কলকাতা শহরের এক দরবেশ: অশোক সেকসরিয়াসুমিত চক্রবর্তী সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব
অশোক সেকসরিয়াকে (১৯৩৪-২০১৪) তাঁর বন্ধুজন অশোকজি বলেই ডাকতেন। “মেরে শহরকা এক দরবেশ” শীর্ষকে অশোকজি সম্পর্কে তাঁরই কলকাতার বন্ধু কৃষ্ণবিহারী মিশ্র রাঁচি থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র “প্রভাত খবর”-এ (২০-এ সেপ্টেম্বর ১৯৯২) একটি পাতা জোড়া প্রবন্ধ লিখেছিলেন অশোকজির জীবনকালেই। “কলকাতা শহরের এক দরবেশ” নামটি সেখান থেকেই নেওয়া। তাঁর সম্পর্কে ভাবলে বিশেষ কোনো দক্ষতা অথবা গুণ নয়, বরং সমগ্র মানুষটিই মনের মধ্যে ভেসে ওঠেন। সোজা চুল, অবিন্যস্ত দাড়ি, ঈষৎ অপরিষ্কার খদ্দরের পাজামা পাঞ্জাবী অথবা ফতুয়া পরা লম্বা চওড়া দরদী মানুষটি কিছুটা অপরিষ্কার বিছানায় বসে আছেন। বিছানার উপর বড়ো মাটির ভাঁড় অথবা স্টিলের বাটিতে সবচেয়ে কমদামী, ফিল্টারহীন “ভারতীয় কোম্পানি”-র রিজেন্ট সিগারেটের আট দশটা পোড়া টুকরো। কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন, বার বার নিভে যায় বলে বিড়ি খেতে পারতেন না। প্রায়ই দেখা যেত, বাঁ হাতে সিগারেট, ডান হাতে সস্তার ডট পেন, ক্লিপবোর্ডে কারো লেখা, প্রেসে যাওয়ার আগে পড়ছেন, সম্পাদনা করছেন, অথবা কারো লেখার প্রুফ দেখতে দেখতেই সম্পাদনা করছেন। এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় লেখা এবং লেখক ক্রমশ স্বরূপে স্পষ্ট হয়ে উঠবেন।
সাহিত্য, সাংবাদিকতা, রাজনীতি এবং প্রায় সমস্ত রকম খেলা সম্পর্কে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল এবং একেবারে হালফিলের খবর রাখতেন। একই সাথে এই দুনিয়ার কদর্যতা এবং বিশেষ করে ক্রিকেটের বাণিজ্যিকীকরণের তীব্র সমালোচক ছিলেন তিনি। আগ্রহ এবং সমালোচনার যুগ্ম সহাবস্থান ছিল তাঁর মধ্যে। তাঁর সঙ্গে তাঁর বন্ধুস্থানীয় জহর গোয়েল আলোচনা করছিলেন ভারতীয় হকির স্বর্ণযুগের কথা। হাঁটুর উপরে হকি স্টিক উঠত না। মনে আছে, সেই খেলার সাথে তাঁরা ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের তুলনা করেছিলেন। কিভাবে ইউরোপ নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অ্যাস্টোটার্ফের কোর্টে হকি খেলা বাধ্যতামূলক করে এবং ভারতীয় হকির দুর্দিন নেমে আসে, সেই কথা তাঁদের আলোচনায় শুনেছিলাম সেদিন। বহু মানুষ আসতেন তাঁর কাছে। কেউ প্রয়োজনে, কেউ নিতান্তই সাহচর্য পেতে। গভীর মানসিক সমস্যায় থাকা কোনো কোনো মানুষের জীবনে তাঁর সাহচর্য একপ্রকার শীতল ছায়ার কাজ করত।
তিনি হিন্দিতে লিখতেন। তাঁর অধিকাংশ লেখা, বিশেষত গল্প, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাও লিখেছেন। তবে সেগুলো প্রকাশিত হয় নি, এমনকি তাঁর পরিচিতরাও প্রায় কেউ জানতেন না যে তিনি কবিতা লেখেন। তাঁর বন্ধুস্থানীয় একজনের কাছে শুনেছিলাম, অশোকজির ইচ্ছা, তিনি ধুলো হয়ে যেতে চান। তাঁর অপর এক বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তির কাছে শুনেছিলাম, অশোকজির ভাবনা ছিল, যশোলিপ্সার পথে চলার আগে যেন তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে যাঁরা চিনতেন তাঁরা জানেন, যশ-ক্ষমতালিপ্সার বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তিনি চালিত ছিলেন। অশোকজি সব মিলে বছর দশেক বিভিন্ন কাগজে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। অশোকজির জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবই কলকাতায়। ১৯৫৮ সালে তিনি দিল্লি যান এবং বিড়লাদের হিন্দি পত্রিকা “দৈনিক হিন্দুস্তান”-এ সাংবাদিক হিসেবে কাজে যোগ দেন। পরে আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর হিন্দি সাপ্তাহিক “রবিবার”-এও কাজ করেছেন। ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে লেখা তাঁর রিপোর্ট বহু দশক বাদেও মানুষকে স্মরণ করতে দেখেছি। তাঁকে না জানিয়ে বিভিন্ন ছদ্মনামে লেখা তাঁর হিন্দি গল্পের একটি সংকলন “লেখকী” তাঁর বন্ধুরা প্রকাশ করেছিলেন বিকানির চন্দনসাগরের বাগ্দেবী প্রকাশন থেকে, ২০০০ সালে, তাঁর জীবিতকালেই।
১৬, লর্ড সিনহা রোড
অবিবাহিত মানুষটি মধ্য কলকাতার লর্ড সিনহা রোডে থাকতেন। খদ্দরের পোশাক পরতেন। তাঁর ঘরে টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ছিল না। বহু বছর তাঁর ঘরে টেলিফোন ছিল না। ফলে বাড়ি আছেন কিনা খবর নিয়ে তাঁর কাছে আসা মুশকিল ছিল। বহু মানুষ বাড়িতে এসে তাঁকে না পেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সেখানে বসে থেকেছেন, হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছেন। তাঁর বড়ির দরজা সবসময় খোলা থাকত। অশোকজি দোতালায় থাকতেন। তবে প্রায়ই তাঁদের বাড়ির একতলায় ভাইয়ের ঘরে অশোকজির ফোন আসত, নিচে থেকে কাউকে এসে তাঁকে খবর দিতে হতো। পরে ভাইয়ের সংসার থেকে তাঁকে টেলিফোন নিতে একপ্রকার বাধ্য করা হয়। মৃত্যুর আগে শেষ ১০-১২ বছর তাঁর ঘরে টেলিফোন ছিল।
খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা
চোদ্দ বছর বয়সে অশোক সেকসরিয়া টেবিল টেনিস-এ জুনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি হিন্দিতে বাচ্চাদের ক্রিকেট শেখার একটা বই লিখেছিলেন, যেটা এখন পাওয়া যায় না। গলিতে বাচ্চাদের দল ক্রিকেট বা অন্য কোনো খেলা খেলছে দেখলে দাঁড়িয়ে যেতেন, মন দিয়ে খেলা দেখতেন। ঘরে টিভি না থাকলেও ক্রিকেট দেখতে চলে যেতেন যেখানে টিভি আছে।
অশোকজির বিকাশে বাবার প্রভাব: পারিবারিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবন
নিজের লেখা যত্ন করে না রাখলেও বন্ধুদের লেখা এমনকি তাঁর কাছে আসা চিঠিপত্র তিনি খুব যত্ন করে রাখতেন। ছোটোবেলায় হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে তিনি গান্ধীজির কাছে চাঁদা পাঠিয়েছিলেন, প্রাপ্তি স্বীকার করে গান্ধীজির লেখা পোস্ট কার্ড বহুদিন অব্দি গুছিয়ে রেখেছিলেন। পরে হারিয়ে যায়। এই হারিয়ে যাওয়া নিয়ে তাঁর আফশোস ছিল। অশোকজির বাবা প্রয়াত সীতারাম সেকসরিয়া (১৮৯২-১৯৮২) ১৯৩৬ সাল থেকে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক এবং ঘনিষ্ঠতা ছিল। এমনকি, আইএনএ কে সাহায্য করার জন্য কলকাতায় কর্মরত একটি গোষ্ঠীর সঙ্গেও সীতারামজি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে সুভাষচন্দ্রের কাছে গান্ধীর পরাজয়ের পর গান্ধী এবং গান্ধী অনুগামীদের অসহযোগিতা এবং নানা রকম কুটিলতার পরিণামে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস ত্যাগ করতে বাধ্য হলে, সীতারামজি অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিলেন এবং এই সংঘাতের বাইরে যাতে কংগ্রেস বেরতে পারে, নিজের সাধ্যমত সেই চেষ্টাও করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯১১ সালে ১৯ বছর বয়সে সীতারাম সেকসরিয়া রাজস্থানের নবলগড় জেলা থেকে পাকাপাকি ভাবে কলকাতা চলে আসেন এবং রায় সাহেব সিউপ্রসাদ ঝুনঝুনওয়ালার ব্যবসায় ম্যানেজার, খাজাঞ্চি ইত্যাদি পদে কাজে যোগ দেন। তখন তিনি বিবাহিত। সীতারামজি দিনলিপি লিখতেন। অশোকজি বাবার সেই দিনলিপি ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৪২ সাল অবধি সম্পাদনা করে “এক কার্যকর্তা কি ডায়রী” নামে দুই খন্ডে প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম খন্ডে ১৯২৯-১৯৩৫ কালপর্ব এবং দ্বিতীয় খণ্ডে ১৯৩৬-১৯৪২ কালপর্ব সম্পাদনা করেছেন। প্রকাশ করেছিল নতুন দিল্লির ভারতীয় জ্ঞানপীঠ প্রকাশন, ১৯৭২ সালের অক্টোবরে। পরবর্তী অংশ, বিশেষ করে ক্ষমতা হস্তান্তর পরবর্তী ভারতীয় রাষ্ট্র এবং রাজনীতির অবক্ষয়কে প্রকাশ করে লেখা দিনলিপির অংশ সম্পাদনা করে প্রকাশ করার ইচ্ছা অশোকজির ছিল। কিন্তু সেটা তিনি করতে পারেননি। এক আত্মীয়া ছলনার আশ্রয় নিয়ে তাঁর কাছ থেকে ডায়রিগুলো নিয়ে যায় এবং অশোকজির সনির্বন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও ফিরিয়ে দেয়নি। অশোকজি তাকে বলেছিলেন, আমি ছাড়া আর কেউ এই ডায়রি সম্পাদনার কাজ করতে পারবে না, মরে যাওয়ার আগে এই কাজটা আমি করে যেতে চাই। লাভ হয় নি। এই প্রসঙ্গে অশোকজিকে বলেছিলাম, “আপনার তো ক্ষমতাশালী প্রচুর লোকের সাথে যোগাযোগ আছে। আপনি চাইলে তাদের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে আপনার আত্মীয়ার কাছ থেকে ডায়রিগুলো আনাতে পারেন”। কিন্তু, তিনি সেই চাপ সৃষ্টি করতে রাজি হননি। হয়তো এই ডায়রি সম্পাদনার কাজটা করতে পারলে অশোকজি আরো কিছুদিন বাঁচতেন। অথচ এই আত্মীয়া নিজের শ্বশুরবাড়িতে নানা জটিলতার কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়লে অশোকজি নিজেকে বিপন্ন করে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন। তাকে সাহায্য করতে গিয়ে অশোকজির একমাত্র অর্থসংস্থানের পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিভাবে টাকাপয়সার সংস্থান করবেন ভেবে অশোকজির সেই দিশেহারা অবস্থার কথা মনে পড়ছে। বলতেন, “ভয় করে”। কিসের ভয়, জিজ্ঞেস করলে বলতেন, “ভয় করে”।
সীতারাম সেকসরিয়া সাহসী ব্যাক্তি ছিলেন। ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে (৬-ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২) হত্যার চেষ্টা করে সাজাপ্রাপ্ত বাংলার বিপ্লবী কন্যা বীণা দাসকে রবীন্দ্রনাথ চাকরি দিতে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সীতারামজি তাঁকে শিক্ষকতার চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। যাই হোক, এই পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা অশোকজি সপ্তম দশকে(১৯৬১-১৯৭০)-র শুরু থেকে আজীবন সোশ্যালিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। তিনি “সমতা সংগঠন” এবং পরবর্তীকালে তার থেকে গড়ে ওঠা “সমাজবাদী জনপরিষদ” নামক রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। যদিও দলীয় সদস্যপদ কখনো গ্রহণ করেন নি। সোশ্যালিস্ট আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা “সাময়িক বার্তা”-র সঙ্গে শুরু (১৯৭৭) থেকে আমৃত্যু কাজ করেছেন। প্রসঙ্গত জানানো যেতে পারে, মতাদর্শের দিক দিয়ে “সমতা দল” বা “সমাজবাদী জনপরিষদ” দলগুলোর সঙ্গে রামমনোহর লোহিয়া, জয়প্রকাশ নারায়ণ এঁদের ভাবনার মিল রয়েছে। অশোকজি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। নন্দীগ্রামে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কখনই তৃণমূল সমর্থক হয়ে ওঠেন নি। অশোকজি অত্যন্ত খোলা মনের মানুষ ছিলেন। নিজের “মত”-এর প্রেমে পড়ে যেতেন না। এই প্রসঙ্গে দুটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। “সমাজবাদী জনপরিষদ” দলের নিষ্ঠাবান কর্মী ছিলেন সুনীল (১৯৫৯-২০১৪)। মৃত্যুর আগে বছর তিনেক সুনীল অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে “সাময়িক বার্তা”-র দায়িত্ব সামলেছেন। সুনীল অকালে প্রয়াত হলে, সুনীল সম্পর্কে অশোকজি বলেছিলেন, “He was growing”। সেই “সমাজবাদী জনপরিসদ” থেকে ২০০৯ সালে পঞ্চদশ লোকসভা ভোটে সুনীল হোশাঙ্গাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করা হয়েছিল। অশোকজি এই ভোটে দাঁড়ানো সমর্থন করে কথা বলছিলেন, আমি বিরোধিতা করে কথা বলি। আলোচনার পর ওনার আগের মত বদলে গেল দেখলাম। এরকমই আর একটি ঘটনার কথা ওনার বন্ধুস্থানীয় কাজল মুখার্জি-র কাছে শুনেছি। ২০১১ সালে অশোকজি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দেবেন না ঠিক করেছিলেন। কাজলদারা তাঁকে বলল, অন্যবার যা করেছেন করেছেন, এইবার বামফ্রন্টকে সরাতেই হবে। অশোকজি মত বদলে ফেললেন। কে কি যুক্তি দিয়েছিলেন সেটা বলা ততটা জরুরি মনে হচ্ছে না। যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল ― তাঁর মতো অভিজ্ঞ, রীতিমতো খোঁজ খবর রাখা মানুষ কতটা খোলা মনের হলে এভাবে নিজের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন!
সীতারামজি “ভারতীয় ভাষা পরিষদ” এবং “শ্রীশিক্ষায়তন” স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। “ভারতীয় ভাষা পরিষদ” কর্তৃপক্ষ ২০০৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল খুলে ব্যবসার উদ্যোগ নিলে এবং “শ্রীশিক্ষায়তন” স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রায় একই সময়ে সাত আটজন নিম্নপদস্থ কর্মচারীকে বরখাস্ত করতে চাইলে অশোকজি প্রায় একক প্রচেষ্টায় তা রুখে দেন। “শ্রীশিক্ষায়তন” স্কুলের ক্ষেত্রে তিনি পরিচালন কমিটির প্রধানের গাড়ির সামনে রাস্তায় শুয়ে পড়েছিলেন। আগেই বলেছি, একটা সময় তিনি দিল্লিতে থাকতেন, বিড়লাদের “দৈনিক হিন্দুস্তান” হিন্দি সংবাদপত্রে কাজ করতেন। সেসময় কয়েকজন সহকর্মীর প্রতি পত্রিকা ম্যানেজমেন্টের অসদাচরণকে মেনে নিতে না পারায় ম্যানেজমেন্টের কুনজরে পড়েন। তাঁকে শাস্তিমূলক বদলি করা হলে তিনি এখানকার সাতশো টাকা মাইনের চাকরি ছেড়ে দেন। পরে রামমনোহর লোহিয়া তাঁর বের করা “জন” পত্রিকায় অশোকজিকে ডাকলে আড়াইশো টাকা মাইনেতে সেখানে যোগ দেন। অশোকজির মৃত্যুর পরে তাঁর সম্পর্কে শিবানন্দ তিওয়ারির স্মৃতিচারণায় এগুলো জেনেছি। শিবানন্দ তিওয়ারির লেখা থেকে আরো জানতে পারি, দিল্লিতে ১৯৭১ সালে সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টির কৃষক আন্দোলনে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করে, একজন মারা যান, বহু মানুষ আহত হন, তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অশোকজি ভর্তি হওয়া আন্দোলনকারীদের দেখতে, কার কি লাগবে খোঁজ খবর নিতে নিয়মিত হাসপাতালে যেতেন। অনেক আন্দোলনকারী গৌরব তিলক হিসেবে নিজেদের জখম চিহ্ন প্রদর্শন করতেন। সেই সময় একদিন, যেখানে থাকতেন, সেই সাংসদ বাংলোর সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের বাইরের কলে যখন তিনি চান করছিলেন, শিবানন্দজি দেখেন, অশোকজির শরীরে রীতিমতো লাঠিপেটার দাগ!
২৯-এ নভেম্বর ২০১৪
বন্ধুকে লেখা তাঁর একটা চিঠি থেকে জানা যায়, অশোকজির জন্ম ১৯৩৪ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে। তারিখ জানান নি। আশি বছর বয়সে ২০১৪ সালে নভেম্বরের এক সকালে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে তাঁর ঊরুসন্ধির (hip joint) হাড় ভেঙে যায়। দিন দশেক বাড়িতে পড়েছিলেন, তারপর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অপারেশন হয়। হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে ২৯-এ নভেম্বর ২০১৪ রাতে তিনি মারা যান। ৩০-এ নভেম্বর সকাল ৭-৮ টার সময় যখন শেষবারের মত অশোকজিকে দেখতে তাঁর বাড়িতে যাচ্ছি, “শ্রীশিক্ষায়তন” স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম, স্কুল গেটের ভেতরে কেউ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মনে হল, যাঁদের চাকরি বাঁচানোর জন্য উনি স্কুল পরিচালন কমিটির প্রধানের গাড়ির সামনে রাস্তায় শুয়ে পড়েছিলেন, তাঁদেরই কেউ কাঁদছেন। তাঁর ব্যবহার করা জিনিস, তাঁর এবং তাঁর সম্পর্কিত লেখা ইত্যাদি দিয়ে সঞ্জয় ভারতী “অশোকায়তন” বানিয়েছে। সঞ্জয়ের ঠিকানা বদলের সাথে সাথে “অশোকায়তন”-ও ঠিকানা বদলে চলেছে। সঞ্জয়ের ভাষায় অশোকজি ছিলেন সঞ্জয়ের “মিত্রবৎ গুরুজন”। তিনি চলে যাওয়ার পর জানুয়ারি ২০১৫ সালে “সাময়িক বার্তা” পত্রিকা অশোক সেকসরিয়া স্মৃতি সংখ্যা বের করেছে। আজও প্রতি বছর ২৯-এ নভেম্বর তাঁর প্রিয়জনরা তাঁকে স্মরণ করতে মিলিত হন।

লেখার সঙ্গে ওপরে পোস্ট করা অশোক সেকসরিয়ার ছবিটি ২০১২-২০১৩ সাল নাগাদ তোলা।
Copyright (c) 2025 by Sumit Chakraborty. This is an open access article distributed under the terms of the Creative Commons Attribution-Noncommercial-No Derivative License (see
http://creativecommons.org/licenses/by-nc-nd/3.0/us/), which permits anyone (if he/she so wishes) to share this article, provided (1) the distribution is only for noncommercial purposes, (2) the original author and the source are attributed, and (3) no derivative works including any alterations are made. For any distribution, this copyright statement should also accompany the article without any alteration and in its entirety, and the publication history should also accompany the article.
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।