দেখা না দেখায় মেশা
পর্ব ১
মোহিনীর কথা
গতমাসের প্রথম রোববার। সকালে চা বানিয়ে ডাইজেস্টিভ বিস্কিটের সঙ্গে আয়েস করে চুমুক দিয়েছি।
খবরের কাগজ আসতে আরও আধঘন্টা।
মোবাইল চেক করে দেখি পেনশনের টাকা কাল রাত্তিরেই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে গেছে।
আর এক কাপ চা করতে উঠব, এমন সময় মোবাইলের প্রমোশনাল গ্রুপে একটা বিজ্ঞাপন আর তার সঙ্গের ভিডিওয় চোখ পড়লঃ
শেষ বয়সে একা? সঙ্গীর অভাব? আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি আপনার জন্যে নিয়ে এসেছে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ। এখানে আপনার রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী কাস্টমাইজড্ সঙ্গী, পুরুষ বা মহিলা, সরবরাহ করা হয়।
কী বিচ্ছিরি শব্দগুলো! পুরুষ বা মহিলা সঙ্গী ‘সরবরাহ’? নির্ঘাৎ আকছার যেসব একরঙা বিবর্ণ পোস্টার কোলকাতার ল্যাম্পপোস্টের গায়ে দেখি, তারই একটা ডিজিটাল অং বং চং!
কিন্তু পরের লাইনটি যেন আমার ভাবনার উত্তরঃ
বিধিসম্মত সতর্কতা— এটা কোন সেক্স ডল বিক্রির দোকান নয়।
আমাদের কৃত্রিম প্রজ্ঞার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উন্নত মানসিক রুচির সঙ্গী তৈরি করে।
আপনি চাইলে তার সঙ্গে পিকাসোর ছবি, দেকার্তের অস্তির প্রমাণ বা রবীন্দ্রসঙ্গীতে কর্ণাটকী ধারার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।
আবার সে আপনার পছন্দমত জাপানি সুশি, ইতালিয় তিরামিসু অথবা বড়ি দিয়ে সুক্তো সবই রান্না করে দিতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা আপনি ওর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে পারেন।
মনে রাখবেন আমাদের কাস্টমাইজড কৃত্রিম বুদ্ধির সঙ্গী পেতে হলে ন্যুনতম মূল্য হল ১০০০ ইউরো। আমরা কেবল ডিজিটাল পেমেন্ট গ্রহণ করি।
বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের অফিসে আসুন।
আগে থেকে ফোন করে আসবেন। আমরা একবারে মাত্র একজন গ্রাহকের সঙ্গে ব্যবসায়িক কথাবার্তা বলি।
ইতিমধ্যে খবরের কাগজ এসে যাওয়ায় আর সব কিছু তুচ্ছ হয়ে গেল।
উত্তর ভারতে বন্যা, দক্ষিণ ভারতে ভাষা আন্দোলন, দাবায় নতুন প্রতিভা, মেয়েদের ক্রিকেটে চমক, মধ্যপ্রাচ্যে বিরামহীন সংঘর্ষ –দু’ঘন্টা পেরিয়ে গেল।
এবার স্নানের জল গরম করতে গীজার চালু করে আর একবার কফি খাওয়া যেতে পারে।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর টিভিতে এলোমেলো চ্যানেল ঘোরাতে গিয়ে চোখে পড়ল আফ্রিকার কোন জঙ্গলে নেউলের সঙ্গে শঙ্খচুড়ের মরণপণ লড়াই।
খানিকক্ষণ দেখে বন্ধ করে দিলাম। চোখ ঘুমে ঢুলে পড়ছে।
একটা হালকা চাদর গায়ে টেনে এসির শীতলভাব একটু কমিয়ে সোজা ঘুমের দেশে।
আমি একটা বনের পথে হাঁটছি, একা। এই বনটা কোথায়?
ছত্তিশগড়ে তো বটেই, কিন্তু কোথায়? বার-নওয়াপারা? কেঁচকি? উদন্তী?
না, না। সেরকম নামকরা কোন অভয়ারণ্য গোছের নয়। আমি একটি ছোট পাহাড়ের নীচে গাঁয়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছি।
তার আগে একটা ছোটখাটো জঙ্গলমতো।
কেন যাচ্ছি? আর কেন, নির্ঘাৎ ব্যাংকের দেনা আদায় করতে।
কিন্তু পায়ে হেঁটে কেন? আচ্ছা, মোটরবাইকের ইঞ্জিন গরম হয়ে গেছে। বোধহয় প্লাগপয়েন্টে কার্বন জমে গেছে।
তাই জঙ্গলের গোড়ায় একটা বনইমলি গাছের নীচে ওটাকে দাঁড় করিয়ে এসেছি। গাঁয়ে এসব ঠিক করার মিস্ত্রি পাওয়া যেতে পারে।
নিদেনপক্ষে কারও কাছে একটুকরো শিরীষ কাগজ, ওরা বলে এমরি কাগজ, পেলে আমি নিজেই প্লাগ পরিষ্কার করে বাইক স্টার্ট করে নিতে পারব।
কিন্তু এতক্ষণে জঙ্গল ফুরিয়ে যাওয়ার কথা।
তেন্দুগাছটার পরেই তো জোড়া বটগাছের তলায় গ্রাম্যদেবতা ঠাকুরদেবের থান, সিঁদুরলেপা পাথর।
কোথায় সেসব? পথ ভুল হওয়ার কথা তো নয়। তাহলে?
আর একটু এগোই। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।
কিন্তু তেন্দুগাছটার পাশ থেকে বেরিয়ে রাস্তা রুখে দাঁড়িয়েছে এক কালীনাগ। প্রায় চারফুট উঁচু মাথা থেকে লকলক করছে জিভ, আর চোখে রাগ।
কেন এসেছি?
অল্প অল্প দুলছে ফণা। ছোবল দিতে কতক্ষণ?
দৌড়ে পালাবো? এই ঝোপঝাড় কাঁটাভরা সরু বনের পথে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পরার চান্স বেশি।
আমার পায়ে শক্তি নেই। নড়তে পারছি না। বাঁচার একটাই উপায়।
সাপের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
দেখি, কে আগে চোখ নামায়?
কিন্তু সাপের চোখ ক্রমশঃ বড় হচ্ছে, আরও বড়, কাজলটানা—আরে এতো শ্রীদেবী!
শ্রীদেবী এই বনপথে একা? আমার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসছেন!
নাকি মেসমেরাইজড্ করেছেন? নইলে পালাতে পারছি না কেন?
ধপ্ করে বিছানায় উঠে বসেছি। এসি চলছে, তবু ঘামে গেঞ্জি ভিজে গেছে।
উফ্ সাপের ভিডিও, কালীনাগ, শ্রীদেবী সব মিলেমিশে একাকার। জলটল খেয়ে সোফায় গিয়ে বসি।
একটা কথা মাথায় ঘুরছে –আমরা জলধারাকে নদ নয়, নদী ভাবতে স্বচ্ছন্দ। ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু, দামোদরকে নদ বলি বটে, কিন্তু অবচেতনে নারীপ্রতিমা। তেমনই সাপ ভাবতে গেলে সাপিনী বা নাগিন ভাবি। কোন গল্পে বা সিনেমায় পুরুষ সাপ কি প্রাধান্য পেয়েছে?
বোম্বাইয়া রোমান্টিক ফিল্মগুলো যেমন নায়ক প্রধান, তেমনই সাপ নিয়ে সিনেমা বা সাহিত্য মানেই নাগিনী। দেখুন—নাগিনী কন্যার কাহিনী, নাগমতী, নারী ও নাগিনী, কালনাগিনী। সাপের দেবী মনসা তো বুঝলাম, দেবতা কে?
বাঘের আছেন দক্ষিণ রায়, সাপের?
কিন্তু আরেকটা কথা।
এমন সময়ে আমার বড্ড একলা একলা লাগে। রীমা যতদিন আমার সঙ্গে ছিল ততদিন এসব মনে হত কথার কথা।
মাঝরাত্তিরে দুঃস্বপ্ন দেখে গলা শুকিয়ে জেগে উঠলে ও ঠিক টের পেত। এক গেলাস জল গড়িয়ে এনে আমার সামনে ধরত।
বলত—যাও, একবার বাথরুম থেকে ঘুরে এস, চোখেমুখে জলের ঝাপটা দাও।
বিছানায় ফিরে এলে পাশে গড়িয়ে এসে বুকের উপর একটা হাত রেখে বলত—আমি একটা মন্ত্র বলছি, তুমি এবার ঘুমিয়ে পড়বে।
কখনও শীতের দিনে ব্যাংকের কাজে দেড়শ কিলোমিটার বাইক চালিয়ে ফিরেছি, ঘরে আসতে রাত হয়ে গেছে।
হাত-পা ঠান্ডায় কালিয়ে গেছে। লেপের তলায় ঢুকেও পা আর হাঁটু যেন বরফ।
রীমা ওর দু’পায়ের ফাঁকে আমার ঠান্ডা পা ঢুকিয়ে নিত।
--নাও, এবার শীত তাড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
কিন্তু ও ফাইটো-কেমিস্ট্রির ফান্ডা ঝাড়তে চাইলে অদীক্ষিত আমি বোর হয়ে যেতাম।
তেমনই আমি এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ বা লগারিদমের স্কেল নিয়ে কথা বললে অথবা কোলরিজের নাবিকের গলায় ঝোলানো মরা অ্যালবেট্রস পাখি নিয়ে কথা বলতে চাইলে টের পেতাম ও খালি তাকিয়ে আছে, কিন্তু অডিও অফ করে রেখেছে।
তাহলে কি সত্যিই কোন এক নারী একজন পুরুষের সমস্ত চাহিদা মেটাতে পারে না? অথবা ভাইস ভার্সা? কিন্তু সামাজিক বন্ধনের মধ্যে বাঁধা হয়ে সেই আর্তির সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
মোবাইল খুলতেই সকালের বিজ্ঞাপনটা স্ক্রীনে লাফিয়ে উঠল।
একটা লাইনে আমার চোখ আটকে গেলঃ
সবচেয়ে বড় কথা আপনি ওর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে পারেন।
সত্যিই তো! কতদিন কাঁদি নি।
এমনকি রীমাকে গড়িয়ার শ্মশানে দাহ করার সময়ও কাঁদি নি।
কেমন মনে হচ্ছিল কাঁদলে রীমাকে অপমান করা হবে। ও যে অন্যরকম ছিল। ওর ভাবনায় আবেগের চেয়ে দায়িত্ব প্রাথমিকতা পেত।
একেবারে আমার উলটো।
ওর বাবা সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়ে চলে গেলেন। ও কোলকাতার ফ্ল্যাটে আমার খাবারের জন্যে দু’বেলা হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করে চলে গেল বাপের বাড়িতে নাগপুরে। একমাস ধরে বাবার সব শুশ্রুষা দেখাশুনো করল, মায় নিজের হাতে খাইয়ে দেয়া পর্যন্ত।
ওনার বাঁপাশটা অবশ হয়ে গেছল কথা অস্পষ্ট। খালি চোখ দিয়ে জল গড়াত।
শেষ সময়ে উনি ডানহাতটা রীমার মাথায় রেখেছিলেন। তবু রীমা কাঁদেনি। ও ভেঙে পড়লে মা-ভাই-ছোটবোনকে কে সামলাবে!
কেঁদেছিল সাতদিন পরে, কোলকাতায় ফিরে বাবার কথা মনে করে—আমার কাঁধে মাথা রেখে।
জান,ছোটবেলায় বড় বেয়াড়া ছিলাম। কেউ কিছু বললেই ভাবতাম –আমাকে কব্জা করে ননীর পুতুল বানাতে চাইছে। আমি কোন ছাঁচে ঢুকতে চাইনি।
সবার উপদেশ, শত অনুরোধেও না। বাবার সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। কেউ শেখায়নি, নিজে নিজেই শিখেছি।
দু’তিনবার আছাড় খেয়ে হাত পা ছড়ে যাওয়ার পর। মা বলত মেয়ের ধিঙ্গিপনা।
নাগপুরে এই শব্দটা কখনও শুনিনি। এর মানে জানা নেই। কিন্তু ধিঙ্গি শব্দটায় এমন কিছু আছে, যাতে আমার হাড়পিত্তি জ্বলে যেত।
বলতাম—বেশ করব, আরও করব।
মা চুলের মুঠি ধরে পিঠে দু’ঘা দিত। কিন্তু বাবা কখনও গায়ে হাত তোলে নি।
হ্যাঁ, তুলেছিল, শুধু একবার। সে এক কাণ্ড।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে ঘর তালাবন্ধ দেখে সাইকেল নিয়ে চক্কর কাটতে চলে গেলাম। ইচ্ছে, পার্কের ভেতরে গিয়ে স্লো-সাইক্লিং প্র্যাকটিস করব।
স্কুলের টুর্নামেন্টে নাম দিয়েছি যে!
বাজার অব্দি গিয়েছি কি একটা লোক সাইকেলে চড়ে পাশ থেকে আচমকা ধাক্কা মারল। আমি কোন রকমে টাল সামলে ওর পেছনের চাকায় কষালাম এক লাথি। হুড়মুড়িয়ে রাস্তার একপাশে মুখ থুবড়ে পড়ল।
আমি পাত্তা না দিয়ে সোজা এগিয়ে গেলাম। তারপরে পার্কে গিয়ে খানিকক্ষণ চালিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
গেট খোলা। দরজায় দাঁড়িয়ে বাবা-মা, ছোট বোন এবং পাড়ার ঘোষকাকু ও সেন কাকিমা।
--কোথায় গিয়েছিলি?
--পার্কে, প্র্যাকটিস করছিলাম।
--ফের মিথ্যে কথা!
ঠাস্ করে একটা চড়! ব্যাথার চেয়েও অবাক হলাম বেশি। বাবা আমার গায়ে হাত তুলল!
পরে জেনেছিলাম পাড়ার কাকু-কাকিমার দল এসে কান ভাঙিয়েছে।
ওরা নাকি আমার ধিঙ্গিপনা নিজের চোখে দেখেছে।
--সিনহা-দা, আপনার মেয়েটাকে সামলান। আজ বাজারে আমাদের চোখের সামনে একটা বয়সে বড় লোককে সাইকেলে এক লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর ফিরে তাকিয়েও দেখল না! সোজা নিজের মনে চলে গেল।
সেই প্রথম, আর সেই শেষ।
যখন স্কুলের স্পোর্টসে স্লো-সাইক্লিং কম্পিটিশনে সেকণ্ড হয়ে মেডেল নিয়ে বাড়ি ফিরলাম, বাবার চোখে জল।
আমাকে জড়িয়ে ধরল, আইসক্রিম কিনে দিল। আর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল—তোকে মেরে অন্যায় করেছিলাম। ভুল হয়ে গেছে মা!
পাড়ার লোকের কথায় মাথার ঠিক ছিল না। আজ থেকে এই সাইকেলটা তোর। কেউ ছোঁবে না, শুধু তুই।
কিন্তু রীমা যে হঠাৎ করে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে কে ভেবেছিল? বোধহয় নিজেও জানত না।
ওর স্বাস্থ্য ভাল ছিল। জ্বরজারি পেটখারাপ হত কদাচিৎ। ও বরং আমাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকত বেশি। আমার শ্বাসের কষ্ট, আমার বুড়ো বয়সের আর নানান ঝামেলা।
ও বলত অ্যাক্টিভ থাক, চলাফেরায় থাক, সারাদিন বইমুখে বসে চায়ের পর চা! তাহলে ডাক্তারের বিল বাড়বে।
তারচেয়ে একটু হাত-পা নাড়ো, শরীরের মেশিনটায় জং ধরতে দিও না।
সেই রীমা তিনদিনের জ্বরে ভুগে শেষ হয়ে গেল।
সেবার কোলকাতায় প্রচণ্ড বৃষ্টি, রাস্তা জলে জলময়। হঠাৎ দেখি রীমা সকাল বেলা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে।
যখন খেয়াল করলাম ও বলল—কিছু না , গা’ টা ম্যাজম্যাজ করছে। কেমন বাদলা দিন দেখছ তো?
আমার কানে বেসুর লাগল। কপালে হাত দিয়ে দেখি বেশ জ্বর। বললাম—গাড়ি ডাকি? হাসপাতালে নিয়ে যাই?
--না , না। ক্যালপল দিয়ে দাও, আর এক গেলাস জল। আর তুমি একটু ভাতে ভাত চড়িয়ে দাও। তোমার জন্যে একটা ডিম ভেজে নিও।
বৃষ্টি ধরে নি। রীমা কিছুতেই হাসপাতাল যাবে না।
বললাম --আমাদের ব্যাচমেট সজল মেডিকেল কলেজ থেকে রিটায়ার্ড, ভাল ডাক্তার। ওকে খবর দিই?
--একদম না। কী ভাববে? সামান্য সর্দিজ্বরে বৌদি ভয় পেয়ে গেছে?
কিন্তু দ্বিতীয় দিনেও জ্বর কমার কোন লক্ষণ না দেখায় আমি সজলকে ফোন করে সব বললাম। ও গম্ভীর হয়ে বলল—কোন ভাইরাস সংক্রমণ। বৌদির রক্তপরীক্ষা করাতে হবে।
আমার মনে হল রীমা কেমন যেন নেতিয়ে পড়ছে। তবু আমি জলপট্টি মাথা ধোয়ানো এসব চালিয়ে গেলাম।
ভাবলাম, বৃষ্টি না কমলেও আমি কাল অ্যাম্বুলেন্স ডেকে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেব।
সে সুযোগ আর পেলাম না। পরের দিন ভোরে এক কাপ হরলিক্স খাওয়াতে গিয়ে টের পেলাম। ওর শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে।
যাকগে, তারপরেও একবছর কেটে গেছে। বিশ্বাস হতে চায় না।
রীমার বাঁধানো ছবিতে ধূলো জমছে। সাতদিন হল মালা বদলানো হয় নি।
মনে হচ্ছে এটা ল্যান্ড লাইন নাম্বার, কোলকাতার। যদিও কোন ঠিকানা লেখা নেই, তবে কোড তো সেই ০৩৩, মানে কোলকাতা। কতদিন ল্যান্ডলাইনে কথা বলি না। রীমা চলে যাওয়ার পর আমাদের টেলিফোন সারেন্ডার করে দিয়েছি। একা মানুষের জন্যে মোবাইল যথেষ্ট। ও থাকলে সপ্তাহে তিনবার ছেলের সঙ্গে কথা বলত।
আমি মাসে দুয়েকবার।
রীমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি—এত ঘনঘন কথা বলার কী আছে? তারপর ওদের একটা নিজস্ব জীবন আছে। ওরা মানে অজয় ও লিজা। লিজা মালয়ালি খ্রিশ্চান। ওরা এখন আর লুরুতে থাকে না। চলে গেছে আমেরিকায়—না না, কী যেন বলে স্টেটসে। মিড ওয়েস্ট অঞ্চলের উইসকনসিন বলে শহরে।
হ্যাঁ, রীমা চলে যাবার পর অজয় ও লিজা এসেছিল, আমায় ওদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি।
আমার আমেরিকা ভাল লাগে না। মুখ ফুটে বলি না।
লোকে ভাববে দ্রাক্ষাফল টক্ অথবা খামোখা উল্টোপালটা বলে তাক লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা।
আসলে গিয়েছিলাম দু’বছর আগে—রীমা আর আমি। ওরা অনেক যত্ন করেছিল। অনেকগুলো জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গেছল। দেখিয়েছিল সবাই গিয়ে যা দেখে --স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, ডিজনিল্যাণ্ড, শিকাগোয় স্বামী বিবেকানন্দের সেই বক্তৃতার হল আরও কত কী!
আমার কেন যেন মন ভরেনি। খালি মনে হত পথের পাঁচালির অপু ক্যালিডোস্কোপের ফুটোয় চোখ লাগিয়ে তাক লাগানো বিচিত্র দুনিয়া দেখছে---তাজ বিবি কা রোজা দেখো, হাতি বাঘ কা লড়াই দেখো!
কিন্তু আমার একটা আমোদগেঁড়ে দিক আছে। নতুন কিছু শুনলে বাজিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। ভাবটা –দেখিই না গিয়ে!
এই ধরণের চক্করে পরে একবার ওয়াগন-ব্রেকারদের দলে ভিড়ে ছিলাম। সময় থাকতে কেটে এসেছি।
আর একবার বুড়ো বয়সে কোন একটা মলে ভগবান বুদ্ধের ছবি আর ওয়েলনেস ট্রিটমেন্ট শুনে ভেতরে ঢুকে গিয়ে দেখি আলো কম, বেশ গা ছমছমে অন্ধকার অন্ধকার ভাব।
ভাবলাম ধ্যানট্যান করতে হবে। আর কিছু এক্সারসাইজ। কোথায় কী?
একটি মেয়ে এসে সোজাসুজি বলল—সেক্স? বডি-টু -বডি? আমার হার্টফেল হবার জোগাড়।
বললাম—ভুল করে এসেছি। সরি, আমায় যেতে দিন।
--এন্ট্রি ফী একহাজার টাকা দিয়ে তবে যাবেন।
--আমার কাছে অত ক্যাশ নেই। মাত্র আটশ’ আছে।
--ক্রেডিট কার্ড চলবে।
আমি একটু টিউবলাইট বটে, কিন্তু হঠাৎ বুদ্ধি খেলে গেল।
--দেখুন ক্রেডিট কার্ড আমার ওয়াইফের কাছে থাকে।
--তাহলে যা আছে, মানে ওই আটশ না কত, সেটাই দিয়ে যান। আর পরের বার পকেটে টাকা নিয়ে তবে এখানে উঁকি মারবেন। কাম-ধান্ধার সময়।
বাড়ি ফিরে রীমাকে সব বলি। গুডবয় সার্টিফিকেট চাই যে! রীমা রাগ করে নি।
শুধু বলল—অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে গেছ। তবে তোমার ভেতরে প্রস্ট্রেট বাড়ছে—ডাক্তার দেখাও।
যাহোক, আজ আবার আমোদগেঁড়ে মন জেগে উঠছে।
একহাজার ইউরো অনেক টাকা। প্রায় একলাখ। একটা ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙতে হবে।
সে যাকগে, একবার ফোন করে দেখি। নির্ঘাৎ কোন ফ্রড হবে। আমার একলাখ টাকা বেঁচে যাবে।
বাজিয়ে দেখি। তার আগে কোন অ্যাডভান্স দিচ্ছি নে।
ফোন বেজে গেল। কেউ ধরছে না।
খানিকক্ষণ পরে রেকর্ডেড ভয়েস—এই নম্বরের কোন অস্তিত্ব নেই। একবার ডায়াল করার আগে নম্বর চেক করে নিন।
হুঁ, বুড়ো বয়সে অনেক সময় আঙুল কেঁপে ভুলভাল নম্বর টাইপ হয়ে যায়। একবার চেক করি।
033-58132134- না, ঠিক নম্বরেই ফোন লাগিয়েছি। আর একবার কল করে দেখি।
ভাল করে দেখেটেখে ধীরে ধীরে টাইপ করলাম---033-58132134; কোন লাভ হল না।
সেই এক ঘ্যানঘ্যানে উত্তর।
ধুস্ শালা! সময় নষ্ট।
বিকেলে হাঁটতে বেরোলাম। আর্বান ভিলেজ বলে একটা পার্ক আছে, এন্ট্রি ফি দশ টাকা ।
ভেতরটা বেশ সুন্দর। একটা জলধারা বয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এখানে এসে বসি। আমার ছোটবেলার বন্ধু সুপ্রিয়কে ডেকে নিই। মাসে দু-একবার ও সল্ট লেক থেকে এখানে চলে আসে।
আজ জলের ধারে বসে আশকথা পাশকথার পর বললাম—হ্যাঁরে, একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিস? অবসরের বুদ্ধিমতী এ আই সঙ্গিনী।
--ছাড় তো! ওসব চক্করে পড়িস না। টাকা ও সম্মান সব যাবে। ব্ল্যাকমেলের শিকার হবি।
--আরে না না। এটা অন্যরকম। সেই সঙ্গিনী নাকি পিকাসো নিয়ে কথা বলতে পারবে।
--হুঁ, এটা হল টোপ। একবার যা, দেখবি পিকাসোর জায়গায় পল গঁগ্যার তাহিতি পেন্টিং।
তুই না একটু আধ্যাত্মিক দিকে মন দে। ফালতু চিন্তা ছাড়। নিজেকে লাগাম দিয়ে টেনে রাখ।
সুপ্রিয় ওই মলে গিয়ে মলত্যাগ এবং গাঁটগচ্চার কিসসাটা জানে।
রাত্তিরে শোবার আগে ফের নম্বরটা মন দিয়ে দেখতে লাগলাম। কোথাও কি একটা ভুল হচ্ছে? চোখের সামনে কোন সমাধান নেচে বেড়াচ্ছে? ধরতে পারছি না?
মাথায় জল থাবড়ে কফি বানিয়ে ফের মোবাইল খুললাম।
এবার নম্বরগুলো যেন চেনাচেনা লাগছে!
033-58132134 – আরে এটা তো ফিবোনাচ্চি সিরিজের নাম্বার।
এই সিরিজে প্রত্যেক নম্বর আগের দুটো নম্বরের যোগফল।
৩+৫= ৮, ৫+৮=১৩, ৮+১৩=২১, ১৩+২১=৩৪ ! কিন্তু কোথায় একটা ঝামেলা এখনও রয়ে যাচ্ছে।
হুম্ !
তাহলে ০৩৩ বা কোলকাতার কোড থাকছে না। আর সঠিক ফিবোনাচ্চি সিরিজ হলে ব্যাপারটা হবে ০১১২৩--৫৮১৩২১৩৪। তবে কি দিল্লির কাছাকাছি বা হরিয়ানার কোন সুদূর অঞ্চলের নম্বর? ফের কোন ফাঁদ?
ফোন করলাম। বিচ্ছিরি ঘড়ঘড় শব্দ।
আচ্ছা, এটা যদি ল্যান্ডলাইন না হয়ে মোবাইল নম্বর হয়ে থাকে? অর্থাৎ দশটি সংখ্যাই আসলে ফোন নম্বর?
নতুন করে সাজাইঃ ০১১—২৩৫৮১৩২১৩৪।
রিং বাজতে থাকে। কেউ ফোনটা তোলে।
আমি কাঁপা গলায় বলি—হ্যালো! কে বলছেন?
--ইয়েস, দিস ইজ ‘আশ্চর্য প্রদীপ” অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস্ । আপনার পরিচয়?
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।