১)
পুরো আদর্শনগরে এই একটাই সরকারপোষিত স্কুল অবশিষ্ট আছে এখন। আদর্শনগর জায়গাটা নেহাত ছোট নয়, আড়ে বহরে প্রায় সাড়ে চার বর্গ কিলোমিটার, লোকসংখ্যাও হাজার পঁয়ত্রিশেক। এই বছর দশেক আগেও এখানে খান চারেক বালিকা বিদ্যালয় আর তিনখানা ছেলেদের স্কুল ছিল যাদের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের বেতন আসত সরকারি কোষাগার থেকে। পড়ুয়ার সংখ্যা কমতে শুরু করে পনেরো ষোলো বছর আগে থেকে। বছর সাতেক আগে থেকে সরকারি তরফে উদ্যোগ শুরু হয় দুটো তিনটে স্কুল একসাথে সংযুক্তিকরণের। তারপরে তো কোভিড এসে সরকারের কাজ সহজ করে দিল।
মেয়েদের স্কুলগুলোতে তাও পড়ুয়া হত কিছু। টিকেও থাকত অনেকেই মাধ্যমিক অবধি। কন্যাশ্রীর টাকাটার জন্য বাপ মায়েরা আজকাল মেয়েদের পড়াশুনোটা চালিয়েই যায়। ঘরে মোটামুটি খাওয়াপরার সংস্থান না থাকলে ছেলেগুলো পড়াশোনাটা চালাতে পারে না। ওই একটু লিখতে পড়তে শেখা, টাকাপয়সা ঠিকঠাক গুণতে শেখা, তারপরে একটু মাথাঝাড়া দিয়ে উঠলেই স্কুল ছেড়ে কাজে লেগে পড়ে। এখানে খেতের কাজে মজুরি কম। বরং বাইরে গিয়ে রাজমিস্ত্রি কি যোগাড়ের কাজে লাগলেও অনেকটা বেশী টাকা পাওয়া যায়। সেসব খবর দেবার লোক স্কুলের আশেপাশেই ঘুরঘুর করে।
লকডাউনের সময়টাতে অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল, আর লকডাউন উঠতে না উঠতেই কতগুলো মেয়ে কোথায় কোথায় যেন কাজের খোঁজে চলে গেল। কে যে ওদের খবর দিল কোথায়ই বা গেল তারা সেসব কথা এলাকার মানুষ আর জানতে পারল না। অবশ্য তেমন করে খোঁজই বা নেয় কে? যে যার জীবন চালাতেই পাগল হয়ে যাচ্ছে। রোজের খাওয়া পরা অসুখ বিসুখ সামলে লেখাপড়া চালিয়ে যাবার ক্ষমতা এ এলাকায় কম পরিবারেরই আছে। কোনোমতে লিখতে পড়তে জানা আর সংসারের হিসেবটুকু রাখা এর বেশী আর মেয়েদের লাগেই বা কি! কন্যাশ্রীর টাকাকটার জন্যই উচ্চমাধ্যমিক অবধি টানা।
২)
আদর্শনগরে মেয়েদের স্কুলগুলোতে ক্লাস টেন অবধিই ছিল। তারপরে হয় পাশের নতুনপাড়ায় যাও নয়ত আরো দূরে দূরে। দু বচ্ছর আগে দুখানা মেয়েদের স্কুল নতুনপাড়ার সিদ্ধেশ্বরীমাতা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সাথে জুড়ে দিয়েছিল সরকার থেকে। বাকী দুটো স্কুল ছাত্রী না হতে হতে শেষে এখন কোনোদিন খোলে কোনোদিন খোলে না। একেবারে কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই এমন চার পাঁচটা মেয়ে আসে যেদিন ইস্কুল খোলে। মিড ডে মিল খাওয়ার পরে তারাও চুপচাপ কেটে পড়ে। আদর্শনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক অবধি আছে, তাই ছেলেদের ইস্কুল দুটোকে এর সাথে জুড়ে দেওয়া হল এই গত বছরের গোড়ার দিকে।
পলাশ এই স্কুলে যোগ দিয়েছিল সেই ২০০৬ সালে। স্কুল তখনো উচ্চমাধ্যমিক হয়নি। তা হতে হতে আরো তিন বছর। পলাশের বাড়ি সেই শিয়াখালার কাছে। ট্রেকার ট্রেন বাস ধরে আসতে প্রায় দেড়ঘণ্টার মত সময় লাগে। প্রথমদিকে ম্যানেজিং কমিটি চাপ দিত এই আদর্শনগরে এসে থাকার জন্য। তখন তো নিত্যই রাস্তা ট্রেন অবরোধ লেগেই থাকত। মাঝে মাঝেই এক আধটু লেট হয়ে যেত। হেডস্যার রথীনবাবু মানুষ ভাল ছিলেন। ফার্স্ট পিরিয়ডে পলাশের ক্লাস রাখতেন না। ২০১১তে জমানা বদলের পরে অবরোধ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ততদিনে স্কুলে উচ্চমাধ্যমিক এসে গেছে, এদিকে তারজন্য টিচার স্যাংশান হয়েছে সাকুল্যে দুজন।
২০১৩তে রথীনবাবু রিটায়ার করার পর পরই বছর দুইয়ের মধ্যে আরো সাতজন টিচার রিটায়ার করেন সাথে ক্লার্ক বরুণবাবুও। ক্লার্কের পোস্ট আর স্যাংশান হয়নি, বদলে একজন কম্পিউটার অ্যাসিস্ট্যান্ট পাওয়া গেছে। সাতজন টিচারের জায়গায় ২০১৭ পর্যন্ত তিনজন পাওয়া গিয়েছিল। সেই সময় ১৪৫৩ জন ছাত্রের জন্য মোট সাতজন টিচার আর একজন টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট। পলাশদের কারো কোন অফ পিরিয়ড বলে কিছু ছিল না। তারপর একলপ্তে আরো তিনজন আসায় একটু সুরাহা হয়। সেই সময় থেকেই ছাত্র কমতে থাকে। প্রথমদিকে ওরা তেমন গা করেনি বরং ছাত্র কমায় স্বস্তিই পেয়েছিল খাটুনি কমতে দেখে।
৩)
স্টেশন থেকে স্কুল বরাবর হেঁটেই আসে পলাশ আরো কয়েকজনের সাথে। এখন অবশ্য টোটো চলে সাঁ সাঁ করে গোটা আদর্শনগর নতুনপাড়া জুড়েই। তবু ট্রেন খুব বেশী লেট না করলে হাঁটতেই ভাল লাগে। আজ বাপী বেকারির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মৃন্ময় পলাশের হাতে টান দিয়ে পাশের গলির দিকে ইঙ্গিতে দেখায়। গলি দিয়ে জোরে হেঁটে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে অরূপ, ক্লাস নাইনের অরূপ ঘোষ, সাথে একটা অচেনা ছেলে। পলাশ ডাকতে গিয়েও থেমে যায়। ‘'গোল্লায় গেছে ছেলেটা, একেবারে উচ্ছন্নে গেছে।” গজগজ করে মৃন্ময়। ঘাড় নেড়ে সায় দেন কৌশিকবাবু। কৌশিক পোড়েল, বছর দশেক ইনিই হেডস্যারের দায়িত্ব পালন করছেন।
মৃন্ময় অঙ্ক আর ভৌতবিজ্ঞানের মাস্টারমশাই হলেও টিচারের অভাবে জীবনবিজ্ঞানও ওই পড়ায়। মৃন্ময়স্যার ছাত্রদের খুব প্রিয়। ওরই উৎসাহে ছেলেরা অনেকে অঙ্ক অতিরিক্ত ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে নেয়, ভাল নম্বরও পাচ্ছে মাধ্যমিকে। এই অরূপ ছেলেটাও অঙ্কে ভাল, ইংরিজি ছাড়া প্রায় সব বিষয়েই ভাল নম্বর পায়। তবে গত কয়েকমাস ধরে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে। একবার গার্জেন কলও হয়ে গেছে। লাভ হয়নি বিশেষ, অরূপের বাবা তাঁর মনিহারি দোকান বন্ধ রেখে আসতে পারেননি। মা এসেছিলেন বটে, ‘'আপনারা খুব মারবেন ওকে স্যার”- ছাড়া আর কিছুই বলেননি তিনিও। ছেলে সম্ভবত মাকে একেবারেই পাত্তা দেয় না।
দুদিন পরে অরূপকে ক্লাসে দেখে ছুটির পরে কমনরুমে আসতে বলল পলাশ। সেদিনের কথা বা এই কদিন স্কুলে না আসার জন্য কোন বকাবকি না করে সেদিনের পড়াটুকু বুঝিয়ে গরমের ছুটির আগে একটা ফুটবল টুর্নামেন্টের পরিকল্পনা করা যায় কিনা জিজ্ঞেস করে ক্লাসকে। ক্লাস সেভেন এইট যেমন লাফিয়ে উঠেছিল, নাইনে তেমন উৎসাহ দেখা যায় না। টিম বানাতে বানাতেই ছুটির ঘণ্টা পড়ে। পলাশ একেবারে অরূপকে সঙ্গে করেই কমনরুমে আসে। মৃন্ময়দের বেরিয়ে যেতে বলে হাতের জিনিষগুলো রেখে বাইরের বেসিনে হাত ধুতে যায়। ফিরে এসে অরূপের দিকে তাকিয়েই এক ঝটকায় মাথায় রক্ত উঠে যায় ওর।
৪)
থমথমে কমনরুমে শ্রীলা আস্তে করে গলা খাঁকারি দেয়। কৌশিকবাবু তাকালে আস্তে আস্তে বলে ‘আমি আর তাহমিনা তাহলে বেরোই এবারে। সন্ধ্যে হয়ে আসছে।’ ঘাড় নাড়েন কৌশিকবাবু, একটু থেমে বলেন মৃন্ময় তুমিও যাও দিদিমণিদের সঙ্গে। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে ব্যাগটা টেনে নিয়ে উঠে পড়ে মৃন্ময়। ওরা বেরিয়ে গেলে কম্পিউটারের দীপঙ্কর বলে ‘'আচ্ছা আমি তাহলে আমার বন্ধু সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলে দেখি সপ্তাহে একদিন করে এখানে আসতে পারে নাকি।’’ পলাশ বলে “হ্যাঁ আমরা চাঁদা তুলে কয়েকটা সেশনের ব্যবস্থা করব নাহয়।” সবাই সায় দেয়। স্কুল বন্ধ করে যে যার বাড়িমুখো রওনা দেয়।
ট্রেনে বসে পলাশ চোখ বন্ধ করে ভাবছিল গত কদিনের ঘটনা। আদর্শনগরে মেয়েদের স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাবার পর টিচারদের কিছু নতুনপাড়ার গার্লস স্কুলে, কিছু বাইরে নানা জায়গায় পাঠায় সরকার থেকে। শুধু শ্রীলা আর তাহমিনাকে পলাশদের স্কুলেই নিয়োগ করে। সেদিন হাত ধুয়ে ফিরে পলাশ দেখেছিল তাহমিনা পেছন ফিরে নিচু হয়ে আলমারিতে কিছু রাখছে আর অরূপ অদ্ভুত লোলুপ চোখে তাহমিনাকে দেখছে। সাথে হাতের আঙুলে অশ্লীল মুদ্রা। প্রথম ইচ্ছে হয়েছিল সপাটে চড় লাগায় একটা। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে অরূপকে ডেকে নিয়ে মাঠে এসে ঘাসের ওপরে বসে। সেদিন প্রায় একঘণ্টা কথা বলেছিল ওরা।
অরূপ আর পড়াশোনা করতে চায় না, বরং মুম্বাই বা চেন্নাই গিয়ে ‘মাল্লু কামাতে চায়।’ অরূপ একা নয়, প্রবীর, তনুময়, অনুজও তাই চায়। বলে পড়াশোনা করে কী হবে? মাল্লু থাকলে সবাই পায়ে এসে পড়বে। খানিকটা ইতস্তত করেই পলাশ জিজ্ঞেস করে ওদের কারো মেয়েবন্ধু আছে কিনা? কোচিনে বা পাড়ায়? তাতেই মুখ খুলে যায় অরূপের। মেয়েরা যে কত খারাপ, ওদেরকে স্রেফ মারের ওপরে রাখতে হয়, ওরা টাকা দেখলেই গলায় এসে পড়বে, পড়াশোনার নামে সেজেগুজে স্কুলে যায় আর সরকার থেকে টাকা পায় তাই টাকা ছাড়া কারো দিকে তাকায় না এইরকম অনেক কিছু টানা বলে যায়। প্রতি বাক্যের সাথে মুখের বিকৃতি বুঝিয়ে দেয় মেয়েদের প্রতি ওর অপরিসীম ঘেন্না।
৫)
চৈত্রমাস শেষ হয়ে আসছে, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, জারুল শিরীষ গাছগুলো ফুলে ছেয়ে গেছে। তবে আমগাছে এবারে তেমন মুকুল ধরেনি। দোকানে দোকানে সেলের হাতছানি। আদর্শনগর হাইস্কুলের ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে। ক্লাস ফাইভ থেকে এইট একটা গ্রুপ আর নাইন থেকে টুয়েলভ আরেকটা। প্রথম গ্রুপের ছেলেদের ভীষণ উৎসাহ কিন্তু দ্বিতীয় গ্রুপে মাঝে মাঝে এক একটা টিমে এগারোজন পাওয়াই মুশকিল হয়। পলাশরা তবু জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে যায় ম্যাচ। সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক এখনো সময় করে আসতে পারেন নি। তবে বলেছেন ওঁর পরিচয় না জানাতে। ‘'মনোবিদ’ শুনলে ছাত্রদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
মৃন্ময় কয়েকদিন ধরে স্কুলে আসা যাওয়ার পথে ঘুরে ঘুরে অরূপ প্রবীরদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলেছে। ছেলেরা পড়া ছেড়ে বাইরে কাজে যেতে চায় শুনে কেউই তেমন অবাক হননি। বরং কিছুটা খুশীই, সংসারের দায়িত্ব নেবে সে তো ভাল কথা। তনুময়ের মা বললেন ট্যাব পেয়ে ছেলেদের খুব উপকার হয়েছে, এইসব খবরাখবর আমরা আর কোত্থেকে পাবো?
অনুজের দাদা মনোজ বেশ রেগে রেগে বলল স্কুলে ওই ‘ওদের’ টিচার নেওয়া ঠিক হয়নি, ‘ওরা’ তাল খুঁজছে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের লাভ জিহাদে ফাঁসাতে। মৃন্ময় ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে চেষ্টা করায় মনোজ আরো রেগে ওঠে।
এই কাটুয়া মোল্লারা কেমন ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে আসছে পাশের দেশ থেকে তা কি মাস্টারমশাই চোখে দেখেন না? তার চড়া গলার আওয়াজে আশপাশ থেকে কজনা জড়ো হয়ে যায়। সকলেই সায় দেয়, মনোজ আদর্শনগরে বেশ নামকরা ইলেকট্রিকাল মিস্ত্রি। প্রায় সব পাড়ায় নিত্য যাওয়া আসা আছে তার। সে কি আর আন্দাজে বলছে? জেনেই বলছে। স্কুলে এসে সাবধানে তাহমিনার কান বাঁচিয়ে মৃন্ময় কমনরুমে কথাগুলো বলে। দীপঙ্কর আর শ্রীলা একটু কিন্তু কিন্তু করে বলে মনোজের কথা খুব একটা ভুল নয়। পলাশ মৃন্ময় উত্তেজিত হয়ে ওঠে, শ্রীলারাও গলা চড়ায়। তাহমিনা কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে ঢোকে, হাতে মোবাইল, মুখ ফ্যাকাসে - ‘'সর্বনাশ হয়ে গেল স্যার, সব শেষ হয়ে গেল।”
দশ দিন পর
কমনরুমে জনা ছয়েক চুপচাপ বসে আছে। কিছুক্ষণ পরে কৌশিকবাবু গলা খাঁকারি দিলেন, ‘'তাহলে কী করা যায়? ডিআই অফিস থেকে তো কিছুই বলতে পারছে না।” এ ওর মুখের দিকে তাকায়, পলাশ আস্তে বলে আমরাই নাহয় মাসে মাসে কিছু করে দিয়ে মৃন্ময়দের আসতে বলি। কৌশিকবাবু চিন্তিত মুখে বলেন তাতে আবার আদালত অবমাননার দায়ে পড়ব না তো…। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মৃন্ময় শ্রীলা তাহমিনাসহ ছয়জনের চাকরি গেছে এই স্কুল থেকে। নতুনপাড়া সিদ্ধেশ্বরীমাতা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকেও জনা সাতেকের গেছে। সেদিন তাহমিনা প্রথম খবরটা আনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোটা স্কুলে ছড়িয়ে গিয়েছিল খবর।
প্রথম দু'একদিন ওরা কয়েকজন স্কুলে এসেছে। রাস্তায় এদিক ওদিক থেকে ‘চোর মাস্টার’, ‘কত দিয়ে পেইছিলে?’ এইসব উড়ে আসায় আর চাকরি গেছেই, এ আর পাওয়া যাবে না এই ধারণা চারিয়ে যাওয়ায় আর কেউ আসছে না। এ মাসটায় অনেক ছুটিছাটা, ছাত্রও অনেক কম আসছে তবু সব ক্লাস সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তবু যাই হোক পরীক্ষার খাতাগুলো সকলেই দেখে দেবে বলেছে এই যা বাঁচোয়া। ক্লাস নাইনের অমিতেশ এসে জানিয়েছে অরূপরা চারজন আর ইলেভেনের তিনজন সাউথে চলে গেছে কাজ পেয়ে। আর পড়বে না। কী কাজ? কোথায়? এসব জানে না অমিতেশ।
বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যে হয়ে এলো প্রায়। ক্লাস নেওয়া, মিড ডে মিলসহ আরো পাঁচরকম সরকারি প্রকল্পের কাজ কীভাবে সামলানো যাবে সে নিয়ে কিছুই ঠিক করা যায় নি। পলাশ বলে দেখুন যারা টাকাগুলো নিয়েছিল তাদেরকে কেউ তেমন কিছু বলছে না অথচ শ্রীলাদের না জেনেই কেমন দাগি বানিয়ে দিচ্ছে মানুষজন। কৌশিকবাবু মলিন হাসেন। তাইই তো হয়। তালা লাগিয়ে রাস্তায় ওঠার মুখেই পলাশের ফোন বাজল, মৃন্ময়। বাকীদের এগোতে বলে পলাশ দাঁড়ায়। মৃন্ময় কলকাতায় যাচ্ছে কদিন, আন্দোলন বিক্ষোভে যোগ দিতে।
আগে কোনোদিন এসব বিক্ষোভ টিক্ষোভে যোগ দেয়নি ওরা কেউই। এমনকি সেই ডাক্তার মেয়েটা যখন হাসপাতালেই খুন হয়ে গেল তখনো না।
কিছু হল কিনা জিগ্যেস করার আগেই মৃন্ময় তড়বড়িয়ে জিজ্ঞেস করে ‘'আচ্ছা মনোজ যে বলছিল ‘ওরা’ আসছে সব জায়গা ভরে ফেলছে, অনেক বড় ছক কষে আসছে সব দখল করতে, এইসব খবর গোপন সূত্র থেকে পাওয়া যায়। আমি শুনেছিলাম লোকের মধ্যে খবরগুলো ছড়িয়ে দিলে নাকি টাকা পাওয়া যায়। তুমি জানো কোথায় কার কাছে নাম লেখালে এটা পাবো?” পলাশও শুনেছিল বৈকি! কিন্তু এ তো অন্যায়! মারাত্মক ভুল গুজব সব। ওর থেকে উত্তর না পেয়ে কেমন মরীয়া গলায় মৃন্ময় বলে যায় ‘'কী করব পলাশদা আমার বাড়িতে ছটা পেট, সেভিংস যা আছে তাতে মাস দুই চলবে।
বাবার অপারেশনে পার্সোনাল লোন নিয়েছিলাম তার কিস্তি আছে… কী করে কী হবে পলাশদা? তুমি একটু মনোজের সাথে কথা বলে জানাবে গো আমাকে।’’
কেউ যেন গলা টিপে ধরেছে, একটাও শব্দ বেরোয় না পলাশের গলা দিয়ে। মৃন্ময় বলে চলে ‘হ্যালো হ্যালো পলাশদা, শুনতে পাচ্ছ? হ্যালোও…’ পলাশ সামনে তাকিয়ে দেখে ‘আদর্শনগর’ শব্দটা আর পড়া যাচ্ছে না। অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে।