরও বলেন, রোগ হয়ে শরীরে ‘স্বাভাবিক’ প্রতিরোধ তৈরি হতে দেওয়াটাই রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে ভাল পন্থা, এবং টিকাকরণের চেয়ে তা অনেক ভাল। ভিডিও-টি আগে দেখেছি, আজ আরও কয়েকবার মন দিয়ে দেখলাম। এবং, একজন বর্ষীয়ান দায়িত্বশীল চিকিৎসক কীভাবে এমন বলতে পারেন, তা দেখে স্তম্ভিত হলাম। হ্যাঁ, তিনি এখানে যা যা বলেছেন, তার সবই ভুল। ... ...
আন্তর্জালে ভুয়ো খবর আর ভুলভাল হাস্যকর অবান্তর কথাবার্তার প্রবাহ নিরন্তরই চলে, চলতেই থাকে। তার বেশিরভাগই চোখে পড়েনা, এবং যা চোখে পড়ে তারও প্রায় সবটাই নীরবে উপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকেনা। কারণ, প্রথমত, যেসব বিচিত্র ব্যাপার নিয়ে কথা হয় তার সব কিছু বিস্তারিত ভাবে জানা থাকেনা, আর জানা থাকলেও তার পেছনে পড়ে থাকতে গেলে নাওয়া খাওয়া ভুলতে হয়। কিন্তু, মাঝে মাঝে সত্যিই কিছু না বলে আর পারা যায়না, এবং এখন বোধহয় সেই মুহূর্ত আবার এসেছে। গত বছরখানেক যাবৎ কোভিড আর তার ভ্যাকসিন নিয়ে ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিকদের নির্বোধ ও কুৎসিত শোরগোলে কান পাতাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যি, এ আর বাস্তবিকই নেওয়া যাচ্ছে না! ... ...
আচ্ছা, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এই যে আমাদের এত কান্নাকাটি, এইটা আদৌ করছি কেন আমরা? শুধুই ওটা আমাদের সংবিধানে সসম্মানে উল্লিখিত আছে বলে? শুধুই কি এই কারণে যে, পশ্চিম একে এক অবশ্য-পালনীয় আদর্শ বলে মনে করে, এবং আমরা পশ্চিমকে অনুকরণ করতে ভালবাসি? শুধুই কি এই কারণে যে, ওর মধ্যে ‘নিরপেক্ষতা’ কথাটা আছে এবং সেটা শুনতে বেশ চমৎকার লাগে? ... ...
পশ্চিমবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্যের মসনদ ধর্মান্ধ হিংস্র মৌলবাদী শক্তির হাতে চলে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনায় আতঙ্কিত ছিলেন এ রাজ্যের গণতন্ত্র-প্রিয় মানুষ। ফলপ্রকাশের পর যখন দেখা গেল যে তা ঘটেনি, তখন তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও, উঠে এসেছে এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন। এ রাজ্যের পূর্বতন ক্ষমতাসীন বাম শক্তি, বিশেষত তার বড় শরিক সিপিএম, কি মৌলবাদী শক্তিকে গোপনে সাহায্য করেছে? অর্থাৎ, তাদেরকে ক্ষমতা থেকে যারা হঠিয়েছে, সেই তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি ক্রোধ ও প্রতিহিংসা বশত তাদের কর্মী ও সমর্থকেরা কি বিজেপি-কে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনতে চেষ্টা করেছিলেন? নির্বাচনের আগে থেকেই এ হেন সম্ভাবনার কথা হাওয়ায় ভাসছিল কোনও কোনও মহলে, এবং নির্বাচনের পর তার ‘প্রমাণ’ মিলেছে বলে দাবি করছেন কেউ কেউ। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনী ফলাফল থেকে সত্যিই এমন ইঙ্গিত মেলে কি? সেটাই আজ আমরা এখানে পর্যালোচনা করে দেখব। ... ...
বিগত কয়েকশো বছরের সময়সীমা জুড়ে ধর্মকে কেবলই সরতে হয়েছে ‘ইতিহাস’ নামক নাটকটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক চরিত্র থেকে ক্রমশ গুরুত্বহীন হতে থাকা পার্শ্বচরিত্রে । একেই পণ্ডিতেরা আজ বলছেন ‘সেক্যুলারাইজেশন’, বাংলায় হয়ত বা কোনও মতে বলতে পারি ‘ধর্মনিরপেক্ষীভবন’ । এ প্রক্রিয়ার তিনটে দিক । প্রথমত, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর থেকে ধর্মের রাশ আলগা হয়ে যাওয়া, প্রশাসন-অর্থব্যবস্থা-সেনা-শিক্ষাব্যবস্থা এইসব থেকে ধর্মের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া । দ্বিতীয়ত, জ্ঞান-চিন্তা-শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির জগতে আধুনিক বিজ্ঞান যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের দ্বারা ধর্মের তাত্ত্বিক পরিসরটি দখল হয়ে যাওয়া । এবং তৃতীয়ত, ব্যক্তি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ও মনোজগতে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত ক্রমশ আলগা হয়ে আসা । বোঝা যায়, প্রক্রিয়াটি অনতিসংক্ষিপ্ত, জটিল, বহুমাত্রিক, বহুস্তরীয় । ‘সেক্যুলারাইজেশন’ নিয়ে চর্চা, কাজে কাজেই, খুব সোজা না । ... ...
বিজ্ঞান ও যুক্তির সত্যসন্ধানী ভাবমূর্তিতে নাকি আজকাল একটু কালির ছিটে লেগেছে, ও সব নাকি আসলে ততটা ‘সত্য’ নয়, যতটা পশ্চিমী মগজ-ধোলাই । ও হচ্ছে এশিয়া, আমেরিকা আর আফ্রিকার প্রাচীন জ্ঞানকে দাবিয়ে রাখা আর অস্বীকার করবার হাতিয়ার, পশ্চিমী জ্ঞানকেই একমাত্র জ্ঞান বলে বাকি পৃথিবীর ওপর চাপিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র । এই কারণেই নাকি আধুনিক যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান আর তারই উপজাত আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগে যুদ্ধ-বিগ্রহে, মানুষকে দমিয়ে রাখতে, নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস করতে । কাজেই, এ হেন খারাপ জিনিসের জন্ম ও বাড়বৃদ্ধি যে এশিয়া আর আফ্রিকার উপনিবেশগুলোকে শোষণ না করে সম্ভব হতে পারত না, তাতে আর সন্দেহ কী ? আধুনিকতা ও পাশ্চাত্যের রোমান্টিক বিরোধিতার এই ফ্যাশনেব্ল্ বয়ানটি বিশ শতকের সাত থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত অ্যাকাডেমিক্স-এ খুব চলত । আজ তার সুদিন গিয়াছে, তবু আজও অনেকে নিয়মিতই এ নিয়ে ফেসবুকে চর্বিতচর্বণ করে থাকেন । ভারতের মত এক সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ইংরেজের হাতে দখল হয়ে যায়, আর, মোটামুটি ওই একই সময় থেকে ব্রিটেন-এ শুরু হয় শিল্প-বিপ্লব, অতএব সেটা নিশ্চয়ই ভারত থেকে লুঠ করা টাকাতেই সম্ভব হয়েছিল, এ রকম একটা ধারণা অ্যাকাডেমিক পণ্ডিত থেকে শুরু করে সাধারণ পড়ুয়া মানুষ অবধি অনেকেই পোষণ করে থাকেন । কিন্তু, কথাটা কি সত্যি ? মানে, যে ভাবে বলা হয় ওভাবেই সত্যি ? ... ...