এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  ইস্পেশাল

  • লক্ষ্মীর ঝাঁপি

    দময়ন্তী
    ইস্পেশাল | উৎসব | ২০ অক্টোবর ২০২৫ | ১৬৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • অবিস্মরণীয় নজরুল | বাঙালি বিদ্বেষ ও পরিচিতি নির্মাণের রাজনীতি | সোনম ওয়াংচুক: গণতন্ত্র কি শুধুই কাগজে-কলমে? | নবান্ন, গাজা থেকে বাংলার দুর্ভিক্ষ | দুই ঘর | সমসাময়িক | ফ্লোটিলা | ঢাকের দিনে ঢুকুঢুকু | দু-প্যান্ডেলের মাঝখানটায় | সুন্দরী কমলা নাচে রে | কাশী বোস লেনের পুজো : লড়াইয়ের হাতিয়ার | অস্তিত্ত্ব | শালপাহাড়ের গান | পুজোর দিনগুলি | অপেক্ষা-দিন | ভোলুরামের হাঁচি ও মত্তের উৎসব | এ অবধি আঠারো | মিনিবাসে গদার | জালিকাটু | তিনটি কবিতা | সাত সেতুর সাতকাহন | ফ্রান্স - একটি অবতরণিকা | শারদীয়া | বালিকা ও ইস্ত্রিওয়ালা | তিনটি কবিতা | গগন | যে জীবন গেঁড়ির, গুগলির | লা পাতা | দু’টি কবিতা | ধাতব পাখিটি একা | নিষিদ্ধ গন্ধ ছড়িয়েছে হাসনুহানা বলে | তিন ঋতুর কবিতা | গ্যেরনিকা | "এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন।" | ছায়া দুপুর | আমাদের ছোট নদী (২) | শারদ অর্পণ ২০২৫ | আমি হিটলারের বাবা | হিমাংশু ও যতীনবাবুদের খবরাখবর | যে চোখে ধুলো দেয় তার কথা | লক্ষ্মীর ঝাঁপি | উৎসব সংখ্যা ১৪৩২


    ১)

    কোথায় কারা যেন খুব হইচই করছে। ঘুমের মধ্যে অস্পষ্ট একটা জড়ানো গোলযোগ শুনতে পাচ্ছিল মিতা। মাথা মুখ চোখ জড়িয়ে থাকা ঘন কুয়াশার মত ঘুম ওকে পুরোপুরি জেগে উঠতে দিচ্ছিল না। বোজা চোখের পাতায় কমলাচে আভা, তার মানে সূর্য রতনদের ছাদ টপকে এসে গেছে মিতার জানলায়।
    কোথাও থালা বাসন পড়ে যাওয়ার ঝনঝন আওয়াজে ঘুমের ঘোরটা পুরোপুরি ছিঁড়ে যায় এবার।

    পিটপিটিয়ে চোখ খুলতে খুলতে মনে পড়ে আজ লক্ষ্মীপুজো। কোজাগরি পূর্নিমায় মা সারা বাড়ি জুড়ে আলপনা দিত। তখন অবশ্য ওদের একতলায় ছোট্ট দুটো ঘর আর সরু একফালি বারান্দা। মা তাও ছাদের দরজা থেকে গোটা সিঁড়ি জুড়ে লক্ষ্মীর পা আঁকত। লক্ষ্মী ঠাকরুণ নাকি ছাদ দিয়েই নামবে। এই নিয়ে ওরা ভাইবোনে কম হাসাহাসি করেছে। ভাগ হওয়ার আগে ওদের এজমালি বাড়িতে গোটা পাড়ার লোকের ভোগ খাবার নেমন্তন্ন থাকত।

    মায়েরা তিন জা আর ঠাম্মু দৌড়োদৌড়ি করে সব সামলাত। মন্টুর মাও সকালে একবার অন্য সব বাড়ির বাসন মেজে দিয়ে এসে এই বাড়িতে যে ঢুকত একেবারে মাঝরাত্তিরে বাড়ি যেত। ঠাম্মু দুধের ক্যান, টিপিন ক্যারিয়ার ভরে ছেলেমেয়েদের জন্য ফলপ্রসাদ আর ভোগপ্রসাদ দিয়ে দিত। অতবড় দোতলা বাড়ি জুড়ে আলপনা দিত ঠাম্মু একাই, আর কারো হাতের আঁকা পছন্দ হত না বুড়ির। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতে বসতে মিতার মুখে একটুকরো হাসি ফোটে।

    এরকম পুজো টুজোর দিনগুলোতে কেন যে যতরাজ্যের পুরোনো কথা মনে পড়ে! বাতিল পুরোনো জিনিষ সাফ করার করার মত পুরোনো স্মৃতিও সাফ করা গেলে বেশ হত। এগুলো নেহাৎই বোঝা। মিতা নীচে নেমে দেখল অমু বাইক বের করছে। আজ একটু তাড়াতাড়িই অফিস যাচ্ছে ভাই। মিতা আবার মনে মনে হাসে, নিশ্চয়ই ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি বিকেলে নেমন্তন্ন আছে অমুর। মুখ ধুয়ে কফি করতে রান্নাঘরে ঢুকতেই চঞ্চলাদি ঘোষণা করে ‘দাদা তো রাতে খাবে না, তোমার মাছ করব তো?’

    ২)

    ‘লক্ষ্মীঠাকুর হল টাকাপয়সার দেবতা, তাকে খুশী রাখলে খাওয়া পরার অভাব হবে না বুঝলি।’ এক্সেলে আয়ব্যয়ের অঙ্কে চোখ রেখে আবারো হাসি পায় মিতার, তেতো হাসি। লক্ষ্মীঠাকুর দয়া করে দুটো টাকা দিলেও মা সেটায় থাবা দিত। অবশ্য টের পেলে। বছর দশেক যাবত তো মিতা প্রায় নো কনট্যাক্ট মোডে চলে গিয়েছিল। যেটুকু যা কথাবার্তা বলত তা অমুর সাথেই। এক একটা মানুষ না থাকলে জীবনটা কত সহজ শান্তিপূর্ণ হয়ে যায় তা মা মারা যাবার পরে প্রতিদিন বোঝে মিতা।

    রোদ্দুরের তেজ ভালই। ছাদের বারমেসে শিউলিগাছটা উজাড় করে ফুল হয়েছে, কিন্তু গন্ধ তেমন নেই। নাকের কাছে এনে শুঁকলে হালকা গন্ধ পাওয়া যায়। তবে ডিসেম্বরে এই গাছের ফুলে বেশ ভাল গন্ধ হয়। ছোটবেলার শরৎকালের আবহাওয়া এখন শীতে সরে গেছে আর কি। মিতার সাজপোষাকের মত। কলেজকালে মেয়েরা যেমন সাজপোষাক করে, মিতা এই ষাটের দোরগোড়ায় এসে তেমনি করে। তখনকার ক্যাটক্যাট করার লোকগুলোকে দেখিয়ে করতে পারলে আরো ভাল হত।

    শীতের গাছপালা বসানোর আগে ছাদটা পরিস্কার করা দরকার। কিন্তু তার আগে খরচের হিসেবটা ঠিক করে করা দরকার। গত বছর যখন হুট করেই চাকরিটা চলে গেল তখন চোখে অন্ধকার দেখেছিল মিতা। ভারতীয় বহুজাতিকের বিজনেস ডেভেলাপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে মাইনে ভালই পেত কিন্তু ইএময়াইতে বেরিয়ে যেত অর্ধেক মাইনে। টেকনিকাল লোক নয় বলে মাইনের ভেরিয়েবল কম্পোনেন্টটাও অনিশ্চিত ছিল। সব মিলিয়ে খুব স্বচ্ছল ছিল না।

    ৩)

    তিন রাত দুইদিনে পান্না বেড়াতে যাবার লোভনীয় অফার, মাত্র আঠাশ হাজার পাঁচশো টাকা। সুন্দরবন পাঁচ রাত্রি চারদিন ষোলো হাজার পাঁচশো। জিম করবেট তিন রাত দুই দিন একত্রিশ হাজার পাঁচশো। তাড়োবা তিনরাত দুইদিন আঠেরো হাজার। মাসাইমারা একলাখ ঊনসত্তর হাজার। মাসাইমারা + সেরেঙ্গেটি তিনলাখ চব্বিশ হাজার পাঁচশো। এনশিয়েন্ট ঈজিপ্ট দুইলাখ বাহাত্তর হাজার। অরোরা ওয়ান্ডারল্যান্ড চারলাখ পঁয়ষট্টি হাজার সাতশো পঞ্চাশ।

    এই অবধি এসে আটকে গেল। চাআর লাআখ! নাহ চার কই এ তো যাওয়া আসা টুকটাক খাওয়া দাওয়া নিয়ে সাড়ে পাঁচলাখ হবে। অরোরা বোরিয়ালিস না দেখেই মরে যাবে ও। অপুও তো দেখে নি। নাকি দেখেছিল? হয়ত পোর্তো প্লাতার ডুবো জাহাজ, অরোরা বোরিয়ালিস সঅব দেখেছিল। তাহলে একটা এসআইপি শুরু করবে নাকি। অল্ট ট্যাব মেরে আবার এক্সেলে ফেরে। করবে কোথা থেকে, দোতলা করতেই তো পিএফের বেশ খানিকটা শেষ।

    চাকরিটা যাবার পরে মাস দুয়েক হন্যে হয়ে খুঁজেছিল মিতা। কিন্তু বয়স দেখেই কোম্পানিগুলো রিজেক্ট করে দেয়। তাছাড়া অটোমেশানের বাড়বাড়ন্ত আর ভূরাজনৈতিক টালমাটালে অনেক চাকরিই হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা বাধ্য হয়েই বাইরের পাট চুকিয়ে বাড়ি ফেরে মিতা। ভাগ্যিস বাবা লিখে গেছিল বাড়িতে ভাইবোনের সমান অধিকার, বিক্রি করলেও সমান ভাগ হবে। নাহলে মা ঠিকই ওকে বাদ দিয়ে দিত কোনও না কোনভাবে।

    ৪)

    এজমালি বাড়ি ভাগ হওয়ার সময় বাবা আর মেজজ্যাঠা দুটো ছোট ছোট জমি পায়, বাড়িশুদ্ধ বাকী জমি বড়জ্যাঠা নেয়। ঠাম্মু তখনো বেঁচে, মেজজ্যাঠাকে প্রায় হাতে পায়ে ধরে কোর্টে যাওয়া থেকে আটকাতে চেয়েছিল ঠাম্মুই। মেজজ্যাঠা রাগ করে বেরিয়ে যাবার সময় বলে যায় ঠাম্মু মরলেও ওকে খবর দেবার দরকার নেই। বাবা শুধু ফ্যালফ্যাল করে দেখে গেছিল সবটা। তারপরেই কাজের জায়গা থেকে ধারধোর করে ছোট্ট একতলা বাড়িটা কোনোমতে খাড়া করে।

    সুন্দরবন এত কাছে, খুব খরচও নয়, তবু যাওয়া হয় নি কখনো। সেই একবার বাড়ি করার ধারটা শোধ হতেই যাবার প্ল্যান হল তারপর মা এমন অশান্তি শুরু করল যে বাবা সব ক্যান্সেল করে দিল। তার একমাসের মধ্যেই বাবার অ্যাক্সিডেন্ট, স্পট ডেড। অমু তখন এগারো ক্লাস, মিতা বি কম পাশ করেছে সবে। অ্যাকাউন্টেন্সিতে অনার্স নিয়েছিল, রাখতে পারে নি কেটে গেছে। অন ডিউটি অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ায় মাকে চাকরি আর কিছু থোক টাকা দেয় কোম্পানি।

    একটা অচেনা নম্বর থেকে বারে বারে ফোন আসছে। নির্ঘাৎ কোন বিল্ডার কোম্পানি তাদের নতুন ফ্ল্যাট বিক্রি করতে চাইছে। নয়ত নতুন ক্রেডিট কার্ড বা লোন। নম্বরটাকে ব্লক করে আবার এক্সেলে মন দেয়। পিএফের বাকীটা ভাগ ভাগ করে পাঁচখানা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেছিল গত বছর এই সময়। ট্যাক্সের বোঝা কমাতে এক বছর হাত দেয় নি, এই মাস থেকে এসডাব্লিউপি শুরু করার কথা। কিন্তু গত এক বছরের বাজারের ওপর দিয়ে যা ঝড় গেল তাতে কোন কোনটা সামান্য বাড়লেও দুটো ফান্ড একেবারে অনেকটা করে কমে গেছে।

    ৫)

    মাকে ওরা অ্যাকাউন্টস দেখার জন্য নিয়েছিল। সিনিয়ার অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন বার্ষিক আয়ব্যয়ের খাতা ঠিক রাখা, অডিটের মুখোমুখী হওয়া ইত্যাদি মূল কাজের জন্য। মার দায়িত্ব ছিল দৈনিক আয়ব্যয়ের হিসেব রাখা। আর্টস গ্র‍্যাজুয়েট মা অঙ্ককে ভয় পেত বরাবর। জমা খরচ ঠিকঠাক মেলাতে না পেরে নিজের মাইনে থেকে গচ্চাও দিয়েছে কয়েকবার। মিতাকে প্রায়ই এটা সেটা দেখিয়ে দিতে বলত। ও একবার বলেছিল বি কম পাশ হিসেবে চাকরিটা তো ওই পেতে পারত। সবদিক থেকেই সুবিধে হত তাহলে।

    ‘স্বার্থপর’, ‘লোভী’, আরো কিছু অকথ্য গালাগালি করে ওই বয়সেও মা ওকে মেরেছিল। কোম্পানির দেওয়া থোক টাকাটায় মা অমুর নামে কিষাণ বিকাশ পত্র কিনে রাখে। মিতা টিউশানি শুরু করে, সাথে একটা দেড় বছরের কম্পিউটার কোর্স আর একটা ম্যানেজমেন্টের ডিপ্লোমা। আর ব্রিটিশ ইনস্টিটিউটে স্পোকেন ইংলিশ। টিউশানি থেকে সবকটার ফী না ওঠায় বাধ্য হয়েই মা'র কাছে টাকা চায়। তবে শুরুতেই ধার বলে নেওয়ায় মা টাকাটা দিয়ে দেয়। তারিখ ধরে ধরে সে ধার শোধ করেছিল ও।

    আবার আরেকটা অন্য নম্বর থেকে কেউ কল করার চেষ্টা করছে। ধুত্তোর ফোনটাকে ফ্লাইট মোডে দিয়ে ল্যাপটপে ইউটিউব খুলে বসে মিতা। ওর পছন্দের ট্রাভেল চ্যানেলগুলো খানিকক্ষণ সার্ফ করে। দূর ভাল্লাগছে না কিচ্ছু। টুং করে নোটি আসে, ফলো করে রাখা এক ফিনফ্লুয়েন্সার নতুন ভিডিও দিয়েছেন পড়তে থাকা বাজার নিয়ে। বাজার পড়া যে আসলে দারুণ সুযোগ এইটা নানা চার্ট দিয়ে গ্রাফ এঁকে বোঝাচ্ছেন বুদ্ধিদীপ্ত চকচকে চোখের অল্পবয়সী ছেলেটি। শুনতে ভালই লাগছে। তবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করার মত টাকা তো হাতে থাকতে হবে রে বাপু।

    ৬)

    ভিডিও পজ করে ফোনের নেটওয়ার্ক ফেরায়। হুড়মুড় করে মেসেজ, হোয়াটস্যাপ ঢোকে। চারখানা মিসড কল অ্যালার্ট। অমু করেছিল দেখেই আঁতকে ওঠে মিতা। গতবছর অমুর একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল রাস্তায়, তখনো এরকম বেশ কটা মিসড কল ছিল। আগের অচেনা নম্বরগুলোর কথা মনে করে আরো ভয় পেয়ে যায়। কাঁপাহাতে কলব্যাক করে অমুকে। বেজে বেজে কেটে গেল। চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নেয় মিতা। মাথায় ভীড় করে আসা চিন্তাগুলোকে প্রাণপণে সরিয়ে আবার কল করে।

    ‘'হ্যাঁ দিভাই বলো’ - ঐন্দ্রিলার গলা শান্ত স্বাভাবিক। অমুর কথা জিজ্ঞাসা করার আগে নিজেই বলে ‘অমিতেশ একটু বাথরুমে ঢুকেছে। তোমাকে কী যেন বলবে বলে খুঁজছিল। ও বেরোলে বলছি আমি।’ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেও পুরো নিশ্চিন্ত হতে পারে না মিতা। জিগ্যেস করে ‘'হ্যাঁরে তোরা সবাই ঠিক আছিস তো?” ঐন্দ্রিলা অত খেয়াল করে না, ‘'হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা সবাই ঠিকঠাক। এই নাও অমিতেশ এসেছে কথা বলো।” অমু ধরেই তড়বড়িয়ে বলে ‘'শোন বড়দা তোকে ফোন করছে, কথা বলে নিস।’’

    বড়দা!? বড়দা কেন? আবার? রাগে মাথা জ্বলে যায়। ওকে চুপ দেখে অমু বোঝে, গলা নামিয়ে বলে ‘'তুই ফোন ধরছিস না বলে আমার অফিসের রিসেপশানে ফোন করে আমাকে চেয়েছে। একটু কথা বলে নে না।’ মিতা একটা শ্বাস ফেলে বলে 'আচ্ছা।’ ‘'আমি বলেছি তোকে সাড়ে সাতটা নাগাদ ফোন করতে।’ ফোন ছেড়ে ঘড়ির দিকে তাকায় মিতা, সোয়া সাতটা বাজে। ভাইটা ওর বড্ড ভালমানুষ। কাউকেই তেমন কড়া করে কিছু বলতে পারে না। সেই সুযোগটাই বড়জ্যাঠার ছেলে নিয়েছে। নাহলে আজ দেড় বছর হল মিতা ওদের ভুতু করে দিয়েছে, কারো ফোন ধরে না।

    ৭)

    এবাড়িতে পাকাপাকি ফেরার সিদ্ধান্ত নেবার সময়ই বুঝেছিল যে কোনোভাবে ওকে দোতলায় খান দুয়েক ঘর তুলতেই হবে। নাহলে বইপত্র, এতদিনের জমানো নানা শখের জিনিষ রাখবে কোথায়। বাবা মারা যাবার বছর দশেক বাদে মা দোতলায় একটা ছোট ঘর সাথে বাথরুম বানিয়েছিল। মা নারা যাবার পরে অমু মায়ের ডবলবেড খাটটা ওই ঘরে তুলে দিয়ে বাইক কেনে। মা'র ঘর গেটের সোজাসুজি, ওখানেই বাইকটা রাখে। অতবড় খাটটা রাখায় ঘরে আর আলমারি রাখার জায়গা নেই।

    ঘরটা মা বানিয়েছিল অমুর বিয়ে দেবে বলে। নীচের একটা ঘর অমুরই, কিন্তু সেটা কেউ এলে বসার ঘরও বটে। বিয়ে হলে তো ওরকম ঘরে অসুবিধে হবে, প্রাইভেসি থাকবে না। মিতাকে মায়ের সাথেই শুতে হত। মা বিছানায় পড়ার পরে অমু ওপরের ঘরে একটা ফোল্ডিং খাট আর একটা পাখা লাগিয়ে দেয়। তাই নিয়েও তুমূল অশান্তি করেছিল মহিলা। খানিকটা নিরুপায় হয়েই আর খানিকটা বিনিয়োগের জন্যও মিতা ‘গ্রামবাংলা রেজোর্ট এন্ড আয়ুর্বেদিক স্পা’তে একটা ইউনিট কেনে।

    ওদের এজমালি বাড়ির বাগানটার কথা মনে করেই সাড়ে তিনকাঠা জমির ওপরে ওই ইউনিটটা কিছুটা নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়েই কিনেছিল। হোমলোনের পরিমাণটা অনেকটাই বেশী। আর প্রথম ছয় সাত বছর আর্থিক বিষয়গুলো তেমন বুঝত না, খুঁটিয়ে বোঝার চেষ্টাও করত না বলে অনর্থক অনেকগুলো টাকা ইন্টারেস্টে বেরিয়ে গেছে। তাতেই এই এতগুলো বছর লেগে গেল পুরোটা শোধ হতে। তাও শেষের ফোরক্লোজার গ্রাচুইটির টাকা দিয়ে করল। মা সে বাড়ি নিয়েও কম অশান্তি করে নি। আশ্চর্য লাগে এই বাড়ি থেকেও তো পারলে ঠেলে বের করেই দিত, নিজে কিনে নেওয়াতেও এত রাগ কেন যে।

    ৮)
    সাড়ে সাতটা বাজে, এক্ষুণি হয়ত ফোনটা আসবে। কী বলতে পারে? হয়ত আবার অমুর বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে। আগে একবার বড়জ্যেঠি এনেছিল তার ভাইয়ের ক্লায়েন্টের মেয়ে। অমু কিছুতেই রাজী হয় নি, বড়জ্যেঠি খুব রাগ করেছিল। পরে জানা গেছিল ওর ভাইয়ের ব্যবসার কিছু সুবিধে ফস্কে যায় বিয়েটা না হওয়ায়। ঐন্দ্রিলার কথা অমু মাকে বলেও নি কখনো। মা মারা যাবার পরে মিতাকে বলে, আলাপ করায়। বিয়েটা ওরা সামনের বছর করবে। মিতার বিশ্বাস মা নির্ঘাৎ ঐন্দ্রিলার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে ভেবেই ওরা এতদিন বিয়ে করে নি।

    আশেপাশের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ আসছে। পূর্নিমা লেগে গেছে তার মানে। ঠাম্মু বলত লক্ষ্মীপুজোয় কাঁসর ঘন্টা বাজাতে হয় না, লক্ষ্মী ঠাকুর ভয় পায়। পজ করে রাখা ইউটিউব আবার চালিয়ে দেয় ও। মা মারা যাবার বেশ কিছুদিন পরে মায়ের ঠাকুরের আসন থেকে লক্ষ্মীর ফোটো, গাছকৌটো, গোপালের অষ্টধাতুর মূর্তি তুলে স্কচ ব্রাইট দিয়ে মেজে তাকে তুলে রেখেছে শুনে বড়বৌদি একেবারে আঁতকে উঠেছিল। বড়দাও হায় হায় করে উঠেছিল লক্ষ্মীকে তাকে তুলে দেওয়ায়।

    ফিনফ্লুয়েন্সার আবার বোঝাতে শুরু করেন বাজারের ওঠাপড়া। বাবা মারা যাবার কয়েক বছর পরে মেজজ্যাঠা এসেছিল ওর জমিটা মা'কে খুব সামান্য দামে বিক্রির প্রস্তাব নিয়ে। মা এমনি নেবে না জানত বলেই বলেছিল দুই হাজার টাকা দিয়ে কিনে নিতে। মা কিছুতেই রাজী হল না, চলে যাবার পরে বলল ‘'এসছেন আমাকে দয়া করতে হুঁহ’’। মিতা জানে দয়া নয় বাবা বেঁচে থাকলে এমনিই দিত। বাবাকে খুব ভালবাসত মেজজ্যাঠা। মা যে কেন এত পেঁচিয়ে ভাবে সবসময়! মেজজ্যাঠা পরে বড়জ্যাঠাকেই বিক্রি করে তখনকার মার্কেট রেটের চেয়ে অনেক কম দামে।

    ৯)

    ফিনফ্লুয়েন্সার শেয়ার থেকে সোনারূপোয় চলে গেছেন। গয়না নয় বন্ড আর ইটিএফ নিয়ে সুবিধে অসুবিধে বোঝাচ্ছেন। বড়দা এখনো ফোন করল না তো। মরুকগে যাক। ভিডিওতে মন দেয় মিতা। বড়জ্যাঠা জ্যেঠি মারা যাবার পরে মাঝের জমিটা বড়দার কাছে কিনতে চেয়েছিল। হ্যাঁ তুই নিলে তো চিন্তাই নেই কদিন পরে বলছি বলে বড়দা জমি বাড়ি পুরোটাই এক প্রোমোটারকে কয়েক কোটি টাকায় বিক্রি করে দেয়। সে ওদের দখলের জিনিষ ওরা যা ভাল মনে করেছে করেছে। কিন্তু স্পষ্ট করে বলার সাহস হল না কেন কে জানে।

    সোনা অবশ্য বেশ ভাল জিনিষ। বাবা বেঁচে থাকতে মায়ের লকার জয়েন্ট করে মিতার নাম ঢুকিয়ে দিয়ে গেছিল। সে ব্যাঙ্ক আবার সেসব সিস্টেম আপডেটের সময় গুবলেট করে বসেছিল। গত বছর মিতা গিয়ে দেখে ওর নাম নেই, তা অমবাডসমেনকে জানাবে বলায় ওরাই হাঁচড় পাঁচড় করে বের করে পুরোন খাতা। মিতা অমুকে নিয়ে গিয়ে সব তুলে আনে। লকার ছাড়ে নি অবশ্য। ছাড়লেই খবর চলে যাবে নানা জায়গায় আর তারপরেই চুরি ডাকাতির সম্ভাবনা। ওসব রিস্ক নেয় নাকি কেউ।

    সোনার দাম গত কয়েকমাসে দেড়শ গুণ বেড়ে যাওয়ায় সেই গয়নার অর্ধেক বিক্রি করেই মোটামুটি দোতলার খরচটা উঠে এসেছে। বাকী অর্ধেক অমুরা যা করবে করুক। এইটা জানলে বড়দা বৌদি আবার চিড়বিড়াবে… ভেবেই ফিকফিক করে হাসতে থাকে মিতা। গয়না ওদের প্রাণ। ঠাম্মুর গয়না সবই বড় জ্যেঠি পেয়েছিল। মেজজ্যেঠি আর মা সেই নিয়ে অনেক রাগারাগি করেছে।

    প্রোগ্রামটা শেষ, আবার এক্সেলে চোখ রাখে। নাহ অবস্থা অতটাও খারাপ নয় তো। সামনের বারো মাসের খরচ আলাদা আলাদা ফিক্সড ডিপোজিট করে বাকীটা মার্কেটে লাগিয়ে দেবে। এর মধ্যে যদি গ্রামবাংলার ইউনিটটা আবার ভাড়া হতে শুরু করে তো আরো ভাল। গত মাস কয়েক এলাকায় রাজনৈতিক খুনোখুনি বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় থানা থেকেই বন্ধ রাখতে বলেছে। বছর দুয়েক বাদে অরোরা ট্রিপও হয়েই যাবে যদি এইভাবে বুঝে চলে। মিতার মনটা ভাল হয়ে যায়। ইউটিউব থেকে এক্সেল থেকে নানা রঙের রূপীচিহ্ন বেরিয়ে এসে উড়ে বেড়াতে থাকে ওর চারপাশে। আর তখনই ফোনটাও বাজতে থাকে তারস্বরে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    অবিস্মরণীয় নজরুল | বাঙালি বিদ্বেষ ও পরিচিতি নির্মাণের রাজনীতি | সোনম ওয়াংচুক: গণতন্ত্র কি শুধুই কাগজে-কলমে? | নবান্ন, গাজা থেকে বাংলার দুর্ভিক্ষ | দুই ঘর | সমসাময়িক | ফ্লোটিলা | ঢাকের দিনে ঢুকুঢুকু | দু-প্যান্ডেলের মাঝখানটায় | সুন্দরী কমলা নাচে রে | কাশী বোস লেনের পুজো : লড়াইয়ের হাতিয়ার | অস্তিত্ত্ব | শালপাহাড়ের গান | পুজোর দিনগুলি | অপেক্ষা-দিন | ভোলুরামের হাঁচি ও মত্তের উৎসব | এ অবধি আঠারো | মিনিবাসে গদার | জালিকাটু | তিনটি কবিতা | সাত সেতুর সাতকাহন | ফ্রান্স - একটি অবতরণিকা | শারদীয়া | বালিকা ও ইস্ত্রিওয়ালা | তিনটি কবিতা | গগন | যে জীবন গেঁড়ির, গুগলির | লা পাতা | দু’টি কবিতা | ধাতব পাখিটি একা | নিষিদ্ধ গন্ধ ছড়িয়েছে হাসনুহানা বলে | তিন ঋতুর কবিতা | গ্যেরনিকা | "এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন।" | ছায়া দুপুর | আমাদের ছোট নদী (২) | শারদ অর্পণ ২০২৫ | আমি হিটলারের বাবা | হিমাংশু ও যতীনবাবুদের খবরাখবর | যে চোখে ধুলো দেয় তার কথা | লক্ষ্মীর ঝাঁপি | উৎসব সংখ্যা ১৪৩২
  • ইস্পেশাল | ২০ অক্টোবর ২০২৫ | ১৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Aditi Dasgupta | ২১ অক্টোবর ২০২৫ ১৩:০৬735113
  • 'শ্রী' শব্দটার ব্যাঞ্জনা ও  ব্যাপ্তি আবার নতুন করে বুঝিয়ে দিলে। লক্ষ্মী আর সরস্বতী একই মূর্তির দুটো দিক। সম্পূর্ণ রূপ দর্শন হয়ে গেলে ---জীবনে যা প্রাথমিক-- তা সুস্থিতি তে থাকলে, যে আকাশে উড়তে চাই --- সে নির্মেঘ থাকলে, বাজুক না তারস্বরে অন্য কণ্ঠ! অবশ্য যে দাম দিয়ে এই অবস্থানে পৌঁছতে হয়,তা বড়োই বেদনার! অথচ বড্ড বাস্তব।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন