প্রতিবছর গরম পড়লেই মানুষের খেয়াল হয় এবারের গরমটা যেন আগের বছরের থেকে অনেকটাই বেশি। তারপরেই চারিদিকে 'গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান"এর ধুম পড়ে যায়। খুব বেশি বৃষ্টি হলে বা বিশেষ শীত না পড়লে, নভেম্বর ডিসেম্বরে পাখা চালাতে হলেও পরিবেশের কথা খেয়াল হয় মানুষের। ভারতের প্রায় সবকটা মেট্রোসিটিতে ভারী বৃষ্টি ত বটেই এমনকি স্বাভাবিক বৃষ্টি হলেও রাস্তায় জল জমে শহর অচল হয়ে যায় অন্তত তিন চারদিনের জন্য। জল জমে থাকার একটা কারণ যেমন অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ছোটবড় জলাজমির বিলুপ্তি, তেমনি আর একটা অন্যতম প্রধান কারণ হল নর্দমা ও পয়ঃপ্রণালীগুলো জঞ্জালের ভারে বুজে আটকে যাওয়া। এই জঞ্জালের অধিকাংশই বিভিন্ন ধরণের প্ল্যাস্টিক বর্জ্য। আজ বরং প্ল্যাস্টিক নিয়ে বলি। রাস্তায় ঘাটে, যে কোনও পর্যটনকেন্দ্রে বড় ছোট যে কোনও গাছের গোড়ার দিকে লক্ষ করে দেখেছেন? দেখবেন নানারকম প্ল্যাস্টিকের মোড়ক, বোতল ইত্যাদি ছড়িয়ে রয়েছে। দীঘার সমুদ্রতীর থেকে সিটঙের কমলালেবুর বন পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে আছে প্ল্যাস্টিক জঞ্জাল।
এই ছড়িয়ে থাকা প্ল্যাস্টিক তো আমরা দেখতে পাই, কিন্তু আমাদের চোখের আড়ালে আরো অনেক বেশি পরিমাণ প্ল্যাস্টিক প্রতিদিন মিশে যাচ্ছে আমাদের খাবারে, আমাদের শরীরে, আমাদের পানীয় জলে। সমুদ্রে মোটামুটি ১৫০-২০০ মিলিয়ন টন প্ল্যাস্টিক বর্জ্য জমা হয়ে আছে আর এর সাথে প্রতি বছর যোগ হচ্ছে আরো অন্তত ৩৩ বিলিয়ন পাউন্ড প্ল্যাস্টিক বর্জ্য। বিভিন্ন আকার ও আকৃতির এইসব প্ল্যাস্টিকমন্ড খাদ্য ভেবে খেয়ে ফেলে সামুদ্রিক পাখী, মাছ ও অন্যান্য প্রাণী। আর স্রেফ এরই ফলে দশলক্ষ সামুদ্রিক পাখী আর একলক্ষ অন্যান্য প্রাণী প্রতি বছর মারা যায়। বর্তমানে প্রতিটি কাছিম শিশুর, আবারও বলছি ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রতিটি কাছিম শিশুর পাকস্থলীতে প্ল্যাস্টিক থাকছে। গোটা পৃথিবীতে মহাসাগরের প্রতি বর্গ মাইলে ম্যাক্রো ও মাইক্রো প্ল্যাস্টিকের ৪৬০০০ টুকরো পাওয়া যায়। এই প্ল্যাস্টিককণাই কাঁকড়া , মাছের দেহে মিশে খাদ্যের সাথে, জল বাষ্পীভূত হলে আকাশে মেঘের সাথে মিশে বৃষ্টি হয়ে ঝরে, খাঁড়িপথে নদীর জলে মিশে পানীয় জলের সাথে ফিরে আসে মানবদেহে। মহাসাগরের তলদেশে ১১ কিলোমিটার গভীরে, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রত্যন্ত প্রান্তেও প্ল্যাস্টিক দূষণের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
এতক্ষণ যে প্ল্যাস্টিকের কথা বললাম, সে সব হল পুনর্ব্যবহৃত না হওয়া একবার ব্যবহারোপযোগী বা একবারী প্ল্যাস্টিক। যে কোনও প্ল্যাস্টিকই ক্ষতিকর, কিন্তু এই একবারী প্ল্যাস্টিক যেহেতু একবার ব্যবহারের পরেই ফেলে দেওয়া হয় ফলে পরিবেশে এর পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তরকারি, ফল, মাছ মাংস ইত্যাদি দোকান থেকে এরকম একবারী প্ল্যাস্টিকের ঠোঙাতেই দেয়। আমরাও অম্লানবদনে তরকারির খোসা, মাছের আঁশ, কাঁটা, মাংসের হাড়, আগেরদিনের বেঁচে যাওয়া তরকারি সব ঐ প্ল্যস্টিকের ঠোঙায় রেখে আচ্ছাসে টাইট করে মুখটা বেঁধে ফেলে দিই। এবারে রাস্তার ধারের ডাস্টবিন থেকে খাবারের গন্ধে গরু ছাগল কুকুর বেড়াল বিশেষত গবাদি পশুরা ঠোঙা টেনে খাবার চেষ্টা করে। ওদের তো আর আমাদের মত মুষ্ট্যাঙ্গুলি (Opposable Thumb) নেই, কাজেই দাঁতে টেনে ছিঁড়তে পারল তো ভাল, নাহলে ঐ ঠোঙাশুদ্ধই চিবিয়ে গিলে ফেলা। গরু ও ষাঁড়েরা যা পায় প্রথমেই গপ করে গিলে নেয় পরে জাবর কাটবে বলে, এদিকে প্ল্যাস্টিক মোটামুটি ওদের শরীরের ভেতরের খাদ্যনালী ও অন্ত্রে জড়িয়ে আটকে যায়। এই বিষয়ে সরকারি কোনও তথ্য পাওয়া না গেলেও বেসরকারিভাবে মাঝে মাঝে যে সব তথ্য আসে তাতে শিউরে উঠতে হয়। মার্চ-২০২১ এ ডেকান হেরাল্ডের এক রিপোর্টে দেখি যে একটি মৃত গাভীন গরুর পেটে ৭১ কেজি প্ল্যাস্টিক পাওয়া গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের হিসেব অনুযায়ী ভারতের ৬০টি শহর থেকে প্রতিদিন ১৫৩৪২ টন প্ল্যাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয় যার মধ্যে ৬০০০ টনের বেশি বর্জ্য অসংগৃহীত অবস্থায় এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকে।
এই বিপুল পরিমাণ প্ল্যাস্টিক বর্জ্যের আবার পুরোটাই একবারী প্ল্যাস্টিক নয়, এর মধ্যে মিশে থাকে আরো নানা দৈনন্দিন ব্যবহার্য্য জিনিষও। যেমন ধরুন চা-ঐ যে ডিপ ডিপ টি ব্যাগগুলো, যেগুলো আজকাল ঘর বাড়ি অফিস কাছারি সব জায়গায় দেখা যায়, ঐগুলো কী দিয়ে তৈরি বলুন তো? ভাবছেন কাপড়? নাহ অতি সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ওগুলোর অধিকাংশই ফুডগ্রেড প্ল্যস্টিক মেশ, যাতে ৩০% - ৪০% প্ল্যাস্টিক থাকে। গরমজলে একবার ডোবালে একটা ব্যাগ ১১.৬ বিলিওন মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক আর ৩.১ বিলিওন ন্যানোপ্ল্যাস্টিক খালাস করে। তারপর আমরা সেটা তৃপ্তিভরে খেয়ে নিই। সে খাওয়াও খাই একবারী নিক্ষেপোযোগী কাগজের কাপে। খেয়াল করেছেন কি এই কাগজের কাপগুলো হতে করে দুমড়ে মুচড়ে ফেলার চেষ্টা করলে এগুলো কখনো খবরের কাগজ বা অন্যান্য কাগজের মত পুরোটা গোল্লা পাকিয়ে যায় না। তার কারণ এই কাপগুলোর ভেতরে খুব পাতলা একটা প্ল্যাস্টিকের স্তর থাকে। নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী একটা ১০০ মিলিলিটারের কাপে গরমজল ১৫ মিনিট রাখলে এর প্ল্যাস্টিক স্তর থেকে ২৫০০০ সূক্ষ্ম প্ল্যাস্টিক কণা জলে মেশে। তাহলে টিব্যাগ ডুবিয়ে বানানো এক কাপ চা খাওয়ার সময় আমরা কি পরিমাণ প্ল্যাস্টিককণা গিলছি ভাবুন। একইভাবে কাগজের টেট্রাপ্যাক, যেগুলোতে দুধ, ফলের রস লস্যি ঘোল ইত্যাদি বিক্রি হয়, সেগুলো থেকে সূক্ষ্ম প্ল্যাস্টিক কণা ভেতরের তরলে মেশে এবং আমাদের পেটে যায়।
আর একটা ন্যানো ও মাইক্রোপ্ল্যাস্টিকের উৎস হল সিগারেটের অবশিষ্টাংশ। সিগারেটের ফিল্টার তৈরি হয় বিষাক্ত প্ল্যাস্টিক দিয়ে। একটা সিগারেটের অবশিষ্টাংশ মোটামুটি ০.২ গ্রাম ওজনের হয় আর এটা সম্পূর্ণভাবে পরিবেশে মিশতে সময় লাগে ১০ বছরের কিছু বেশি। ততদিন এরা ধীরে ধীরে পরিবেশে মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক মুক্ত করে। পৃথিবীতে প্রতি বছর আনুমানিক ৪.৫ ট্রিলিওন অবশিষ্টাংশ ফেলা হয়। এরপরে আসি চ্যুইং গামের কথায়। এটা বোধহয় একমাত্র চিবানোর উপযোগী জিনিষ যেটা তৈরিই হয় মূলত প্ল্যাস্টিক দিয়ে। যদিও চ্যুইং গামে প্ল্যাস্টিকের পরিমাণ ১-২% এর মত, কিন্তু প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ২,৫০,০০০ টনের মত বর্জ্য উৎপন্ন করে এই গাম। আর এর ৮০-৯০% বর্জ্যই ঠিকভাবে পরিত্যাগ করা হয় না। অতি অল্পসংখ্যক কোম্পানি আছে যারা প্ল্যাস্টিক ছাড়া গাম বানায়, একটু খেয়াল করে তাদের গাম কেনা নিজের শরীর আর পৃথিবী পরিবেশ দুইয়ের জন্যই ভাল। আর যে কটা দৈনন্দিন বহুল ব্যবহৃত জিনিষ প্রচুর প্ল্যাস্টিক দূষণ ঘটায় সেগুলো হল ডায়াপার, স্যানিটারি ন্যাপকিন আর ওয়েট ওয়াইপ বা অল্প ভিজে মুখ মোছার টিস্যু এবং টয়লেট টিস্যু। এছাড়া করোনাকালে আরেকটা জিনিষের ব্যবহার প্ল্যাস্টিক দূষণের মাত্রা বাড়িয়েছে সেটা হল সার্জিকাল মাস্ক। এই সবকটাই আমরা যেমন তেমন করে ডাস্টবিনে ফেলে দিই বা বড়জোর একবারী প্ল্যাস্টিকে ঠোঙায় ভরে ভাল করে বেঁধে ফেলি।
তো, এইভাবে ফেলার পরে হয় সেগুলো রাস্তায় ঘাটে, নদী, জলাশয় বা সমুদ্রের ধারে জমা হয়ে থেকে ধীরে ধীরে মাইক্রো ও ন্যানোপ্ল্যাস্টিক পরিবেশে মুক্ত করতে থাকে আর নয়ত বিভিন্ন ভাগাড়ে যায়। দুইক্ষেত্রেই ফল একই। ঘুরেফিরে আমাদের মানে যাবতীয় প্রাণীকুলের শ্বাসনালী, খাদ্যনালী, পাকস্থলী ও ফুসফুসেই এসে বাসা বাঁধে এই প্ল্যাস্টিককণারা। এবারে কথা হল তাহলে কি আমরা যাবতীয় প্ল্যাস্টিক ব্যবহার বাদ দেব আমাদের জীবন থেকে? না সেটা আমরা চাইলেও পারব না। প্ল্যাস্টিক অত্যন্ত হালকা, দামে কম এবং সহজে নষ্ট হয় না বলেই এর ব্যবহার অর্থনৈতিকভাবে সহায়ক। দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারোপযোগী করার মাধ্যমে এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে কমানো সম্ভব। একবারী প্ল্যাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ। তবে ঔচিত্যে আর আসল কাজে অনেক তফাৎ। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে একবারী প্ল্যাস্টিক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তা কাজে পরিণত করার দায়িত্ব বিভিন্ন রাজ্যের। আবার একবারী প্ল্যাস্টিক ব্যবহার করলে কী কী শাস্তি হতে পারে সরকারের তরফে তার কোনও স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে একবারী প্ল্যাস্টিকের বিকল্প কী কী হতে পারে সেই নিয়েও পরিষ্কার নির্দেশিকা নেই। জনগণের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরির চেষ্টাও যৎসামান্য। ফলে অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা ক্ষুদ্রচাষীদের পক্ষে অনেক সময়ই এর ব্যবহার এড়ানো সম্ভব হয় না।
সরকারের তরফে যা যা করা উচিৎ তার অনেকটাই করা হচ্ছে না, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতাও বিভিন্ন স্তরের। ফলে সিকিম সম্পূর্ণ প্ল্যাস্টিকমুক্ত হলেও পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের প্ল্যস্টিক দূষণের পরিমাণ উদ্বেগজনক। বিসলেরি জাতীয় জলের বোতল, বিরিয়ানি , মাটন কষার কৌটো ইত্যাদি একবার ব্যবহার্য্য প্ল্যাস্টিক দিয়ে তৈরি। ভাবছেন আপনি তো নিয়মনিষ্ঠ মানুষ, জল খেয়ে বোতলটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেন যাতে আর কেউ ব্যবহার করতে না পারে। উঁহু আপনি ফেলে দিলেও সে বোতল কিন্তু মাটির সাথে মিশে যায় না। আস্তে আ-আ-আস্তে মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক আর ন্যানোপ্ল্যাস্টিক মুক্ত করতে থাকে, সেসব গিয়ে মেশে নর্দমার জলে। ক্রমে চলে যায় হ্রদে, নদীতে, সমুদ্রে। হ্রদ বা নদীর জল ফিল্টার হয়ে পৌরসভার পাইপ বেয়ে চলে আসে আমার আপনার বাড়ির অ্যাকোয়াগার্ড কিম্বা RO ফিল্টারে। বাহ চমৎকার পরিচ্ছন্ন পানীয় জল ভেবে আমি আপনি ঢকঢক করে খেয়ে ফেলি। এইভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক আর ন্যানোপ্ল্যাস্টিক গিয়ে জমা হয় আমাদের শরীরে। প্রতিদিন আমরা একটা ক্রেডিট কার্ডের সাইজের (৫ গ্রামের মত) প্ল্যাস্টিক খেয়ে ফেলি। তো বুদ্ধিমান মানুষ প্রচুর বুদ্ধি খাটিয়ে প্ল্যাস্টিকের পাহাড় জমা করছে নিজের শরীরে আর বুদ্ধিহীন গরু ছাগল বা তিমি হাঙর সরাসরিই গিলে নিচ্ছে টন কে টন প্ল্যাস্টিক।
তা এই গপাগপ প্ল্যাস্টিক গেলা ঠ্যাকানোর কি কোনই উপায় নেই? আমরা সাধারণ মানুষ কি কিছুই করতে পারি না? হ্যাঁ অবশ্যই পারি বৈকি, তবে একটু কষ্টসাধ্য। আমরা যদি আমাদের জীবনযাপনের কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করি তাহলে সামান্য হলেও প্ল্যাস্টিক গেলা কমিয়ে আনা যায় অনেকটাই। তবে পুরোটা বন্ধ করা যায় না। প্ল্যাস্টিকের জলের বোতলের বদলে স্টিলের বা কাচের বোতল ব্যবহার, প্ল্যাস্টিকের কাপ বা কাগজের কাপের বদলে বাইরে প্ল্যাস্টিক ভেতরে স্টিল দেওয়া কাপ,সেরামিক, পোরসিলেন কিম্বা এনামেলের কাপ ব্যবহার, বাজার দোকানে যাবার সময় নিজের কাপড়ের বা চটের ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি খুবই সহজ কিছু অভ্যেস করলেই প্ল্যাস্টিক গেলার পরিমাণ কমানো যাবে। প্ল্যাস্টিক বর্জ্য দিয়ে জ্বালানী, বাড়ি বা রাস্তা তৈরির ইট, কাচের মত স্বচ্ছ/ অর্ধস্বচ্ছ জানলা দরজার পাল্লা ইত্যাদি তৈরি হয়। মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু এলাকায় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় তৈরি বাড়িগুলোতে এই ধরণের জানলা দরজার পাল্লা ব্যবহার হয়। একটা নিয়মিত সরকারি চাহিদা থাকার ফলে প্ল্যাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহারে উৎসাহ বাড়ছে।
কাজেই দৈনন্দিন বর্জ্যের সাথে ডাস্টবিনে না ফেলে প্রত্যেক বাড়িতে প্ল্যাস্টিক বর্জ্য জমিয়ে রেখে এক একটা হাউসিং /পাড়া /এলাকা ধরে বিভিন্ন সংস্থা যারা প্ল্যাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য কিছু বানায় তাদের সাথে যোগাযোগ করে নিজ নিজ এলাকা থেকে একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্ল্যাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে পারলে সেটি নিজ হাউসিং /পাড়া /এলাকার জন্য একটা আয়ের উৎস হয়ে উঠবে। দীর্ঘস্থায়ী বর্জ্যজনিত দূষণ এড়ানোর সাথে সাথে অপেক্ষাকৃত কম দামে জ্বালানি বা ইট পাওয়া সম্ভব হবে। এরকম সংস্থা সব রাজ্যেই গড়ে উঠুক, গড়ে উঠুক আরো বেশি সংখ্যায়। শেষ করার আগে একটা পরিবেশবান্ধব জীবাণুনাশক তরল পরিষ্কারক বানানোর পদ্ধতি লিখে দিই, যাতে যে কেউ খুব সহজেই বাড়িতে বানিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। এতে প্রতিমাসে ফিনাইল, মেঝে পরিষ্কারক ইত্যাদি কিনে একগাদা প্ল্যাস্টিকের বোতল জমা হবে না বাড়িতে, এবং ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতে বিষাক্ত রাসায়নিক তরল ব্যবহার করতেও হবে না। এই তরল দিয়ে বাড়ীর যাবতীয় সাফ সাফাই করা যাবে। ঘর রান্নাঘরের সাথে সাথে বেসিন বা কমোডও পরিষ্কার হবে।
তাহলে আসুন শুরু করা যাক।
পরিবেশবান্ধব জীবাণুনাশক পরিষ্কারক তরল – ৬০-৭০-৮০-৯০ নিয়মে বানানো
উপকরণ হিসেবে লাগবে
১) একটা প্ল্যাস্টিকের বড় বাতাসনিরোধক বোতল বা কৌটো। ওই ওটমিল বা মিউজলির যে বড় কৌটো পাওয়া যায় ওইরকম।
২) এককিলোর সামান্য কমবেশি আখের শক্ত গুড় বা ভেলিগুড়।
৩) বিভিন্নরকম ফল ও তরকারীর খোসা ও ফেলে দেবার মত শাঁস অর্থাৎ যে যে অংশ খাদ্য নয় সেই সব অংশ।
৪) জল
পদ্ধতি
ক) প্রথমে প্ল্যাস্টিকের বোতল /কৌটোর গা বরাবর লম্বার দিকে ঠিক মাঝামাঝি একটা কালো দাগ দিয়ে নিন। এমনভাবে দেবেন যেন দাগের উপরে ও নীচে ৫০-৫০ ভাগ হয়। এবারে নীচের অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ ভাগ অংশ ছেড়ে দিয়ে উপরের অর্ধেককে সমান ৫ ভাগে ভাগ করে দাগ দিয়ে নিন। তাহলে ৬০, ৭০, ৮০, ৯০তে দাগ পড়বে আর ১০০ মানে কৌটোর গলা।
খ) এবারে নীচের অর্ধেক অংশে পরিষ্কার জল ভরে নিন। কৌটোর ৫০ ভাগ জলে ভর্তি হয়ে গেল। ধীরে ধীরে আর একটু জল ঢেলে ৬০ এর দাগ অবধি জল ভরে নিন। ৬০% এর মত জল লাগবে।
গ) গুড়টা একটু ভেঙে নিয়ে কৌটোতে জলের মধ্যে ফেলতে থাকুন। গুড় ফেললে জলের উচ্চতা বাড়বে। বেড়ে বেড়ে যখন ৭০ ভাগের দাগে আসবে তখন গুড় ফেলা বন্ধ করুন।
ঘ) ফল ও তরকারির খোসা, শাঁস ছোট টুকরো করে নিয়ে ওই কৌটোয় ফেলতে হবে। জলের উচ্চতা বেড়ে ৮০র দাগে এলে খোসা ফেলা বন্ধ করুন। বাকী ২০% জায়গা খালি থাকবে। কৌটোর মুখ বন্ধ করে দিন।
ঙ) এই বন্ধ কৌটো এবারে মোটামুটি আলো বাতাস আসে এরকম একটা কোণায় বসিয়ে রেখে দিন। প্রতিদিন একবার করে কৌটোর ঢাকনা খুলে আবার বন্ধ করে দেবেন। এইভাবে ৯০ দিন রাখতে হবে। প্রথম এক থেকে দেড়মাস প্রতিদিনই খুলতে হবে পচনের ফলে জমা গ্যাস বের করে দেবার জন্য। পরের দিকে আর অত গ্যাস হয় না এবং ক্রমে একদমই কমে আসে।
চ) ৯০ দিন পরে কৌটো খুলে একটা পরিষ্কার কাপড়ে বা লোহার ছাঁকনিতে ছেঁকে তরলটা প্রয়োজনমত আলাদা শিশিতে ভরে রাখুন। পচে যাওয়া ফল তরকারির খোসার অবশেষ বাড়িতে যদি কম্পোস্ট বানানোর ব্যবস্থা থাকে তাহলে তার মধ্যে দিয়ে দিন। নাহলে বাগানে বা টবে গাছের মূল শেকড়ের থেকে একটু দূরে মাটির মধ্যে দিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দিন। গাছের পুষ্টি যোগাবে।
এখানে বলে রাখি প্রথমতঃ আপনার বাড়িতে যদি পোকামাকড়ের উৎপাত বেশি হয় তাহলে কাঁচালঙ্কা, শুকনো লঙ্কা, রসুন আর লেবুজাতীয় ফলের খোসা বেশি পরিমাণে দেবেন। পরিষ্কারক তৈরি হয়ে গেলে একবালতি ঘরমোছার জলে ৩-৫ মিলিলিটার মত তরল মিশিয়ে প্রতিদিন মুছলে আরশোলা মাকড়সা পিঁপড়ে আপনার ঘর ছেড়ে পালাবে। পোকার তেমন উৎপাত না থাকলে যে ফল বা তরকারির গন্ধ আপনার ভাল লাগে সেই খোসা বেশি করে দেবেন। আনারসের খোসা বেশি করে দিলে আনারসগন্ধী তরল পাবেন। আর কৌটোটা যেন অবশ্যই প্ল্যাস্টিকের হয়। দ্বিতীয়ত প্রতিদিন কৌটোর ঢাকনা খোলাটা জরুরী। নাহলে উৎপন্ন গ্যাস জমে গিয়ে তরলে দুর্গন্ধ হবে, বেশি জমে গেলে গ্যাসের চাপে কোটোর মুখ ফাটিয়ে তরল বেরিয়ে আসতে পারে। এই ৯০ দিন চেষ্টা করবেন কৌটোকে বেশি নাড়াচাড়া না করার। পরিষ্কারক তৈরি হয়েছে কিনা বোঝার জন্য ঢাকনা খুলে উপরের তরলে একটা কাপড় সাবধানে ভিজিয়ে নিয়ে রান্নাঘরের দেওয়াল বা সিঙ্কের পাশে ঘষে যদি দেখেন নোংরা, তেল ইত্যাদি উঠে যাচ্ছে, তাহলে বুঝবেন আপনার পরিষ্কারক তৈরি।
ব্যসস একবার হয়ে গেলে একদিকে যেমন দামী ফিনাইল ক্লিনার কেনার খরচ বেঁচে যাবে, রাসায়নিক দূষণ থেকে বাড়িটা বাঁচবে, অন্যদিকে তেমনি কিছুই প্রায় ফেলা যাবে না, সব বর্জ্যই কোন না কোন কাজে লেগেই যাবে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র:-
https://www.nature.com/articles/nindia.2020.173
https://www.condorferries.co.uk/plastic-in-the-ocean-statistics#:~:text=There%20is%20an%20estimated%2075,their%20way%20into%20our%20oceans.
https://www.nationalgeographic.com/environment/article/global-treaty-to-regulate-plastic-pollution-gains-momentum
https://kids.nationalgeographic.com/nature/kids-vs-plastic/article/pollution-1
https://www.teriin.org/sites/default/files/files/factsheet.pdf