এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ইউরোপের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিপ্লব কি ঔপনিবেশিক শোষণ ছাড়া কিছুতেই হতে পারত না?

    Debasis Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৫ অক্টোবর ২০২০ | ৭৭৭৮ বার পঠিত | রেটিং ৪ (৫ জন)
  • বিজ্ঞান ও যুক্তির সত্যসন্ধানী ভাবমূর্তিতে নাকি আজকাল একটু কালির ছিটে লেগেছে, ও সব নাকি আসলে ততটা ‘সত্য’ নয়, যতটা পশ্চিমী মগজ-ধোলাই । ও হচ্ছে এশিয়া, আমেরিকা আর আফ্রিকার প্রাচীন জ্ঞানকে দাবিয়ে রাখা আর অস্বীকার করবার হাতিয়ার, পশ্চিমী জ্ঞানকেই একমাত্র জ্ঞান বলে বাকি পৃথিবীর ওপর চাপিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র । এই কারণেই নাকি আধুনিক যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান আর তারই উপজাত আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগে যুদ্ধ-বিগ্রহে, মানুষকে দমিয়ে রাখতে, নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস করতে । কাজেই, এ হেন খারাপ জিনিসের জন্ম ও বাড়বৃদ্ধি যে এশিয়া আর আফ্রিকার উপনিবেশগুলোকে শোষণ না করে সম্ভব হতে পারত না, তাতে আর সন্দেহ কী ?

    আধুনিকতা ও পাশ্চাত্যের রোমান্টিক বিরোধিতার এই ফ্যাশনেব্‌ল্‌ বয়ানটি বিশ শতকের সাত থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত অ্যাকাডেমিক্স-এ খুব চলত । আজ তার সুদিন গিয়াছে, তবু আজও অনেকে নিয়মিতই এ নিয়ে ফেসবুকে চর্বিতচর্বণ করে থাকেন । ভারতের মত এক সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ইংরেজের হাতে দখল হয়ে যায়, আর, মোটামুটি ওই একই সময় থেকে ব্রিটেন-এ শুরু হয় শিল্প-বিপ্লব, অতএব সেটা নিশ্চয়ই ভারত থেকে লুঠ করা টাকাতেই সম্ভব হয়েছিল, এ রকম একটা ধারণা অ্যাকাডেমিক পণ্ডিত থেকে শুরু করে সাধারণ পড়ুয়া মানুষ অবধি অনেকেই পোষণ করে থাকেন । এ রোমান্টিকতা এমনিতে একটি নির্দোষ ভ্রমমাত্র, তবে তার পরিণতি সব সময় তত নির্দোষ না-ও হতে পারে। যেমন ধরুন, একে যদি শুধু ব্রিটিশ আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন, তাহলে ব্যাপারটাতে বেশ একটা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মেজাজ থাকে । কিন্তু এই একই যুক্তিটিকে আর পাঁচশো বছর মতন পিছিয়ে দিলেই ব্রিটিশের জায়গায় মুসলমান বসে যাবে, এবং তখন গল্পটা প্রাচীন ভারতের হেঁদুস্বর্গ যবন দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ার হিন্দুত্ববাদী গল্পে গিয়ে দাঁড়াবে ।

    এই সব কথাবার্তার ঠিক-ভুল নিয়ে দুচার কথা এ লেখায় বলার চেষ্টা করব, কিন্তু তার আগে এ ধরনের দুয়েকটি প্রতিনিধিস্থানীয় ও সাম্প্রতিক বক্তব্য নির্দিষ্টভাবে হাজির করা দরকার, নইলে মনে হতে পারে আমি বুঝি বা খড়ের পুতুলের সাথে ঝগড়া করছি । আরও একটি কথা এই সূত্রে বলে নেওয়া দরকার । ওপরে যে অবস্থানের কথা বললাম, তার গোটাটাই যে কোনও একজন বিশেষ কেউ (বা কয়েকজন) বলেছেন, বা ঠিক একই ভাবে বলেছেন, এমনটা নয় কিন্তু । বরং বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন সুরে যা যা বলেছেন, সে সব একসাথে ধরলে তা থেকে এই রকম একটা মোদ্দা অবস্থান দাঁড়ায় । কাজেই, গোটা চিত্রটি খাড়া করার জন্য বেশ কয়েকজনের কথা টেনে আনতে হবে ।

    আপনাদের মনে পড়বে, ২০১৫ সালে শশী থারুর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, ব্রিটেনের তরফে ভারতকে ঔপনিবেশিক শোষণের ক্ষতিপূরণ বা ‘রিপ্যারাশন’ দেওয়ার দাবিতে । তাতে তিনি বেশ জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, দুশো বছর ধরে ব্রিটেনের উত্থান ঘটেছে ভারতকে লুণ্ঠন করেই, কারণ, ইংল্যান্ডের শিল্প-বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল ভারতকে বিশিল্পায়িত করে (এই বক্তৃতাটির স্বচ্ছন্দ বঙ্গানুবাদ করেছেন সমর বাগচী, ‘প্রেক্ষা’ পত্রিকায়) । তিনি আরও বলেছিলেন, ব্রিটিশরা যখন ভারতে আসে তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের ভাগ ছিল ২৩ শতাংশ, এবং যখন তারা সে দেশ ছেড়ে গেল তখন তা দাঁড়িয়েছিল শোচনীয় ৪ শতাংশে (এই সংখ্যাগুলোর উৎস অর্থনীতিবিদ অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসনের গবেষণা, সে প্রসঙ্গে শিগগিরই আসতে হবে আমাদের) । এই বক্তৃতাটি যেমন বিপুল সাড়া ফেলেছিল, ঠিক তেমনিই সাড়া ফেলেছে মাত্র কয়েক মাস আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকার, যেখানে অর্থনীতিবিদ উৎসা পট্টনায়ক দাবি করেছেন যে তিনি হিসেব করে দেখেছেন, ভারত থেকে ব্রিটেন যা শোষণ করেছে তার পরিমাণ নাকি সুদে আসলে আজ দাঁড়িয়েছে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার --- ব্রিটেনের বর্তমান জাতীয় আয়ের পনেরো গুণেরও বেশি ! এই রকম হিসেবনিকেশে লিপ্ত থেকেছেন অর্থনৈতিক ইতিহাসের আরেক গবেষক আদিত্য মুখার্জিও, ‘ইকোনমিক অ্যান্ড পোলিটিক্যাল উইকলি’ পত্রিকায় ২০১০ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘এম্পায়ার : হাউ কলোনিয়াল ইন্ডিয়া মেড মডার্ন ব্রিটেন’ প্রবন্ধে। ভারত থেকে নির্গত সম্পদ ব্রিটেনের জাতীয় আয় বাড়িয়ে তাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে, এবং শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি জুগিয়েছে, এই তাঁর বক্তব্য ।

    উনিশ শতকের শেষদিক থেকে ভারতের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদ ও অর্থনীতিবিদরা, যেমন দাদাভাই নৌরজি, রমেশচন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, এঁরা ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটেনে সম্পদের বহির্গমন বা ‘কলোনিয়াল ড্রেন’ নিয়ে যে সব অভিযোগ তুলেছিলেন, এই সব চর্চা এক অর্থে তারই ধারাবাহিকতা । তবে কিনা, যেহেতু ব্রিটেনের এই দখলদারি ও লুঠ চালাতে পারাটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তাদের এগিয়ে থাকার সুবাদেই, অতএব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যাপারটাকেই কাঠগড়ায় তুলতে হবে, এমন কথা অবশ্য এঁরা কেউই বলেন নি । অথচ, ঠিক এই কথাটাই বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বার বার উঠে এসেছে, ইউরোপের তরফে এশিয়া ও আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শোষণের বিষয়টিকে ভিত্তি করেই । সে বক্তব্যের চেহারাটা এবার তবে একটু দেখে নেওয়া যাক ।

    ভারতে যাঁরা এই অবস্থান থেকে লেখালিখি করে থাকেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম অগ্রগণ্য হলেন গোয়ার পরিবেশ ও মানবাধিকার আন্দোলনের সোচ্চার ব্যক্তিত্ব ক্লদ আলভারেজ । আশিস নন্দী সম্পাদিত বহুপঠিত সংকলন-গ্রন্থ ‘সায়েন্স, হেজিমনি অ্যান্ড ভায়োলেন্স’-এর অন্তর্গত ‘সায়েন্স, কলোনিয়ালিজ্‌ম্‌ অ্যান্ড ভায়োলেন্স’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, পশ্চিমী বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাহায্যে এই যে যুদ্ধাস্ত্র বানান হয়, ভয়ঙ্করভাবে পরিবেশ দূষণ হয়, তার কারণ মোটেই এই নয় যে খারাপ লোকেরা বিজ্ঞানের অপব্যবহার করে, বরং তার আসল কারণ হল এই যে ‘পশ্চিমী’ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিজেই মূলগতভাবে হিংস্র । তাঁর মতে, হিংস্রতার সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের আন্তরিক যোগাযোগটা অন্তত দুটো জায়গায় । প্রথমত, বিজ্ঞানের পদ্ধতি, এবং দ্বিতীয়ত, ঔপনিবেশিকতা । ব্যাখ্যা করা যাক । প্রথমত, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের যে পদ্ধতি, সেখানে শুধু যুক্তি আর সত্যাসত্য বিচারেরই রমরমা, রুচি-সৌন্দর্য-নৈতিকতা এইসব বিচারের জায়গা নেই । তার ওপর, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে যে কোনও জিনিসকে কেটেকুটে ছিঁড়েখুঁড়ে বিশ্লেষণ করে দেখা হয় । ফলত, তার মধ্যে হিংস্রতা থেকেই যায় । আর দ্বিতীয়ত, ঔপনিবেশিকতার সাথে বিজ্ঞানের যে যোগ, সেটা যেহেতু এই লেখায় বেশি প্রাসঙ্গিক, অতএব তা শোনা যাক স্বয়ং লেখকের জবানিতেই (এবং আমার বঙ্গানুবাদে), “বিজ্ঞান ও হিংস্রতার দ্বিতীয় যোগাযোগটা স্পষ্ট হয়ে উঠল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কার হবার ঠিক পরপরই : ঔপনিবেশিকতা । এ বিচারটা ইতিহাস ও রাজনীতির বিচার । বিজ্ঞান ও সাম্রাজ্যবাদের ‘রক্তের সম্পর্ক’-টি যে অতি ঘনিষ্ঠ ও ধারাবাহিক, সেটা পরিষ্কার করে বোঝা যায় এই বিচারে গেলে । এ গণ্ডগোলটা আজ বোঝা গেছে, তবু ক্রমাগত চেষ্টা চলে বিজ্ঞানকে ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের থেকে আলাদা করে দেখানোর । আমি আজ এখানে এটাই প্রতিপন্ন করতে চাইব যে, যেহেতু বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি দুটোই হচ্ছে ঔপনিবেশিক দখলদারির কর্মকাণ্ড, অতএব তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদ থেকে আলাদা করে দেখানোর যে কোনও ইঙ্গিতই প্রতারণা মাত্র ।” লেখক ক্লদ আলভারেজ তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে যে সব ‘যুক্তি’ দিয়েছেন তা আমার মতে এক আদ্যন্ত আগড়ম-বাগড়ম, এবং, বিজ্ঞানের অন্তর্বস্তুর মধ্যে হিংস্রতার আদল অন্বেষণ এক উন্মত্ত কল্পনা চালিত প্রকল্প । কিন্তু, এখন সে সব তর্কে ঢোকা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমি আপাতত শুধু চাই তাঁর অবস্থানটিকে স্বচ্ছভাবে হাজির করতে ।

    বিজ্ঞানের ‘অন্তর্গত’ এই তথাকথিত ‘হিংস্রতার’ কথাটা যাঁরা মানতে রাজি, তাঁরা সবাই কিন্তু এর উৎস বিষয়ে একমত নন । ক্লদ আলভারেজ, আশিস নন্দী এবং বন্দনা শিব-এর মত আধুনিকতা-বিরোধীরা যখন একে আধুনিকতারই উপজাত দ্রব্য বলে দেখাতে চান, তখন লিন হোয়াইট জুনিয়র-এর মত প্রযুক্তি-ইতিহাসবিদ একে খুঁজে বার করেন পশ্চিমী ইহুদী-খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির একেবারে গোড়ায়, খোদ বাইবেল-এর মধ্যে । তাঁর ‘দ্য হিস্টোরিক্যাল রুট্‌স্‌ অফ আওয়ার ইকোলজিক ক্রাইসিস’ প্রবন্ধটি এ জন্য বিখ্যাত । সেখানে তাঁর বক্তব্য, ওই যে বাইবেল বলছে, ঈশ্বর সব প্রাণিকে সৃষ্টি করার পর সব শেষে নিজের আদলে গড়লেন মানুষকে, সেখানেই প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে, অন্য সমস্ত প্রাণির অস্তিত্ব শুধুই মানুষের খিদমতগারি করবার জন্য । অর্থাৎ, মানুষ যে তার নিজের সেবার জন্য গোটা প্রকৃতিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করতে পারবে, এইটা কিনা বাইবেলই বলে দিচ্ছে !

    তবে, এ ব্যাপারে কেউ যে খ্রিস্টধর্মের চাইতেও পুরনো কথা পাড়তে চাইতে পারেন না, তা নয় । যেমন, শিকাগোর ‘ঈস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি’-র গবেষক জিয়াউদ্দিন সরদার তাঁর সম্পাদিত ‘সায়েন্স, এক্সপ্লয়টেশন অ্যান্ড দ্য থার্ড ওয়ার্ল্‌ড্‌’ শীর্ষক সঙ্কলন-গ্রন্থের ভূমিকার গোড়াতেই বলে দিয়েছেন, ওই যে প্রাচীন গ্রিক ধর্মে বজ্র-দেবতা জিউস-এর কন্যা অ্যাথেনা-কে একই সাথে যুদ্ধ আর যুক্তির দেবী বলে মানা হয়েছে, ওইখানেই নির্ধারিত হয়ে গেছে, পশ্চিমী সংস্কৃতিতে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িত হয়ে পড়বে হিংস্রতা আর দখলদারির সঙ্গে ।

    তাহলে, বিজ্ঞান-উপনিবেশ-হিংস্রতা সম্পর্কিত তত্ত্বচর্চার পরিসরে নানা অবস্থান একটু নেড়েচেড়ে দেখে নেওয়া গেল । কিন্তু, এখনও প্রশ্ন হতে পারে, ওপরে যে বলেছি, “এই একই যুক্তিটিকে আর পাঁচশো বছর মতন পিছিয়ে দিলেই ব্রিটিশের জায়গায় মুসলমান বসে যাবে, এবং তখন গল্পটা প্রাচীন ভারতের হেঁদুস্বর্গ যবন দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ার হিন্দুত্ববাদী গল্পে গিয়ে দাঁড়াবে ।”, এইটা তবে কে কোথায় বলেছেন ? হ্যাঁ, অ্যাকাডেমিক গবেষণার জগতে এরও দৃষ্টান্ত আছে । যদিও আসলে এখানে এ কথাটা একটা স্বতন্ত্র অবস্থান হিসেবে হাজির করা হয়নি, হাজির করা হয়েছে অন্য আরেকটি অবস্থানের যৌক্তিক পরিণতির অনুমান হিসেবেই, তবু খুঁজলে এরও দৃষ্টান্ত পাওয়া কঠিন নয় । আই আই টি-র গবেষক অরুণ কুমার বিশ্বাস, যিনি প্রাচীন ভারতে ধাতুবিদ্যার ইতিহাসের একজন অগ্রগণ্য গবেষক, তিনি ২০১০ সালে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ হিস্ট্রি অফ সায়েন্স’-এ প্রকাশিত তাঁর ‘হোয়াই ডিড সায়েন্টিফিক রেনেসাঁ টেক প্লেস ইন ইউরোপ অ্যান্ড নট ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক প্রবন্ধে অভিযোগ করেছেন, জহরলাল নেহেরু এবং দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মত লেখকেরা প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার অবনতি বিষয়ে শুধু হিন্দুধর্মের মায়াবাদ, কুসংস্কার ও জাতপাতকেই দূষেছেন, কিন্তু তার পেছনে মুসলমানদের ভারত আক্রমণ ও লুণ্ঠনের ক্ষতিকর ভূমিকার কথা বাদ দিয়ে গিয়েছেন । এমন কি, শুধু অভিযোগেই না সীমাবদ্ধ থেকে তিনি এ ধরনের ‘স্যুডো-সেক্যুলারইজ্‌ম্‌’-এর মোকাবিলা করবার ডাকও দিয়েছেন ! নরেন্দ্র মোদির ভারত-বিজয়ের বছর তিনেক আগে একটি সরকার-পোষিত গবেষণা পত্রিকায় ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতাকে মোকাবিলা করবার এ হেন আহ্বান আমাদেরকে যারপরনাই সচকিত করে, কিন্তু তা সত্ত্বেও, ওইটুকু বাদ দিলে প্রবন্ধটি যে চমৎকার তা অস্বীকার করার উপায় নেই ।

    আশা করা যাক, এত সব কথাবার্তা বলে অন্তত এটুকু প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি যে, আমি নিছকই এক খড়ের পুতুলের সাথে ঝগড়া করছি না । তা যদি পেরে থাকি, তবে এবার নিশ্চয়ই এ বিষয়ে আমার বক্তব্য পেশ করতে আর বাধা নেই ।

    পাশ্চাত্য বিজ্ঞান অত্যন্ত নিন্দনীয় কারণ তার পেছনে আছে ঔপনিবেশিক লুঠতরাজ --- এই অত্যুৎসাহী নৈতিক বিচারের পেছনে অন্তত তিন রকমের ভুল আছে । এক, বিজ্ঞানের তত্ত্বের বিচারটা নৈতিক বিচার নয়, সত্য-মিথ্যের বিচার, এই সোজা কথাটা বুঝতে না পারা বা না চাওয়া । অঙ্ক, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা আর রসায়নের সূত্রগুলোর উৎস যা-ই হোক, তারা অত্যন্ত মূল্যবান কারণ তারা সত্য । এগুলো পশ্চিম জেনেছে আমরা পারিনি, এ কথাটাকে সহজে মানতে না শিখলে সত্য জানবার যোগ্য বলে নিজেকে দাবি না করাই ভাল । ওরা লুঠেরা তাই ওদের জ্ঞানটা মানব না --- এ রকম কথার মধ্যে শিশুসুলভ অভিমান থাকতে পারে, নিজের অজ্ঞতা ঢাকার ধূর্তামিও থাকতে পারে, কিন্তু প্রজ্ঞা মোটেই নেই । বিজ্ঞান-টিজ্ঞান মেনে ব্রিটিশ যদি বন্দুক বানায়, তো তার বুলেট-টা ব্রিটিশের মতই ভারতীয়েরও বুক ফুঁড়ে দিতে পারে, কালিদাসের কাব্য পাণিনির ব্যাকরণ আর উপনিষদের দর্শনের দোহাই দিয়ে তার হাত থেকে বাঁচা যাবে না । দুই, ঔপনিবেশিক লুঠতরাজটাই পশ্চিমী বিজ্ঞানের সৃষ্টি ও বিকাশের কারণ --- এ রকম ধারণাও ঐতিহাসিক সত্য থেকে বহু দূরে অবস্থিত । পশ্চিমী বিজ্ঞানের শিকড় আছে আড়াই হাজার বছর আগের গ্রিক বিজ্ঞান ও মধ্যযুগীয় আরব-রেনেসাঁর মধ্যে, এবং সেগুলোও আবার বহু হাজার বছরের প্রাচীন ব্যাবিলন-মিশর-ভারত-চিনের নানা অবদানে সমৃদ্ধ । জগৎটাকে জানতে হবে, এ তো মানুষের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা, নিছক ঔপনিবেশিক লুঠতরাজ তার কারণ হতে যাবে কেন ?

    প্রাচীন প্রজ্ঞাকে বাদ দিয়ে শুধু আধুনিক বিজ্ঞানকে পাকড়াও করবেন ভাবছেন ? উঁহু, নাঃ । যদি ঐতিহাসিক শিকড়ের কথা বাদ দিয়ে শুধু আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের কথাই ধরেন, তাতেও বিশেষ কিছু সুবিধে হবে না । ভাস্কো ডা গামা ভারতে প্রথম পা দিলেন ১৪৯৮-তে, সে সময়ই পোল্যান্ডে কাজ করছেন কোপার্নিকাস, বাইবেল-বিরোধী মহাজাগতিক সত্যকে তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন । ১৬১৫-তে যখন স্যার টমাস রো মুঘল সম্রাটের দরবারে হাজির হলেন ব্যবসার অনুমতির আর্জি নিয়ে, তার দু বছর আগেই গ্যালিলিও চিঠি লিখে ফেলেছেন বেনিদেত্তো কাস্তেলি-কে, কোপার্নিকাস-এর বিশ্বতত্ত্বকে সমর্থন জানিয়ে । ১৬৯০-তে জোব চার্নক যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে কলকাতা নামক একটি গাঁ কিনছেন, তার বছর তিনেক আগেই নিউটনের 'প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা' প্রকাশিত হয়ে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে । ১৭৫৭-তে যখন পলাশি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সৈন্য বাংলা দখল করল, ততদিনে ইংলন্ডে শুরু হয়ে গেছে শিল্পবিপ্লব । উপনিবেশ থেকে লুঠ করা সম্পদ ইউরোপকে বড়লোক করেছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু টাকা লুটতে পারলেই বিজ্ঞান-টিজ্ঞান করা যায়, ব্যাপারটা ও রকম হাতের মোয়া নয় । ব্রিটিশদের বহু আগে থেকেই স্পেন দেদার লুটেছে লাতিন আমেরিকা থেকে, কিন্তু ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশেষ কিছুই অবদান রাখতে পারেনি, এবং ইউরোপকে আধুনিক রাষ্ট্র ও অর্থনীতি গড়বার রাস্তাও দেখাতে পারেনি ।

    তিন নম্বর ভুলটি হল আরও এককাটি সরেস, কারণ, এটি হচ্ছে 'নিজের বেলায় আঁটিসুঁটি পরের বেলায় দাঁতকপাটি' গোত্রের ভুল । যখন বলা হয় যে ভারতবাসী ছিল ধর্মভীরু শান্তিপ্রিয় চিন্তাশীল, আর ইউরোপীয়রা (কিম্বা মুসলমানেরা) বার বার এসে তাকে উত্ত্যক্ত করেছে, তখন ভুলে যাওয়া হয় প্রাচীন ভারতে নিম্নবর্ণের প্রতি অত্যাচারের কথা, নৃশংস যুদ্ধকেন্দ্রিক দুই বিখ্যাত ও জনপ্রিয় মহাকাব্যের কথা, ছোট বড় রাজাদের ক্রমাগত অর্থহীন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা, এমন কি শ্রীলঙ্কা-বালি-যবদ্বীপ-ইন্দোচীনে ভারতীয়দের উপনিবেশ তৈরির কথাও । ইতিহাস নিয়ে চর্চা হোক (ঠিক ওই বস্তুটাই তো প্রাচীন ভারতে ছিল না), ইতিপূর্বে যেখানে যা অন্যায় অত্যাচার হয়েছে সে সব নিয়ে নির্মম কাটাছাঁড়াও হোক । কিন্তু, 'আমরা হেরো অতএব আমরা বড্ড ভালমানুষ আর জ্ঞানী' --- এই আত্মপ্রতারণা দিয়ে আমাদের আখেরে কোনও লাভ হবে না ।

    ইউরোপের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিপ্লব ও ভারতে ঔপনিবেশিক শোষণের সম্পর্ক নিয়ে কথাবার্তা আরও এগোবার আগে আধুনিক যুগ নিয়ে একটা খুব ছোট্ট কথা বলে নিই । আচ্ছা, ইউরোপে আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উদ্ভবের পর আমরা মোটের ওপর আগের চেয়ে ভাল আছি, না খারাপ আছি ? প্রশ্নটি কঠিন, এবং এ লেখাটি সে বিষয় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ চর্চার জায়গাও নয় । তবু, একটা প্রাথমিক ইঙ্গিত পাবার জন্য নিচের লেখচিত্রে (চিত্র-১) চোখ বোলানো যাক । ১৭৭০ সালে এশিয়ায় সদ্যোজাত শিশুর সম্ভাব্য গড় জীবনকাল (Life Expectancy at Birth, or LEB) ছিল সাতাশ-আটাশ, ইউরোপে তা ছিল পঁয়ত্রিশ মতন । এই সংখ্যাগুলোই বর্তমানে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে মোটামুটি একাত্তর ও আশি । আধুনিকতা খুব বেশি খারাপ নয়, কী বলেন !



    তা সে যা-ই হোক, আমরা প্রসঙ্গে ফিরে আসি । ঔপনিবেশিক শোষণ সম্পর্কে দুটো কথা খুব শোনা যায় --- (১) ১৭০০ সাল নাগাদ ভারতের জাতীয় উৎপাদন গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক উৎপাদনের ২৪ শতাংশ মত ছিল, ব্রিটিশ অত্যাচারে তা শেষে নেমে আসে ৪ শতাংশে । (২) এই ঔপনিবেশিক শোষণে তৈরি হয় বিপুল অর্থনৈতিক অসাম্যও । এ দুটো কথা কিন্তু ততটা মিথ্যে নয়, শুধু একটু ঘোলাটে । এর অর্থ আসলে যে ঠিক কী, তা বোঝা যাবে এটিকে বিস্তারিত তথ্যের প্রেক্ষিতে স্থাপন করলে।

    এখন এই প্রশ্নটি আলাদা করে বিচার করে দেখা যাক যে, দীর্ঘ ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ভারত ও বাকি বিশ্বের অর্থনৈতিক ওঠানামা ও তার পরস্পর-সম্পর্কের নকশাটি ঠিক কী রকম । নিচের সারণি (চিত্র-২) দেখুন, বিশ্লেষণে পরে আসছি । এ সারণি শুধুমাত্র ভারত সম্পর্কেই। অর্থাৎ, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতের মোট ও মাথাপিছু উৎপাদন, উৎপাদন বৃদ্ধির হার, সেটা পৃথিবীর মোট উৎপাদনের কত শতাংশ, ভারতে জনসংখ্যারই বা তখন কি দশা, সে সব তথ্য এখানে পাবেন এক নজরেই।



    এর সাথে চোখ বুলিয়ে নিন এই ‘গ্রাফ’ বা লেখচিত্রটিতেও (চিত্র-৩), সুবিধে হবে। এতে আছে দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে অর্থনৈতিক বিবর্তনের চিত্র, এক নজরে (গোটা পৃথিবীর, শুধু ভারতের নয়) । প্রাচীন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিভিন্ন কালপর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদা ভাবে কতটা অবদান রাখত মোট পার্থিব উৎপাদনে, তার চিত্র এখানে পাবেন ।



    দ্বিতীয় ছবি, অর্থাৎ সারণিটি ভাল করে দেখুন । প্রাচীন যুগে ভারত ও চিন যে অর্থনীতিতে পৃথিবী-সেরা ছিল, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, খ্রিস্টীয় শতকের গোড়ার দিকে গোটা পৃথিবীর তৎকালীন অর্থনৈতিক উৎপাদনের যথাক্রমে প্রায় ৩২ ও ২৬ শতাংশের দায়িত্ব তারা নিতে সক্ষম ছিল । শুধু উৎপাদন-কুশলতা বা উন্নত সভ্যতা তার কারণ নয়, একটি বড় কারণ জনবলও (জনসংখ্যা-স্তম্ভটি লক্ষ করুন) । ওই জনবিরল পৃথিবীতে যে দেশে বেশি লোক, সে দেশেই বেশি বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, এবং সেহেতু বেশি বেশি উৎপাদন । অবশ্য, উল্টোটাও সমানভাবে ঠিক । বেশি উৎপাদনই আবার বেশি জনবলকে টিঁকিয়ে রাখতে পারে । কাজেই, সভ্যতার উন্নতি ও উৎপাদন-কুশলতার বিষয়টি পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়ারও কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না । তবে কিনা, ইতিহাসের অগ্রগতির সাথে সাথে ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনটি ক্রমশই খোয়াতে থাকে (পঞ্চম স্তম্ভটি দেখুন) । খ্রিস্টাব্দের শুরুতে যেখানে ভারতীয় উৎপাদন পৌঁছেছিল মোট পার্থিব উৎপাদনের ৩২ শতাংশে, সেখানে হাজার খ্রিস্টাব্দে তা নেমে দাঁড়াল ২৮ শতাংশে, ষোলশোতে মোটামুটি ২২.৫, সতেরশোতে সামান্য বেড়ে ২৪ হলেও আঠেরোশোতেই আবারও ১৬ এবং উনিশশো তেরোতে ইংরেজ আমলের শেষদিকে প্রায় ৭.৫ । ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে যাবার সময়ে অধঃপতন চূড়ান্ত, প্রায় ৪ শতাংশ । এবং, এই অধঃপতন মোটের ওপর ধারাবাহিক, ওঠাপড়ার গল্প খুব একটা নেই ।

    এখন, ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ভারত দখল হবার আগে পর্যন্ত ইংরেজরা এ দেশে শুধুই ব্যবসা করেছে, সেখানে গা জোয়ারির প্রশ্ন ওঠে না । কাজেই, ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে ভারতের অর্থনৈতিক অধঃপতনের গল্পটা বড়জোর অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি অবধি টেনে নিয়ে যেতে পারবেন (আর মুসলমানী অত্যাচারে দেশ ছারখার হওয়ার গল্প বড়জোর ১২০০ অবধি), কিন্তু তার আগে ? তার বহু আগে থেকে সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক উৎপাদনে ভারতের ভাগ ক্রমাগত নেমে আসার ব্যাখ্যাটা তবে কী ? ঠিক আছে, বিষয়টা খতিয়ে দেখা যাক । এমন কি হতে পারেনা যে, হাজার সালের আগের পতনটা আকস্মিক, আর হাজার সাল থেকে এই যে অনবরত মসৃণ পতন, তার পেছনে বাস্তবিকই প্রথমে মুসলমান ও পরে ব্রিটিশদের লুণ্ঠনই দায়ী ? ব্যাপারটা এমন নয় তো যে, 'ওরা' এগিয়েছে আমাদের শোষণ করেই, তাই ওরা হয়েছে বড়লোক আর আমরা ক্রমেই হয়েছি গরিব ? সারণিটি (চিত্র-২) খুঁটিয়ে দেখলে সে প্রশ্নেরও অনেকটাই উত্তর পাওয়া যাবে --- দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ স্তম্ভগুলোতে একটু নজর দেবেন । ভাল করে ভেবে দেখুন, আমাদের শোষণ করাটাই যদি অন্যদের উন্নতির একমাত্র কারণ হত, তাহলে ওরা বড়লোক হবার সাথে সাথে আমরা সমান তালে গরিব হতাম । অথচ স্পষ্টতই ঘটনা তা নয়, কারণ ওই সময়ে ক্রমাগতই অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটেছে, খুব ধীর লয়ে হলেও । ওই সময়কালে উৎপাদনের মোদ্দা অর্থমূল্য (স্তম্ভ-২), মাথাপিছু আয় (স্তম্ভ-৩) এবং জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার (স্তম্ভ-৪) --- এই তিনটি হিসেবেই ক্রমাগত সমৃদ্ধি ঘটেছে, নিজেদের অতীতের তুলনায় অন্তত আমরা গরিব হয়ে পড়িনি । প্রশ্ন হচ্ছে, অন্যরা তবে সমৃদ্ধ হল কীভাবে ?

    এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে এই গোটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটিকে একটিমাত্র ঐতিহাসিক বোধের আওতায় আনতে হবে । আর তা যদি করতে হয়, তাহলে বিনা ওজর-আপত্তিতে প্রথমেই এইটা স্বীকার করে নিতে হবে যে, ভারত সজোরে দৌড় শুরু করেও গতি বাড়াতে পারেনি, আর বাকিরা অর্থনৈতিক উন্নতির গতি বাড়িয়ে বাড়িয়ে ক্রমশই তাকে ধরে ফেলেছে বা টপকে গেছে । এবং, এই টপকে যাওয়ায় কোনওমতেই ব্রিটিশ বা মুসলমানেরা প্রথম নয়, এগিয়ে আছে চিন, যে নাকি হাজার খ্রিস্টাব্দ থেকেই ভারতকে প্রবল বেগে তাড়া করে এবং অচিরেই ধরে ফেলে (তৃতীয় ছবি, অর্থাৎ গ্রাফ-টি দেখুন) । ইউরোপেরও এগোনোর গল্প শুরু হয়েছে মোটামুটি ওই একই সময় নাগাদ, তবে ১৭০০ সালের আগে তারা ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি । এই গোটা সময়টাই ভারতের কাছে শুধুই পিছিয়ে পড়ার গল্প । ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক নানা টানাপোড়েনে বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতা ওঠে আর পড়ে, একে বুঝতে হবে নির্মোহ ও কঠোর তথ্য-যুক্তি দিয়ে, এখানে 'বঞ্চিত' ব্র্যান্ডের আখাম্বা সেন্টিমেন্ট আর অন্ধ ঐতিহ্যপ্রেমের কোনও স্থান নেই।

    এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রশ্নে, অর্থাৎ, প্রাক-ব্রিটিশ অর্থনীতিতে অধিকতর 'সাম্য' বিরাজ করত কিনা সেই প্রশ্নে । ওইসব সময়ের তথ্য পাওয়া খুবই কঠিন, অতএব কঠিন তৎকালীন অর্থনীতির সাম্য-অসাম্য মাপাও । তবু, অর্থনীতিবিদেরা চেষ্টার ত্রুটি করেন নি, যতটা পারা যায় কাজটা করার চেষ্টা করেছেন । নিচের সারণি দেখুন (চিত্র-৪) । এখানে পাওয়া যাচ্ছে ১৭৫০ সালে ভারতে আয়-বন্টনের চিত্র, এক নজরে । এতে দেখা যাচ্ছে, তখন রাজা-গজা-জমিদার শ্রেণি ছিল মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ, এবং জাতীয় মোট আয়ে তাদের ভাগ ছিল ১৫ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ছিল গড় জাতীয় আয়ের ১৫ গুণ । তাদের নিচে ছিল ব্যবসায়ী ও রাজকর্মচারী শ্রেণি, তারা ছিল মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ, জাতীয় মোট আয়ে তাদের ভাগ ছিল ৩৭ শতাংশ, এবং মাথাপিছু আয় ছিল গড় জাতীয় আয়ের ২.২ গুণ । তারও নিচে ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির লোকজন, যারা ছিল মোট জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ, এবং জাতীয় মোট আয়ে তাদের ভাগ ছিল ৪৫ শতাংশ, যদিও মাথাপিছু আয় ছিল গড় জাতীয় আয়ের .৬ (দশমিক ছয়) গুণ । আর, সবচেয়ে নিচে ছিল আদিবাসী জনসমাজ, যারা ছিল মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ, এবং জাতীয় মোট আয়ে তাদের ভাগ ছিল ৩ শতাংশ, এবং মাথাপিছু আয় ছিল গড় জাতীয় আয়ের .৩ (দশমিক তিন) গুণ ।

    এ চিত্র আরও স্পষ্ট হয় ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবের ‘মুঘল ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী বিকাশের প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনাসমূহ’ প্রবন্ধে দেওয়া তথ্য থেকে । সেখানে তিনি গবেষক এ জান কায়সার-এর সূত্র উদ্ধৃত করে দেখান, ১৬৪৭ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের সমগ্র আয়ের ৬১.৫ শতাংশ ছিল মাত্র ৪৪৫ জন মনসবদারের আয় (মোট মনসবদারের সংখ্যা ৮০০০), এবং তাদের মধ্যেও আবার মাত্র ৭৩ জনের দখলে ছিল সমগ্র রাজস্বের ৩৭.৬ শতাংশ ! আদর্শ সাম্যের দশা নয়, বলা বাহুল্য ।



    না, এত সব কথাবার্তার উদ্দেশ্য মোটেই এইটা প্রমাণ করা নয় যে, ঔপনিবেশিক শোষণ বলে কিছু ছিল না, বা, সেটা খুব ভাল জিনিস ছিল, বা যেটুকু খারাপ ছিল তার গুরুত্ব যথেষ্ট বেশি নয় । আমার আপত্তি শুধু উপনিবেশবিরোধী কান্নাকাটি মাত্র সম্বল করে মানুষের ইতিহাস ও বিজ্ঞান নিয়ে ভুয়ো-নৈতিক ভাটচর্চায় । এইটা পরিষ্কার করে বুঝতে হবে যে, এ ধরনের সেন্টিমেন্ট্যাল তত্ত্বায়নে ঐতিহাসিক কার্যকারণকে উল্টে‌ ফেলা হয় । ইউরোপীয়রা উপনিবেশকে শোষণ করেছিল বলেই উন্নত হয়েছিল তা নয়, বরং ঠিক উল্টো‌, তারা উন্নত হয়েছিল বলেই উপনিবেশ দখল করতে পেরেছিল । হ্যাঁ, তবে, সেইসঙ্গে আবার এটাও সত্যি যে, ওই দখল ও লুঠের সুযোগ নিয়েই তারা তাদের সমৃদ্ধি অনেকখানি বাড়িয়ে তুলেছিল, এবং তার ফলে তাদের সাথে আমাদের যে পার্থক্য ইতিমধ্যেই ছিল তা আরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল । এটা শুধু পদার্থবিদ্যা আর রসায়নে উন্নতির প্রশ্ন নয়, কিম্বা শুধু বন্দুক আর ইঞ্জিন তৈরির প্রশ্নও নয়, ইতিহাস ভূগোল সমাজ বিষয়ক বোধেরও প্রশ্ন । যে নির্বোধ দেশীয় রাজাটি আজ ভাবছে ইউরোপীয় সেনার সাহায্য নিয়ে পাশের রাজাটিকে কাত করলেই কেল্লা ফতে, তার সাথে ইউরোপীয় সেনাপতিটির তফাত শুধু নিষ্ঠুরতা আর ধূর্ততায় নয়, সমাজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বোধবুদ্ধিতেও ।

    এবার আরেকটি সারণিতে (চিত্র-৫) নজর দেওয়া যাক, যাতে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর নানা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে মাথাপিছু জাতীয় আয়, ১৫০০ সাল থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত । রক্ত-নিম্নরেখিত অংশ দুটি লক্ষ করুন । পশ্চিম ইউরোপের মাথাপিছু আয় ১৫০০ সাল থেকেই এশিয়ার ওপরে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি । পরবর্তীকালে তা বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, ১৯১৩-তে দাঁড়িয়েছে ১৫০০-র তুলনায় প্রায় সাড়ে চার গুণ। ততদিনে এশিয়ার বৃদ্ধি কিন্তু ঋণাত্মক হয়ে যায়নি, তবে তা যৎসামান্য --- মাত্রই আটভাগের একভাগ । নজর করে দেখুন, এশিয়া পিছিয়ে পড়েছে শুধু ইউরোপের তুলনায় নয়, একমাত্র আফ্রিকা ছাড়া বাকি সকলের থেকেই । অর্থাৎ, শুধু এশিয়ার সম্পদ ফাঁকা করে করেই ওরা বড়লোক হচ্ছে, এ হিসেব মোটেই মিলছে না । এর পরে আমরা দেখব, এশিয়ার মধ্যে ভারতকে বিশেষভাবে ধরলে এ সত্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে ।



    এবার হাজির করব একটি লেখচিত্র (চিত্র-৬), যাতে রয়েছে ভারত, চিন, জাপান ও কয়েকটি পশ্চিম ইউরোপীয় দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, ১৫০০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত । লক্ষ করুন, ব্রিটেন তখন থেকেই ভারতের থেকে এগিয়ে শুরু করছে (অন্য ইউরোপীয় ও এশীয় দেশগুলোও), এবং সাড়ে আঠেরোশো সাল অবধি মোটামুটি সমগতিতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে, যদিও ভারত ও চিন প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকছে, এমন কি চিন যৎসামান্য নেমেও যাচ্ছে (চিনের অবাক করা উত্থান এর ঠিক পরের গল্প, যদিও এখানে প্রাসঙ্গিক না) । ব্রিটেনের বাড়বাড়ন্ত অন্য সব দেশের চেয়েই অনেক বেশি । খুঁটিয়ে নজর করুন, ১৫০০ সাল থেকেই ইউরোপীয় দেশগুলোর এই যে মসৃণ অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, এ কিন্তু ঘটে চলেছে ইংরেজরা ভারতে আসার বহু আগে থেকেই । আরও নজর করুন, ভারত দখল করে ব্রিটেনের অর্থনীতি ফুলেফেঁপে ওঠার তত্ত্ব যদি সত্যি হত, সেক্ষেত্রে ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের পর ব্রিটিশ অর্থনীতিতে এক বাড়তি গতি আসার কথা ছিল, তেমন কোনও লক্ষণ কিন্তু মোটেই দেখা যাচ্ছে না, এবং লেখচিত্র অনুযায়ী সেই বাড়তি গতিসঞ্চারটুকু আসলে ঘটছে আরও প্রায় একশো বছর পরে। দাবি উঠতে পারে, ১৫০০ সাল নাগাদ ভারত দখল হয়ত হয়নি, কিন্তু আমেরিকাতে ইউরোপীয় লুণ্ঠন তো ছিলই, কাজেই ওই বৃদ্ধিটাও ঔপনিবেশিক শোষণের ফল হিসেবেই ধরতে হবে । কিন্তু, সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে ওই সময় স্পেন-এর অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর থেকে বেশ খানিকটা বেশি হবার কথা, অথচ তা কিন্তু ঘটেনি । স্পেনের অর্থনীতি অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় বরাবরই দুর্বল থেকেছে, এবং ব্রিটেন বরাবরই থেকেছে অনেক এগিয়ে। অবশ্য, আরেকটি জরুরি প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে । এমন তো নয় যে, ১৮৫০ সাল নাগাদ যে প্রচণ্ড বাড়তি বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, সেটাই আসলে ভারতে ঔপনিবেশিক শোষণের ফল, যদিও নানা কারণে তা ফলেছে প্রায় একশো বছর দেরিতে ? সত্যিই তো, অর্থনৈতিক কার্যকারণ বিলম্বিত হতেই পারে, সব সময় তার ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে দৃষ্টিগোচর হয় না।

    এ প্রশ্নটি শুনতে বেশ লাগসই বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে অন্তত দুটি সমস্যা আছে । প্রথমত, প্রশ্নটিকে এভাবে রাখা মানেই ঠারেঠোরে এইটা মেনে নেওয়া যে, অন্তত প্রথম শিল্প-বিপ্লবের পেছনে ঔপনিবেশিক শোষণের কোনও হাত ছিল না (পাঠক এইটা মেনে নিলে তো আমার অর্ধেক কাজ ওখানেই শেষ) । দ্বিতীয়ত, সেক্ষেত্রে এই প্রশ্নও এসে পড়বে যে, ১৮৫০ সাল থেকে ব্রিটেন তথা ইউরোপে অর্থনীতি ও প্রযুক্তির প্রবল উল্লম্ফন যাকে ‘দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব’ বলে অভিহিত করা হয়, তার পেছনে প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে তো প্রথম শিল্প-বিপ্লব রয়েইছে, তবে আবার তার আরেকটা ব্যাখ্যার আদৌ দরকার পড়বে কেন ? ফলত, তখন ব্যাখ্যার দায়টা এই রকম দাঁড়াবে যে, প্রথম শিল্প-বিপ্লবের প্রভাব বিবেচনা করবার পরও দ্বিতীয় শিল্প-বিপ্লবের মধ্যে এমন কিছু থেকে যাচ্ছে যা ঔপনিবেশিক শোষণ ছাড়া অন্য কোনওভাবেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না । কাজটি যে যারপরনাই জটিল, তাতে সন্দেহ নেই । এখানে প্রথম শিল্প-বিপ্লব ও দ্বিতীয় শিল্প-বিপ্লবের তফাৎগুলো মনে মনে একটু আউড়ে রাখাটা সম্ভবত খুব একটা খারাপ ব্যাপার হবে না । প্রথমটির সময়কাল মোটামুটি ১৭৫০-১৮৫০, এর প্রধান চালিকাশক্তি ছিল কয়লার ব্যাপক ব্যবহার, সস্তায় ভাল লোহা তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার, স্টিম ইঞ্জিন, যন্ত্রচালিত সুতোকল ও তাঁত, এই সব জিনিস । আর দ্বিতীয়টির সময়কাল মোটামুটি ১৮৬০ থেকে ১৯১৫, এবং এর প্রধান চালিকাশক্তি-স্বরূপ উদ্ভাবনগুলো ছিল বৈদ্যুতিক মোটর ও আলো, টেলিগ্রাফ আর টেলিফোনের মত বৈদ্যুতিন যোগাযোগ-ব্যবস্থা, এইসব । এবার তবে দেখা যাক, শিল্প-বিপ্লবের রমরমার পেছনে ঔপনিবেশিক শোষণের ভূমিকা কতদূর ।

    এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে জানতে হবে, ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব ঘটবার কী কী কারণ অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করে থাকেন । সেই কথাতেই যাব এর পরে, তবে আপাতত একটা জিনিস শুধু লক্ষ করতে বলব । সেক্ষেত্রে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির রেখাটি শোষণে নিম্নমুখী হয়ে পড়ার কথা, তা ঘটেনি । ভারতের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থেকেছে একই জায়গায়, এমন কি তার যৎসামান্য বৃদ্ধিও ঘটেছে, যদিও তা ইউরোপের তুলনায় খুবই নগণ্য ।



    ব্রিটেনে শিল্প-বিপ্লব কেন হয়েছিল সে নিয়ে পণ্ডিতেরা পাহাড়প্রমাণ বই ও গবেষণাপত্র রচনা করেছেন, বইপত্তর পড়লে সে সব তো জানা যায়ই, এমন কি অন্তর্জালে খানিক সময় আর বুদ্ধি খরচা করে খোঁজাখুঁজি করলেও আজকাল বেশ কিছু কথা জেনে ফেলা যায় । তাছাড়া, যাঁরা পড়াশোনা করতে ভালবাসেন তাঁরা অনেকে সাধারণ জ্ঞান হিসেবেই এ সব বিষয়ে কিছু কিছু জানেন । কাজেই, এখানে সবিস্তারে সে কথা ফেঁদে বসা অর্থহীন । তবু, অন্তত মোদ্দা কথাটা না আউড়ে নিলে আলোচনায় ঢোকা মুশকিল । কেন শিল্প-বিপ্লব ব্যাপারটা আদৌ ঘটল, এবং ওই ব্রিটেনেই ঘটল, সে নিয়ে অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিশেষজ্ঞরা আজও মাথা খুঁড়ে মরেন । এ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে, এবং আজ পর্যন্ত যত রকমের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এসেছে তার প্রায় কোনওটাই পুরোপুরি সন্দেহের উর্ধ্বে নয় । একজন বিশেষজ্ঞ তো একে অর্থনৈতিক ইতিহাসের ‘হোলি গ্রেইল’ আখ্যা দিয়ে বসে আছেন ! তবু, শিল্প-বিপ্লবের যে সমস্ত বস্তুগত কারণের কথা অর্থনীতির পাঠ্যে খুব নিয়মিতভাবে পাওয়া যায় সেগুলো এই রকম --- (১) বহু আগে থেকেই কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধি, (২) কয়লা ও লোহার সহজলভ্যতা, (৩) কাপড় বোনবার যন্ত্র, বাষ্পীয় ইঞ্জিন, কোক কয়লা ও ধাতব লোহা তৈরির প্রযুক্তি ইত্যাদির আবিষ্কার, (৪) রেল, জল ও সড়ক পথে পরিবহন ব্যবস্থার প্রচণ্ড উন্নতি, (৫) জনসংখ্যার বৃদ্ধি, এই সব । এর সঙ্গে কেউ কেউ যোগ করতে চান নানা ঐতিহাসিক পরিস্থিতিগত ‘ফ্যাক্টর’, যেমন, আগের শতাব্দীতেই নিউটন সাহেবের হাতে ‘বৈজ্ঞানিক বিপ্লব’ সমাধা হওয়া, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় যুদ্ধবিগ্রহ কম হওয়ায় বেশ একটু শান্তির পরিবেশ বজায় থাকা, ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূলে সরকারি নানা নিয়মকানুন, এই সব । আবার, কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ ব্রিটেনের বিশেষ কিছু সমাজতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কথাও বলেছেন, যেমন, অন্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় ব্রিটেনের বড়লোকেরা লাভের মুখ দেখার জন্য শ্রমিক-মিস্তিরি-কারিগর শ্রেণির লোকজনকে বেশি বেশি পাত্তা দিতেন, ফলে ওখানে এই সব শ্রমিক-মিস্তিরি-কারিগর শ্রেণির লোকজন যন্ত্রপাতির উন্নতিসাধনে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন । এমন কি, এর পেছনে ধর্মীয় মতাদর্শগত প্রভাব কাজ করে থাকতে পারে কিনা, এ হেন সম্ভাবনাকেও গবেষকরা কিন্তু ফেলে দেননি । সর্বকালের সেরা সমাজতত্ত্ববিদদের একজন, জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ওয়েবার বলেছিলেন ‘প্রোটেস্টান্ট ওয়ার্ক এথিক্স’-এর কথা । অর্থাৎ, প্রোটেস্টান্ট ধর্মে যে কঠোর পরিশ্রম ও আত্মনিয়োগের কথা আছে, সেই মতাদর্শের কারণেই প্রোটেস্টান্ট ব্রিটেনের পুঁজিপতিরা কঠোর পরিশ্রম করে লক্ষ্যবস্তু অর্জনের প্রতিযোগিতায় ক্যাথলিক ফ্রান্স-স্পেন-ইতালিকে পেছনে ফেলেছেন, এই রকমই ছিল তাঁর বক্তব্য । ওয়েবার-এর এই অবস্থানকে আরও পোক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন ব্রিটিশ সমাজতত্ত্ববিদ রবার্ট মার্টন এবং ওলন্দাজ বিজ্ঞান-ইতিহাসবিদ রেইয়ার হুইকাস । এই যে এত বিচিত্র সব সম্ভাব্য কারণ, এরই মধ্যে আরেকটি হচ্ছে, উপনিবেশ থেকে শোষণ করা সম্পদ ব্রিটেনে গিয়ে শিল্প-বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি যুগিয়েছিল --- এই তত্ত্ব । বলা বাহুল্য, এটি একটি বেশ জোরাল বস্তুগত কারণ হলেও হতে পারে । উপনিবেশ থেকে সম্পদ যে বিদেশে পাচার হত, সে তো বলাই বাহুল্য । নানা রকম ট্যাক্স আদায় করে, তুলো নীল শস্য ইত্যাদি কাঁচামাল জোর করে এখানে চাষ করিয়ে তারপর ওদেশে রপ্তানি করে, যন্ত্রে তৈরি বিলিতি বস্ত্র আমদানি করে এদেশে বেচে, এদেশের জোত জমি কারখানার মালিক হয়ে, উৎপাদন-ব্যবসা-বিপণন সংক্রান্ত নানা ব্যাপারে পরামর্শদাতা ও ব্যবস্থাপক হয়ে । এই রকম সব কায়দায় । ওদিকে আমেরিকাতে ছিল চিনি আর ক্রীতদাসের ব্যবসা । এই সম্পদ যে ব্রিটেনে গিয়ে সেখানকার সমৃদ্ধি বাড়িয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই । প্রথমে দাদাভাই নৌরোজি এবং পরে মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, পশ্চিমবঙ্গে রমেশচন্দ্র দত্ত, এবং তারও পরে আরও অনেকেই, এই রকম ‘কলোনিয়াল ড্রেন’ বা ঔপনিবেশিক সম্পদ-ক্ষরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন । অবশ্য, এই সম্পদের সবটাই পাচার হওয়া সম্ভব হত না, তার একটা বড় অংশ এখানেই লেগে যেত ঔপনিবেশিক পরিকাঠামো তৈরি ও যুদ্ধবিগ্রহে । এখন, প্রশ্ন হচ্ছে, এই সম্পদ-পাচার কি এতটাই বেশি ছিল যে তা না হলে ইউরোপে শিল্প-বিপ্লব হতেই পারত না ? এর উত্তরে আজকের বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞই বলছেন, তা মোটেই নয়, তা না হলেও শিল্প-বিপ্লব মোটেই আটকাত না, কারণ ব্রিটেন তথা ইউরোপের মোট পুঁজির তুলনায় এ ছিল খুবই সামান্য ।

    কথাটাকে যাচাই করতে গেলে বাণিজ্য সংক্রান্ত কিছু তথ্য গুছিয়ে হাজির করা দরকার । কাজেই, আসছে আরও একটি সারণি (চিত্র-৭) । নিচে দেওয়া ছবি দেখুন । এখানে পাওয়া যাচ্ছে অষ্টাদশ শতক জুড়ে বিশেষ কয়েকটি বছরে ব্রিটেনের বহির্দেশীয় জলপথ বাণিজ্যের আয়। ভাল করে দেখুন, এক নজরে পাওয়া যাচ্ছে তিনটি বাণিজ্য-গন্তব্যের হিসেব --- ভারত (ইস্ট ইন্ডিয়া), আমেরিকা এবং ইউরোপ (উত্তর ও দক্ষিণ) । সারণি থেকে খুবই স্পষ্ট, ব্রিটেনের বহির্বাণিজ্যের সিংহভাগটাই ছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশের সাথেই । আমেরিকার সাথে তার থেকে বেশ খানিকটা কম, এবং ভারতের সাথে তারও চেয়ে অনেকটাই কম, যাকে নগণ্য বললেই হয় । রক্ত-নিম্নরেখিত সংখ্যাগুলোতে বিশেষ মনোযোগ দেবেন । এ সারণি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাবে, ব্রিটেনের দুই কলোনি অর্থাৎ আমেরিকা ও ভারতের তুলনায় ইউরোপের সাথেই বাণিজ্য চলত অনেক বেশি । এতে অবাক হবার কিছুই নেই, বরং এইটা না হলেই অবাক হতে হত । ইউরোপের দেশগুলোই তখন পৃথিবীর সমৃদ্ধতম দেশ (ব্রিটেনের থেকে হয়ত একটু কম), কাজেই ব্রিটিশ কারখানায় তৈরি পণ্যের সবচেয়ে শাঁসাল ক্রেতা তো তারাই হবে ।



    কিন্তু, এখনও বোধহয় তত নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না । বাণিজ্য তো একটা পরোক্ষ ব্যাপার । বাণিজ্য করলে সম্পদ বাড়ে ঠিকই, কিন্তু বাণিজ্য জিনিসটা নিজেই যে জাতীয় সম্পদের সমার্থক, এমন তো আর নয় । তাহলে, ব্রিটেনের জাতীয় সম্পদের সাথে ভারত থেকে ওদেশ যাওয়া বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের একটা সরাসরি তুলনা হলে ভাল হত, তাই না ? আচ্ছা, দেখা যাক সে রকম কিছু পাওয়া যায় কিনা । নিচের ছবিটা (চিত্র-৮) দেখুন, এখানে এক নজরে পাবেন ভারত ও ব্রিটেনের বাৎসরিক জাতীয় আয় বা ‘জিডিপি’-র সাথে ভারত থেকে ওদেশ যাওয়া বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের সরাসরি তুলনা, শতাংশের হিসেবে । চোখ বুলোলেই বুঝবেন, দুটো দেশের ক্ষেত্রেই এই অনুপাতটি মোটামুটি এক শতাংশের ধারেকাছে ! এটা কীভাবে হয়, দুটো দেশের আয় সমান নাকি ? হ্যাঁ, ঠিক তাই, মোট আয়ের নিরিখে । কিন্তু ভারতের লোকসংখ্যা যেহেতু ব্রিটেনের তুলনায় অকল্পনীয় রকম বেশি, কাজেই মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারত হতদরিদ্র, ব্রিটেন ধনী । তা, সে অবশ্য অন্য প্রশ্ন । ধনী গরিবের প্রশ্ন এখানে আসছে না, কারণ, এখানে আমরা মোট আয়ের সাথে বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের সম্পর্ক কী শুধু এইটুকু নিয়েই মাথা ঘামাতে চাইছি । এখানে যেটা দেখবার সেটা হল এই যে, ভারত ও ব্রিটেন দুটো দেশের ক্ষেত্রেই এই বাণিজ্য-উদ্বৃত্তটি মাত্রই এক শতাংশের ধারেকাছে । অতএব, এটা না হলে ব্রিটেনের শিল্প-বিপ্লব ব্যাপারটাই পুরো আটকে যেত, এতটা ভেবে নেওয়া বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি ।



    তাহলে, এখন আমরা আলোচনার শেষপর্বে এসে পড়েছি । এবার একটা জিনিস ভেবে দেখা যাক । আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় ছিল, ইউরোপের বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক বিপ্লব ঘটার জন্য উপনিবেশ থেকে সম্পদের পাচার অপরিহার্য ছিল কি না । এখনও পর্যন্ত আমরা যে তথ্যাবলী হাজির করেছি তার ইঙ্গিতটা হচ্ছে, না, তা ছিল না । কিন্তু, এও শেষ বিচারে এক পরোক্ষ ইঙ্গিতই বটে । এখনও পর্যন্ত আমরা নজরের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছিলাম অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে । পেছনে যুক্তিটা ছিল, বেশি আর্থিক সমৃদ্ধি বেশি বেশি বৈজ্ঞানিক-প্রাযুক্তিক আবিষ্কারকে সম্ভব করে তুলবে, এবং তার ফলে আবার ওই আবিষ্কারগুলোকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আরও বেড়ে উঠবে । কাজে কাজেই, যদি এইটা প্রমাণ করা যায় যে ইউরোপের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ঔপনিবেশিক সম্পদের পাচার অপরিহার্য ছিল (বা ছিল না), তাহলেই প্রমাণ হবে যে, ইউরোপের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সমৃদ্ধির জন্যও ঔপনিবেশিক সম্পদের পাচার অপরিহার্য ছিল (বা ছিল না) । এখন প্রশ্ন, আমরা কি এই পরোক্ষ অনুসন্ধানেই সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য, না আরও প্রত্যক্ষ তথ্যের খোঁজখবর করতে পারি ।

    এর উত্তর হচ্ছে, হয়ত তা পারি । যেমন ধরুন, আমরা সরাসরি খোঁজ করে দেখতে পারি, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময়কাল বরাবর ইউরোপে বিজ্ঞানচর্চার ধারায় কোনও পরিবর্তন এসেছিল কিনা । সেটা মাপার চেষ্টা করা যেতে পারে, যদি ওই সময় নাগাদ ইউরোপের বিজ্ঞানচর্চা সংক্রান্ত কোনও একটি রাশির পরিবর্তনসূচক একগুচ্ছ তথ্য জোগাড় করা যায় । যেমন, বিজ্ঞানীর সংখ্যা, বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রিকার সংখ্যা, আবিষ্কারের সংখ্যা, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় খরচের পরিমাণ, এই ধরনের কিছু একটা । এ রকম তথ্য আছে কি ? সুখের বিষয়, তা আছে, এবং বেশ হইচই করেই আছে । প্রখ্যাত বিজ্ঞান-ঐতিহাসিক ডেরেক জে ডি সোলা প্রাইস তাঁর 'লিটল্ সায়েন্স, বিগ সায়েন্স' (১৯৬২) নামক ক্লাসিক গবেষণাগ্রন্থে এই বিষয়ে বিস্তর তথ্য খুব গুছিয়ে হাজির করেছেন । সত্যি বলতে কী, এই গবেষণাটির মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানের বিকাশকে মাপার একটি নতুন বিজ্ঞান সৃষ্টি করেন, যাকে আজ বলা হয় 'সায়েন্টোমেট্রি' । সেই বইয়েরই একটি লেখচিত্র (চিত্র-৯) এখানে হাজির করলাম, এতে দেখা যাবে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যকাল থেকে বিশ শতকের শেষভাগ অবধি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রিকার সংখ্যাবৃদ্ধির জ্যামিতিক নকশা । সাধারণ গবেষণাপত্রিকা ও সারসংক্ষেপ গবেষণা পত্রিকা --- দুটিরই প্রকাশ সংক্রান্ত তথ্য এখানে পাওয়া যাবে । এমনিতে এই ধরনের বৃদ্ধিগুলোর ছাঁচটা ব্যাঙ্ক-আমানত বা জনসংখ্যা বৃদ্ধির ছাঁচের অনুরূপ, যাকে গণিতের ভাষায় বলে 'এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ' বা সুচকীয় বৃদ্ধি । লক্ষ করুন, এ লেখচিত্রে উল্লম্ব অক্ষের রাশিটি সমান্তর প্রগতিতে বাড়ছে না, বাড়ছে গুণোত্তর প্রগতিতে । অর্থাৎ, দশ কুড়ি তিরিশ বা একশো দুশো তিনশো এভাবে নয় --- দশ একশো হাজার দশহাজার লক্ষ এইভাবে, মানে প্রতি ধাপে দশগুণ করে । এ রকম বৃদ্ধির লক্ষণটি হচ্ছে, রাশিটি একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর দ্বিগুণ হতে থাকে (ফিক্সড্ ডিপোজিট স্কিম-এর ক্ষেত্রে যা হয় আর কি) । আরও লক্ষ করুন, এবং এটাই সবচেয়ে জরুরি, লেখচিত্রটি কিন্তু সবসময়ই তীব্র বেগে ওপরে উঠছে, এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময়কালটি জুড়ে (১৭৫৭ - ১৯৪৭) তার মধ্যে আলাদা করে আর কোনও বিশেষ ঘটনা বা নকশা নজর করা যাচ্ছে না ।



    এ ব্যাপারে আমার যা বলবার ছিল, এতক্ষণে বোধহয় তা বলে উঠতে পেরেছি । তবু, একটা উপসংহার না টানলে কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে । এই যে এত সব ব্যাখ্যা, সংখ্যা আর ছবি ছাপাটি এতক্ষণ ধরে দিলুম, তাতে মোদ্দা কথা কি কি দাঁড়াল ? এক এক করে দেখা যাক । প্রথমত, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিচার হচ্ছে মূলত সত্য-মিথ্যার বিচার, সেখানে নৈতিক বা নান্দনিক বিচারের স্থান যদি বা থেকে থাকে, তো সে খুবই গৌণ । কাজেই, ‘গবেষণার অর্থের যোগান যেভাবে এসেছে তা অনুমোদন করিনা অতএব গবেষণার ফলাফলগুলোও মানব না’, এ রকম যুক্তি দেওয়া চলে না, গবেষণার ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতার বিচার সম্পূর্ণ আলাদা । দ্বিতীয়ত, ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক সত্যগুলো জানতে গেলে নির্মোহভাবে তথ্য-যুক্তি দিয়ে বিচার প্রয়োজন । জাত্যভিমান এবং নৈতিক হাহাকার ও অভিযোগ সেখানে যদি বা থাকে, তো তাকে সত্যের পটভূমিকায় খাড়া করা প্রয়োজন, সেগুলো দিয়ে সত্যকে প্রতিস্থাপিত করার দরকার নেই । তৃতীয়ত, তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, খ্রিস্টীয় প্রথম হাজার বছরে অর্থনীতিতে ভারত ছিল পৃথিবী সেরা (চিন তার পরেই), যদিও পরবর্তীকালে ভারত ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে, প্রথমে চিন ও পরে অন্যদের কাছে (আরও পরে চিনও) । মুসলমান বা ব্রিটিশ আমলে এই দীর্ঘমেয়াদি ঐতিহাসিক প্রবণতা চালু থেকেছে মাত্র, নতুন করে সৃষ্টি হয়নি, হয়ত অধঃপতন দ্রুততর হয়েছে । চতুর্থত, ব্রিটিশরা আসার আগে থেকেই ভারতীয় সমাজে যথেষ্ট অসাম্য ছিল । পঞ্চমত, ভারতে দখলদারি শুরু করার অনেক আগে থেকেই ইউরোপে অর্থনীতি ও বিজ্ঞানের বিকাশ শুরু হয়েছে, যার সুবাদে তারা ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে সারা পৃথিবীতে, ভারত হয়ে থেকেছে কুয়োর ব্যাঙ । ষষ্ঠত, ঔপনিবেশিক ভারত থেকে যে সম্পদ ব্রিটেনে গেছে তা ব্রিটেনের জাতীয় আয়ের তুলনায় খুবই সামান্য, যা কিনা তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একমাত্র কারণ হবার পক্ষে মোটেই যথেষ্ট নয় । এবং শেষত ও সপ্তমত, ইউরোপে সপ্তদশ শতক থেকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রচণ্ড বৃদ্ধির যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তার মতিগতিতে ভারতে ঔপনিবেশিক দখলদারির সময়টুকুতে বা তার অব্যবহিত পরেও তেমন কোনও চোখে পড়ার মত তফাত দেখা যায় না, ফলে দুটো ঘটনার কার্যকারণ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নই সেভাবে ওঠেনা ।

    এখন, এই সাতটি মোদ্দা কথা থেকে মোদ্দাতর কোনও কথা বেরিয়ে আসে কি ? হ্যাঁ, তা আসে বোধহয় । কথাটা এই যে, ঔপনিবেশিক দখলদারিটা ইউরোপে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিকাশের একমাত্র কারণ হবার কথা ছিল না (মোদ্দা কথা নং ১-৬), এবং তা হয়ওনি (মোদ্দা কথা নং ৭)। বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও শিল্পবিপ্লবের মত সারা পৃথিবীর ইতিহাসের মোড় ঘোরানো প্রকাণ্ড ঘটনার পেছনে ভারতে ব্রিটিশের দখলদারির মত একটিমাত্র সংকীর্ণ কার্যকারণ খাড়া করা কিঞ্চিৎ ইতিহাসবোধরহিত । ত্রৈলোক্যনাথের গল্পে যেমন অন্ধকার জমে জমে ভূত হত, ঠিক তেমনি করে ঔপনিবেশিক শোষণ জমে জমে বোধহয় ইউরোপের বিজ্ঞানটা হয়নি । এমন কি শুধু ভারতকে না ধরে যদি আমেরিকা আফ্রিকা সহ সমস্ত উপনিবেশকেই হিসেবে নেওয়া যায় (সেক্ষেত্রে তুলনাটাও আর শুধু ব্রিটেনের সাথে হবে না, গোটা ইউরোপের সাথে হবে), তাহলেও আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আবির্ভাবকে স্রেফ ঔপনিবেশিক সম্পদ-পাচার দিয়ে বুঝে ফেলা যাবে না । বিষয়টা শুধু আধুনিক কালেরও নয়, এ আবির্ভাবের শিকড় রয়েছে ইউরোপীয় ইতিহাসের অনেক গভীরে ।

    কেউ বলতেই পারেন, কেন, প্রাচীনকালে বিজ্ঞান-সিদ্ধি তো শুধু গ্রিস-এরই ছিল না, ভারতেরও ছিল । আমি এ নিয়ে অবশ্যই খানিক তর্ক করতে পারি । বলতে পারি, এখানে থ্যালেসের মত করে বস্তুবাদী দর্শন আর বিজ্ঞান এক জায়গায় মেলেনি, অ্যারিস্টটলের মত করে তৎকালীন প্রাপ্তব্য সমস্ত জ্ঞান এক জায়গায় করে জবরদস্ত দার্শনিক কাঠামো-নির্মাণ হয়নি, আর্কিমিডিসের মত করে পদার্থবিদ্যা-গণিত-যন্ত্রবিদ্যার আঁটোসাঁটো তাত্ত্বিক সঙ্গমস্থল রচিত হয়নি, ইউক্লিডের মত করে প্রমাণতন্ত্রও জন্ম নেয়নি । আরও বলতে পারি, ভারতীয় পণ্ডিতরা ধাঁধার মত করে বিজ্ঞান বা গণিতের নিয়মগুলো ছড়ার আকারে লিখে রাখতে ভালবাসতেন, যাতে শিষ্যরা সেগুলো সহজে মুখস্থ করতে পারে, কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো কোথা থেকে কীভাবে এল সেই প্রমাণগুলো হাজির করতে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না ।

    কিন্তু, ধরুন, এ সব তর্কে গেলামই না । মেনে নিলাম, প্রাচীনকালে ভারত অন্যদের সাথে সমান সমান বা সামান্য এগিয়েই ছিল । ধরুন, এ নিয়েও কূট তর্ক করলাম না যে, ভারত আদৌ শূন্যের আবিষ্কারের কৃতিত্ব একা দাবি করতে পারে কিনা, চরক শুশ্রুতের চিকিৎসায় আদৌ রোগ সারত কিনা, বা, চতুর্দশ শতকের কেরালায় নীলকান্ত পণ্ডিত ইনইফাইনাইট সিরিজ বা অসীম শ্রেণির মত কিছু একটা পেলেই তাকে ‘ক্যালকুলাস আবিষ্কার’ বলে দাবি করা যায় কিনা । কিন্তু আমাকে বলুন তো, আধুনিক বিজ্ঞানের যা অগ্রদূত, সেই বৈজ্ঞানিক দর্শন কোথায় ? বেকন-দেকার্তের কথা ছেড়েই দিলাম, একাদশ-দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের এক্সপেরিমেন্টাল ফিলোজফিই বা কোথায় ? ইউরোপে মধ্যযুগের শেষের দিকে রজার বেকন, রবার্ট গ্রোসেটেস্টে, অ্যালবার্টাস ম্যাগনাস, উইলিয়াম অফ ওকাম, এঁরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নির্মাণের যে প্রাথমিক হদিশগুলো দিয়েছিলেন, সে সব কোথায় এখানে ? প্রাচীন পৃথিবীর জ্ঞান আরব দেশ সংগ্রহ করল, আরবী-পার্শী ভাষায় তাকে অনুবাদ করে বাঁচিয়ে রাখল, বিকশিত করল, সেগুলো ল্যাটিন আর সিরীয় ভাষায় অনুবাদ হয়ে ইউরোপে গিয়ে সেখানে রেনেশাঁ ঘটিয়ে দিল, আর ভারতের পণ্ডিতরা কি তখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন ? কষ্ট করে আরব, ইউরোপ আর চিনদেশে গিয়ে সেখানকার কাজগুলো সংস্কৃতে অনুবাদ করে আনলে মুসলমান আর সায়েব শাসকরা ফাঁসি দিয়ে দিত বুঝি ?

    শুধু বিজ্ঞানের কথাও তো নয় । ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞানই বা কোথায় এখানে ? গ্রিক দার্শনিক জেনোফেনস যে খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকে সারা পৃথিবী ঘুরলেন, গ্রিক দেবতাদের সাথে আফ্রিকার দেবতাদের তুলনা করে দেখলেন, এবং বুঝলেন যে প্রত্যেক জায়গার মানুষ ঠিক নিজের মত করে তার দেবতাদের বানায় --- ইউরোপের দেবতা হয় ফরসা ও চোখালো নাকওয়ালা, আফ্রিকার দেবতা হয় কালো আর পুরু ঠোঁটওয়ালা --- সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের এই বোধ এখানে কবে জন্মালো ? কোথায় এখানে হেরোডোটাস আর থুকিদিদিস-এর মত ইতিহাসবিদ ? কেন বলুন তো, আমাদের দেশে কেউ কোনও ঘটনা লিখে রাখবেন না, নিজেদের ইতিহাস আমাদের অতিকষ্টে আন্দাজ করতে হবে পৌরাণিক দৈবী গালগল্প থেকে, বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ পড়ে আর রাজারাজড়াদের সম্পর্কে পেটোয়া লোকেদের লেখা খোসামোদী কাব্য পড়ে ?

    নাঃ, একজন অবিশেষজ্ঞ যুক্তিবাদী অ্যাক্টিভিস্ট-এর পক্ষে বড্ড বেশি কথা বলে ফেলছি বোধহয়, আর একদমই নয় । আমার বটমলাইনটা এই রকম থাক যে, মানুষের সভ্যতার উত্থান ও পতন ইতিহাসের নানা নৈর্ব্যক্তিক শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয়, তার কিছুটা আমরা বুঝি, কিছুটা আজও বুঝি না, তবে রোজই হয়ত আগের দিনের থেকে আরেকটু বেশি বুঝি । তার পেছনের কার্যকারণ কিছুটা ধারাবাহিক, কিছুটা আকস্মিক, কিছুটা আবিশ্ব, কিছুটা স্থানিক । কখনও মিশর-চিন-ব্যাবিলন-ভারত, কখনও গ্রিস, কখনও বাগদাদ, কখনও তুর্কি, কখনও ইটালি, কখনও ব্রিটেন, কখনও আমেরিকা এই সব উত্থান আর পতনের ধাত্রী হয়েছে । সব সময় সব সভ্যতাই সমসাময়িক ও আগের সভ্যতার থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছে (দক্ষিণ আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতাগুলোর কথা বাদ, তারা বেশ কিছুদূর গিয়েও বাকি পৃথিবীর সাথে আদানপ্রদানের অভাবে স্থাণু হয়ে গিয়েছিল) । এবং, সব সময়ে সব সভ্যতাই তার আগেরটির থেকে বেশি ‘গ্লোব্যাল’, বা বৈশ্বিক ।

    আমার কেমন যেন মনে হয়, ব্যাপারটা অনেকটা একটা হাঁড়িতে জল ফোটবার মত, এখানে ওখানে ফুটতে ফুটতে এক সময় গোটা হাঁড়ির জল একসাথে ফুটে ওঠা । জল ফুটে ওঠার প্রথম লক্ষণ যদি হাঁড়ির দক্ষিণ দিকে দেখা যায়, তার জন্য আমরা যেমন ‘ফুটে ওঠা’ ব্যাপারটাকেই ‘দক্ষিণী’ ঘটনা বলে আখ্যা দিতে পারিনা, ঠিক তেমনি আধুনিক বিজ্ঞানের বৈশ্বিক রূপটি প্রথম পশ্চিমে দেখা গেছে বলেই তাকে ‘পশ্চিমী’ আখ্যা দেওয়া যায় না --- বিজ্ঞান সব সময়ই ‘ওয়ার্ল্ড ফেনোমেনন’, বৈশ্বিক ঘটনা । প্রথমদিকে এখানে ওখানে বিচ্ছিন্নভাবে বুদ্বুদ দেখা দিতে পারে, এক বুদবুদকে আত্মসাৎ করে আরেকটি বড় বুদ্বুদ জন্ম নিতে পারে, কিন্তু শেষপর্যন্ত ‘ফুটে ওঠা’ ব্যাপারটা বোঝার জন্য এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল তাপের প্রবাহ ও জলের ধর্মের সাথে তার মোদ্দা সম্পর্কটা ।

    এটা ঠিকভাবে বুঝতে গেলে ইতিহাসকেও এক পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান হয়ে উঠতে হবে । হয়ত ভবিষ্যতের সমাজবিজ্ঞানীরা সেটা পারবেন, তাঁরা পরিসংখ্যানবিদ্যার উন্নত হাতিয়ার দিয়ে বিপুল তথ্য বিশ্লেষণ করে জটিল ঐতিহাসিক কার্যকারণের একেকটি স্বতন্ত্র উপাদানের গুরুত্ব আলাদাভাবে নির্ণয় করতে পারবেন, স্পষ্টভাবে তফাত করতে পারবেন ধারাবাহিকতা ও আকস্মিকতার মধ্যে, গড়তে পারবেন মানুষের ইতিহাসের দীর্ঘমেয়াদি গাণিতিক মডেল । কিন্তু, সে তো অনেক দূর ভবিষ্যতের কথা । যতদিন না তা পারা যাচ্ছে, ততদিন আমরা যেন অন্তত তথ্যযুক্তির প্রতি নিষ্ঠাবান থাকি, যেন চিরায়ত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে না ভুলি, যেন ইতিমধ্যে যেটুকু ভালভাবে জানতে পেরেছি তার সারাংশটুকু না হারিয়ে ফেলি । ঔপনিবেশিক অন্যায়কে অভিযুক্ত করতে হবে এ যদি বিজ্ঞানের ইতিহাসচর্চায় এক নৈতিক তাড়না হয়ে থাকে, তো তার বিপ্রতীপে একটি নৈতিক অবস্থান আছে আমারও । সে নৈতিকতা হল তথ্যযুক্তিজাত বস্তুনিষ্ঠ সত্যের প্রতি অনুগত থাকার নৈতিকতা, বৈশ্বিক মানুষের মোদ্দা ইতিহাসকে সংকীর্ণ ‘আমার ইতিহাস’-এ পর্যবসিত না করার নৈতিকতা, ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিকতাকে জাতীয়তাবাদী অভিমানের অনুগত হতে না দেবার নৈতিকতা । মানুষের ইতিহাস-চর্চার দৌড়ে অন্য সব কিছুকে পেছনে ফেলে এই নৈতিকতাই শেষপর্যন্ত সঙ্গে থাকবে, এই আমার বিশ্বাস ।

    [ অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশ ও ইতিহাসবিদ সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় তাঁদের প্রবল ব্যস্ততা সত্ত্বেও এ লেখাটির প্রথম খসড়া পড়ে তাঁদের মূল্যবান মতামত দিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ ও কৃতজ্ঞ করেছেন । তবে, সময়াভাবে তাঁদের পরামর্শগুলো সবটা কার্যকরী করা যায় নি (কিছুটা গেছে অবশ্য)। পরে লেখাটির আরও উন্নতিসাধনের ইচ্ছে আছে, ইতিমধ্যে গঠনমূলক সমালোচনা/মতামত/পরামর্শ এলে সমৃদ্ধ হব । ]

    মূলত যে সব বই, প্রবন্ধ ও আন্তর্জাল সূত্র থেকে সাহায্য পেয়েছি

    (1) ‘প্রেক্ষা’ পত্রিকা, জুন ২০১৬
    (2) Science, Hegemony and Violence : A Requiem for Modernity, by Ashis Nandy (Ed.), Oxford University Press, 1988
    (3) The Historical Roots of Our Ecologic Crisis, by Lynn White, Jr., Science, New Series, Vol - 155, No. 3767 (March 10, 1967), pp. 1203-1207
    (4) The Revenge of Athena : Science, Exploitation & The Third World, by Ziauddin Sardar (Ed.), Mansell Publishing Limited, London and New York, 1988
    (5) Why Did Scientific Renaissance Take Place in Europe and Not in India, by Arun Kumar Biswas, Indian Journal of History of Science, 45.2 (2010), 241-285
    (6) Empire : How Colonial India Made Modern Britain, by Aditya Mukherjee, Economic & Political Weekly, December 11, 2010, Vol. XLV, No. 50
    (7) ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রসঙ্গে : মার্ক্সীয় চেতনার আলোকে, ইরফান হাবিব, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৯৯ [লেখকের ‘Essays in Indian History : Towards a Marxist Perception’ বইটির কাবেরী বসু-কৃত বঙ্গানুবাদ ]
    (8) Contours of the World Economy, 1-2030 CE : essays in macro-economic history, by Angus Maddison, OUP, 2007
    (9) Little Science, Big Science, by Derek J. de Solla Price, Columbia University Press, 1962
    (10) ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতি ১৮৫০-১৯৪৭, সব্যসাচী ভট্টাচার্য, আনন্দ পাবলিশার্স, বাংলা সন ১৩৯৬
    (11) Foreign capital flows in the century of Britain’s industrial revolution : new estimates, controlled conjectures, by Ellis S. Brezis, Economic History Review, XLVIII, I(1995), pp. 46-67
    (12) আন্তর্জাল মুক্ত বিশ্বকোষ ‘Wikipedia’-র বিভিন্ন প্রবন্ধ

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৫ অক্টোবর ২০২০ | ৭৭৭৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ayaon Ghosh | ০৫ অক্টোবর ২০২০ ২০:১০98085
  • নন্দবাবুকে ট্যাগ করা যায়? 

  • সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | ০৫ অক্টোবর ২০২০ ২২:২৯98088
  • পড়লাম। যত্ন নিয়ে পরিশ্রম করে লেখা। 


    এবার সমালোচনা। লেখক লিখেছেনঃ "ওদিকে আমেরিকাতে ছিল চিনি আর ক্রীতদাসের ব্যবসা । এই সম্পদ যে ব্রিটেনে গিয়ে সেখানকার সমৃদ্ধি বাড়িয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই ।"


    ব্যাপারটা আদপেই এমন না। লেখক যে বিরাট ব্যবসাটা মিস করে গেছেন, তা হল আমেরিকার তুলো চাষ। এইটা শুধু  একটা পণ্যকে ফসকে যাওয়া নয়।  তুলো, ক্রীতদাস এবং শিল্পবিপ্লব হাত ধরাধরি করে আছে। আঙ্কল টমস কেবিন মনে করুন। ওটা একটা আইকনিক উপাখ্যান, তুলো থেকে ক্রীতদাসকে আলাদা করার কোনো জায়গা নেই। 


    এত তুলো-তুলো করছি কেন? কারণ হল, তুলোর বিরাট ভূমিকা ছিল শিল্পবিপ্লবে। অটোমেশন শুরু হয় তুলো শিল্পে। জেনি র হাত ধরে। যেটা শিল্পবিপ্লবের পুরোধা। এই তুলোর একটা বিরাট অংশ আসত আমেরিকা থেকে। অতএব তুলো ফসকে  যাওয়া মানে শিল্পবিপ্লবই ফসকে যাওয়া।  


    ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের তিনটি চিহ্ন সর্বজনগ্রাহ্য। ১। স্টিম ইঞ্জিন। ২। বস্ত্রশিল্পের বিস্তার। এবং ৩। নিউটন।  হঠাৎ কেন সব্বাইকে ছেড়ে ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব হল এ নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে, লেখক যেমন বলেছেন। কিন্তু এই তিনটে চিহ্ন নিয়ে কোনো তর্ক নেই। এবং এরা হাত-ধরাধরি করে ছিল।


    প্রথমে স্টিম ইঞ্জিনকে পাকড়ানো যাক। জেমস ওয়াট স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কারক বলে প্রচারিত। কিন্তু সত্যিই কি তিনি আবিষ্কারক? না। কারণ স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কার তার আগেই হয়েছে,  ইউরোপে তো বটেই, এমনকি শোনা যায়, চিনেরাও বাষ্পশক্তি ব্যবহার করত। তাহলে ওয়াট করলেন কী? ওয়াট স্টিম ইঞ্জিনের আধুনিক ডিজাইন করেন। এবং রেলের উপর দিয়ে চলার ব্যবস্থা করেন। স্টিম ইঞ্জিন যে গাড়ির মতো রাস্তা দিয়ে চলেনা, তার কারণ ওয়াট। এবার প্রশ্ন হল, হঠাৎ ওয়াট এটা কীভাবে এবং কেন চালু করলেন বা করতে পারলেন? তার কারণ, ওটা চালু করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। গণপরিবহনের জন্য নয়। কয়লাখনি থেকে কয়লা তোলার জন্য। শিল্পবিপ্লবের সময় কয়লার প্রয়োজন প্রবল বেড়ে যায়। চাহিদাও। কয়লাখনি মালিকরা দ্রুত কয়লা তোলার একট ব্যবস্থা খুঁজছিলেন। স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার করে সেই উপায়টা তাঁদের দেন ওয়াট। রেল পেতে কয়লা চালিত ইঞ্জিনে কয়লা তুলে এনে সরবরাহ করা শুরু হয়। এইটাই হল আবিষ্কার। 


    এবার প্রশ্ন হল, হঠাৎ কয়লার চাহিদা বাড়ল কেন? ব্রিটেনের স্থানীয় কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। তা দিয়েই চাহিদার শুরু । তার  পরে, যে ব্যাপারটা জরুরি, যে, শিল্পে কয়লার ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল। অটোমেশন যার নাম। জেনি দিয়ে যার শুরু। এবং স্টিম ইঞ্জিনসহ পাওয়ারলুম যার বিবর্তিত রূপ। সেখানে কয়লার ব্যবহার বাড়তে থাকে এবং বাড়তেই থাকে। জ্যামিতিক হারে। প্রয়োজন হতে থাকে আরও আরও পরিবহনের। বাষ্পচালিত জাহাজও এসে গিয়েছিল আগেই। তার একচেটিয়া শুরু হয়। ইত্যাদি প্রভৃতি। 


    পরের প্রশ্ন হল হঠাৎ বস্ত্রশিল্পে অটোমেশন শুরু হল কেন? যেজন্য এত কয়লার দরকার(অবশ্যই বস্ত্রশিল্পই কয়লার একমাত্র খরিদ্দার না, কিন্তু খুবই বড় খরিদ্দার) ? কারণ, বস্ত্রশিল্পের রমরমা বেড়ে গিয়েছিল। কেন বাড়ল? দুদিক থেকে। আমেরিকার তুলোর উৎপাদনের চাপ। এবং বস্ত্রের চাহিদার চাপ। আমেরিকার তুলো এই কারণে শিল্পবিপ্লবে জরুরি। এবং এর পরিবহন, জাহাজ, রেল, সব মিলিয়ে এক বিপুল বিস্ফোরণ, যাকে এক কথায় আমরা একাধিক পর্যায়ের শিল্প বিপ্লব বলি। 


    লেখক আমেরিকা এবং পরবর্তীকালের অস্ট্রেলিয়াকে বাদ দেওয়ায় এই চিত্রটা ফস্কে ফেলেছেন। আমেরিকাকে বাদ দেননি, কিন্তু গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছেন। সেজন্যই এই ফস্কে যাওয়া। এইটা ফস্কে না গেলেই দেখা যেত, যে, এই পুরো প্রক্রিয়ায় বাংলার বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হয়। মন্বন্তরে এক তৃতীয়াংশ লোক মরে। এই পুরো প্রক্রিয়াটা অমানবিকও ছিল। যে জাহাজগুলো আমেরিকা থেকে তুলো আনত, তারা ফাঁকা আমেরিকা গেলে লাভ কমে যেত। তাই তারা ভর্তি করে ক্রীতদাস অথবা কয়েদি নিয়ে যেত।  ফলত শিল্পবিপ্লব, তার অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া হিসেবেই বঙ্গের বস্ত্রশিল্প ধ্বংস থেকে শুরু করে ক্রীতদাস ব্যবসা, এইগুলো চালু করে। লুঠ কতটা কী  হয়েছিল, সে তো অ্যাকাউন্টিং দেখলেই বোঝা যাবে, কিন্তু বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোককে মেরে ফেলাটা তো এমনি হয়নি। 

  • Debasis Bhattacharya | ০৫ অক্টোবর ২০২০ ২৩:২৮98090
  • সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়, 


    আপনার বিস্তারিত প্রতিক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ ,  এ ধরনের প্রতিক্রিয়া সব সময়েই লেখকের প্রচেষ্টাকে সম্মানিত করে । 


    কিন্তু, আপনি আমার মোদ্দা বক্তব্যেরই বিরোধিতা করতে চাইলেন, নাকি তাতে কিছু ডিটেল সরবরাহ করে তার ফাঁকফোকর বোঝাতে চাইলেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলাম না । যদি দ্বিতীয়টি হয়ে থাকে, আবারও ধন্যবাদ । যদি প্রথমটি হয়ে থাকে, তাহলে আর একটু ভাল করে আপনার কথা বুঝে নিতে চাইব । 


    আমার বক্তব্য ছিল, 'কলোনিয়াল ড্রেন' নিশ্চয়ই ইউরোপের সম্পদ বাড়িয়েছে, কিন্তু শিল্পবিপ্লবের জন্য তা অপরিহার্য ছিল না । অর্থাৎ, ওটা না ঘটলেও ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ঘটতই --- ঠিক ওভাবে বা অত দ্রুত ঘটত কিনা সে নিয়ে তর্ক চলতেই পারে । এখন, আপনি যে সব তথ্য দিলেন, তা দিয়ে এই মোদ্দা বক্তব্য খন্ডিত হল কি ? হলে, ঠিক কীভাবে ?

  • Debasis Bhattacharya | ০৫ অক্টোবর ২০২০ ২৩:৫৭98091
  • আরও দুটি ছোট্ট নিবেদন । 


    এক, তুলো বা 'টেক্সটাইল' অবশ্যই একটা বড় ব্যাপার, তার উল্লেখ বাদ না গেলেই ভাল হত, ঠিক বটে । কিন্তু উল্লেখ বাদ গেলেও, এখানে যে সমস্ত লেখ সারণি হিসেবনিকেশ ইত্যাদি পেশ করা হয়েছে, তার মধ্যে টেক্সটাইল অবশ্যই ধরা আছে । ফলত, আমার মোদ্দা যুক্তি-কাঠামো ও সিদ্ধান্তে এই অনুল্লেখের খুব বেশি প্রভাব থাকার কথা না ।


    দুই, এখানে আমার আরও একটি প্রতিপাদ্য হল, বিজ্ঞানের সত্যমূল্য তার ঔপনিবেশিক প্রেক্ষিত দিয়ে আদৌ নির্ধারিত হয়না । আপনার বক্তব্যের পরে তারই বা কী দশা দাঁড়াল বলে আপনার মনে হয়, সেটাও জানতে পারলে ভাল লাগবে ।

  • সত্যসন্ধানী ভাবমূর্তি | 100.25.***.*** | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ০২:৪৯98094
  • এ তো অতি উত্তম হইল। তর্ক-বিতর্কের চমত্কার পরিমন্ডল! 


    অপ্রাস্ঙ্গিক-প্রাক্তন হেড ডিপ রতন খাশনবিশের নাম দেখে ভাল লাগল। 

  • সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ০৭:৩১98096
  • এটা একটু সময় নিয়ে লিখতে হবে। কপাল এমনই, যে এখনই ৫০ টা জিনিস নিয়ে অস্থিরমস্তিষ্ক হয়ে আছি। একটু সময় লাগবে।

  • Debasis Bhattacharya | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ০৮:৪০98100
  • সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়,


    সময় লাগুক, বলুন প্লিজ । বিশেষভাবে আগ্রহী । 

  • Amit | 121.2.***.*** | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ০৮:৫৭98102
  • মূল লেখাটা ভালো লাগলো পড়ে। অনেকটাই একমত।  যেটা নিজের মনে হয়েছে , ওয়েস্টার্ন কালচারে প্রশ্ন করাকে উৎসাহ দেওয়া হয় বেশি , অন্ধভাবে  ফলো করাকে নয়। সেটা হয়তো জেনেরালি বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ার একটা কারণ। 

  • Ranjan Roy | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ১২:৪৯98123
  • খাসা লেখা।
    কলোনিয়াল লুন্ঠন এবং ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লবের কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে বহুদিন ধরে লালিত সরল একমাত্রিক চিন্তায় জোর আঘাত লাগল। তবু স্বাগত।


     সৈকত বন্দ্যোর তুলো পয়েন্ট খুব মূল্যবান, কিন্তু তাতে লেখকের বক্তব্যের তাত্ত্বিক কাঠামোটি ধ্বসে যায়নি , বরং সমৃদ্ধ হয়েছে বলে আমার মত সাধারণ পাঠকের মনে হল।

  • রমিত | 202.142.***.*** | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ১৩:১৯98126
  • ভারতে আসলে চিরকালই গুরুবাদ টা বেশি, আর পশ্চিমে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র। এই কারনেই ভারতে মুখস্থ বিদ্যা বা পূর্বসূরীকে অন্ধ ভাবে অনুকরণ করাকে উৎসাহ দেওয়া হয়। এই কারনেই সমাজে স্থবিরতা দেখা যায় ও কোনো বড় সামাজিক বা ধর্মীয় বিপলব স্থায়ী হয় না, আবার বৃহৎ সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। 

  • Somnath Roy | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ১৫:৩৬98128
  • একজায়গায় এই আলোচনাটা পেলাম ভালো। কিছু অভিমত লেখার ইচ্ছে আছে। কিন্তু, একটা জিনিস অনেকদিন খুঁজছিলাম। মুঘল আমলে ভারতে লাইফ এক্সপেক্টেন্সি কেমন ছিল? সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে লাইফ এক্সপেক্টেন্সি নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এরকম কোনও ডেটা আছে কি?


    আর, ১৭৭০-এ ভারতে লাইফ এক্সপেক্টেন্সির যে সংখ্যাটা দেওয়া আছে, তার সূত্র কি মূল লেখায় আছে? ১৭৭০ মানে মন্বন্তরের বছর, সেই বছরের আগে পরে এই হিসেবটা পাল্টানোর কথা না?

  • Debasis Bhattacharya | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ১৬:২৩98129
  • না, ১৭৭০ সালের জীবনকালের যে হিসেবগুলো গ্রাফে আছে সেগুলো নির্দিষ্ট কোনও দেশের নয়, পৃথিবীর এক-একটি বড় বড় অংশের (মূলত মহাদেশ), এবং সেইহেতু এশিয়ারও । ভারতের ওই সময়কার হিসেব আলাদা করে পাওয়া যায় কিনা, ঠিক জানিনা । খুঁজে দেখব ।

  • Somnath Roy | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৪০98130
  • ১৭৭০ এমন কি ১৯০০ সালেও একটা গোটা মহাদেশের নিরিখে লাইফ এক্সপেক্টেন্সি বের করা কি সম্ভবপর ছিল?  ভেবে দেখার।

  • Debasis Bhattacharya | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৪৯98131
  • না, তখন বার করা সম্ভব ছিল না মোটেই, তখন তো 'লাইফ এক্সপেক্টেন্সি' নামক ধারণাটাই আসেনি । এখন সে চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু এখনকার মত করে তথ্য তো আর পাওয়া যাবে না, তবে পুরোনো নানা তথ্যকে কাজে লাগিয়ে পরোক্ষভাবে নির্ণয় করার চেষ্টা করা যায় । জনসংখ্যা থেকে শুরু করে জাতীয় আয় পর্যন্ত অনেক কিছুই এভাবে করা হয় (এখানে সে সবও ব্যবহৃত হয়েছে) । আজকের দিনের মত নির্ভরযোগ্য হবে না নিশ্চয়ই, আর, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন পদ্ধতি প্রেফার করবেন, ফলে দ্বিমত সব সময়ই থাকবে । তবু, যেটুকু জানা যায় আর কি । মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে থেকে তো আর লাভ নেই । 

  • সুব্রত রায় | 2401:4900:1045:57ab:2484:9a22:ebd8:***:*** | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ১৯:৫৯98135
  • অসাধারণ পরিশ্রমসাধ্য লেখা। আগাগোড়া যৌক্তিক বিশ্লেষণ। একসঙ্গে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ লেখ ও সারণি যোগ করা। শেষের ঝাঁঝটাও খুুুব জরুরী ছিল। একটাই অনুযোগ। এত বড়ো লেখাটাকে এক-ঢালা না-করে কয়েকটা সাবহেডিং-এ ভেঙে দিলে বেশ হত।

  • Somnath Roy | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ২০:০৯98136
  • আসলে লাইফ এক্সপেক্টেন্সিকে বহু জায়গায় বিজ্ঞানের জয়যাত্রার প্রমাণ হিসেবে দেখাতে দেখেছি। কিন্তু, ইউরোপের দু-একটা শহরের বাইরে আদৌ কোথাও লাইফ এক্সপেক্টেন্সির ডেটা ছিল কী না জানা যায় না। কিন্তু, মধ্যযুগে অবশ্যই অনেক প্যারামিটার ছিল, যেগুলোর রেকর্ড রাখা হত- যেমন, রাজস্ব আদায়, বহির্বাণিজ্য, সৈন্যবাহিনীর খরচ, খাল-পথ নির্মাণ, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি। 

  • Ranjan Roy | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ২১:২২98141
  • "এই কারনেই সমাজে স্থবিরতা দেখা যায় ও কোনো বড় সামাজিক বা ধর্মীয় বিপলব স্থায়ী হয় না, আবার বৃহৎ সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে যায়"


    -- রমিতের এই অবজার্ভেশন ভাল লাগল। এটা নিয়ে গুছিয়ে একটা প্রবন্ধ নামাবেন? খুব ইন্টারেস্টিং হবে।

  • অনিন্দিতা | 103.87.***.*** | ০৬ অক্টোবর ২০২০ ২১:৫৭98144
  • পরম আগ্রহে লেখাটি পড়লাম। গুরুর পাতায় এতো গভীর গবেষণাভিত্তিক লেখা চোখে পড়ে কম। 


    পাঠকদের মন্তব্যে নানারকম আলোচনা উঠে এসেছে। এই প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি কথা মনে হল। 


    ১) আমেরিকার গৃহযুদ্ধের কারণে ল্যাঙ্কাশায়ারে তুলো আমদানী বিঘ্নিত হওয়াতেই ভারতীয় তুলো রপ্তানী বেড়েছিল। অবশ্য এটা ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের ধরনের মধ্যেই পড়ে।


    ২) মানুষের কৃষিকার্য শুরুর সময় থেকেই প্রকৃতির হননপর্ব ও পরিবেশের ক্ষতিসাধন শুরু। শিল্পবিপ্লব সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। বর্তমানের পরিবেশ সংকটের ঐতিহাসিক মূল সেখানে প্রোথিত। আলোচনাতে না আসলেও তথ্যসূত্রে এই বিষয়ক বইয়ের উল্লেখ আছে। 


    লেখককে আবারও ধন্যবাদ। 

  • কৃশানু নস্কর | 2409:4060:2180:6be8::cdf:***:*** | ০৭ অক্টোবর ২০২০ ১৭:৪৬98165
  • অসাধারণ সুন্দর লেখা। ইংল্যাণ্ডের শিল্প বিপ্লবে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বিষয়ে আমার নিজের ও ঐ ধারণাই ছিল যে উপনিবেশ থেকে শোষিত সম্পদই ঐ শিল্প বিপ্লবের কারণ এবং উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ ছাড়াই একথা অনেককে বলেওছি even তর্ক করেছি। আজ আপনার এই লেখায় সে ধারণা বেশ বড়রকম ধাক্কা খেলো। আমাকে আবার একবার সেই সব বইপত্র এবং আপনার দেওয়া তথ্য গুলো পড়ে বিচার করে, ভেবে দেখতে হবে। তবুও এই চিন্তার খোরাক দেওয়া এবং নতুন করে ভাবতে বাধ্য করার জন্য ধন্যবাদ।


    যদি আবার পড়াশোনা করে কিছু  বলার মতো পাই তাহলে আবার মন্তব্য লিখবো। ততদিন অবধি, শ্রদ্ধা নেবেন।

  • Debasis Bhattacharya | ১১ অক্টোবর ২০২০ ১৪:৪৩98276
  • সত্যসন্ধানী ভাবমূর্তি, Amit, Ranjan Royরমিত, সুব্রত রায়, অনিন্দিতা এবং  কৃশানু নস্কর  ---


    আপনারা যাঁরা আমার লেখা থেকে চিন্তার খোরাক পেয়েছেন, তাঁদের সকলকেই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই । আপনাদের সাড়া পেয়ে ভরসা পেলাম । প্রশ্ন, পরামর্শ ইত্যাদি থাকলে অবশ্যই বলবেন ।


    Somnath Roy,


    শুধু মধ্যযুগ কেন, প্রাচীন যুগেও মানুষের জীবনকাল কেমন ছিল সে সব আন্দাজ করার উপযোগী নানা তথ্য ও পদ্ধতির অস্তিত্ব আছে,  এবং তা দিয়ে কিছু বাস্তবসম্মত আন্দাজ করা চলে এবং করা হয়েও থাকে । শুধু ইউরোপের নয়, সারা পৃথিবীরই । এখানে দেওয়া লেখচিত্রটি তারই এক দৃষ্টান্তমাত্র । এ যুগে সবারই আঙুলের ডগায় তথ্য কিলবিল করছে, কাজেই সূত্রনির্দেশ বাহুল্য হবে ।

  • Debasis Bhattacharya | ১১ অক্টোবর ২০২০ ১৯:০৭98283
  • সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়,


    আপনার ব্যাখ্যার জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করলাম, এবং আরও অপেক্ষা করতে অরাজি নই । তবে, ইতিমধ্যে আপনার দীর্ঘ মন্তব্যের ভিত্তিতে কয়েকটা কথা বলি । কথা তো কিছু ছিলই, কিন্তু আপনি আমার মোদ্দা বক্তব্য নিয়ে ঠিক কী অবস্থান নিতে চান সেটা জানতে বেশি আগ্রহী ছিলাম বলে খুঁটিনাটি নিয়ে বেশি কথা প্রথমেই বলতে চাইনি । এখন মনে হচ্ছে, সেগুলো বলে রাখলেও খারাপ হবে না । আমার ধারণা, এতে এই চর্চাটির পক্ষে নির্দিষ্ট অবয়ব পেতে হয়ত খানিক সুবিধেই হবে ।


    (ক) একটু খেয়াল করে দেখবেন, আমি তুলোর প্রসঙ্গ আদৌ বাদ দিইনি । ওটা আছে, এবং আপনি যেখান থেকে আমার উদ্ধৃতিটা তুলেছেন ঠিক সেখানেই আছে, ছ-নং চিত্রের ঠিক নিচের অনুচ্ছেদে । এই দেখুন --- 


    "উপনিবেশ থেকে সম্পদ যে বিদেশে পাচার হত, সে তো বলাই বাহুল্য । নানা রকম ট্যাক্স আদায় করে, তুলো নীল শস্য ইত্যাদি কাঁচামাল জোর করে এখানে চাষ করিয়ে তারপর ওদেশে রপ্তানি করে, যন্ত্রে তৈরি বিলিতি বস্ত্র আমদানি করে এদেশে বেচে, এদেশের জোত জমি কারখানার মালিক হয়ে, উৎপাদন-ব্যবসা-বিপণন সংক্রান্ত নানা ব্যাপারে পরামর্শদাতা ও ব্যবস্থাপক হয়ে । এই রকম সব কায়দায় । ওদিকে আমেরিকাতে ছিল চিনি আর ক্রীতদাসের ব্যবসা । এই সম্পদ যে ব্রিটেনে গিয়ে সেখানকার সমৃদ্ধি বাড়িয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই ।" [প্রাসঙ্গিক শব্দগুলো বাঁকা অক্ষরে দিলাম] 


    এখান থেকে আপনি শুধু শেষের বাক্যদুটোকে উদ্ধৃত করেছেন । আর, ব্যবসা-বাণিজ্য-টাকা-পয়সা এইসবের হিসেবপত্তর যা দেওয়া আছে, সেখানে তুলোসহ সব হিসেবই ধরা আছে, কাজেই 'টেক্সটাইল ফ্যাক্টর' দিয়ে মোদ্দা সিদ্ধান্তের যে আদৌ কোনও নড়চড় হচ্ছেনা, সেটা ওপরের মন্তব্যে বলেছি । সে ব্যবসায় ক্রীতদাস লাগত কিনা, সেটা এখানে মোটেই প্রাসঙ্গিক না। 


    (খ) আপনি স্বয়ং ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের তিনটি চিহ্নকে সর্বজনগ্রাহ্য বলে মেনে নিয়েছেন --- ১) স্টিম ইঞ্জিন, ২) বস্ত্রশিল্পের বিস্তার, এবং ৩) নিউটন।  


    এখন লক্ষ্য করে দেখুন, উপনিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু দ্বিতীয়টিরই, প্রথম এবং তৃতীয়টি ইউরোপের একান্ত নিজস্ব (না, শুধু ব্রিটেনের নয় মোটেই) । এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রেও, বস্ত্রশিল্পের বিস্তার ঔপনিবেশিক চাহিদার কারণে হতে পারে, কিন্তু তার উদ্ভব অবশ্যই সে কারণে নয়। অল্প সময় ও খাটুনিতে প্রচুর কাপড় বুনে দিতে পারে এমন তাঁত ইউরোপ বানাতে পেরেছিল, উপনিবেশের কারণে নয়, নানা জটিল ধাতব যন্ত্র তৈরির দীর্ঘ ইতিহাসের কারণে । দিল্লির কুতুব মিনারের দিকে আঙুল তুলে প্রাচীনকালে স্টেনলেস স্টিল বানিয়ে ফেলার ভুয়ো দাবিতে মুগ্ধ হয়ে থাকা আম-ভারতবাসীদের বেশির ভাগই জানেন না যে, উপযুক্ত ধাতুবিদ্যার অভাবে বৃহদায়তন উৎপাদনের চাপ সহ্য করার মত পোক্ত তাঁত বানানোর প্রযুক্তি ভারতীয় কারিগরদের অধরা ছিল । এবং, কয়লার প্রাথমিক চাহিদাটা ছিল বস্ত্রশিল্পে নয়, ওখানেই --- আয়রন ফাউন্ড্রিতে । যন্ত্রপাতি গাড়িঘোড়া থেকে শুরু করে অস্ত্রশস্ত্র সবই ছিল ওরই ওপরে নির্ভরশীল । সে রকমই একটি বস্তু ছিল ঘড়ি । ভারতীয় ধনীরা ইউরোপ থেকে বিস্তর বড়লোকী বস্তু আমদানি করতেন, কিন্তু তার মধ্যে 'ঘড়ি' বস্তুটি ছিল না, ইউরোপীয় ঘড়িকে খুলে দেখে কৃৎকৌশল বোঝার চেষ্টা করা তো বহু দূরের বিষয় । সময়কে মেপে খরচ করার তাগিদ তাঁরা কোনওদিনই খুব বেশি বোধ করেননি, এখানকার আদিম সময়-মাপনীই তাঁদের কাছে যথেষ্টর বেশি ছিল । 


    ব্রিটেনের বস্ত্র-পণ্য যতদিনে সারা পৃথিবীতে দাপাতে শুরু করেছে, তার বহু আগের গল্প এইসব । 


    (গ) অস্ট্রেলিয়া থেকে ব্রিটেনে যথেষ্ট পরিমাণে সম্পদ নির্গমণ উনিশ শতকের আগে শুরু হয়নি । আর, শিল্পবিপ্লবের শুরু ধরা হয় অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি । কাজেই, 'কারণ' শব্দটির কোনও সম্ভাব্য অর্থেই অস্ট্রেলিয়া দখলকে শিল্পবিপ্লবের 'কারণ' বলে খাড়া করার কোনও বাস্তব উপায় নেই (প্রায় একই যুক্তি ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, মূল লেখায় সেটা বলেছি) । 


    এই যে আপনি বলছেন "এইটা ফস্কে না গেলেই দেখা যেত, যে, এই পুরো প্রক্রিয়ায় বাংলার বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হয়" --- এর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার কী সম্পর্ক বুঝতে পারিনি, তবে কথাটা এমনিতে ঠিকই বলেছেন । অর্থাৎ, বাংলার বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হওয়াটা ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের কারণ নয়, ফল ।


    (ঘ) "বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোককে মেরে ফেলা" জাতীয় আবেগী কথাংশের মধ্যে নৈতিক অভিযোগের উত্তাপ যতটা প্রকট, কঠোর তথ্য-যুক্তি সহযোগে ঐতিহাসিক কার্যকারণ নির্ণয়ের আকাঙ্ক্ষাটি বোধহয় ঠিক ততটা নয় । মন্বন্তরের সময়টুকুতে প্রচুর লোক মরেছিল বটে, তবে সামগ্রিকভাবে মোগল আমলের তুলনায় ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় জনসংখ্যার (এবং মোট জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয় ইত্যাদিরওবৃদ্ধিহারে বিশেষ কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না (মূল লেখার চিত্র ২ দেখুন) । আর, এমনকি মন্বন্তরের সময়েও, আসলে ইংরেজরা 'টেকনিক্যালি' প্রকৃত শাসক ছিলই না, মোগল সম্রাটের তরফে 'দেওয়ানি' পেয়ে তারই তরফে কর আদায়কারী ছিল মাত্র । বস্তুত, মন্বন্তরটি হয়েছিল ব্রিটিশ-মোগলের বিভ্রান্তিকর দ্বৈত শাসনজনিত অরাজকতা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের যৌথ ফল হিসেবে । লোকজন মরে গিয়ে দেশের উৎপাদন কমে যাওয়াটা ইংরেজরা কেনই বা চাইবে খামোখা, তারা তো আর নির্বোধ নয় ! 


    মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের সময়েও কঠোরভাবে পাওনা আদায় করে যাওয়াটা তাদের লোভ ও নিষ্ঠুরতার প্রমাণ বইকি । তবে কিনা, ১৭৭০ সালের বাংলায় ব্রিটিশ অসংবেদনশীলতাকে ১৭৫০-পরবর্তী ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের কারণ হিসেবে দেখতে চাওয়ার মধ্যে বোধহয় ঐতিহাসিক কাণ্ডজ্ঞানের চেয়ে অভিমানী আবদারটুকুই বেশি ।


    একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন, ব্রিটিশ নিষ্ঠুরতার বিবরণটিকে যথেষ্ট মর্মস্পর্শী করে তোলা গেলেই যে ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের কারণ বলে তাকে চালানো যাবে, ব্যাপারটা সম্ভবত এত সোজা নয় । বাংলার মন্বন্তরে এক তৃতীয়াংশের বদলে যদি দুই তৃতীয়াংশ লোকও মারা যেত, তাতেও ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের কার্যকারণ ব্যাখ্যায় এক পা-ও এগোনো যেত না ।


    আপনি আদৌ জবাব দেবার সময় পাবেন কিনা, জানি না । তবে, কথাগুলো রাখা রইল । এর কিছু না কিছু প্রাসঙ্গিকতা হয়ত থাকবে, এই রকমই আশা আমার ।

  • Suman Pachal | ১৭ অক্টোবর ২০২০ ২৩:৩৫98587
  • অসাধারণ মূল লেখাটির সঙ্গে উপরের মন্তব্য গুলোও সমান সমৃদ্ধ করলো.. উপনিবেশ না থাকলেও ইউরোপে শিল্প বিপ্লব হতোই.. তার কারণ বিজ্ঞান.. 

  • জয়র্ষি | ০২ নভেম্বর ২০২০ ০২:৫৬99546
  • খুবই তথ্যনিষ্ঠ লেখা। সেজন্য ধন্যবাদ। তবে বিশ্লেষণ অনেকটা "কী হইলে কী হইতো জাতীয় সন্ধান" মনে হলো। ইতিহাস তো সেভাবে এগোয় না৷ 


    জ্ঞানচর্চার কথা বললে এককালে এই উপমহাদেশে সত্যিই প্রভূত জ্ঞানচর্চা হয়েছে (বিশেষত গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্র)। অপদার্থতার কারণেই তা ভোগে গেছে৷ তারপর মধ্যপ্রাচ্যে বেড়েছে জ্ঞানচর্চা৷ রসায়ন ও গণিতের বিকাশ চোখে পড়ার মতো৷ উপমহাদেশের পুঁথির অনুবাদও হয়েছে যথেষ্ট। সেই পুঁথি এসে পৌঁছেছে ইউরোপে৷ ঘটেছে আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশ (যাকে আমরা ইউরোপীয় ইতিহাস চর্চার কল্যাণে রেনেসাঁ নামে চিনি)।


    এবার এই ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, বিজ্ঞানের ফলশ্রুতিতেই প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু প্রযুক্তির ধারণা থাকলেও শিল্প 'বিপ্লব' সম্ভব না। তার জন্য চাই পুঁজি। পুঁজি এসেছে দেশ দখলের মাধ্যমে। দেশ দখল হয়েছে আবার সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফলে এটি একটি চক্রাবর্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।


    এ থেকে সিদ্ধান্ত খুব বেশী করা যায় না। এটুকুই বলা যায়, উপনিবেশ (পুঁজি) না থাকলে শিল্প বিপ্লব সম্ভব ছিলো না। আবার একইভাবে শিল্প বিপ্লব না হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত দ্রুত এগোতো না। হয়তো উপমহাদেশ বা মধ্যপ্রাচ্যের মতোই জ্ঞানচর্চা একদিন স্থবির হয়ে যেতো। তবে উপনিবেশ বিস্তারের জন্য বিশেষ রাজনীতি দায়ী, বিজ্ঞানকে দায়ী করা নেহাৎই ছেলেমানুষী। আবার একই সাথে প্রযুক্তির বিকাশের পেছনে লুঠের কালো ইতিহাসকে সামান্যও ছোটো করা সম্ভব না।

  • দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য | 157.119.***.*** | ০৩ নভেম্বর ২০২০ ০৮:১২99583
  • এই যে বলছেন, এখান থেকে পুঁজি লুঠ হয়ে তবেই ইউরোপে শিল্পবিপ্লব হয়েছে, ঠিক ওই ধারণাটাকেই আমি এখানে ভুল বলে দেখাতে চেয়েছি । তার জন্য আমার সাধ্যমত তথ্য-যুক্তি দেবার চেষ্টা করেছি, হয়ত বোঝাতে পারিনি । আমার তথ্য-যুক্তিতে কোথায় ফাঁক আছে বলে আপনার মনে হল সেটা এখানে যদি নির্দিষ্টভাবে বলতেন, তাহলে আর একটু আলোচনার চেষ্টা করা যেত । এখানে যে এক সময় জ্ঞানচর্চা হয়েছে, সে কথা আমি অস্বীকার করিনি ।

  • জয়র্ষি | ০৪ নভেম্বর ২০২০ ০৯:০০99608
  • এই আলোচনায় আপনি বিভিন্ন উদাহরণ দেখিয়েছেন যে উপনিবেশ থেকেও শিল্পবিপ্লব না হওয়া বা উপনিবেশ হওয়ার আগেই প্রযুক্তির উন্নতি হওয়া। 


    আমি সেটা নিয়েই লিখলাম, প্রযুক্তির বিকাশ আর শিল্প বিপ্লবের মাঝে একটা স্তর আছে পুঁজি। যথেষ্ট পুঁজি ছাড়া এমন বিপ্লব সম্ভব না। নেসেসারি কন্ডিশনের মধ্যে পড়ে সেটা। আর সেটার জন্যই উপনিবেশ জরুরি চিি

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন