নন্দবাবুকে ট্যাগ করা যায়?
পড়লাম। যত্ন নিয়ে পরিশ্রম করে লেখা।
এবার সমালোচনা। লেখক লিখেছেনঃ "ওদিকে আমেরিকাতে ছিল চিনি আর ক্রীতদাসের ব্যবসা । এই সম্পদ যে ব্রিটেনে গিয়ে সেখানকার সমৃদ্ধি বাড়িয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই ।"
ব্যাপারটা আদপেই এমন না। লেখক যে বিরাট ব্যবসাটা মিস করে গেছেন, তা হল আমেরিকার তুলো চাষ। এইটা শুধু একটা পণ্যকে ফসকে যাওয়া নয়। তুলো, ক্রীতদাস এবং শিল্পবিপ্লব হাত ধরাধরি করে আছে। আঙ্কল টমস কেবিন মনে করুন। ওটা একটা আইকনিক উপাখ্যান, তুলো থেকে ক্রীতদাসকে আলাদা করার কোনো জায়গা নেই।
এত তুলো-তুলো করছি কেন? কারণ হল, তুলোর বিরাট ভূমিকা ছিল শিল্পবিপ্লবে। অটোমেশন শুরু হয় তুলো শিল্পে। জেনি র হাত ধরে। যেটা শিল্পবিপ্লবের পুরোধা। এই তুলোর একটা বিরাট অংশ আসত আমেরিকা থেকে। অতএব তুলো ফসকে যাওয়া মানে শিল্পবিপ্লবই ফসকে যাওয়া।
ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের তিনটি চিহ্ন সর্বজনগ্রাহ্য। ১। স্টিম ইঞ্জিন। ২। বস্ত্রশিল্পের বিস্তার। এবং ৩। নিউটন। হঠাৎ কেন সব্বাইকে ছেড়ে ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব হল এ নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে, লেখক যেমন বলেছেন। কিন্তু এই তিনটে চিহ্ন নিয়ে কোনো তর্ক নেই। এবং এরা হাত-ধরাধরি করে ছিল।
প্রথমে স্টিম ইঞ্জিনকে পাকড়ানো যাক। জেমস ওয়াট স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কারক বলে প্রচারিত। কিন্তু সত্যিই কি তিনি আবিষ্কারক? না। কারণ স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কার তার আগেই হয়েছে, ইউরোপে তো বটেই, এমনকি শোনা যায়, চিনেরাও বাষ্পশক্তি ব্যবহার করত। তাহলে ওয়াট করলেন কী? ওয়াট স্টিম ইঞ্জিনের আধুনিক ডিজাইন করেন। এবং রেলের উপর দিয়ে চলার ব্যবস্থা করেন। স্টিম ইঞ্জিন যে গাড়ির মতো রাস্তা দিয়ে চলেনা, তার কারণ ওয়াট। এবার প্রশ্ন হল, হঠাৎ ওয়াট এটা কীভাবে এবং কেন চালু করলেন বা করতে পারলেন? তার কারণ, ওটা চালু করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। গণপরিবহনের জন্য নয়। কয়লাখনি থেকে কয়লা তোলার জন্য। শিল্পবিপ্লবের সময় কয়লার প্রয়োজন প্রবল বেড়ে যায়। চাহিদাও। কয়লাখনি মালিকরা দ্রুত কয়লা তোলার একট ব্যবস্থা খুঁজছিলেন। স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার করে সেই উপায়টা তাঁদের দেন ওয়াট। রেল পেতে কয়লা চালিত ইঞ্জিনে কয়লা তুলে এনে সরবরাহ করা শুরু হয়। এইটাই হল আবিষ্কার।
এবার প্রশ্ন হল, হঠাৎ কয়লার চাহিদা বাড়ল কেন? ব্রিটেনের স্থানীয় কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। তা দিয়েই চাহিদার শুরু । তার পরে, যে ব্যাপারটা জরুরি, যে, শিল্পে কয়লার ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল। অটোমেশন যার নাম। জেনি দিয়ে যার শুরু। এবং স্টিম ইঞ্জিনসহ পাওয়ারলুম যার বিবর্তিত রূপ। সেখানে কয়লার ব্যবহার বাড়তে থাকে এবং বাড়তেই থাকে। জ্যামিতিক হারে। প্রয়োজন হতে থাকে আরও আরও পরিবহনের। বাষ্পচালিত জাহাজও এসে গিয়েছিল আগেই। তার একচেটিয়া শুরু হয়। ইত্যাদি প্রভৃতি।
পরের প্রশ্ন হল হঠাৎ বস্ত্রশিল্পে অটোমেশন শুরু হল কেন? যেজন্য এত কয়লার দরকার(অবশ্যই বস্ত্রশিল্পই কয়লার একমাত্র খরিদ্দার না, কিন্তু খুবই বড় খরিদ্দার) ? কারণ, বস্ত্রশিল্পের রমরমা বেড়ে গিয়েছিল। কেন বাড়ল? দুদিক থেকে। আমেরিকার তুলোর উৎপাদনের চাপ। এবং বস্ত্রের চাহিদার চাপ। আমেরিকার তুলো এই কারণে শিল্পবিপ্লবে জরুরি। এবং এর পরিবহন, জাহাজ, রেল, সব মিলিয়ে এক বিপুল বিস্ফোরণ, যাকে এক কথায় আমরা একাধিক পর্যায়ের শিল্প বিপ্লব বলি।
লেখক আমেরিকা এবং পরবর্তীকালের অস্ট্রেলিয়াকে বাদ দেওয়ায় এই চিত্রটা ফস্কে ফেলেছেন। আমেরিকাকে বাদ দেননি, কিন্তু গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছেন। সেজন্যই এই ফস্কে যাওয়া। এইটা ফস্কে না গেলেই দেখা যেত, যে, এই পুরো প্রক্রিয়ায় বাংলার বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হয়। মন্বন্তরে এক তৃতীয়াংশ লোক মরে। এই পুরো প্রক্রিয়াটা অমানবিকও ছিল। যে জাহাজগুলো আমেরিকা থেকে তুলো আনত, তারা ফাঁকা আমেরিকা গেলে লাভ কমে যেত। তাই তারা ভর্তি করে ক্রীতদাস অথবা কয়েদি নিয়ে যেত। ফলত শিল্পবিপ্লব, তার অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া হিসেবেই বঙ্গের বস্ত্রশিল্প ধ্বংস থেকে শুরু করে ক্রীতদাস ব্যবসা, এইগুলো চালু করে। লুঠ কতটা কী হয়েছিল, সে তো অ্যাকাউন্টিং দেখলেই বোঝা যাবে, কিন্তু বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোককে মেরে ফেলাটা তো এমনি হয়নি।
সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়,
আপনার বিস্তারিত প্রতিক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ , এ ধরনের প্রতিক্রিয়া সব সময়েই লেখকের প্রচেষ্টাকে সম্মানিত করে ।
কিন্তু, আপনি আমার মোদ্দা বক্তব্যেরই বিরোধিতা করতে চাইলেন, নাকি তাতে কিছু ডিটেল সরবরাহ করে তার ফাঁকফোকর বোঝাতে চাইলেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলাম না । যদি দ্বিতীয়টি হয়ে থাকে, আবারও ধন্যবাদ । যদি প্রথমটি হয়ে থাকে, তাহলে আর একটু ভাল করে আপনার কথা বুঝে নিতে চাইব ।
আমার বক্তব্য ছিল, 'কলোনিয়াল ড্রেন' নিশ্চয়ই ইউরোপের সম্পদ বাড়িয়েছে, কিন্তু শিল্পবিপ্লবের জন্য তা অপরিহার্য ছিল না । অর্থাৎ, ওটা না ঘটলেও ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ঘটতই --- ঠিক ওভাবে বা অত দ্রুত ঘটত কিনা সে নিয়ে তর্ক চলতেই পারে । এখন, আপনি যে সব তথ্য দিলেন, তা দিয়ে এই মোদ্দা বক্তব্য খন্ডিত হল কি ? হলে, ঠিক কীভাবে ?
আরও দুটি ছোট্ট নিবেদন ।
এক, তুলো বা 'টেক্সটাইল' অবশ্যই একটা বড় ব্যাপার, তার উল্লেখ বাদ না গেলেই ভাল হত, ঠিক বটে । কিন্তু উল্লেখ বাদ গেলেও, এখানে যে সমস্ত লেখ সারণি হিসেবনিকেশ ইত্যাদি পেশ করা হয়েছে, তার মধ্যে টেক্সটাইল অবশ্যই ধরা আছে । ফলত, আমার মোদ্দা যুক্তি-কাঠামো ও সিদ্ধান্তে এই অনুল্লেখের খুব বেশি প্রভাব থাকার কথা না ।
দুই, এখানে আমার আরও একটি প্রতিপাদ্য হল, বিজ্ঞানের সত্যমূল্য তার ঔপনিবেশিক প্রেক্ষিত দিয়ে আদৌ নির্ধারিত হয়না । আপনার বক্তব্যের পরে তারই বা কী দশা দাঁড়াল বলে আপনার মনে হয়, সেটাও জানতে পারলে ভাল লাগবে ।
এ তো অতি উত্তম হইল। তর্ক-বিতর্কের চমত্কার পরিমন্ডল!
অপ্রাস্ঙ্গিক-প্রাক্তন হেড ডিপ রতন খাশনবিশের নাম দেখে ভাল লাগল।
এটা একটু সময় নিয়ে লিখতে হবে। কপাল এমনই, যে এখনই ৫০ টা জিনিস নিয়ে অস্থিরমস্তিষ্ক হয়ে আছি। একটু সময় লাগবে।
সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়,
সময় লাগুক, বলুন প্লিজ । বিশেষভাবে আগ্রহী ।
মূল লেখাটা ভালো লাগলো পড়ে। অনেকটাই একমত। যেটা নিজের মনে হয়েছে , ওয়েস্টার্ন কালচারে প্রশ্ন করাকে উৎসাহ দেওয়া হয় বেশি , অন্ধভাবে ফলো করাকে নয়। সেটা হয়তো জেনেরালি বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ার একটা কারণ।
খাসা লেখা।
কলোনিয়াল লুন্ঠন এবং ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লবের কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে বহুদিন ধরে লালিত সরল একমাত্রিক চিন্তায় জোর আঘাত লাগল। তবু স্বাগত।
সৈকত বন্দ্যোর তুলো পয়েন্ট খুব মূল্যবান, কিন্তু তাতে লেখকের বক্তব্যের তাত্ত্বিক কাঠামোটি ধ্বসে যায়নি , বরং সমৃদ্ধ হয়েছে বলে আমার মত সাধারণ পাঠকের মনে হল।
ভারতে আসলে চিরকালই গুরুবাদ টা বেশি, আর পশ্চিমে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র। এই কারনেই ভারতে মুখস্থ বিদ্যা বা পূর্বসূরীকে অন্ধ ভাবে অনুকরণ করাকে উৎসাহ দেওয়া হয়। এই কারনেই সমাজে স্থবিরতা দেখা যায় ও কোনো বড় সামাজিক বা ধর্মীয় বিপলব স্থায়ী হয় না, আবার বৃহৎ সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে যায়।
একজায়গায় এই আলোচনাটা পেলাম ভালো। কিছু অভিমত লেখার ইচ্ছে আছে। কিন্তু, একটা জিনিস অনেকদিন খুঁজছিলাম। মুঘল আমলে ভারতে লাইফ এক্সপেক্টেন্সি কেমন ছিল? সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে লাইফ এক্সপেক্টেন্সি নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এরকম কোনও ডেটা আছে কি?
আর, ১৭৭০-এ ভারতে লাইফ এক্সপেক্টেন্সির যে সংখ্যাটা দেওয়া আছে, তার সূত্র কি মূল লেখায় আছে? ১৭৭০ মানে মন্বন্তরের বছর, সেই বছরের আগে পরে এই হিসেবটা পাল্টানোর কথা না?
না, ১৭৭০ সালের জীবনকালের যে হিসেবগুলো গ্রাফে আছে সেগুলো নির্দিষ্ট কোনও দেশের নয়, পৃথিবীর এক-একটি বড় বড় অংশের (মূলত মহাদেশ), এবং সেইহেতু এশিয়ারও । ভারতের ওই সময়কার হিসেব আলাদা করে পাওয়া যায় কিনা, ঠিক জানিনা । খুঁজে দেখব ।
১৭৭০ এমন কি ১৯০০ সালেও একটা গোটা মহাদেশের নিরিখে লাইফ এক্সপেক্টেন্সি বের করা কি সম্ভবপর ছিল? ভেবে দেখার।
না, তখন বার করা সম্ভব ছিল না মোটেই, তখন তো 'লাইফ এক্সপেক্টেন্সি' নামক ধারণাটাই আসেনি । এখন সে চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু এখনকার মত করে তথ্য তো আর পাওয়া যাবে না, তবে পুরোনো নানা তথ্যকে কাজে লাগিয়ে পরোক্ষভাবে নির্ণয় করার চেষ্টা করা যায় । জনসংখ্যা থেকে শুরু করে জাতীয় আয় পর্যন্ত অনেক কিছুই এভাবে করা হয় (এখানে সে সবও ব্যবহৃত হয়েছে) । আজকের দিনের মত নির্ভরযোগ্য হবে না নিশ্চয়ই, আর, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন পদ্ধতি প্রেফার করবেন, ফলে দ্বিমত সব সময়ই থাকবে । তবু, যেটুকু জানা যায় আর কি । মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে থেকে তো আর লাভ নেই ।
অসাধারণ পরিশ্রমসাধ্য লেখা। আগাগোড়া যৌক্তিক বিশ্লেষণ। একসঙ্গে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ লেখ ও সারণি যোগ করা। শেষের ঝাঁঝটাও খুুুব জরুরী ছিল। একটাই অনুযোগ। এত বড়ো লেখাটাকে এক-ঢালা না-করে কয়েকটা সাবহেডিং-এ ভেঙে দিলে বেশ হত।
আসলে লাইফ এক্সপেক্টেন্সিকে বহু জায়গায় বিজ্ঞানের জয়যাত্রার প্রমাণ হিসেবে দেখাতে দেখেছি। কিন্তু, ইউরোপের দু-একটা শহরের বাইরে আদৌ কোথাও লাইফ এক্সপেক্টেন্সির ডেটা ছিল কী না জানা যায় না। কিন্তু, মধ্যযুগে অবশ্যই অনেক প্যারামিটার ছিল, যেগুলোর রেকর্ড রাখা হত- যেমন, রাজস্ব আদায়, বহির্বাণিজ্য, সৈন্যবাহিনীর খরচ, খাল-পথ নির্মাণ, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি।
"এই কারনেই সমাজে স্থবিরতা দেখা যায় ও কোনো বড় সামাজিক বা ধর্মীয় বিপলব স্থায়ী হয় না, আবার বৃহৎ সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে যায়"
-- রমিতের এই অবজার্ভেশন ভাল লাগল। এটা নিয়ে গুছিয়ে একটা প্রবন্ধ নামাবেন? খুব ইন্টারেস্টিং হবে।
পরম আগ্রহে লেখাটি পড়লাম। গুরুর পাতায় এতো গভীর গবেষণাভিত্তিক লেখা চোখে পড়ে কম।
পাঠকদের মন্তব্যে নানারকম আলোচনা উঠে এসেছে। এই প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি কথা মনে হল।
১) আমেরিকার গৃহযুদ্ধের কারণে ল্যাঙ্কাশায়ারে তুলো আমদানী বিঘ্নিত হওয়াতেই ভারতীয় তুলো রপ্তানী বেড়েছিল। অবশ্য এটা ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের ধরনের মধ্যেই পড়ে।
২) মানুষের কৃষিকার্য শুরুর সময় থেকেই প্রকৃতির হননপর্ব ও পরিবেশের ক্ষতিসাধন শুরু। শিল্পবিপ্লব সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। বর্তমানের পরিবেশ সংকটের ঐতিহাসিক মূল সেখানে প্রোথিত। আলোচনাতে না আসলেও তথ্যসূত্রে এই বিষয়ক বইয়ের উল্লেখ আছে।
লেখককে আবারও ধন্যবাদ।
অসাধারণ সুন্দর লেখা। ইংল্যাণ্ডের শিল্প বিপ্লবে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বিষয়ে আমার নিজের ও ঐ ধারণাই ছিল যে উপনিবেশ থেকে শোষিত সম্পদই ঐ শিল্প বিপ্লবের কারণ এবং উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ ছাড়াই একথা অনেককে বলেওছি even তর্ক করেছি। আজ আপনার এই লেখায় সে ধারণা বেশ বড়রকম ধাক্কা খেলো। আমাকে আবার একবার সেই সব বইপত্র এবং আপনার দেওয়া তথ্য গুলো পড়ে বিচার করে, ভেবে দেখতে হবে। তবুও এই চিন্তার খোরাক দেওয়া এবং নতুন করে ভাবতে বাধ্য করার জন্য ধন্যবাদ।
যদি আবার পড়াশোনা করে কিছু বলার মতো পাই তাহলে আবার মন্তব্য লিখবো। ততদিন অবধি, শ্রদ্ধা নেবেন।
সত্যসন্ধানী ভাবমূর্তি, Amit, Ranjan Roy, রমিত, সুব্রত রায়, অনিন্দিতা এবং কৃশানু নস্কর ---
আপনারা যাঁরা আমার লেখা থেকে চিন্তার খোরাক পেয়েছেন, তাঁদের সকলকেই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই । আপনাদের সাড়া পেয়ে ভরসা পেলাম । প্রশ্ন, পরামর্শ ইত্যাদি থাকলে অবশ্যই বলবেন ।
শুধু মধ্যযুগ কেন, প্রাচীন যুগেও মানুষের জীবনকাল কেমন ছিল সে সব আন্দাজ করার উপযোগী নানা তথ্য ও পদ্ধতির অস্তিত্ব আছে, এবং তা দিয়ে কিছু বাস্তবসম্মত আন্দাজ করা চলে এবং করা হয়েও থাকে । শুধু ইউরোপের নয়, সারা পৃথিবীরই । এখানে দেওয়া লেখচিত্রটি তারই এক দৃষ্টান্তমাত্র । এ যুগে সবারই আঙুলের ডগায় তথ্য কিলবিল করছে, কাজেই সূত্রনির্দেশ বাহুল্য হবে ।
আপনার ব্যাখ্যার জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করলাম, এবং আরও অপেক্ষা করতে অরাজি নই । তবে, ইতিমধ্যে আপনার দীর্ঘ মন্তব্যের ভিত্তিতে কয়েকটা কথা বলি । কথা তো কিছু ছিলই, কিন্তু আপনি আমার মোদ্দা বক্তব্য নিয়ে ঠিক কী অবস্থান নিতে চান সেটা জানতে বেশি আগ্রহী ছিলাম বলে খুঁটিনাটি নিয়ে বেশি কথা প্রথমেই বলতে চাইনি । এখন মনে হচ্ছে, সেগুলো বলে রাখলেও খারাপ হবে না । আমার ধারণা, এতে এই চর্চাটির পক্ষে নির্দিষ্ট অবয়ব পেতে হয়ত খানিক সুবিধেই হবে ।
(ক) একটু খেয়াল করে দেখবেন, আমি তুলোর প্রসঙ্গ আদৌ বাদ দিইনি । ওটা আছে, এবং আপনি যেখান থেকে আমার উদ্ধৃতিটা তুলেছেন ঠিক সেখানেই আছে, ছ-নং চিত্রের ঠিক নিচের অনুচ্ছেদে । এই দেখুন ---
"উপনিবেশ থেকে সম্পদ যে বিদেশে পাচার হত, সে তো বলাই বাহুল্য । নানা রকম ট্যাক্স আদায় করে, তুলো নীল শস্য ইত্যাদি কাঁচামাল জোর করে এখানে চাষ করিয়ে তারপর ওদেশে রপ্তানি করে, যন্ত্রে তৈরি বিলিতি বস্ত্র আমদানি করে এদেশে বেচে, এদেশের জোত জমি কারখানার মালিক হয়ে, উৎপাদন-ব্যবসা-বিপণন সংক্রান্ত নানা ব্যাপারে পরামর্শদাতা ও ব্যবস্থাপক হয়ে । এই রকম সব কায়দায় । ওদিকে আমেরিকাতে ছিল চিনি আর ক্রীতদাসের ব্যবসা । এই সম্পদ যে ব্রিটেনে গিয়ে সেখানকার সমৃদ্ধি বাড়িয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই ।" [প্রাসঙ্গিক শব্দগুলো বাঁকা অক্ষরে দিলাম]
এখান থেকে আপনি শুধু শেষের বাক্যদুটোকে উদ্ধৃত করেছেন । আর, ব্যবসা-বাণিজ্য-টাকা-পয়সা এইসবের হিসেবপত্তর যা দেওয়া আছে, সেখানে তুলোসহ সব হিসেবই ধরা আছে, কাজেই 'টেক্সটাইল ফ্যাক্টর' দিয়ে মোদ্দা সিদ্ধান্তের যে আদৌ কোনও নড়চড় হচ্ছেনা, সেটা ওপরের মন্তব্যে বলেছি । সে ব্যবসায় ক্রীতদাস লাগত কিনা, সেটা এখানে মোটেই প্রাসঙ্গিক না।
(খ) আপনি স্বয়ং ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের তিনটি চিহ্নকে সর্বজনগ্রাহ্য বলে মেনে নিয়েছেন --- ১) স্টিম ইঞ্জিন, ২) বস্ত্রশিল্পের বিস্তার, এবং ৩) নিউটন।
এখন লক্ষ্য করে দেখুন, উপনিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু দ্বিতীয়টিরই, প্রথম এবং তৃতীয়টি ইউরোপের একান্ত নিজস্ব (না, শুধু ব্রিটেনের নয় মোটেই) । এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রেও, বস্ত্রশিল্পের বিস্তার ঔপনিবেশিক চাহিদার কারণে হতে পারে, কিন্তু তার উদ্ভব অবশ্যই সে কারণে নয়। অল্প সময় ও খাটুনিতে প্রচুর কাপড় বুনে দিতে পারে এমন তাঁত ইউরোপ বানাতে পেরেছিল, উপনিবেশের কারণে নয়, নানা জটিল ধাতব যন্ত্র তৈরির দীর্ঘ ইতিহাসের কারণে । দিল্লির কুতুব মিনারের দিকে আঙুল তুলে প্রাচীনকালে স্টেনলেস স্টিল বানিয়ে ফেলার ভুয়ো দাবিতে মুগ্ধ হয়ে থাকা আম-ভারতবাসীদের বেশির ভাগই জানেন না যে, উপযুক্ত ধাতুবিদ্যার অভাবে বৃহদায়তন উৎপাদনের চাপ সহ্য করার মত পোক্ত তাঁত বানানোর প্রযুক্তি ভারতীয় কারিগরদের অধরা ছিল । এবং, কয়লার প্রাথমিক চাহিদাটা ছিল বস্ত্রশিল্পে নয়, ওখানেই --- আয়রন ফাউন্ড্রিতে । যন্ত্রপাতি গাড়িঘোড়া থেকে শুরু করে অস্ত্রশস্ত্র সবই ছিল ওরই ওপরে নির্ভরশীল । সে রকমই একটি বস্তু ছিল ঘড়ি । ভারতীয় ধনীরা ইউরোপ থেকে বিস্তর বড়লোকী বস্তু আমদানি করতেন, কিন্তু তার মধ্যে 'ঘড়ি' বস্তুটি ছিল না, ইউরোপীয় ঘড়িকে খুলে দেখে কৃৎকৌশল বোঝার চেষ্টা করা তো বহু দূরের বিষয় । সময়কে মেপে খরচ করার তাগিদ তাঁরা কোনওদিনই খুব বেশি বোধ করেননি, এখানকার আদিম সময়-মাপনীই তাঁদের কাছে যথেষ্টর বেশি ছিল ।
ব্রিটেনের বস্ত্র-পণ্য যতদিনে সারা পৃথিবীতে দাপাতে শুরু করেছে, তার বহু আগের গল্প এইসব ।
(গ) অস্ট্রেলিয়া থেকে ব্রিটেনে যথেষ্ট পরিমাণে সম্পদ নির্গমণ উনিশ শতকের আগে শুরু হয়নি । আর, শিল্পবিপ্লবের শুরু ধরা হয় অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি । কাজেই, 'কারণ' শব্দটির কোনও সম্ভাব্য অর্থেই অস্ট্রেলিয়া দখলকে শিল্পবিপ্লবের 'কারণ' বলে খাড়া করার কোনও বাস্তব উপায় নেই (প্রায় একই যুক্তি ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, মূল লেখায় সেটা বলেছি) ।
এই যে আপনি বলছেন "এইটা ফস্কে না গেলেই দেখা যেত, যে, এই পুরো প্রক্রিয়ায় বাংলার বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হয়" --- এর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার কী সম্পর্ক বুঝতে পারিনি, তবে কথাটা এমনিতে ঠিকই বলেছেন । অর্থাৎ, বাংলার বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হওয়াটা ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের কারণ নয়, ফল ।
(ঘ) "বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোককে মেরে ফেলা" জাতীয় আবেগী কথাংশের মধ্যে নৈতিক অভিযোগের উত্তাপ যতটা প্রকট, কঠোর তথ্য-যুক্তি সহযোগে ঐতিহাসিক কার্যকারণ নির্ণয়ের আকাঙ্ক্ষাটি বোধহয় ঠিক ততটা নয় । মন্বন্তরের সময়টুকুতে প্রচুর লোক মরেছিল বটে, তবে সামগ্রিকভাবে মোগল আমলের তুলনায় ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় জনসংখ্যার (এবং মোট জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয় ইত্যাদিরও) বৃদ্ধিহারে বিশেষ কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না (মূল লেখার চিত্র ২ দেখুন) । আর, এমনকি মন্বন্তরের সময়েও, আসলে ইংরেজরা 'টেকনিক্যালি' প্রকৃত শাসক ছিলই না, মোগল সম্রাটের তরফে 'দেওয়ানি' পেয়ে তারই তরফে কর আদায়কারী ছিল মাত্র । বস্তুত, মন্বন্তরটি হয়েছিল ব্রিটিশ-মোগলের বিভ্রান্তিকর দ্বৈত শাসনজনিত অরাজকতা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের যৌথ ফল হিসেবে । লোকজন মরে গিয়ে দেশের উৎপাদন কমে যাওয়াটা ইংরেজরা কেনই বা চাইবে খামোখা, তারা তো আর নির্বোধ নয় !
মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের সময়েও কঠোরভাবে পাওনা আদায় করে যাওয়াটা তাদের লোভ ও নিষ্ঠুরতার প্রমাণ বইকি । তবে কিনা, ১৭৭০ সালের বাংলায় ব্রিটিশ অসংবেদনশীলতাকে ১৭৫০-পরবর্তী ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের কারণ হিসেবে দেখতে চাওয়ার মধ্যে বোধহয় ঐতিহাসিক কাণ্ডজ্ঞানের চেয়ে অভিমানী আবদারটুকুই বেশি ।
একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন, ব্রিটিশ নিষ্ঠুরতার বিবরণটিকে যথেষ্ট মর্মস্পর্শী করে তোলা গেলেই যে ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের কারণ বলে তাকে চালানো যাবে, ব্যাপারটা সম্ভবত এত সোজা নয় । বাংলার মন্বন্তরে এক তৃতীয়াংশের বদলে যদি দুই তৃতীয়াংশ লোকও মারা যেত, তাতেও ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের কার্যকারণ ব্যাখ্যায় এক পা-ও এগোনো যেত না ।
আপনি আদৌ জবাব দেবার সময় পাবেন কিনা, জানি না । তবে, কথাগুলো রাখা রইল । এর কিছু না কিছু প্রাসঙ্গিকতা হয়ত থাকবে, এই রকমই আশা আমার ।
অসাধারণ মূল লেখাটির সঙ্গে উপরের মন্তব্য গুলোও সমান সমৃদ্ধ করলো.. উপনিবেশ না থাকলেও ইউরোপে শিল্প বিপ্লব হতোই.. তার কারণ বিজ্ঞান..
খুবই তথ্যনিষ্ঠ লেখা। সেজন্য ধন্যবাদ। তবে বিশ্লেষণ অনেকটা "কী হইলে কী হইতো জাতীয় সন্ধান" মনে হলো। ইতিহাস তো সেভাবে এগোয় না৷
জ্ঞানচর্চার কথা বললে এককালে এই উপমহাদেশে সত্যিই প্রভূত জ্ঞানচর্চা হয়েছে (বিশেষত গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্র)। অপদার্থতার কারণেই তা ভোগে গেছে৷ তারপর মধ্যপ্রাচ্যে বেড়েছে জ্ঞানচর্চা৷ রসায়ন ও গণিতের বিকাশ চোখে পড়ার মতো৷ উপমহাদেশের পুঁথির অনুবাদও হয়েছে যথেষ্ট। সেই পুঁথি এসে পৌঁছেছে ইউরোপে৷ ঘটেছে আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশ (যাকে আমরা ইউরোপীয় ইতিহাস চর্চার কল্যাণে রেনেসাঁ নামে চিনি)।
এবার এই ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, বিজ্ঞানের ফলশ্রুতিতেই প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু প্রযুক্তির ধারণা থাকলেও শিল্প 'বিপ্লব' সম্ভব না। তার জন্য চাই পুঁজি। পুঁজি এসেছে দেশ দখলের মাধ্যমে। দেশ দখল হয়েছে আবার সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফলে এটি একটি চক্রাবর্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এ থেকে সিদ্ধান্ত খুব বেশী করা যায় না। এটুকুই বলা যায়, উপনিবেশ (পুঁজি) না থাকলে শিল্প বিপ্লব সম্ভব ছিলো না। আবার একইভাবে শিল্প বিপ্লব না হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত দ্রুত এগোতো না। হয়তো উপমহাদেশ বা মধ্যপ্রাচ্যের মতোই জ্ঞানচর্চা একদিন স্থবির হয়ে যেতো। তবে উপনিবেশ বিস্তারের জন্য বিশেষ রাজনীতি দায়ী, বিজ্ঞানকে দায়ী করা নেহাৎই ছেলেমানুষী। আবার একই সাথে প্রযুক্তির বিকাশের পেছনে লুঠের কালো ইতিহাসকে সামান্যও ছোটো করা সম্ভব না।
এই যে বলছেন, এখান থেকে পুঁজি লুঠ হয়ে তবেই ইউরোপে শিল্পবিপ্লব হয়েছে, ঠিক ওই ধারণাটাকেই আমি এখানে ভুল বলে দেখাতে চেয়েছি । তার জন্য আমার সাধ্যমত তথ্য-যুক্তি দেবার চেষ্টা করেছি, হয়ত বোঝাতে পারিনি । আমার তথ্য-যুক্তিতে কোথায় ফাঁক আছে বলে আপনার মনে হল সেটা এখানে যদি নির্দিষ্টভাবে বলতেন, তাহলে আর একটু আলোচনার চেষ্টা করা যেত । এখানে যে এক সময় জ্ঞানচর্চা হয়েছে, সে কথা আমি অস্বীকার করিনি ।
এই আলোচনায় আপনি বিভিন্ন উদাহরণ দেখিয়েছেন যে উপনিবেশ থেকেও শিল্পবিপ্লব না হওয়া বা উপনিবেশ হওয়ার আগেই প্রযুক্তির উন্নতি হওয়া।
আমি সেটা নিয়েই লিখলাম, প্রযুক্তির বিকাশ আর শিল্প বিপ্লবের মাঝে একটা স্তর আছে পুঁজি। যথেষ্ট পুঁজি ছাড়া এমন বিপ্লব সম্ভব না। নেসেসারি কন্ডিশনের মধ্যে পড়ে সেটা। আর সেটার জন্যই উপনিবেশ জরুরি চিি