প্রফুল্ল রায়ের মৃত্যু অকস্মাৎ নয়। শুনতে খারাপ লাগলেও, ওঁর যে বেঁচে থাকার কথা ছিল, আমাদের অনেকের কাছেই তা বরং বেশ চমকের। আলোকপ্রাপ্ত মানুষ বেঁচে থাকতে থাকলে যে ন্যূনতম খবরখবর কানে আসে, নিদেনপক্ষে সরকার পুরস্কার ভিক্ষে দিয়ে যেভাবে ঢোল সহবত করে, তার কানাকড়িও নজরে আসেনি এক্ষেত্রে। নতুন কোনো উপন্যাসের হদিস দেখিনি কোথাও। শুধু জানতাম, দেজ থেকে ছয় খণ্ডে তাঁর সমগ্র বেরিয়েছে, এন্টিক পিসের লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টের মত। এই সব সাতপাঁচ ভেবে আমার আন্দাজ খানিক ডালপালা মেলেছিল আর কি।
যাইহোক, যেটা বলতে আসা—কী এত লিখতেন বাংলা সাহিত্যের এলিট ক্লাবচ্যুত প্রফুল্ল রায়? নস্টালজিয়ায় ভিজে থাকা কবিতাময় গদ্য? নাকি খুঁজে নিয়েছিলেন সমসাময়িক মহারথীদের ছায়াময় শর্টকাট? শীর্ষেন্দু টাইপ, বা সুনীল ছাপ? অতিন মার্কা, কিংবা সমরেশীয় ধাঁচ? অশ্রাব্য হলেও উঠতিদের কাছে খুবই জরুরি এইসব প্রশ্ন। এখনকার আবর্জনা পড়ুয়াদের আবার এমনিতে নেই, ওমনিতে আছে। লাইক সর্বস্ব কিছু নাকউঁচু বেঞ্চমার্ক রেখে দিয়েছে। তার বাইরে কেউ কিছুই লিখতেন না। কী গেরো! ভাষার চাকচিক্য এড়িয়ে হেজে মজে যাওয়া দলিত জীবন প্রফুল্ল রায় কেন লিখে গেছেন পাতার পর পাতা, কে বোঝাবে শালাদের। কেনই বা বেশ্যার হতকুচ্ছিত হাড়গিলে দিনযাপনকে ধরে রাখতে গিয়ে ভরিয়ে ফেলেছেন কতশত খাতা! স্রেফ গন্ধওয়ালা ঘামের গল্প লিখবেন বলে। ঘরোয়া মায়া, মায়াবী বেলাভূমিকে লোকটা জেনে বুঝে ঝেড়ে ফেলেছিল। বাংলা সাহিত্যে অন্তত আর কেউ দলিত, অন্ত্যজ, অচ্ছুৎ জীবনকে নিয়ে এইভাবে একটানা লিখেছেন বলে তো আমার জানা নেই। নিজেকে ক্রমাগত রিপিট করছেন জেনেও। গল্পের চলন ভীষণ একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে—একথা মেনে নিয়েও। হেরে যাওয়া মানুষের পক্ষ নেওয়াটা সাহিত্যিকের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ভাষা যত না অলংকারের, তার চেয়ে অনেক বেশি বিষ্ঠার গন্ধ টেনে আনা প্রান্তিক সত্যের—এই ছিল তাঁর ভাবনা।
যেমন ধরুন—দাঙ্গা-হাঙ্গামার রক্তাক্ত বিবরণ না টেনেও, দেশভাগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী নির্মম নিষ্ঠুরতায় তুলে ধরলেন সামান্য এক হতদরিদ্র মুসলিম জেলে তোরাব আলীর চোখ দিয়ে। জঙ্গল হাঁকোয়া ভরোসালালের খাঁটি বোহেমিয়ান জীবন আমরা পড়লাম হাঁ হয়ে। করুণা হল। ঈর্ষাও হল প্রকৃত অর্থে একজন স্বাধীন মানুষকে দেখে। ঘুনুরাম বহুরূপী, বাঘ সাজে সে। পেটে বিস্তর টান, তদুপরি লোকালয়ে বাঘের সার্কাস এসেছে। ঘুনুরাম সাতপাঁচ না ভেবে স্রেফ পেটের দায়ে, নিজের গ্রহণযোগ্যতা চলে যাওয়ার আতঙ্কে দিল বাঘের খাঁচায় ঝাঁপ। রামধারী টাঙ্গা চালাতো মালিক দেওকিপ্রসাদের। রামধারীর বউ শনিচারির খুব ইচ্ছা একবার টাঙ্গায় চড়ে। কিন্তু উপায় কী, তাঁর মালিকের হল ‘গিধের’ চোখ। জুতিয়ে ছাল ছাড়িয়ে নেবে না! টাঙ্গায় সে চড়ল, তবে পরপারের রাস্তায়।কিংবা ধরুন—মাঠে ঘাটে শাক, আলু, মাকড় খুঁজতে আসা বিষ্টুপদ আর নিশি। একেবারে সম্পর্কহীন অপরিচিত দুই সত্তা। অথচ দুর্যোগভরা শীতের রাতে টিকে থাকতে একে অন্যের দেহতাপ আদানপ্রদান করে জাপটে শুয়ে রইল। তারপর ধরুন, ওই গল্পটা—‘সাতঘড়িয়া’। চাঁপিয়া জাতে দোসাদ। ভাঙাচোরা প্যাঁকাটি চেহারা। এদিকে নাটোয়ারের সাথে তার বিয়ের কথা। তবে, শর্ত হচ্ছে চাঁপিয়া তার নিজের খোরাকির বন্দোবস্ত করবে। হাটে গিয়ে কাজের সন্ধান মিললে তবেই বিয়ে। কে দেবে কাজ! শুধু তো গতর চূড়ন খাটুনি নয়, বাবুদের ভোগযোগ্যও হতে হবে যে!
আবার ধরুন, ফাঁদুয়া লখিন্দর—বিলে বাদায় পাখি মেরে বেরোলেও সে জানে, যে নটবর তার অনুপস্থির সুযোগে রোজ ধামসায় যায় তার বউয়ের গতরখানা। সে অবশ্য লাই দেয় ব্যাপারটায়। না হলে খামোখা তাকে যে আবার নটবরের সাথে শিকার নিয়ে মোকাবিলায় নামতে হবে।
এরকমই এক অধরা ভারতবর্ষের আখ্যান, নির্বিবাদী মেদুর বাঙালিআনার বাইরের এক প্রকাণ্ড পৃথিবীর বৃত্তান্ত, প্রফুল্ল রায় তারস্বরে শুনিয়ে গিয়েছেন। ফালতু রোমান্টিসিজম নেই সেখানে, "বাঙালিয়ানা"র বুর্জোয়া গ্লোরিফিকেশনও নেই। আছে কেবল ধাঙড়, দোসাদ, চামারদের ক্লান্তিহীন কথকথা। হয়ত তা সাহিত্য কম, বর্ণনা বেশি—পরিশীলন কম, কর্কশ শ্রেণীসংগ্রাম বেশি। সমাজকে কাঠগড়ায় তুলে কোপাতে গিয়ে, প্রফুল্ল রায় হয়ত চর্বিতচর্বণ করেছেন বিস্তর, তবে তা পুরোদস্তুর রাজনৈতিক প্রত্যয় বিচ্ছুরিত। এক বিশেষ দায়বদ্ধতাজনিত। সাহিত্যের নাম করে শুধুই যারা প্রোপাগান্ডা লেখেন, সাম্প্রদায়িকতা ইনজেক্ট করেন দিন-রাত এক করে, দায়বদ্ধতার কথা শুনে তাঁদের চক্ষু অবশ্য চড়কগাছে উঠবে। বুদ্ধদেব গুহরা যে সময়ে জংলী ব্যাপারটার সাথে আদিম মালপত্র মিশিয়ে একটা শহুরে ককটেল বানাচ্ছেন, প্রফুল্ল রায় তখন লিখছেন—রাজকীয় ভোজে পেটপুরে খেতে গিয়ে জরাজীর্ণ ধনিয়া নিজেই কীভাবে হয়ে উঠছে শুকুনের ভোজ। কার্যত, শহুরে বাবুদের জঙ্গলে ডেকে এনে উর্বর সাঁওতাল রমণীর শরীর মোচ্ছব তাঁর লেখাতে নেই। যে দুর্ধর্ষ সমাজে উচ্চবর্ণের যুবককে 'বেটা' বললে পিটিয়ে ছাতু করা হয়, সেই সমাজে প্রফুল্ল রায়ের গদ্যকে আমি রাবীন্দ্রিক গদ্যের চেয়েও বেশ জরুরি বলে মনে করি। যে মহান সমাজে ‘চামার’, ‘ধাঙড়’ গালিগালাজ হিসেবে দিব্যি গ্রাহ্য হয়, সেই সমাজে প্রফুল্ল রায়ের লেখা হওয়া উচিত অপরিহার্য। অবশ্য পাঠ্য হওয়া দরকার পঞ্চম শ্রেণি থেকে একেবারে গবেষণা অবধি।
মনে পড়ছে কি, ‘আকাশের চাঁদ এবং একটি জানালা’ এই শিরোনামের একটি গল্প? বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত যা থেকে ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ বানালেন। ললিতাকে মূলধনের মত আগলে রেখেছে রজনী। নরকের খাসমহল থেকে রেহাই পেতে নিজের মেয়েকে এলাকার দোর্দণ্ডপ্রতাপ জোতদারের হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া উপায় কী! স্কুলছুট ঘরবন্দি ললিতার শরীরে এখনও নারীত্ব আসেনি। রজঃস্বলা হওয়ার অপেক্ষা শুধু। ওদিকে ললিতার এক সহপাঠী খবর দিয়েছে—মানুষ নাকি চাঁদে যাচ্ছে, এমনটাই জানিয়েছেন স্কুলের নগেন স্যার। মানুষ চাঁদে পাড়ি জমাচ্ছে, অথচ সামান্য খিড়কি দুয়ার ডিঙোনোর হুমুক নেই এক কিশোরীর। মানুষের আত্মবিশ্বাসের শিখর—আকাশ ছোঁয়ার ইতিহাসের তীব্র বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা জন্মাবধি যৌন মালমত্তা হিসেবে চিহ্নিত ললিতা।
আর ‘ধর্মান্তর’ উপন্যাসের সেই অনিবার্য অন্তিম মুহূর্ত। রামধারী মিশ্রর কোঠিতে এসে গৈরুনাথ দেখে, লেঠেলরা ফেকুনাথাকে নির্বিচারে ঠেঙিয়ে তার ঘাড় ভেঙে মাথাটা ঝুলিয়ে দিয়েছে বুকের উপর। পাঠক তখনও ভেবে চলেছেন, আর তো মাত্র কয়েকটা প্যারাগ্রাফ! উপন্যাসের নাম তবে ‘ধর্মান্তর’ কেন! ওদিকে গৈরুনাথের বুকে তখন ধস নামছে। জন্মাবধি গোলামি করে যাওয়া এক ক্রীতদাসের শরীরের সমস্ত রক্ত যেন লম্ফ দিয়ে জমাট বাঁধছে চোখের কোনায়। প্রবল রক্তচাপে শুকনো দড়ির মতো পাকিয়ে যাচ্ছে গলার শিরা। পরাক্রান্ত গৈরুনাথের উপর এক অপার্থিব শক্তি ভর করছে তখন। ধর্ম পালনের মতো আজন্ম লালন করে আসা ভীরুতার খোলস ছাড়িয়ে সে তখন বেরিয়ে আসছে এক পরোয়াহীন দাপটে। এক অনিবার্য জাগতিক প্রক্রিয়ায়। ক্রীতদাসের একটাই ধর্ম—গোলামী। সেই গোলামির তখন ‘ধর্মান্তর’ ঘটে চলেছে অতর্কিতে, এক বেপরোয়া স্বতঃস্ফূর্ততায়।