সীমান্ত হত্যা নিয়ে লেখার জন্য যে চিন্তা ভাবনা নিয়ে বসে ছিলাম তা থেকে একটু সরে যেতে হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই সরে যেতে হচ্ছে। পরে আবার আমার যে ছক সেই ছকে ফিরব। কিন্তু সীমান্ত হত্যা নিয়ে লিখতে বসে বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা না করলে এই লেখা পুরোটাই হালকা হয়ে যাবে, ওজন হারাবে।
বিষয়টা হচ্ছে গত এপ্রিলে কাশ্মীরে পাকিস্তানি জঙ্গি গোষ্ঠীর নির্মম হত্যাকাণ্ড। ধর্মের নামে, ইসলামের নামেই এইটা করেছে। কেউ এইটাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করলে ভণ্ডামি হবে। জঙ্গিরা নিশ্চিত করেছে ইসলামের নাম যেন স্পষ্ট ভাবেই ডুবে। কোন রাখঢাক করে নাই ইসলামকে ব্যবহার করতে। যারা নিজেদের পরিচিত ইসলামের সাথে এই ইসলামের মিল খুঁজে পান না তারা প্রতিবাদ করবে, কোন প্রকার যদি কিন্তু না রেখেই করবে। কিন্তু আমরা আমাদের দেশেই দেখছি তীব্র ভারত বিদ্বেষের কারণে এমন ন্যাকারজনক ঘটনার পরেও ভারতের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে রাজি না মানুষ। এই তীব্র ভারত বিদ্বেষ নিয়ে ভাবা উচিত, সামনে এইটা নিয়েও আলোচনা করব।
এই জঙ্গি আক্রমণের জবাবে ভারত দুম করেই পাকিস্তানে আক্রমণ করে বসল। রীতিমত যুদ্ধাংদেহী অবস্থা। এইখানেই আমার আপত্তি। আমি যদি আমার যুদ্ধ বিরোধী অবস্থানে থাকতে চাই তাহলে ভারতের পাকিস্তানে আক্রমণ করাকে সমর্থন করতে পারি না। আর আমি সব সময়ই যুদ্ধ বিরোধী অবস্থানে থাকতে চাই। আরেক দেশের সার্বভৌমত্বের ওপরে আক্রমণ এইটা মেনে নেওয়ার মত না। পাকিস্তান থেকে জঙ্গি ঢুকে জঘন্য অপরাধ করেছে এর জন্য সেই দেশে ঢুকে আক্রমণ করে আসা সমাধান? আমাদের দেশের যে অবস্থা, সরকার যেভাবে মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে, কালকে এখান থেকে যদি একটা দল সীমান্ত অতিক্রম করে এমন একটা কাণ্ড করে তাহলে ভারত বাংলাদেশে বোম ফেলবে?
এখন আসেন লাখ টাকা দামের প্রশ্নে। যে দেশের সাথে চরম বৈরী সম্পর্ক সেই দেশের সীমান্ত এত অরক্ষিত থাকে কীভাবে? এক দল সশস্ত্র জঙ্গি ঢুকে মানুষ মেরে চলে গেল আর কেউ কিছু করতে পারল না কেন? আর এদিকে আমাদের সীমান্তে গরু ছাগল আনতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরে মানুষ! রহস্যটা কই? আগের লেখায় অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে চোরাকারবারিদের তো মারবেই! যদিও আইনে নাই তবুও যদি ধরে নেই যে তাদের কথায় যুক্তি আছে তাহলে সেই যুক্তি এখানে খাটে না কেন?
সহজ জিনিসটা বুঝেন একটু, আরেক দেশে জঙ্গি চাষাবাদ হচ্ছে এই জন্য সেই দেশে আক্রমণ করার থেকে জরুরি ছিল নিজের ঘরের বেড়া ঠিক করা। অন্য দেশ এমন কাণ্ড প্রশ্রয় দিতেই পারে। কিন্তু আমার বাঁচার উপায় কি? প্রতিবার আমি আক্রমণ করব? না আমি আমার দেউরি পর্দা ঠিক করব? ছাগল ঢুকে ফসল নষ্ট করে এর সমাধান ছাগলের মালিকের বাড়িতে গিয়ে আক্রমণ করা না আগে ছাগল যেন জমিতে না ঢুকতে পারে তার সমাধান করা? ঢুকতে যেন না পারে এবং ঢুকলে যেন ধরা পরে, এইটাই বাঁচার সহজ বুদ্ধি। আশেপাশের অনেকের অনেক ছাগল থাকতে পারে, আমি সবার বাড়িতে ঢুকে আক্রমণ করব? তাহলে কাজ করব কখন? আমার তো এই বাড়ি ওই বাড়ির সাথে মারামারি করতে করতেই দিন যাবে! আগে বেড়া ঠিক করেন, তারপরে হুঙ্কার দিন যে তোমার ছাগল জমিতে ঢুকলে কিন্তু শেষ! গোস্তের ভাগও পাবা না!
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এমন একটা কাণ্ডের প্রতি অগণিত মানুষের সমর্থন দেওয়া। পাকিস্তানকে ঘৃণা করার হাজারও কারণ আছে। আমরা স্বাধীনতার এত বছর পরে পর্যন্ত অতিষ্ঠ তাদের যন্ত্রণায়। কিন্তু তাই বলে যুদ্ধ শুরু করে দিব আমরা? যুদ্ধ তো শেষ ধাপ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যুদ্ধ না করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। এই সত্যটা বুঝতে হবে সবার। আর ভারতকে বুঝতে হবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে যদি কোন জঙ্গি সংগঠন লুকিয়ে বা প্রকাশ্যে বা যেভাবেই হোক সীমান্ত অতিক্রম করে কোন সর্বনাশা কাণ্ড করে বসে তাহলে তাদের শিক্ষা দিতে এই ভূখণ্ডে আক্রমণ সমাধান না। যারা এই কাজ করবে তারা এই ভূখণ্ডকে নিজেদের দেশই মনে করে না। কোন এক অদ্ভুত কারণ তারা কোন এক আজব স্বপ্নের দেশকে নিজের দেশ মনে করে। যার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কমই আছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে বিষয়টা হয়ত তেমন না। রাষ্ট্র সেখানে মদদ দেয় নানা আকামের। জঙ্গিরা রাজার হালে থাকে। আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের হিসাবটা আলাদা। কিন্তু তারপরেও এমন আক্রমণ সমাধান না। নিজের দেওয়াল শক্তিশালী করা হচ্ছে প্রথম ও প্রধান কাজ। শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থাটা অল্পের মধ্যে শেষ হওয়ায় রক্ষা। কিন্তু প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই গেল।
এখন বলেন কেন আমি একজন বাংলাদেশী হিসেবে এই প্রশ্ন তুলব না? বছরের পর বছর ধরে যাদের সাথে সম্পর্ক বন্ধুত্বের, কেউ বলতে পারবে না আমাদের এখান থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো হয়েছে ভারত বিরোধী। অনালাইনে প্রচুর আস্ফালন দেখা যায় কিন্তু কংক্রিট কোন প্রমাণ আছে কি বাংলাদেশ ভারতের ভিতরে কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে? হ্যাঁ, একটা সময় সেভেন সিস্টারের অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা ঢাকায় রাত্রিযাপন করতেন। কিন্তু সেই দিন বাসি হয়েছে। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি দীর্ঘদিন ধরে যাদের সাথে দারুণ সম্পর্ক, যাদেরকে বন্ধু বলতে কংগ্রেস, বিজেপি কেউ দুইবার ভাবে না সেই সীমান্তে দিনের পর দিন মানুষ মরছে গুলি খেয়ে আর যারা তৈরিই হয়েছে আছে ভারতকে শান্তিতে থাকতে দিবে না, সুযোগ পাওয়া মাত্র যে দেশের জঙ্গি গোষ্ঠী ঢুকে একের পর এক ন্যাকারজনক কাজ করে যায় সেই সীমান্ত প্রহরী ঘুমায়? কীভাবে পাহারা দেওয়া হয়?
ওই সীমান্তে সন্ত্রাসী এসে ঢুকে মানুষ মেরে যায় আর আমাদের এই সীমান্তে ১৪ বছরের স্বর্ণা দাস গুলি খেয়ে মারা যায়। ভারতের সীমান্ত রক্ষীদের যোগ্যতা নিয়েও তো সন্দেহ করতে পারে কেউ। কেউ তো প্রশ্ন করতে পারে যে অমিয় ঘোষদের সব বীরত্ব শুধু ফেলানি আর স্বর্ণা দাসের মত কিশোরীদের সাথেই, অন্য দিকে মানুষ মরে ২৬ জন!
আমি জানি বিষয়টা ভারতীয়দের জন্য বেশ স্পর্শকাতর। কিন্তু এই প্রশ্ন নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই তোলা উচিত না? আমি তুলছি কারণ এইটাকে আমার কাছে রীতিমত অশালীন মনে হয়েছে। এইটা কোন কথা হতে পারে? দুঃখিত কিন্তু আমি এই প্রশ্ন করবই। এমন না যে পাকিস্তান ভারত সীমান্ত খুব শান্ত, সেখানেও মৃত্যুর থাবা আছে। কিন্তু পার্থক্য আছে, পাকিস্তান সীমান্তে হত্যাকাণ্ড হয় যুদ্ধের নামে, বাংলাদেশ সীমান্তে হয় বন্ধুত্বের মুখোশে। পাকিস্তান সীমান্তে মারা যায় সৈন্য আর আমাদের সীমান্তে মারা যায় কৃষক, কিশোরী, নিরীহ মানুষ।
সীমান্ত হত্যা নিয়ে অসহায় লাগে। অনেক আজগুবি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। কেন যায়, কেন ওইখানে গেল, কেন কেন? সোজা বিষয়টা বুঝে না আমাদের সীমান্ত চীনের দেওয়াল না, আমাদের এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে মানুষের বাড়িঘর সীমান্তে ঢুকে গেছে। এই পাশে বাড়ি ওই পাশে ক্ষেত! মরে এরাই। কয়জন চোরাকারবারি মরছে আজ পর্যন্ত? যে 'আত্মরক্ষার জন্য গুলি' আইন আছে তা আজ পর্যন্ত কয়জনের জন্য খাটে? দশ? পাঁচ? দুই? একজনও না? কেন ভাই? কেউ বন্দুক তুলল না গুলি মেরে দিলেন? আর আমরা প্রশ্ন তুললে বলবেন ওই জায়গায় গেল কেন? তাহলে সাহস করে সোজা বলে দিন এইখানে আসলেই গুলি। ভণ্ডামি করার দরকার কী? নানান প্রটোকল, চুক্তি ফুক্তি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সোজা কথা বলে দিন। এখন তো বাংলাদেশ সরকারও বন্ধুত্বের আশেপাশে নাই। বন্ধু বন্ধু খেলা বন্ধ হোক।
আগের লেখাও বলছিলাম যে দুঃখ বেশি এই কারণে যে বাঙালি হয়েও পশ্চিমবঙ্গ থেকে দিনের পর দিন এই অনাচারের কোন প্রতিবাদ চোখে পরে না আমাদের। পশ্চিমবঙ্গের বেশ জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন একজনের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমার। তিনি সেখানের নামকরা পত্রিকায় কাজ করেন। আমি তাকে এই একটা প্রশ্নই করেছিলাম, কেন তারা জানেও না এমন অন্যায়ের ব্যাপারে? কেন একটা শব্দও উচ্চারণ হয় না এখান থেকে? এর একটা সহজ উত্তর দিয়েছিলেন, কেউই আর্মি বিরোধী বা আর্মি সংক্রান্ত কোন বিষয়ে কথা বলতে চায় না! ঘুরেফিরে সেই আদি অকৃত্রিম সমস্যা! উপমহাদেশের এই বিষফোঁড়ার সমস্যা ভারতের নেই বলে জানতাম কিন্তু দেখছি একটু রঙ বদলে এখানেই এই জিনিস বহাল তবিয়তে রয়েছে!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।