আমার সহকর্মিনী ও দিদি বল্লরীদি আমাদের কলেজে আসার আগে কোচবিহার কলেজে পড়াতো। তাই উত্তর বঙ্গে এলে ওর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যায়। কথায় কথায় ও বলল, কোচবিহার কলেজে থাকাকালীন একবার এমন একটা জায়গায় ও সহকর্মী আর প্রিন্সিপালের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল, সেখানে কেবল জঙ্গল আর নদী। কিন্তু ডুয়ার্সের অন্য জঙ্গল আর নদীর থেকে সে জায়গাটা আলাদা, কারণ সুন্দরবনে যেমন নৌকো করে জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করা যায়, জঙ্গলটাকে কাছ থেকে অনুভব করা যায়, এখানে তেমনই নৌকো করে ডুয়ার্সের জঙ্গলের হৃদয়ে প্রবেশ করা যায়। কিন্তু এখন কিছুতেই নামটা মনে পড়ছেনা। শুনে তো আমাদের ভীষণ আগ্রহ। বল্লরীদিকে ঘিরে ধরলাম, প্লীজ প্লীজ একবার মনে করার চেষ্টা কর। মনে আর পড়েনা। শেষে কনিষ্ঠ মধুসূদন বলল, আসুন বল্লরীদি, ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে ঐ অন্ধকার জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে মনোনিবেশ করুন। নামটা মনে না পড়ে যাবেনা। হোটেলের আলোর ক্ষীণ রেশ যত দূর যায়, তত দূর গাছের মাথার রেখার আবছা আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু তারপর ঘন কৃষ্ণ দেওয়ালে দৃষ্টি আটকে যায়, সবই একাকার। এক এক পল কাটছে, আমাদের উত্তেজনার পারদ আরও উঁচুতে উঠছে। বল্লরীদির মুখটা আরও করুণ হচ্ছে। মনে পড়ি পড়ি করেও শেষ রক্ষা হচ্ছেনা। আধঘণ্টা কাটল, মশককুলের মহাভোজ শুরু হয়েছে। প্রতি মুহূর্তেই আমন্ত্রিত মশক অতিথির নতুন নতুন ঝাঁক জলদাপাড়ার জঙ্গল থেকে হোটেলের বারান্দায় পদার্পণ করছে। আমরাও হাল ছাড়ার পাত্র নই। বল্লরীদি বলল দাঁড়াও আমি পুরোনো কলিগদের ফোন করি। তেমনই একজন চলভাষের ওপার থেকে জানালেন, জায়গাটার নাম উত্তর পানিয়ালগুড়ি। ব্যাস, কেল্লা ফতে। ঐ একটা নাম সম্বল করে আমরা সকলে যে যার চলভাষে আন্তর্জালের অলিগলিতে খোঁজাখুঁজি শুরু করি। বেশি চেষ্টা করতে হয়না। একটু পরেই নদীর নাম বেরিয়ে পড়ে : সিকিয়া ঝোরা।
সেখানে কী আছে, কিভাবে যাওয়া যায় একটা দিশা পাওয়া যায়। আগে যাঁরা গেছেন, তাঁদের লেখা, তাঁদের তোলা স্থিরচিত্র বা চলচ্ছবি আমাদের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে তোলে। হোটেলের মালিক, গাইড, গাড়িচালক, ট্যুর অপারেটর সবার সঙ্গে আলোচনায় বসে যাই। ঠিক হয়, ফেরার দিন সময় বার করে জায়গাটা একবার ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে। ফিল্ড সার্ভের অন্তিম দিনের শেষ বিকেলে নিউ আলিপুরদুয়ার থেকে রেলগাড়ি চাপতে হবে। সারাদিনে অনেকটাই সময়। বক্সা জয়ন্তী থেকে ফেরার পথে প্রায় বিকেল তিনটে নাগাদ ছখানা ভাড়া গাড়ি করে মোট একচল্লিশজন পৌঁছলাম উত্তর পানিয়ালগুড়ি গ্রামে।
বেশ শান্ত প্রকৃতি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিকিয়াঝোরা ইকোট্যুরিসম ক্যাম্পাসে ঢোকার মুখেই টিকিট কাউন্টার। মাথাপিছু কুড়িটাকা দিয়ে টিকিট কেটে ভিতরে ঢোকা গেল। ঢুকেই ডানদিকে একটি বড় ক্যান্টিন। চা আর টুকিটাকি জলখাবার পাওয়া যায়। দুপুরে ভাতও মিলবে। একটা জিনিসে চোখ আটকে গেল, বসার টুল আর সামনের টেবিল সবই চা গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি। উত্তর বঙ্গের গর্ব তার চা বাগান। বাগানের বয়স পঁচিশ বছর হলে উৎপাদন কমে। তাই ঐ বয়সী সব পুরোনো গুঁড়ি তুলে ফেলে, নতুন চা গাছ লাগানো হয়।
এলাকার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে সিকিয়া ঝোরা। এটি ডুয়ার্সের বালা নদীর উপনদী, জন্ম জয়ন্তী পর্বত শ্রেণীতে। সামনে একটি বাঁশের ব্রিজ। পেরিয়ে ওপারে গেলে হাল্কা জঙ্গল। ভিতরে বেশ পরিপাটি বসার জায়গা করা আছে। অনতিদূরে ঘন জঙ্গলের হাতছানি। ডানদিকে ক্যান্টিন ছাড়িয়ে একটু এগোলেই সামনে বাচ্চাদের খেলার জায়গা। দোলনা আছে। প্রকৃতির কোলে বড়দেরও ছোট হতে ইচ্ছে করে। তাই বড়রা গেলেও কারোর আপত্তি নেই। ঘাসের মধ্যে শুঁড়ি পথ ধরে আরও এগোলে নৌকোর ঘাট। ঘাটের দিকে এগোচ্ছি, হঠাৎ একটা কোলাহল কানে এল। পিছনদিকে তাকাতে না তাকাতে দেখি, ছেলেমেয়েরা বাঁশের ব্রিজের দিকে দৌড়োচ্ছে। কি হল রে বাবা, হাঁচড় পাঁচড় করে ওদের অনুসরণ করি। দেখি জলের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো গতিতে হিলহিল করে চলেছে এক বিরাট গোখরো।
নৌকোর ঘাটে দুটি নৌকো, কিন্তু সাধারণ নৌকোর মতো দেখতে নয়, বরং পার্কের মোটর চালিত বোটের মতো রঙচঙে, গড়নটাও সেরকম। নৌকোর গতির দিকে মুখ করে বসার বন্দোবস্ত অর্থাৎ নৌকোর খোলের দিকে আড়াআড়ি পরপর বেঞ্চি পাতা। এক একটি নৌকোয় তিরিশ জনের মতো বসতে পারে। একজন করে মাঝি, তিনি দাঁড়িয়ে লগি ঠেলছেন। আমরা একচল্লিশজন মোটামুটি সমভাগে দুটি বোটে চেপে বসলাম। নৌকাবিহারের জন্য পারানি আলাদা গুনতে হয়।
নৌকো চলতে শুরু করে। জলপথে জঙ্গল ভ্রমণের জন্য সময় বরাদ্দ আধঘণ্টা। এখন ঘড়িতে সময় বিকেল সাড়ে তিনটে। জঙ্গলের নিয়ম অনুসারে কোনরকম হৈচৈ বারণ। নৌকোর দুলুনিতে মনেও খুশির দোলা লাগে। ঝিরিঝিরি হাওয়া বয়। জঙ্গলের অপার্থিব শব্দ। সবাই চুপ করে আছি। আমরা টিচার, স্টুডেন্ট আর এই প্রকৃতি সবাই যে এক, কোনো অমিল নেই, সেই কথাটা বড় একান্তভাবে অনুভব করি। জীবনের কত দায়িত্ব, না পাওয়ার বেদনা, বিশ্বাসভঙ্গের ব্যথা, শারীরিক কষ্ট, সব ভুলে যাই। নিজেকে ভীষণ হাল্কা লাগে। জীবনটা কানায় কানায় পূর্ণ মনে হয়।
কয়েক মুহূর্ত পরেই জলের দিকে নজর পড়ে। জলের তলায় দৃষ্টি থিতু হতেই চমকে উঠি। একি!! তবে কি এটাই রূপকথার পাতালপুরীর রাজকন্যের রাজত্ব!! জল কাচের মতো স্বচ্ছ নয়, আবার ঘোলা অস্বচ্ছও নয়। বলা যেতে পারে হালকা সবুজ অনচ্ছ, ইংরেজিতে যাকে বলে translucent, জলের তলায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অসংখ্য ধরণের জলজ উদ্ভিদ। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে, পাতা ওয়ালা একধরণের লম্বাটে গাছ। মনে হল বড় হোটেলের বড় অ্যাকোরিয়ামে আমি এমন গাছ দেখেছি। আকাশে ঝকঝকে সূর্য। কিন্তু নদীর ওপরে গাছের ছায়া। তাই খোলা নৌকোয় থাকলেও একটুও রোদ লাগছেনা। নদী অবশ্য খুব চওড়া কিছু নয়।
দুপাশ থেকে জংলি গাছ ঝুপসি হয়ে ঝুঁকে পড়েছে জলের ওপর। আমরা এখন নদীর বাঁপাড়ের কাছ দিয়ে চলেছি। ঠিক পাশ দিয়ে নয়, বলা যেতে পারে নদীখাতের মধ্য রেখা থেকে একটুখানি বাঁদিকে সরে রয়েছি। এর চেয়ে বেশি কাছে গেলে বিপদ হবে। জঙ্গল এত ঘন, মাঝে মাঝে ফাঁকগুলো মনে হচ্ছে যেন গাছ ঢাকা আদিম গুহা। নৌকোর মাঝি এমনই একটি গাছ - গুহার সামান্য কাছে নৌকোর গতি কমিয়ে বললেন, দেখুন। জঙ্গলের অন্ধকারে চোখটা সইয়ে নিয়ে মনে হল, একটা ছিট ছিট চাদরের মতো কিছু নিচু গাছের ডালে আটকে রয়েছে। আমাদের সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে মাঝি জানালেন ওটা হরিণের দেহাবশেষ। গত পরশু চিতাবাঘের বনভোজনের চিহ্ন। বনের ভিতর গাঢ় অন্ধকার। মাঝি বলেন অনেক জোড়া চোখ আমাদের লক্ষ্য করছে। আমরা দেখতে পাচ্ছিনা। গা ছমছম করে ওঠে। একটু এগিয়ে নদী খানিক চওড়া। তার পরে একটা ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো বাঁক। বাঁক ঘুরে দেখা যায় জঙ্গলের অন্দরমহল আর ঝুঁকে পড়া গাছে ঢাকা বহুদূর জলপথের সুড়ঙ্গ। জলে মেঘের ছায়া আর পড়ন্ত বিকেলের সোনা রং। সব মিলিয়ে চোখে ঘোর লাগে। আমি কি ছিন্ন ওজোন গ্যাসের চাদরে মোড়া, কার্বন মনোক্সাইডের বিষবাষ্পে জ্বরাক্রান্ত পৃথিবীতেই আছি, নাকি বিজ্ঞানী হকিন্সের কল্পনার মতো মানুষ খুঁজে বার করেছে এ এক অন্য আদিম গ্রহ, মানুষের যন্ত্র সভ্যতা যাকে কলুষিত করেনি।
হঠাৎ তাল কাটে। নৌকো মুখ ঘুরিয়ে ফেরার রাস্তা ধরে। সকলে একসঙ্গে ককিয়ে উঠি, কী হল!!! মাঝি জানান সরকারী নিয়ম অনুযায়ী পর্যটকদের এই পর্যন্তই নিয়ে যাওয়া যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি টাকার বিনিময়ে আরও কিছুদূর ওঁরা নিয়ে যান বটে, তবে তা নিরাপত্তা বিচার করে। বিশেষ ট্রেনিং, পোষাক, উপকরণ ছাড়া আরও গভীরে যাওয়া সমীচিন নয়। ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা সবার আগে। আর ফিল্ড সার্ভের শেষদিনে বাড়তি টাকার যোগাড় নেই। তাই ফিরতেই হয়। সবাই মিলে অনুনয় করি আরও একটু গেলে কী দেখতে পেতাম, প্লিজ বলুন। মাঝি বলেন অনতিদূরেই আজ নিয়ে তিনদিন বিরাট অজগর জলের ধারে শুয়ে রয়েছে।
ফেরার পথে নৌকো অপর পাড় ধরে আগের নিয়মেই চলে। কিন্তু এদিকে কাদা বেশি। ছোটদের ভূগোল বইতে নদীখাতের প্রস্থচ্ছেদ সবসময়ে ইংরেজি V অথবা U অক্ষরের মত আঁকা হয়। তবে সত্যিকারের নদীখাতের দেয়াল অমন দেখতে কমই হয় বরং ঐ ইউএর মেঝেটা একদিকে একটু বেশি গভীর আর অপর দিকটা অগভীর থাকে। আসলে জল তো এঁকে বেঁকে চলে, তাই এক একটা নদীবাঁকের পিঠের দিকে জলের ধাক্কা বেশি লাগে, ওদিকে পাড়টা খাড়াই আর খাতটা গভীর হয়ে যায়। বাঁকের কোলের দিকে ঠিক উল্টো, ওদিকটা ধাক্কা কম লাগে তাই পলি জমে অগভীর হয়ে যায় - এটাই স্বাভাবিক। আমরা যাবার সময়ে গভীর অংশটা দিয়ে যাচ্ছিলাম, ফেরার দিকটা তাই কাদার চড়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে কিছুদূর অন্তর অন্তর কাদার মধ্যে একসঙ্গে অনেক গর্ত দেখতে পাচ্ছিলাম। কারণটা আন্দাজ করেছিলাম অবিশ্যি। মাঝির কথায় নিশ্চিত হলাম। এগুলি গজরাজদের নদী পারাপারের চিহ্ন। এদিকটায় জলের ওপরে অনেক ঝাঁঝি। তারমধ্যে পানকৌড়ি আর বুনো হাঁস। গাছে গাছে কত যে পাখি, কাঠবিড়ালি আর ঝোপে ঝোপে কত যে প্রজাপতি, ফড়িং, ভোমরা তার হিসেব নেই। তারা যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। আবার ঘাটে ফিরে আসি। অনেক কিছু পেলাম। কিন্তু আরও একটু বেশি পেলে কি আরও ভালো হতনা!!!
জায়গাটা ছেড়ে যেতে কারোরই ইচ্ছে করছেনা। পায়ে পায়ে হেঁটে এসে ক্যান্টিনে বসি। চা খাই। তখনই জানতে পারলাম, এই প্রকল্পটি সম্পূর্ণভাবে মহিলাদের সেল্ফ হেল্প গ্রুপ দ্বারা পরিচালিত। সদস্য মহিলারা নিজেই এসে আলাপ করেন। অনুরোধ করেন, পর্যটকদের মতামতের খাতায় যেন কিছু লিখে দিই। প্রকল্প এলাকার ভিতরে নতুন বাড়ি, শৌচাগার তৈরি করা হয়েছে। এখনও উদ্বোধন হয়নি। এখানে সরকারী ট্যুরিস্ট লজের মতো পর্যটকেরা থাকতে পারবেন। তবে বাইরে থেকে দেখে যা মনে হল ঘরগুলি সাদামাটা, বেশি বাহুল্য নেই। চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে বেশ সাযুজ্য আছে। এটি পুরোনো প্রকল্প। কিন্তু মাঝে নানা সমস্যায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে গতবছর মানে ২০১৮ সালে নাম বদলে খোলা হয়েছে। প্রকল্প চালিয়ে যা আয় হয়, তার এক অংশ সরকারী কোষাগারে জমা পড়ে। বাকিটা সদস্যদের মধ্যে ভাগ হয়। আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের মহিলারা এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। আলাপ জমে উঠেছে। এমন সময়ে বনদপ্তরের সরকারী আধিকারিক পৌঁছলেন পরিদর্শনে। মহিলারা আবার সেদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমরাও এবার ওঠার তোড়জোড় করি। হঠাৎ দেখি দুই মহিলা ছুটতে ছুটতে আসছেন। হাত দেখিয়ে আমাদের দাঁড়াতে বলছেন। কাছে এসে অনুরোধ করেন, আমরা যেন সরকারী আধিকারিককে বলি, আমরা এখানে এসে সরকারী আবাসে থেকে ডুয়ার্সের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাই, তাই তাড়াতাড়ি যেন পর্যটক আবাস চালু করা হয়। নৌকোর সংখ্যা যেন বাড়ানো হয় আর যে নৌকোগুলি আছে, সেগুলি যেন মেরামত করে ভালো রাখার ব্যবস্থা করা হয়। মহিলাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা কলেজের দিদিমণি, মাস্টারমশাইরা বললে, স্যার না করতে পারবেননা। তাঁদের সরল, অকপট অনুরোধ না রাখার কোনো কারণই নেই। কারণ এগুলো আমাদেরও মনের কথা। আধিকারিক অল্পবয়স্ক অমায়িক ভদ্রলোক। পরিদর্শনে এসেছেন। সঙ্গে তরুণী স্ত্রী ও তাঁর বাপের বাড়ির লোকজন বেড়াতে এসেছেন। কথাবার্তায় তিনি জানালেন খুব শিগগিরই আবাসটি উদ্বোধন হবে। পর্যটনের মানোন্নয়ন এখন রাজ্য সরকারের অন্যতম প্রায়োরিটি। কথা শেষ হলে প্রকল্পের পরিচালিকা মহিলারা হাত ধরে ধন্যবাদ জানান। সজল চোখে অনুরোধ করেন আবার যেন আসি। ধন্য আমার বাংলা ভূমি। মাত্র দুঘণ্টার আলাপে এত আন্তরিকতা, এত স্নেহ, চোখের জল। আমরা শহরের মানুষ, কেউ স্বার্থ ছাড়া বুঝিনা। বনের ধারের সরলতার ছোঁয়ায় মনটা একই সঙ্গে মুগ্ধ, তৃপ্ত কিন্তু ভারি হয়ে ওঠে। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করে। কিছুটা গেলেই নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশন। ট্রেনের টিকিট কাটা আছে। এবারের মতো বিদায় ডুয়ার্স। আমাদের বাড়িও ফিরতে হবে। ফেরার পথে দেখলাম রাস্তার ধারে সরকারী জমির সীমানায় বা বলা যেতে পারে ঘাড়ের ওপর বেশ কিছু নির্মীয়মাণ আধুনিক হোটেল রিসর্ট - কোন জায়গাকেই মানুষের লোভ শান্তিতে থাকতে দেবেনা। এর পর শুরু হবে নেশার ফোয়ারা আর বীভৎস ডিজের আওয়াজ। আমার ছোট্ট জীবনের অভিজ্ঞতায় জানি যে এ বাংলায় কলকাতার সীমানা ছাড়ালে শব্দের ব্যাপারে কোন আইনের শাসন চলেনা। কানেও শুনলাম যে উত্তর দক্ষিণ দুই পানিয়ালগুড়িতেই জমি এখন সোনা। জমি হাঙ্গরের দল চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। কিছুটা দূর যাবার পর এক গজরাজ বন থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে দুলকি চালে উদাসীন ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ আমাদের গাড়িগুলোকে সঙ্গ দিলেন, তারপর চুপচাপ মিলিয়ে গেলেন গভীর গহনে। হয়তো ভবিষ্যতের দুর্গতির কথা বলে গেলেন আমাদের। এই ঘটনা আসার দিনে হলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে হুল্লোড় পড়ে যেত। আজ যাওয়ার দিনে সবাই জানলা দিয়ে চেয়ে রয়েছে নির্বাক, দৃষ্টি সেই আঁধার হয়ে আসা বনপথের দিকে। আমি স্পষ্ট বুঝলাম, গজরাজের উদাসীন চলনের ভেতর যে গম্ভীর উচ্চারণ, তা ওরা শুনতে পেয়েছে। আমাদের মনতোষ স্যার বলতেন, কপালে চোখ কেবল মহাদেব ও দেবীর থাকেনা, আমাদের সবার থাকে, বোজা থাকে। সেই চোখ খুলে প্রকৃতির দিকে তাকাতে হয়। তবেই ওর কথাগুলো শুনতে পাওয়া যায়। যে শুনতে পায় তার উত্তরণ ঘটে। শুনতে চাওয়াটাই আমাদের সাধনা। পরের প্রজন্মের তৃতীয় নয়ন খুলে দেওয়াই আমাদের অভিভাবকদের কর্তব্য। ছাত্র-শিক্ষকের তৃতীয় নয়নে নয়নে বিদ্যুৎই আমাদের তপোবল। আমার কু ঝিকঝিক রেলগাড়ি তিস্তা নদী পেরোয়। আমিও চলে যাই একুশ বছর বয়সে। সুভাষ রঞ্জন বসু সিকিম থেকে ফেরার পথে আমাদের ব্রিজের গায়ে লাল দাগ দেখাচ্ছেন। জলপৃষ্ঠ ওর কাছাকাছি এলে ‘হাই অ্যালার্ট ফর ফ্লাড’। আমার কাঁচা বয়স থেকে পরিণতি - অনেক কিছুর সাক্ষী এই পাহাড় আর বন। আমার তপোবলের রোদ্দুর আর স্মৃতির মেঘ তিস্তার সবুজ জলে জাদু ঢেউ তোলে। সেই কবে ঋতুপর্ণ গান লিখেছেন - আমি ওনার সঙ্গে পূর্ণ সহমত।