এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল

  • টুকরে টুকরে গ্যাং (পথনাটিকা)

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ইস্পেশাল | ০৭ এপ্রিল ২০২৫ | ৫০ বার পঠিত
  • টুকরে টুকরে গ্যাং (পথনাটিকা )
    চারজন লোক একসঙ্গে খেতে বসেছে। মনে হয় এরা মজুর শ্রেণীর লোক, কাজের অবসরে টিফিনের ছুটিতে
    একসঙ্গে খাবে। প্রত্যেকের সামনে একটা করে গামছা পাতা, গামছায় খানিকটা করে চিঁড়ে। এদের নাম রসুল,
    বিনয়, কালু আর যুদিষ্টির। যুদিষ্টির একটা মোড়া কলাপাতা থেকে খানিকটা করে কিছু-একটা প্রত্যেককে দেয়।


    বিনয়। (যুদিষ্টিরের দেওয়া খাবারটা মাখতে মাখতে) যুদিষ্টির আচে সুকে, রোজ রোজ বউয়ের হাতের রান্না...

    রসুল। তা সুকের তোরই বা কম কী, বিনয়? দেশে ফিরে বউয়ের রান্না, একেনে বৌদির।

    বিনয়। তা ঠিকই কয়েচ। কালুও তো বলতেছিল কাল, সামনের বার বউ-বাচ্চাকে লিয়েই আসবে। কনট্যাকটর কয়েচে একেনের কাজ আরও দুটি বচ্ছর চলবে। বউরা এলে তাদেরও কাজ দেবে। তাহলে মন্দ কী কও। দুয়ে-মিলে কাজ করলে দুটো পয়সারও মুক দেকবে, শুণ্ডির বাঁদা দেওয়া জমিটাও ছাড়াতে পারবে, বাচ্চাটাকে একেনেই লেকাপড়ি শেকাবে, এক্কেরে রাজার জীবন, কও?



    পেছন থেকে বেশ জোরে কয়েকজনের গলা শোনা যায়, তারা এগিয়ে আসে,
    এবং তাদের মধ্যে একজন ওদের খাবারের দিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে।


    ১। অ্যাই, ওটা কী খাচ্ছিস, পোয়া নাকি? কী দুর্গন্ধ রে বাবা, পেট গুলিয়ে অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে আসতে চায়।

    রসুল। না না পোয়া লয় পোয়া লয়। সকাল থেইক্যে মশলা বয়ে বয়ে ঘাড়ে-পিটে ব্যতা হইয়্যে গেল। একন কি আর পোয়ায় পোষাবে? একন নিদেনপক্কে এক-একজনের আদা-আদা সের।

    ২। কায়দা করে কথা বলে আসল কথা ঢাকবার চেষ্টা করিস না রসুল। তোকে ওজনের কথা কে জিজ্ঞেস করেছে? যেটা খাচ্ছিস সেটার নাম কী? পোয়া?

    যুদিষ্টির। ওরে রসুল, বুজলিনি, চিঁড়েকে ওরা পোয়া নামে ডাকে। হ্যাঁ বাপু, পোয়াই খাচ্চি আমরা। তাতে তোমাদের রাগের কী হল? খেইয়্যে দেকবে এট্টু কেমন লাগে? আরে এই কালু, দে না ওদের চাট্টিখানি করে।

    ৩। একদম চালাকি করবি না যুদিষ্টির। এইসব পোয়া-মোয়া আমাদের দেশের খাদ্য নয়, আমাদের ধম্মেরও নয়।

    কালু। তোদের খাইদ্য লয় মানে কী? তোদের খাইদ্য লয় আর আমাদের খাইদ্য? আমরা কি এদেশের লোক লই নাকি? গিয়ে দেকে এস, হাজার বচ্ছর ধরে আমাদের শুণ্ডির লোকরা চিঁড়ে খেইয়্যে পেট ভরিয়ে এসেচে। আমাদের বাপ-পিতেমো সবাই খেইয়্যেচে। একন চিঁড়েকে পোয়া লামে ডেইক্যে আমাদের খাবারের বদনাম কইরতে চাও?

    ৪। সেই কথাই তো বলতে এলাম আমরা। তোরা সব কটা আসলে মুণ্ডির লোক। সেই যে সাতচল্লিশে দেশ ভাগ হল, তখন যত শালা কালু-রসুলের বাপ-পিতেমো শুণ্ডি ছেড়ে চলে গেল মুণ্ডিতে। আর মুণ্ডি থেকে মেরে তাড়িয়ে দিল যারা আমাদের বোষ্টম ধম্মের লোক, তাদের।

    যুদিষ্টির। মুক সামলে কতা বলবে বলে দিচ্চি। কালু-রসুলের বাপ-পিতেমো শুণ্ডি ছেইড়্যে চলে গেল মুণ্ডিতে? যত আমাদের মইদ্যে ভাঙন ধরাবার চেষ্টা? ওদের বাপ-পিতেমো সেই ছিষ্টির দিন থেইক্যে আচে শুণ্ডিতে। লিজেদের মাটি-জমিন ছেইর‍্যে মুণ্ডি যাবে কোন্‌ দুক্যে? ওদের গায়ে যে অক্ত আমাদের গায়েও সেই অক্ত। মাটি জলের দ্যাশ আমাদের শুণ্ডিমুণ্ডি। এমন মাটি দেইকোচো কোতাও? যিদিকে তাকাবে শুদু ধান, সোনাপানা ধান। আর জলের মইদ্যে মাচ। তাই আমরা ভাত খাই, চিঁড়ে খাই, আর মাচ খাই। যকন বিদেশে যাই, ওই মাচ শুকনো কর‍্যে কৌটোয় লিয়ে আসি। তাই খাই চিঁড়ে দিয়ে। তোদের দুগ্‌গন্দ লাইগ্যে তো খাইস না। কে তোদের খেইত্যে ডেইক্যেচে রে?

    ২। (মাটিতে লাঠি ঠুকে) মুখ সামলে কথা বলবি যুদিষ্টির। মনে রাখিস এ তোদের পেটরোগা ঢিপঢিপে-বুকের ছাতির দেশ শুণ্ডি নয়, এ রীতিমতন হাল্লা রাজ্য।

    কালু। হ হ শুনিচিতো, তোদের সব ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতি!

    ৩। বিদেশ থেকে না খেতে পেয়ে আমাদের রাজ্যে এসেছিস শালা পেটের জ্বালায়, মাথা নীচু করে বউ-বাচ্চা সামলিয়ে কাজ করে চলে যাবি। শালা!

    বিনয়। (উঠে দাঁড়িয়ে) কী কইতে চাস কী তোরা? বউ-বাচ্চা সামলে? আমরা শালা বিদেশ থেইক্যে এইস্যিচি? আমাদের শুণ্ডিরাজ্য বন্ধুদেশের মইদ্যে লয়? বিদেশ?

    ১। নিজেদের ভালো বুজিস না রে বিনয় আর যুদিষ্টির, ভালো কথা বইললে শুদুই মাতা গরম কইরত্যে শিখেছিস।

    ৪। তা নয় তো কী? আরে, এই লুঙ্গিওয়ালা গুলো তোদের বুকের উপর বসে তোদেরই দাড়ি ওপড়াচ্ছে। শুনিসনি দেশের
    পোদান স্বয়ং কী বলেচেন? ওদের পোশাক দেখলেই ওদের চেনা যায়, শুনিসনি?

    কালু। যেমন তোরা তেমনি তোদের পোদান হবেনি? আরে শুণ্ডিরাজ্যে লুঙ্গি চালু হইয়্যেচে সেই নিমাই সন্নেসীর আমল থেইক্যে। বামুন কায়েত নমোশুদ্দুর সব হিন্দুরা আর মোচলমান চাষা-জমিদার সব্বাই সেই নিমাই পণ্ডিতের লেইগ্যে গেরুয়া লুঙ্গি পরে লাইচত্যে লাগলো, কেরমে কেরমে সেই গেরুয়া রঙ বদল্যে, যে যার পচন্দের রঙে শুণ্ডিরাজ্য ছেইড়্যে অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ ছেইড়্যে – বন্ধু আর সিন্ধু দ্যাশতো ত্যাখন এক্যেই ছেল – সব দ্যাশেই পরতে শিকলো। অ্যাকন সরকারি পয়সায় বিশ-লাখি প্যান্টুল-কোট পইরত্যে শিখ্যে তোদের পোদান লুঙ্গিওয়ালা চিনত্যে শিক্যেচে!

    ২। যত্তো বড়ো মুখ নয় তত্ত বড় কথা! দেশের পোদানকে তুচ্ছু করতে শিকোচো? দেশদ্দোহিতার নালিশ একখানা ঠুকে দিলে পালিয়ে বাঁচার পথ খুঁজে পাবিনা রে শালা।

    বিনয়। সেই পথ তুই-ই খুঁজে মর। একন ভাগ ইকান থিক্যে। আমাদের খেইত্যে দে রে শালা।



    ১ ২ ৩ ৪-কে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে ওরা খেতে শুরু করে, ১ ২ ৩ ৪ কিছুক্ষণ ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ওদের
    দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতে যেতে নিমাইয়ের সঙ্গে দেখা। নিমাইও শুণ্ডি
    রাজ্যের লোক, কিন্তু ওর কপালে একটা লাল ফোঁটা। পোশাক-আশাকও অন্যদের তুলনায় একটু ভালো।


    নিমাই। কী হল রে তোদের? ঝগড়াকাজিয়া কর‍্যে যাচ্চিস মনে লাগে। কী লিয়্যে ঝগড়া?

    ১। এই তো তোদের শুণ্ডি না মুণ্ডি রাজ্যের এই শালা লুঙ্গিওয়ালা বিধম্মীগুলোর সঙ্গে কথা বলচিলাম। বলে, আমাদের দেশের পোদান নাকি এই সেদিনও হাড়হাভাতে ছিল। এখন পোদান হয়ে দেশের লোকের পয়সায় বিশলাখি কোট-প্যান্টুল পরতে শিখ্যে সবায়ের পোশাক লিয়ে কতা কয়।

    ২। আমরা তাই বলেছি দেশের পোদানের নামে বাজে কথা কও, দেশদ্দোহিতার মামলা ঠুকে দেব। তাই নিয়ে চোপা!

    নিমাই। (কালুকে) কী রে কালু, তোকে কতবার কয়েচি না ঝগড়া-কাজিয়া না কইরত্যে? বললুম, বউকে নিয়ে চল্যে আয়, কনট্যাকটরকে বল্যে কইয়্যে তোর বউকে একটা কাজে লাইগ্যে দোব, শুণ্ডির জমিটা ছাড়াতে পারবি। এ রাজ্যটা হাল্লা, মনে লেই সে কতা? যাদের দেশে থাকবি তাদের সাথে কোথায় ভাব-ভালোবাসা কইর‍্যে থাকবি, তা না ঝগড়া।

    যুদিষ্টির। অ, তুমি হইচ্য শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল? শোন, কালু কিছু কয়নি, কইচি আমি। সকাল থিক্যে খাট্যে খুট্যে সবাই মিল্যে বসচি দুটো চিঁড়ে লোইট্যা মাচের শুটকি দিইয়ে মজা কর‍্যে এট্টু খাব, তা না কোথা থিক্যে উড়্যে এসে গাওনা শুরু করচে, কী খাস? পোয়া নাকি? আরে, কী দুগ্‌গন্দ! তোর কী রে শালা, আমার খাবারে দুগ্‌গন্দ আমি খাই, তোকে আমি খেইত্যে সাদচি? বলে আমরা সব নাকি বিদেশী, মুণ্ডির লোক!

    নিমাই। তা তোরাই বা সবার সামনে শুটকি খেইত্যে যাস কেন? যে দেশে যে নিয়ম। দেখচিস না এখেনে সবাই রুটি-সবজি খায়? আইন করে সব রাজ্যে মাচ খাওয়া বন্দ করা হচ্চে শুনিসনি?

    বিনয়। মাচ খাওয়া বন্দ? আমাদের শুণ্ডিতেও? তাইলে আমরা খাবটা কী?

    নিমাই। কেন, দেশ শুদ্দু লোক যা খায়, রুটি-সবজি। আইন মানবি না, অন্য রাজ্যের লোক বইলব্যে না মুণ্ডি থেইক্যে এসিচিস? জানিস না (হাত জোড় করে) ভগবান বিষ্ণু মৎস্য-অবতারে নিজে পিথিমিতে অবতীন্ন হইয়্যেছিলেন? সেই মৎস্য খাবি হিঁদু-বোষ্টমের ছা হয়্যে? যা পাপ কইর‍্যেচিস এতদিন কইর‍্যেচিস ঠিক আচে, একন দেশে আইন হইচ্যে, সবাই একন থিইক্যে রুটি-সবজি খাবে।

    রসুল। আইন কী কইর‍্যে হল্য? আমরা তো কেউ এই আইনের বোতামে টিপ দিলুম না ভোটের সময়?

    নিমাই। ওরে ওরে ওরে ওরে ওরে! তোর কী সাহস রে রসুল! আইনের বোতামে তুই টিপ দিবি?

    কালু-নিমাই-বিনয়-রসুল (সমস্বরে)। আমাদের জন্যে আইন, আমরা টিপ দিবুনি? (১ ২ ৩ ৪ জোরে হেসে ওঠে, কালুরা বোকা-বোকা মুখ করে চারিদিকে তাকায়)

    নিমাই। এই বুদ্ধি নিয়ে কাজ কইরত্যে এসিচিস! হঃ, কী আর বইলব! শোন্‌, কী আইন হইচে শুন্যে নে আমার ঠেঙে। এ দেশে আর নতুন কইর‍্যে কোন লুঙ্গিওয়ালা ঢুকবে না। শুদু তাই লয়, সিন্ধু আর মুণ্ডি দেশে যত বোষ্টম আচে, তারা আসতে চাইলেই এ দেশে তাদের নাগরিক করে নেওয়া হবে, কারণ তারা আমাদের ভাই, লুঙ্গির দেশে তারা ভালো নেই।

    বিনয়। তুমি খালি লুঙ্গির দেশ, লুঙ্গিওয়ালা এসব কইচ কেন? আমরা সবাই তো লুঙ্গি পরি, তুমিও তো পর।

    নিমাই। (নিজের প্যান্ট দেখিয়ে) কই পরেচি? এটা লুঙ্গি নাকি?

    কালু। সে একন পরনি, গেরামে তো দিব্যি পর, সবাই জানে।

    নিমাই। আর পরব না।

    রসুল। অ, তা এত লোককে যে মুণ্ডি আর সিন্ধু থিক্যা আনাবে, তারা কইরব্যেটা কী? দেশে তো এমনিতেই কাজকম্ম নাই, আমাদের গেরামের সূয্যি বাবুর ছেইল্যে সে বার এম-এ পাশ কইরল্যো। এখন শুনচি রাজস্তানে পাতর ভাঙার কাজ কইরত্যে যাবে। এতগুলান লোক যে আনাবে, তাদের খুদা-তেষ্টা নাই? কাম-কাজের দরকার নাই?

    নিমাই। সে সরকার দেইখব্যে।

    বিনয়। সরকার যেদি দেইখতে পাইরত্যো, তো অকনই কেন দেক্যে না, এত বেকার সব চাদ্দিকে!

    নিমাই। সোজা কতা সোজা ভাবে বুজিসনা কেনে, অ্যাঁ? এই যে এতগুলান লুঙ্গিওয়ালা দেশ ছাইড়্যে যাবে, তাদের কাজকাম? সেগুলান তো নতুন যারা আইসব্যে তারাই পাব্যে।

    কালু। দেশ ছাইড়্যে যাবে কারা?

    নিমাই। এ আর শক্ত কতা কী? যে লুঙ্গিওয়ালারা কাগজ দেখাত্যে পারবে না, তাদের যে সাতচল্লিশের আগে জন্ম হইছ্যে তার প্রমাণ, বাপ-পিতেমো একেনে জন্মেচ্যে তার প্রমাণ, এসবের কাগজ যাদের কাচে নাই তারা!

    বিনয়। আর যারা আইসব্যে, যাদের তুমরা আনাইব্যে সেই বোষ্টমরা? তাদের কাগজ?

    নিমাই। আমরা দিব। সরকার দিবে।

    যুদিষ্টির। মানে? এ-দেশে যারা আচে, তাদের কাগজ নাই, তারা দেশ ছাইড়ব্যে, আর যারা দেশে নাই, একন আইসব্যে, তাদের কাগজ সরকার দিবে! (প্রায় ভেঙে পড়ে, তারপর কালু আর রসুলকে দেখিয়ে) এই যারা ছিষ্টির দিন থেইক্যে এ-দেশে আচে, তাদের কাগজ নাই তাই দেশ ছেইড়্যে যাবে, আর ও দেশ থেইক্যে যারা আইসব্যে সরকার তাদের কাগজ দিবে, এই বিচার!

    নিমাই। তাই তো বলি, কতা শোন্‌ কতা শোন্‌।



    হঠাৎ দূর থেকে একটা গণ্ডগোলের শব্দ, আর “ওই তো ওখানে পাঁচজনকে কী বোঝাচ্ছে” – এরকম একটা কথা
    শোনা যায়। একদল লোক দৌড়োতে দৌড়তে ঢুকে নিমাইকে ঘিরে ফেলে। তাদের সমবেত কণ্ঠস্বর শোনা যায়।


    সমবেত। এই শালাই পালের গোদা। এই নিমেটাই লুকিয়েছে, দালাল শালা। একে পেটালেই সবাইকে পাওয়া যাবে। (মারতে উদ্যত)



    আরও একদল লোক ঢোকে, সবাই মিলে নিমাইকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে, মনে হয় বিনয়দের দলের এরা পরিচিত।


    বিনয়। কী হল রসময়?

    রসময়। কাল রাত্তিরে আমাদের বস্তিতে আগুন লেগেচে। সব পুড়ে ছাই। বাচ্চা-কাচ্চা যারা ছিল তাদের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় স্টেট-বাসের গুমটিতে পাওয়া গেছে, মেয়েদের কাউকে এখনও পাওয়া যায়নি। আশপাশের দোকানদাররা বলছে কাল অনেক রাত্তির পর্যন্ত তারা এই নিমে আর তার দলবলকে বস্তির কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করতে দেখেচে।

    যুদিষ্টির। এসব হল কেন?

    রসময়। পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া। যে সাইটে আমরা কাজ করি সেখানে দুপুরের খাওয়ার ছুটিতে আমাদের খাওয়া নিয়ে একদল ঝামেলা করে। নিমেও ওদের মধ্যে ছিল, শালা এখন লীডার হয়েছে। তারপর কাল রাত্তিরে এই কান্ড। আমরা ঠিক করেছি আর কাজ করব না। আমাদের মেয়েদের ফিরিয়ে দিক, আমরা আজই শুণ্ডিতে রওনা দেব।



    ভীড়ের মধ্যে এই কথোপকথন শুনছিল রাও নামে একজন। সে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে।


    রাও। কেউ যাবে না। সবাই এখানে থাকবে। (হাততালি দিয়ে এবং চিৎকার করে সে লোক জড় করে)

    রাও (ভীড়ের উদ্দেশে) । ভাইসব, আমাদের এই শুণ্ডির ভাইরা বছর বছর আমাদের এখানে কাজ করতে আসে, আমরা কি তাদের চিনি না?

    ভীড়ের মধ্যে থেকে একদল। কী যে বলো রাও, চিনব না কেন? চিনি চিনি।

    রাও। ওরা আমাদের বন্ধু কিনা?

    ভীড়ের মধ্যে থেকে একদল। হ্যাঁ, বন্ধু।

    রাও। নাগরিকত্বের নতুন আইন আনবার পর সরকার অনেক দালাল লাগিয়েছে। এই দালালরা নানা রাজ্য থেকে এসে এদের নিজেদের রাজ্যের মানুষকে নিজেদেরই বিরুদ্ধে লাগাবার চেষ্টা করছে। প্রতিটি রাজ্যের লোকের আলাদা আলাদা অভ্যেস, আমাদের এই এত বড় দেশে লোকে নানারকমের পোশাক পরে, নানারকমের খাবার খায়, নিজের নিজের মতো তাদের আনন্দ, উৎসব, নাচ-গান। সরকার চাইছে দেশের এই বিভিন্নতাকে ভেঙে দিতে। দালালদের দিয়ে ভয় দেখিয়ে সরকার চাইছে সবাই একই রকমের পোশাক পরুক, একই রকমের খাবার খাক,একই ভগবানের পুজো করুক, ভেন্ন ধর্মের মানুষদের অসুবিধেয় ফেলুক। আপনারা কী মনে করেন, আমরা এসব মেনে নেব?

    ভীড়ের মধ্যে একজন। রাও যে কথাটা বলল সেটা জরুরি কথা। নিজেদের মধ্যে এত মারামারি করব নাকি?

    আর একজন। না না, কখনোই নয়।

    রাও। আমাদের শুণ্ডির এই ভাইদের বস্তিতে এরা কাল আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। দিনের বেলায় শুণ্ডির সব জাত আর ধর্মের মানুষরা যখন এক সঙ্গে তাদের পছন্দের খাবার খাচ্ছিল, তখনই তাদের ওপর এরা হল্লা চালায়। তারপর রাতে বস্তিতে আগুন দিয়ে এদের ছেলেমেয়েদের বেঁধে ফেলে রেখে যায় স্টেট বাসের গুমটিতে। আর মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখেছে এরা, জানিনা এদের কী বদ মতলব আছে। শুণ্ডির বন্ধুরা এত ভয় পেয়ে গেছে যে তারা ঠিক করেছে, মেয়েদের খুঁজে পেলেই ওরা আমাদের এই হাল্লা রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাবে। আজ যদি শুণ্ডি পালায়, কাল পালাবে আর এক রাজ্য। এই সরকার তা-ই চায়, তাহলে দেশটাকে জাত-ধর্ম ভাষা-খাদ্যের ভিত্তিতে টুকরো টুকরো করার সুবিধে হয়। আমরা কি সরকারের আর তার দালালদের এই ষড়যন্ত্র মেনে নেব?

    ভীড়ের মধ্যে থেকে একদল। না না, কখনোই নয়।

    রাও। তাহলে আমি একটা প্রস্তাব দিই। সকলে শুনুন। শুণ্ডির ভাইরা যে ভয় পেয়ে চলে যাবে তা আমরা হতে দেব না। আমাদের মধ্যে থেকে দশজনের একটা দল এখনই বেরিয়ে পড়বে, শুণ্ডির মা-বোনেদের তারা খুঁজে বের করবে। এই যে নিমে দালালটাকে এরা ধরেছে, ও হল নাটের গুরু। ও নিশ্চয়ই জানে মেয়েদের কোথায় রাখা হয়েছে। কয়েক ঘা দেবার মামলা। যাই হোক, দশজনের যে দলকে আমরা দায়িত্ব দেব, তারাই যা বোঝে সে হিসেবে কাজ করুক। আপনারা কি আমার সঙ্গে একমত?

    ভীড়ের মধ্যে থেকে একদল। হ্যাঁ, একমত। যে দশজন এই দলে যেতে চায় তারা এখনই হাত তুলুক।



    অনেক হাত ওঠে, তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই দল ঠিক করে ফেলে।


    রাও। শুণ্ডির বন্ধুদের আমরা অনুরোধ করছি, আপনারা আমাদের ওপর ভরসা করুন। মা-বোনেদের আমরা খুঁজে বার করবই। কিন্তু আপনারা এখনই হাল্লা ছেড়ে যাবার কথা ভাববেন না। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি, শুধু শুণ্ডি নয়, প্রতিটি রাজ্যের মানুষের সঙ্গে আমরা আছি। আজ, এই মুহূর্ত থেকে আমরা এইখানেই বসে পড়ব। এইখানেই আমাদের অবস্থান ধর্মঘট শুরু হবে। সব ভাষার, সব ধর্মের, সব জাতের লোকরা মিলে আমরা নতুন নাগরিকত্ব আইন ফিরিয়ে নেবার জন্যে লড়াইয়ে নামলাম। যতদিন না সরকার এই আইন ফিরিয়ে নেয়, আমরা এখান থেকে উঠব না। আমাদের লড়াই চলবে। শুণ্ডির ভাইরা, দয়া করে হাত তুলে আমাদের সমর্থন জানান।



    রসুল-কালু-বিনয়-যুদিষ্টির-রসময় এবং আরও অনেকে হাত তোলে, সবাই মিলে শ্লোগান দিতে থাকে।


    সবাই। কালা নাগরিকত্ব আইন ফিরিয়ে নাও ফিরিয়ে নাও। জান দেব মান দেব, কালা আইন মানব না। ইনিকিলাব জিন্দাবাদ। জাত-পাত-ধর্মের ভিত্তিতে দেশকে টুকরো করতে দেব না, দেব না দেব না। এ সরকারের আর এক নাম, টুকরে টুকরে গ্যাং।

    রাও। চমৎকার। দালালরা যারা এখানে এখনও আছিস জেনে রাখিস তোদের ধ্বংস আমাদের হাতে। তোরা যদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে না থাকিস সাধারণ মানুষই তোদের দেখে নেবে, কোন পুলিশের বাচ্চা বাঁচাতে পারবে না। বন্ধুরা, এখন থেকেই আমাদের আন্দোলন শুরু। যার হাতে যা আছে, তাই দিয়ে আমাদের দাবিগুলো লিখে ফেলুন, সহজ দাবি, নতুন নাগরিকত্ব আইন ফিরিয়ে নিতে হবে। জাত-পাত-ভাষা-ধর্ম নিয়ে সরকার আর সরকারের দালালরা কোন কথা বলবে না। আসুন ভাইসব, লড়াই শুরু।



    সমবেত মানুষের হাতে হাতে নানা পোস্টার। নতুন উদ্যমে নানা শ্লোগান ধ্বনিত হতে
    থাকে, তার মধ্যে সবচেয়ে উচ্চকিত, এই সরকারের আর এক নাম, টুকরে টুকরে গ্যাং।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    টুকরে টুকরে গ্যাং (পথনাটিকা )
  • ইস্পেশাল | ০৭ এপ্রিল ২০২৫ | ৫০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন