নজরুলের অবশ্য সাপের ছুঁচো গেলা কেত্তন।
অগ্রজরা নাক কুঁচকে বলল, কোথাকার কোন পল্টনফেরত হাবিল, বাংলার মনোজ্ঞ মহলে ওঠাবসা নেই, রবীন্দ্রবলয়ে ঘোরাফেরা নেই, প্রকাশকের দোরে দোরে হাত কচলানিও নেই, নেই বন্ধুমহলে নিরলস অধ্যবসায়ের দীর্ঘ বিজ্ঞাপন —এত ‘নেই’ নিয়েও কিনা উড়ে এসে জুড়ে বসে জনপ্রিয়তায় সবাইকে টেক্কা দেবে — না না, এ লোক কবিতার কিস্যু বুঝতেই পারে না! ব্যাটা আস্ত চাঁড়াল একটা।
শনিবারের চিঠিতে সজনীকান্ত ঘোমটা-ঠোঁটে খেমটা নাচতেই ঘরের দুয়োর দিয়ে তাবৎ কবিদের সে কী হর্ষধ্বনি! বেলাভর নেচেকুদে হেদিয়ে গেলেন সক্কলে। কবিতা মাথায় উঠল, চড়া পড়ল দোয়াতে, আগে হোক নিকেশ নজরুল, তারপর না হয় কাব্যকুল।
অনুজরা অনেক ভেবে মাথা নাড়ল, — ঠিকই তো! কবিতা কুস্তির আখড়া, নাকি আতশবাজির সলতে, কাব্যের সুর এত উঁচু তারে বাঁধবে কেন, চলনই বা হবে কেন সর্বক্ষণ দ্রুতলয়ে, তাছাড়া ভাবাবেগ কি ফুটন্ত দুধ যে কথায় কথায় উথলে উঠল, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে এ লোক অনাগ্রহী, জীবন জিজ্ঞাসায় অনুৎসাহী, কোথায় সেই ঋষিসুলভ ব্যক্তিত্ব, ভাবনা মদির চাউনি। এ লোক বড়জোর ‘আধলা’ কবি হতে পারে, তবে ‘গোটা’ কবি নয়।
বন্ধুবৎসলরাও সুযোগ পেয়ে আওয়াজ দিল, — হক কথা। জ্ঞানপিপাসার হাতছানিটাই নেই। তাছাড়া, এ লোক গভীর দর্শনে বিকলাঙ্গ, অন্তরের প্রেম থেকে মুখ ফেরানো, গুরুচণ্ডালীতে আক্রান্ত।
প্রকাশক চোখে চশমা আঁটলেন, — হুম, কথাটার সারবত্তা আছে। লোকটার নান্দনিকতা তলানিতে, শিল্পবেত্তা পাতালে, আর বোধ-বুদ্ধি তো চিরকালই রসাতলে। সবেতেই গলাবাজি আর গর্জন, কবিতা কি স্লোগান নাকি! কোথায় দেখতে পাবো নান্দনিক সুষমা, পেলব লাবণ্য, তা না কেবল হট্টগোল! ছন্দ নিয়ে কারসাজি। কবিতা তো আর পাটিগণিত নয় রে বাবা! না! এ লোক খাঁটি কবি হিসেবে উৎরোয় না, এ ছিল নেহাতই যুগের হুজুগ, ইদানীং যা তামাদি। অভিজাত ঘরের বৈঠকখানায় রাখা যায় না এঁর কাব্যগ্রন্থ, তবে ছাপাব আরও হাজার পাঁচেক। লোকটা ব্যবসা দেয় না মন্দ।
বাঙালি মুসলমান অতশত জানে না। সে খায় ঘুমোয়, স্বপ্ন দেখে বখতিয়ার খলজির, জাবর কাটে আরব্য রজনীর। দিগ্বিদিকে কবির নামটা শোনে, কপালে কোঁচ ফেলে নামাজে উপুড় হয়ে নিত্য গজরায়, — কবি! হুঁ! দিনরাত জিভে শুধু দেব আর দেবী। আবার ঘরে তুলেছে প্রমীলা — ইম্পোরটেড ফ্রম সুদূর কুমিল্লা। আল্লাহ এক, কেউ শেখায়নি নাকি! আজাব নামল বলে। ধ্বংস তোমার অনিবার্য।
হিন্দু বাঙালিও কাতরায়, —ঘোর কলি ! প্রমীলা নাকি ঘর করছে কবির। এ কী অনাসৃষ্টি। আরবি-ফার্সি-তুর্কি শব্দের ছড়াছড়ি। প্রমীলা রে, ও যে নেড়ে কবি!
ইংরেজ তলায় তলায় সব খবরই রাখে , তক্কে তক্কে থাকে। রাগে গোঁফ মুচড়ে তাকায়,— এ লোক ঘোড়েল , আস্ত এক শয়তান। কবিতার নামে লোক খ্যাপায়। ব্যাটাকে জেলের ভাত এবার না খাওয়ালেই নয়। বলা মাত্রই দিশি আর্দালি জানায়, — সে নাকি কবিতা ছেড়েছে নতুন। শুনেই সাহেব সিং উঁচিয়ে দৌড় লাগায়।
নজরুলের বুকের কলিজা প্রমীলা রাঁধে, ভাত বাড়ে, কবির অপেক্ষায় সাজানো থালার দিকে চেয়ে চোখের জল মোছে। না চাইতেও দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে, — কবি, জানি তুমি ছিন্ন শিকড়, পিছুটানহীন, মুক্তবিহঙ্গ। কিন্তু চাল যে বাড়ন্ত।
অহিংস আন্দোলনের ঝাণ্ডা জানায়, — গোপন সূত্রে খবর এসেছে, সহিংসদের সাথে কবির একেবারে হরিহর আত্মা, ইয়ারবকশি, তুই-তোকারি অতি প্রাচীন। এ লোককে আর যাই হোক, বিশ্বাস করা নয় সমীচীন।
শুনেই সশস্ত্র বন্দুকের নল উঁচিয়ে ধমকায়, —ছাড়ো তো! আছে কি ওর ওই ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া। অকর্মার ঢেঁকি, একটি নির্বিষ অষ্টরম্ভা। এই মানুষ অহিংস না হয়ে যায় কোথা।
গ্রামোফোন বলে , - ওসব তর্কে কাজ কী ! লোকে যখন খাচ্ছে, দাও না যদু মধুর গান ওঁর নামে চালিয়ে। তাতে কবির মান পড়ে পড়ুক। আমরা অত ভাবব কেন, নিই না দু হাতে কামিয়ে!
কবি নির্বাক হতেই বঙ্গীয় বিশারদ আক্ষেপের সুরে কোঁত পাড়ে, —লোকটার আবেগ ছিল সন্দেহ নেই। তবে কোথায় থামতে হবে জানল না। কেবলই হৈ চৈ। সম্পদ ছিল, তবে তার ব্যবহারটাই শিখল না। অতি ভাবালুতার মলাটে, অনর্গল অবচেতন বাক্য-বিন্যাসে ঘোলাটে।
শিক্ষামন্ত্রক শোনে, নোটিশ জারি করে, —বাতিল করো একে। উঁচু ক্লাসের সিলেবাস থেকে হটাও তো বাবরি চুলকে। থাকুক ব্যাটা বালখিল্যের ফাইভে আর সেভেন এইটের কিশোরসুলভ নাইভে।
শুনেটুনে ফের মুষড়ে পড়ে পশ্চিমের মুসলমান বাঙালি। এ অত্যন্ত অন্যায়। উপুড় হয়ে সে নামাজে কাঁদে, — হুজুর কাণ্ড দেখেছেন! নজরুলকে করেছে বাতিল। কিছু একটা বাতলে দিন উপায়।
হুজুর তাজ্জব, — যাব্বাবা! তোরাই তো এককালে চেল্লালি, এ লোক আমাদের স্বজাতি নয়। দেবদেবীদের নাম এনেছে মুখে। করেছে হিন্দু বিয়ে। তবে এখন কিসের এত ইয়ে ?
পশ্চিমের মুসলমান বাঙালি আলজিভ কাটে, — জাহাঁপনা, সে তো আগে। ভেবেছিলাম আরও দু চারটে খাঁটি মুসলমান উঠবে লম্ফ দিয়ে। তারপর সব পগারপাড় করল পূবে। রইল পড়ে সব খুদকুঁড়ো আর নেহাতই এলেবেলে।
বাংলাদেশ ভাবে, — এই সেই সুবর্ণ সুযোগ। এবার নিতে হয় কবিকে দত্তক। মানুষকে সান্ত্বনা দেব আর কাঁহাতক। এপারে আইকনের যা আকাল, তাতে ওই আধেক হিঁদু আধেক মুসলমানও পার না করলে বৈতরণী, হতে হবে নাকাল।
নির্বাচন আসে নির্বাচন যায়। রাজ্য পরের বারের ঘুঁটি সাজায়, — কবির নামে একটি সরণি করে যুক্ত, পাঁচ খণ্ডের সমগ্র, তাহলেই আমাদের দায়িত্ব খালাস, ঝামেলা থেকে মুক্ত।
কেন্দ্র আঁতকে উঠে পাল্টা চালে, খ্যালখ্যাল হাসে, — হ্যাহ! শেষকালে এই - সরণি। ওই দ্যাখো বিমানবন্দরে, কবির নাম আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে হতে টেক অফ করবে বিদেশবিভূঁইয়ের অন্দরে ।
বাংলা ক্যালেন্ডার হাঁকে, — মনে রেখো! তারিখটা কিন্তু ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দে। কবিকে ভুললেও ক্ষতি কিছু নেই, মাঝেমধ্যে যদি লাগে শব্দজব্দে।
রাগে গ্রেগরিয়ানের শক্ত হয় চোয়াল, — রাখো তোমার কাওতাল। ডেটটা ২৪ শে মে, ইয়ার 1899। এটাই ফুল এন্ড ফাইনাল।
জেন-জেড হাই তোলে , — খামোখা সময় নষ্ট। ও লোক তো এমনিতেই ফসিলস। কী লাভ বিলুপ্তের জন্মবৃত্তান্ত। মিছামিছি এই কষ্ট।
চুরুলিয়া এই ফাঁকে হাত তোলে, কবির জন্ম কিন্তু এদিকেই। এদিকের জল মাটি পেয়েই … কাজেই আমরাই খাঁটি নজরুলী — দাবি শুধু এই ।
ঢাকা সশব্দে হেসে ওঠে, — বোকা! জীবন মিথ্যা, মৃত্যু সত্যি। মৃত্যুই জীবনের একমাত্র সত্য, এবং তা অবধারিত। কাজেই কবির আত্মা এদিকেই ঘোরে ফেরে আজও।
দিন যায়। গড় বাঙালির মনে কবি একটু করে বিস্মৃত হয়। নজরুল সন্ধ্যায় স্রোতারা শুনতে এসে নাগাড়ে ঢোলে। অবহেলার আস্তাকুঁড় থেকে কবিকে উঠিয়ে আনা হোক - এই মর্মে তাও দু একজন মুখ খোলে। অবশ্য নজরুল প্রেমীরাও একে একে ধরাধামের পাঠ চুকিয়ে আলবিদা জানাবে। কবির সমগ্র কেটে পোকামাকড়ের আত্মীয়রা জোর পিকনিক মানাবে।
তারপর একদিন এ-আর রহমান খবরে আসেন। তিনি বরাত পেয়ে কাশেন, — কারার ঐ লৌহকপাট! মন্দ নয়, তবে লোহার জায়গায় এলুমিনিয়াম, আর কপাটের জায়গায় জানালা করতে কী বাধা। কারাগার বদলে পাঠাগার করলেও খুব কি অসুবিধা!
শুনেই খলবলিয়ে ওঠে খোরাকসর্বস্ব বাঙালি ফেসবুক। পুরনো একটা লাইন ঝেড়ে দেয়াল লেখে, — কবিতা তো নয়, যেন আস্ত এক একটা বন্দুক।
দেখেশুনে আসরে নামে সাংবাদিক আস্তিন গুটিয়ে। এডিটর বলে, — যাবার আগে তিনটে কবিতা আর পাঁচটা গানের প্রথম লাইন কিন্তু টুকে নিও, হিড়িক যা পড়েছে তাতে ভুলভাল বললে লাল করে দেবে শুঁটিয়ে ।
কাওতালি জমেছে দেখে প্রকাশক বলে, — বাজার গরম, মস্তি চরম। অন্তত হাজার দুয়েক ছাপতেই হয় এক ঝাঁকিতে ,নইলে দিনের শেষে আবার না হয় পড়তে হবে ফাঁকিতে।
কবি তখন স্বর্গীয় নরকের দ্বারে বসে ভাঁজছেন মুগুর, কথাটা শুনে থমকে যান, ভাবনা আসে স্মৃতি-মেদুর। পরক্ষণেই অবশ্য মুগুরখানা হাতের কব্জিতে , শক্ত করে চেপে ধরেন চটজলদিতে — ফাঁকিতে! ব্যাটা এদিক পানে আসিস। ফাঁকিতে ! এইটা দিয়ে আ্যইসা দাবনা দেব না, বুঝবি তখন যন্ত্রণা শুধু আমার বুকেই নয়, লুকিয়ে থাকে তোরও মালায় চাকিতে। ফাঁকিতে !
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।