বলা হয়, প্রতিভা যতই সহজাত হোক, বুক চমকানি স্পর্ধা না থাকলে সেই প্রতিভার রাজকীয় উন্মেষ ঘটে না। দিগ্বিজয়ী সম্রাটরা রাজ্যাভিষেকের প্রতীক্ষায় কি আর প্রহর গোনেন, নিজেরাই চড়িয়ে নেন মাথার মুকুট। এর উল্টোটাও অবশ্য সত্যি, তবে ওঁর ক্ষেত্রে তেমনটা হয় নি। হয়নি বলেই বিএসসি ফেল করে দাদাকে সটান লিখে দিলেন, ‘লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব।’ এবং সর্বোপরি যোগ করলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমারও নাম ঘোষিত হবে।’
এমন প্রত্যয় চাট্টিখানি বিষয় না। হয় সে বদ্ধ উন্মাদ, আর নয়ত সময়ের জঠরে বেড়ে ওঠা প্রতীক্ষিত ক্ষণজন্মা। বড় দাদা ছিলেন বিজ্ঞানী, নিজেও ছিলেন প্রেসিডেন্সির অঙ্কের ছাত্র, মাথা ছিল বিজ্ঞানে, পাস করলেই বাঁধা চাকরি, সেই আরাম কেদারাটি ছেড়ে কেন যে সাহিত্যের অনিশ্চিত বন্ধুর উপত্যকায় মুখ ফেরালেন এক আলোকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানমনস্ক যুবক, সে যেন এক রহস্য। আসলে ইতিহাস দীর্ঘকাল অপেক্ষমাণ ছিল তাঁকে কিছু গুরুভার দিতে। সে দায়িত্ব তিনি এড়াবেন কী করে! ইতিহাস বলেইছিল, এঁর আয়ুরেখা হবে সংক্ষিপ্ত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট, তবে সৃষ্টি হবে একটা ব্রম্ভান্ডের মত, যার পরতে পরতে কেবলই গভীর জিজ্ঞাসা, অপূর্ব সব তত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বের রক্তমাংসের রূপায়ণ। যার পর্যালোচনা করতে নেমে ভবিষ্যতও চিরকাল পিছিয়েই থাকবে।
হিসেব করলে দেখা যাবে, ওঁর লেখক বনার এই যে সঞ্চারপথ, তা একদিকে যেমন অপ্রত্যাশিত, অপরদিক থেকে ভাবলে তা পূর্ব নির্ধারিতও বটে। বরং বিস্ময়ের হল, এত অল্প বয়সে, এতখানি পরিণতিবোধ ও জীবন-জিজ্ঞাসা নিয়ে তার আকস্মিক হাজির হওয়াটা। যা কেবল গুহামুখ ফাটিয়ে জ্বলন্ত ম্যাগমার অকস্মাৎ উঠে আসার সাথেই তুলনাযোগ্য। কোনও চিহ্নই ছিল না , পরক্ষণেই যেন তার উপস্থিতি আগুন ঠিকরোচ্ছে। যদিও, ওঁর জীবনের আলগোছ অধ্যয়নও বলে দেবে, ইতিহাস তাঁকে প্রস্তুত করছিল তিলেতিলে। লেখক আসলেই যে সময়ের ফসল , তা ওঁর জন্য যেন আরও বেশি প্রযোজ্য হল। লেখক তার সময়কে কামড়ে ধরবেন, তা তো প্রত্যাশিতই, কিন্তু অবিশ্বাস্য হল তাঁর এই দেখার চোখ , গভীর নিরীক্ষণ , অপরূপ মনোবিশ্লেষণ। এই উপলব্ধিময় ব্যতিক্রমী অন্তর্দৃষ্টি বেশ আশ্চর্যের।
অবশ্য মানুষ হিসেবেও তিনিও কী কম আশ্চর্যের !
বর্ষণপুষ্ট নদীতে সবান্ধব বাইচ খেলার নেশা ছিল তাঁর। মাঝি মেঝেনদের সাথে গালগল্পে কাবার করতেন বেলা। যাতায়াত ছিল কুস্তির আখড়ায়। গাড়োয়ানদের চমৎকার সান্নিধ্য উপভোগ করতেন। শোনা যায় , সুর ছিল গলায়। ঠোঁটের ফাঁকে বাতাসের সামান্য তরবেতর ঘটিয়ে বাঁশিকে মন কেমনিয়া তরঙ্গ বিস্তারে কথা বলাতেন। ছেলেবেলা থেকে সবসুদ্ধ আটবার স্কুল বদলি হয়েছিল। উপভাষার সব সীমারেখাকে তিনি টপকে গিয়েছিলেন অনায়াসে। সময় তাকে এভাবেই গড়েছিল রূপ-রস-স্পর্শ-গন্ধ এবং শব্দের স্নিগ্ধ মাধুর্যে । আবার সময়ই তাঁকে শিখিয়েছিল, অবদমিত আকাঙ্ক্ষার বিপন্নতা এবং বিপজ্জনক অবচেতনের সঙ্কট। এ মানুষ না লিখলে, আর কেই বা লিখবে!
আর ছিল বইয়ের নেশা। শরৎচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথ খুঁটিয়ে পড়তেন। প্রয়োজনীয় নির্যাসটুকু টেনে নিয়ে সরিয়ে রাখতেন বাকিটা। বই পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেছেন, ‘একখানা বই পড়তাম আর তার ধাক্কা সামলাতে তিন-চারদিন মাঠে ঘাটে, নৌকায় নৌকায়, হাটবাজারে মেলায় ঘুরে তবে সামলে উঠতাম’। চরিত্রহীন পড়ার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ লিখেছেন, ‘বোধহয় আট-দশবার বইখানা পড়েছিলাম তন্ন তন্ন করে। বাংলা সাহিত্যের কত দূঢ়মূল সংস্কার আর গোঁড়ামি যে চুরমার হয়ে গিয়েছিল এই উপন্যাসে!’
পাঠ করতেন কেবল আনন্দকে আহরণ করার উদ্দেশ্যে নয়, চেতনার অলিন্দে অবচেতনকে নামিয়ে এনে হাঁটকে দেখতে। আলগা ভাবনাকে কীভাবে শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ, প্যারাগ্রাফ এবং অধ্যায়ের শৃঙ্খলে বেঁধে দিতে হয়, এমনকি শুধু এই কৌশলকে আয়ত্ত করাই নয়, এ যাবত যা বলা যায় নি শালীনতার দোহাই দিয়ে, তা কি করে নিরাপদ মাত্রার আগল না ছাড়িয়েও বলা যায়, এই ছিল তার নিত্য অধ্যয়ন।
প্রথম উপন্যাসের খসড়ায় হাত দেবার আগেই ফ্রয়েড খতম। পড়ে ফেলেছেন হ্যাভলক এলিস’ও। তাই লেখা শুরুই করলেন সমতলের সহজতায় নয়, দুস্তর পথের বন্ধুরতা দিয়ে। কঠিন সব জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দিলেন তথাকথিত সুশীল জীবনকে উদ্দেশ্য করে। তাঁর গল্প উপন্যাসে যৌনতা ঘুরেফিরে এলো বহমানতার অনিবার্য তাগিদ এবং সচলতার স্বাভাবিক প্রতীক হিসেবে, যা ধারাবাহিক ভাবেই অবদমন ও বিরুদ্ধতার শিকার। যৌনতার স্পর্শকাতর নিরিখে ব্যক্তির আচরণ নিয়ে তিনি চালিয়েছিলেন বিশদ বিশ্লেষণ। সংযত এবং অনাসক্ত থাকার মধ্যেই কি জীবনের মহত্ত্ব! নাকি নিজেকে মেলে দিয়ে বয়ে চলার মধ্যেই তার আকণ্ঠ পরিপূর্ণতা। সম্পর্কে প্রেমের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও তার স্বতঃস্ফূর্ত ভাষা পাঠককে নিয়ে গিয়েছিল অস্বস্তির গভীরে। লোকে নাক সিঁটকালো। প্রেমেন্দ্র মিত্র ভদ্র সমাজের অভিযোগ নস্যাৎ করে লিখলেন, ‘তাঁর রচনায় যেটুকু অসুস্থতার ছায়া তা আমাদেরই রুগ্নতার প্রতিবিম্ব। কোনো দিকেই মাঝারি হবার সৌভাগ্য নিয়ে তিনি আসেননি। চূড়াও যেমন তাঁর মেঘ-লোক ছাড়ানো, খাদও তেমনই অতল গভীর। তাই মানিয়ে নেবার মানুষ তিনি নন।’
ক্ষুরধার প্রতিভা তো ছিলই, ছিল নৃশংস আত্মনিবেদন, জীবন নিংড়ানো সাধনা। শরীর পাত হত, জারি থাকত কেবল পড়া, লেখা। প্রগাঢ় সমীক্ষা। আর জীবনের একদম শেষ লগ্নে, যখন প্রায় শয্যাশায়ী, তখনও লেখার ভঙ্গিমায় শূন্যে সঞ্চালিত হত তাঁর নিস্তেজ আঙ্গুল। ধ্বস্ত চেতনের প্রতিবর্ত ক্রিয়া। যেন অনন্তের অনুসন্ধানে বাতাসের প্রেক্ষাপটে এইবার ডানা মেলবে শব্দেরা।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চর্চা করার জায়গা ফেসবুক নয়, তাও আমাদের নিম্ন ও মধ্যমেধার সাহিত্যচর্চায় একটু বেশি বেশি ঢুকে পড়ে তিনি যদি সকলকেই অনুশীলনে সাহস যোগান , নিলডাউনে বসিয়ে রেখে একটু আধটু শাস্তি দেন, তাহলে হয়ত আমরা বর্তে যাই।
যে মানুষ, ‘আড়াই বছর বয়স থেকে আমার দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস আমি মোটামুটি জেনেছি।’ – একথা বলতে পারেন, তাঁকে নিয়ে রোমাঞ্চ জাগে, তবে এই উপলব্ধির ব্যবচ্ছেদ করার দুঃসাহস আসে না।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।