ভূমিকা
বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর সময়কাল ধরে ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ বা ‘মৌলবাদ’ সারা পৃথিবী জুড়ে এমনই এক ‘ফেনোমেনন’ হয়ে দেখা দিয়েছে, কোনও চিন্তাশীল মানুষই যাকে আর উপেক্ষা করতে পারেন না। ইউরোপে রেনেসাঁ, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব, এনলাইটেনমেন্ট, শিল্প বিপ্লব এইসব ঘটে যাবার পর থেকে আলোকপ্রাপ্তদের মনে ক্রমশ এই ধারণাটাই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছিল যে, জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি অর্থনীতি এইসবের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের প্রভাব আস্তে আস্তে কমে আসবে, এবং এক সময়ে হয়ত তা পুরোপুরিই অবলুপ্ত হয়ে যাবে। সমাজতন্ত্রের ধ্যানধারণার প্রচার ও প্রসারের ফলে এ প্রত্যাশা আরও অনেক জোরালো হয়েছিল, শেষতক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক বা না-ই হোক। সেদিক থেকে দেখলে, বিশ শতকের শেষে ধর্মের রমরমা বেড়ে ওঠা এবং মৌলবাদের উত্থান প্রায় এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান যাঁদের হাতে গড়া সেই ম্যাক্স ওয়েবার, এমিল দুর্খাইম, কার্ল মার্ক্স ও তাঁদের মত চিন্তাবিদেরা কেউই ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি, একুশ শতকে ধর্মোন্মত্ত কিছু ব্যক্তি সংগঠিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন আধুনিক রাষ্ট্র থেকে খামচে নিয়ে একটা গোটা ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলবে, বা আমেরিকার মত ভয়ঙ্কর শক্তিশালী দেশের মূল বাণিজ্যকেন্দ্র ও সামরিক দপ্তরে বিমানহানা চালাবে, বা ভারতবর্ষের মত একটি বিরাট ও প্রচণ্ড জনবহুল দেশ আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার ষাট বছর পরেও প্রবল জনসমর্থন আদায় করে তাকে ধর্মীয় রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার কাজ প্রবল উদ্যমে শুরু করে দেবে। এর প্রতিক্রিয়ায় আধুনিকমনস্ক মানবাধিকার-সচেতন গণতান্ত্রিক যুক্তিবাদী মানুষেরা আতঙ্কিত, সেক্যুলার চিন্তাবিদেরা হতাশ ও বিমূঢ়। এবং, ধর্মমনস্ক পণ্ডিতেরা উল্লসিত --- এই দ্যাখো, আমরা তো বরাবরই জানতাম যে ধর্ম অবিনশ্বর --- তোমরা তাহলে এখন নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছ, তার মাহাত্ম্য কমেনি, বরং বেড়েছে!
এই প্রেক্ষিতে অনেকেই বুঝতে চান, ঠিক কী ঘটছে তবে? কেনই বা ঘটছে, কোন প্রক্রিয়ায় ঘটছে? পৃথিবী কি সত্যিই তবে পেছন দিকে ঘুরছে, এবং আমরা ফেরত যাচ্ছি প্রাগাধুনিকতার দিনগুলিতে? তা কি আদৌ আর সম্ভব? এই পশ্চাদগমন যদি সত্যি হয়, তো তাকে কি প্রতিরোধ করা সম্ভব? যদি সম্ভব হয়, তো ঠিক কীভাবে? আর, যদি সম্ভব না হয়, তো তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎটা কী? সমাজতত্ত্ববিদেরা আজ তাই মৌলবাদ বিষয়ক চর্চায় মন দিয়েছেন, এই জরুরি প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবার জন্য।
এ বিষয়টির মধ্যে আরও একটি ফ্যাঁকড়া আছে। অনেকে মনে করেন, এই ‘মৌলবাদ’ সংক্রান্ত সমস্যাটা আসলে শুধুই ইসলামের সমস্যা, আর কারুরই নয় --- ধর্মের নামে ফতোয়াবাজি আর মারদাঙ্গা মূলত মুসলমানেরাই করছে। অন্যদের যদি আদৌ কিছু সমস্যা থেকেও থাকে, তো সেটা শুধু ইসলামি জঙ্গিপনার প্রতিক্রিয়া মাত্র। কাজেই, ইসলামীয় জঙ্গিপনাকে সজোরে দমন করলেই বাকিটা আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যাবে। লক্ষণীয়, যাঁরা এ রকম মনে করেন, তাঁদের মধ্যেও কিন্তু অনেক মুসলমান আছেন --- অত্যন্ত শিক্ষিত ও আধুনিকমনস্ক মুসলমান। আবার, এ অবস্থানটি অন্য অনেকের দুশ্চিন্তারও কারণ, ইসলামি জঙ্গিপনার বিপদ স্বীকার করেও যাঁরা মনে করেন যে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নির্দোষ ও নিরীহ আম মুসলমানের ঢালাও খলনায়কীকরণ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণা বিদ্বেষ ও হিংস্রতা।
এখন, এই সব কিছুর সামনে দাঁড়িয়েই আমাদেরকে বিষয়টি নিয়ে চর্চা করতে হবে, গভীরভাবে ভাবতে হবে যুক্তি সহকারে, এবং পৌঁছতে হবে কোনও এক বুদ্ধিগ্রাহ্য উপলব্ধিতে। বোঝার চেষ্টা করতে হবে, সমকালীন সমাজবিজ্ঞান এ নিয়ে কী ভাবছে। হবেই, তার কারণ, তা না হলে আমাদের যা কিছু ধারণাগত ও আদর্শগত অর্জন --- বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি, যুক্তিবাদিতা, ধর্ম জাতপাত লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের মৌল অধিকার, প্রশ্ন করার ও মতপ্রকাশের অধিকার, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, আধুনিক শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি --- সব কিছুই এসে দাঁড়াবে বিলুপ্তির মুখোমুখি। এবং, এই ধারণাগত ও আদর্শগত অর্জন যদি বিলুপ্ত হয়, তাহলে আধুনিক প্রযুক্তি এবং গণতান্ত্রিক ও পেশাদার প্রতিষ্ঠান জাতীয় বস্তুগত অর্জনগুলোও আর অক্ষত থাকার কথা নয়। চর্চা ও চিন্তা অপরিহার্য, অতএব। এবং, যা অপরিহার্য তা তো চলবেই, চলছেও।
ইংরিজিতে আজ যা ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে, এবং সমকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম বলে গণ্য হচ্ছে, সেই আধুনিক মৌলবাদ সম্পর্কে যুক্তিবাদী সমিতির ভেতরে বেশ কয়েক দিন ধরে কেন্দ্রীয়ভাবে পাঠচক্র চালিয়ে আমরা কিছু মৌল উপলব্ধিতে এসে পৌঁছেছিলাম, এবং সেটা পুস্তিকা আকারে প্রকাশ হবার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নানা কারণেই তা এখনও করে ওঠা যায়নি, কাজ চলছে যদিও। ইতিমধ্যে মৌলবাদ বিষয়ে আমার উপলব্ধি একটু ব্যাখ্যা করে বলার চেষ্টা করছি। বলা বাহুল্য, পূর্বোক্ত ওই পাঠচক্রে আমার অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা আমার উপলব্ধিতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বলা বাহুল্য বোধহয় এইটাও যে, এ আলোচনা শুরু হওয়া উচিত ‘মৌলবাদ’ শব্দটির অর্থ ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধারণাগুলোকে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে।
একটি জুৎসই সংজ্ঞার্থের খোঁজে
প্রথমেই খেয়াল করা দরকার, শব্দটি কিন্তু আমরা আমাদের কথাবার্তায় প্রায়শই ব্যবহার করি, এবং সব সময়ে ঠিক একই অর্থে নয়। এবং, এই ব্যবহারিক বিভিন্নতার ছাপ পড়েছে অভিধানেও। ইংরিজি অভিধানগুলোতে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ কথাটার মূল অর্থ করা হয়েছে, ‘চিরাচরিত ধর্মীয় শাস্ত্রগ্রন্থের আক্ষরিক ব্যাখ্যা মেনে চলা, এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্বাস, রীতিনীতি, বাধানিষেধ ইত্যাদি কঠোরভাবে আঁকড়ে থাকা’ --- বা ওই ধরনের কিছু। এবং, মৌলবাদীরা নিজেরাও তাঁদের অবস্থানের বিবরণ ও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ঠিক ওই দাবিটাই করে থাকেন --- তাঁরা কোনও এক বিশুদ্ধ ‘ফান্ডামেন্টাল’ বা মূল-কে আঁকড়ে ধরে থাকতে চান, অধার্মিক এই আধুনিক পৃথিবীর কুপ্ররোচনা ও কুপ্রলোভনে পা দিয়ে নিজেকে কলুষিত হতে দিতে চান না,বরং সম্ভব হলে দুনিয়াটাকেই ‘বিশুদ্ধ’ করে তুলতে চান (এটা বোঝা যায় যে, প্রবল সংরক্ষণশীলতা এর অপরিহার্য উপাদান, কিন্তু ‘মৌলবাদ’ মানে নিছক সংরক্ষণশীলতার বাড়াবাড়িটুকু মাত্র নয়)। কোনও কোনও অভিধান আবার এই বিষয়টিকে মূলত প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের ব্যাপার বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছে। বস্তুত, আমেরিকায় বিশ শতকের গোড়ায় একটি কট্টরপন্থী প্রোটেস্টান্ট গোষ্ঠীই কয়েকটি পুস্তিকা প্রকাশ করে প্রথম এই দাবিটি তোলে, এবং এই ধরনের অর্থে ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ শব্দটির ব্যবহারের সূচনা করে। তার পরে কিছুকাল পর্যন্ত ‘ফান্ডামেন্টালিস্ট’ বা ‘মৌলবাদী’ বলতে শুধু তাদেরকেই বোঝাতো। কিন্তু বিশ শতক একটু গড়াতেই বোঝা যায়, প্রায় সমস্ত প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যেই ওই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এবং শব্দটি আরও ব্যাপক ও ‘জেনেরিক’ অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। অর্থাৎ, সব ধর্মের কট্টরপন্থী জঙ্গিদেরকেই ‘মৌলবাদী’ বলে বোঝানো হতে থাকে। আবার, সাম্প্রতিক কালে ইসলামীয় জঙ্গিদের তরফে নাশকতামূলক কাজকর্ম অনেক বেড়ে যাওয়ায় কেউ কেউ ‘মৌলবাদ’ ব্যাপারটাকে শুধু ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত করে ভাবতে চান, যদিও সেটা স্পষ্টতই ভুল (পরে আবার এ প্রসঙ্গে ফেরা যাবে)।
তো সে যা-ই হোক, আমরা বলছিলাম ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ বা ‘মৌলবাদ’ শব্দটির সংজ্ঞার্থের কথা। একটি বিশেষ ও সুপরিচিত সংজ্ঞার্থের কথা ওপরে বলা হয়েছে, কিন্তু আরও নানা অর্থে শব্দটির ব্যবহার হয়। যেমনটি ‘এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা’-র অনলাইন সংস্করণ উল্লেখ করেছে, কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ অভিযোগ করে থাকেন, “significant negative connotations of the term fundamentalism — usually including bigotry, zealotry, militancy, extremism, and fanaticism — make it unsuitable as a category of scholarly analysis”। অর্থাৎ কিনা, এই শব্দটির মধ্যে এমনভাবে গোঁড়ামি, গা-জোয়ারি, জঙ্গিপনা, চরমপন্থা, উন্মত্ততা এইসব নেতিবাচক ধারণা ঢুকে পড়ে, যার ফলে তা নিয়ে গবেষকোচিত বিশ্লেষণ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এহেন অর্থবৈচিত্র্যের উল্লেখ মিলবে অন্তর্জালে প্রাপ্য অভিধানগুলোতেও, দুয়েকটি নমুনা হাজির করা যাক। ওপরে মৌলবাদের যে সংজ্ঞার্থের কথা বলা হয়েছে তা প্রায় প্রতিটি অভিধানেই দেখা যায়, কিন্তু সাথে আরও কয়েকটি থাকে। যেমন, অক্সফোর্ড লার্নার্স অভিধান বলছে, ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ শব্দের অন্যতম অর্থ, “the practice of following very strictly the basic principles of any subject or ideology”। আবার, কেমব্রিজ অভিধান বলছে, “the belief that the traditional principles of a religion or set of beliefs should be maintained”। অর্থাৎ, এখানে কিন্তু অর্থকে প্রসারিত করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে যেমন এ শব্দের অর্থ প্রসারিত হয়ে নিছক কট্টরপন্থী প্রটেস্টান্ট-দের বৈশিষ্ট্য থেকে সব ধর্মেরই কট্টরপন্থীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তেমনিই, এখন এ শব্দের অর্থ আরও বেশি সম্প্রসারিত হয়ে ধর্ম বা অন্য যে কোনও নীতি-আদর্শকেই আঁকড়ে থাকা বোঝাতে পারে। লক্ষণীয়, এখানে শুধু ধর্ম নয়, যে কোনও ধরনের নীতি-আদর্শের কথাই বলা হচ্ছে। এবং এমন কি, এই সংজ্ঞার্থের জন্য অযুক্তি অন্ধত্ব গোঁড়ামি এইসবও বাধ্যতামূলক নয়, শুধুমাত্র কঠোরভাবে নীতি-আদর্শ আঁকড়ে থাকাটাই ‘মৌলবাদী’ সাব্যস্ত হবার পক্ষে যথেষ্ট। এতখানি সম্প্রসারিত হবার পরে এর অর্থ বোধহয় কিঞ্চিৎ তরল হয়ে পড়েছে, এবং এর ভেতরকার যৌক্তিক নির্মাণটি হয়ে পড়েছে নড়বড়ে। এ ধরনের সংজ্ঞার্থ বানিয়ে তোলবার ধারাতেই তৈরি হয়েছে 'রাজনৈতিক মৌলবাদ', 'বৈজ্ঞানিক মৌলবাদ', 'সেক্যুলার মৌলবাদ', 'নাস্তিক মৌলবাদ' জাতীয় শব্দবন্ধ, যার মধ্যে সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক অর্থ না থাকলেও আছে মনোভাব প্রকাশের রাস্তা। কিন্তু, এই সংজ্ঞার্থ যদি মেনে নিতে হয়, তবে ‘মৌলবাদ কখনই সমর্থনযোগ্য নয়’ এই কথাটা জোর দিয়ে বললেও ‘মৌলবাদী’ সাব্যস্ত হতে হবে, যা স্পষ্টতই হাস্যকর। ফলত, ভাষাগত নানা নতুনতর উদ্দেশ্য সাধন করতে পারলেও (যেমন অপছন্দ বা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা বা গালি দেওয়া), এই ধরনের সংজ্ঞার্থে কোনও নির্দিষ্ট বাস্তবতাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিনিধিত্ব করবার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এখানে এই বিষয়টি এতটা তরলীকৃত অর্থে আলোচিত হচ্ছে না, বলা বাহুল্য।
এখন, আর কোন কোন জনপ্রিয় ও সুপরিচিত অর্থে এ শব্দটি এখানে আলোচিত হতে পারত কিন্তু হবেনা, এবং কেনই বা হবেনা, সেটাও এখানে একবার বলে নেওয়া জরুরি। কারণ, তা না হলে বিভ্রান্তি ঘটতে পারে। আসলে, আমি চাইছিলাম 'মৌলবাদ' কথাটার ‘ফোক’ বা জনপ্রিয় (এবং সেইহেতু ঢিলে) অর্থের সঙ্গে তার পারিভাষিক (এবং সেইহেতু ‘রিগোরস’ বা পরিশ্রমসাধ্যভাবে নির্মিত) অর্থের তফাতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, এবং সেইসূত্রে মৌলবাদ সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। যথা --- (১) মৌলবাদী উত্থানের বিভিন্ন দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে কোনও সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে কিনা, (২) একটি নির্দিষ্ট সময়কালে বিভিন্ন দেশ-জাতি-ধর্মের মধ্যে মৌলবাদী প্রবণতার উদ্ভব ও বিকাশের কোনও সাধারণ কারণ থাকতে পারে কিনা, (৩) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত উন্নতির পরেও, এবং মানবাধিকার-ধর্মনিরপেক্ষতা-গণতন্ত্রের ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পরেও, মৌলবাদের এই বিস্ময়কর উত্থানের পেছনে কোনও অনিবার্য কারণ ছিল কিনা, (৪) মৌলবাদ আসলে আধুনিক পৃথিবীতে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়ার জন্য ধর্মের তরফে শেষ চেষ্টা কিনা, (৫) একটি সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে ধর্মের আজ এ ছাড়া আদৌ কোনও 'অপশন' আছে কিনা, (৬) আধুনিক অর্থনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে মৌলবাদের জটিল সম্পর্কের টানাপোড়েনগুলোর কাঠামো ও প্রক্রিয়াগুলো ঠিক কী ধরনের, (৭) মৌলবাদ আদৌ ধর্মের বিলুপ্তি বিলম্বিত করতে পারবে অথবা আসলে তাকে ত্বরান্বিত করবে মাত্র। এইসব আর কি!
‘মৌলবাদ’ শব্দটির কোন কোন সম্ভাব্য অর্থকে এড়িয়ে চলতে চাই, তার তালিকা এবার পেশ করা যাক তবে। বলা বাহুল্য, ‘মৌলবাদ’ জিনিসটা আসলে কী বলে তবে আমার নিজের মনে হয়, তার ইঙ্গিত এখানে মাঝে মাঝেই চলে আসবে হয়ত বা, কোনও সচেতন আবাহন ছাড়াই।
প্রথমত, 'মৌলবাদ' মানে নিছক মতান্ধতা বা গোঁড়ামি বা গা-জোয়ারি নয়, এ হল আধুনিক পৃথিবীতে ক্রমশ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলতে থাকা ধর্মের তরফে জমি ফিরে পাবার জন্য এক মরিয়া লড়াই, হয়ত বা শেষ লড়াই। ফলত, 'রাজনৈতিক মৌলবাদ', 'বৈজ্ঞানিক মৌলবাদ', 'সেক্যুলার মৌলবাদ', 'নাস্তিক মৌলবাদ' --- ইত্যাদি কথার মধ্যে 'মৌলবাদ' শব্দটির প্রয়োগ নেহাতই ঢিলে প্রয়োগ, এবং বস্তুত অপপ্রয়োগ। এতে মৌলবাদের স্বরূপ প্রকাশ পায়না, বরং আরও চাপা পড়ে। বলা দরকার, সাধারণত ধর্মের হত্তাকত্তা আর উত্তর আধুনিকেরা এইসব লব্জ প্রয়োগ করে থাকেন। এবং, শব্দটির প্রয়োগ হয়ে থাকে ভিন্ন মতাবলম্বীকে গালি দেবার জন্যও।
‘ফান্ডামেন্টালিজম’ বা ‘মৌলবাদ’ শব্দটি অনেক সময় ভুল করে ‘ডগম্যাটিজম’ বা 'গোঁড়ামি'-র সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেই ভুল অর্থে যুক্তিবাদী মুক্তমনা নাস্তিকরাও 'মৌলবাদী' (অর্থাৎ গোঁড়া বা মতান্ধ) হতেই পারে, অন্য অনেকের মতই। কারণ, কোনও মানুষই নিখুঁত নয়, আর নাস্তিক তো একজন মানুষই। গোঁড়ামি ছাড়িয়ে সত্যিকারের মুক্তমনস্ক হয়ে ওঠা এক দীর্ঘ ও কষ্টকর প্রক্রিয়া। কাজেই, কোনও এক বিশেষ মুহূর্তে কোনও একজন বিশেষ নাস্তিকের ক্ষেত্রে সে প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না-ই হতে পারে --- হয়ত আমাদের অনেকেরই হয়নি। কিন্তু, 'মৌলবাদ' শব্দটির এ রকম অর্থ করা আসলে এ শব্দটির কিঞ্চিৎ ঢিলে ব্যবহার। শব্দটি আসলে একটি আধুনিক ‘কয়েনেজ’, বিশ শতকের এক বিশেষ ধরনের সামাজিক-ঐতিহাসিক ফেনোমেনন-কে চিহ্নিত করবার জন্য তৈরি এক পারিভাষিক শব্দ। এইটা ভাল করে না বুঝে শব্দটি নিয়ে কথা বলতে থাকলে আমাদের বোধের উন্নতি কিছু ঘটবে না, শুধু বিভ্রান্তি বাড়বে (এ নিয়ে পরে আরও কথা হবে)।
আমরা যখন বলি 'পৃথিবী জুড়ে মৌলবাদ এক বিপদ হয়ে দেখা দিচ্ছে', তখন আমরা নিছক গোঁড়ামির কথা বলি না। আবার, সমাজবিজ্ঞানের পণ্ডিতরা যখন মৌলবাদের নানা বৈশিষ্ট্য ও তার ঐতিহাসিক উত্থানের কার্যকারণ নিয়ে কথা বলেন, তখন তাঁরাও কিন্তু নিছক গোঁড়ামির কথা বলেন না। এই সমস্ত ক্ষেত্রে 'মৌলবাদ' শব্দটি যে পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়, তার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, আধুনিক কালের এক ধরনের ধর্মীয় আন্দোলন, যেখানে এ যুগে ধর্মের হারিয়ে ফেলা প্রাসঙ্গিকতাকে উদ্ধার করার আশায় ধর্মের কোনও এক 'মূল' নীতিকে আঁকড়ে ধরে থেকে সেই ধর্মের কোনও এক অতীত স্বর্ণযুগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবার ডাক দেওয়া হয়, অধার্মিকতার থেকে নিজেকে বিশুদ্ধ রাখার জন্য অনুগামীদের ওপর নৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়, এবং অতীত স্বর্ণযুগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবার জন্য আত্মবলিদানের আহ্বান রাখা হয়।
দ্বিতীয়ত, মৌলবাদ মানে আদিম ধর্মীয় অন্ধত্ব ও হিংস্রতার নিছক প্রত্যাবর্তন এবং/অথবা বিবর্ধন মাত্র নয়, যদিও ওগুলো অতি অবশ্যই মৌলবাদের অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অর্থাৎ, শুধু ওগুলো ফিরে এলেই এবং বেশ একটু বেড়ে উঠলেই মৌলবাদ হয়না। আধুনিক মৌলবাদী আন্দোলন আদৌ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ধর্ম-ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন বা পুনরাবৃত্তি নয়, এ হল এক অর্থে আধুনিকতারই অনিবার্য উপজাত পদার্থ। এর বীজ ও শিকড় সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকেই, কিন্তু এর উদ্ভব বিশ শতকে, চূড়ান্ত পরিণতি বিশ শতকের শেষ ও একুশ শতকের গোড়ায়, এবং খুব সম্ভবত ইতিমধ্যেই এর ক্ষয় শুরু হয়ে গেছে।
তৃতীয়ত, 'মৌলবাদ'-ই বলি বা ইংরেজিতে 'ফান্ডামেন্টালিজম' --- তার অর্থ কিন্তু কোনও ক্রমেই তার ব্যুৎপত্তি দিয়ে নির্ধারিত নয়। অর্থাৎ, মৌলবাদ মানে কোনও এক ‘ফান্ডামেন্টাল’ বা ‘মূল’-কে আঁকড়ে ধরা বা 'মূলের কাছে ফিরে যাওয়া' বা ওই জাতীয় কিছু নয়। মৌলবাদকে এই অর্থে বুঝতে হবে --- এ দাবি মোটেই মৌলবাদের প্রকৃত স্বরূপ থেকে উঠে আসেনা, বরং এ হল মৌলবাদের তাত্ত্বিক মুখপাত্রদের নিজেদের দাবি, এবং আসলে ভুয়ো দাবি। মৌলবাদীরা কোনও এক কল্পিত প্রাচীন স্বর্ণযুগে জীবনযাপনের কোনও এক ঐতিহাসিক বা অনৈতিহাসিক মাপকাঠিকে আদর্শ ও বিশুদ্ধ বলে গণ্য করে সেই অনুযায়ী চলবার ডাক দেয় এবং এই পাপের পৃথিবীকে উদ্ধার করে সেই স্বর্ণযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ডাক দেয়। কিন্তু তাদের আচরণ থেকে এইটা পরিষ্কার, তারা মনে মনে ভালভাবেই জানে যে তা মোটেই সম্ভব নয়। যেভাবে মুসলমান মৌলবাদীরা খনি থেকে তেল তুলে এবং তা বেচে সন্ত্রাসমূলক কাজকর্মের অর্থ সংগ্রহ করে, যেভাবে আধুনিক রাষ্ট্রের কারখানায় তৈরি বিস্ফোরক ও স্বয়ংক্রিয় বন্দুক চোরাপথে সংগ্রহ করে নাশকতা ঘটায়, যেভাবে এক অত্যন্ত সুচারু পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি ছিনতাই করা বিমানকে বোমা হিসেবে ব্যবহার করে একটি শক্তিশালী দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্রে আঘাত হানে --- তার নির্দেশ নিশ্চয়ই কোরান বা হাদিস থেকে পাওয়া সম্ভব না। আবার, যেভাবে হিন্দুত্ববাদীরা ‘হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার’-এর মিথ্যে ভিডিও বানিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে অন্তর্জালে ঘৃণা ও হিংসা ছড়াতে থাকে, তার নির্দেশ নিশ্চয়ই বেদ বা রামায়ণে থাকা সম্ভব না। বস্তুত, মুসলমান মৌলবাদীরা জানে যে খিলাফত-এ ফেরা অসম্ভব, এবং হিন্দুত্ববাদীরাও জানে যে রামরাজত্ব অবাস্তব। তবুও এ আত্মপ্রতারণার খেলা তারা খেলতেই থাকে, কারণ এ পৃথিবীতে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাবার আর দ্বিতীয় কোনও রাস্তা তাদের জানা নেই।
আসলে, ধর্মের নির্দেশ ‘আক্ষরিকভাবে’ মেনে চলবার দাবিটিই ভীষণ গোলমেলে, কারণ, ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর ‘আক্ষরিক’ বা 'লিটার্যাল' ব্যাখ্যা বলে আজ আর কিছু হতেই পারে না। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোর টেক্সট তার সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে ছিঁড়ে গিয়ে আজ এতদূর চলে এসেছে যে, আজ এর শুধু সাবজেক্টিভ রূপকধর্মী ব্যাখ্যাই সম্ভব, এবং যুগে যুগে ধর্মবেত্তারা ঠিক তাইই করে এসেছেন, স্ব স্ব স্থান-কালের তাগিদ অনুযায়ী। এর ‘সোশিও-কালচারাল কন্টেক্সট’ বা সমাজ-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট তো বটেই, এমনকি ভাষা ও শব্দার্থও ভীষণভাবে বদলে গেছে। ফলত, আমাদের কাছে আজ এই টেক্সট-গুলো অনেকটা মনোরোগের ‘ররশা’ পরীক্ষার অর্থহীন দাগগুলোর মত, কিম্বা প্রাচীন ফরাসিতে লেখা নস্ত্রাদামুসের ধোঁয়াটে শ্লোকগুলোর মত --- তার যা খুশি ব্যাখ্যা সম্ভব। আজকের ঐতিহাসিক-প্রত্নতত্ত্ববিদ-ভাষাবিদেরা এগুলোর মূল অর্থের ‘রিগোরস রিকন্সট্রাকশন’ বা কঠোরভাবে যুক্তি-তথ্য দিয়ে পরিশ্রমসাধ্য পুনর্নির্মাণ করবার চেষ্টা করতেই পারেন, চেষ্টা করতে পারেন তা অনুমান করবার, যতটা সম্ভব তার কাছাকাছি যাবার। তবে কিনা, তার যা ফলাফল দাঁড়াবে তাকে হয়ত বড়জোর 'সায়েন্টিফিক' বা 'অবজেকটিভ' আখ্যা দেওয়া যায়, কিন্তু তাতে 'লিটার্যাল'-এর তকমা আঁটা অসম্ভব। আর, যদি বা কোনও গতিকে কোনও প্রাচীন ধর্মীয় টেক্সট-এর এমন কোনও ‘মূল অর্থ’ খুঁজে পাওয়া যায় যাকে ‘আক্ষরিক’ বলে দাবি করা সম্ভব, তাহলে সেটাও তো হবে টেক্সট-টির রচনাকালে চালু ‘আক্ষরিক’। কাজেই, তা থেকে বর্তমান পৃথিবীর কোনও সমস্যা সমাধানের দিক-নির্দেশ পাওয়া যাবে --- এমন আশা হবে নিতান্তই দুরাশা।
এ লেখার এই পর্যন্ত পৌঁছে পাঠক এখন নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবেন, মৌলবাদ কী কী নয় সে নিয়ে তো অনেক কথাই বললেন। কিন্তু জিনিসটা তবে কী, সেটা কখন বলবেন? সে প্রশ্নের উত্তরের দিকে এগোতে পারি কিনা, সেইটা এবার তবে দেখা যাক (তার কিছু ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দিয়ে ফেলেছি, যদিও)।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।