স্প্রেড যখন সাজানো হচ্ছে তখনই ফল্গু জানিয়ে দিল ওর একজন অতিথি আজ আসবেন ব্রেকফাস্টে, কোন চার্জ লাগবে কি আলাদা করে?
আপনার গেস্ট আমাদেরও গেস্ট, কাজেই ওটা কমপ্লিমেন্টারি, বলেন ম্যানেজার।
পুলিস চীফ পৌঁছোন ঠিক সকাল আটটায়। ফল্গু আলাপ করিয়ে দেয়, স্যর্শিও রামস, এই হোটেলের মালিক আর ম্যানেজার।
আমার নাম জানলেন কী করে? – একটু রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করেন ম্যানেজার।
হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট, সাত-সাতটা হোটেলের মালিক, আর বার্ড লাভার্স ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের নাম ছবিসমেত ছাপা দেখতে পাওয়া কি দুর্লভ? – প্রশ্ন করে ফল্গু।
সেটা ঠিক, হাসেন স্যর্শিও রামস ওরফে ম্যানেজার, তারপর পুলিস চীফের দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনার পরিচয় লাগবে না, আপনাকে আমি চিনি, কী নেবেন স্যর, মাছ পছন্দ করেন?
ব্ল্যাক কফি, চার চামচ চিনি দিয়ে, উত্তর দেন পুলিস চীফ, আর কিছু নয়।
ব্রেকফাস্টের মধ্যেই খুব শান্ত এবং মৃদু গলায় ফল্গু জানায় রামসকে, কোকা পাউডার সমেত আপনার একটা গাড়ি কাল পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে। যদি খুব হৈ হৈ না করেন তাহলে ফেরবার সময় পুলিস চীফ আপনাকে সঙ্গে করে পাশে বসিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। তার আগে হোটেলের কোন কোন অংশ পুলিশ হয়তো সার্চ করতে চাইতেও পারে।
তাম্বোপাতা ট্র্যাভ্লার্স-ইন থেকে পুলিস উদ্ধার করল এক সিন্দুক ভর্তি ট্যাক্সিডার্মি-করা কাকাতুয়া, নানা রিএজেন্ট সমেত ছোট একটা লেবরেটরী, দশ বস্তা কোকা পাউডার, তিন ব্যাগ চামড়ার মুখোশ আর ডজনখানেক তীরধনুক। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে ফল্গু লাঞ্চের সময়। ওবেলিস্কোর মিউজিয়মের লাইব্রেরিতে যখন দেখলুম স্যর্শিও রামস নামের এক ভদ্রলোক পেরুর সবচেয়ে বড় হোটেলিয়ার এবং বার্ড লাভার্স ইউনিয়নেরও চেয়ারম্যান, এবং তাঁর ছবি দেখে বুঝলুম ইনিই আমাদের নিতান্ত ছাপোষা হোটেলটির ম্যানেজারও, তখন থেকেই কেমন খটকা লাগছিল। উনিই আমাদের প্রথম লণ্ড্রোম্যাটে পাঠান, ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারে পাঠান – সে কি কাকাতুয়ার জনপ্রিয়তা দেখাবার জন্যে?
কিন্তু সন্দেহটা, বলতে থাকে ফল্গু, সত্যিকারের দানা বাঁধলো পুন্টুর মৃত্যুর পর। পুন্টুকে হত্যা করা হলো কেন? পুন্টুকে যখন আমরা শেষ দেখেছি ও তখন আমাদের দিকে দৌড়িয়ে আসছিল। কেন আসছিল? আমরা ভাবতে চেয়েছি, ও আসছিল মুড়কির চিঠি আমাদের তাড়াতাড়ি পৌঁছিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? সে ক্ষেত্রে আমাদের দেখতে পাবার পর ওর আর দৌড়োবার প্রয়োজন ছিল না। আমার মনে হয়, ও আসলে আসছিল আমাকে সাবধান করতে, আসন্ন হত্যার হাত থেকে আমাকে বাঁচাবার জন্যে।
পুন্টুর হত্যাকাণ্ডের সময়টা ভেবে দেখুন। মুড়কিকে অপহরণের পর চারদিন কেটে গেছে, আমরা পুলিশের কাছে কোন অভিযোগ করিনি। একটা হোটেলে – পরে জানতে পেরেছি এই হোটেলটারও মালিক রামস – খুব শস্তার একটা ঘর ভাড়া নিয়ে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় একদিন সকালে ট্র্যাভ্লার্স-ইনের রিসেপশন থেকে স্যর্শিও রামস লক্ষ্য করলেন, সামনের রাস্তা দিয়ে লণ্ড্রীব্যাগ হাতে হেঁটে চলেছি উল্কি আর আমি। এই সুযোগ! শেষ সুযোগ! পাখি-সংক্রান্ত তদন্ত আপাতত শেষ করার সবচেয়ে সহজ উপায় ফল্গুকে শেষ করে দেওয়া, আর দেরি নয়! গাড়িটা বের করেন রামস, সঙ্গে তীরধনুক, কালো কাচের আড়ালে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে পৌঁছিয়ে যান লণ্ড্রোম্যাট। হয়তো তীরধনুক নিয়ে নিজেই অপেক্ষা করেন লণ্ড্রোম্যাটে, কাজ সেরে আমরা বেরোলে নিজেই অস্ত্রচালনার কাজটা সারবেন। অথবা এমনও হতে পারে, ছুঁচো মেরে নিজের হাতে গন্ধ না করে, অস্ত্রগুলো কামিলাকে দিয়ে, তাড়াতাড়ি ফিরে যান অন্য রাস্তা ধরে।
পুন্টু জানতো না আমরা কোথায় আছি। তার শেষ জানা আমাদের ঠিকানা তাম্বোপাতা ট্র্যাভ্লার্স-ইন। সে হয়তো খুঁজছিল আমাদের। কপালক্রমে দূর থেকে ঘটনাটা দেখে সে। বুঝতে সময় লাগে তার, অবশেষে যখন বুঝতে পারে, ততক্ষণে দেরি যে হয়ে গেছে, তা-ও বোঝে সে। দৌড়োতে শুরু করে।
লণ্ড্রোম্যাট থেকে বেরিয়ে যখন আমরা দেখি পুন্টুকে, সে তখন দৌড়িয়ে আসছে আমাদের দিকে। লণ্ড্রোম্যাটের মহিলা বা রামস, যে-ই হোক আততায়ী, সে-ও ততক্ষণে তীরধনুক নিয়ে প্রস্তুত। তার তীর যখন পেছন থেকে আমাকে তাক করেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই হঠাৎ সামনাসামনি পুন্টু! এ-ই সেই দুশমন যে মুড়কির খবর নিয়ে এসেছে তাকিলে থেকে। এক মুহূর্তের দ্বিধা। লক্ষ্য কে? ফল্গু? না পুন্টু?
আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে এসে সোজা পুন্টুকে আঘাত করে তীর। লুটিয়ে পড়ে পুন্টু। কিন্তু আততায়ী কে? রামস? লণ্ড্রোম্যাটের মহিলা? কে?
আমার সন্দেহের তালিকায় সেই দিন থেকেই স্যর্শিও রামস। কিন্তু নিশ্চিত হলাম কাল। কালো কাচের গাড়িটা কাল দেখেই চিনেছি। মালিকের নামটা যখন জানা গেল, আর সন্দেহের অবকাশই রইল না।
এই পর্যন্ত শোনার পর পুলিসের সিটি চীফ বলেন, আমার একটা প্রশ্ন আছে। এই নিউক্লিয়ার আর্মসের যুগে রামসরা তীরধনুক ব্যবহার করবে কেন? ভেবে দেখুন, তীরধনুকের বদলে হাতে একটা রিভলভার থাকলে পরপর আপনাদের দুজনকেই সহজেই শেষ করে দেওয়া যেত।
ঠিকই বলেছেন, বলে ফল্গু, তবে সে ক্ষেত্রে আপনাদের গুলিয়ে দেওয়া যেত না। জঙ্গলের সম্পদ যারা চুরি করে, তারাই সগর্জনে জনজাতিদের ঘাড়ে দোষ চাপায়। তীরধনুক নিয়ে যারা খুনোখুনি করে তারা তো জংলী, কাজেই তাদের মধ্যেই খুনিকে খুঁজব আমরা, তাই না?
লাঞ্চের পর যখন ফিরছে ওরা সবাই, উল্কি বললো, কিন্তু ফল্গুদি, যে কাগজটা তুমি দিয়েছিলে তাতে তো রামসের নাম লেখা ছিল সার্গিও অথবা সার্জিও।
নামটা ইংরিজি নয়, স্প্যানিশ, বলে ফল্গু, সম্ভবত স্যর্শিওটাই ঠিক ঠিক উচ্চারণ।
সবাই মিলে আবার অ্যালবার্ট পেরীরার অতিথি। ফল্গুরা সেই গেস্ট হাউজ নম্বর সিক্সের পুরোনো ঘরেই। এবার পাশের ঘরে আছেন চন্দ্রশেখরও। ব্রেকফাস্টের পর উল্কি বলে, সেই সেদিন থেকেই তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাবছি ফল্গুদি, কিন্তু এত তুমি ব্যস্ত, সুযোগই পাচ্ছিনা।
বলিস কী রে, সুযোগই পাচ্ছিস না? বল্ না কী বলবি।
তোমার রিপোর্টে তুমি সব লিখলে, শুধু তাকিলে দ্বীপের টাওয়ার আর ছোট্ট দ্বীপটার গণ্ডারটার কথা লিখলে না। কেন? এমনকি কথাবার্তাতেও তুমি ওই দ্বীপটার কথা বলনি কাউকে। আমি আরও লক্ষ্য করেছি, কখনও কেউ যদি গণ্ডারটার কথা তুলেছে, তুমি কেমন যেন এড়িয়ে গিয়েছ, কথাটাকে আর বিশেষ এগোতে দাওনি।
এগোতে দিইনি, কারণ ওটা গণ্ডার নয়।
গণ্ডার নয়, তবে কী?
তবে কী সেটা বলা শক্ত, তাই একজন বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি জানালে তবেই আমি বলতে পারব।
কিন্তু ফল্গুদি, বলে উল্কি, আমার স্পষ্ট মনে আছে, টাওয়ার থেকে নেমে তুমি প্রথমেই বলেছিলে, অতিকায় কোন গণ্ডার। পরে যদি তোমার মনেও হয় সেটা ভুল, এটা অন্য কিছু, তুমি আমাদের বলবে না?
এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল মুড়কি, এবার সে বলে, তুমিই না বলেছিলে, ভুল করতে ভয় করিস না?
হেসে ফেলে উল্কি, বলে, আমার মনে হয় ওটা ভারতথেরিয়াম।
ভারতথেরিয়াম? ইয়ার্কি মারছ না তো?
উঁহু, সীরিয়াস।
প্রায় লাফিয়ে ওঠে মুড়কি আর উল্কি, সেই যেটা ডারেল কনজার্ভেশন ফাউণ্ডেশনের দায়িত্বে রাখা আছে? সেটাকে দেখলাম আমরা?
সেটা কিনা আমি জানিনা, বলে ফল্গু, সম্ভবত সেটা নয়। দূর থেকে দেখে আমার মনে হলো ওটা ভাল নেই। ডারেল ফাউণ্ডেশনের তত্ত্বাবধানে যেটা থাকবে সেটা ভালই থাকবে। এটা আর-একটা।
তার মানে ভারতথেরিয়াম নাম্বার টূ! – উচ্ছ্বসিত উল্কি আর মুড়কি।
আমার তা-ই মনে হয়েছে, বলে ফল্গু, কিন্তু এসপিণ্ডোলো ছাড়া আর কাউকেই বলিনি। তোদের বলছিলুম বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করেছি, সেই বিশেষজ্ঞ তিনিই। পেরুর পুলিশকে জানালে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা ছিল। কে দখল নেবে, ক্রেডিট কার – এইসব আন্তর্জাতিক কচকচি তৈরি হত। ব্যাপারটা তাই ছেড়ে দিয়েছি এসপিণ্ডোলোর হাতে। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফল্গু, কিন্তু এখনো কিছু জানালেন না এসপিণ্ডোলো। এদিকে পরশু দিনের ফ্লাইট কনফার্মেশন হয়ে গেছে আমাদের। ফেরবার আগে জানতে পারব কিনা কে জানে!
জানতে কিন্তু পারল ওরা পরের দিনই। ব্রেকফাস্টের অপেক্ষায় সবাই বসে আছে, এমন সময় বেজে উঠল ফল্গুর মোবাইল ফোন। ওদিক থেকে ভেসে এল এসপিণ্ডোলোর গলা, তোমরা কোথায় আছ ফল্গু?
ব্রাসিলিয়ায়, প্রফেসর পেরীরার গেস্ট, ফল্গু বলে, এখন ব্রেকফাস্ট করব সবাই মিলে।
সবাই মানে কে কে? কে কে আছ ওখানে?
আমরা তিনজন।
তাহলে তোমার ফোনটা লাউডস্পীকারে করে দাও।
লাউডস্পীকারে করার পর শোনা যায় এসপিণ্ডোলোর গলা আবার, পেরু থেকে সাকসেসফুলি ফিরেছ শুনলাম, ফিনিগান ফোন করেছিল, তোমাদের নাকি পার্টি দিয়েছেন পেরুর পুলিস চীফ খুশি হয়ে। গূড। এবার আমার রিপোর্ট শোন। যে প্রাণীটাকে তুমি দেখেছ সেটা ভারতথেরিয়ামই।
আনন্দে প্রায় লাফিয়ে ওঠে সবাই, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দধ্বনি মুড়কি আর উল্কির গলায়, ফল্গু আর একটু এগিয়ে বসে ফোনটার দিকে। আবার শোনা যায় এসপিণ্ডোলোর গলা, তবে আমি এটার নাম দেব ভারতথেরিয়াম ডলি।
মানে? ডলি মানে? – ফল্গুর গলায় বুঝতে-না-পারার স্বর।
ডলির নাম শোননি? ডলি দ্য শীপ?
শুনেছি তো, বলে ফল্গু, ক্লোন করা ভেড়া। উনিশশো ছিয়ানব্বইয়ে যেবার আমি এইচ-এস দেব, সেবার হয়েছিল। স্কটল্যাণ্ডে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এটাও ক্লোন। তুমি বলেছিলে, বিশাখাপত্তনমের পোর্ট থেকে তোমরা উদ্ধার করেছিলে চুরি-যাওয়া ভারতথেরিয়ামকে। কোন লোক সেটার মালিকানা দাবি করেনি তখন – করে না ওরা, সেটাই নিয়ম – কাউকে শাস্তি দেওয়া যায়নি, ছোটখাট একজন দোকানদার শুধু মারা গিয়েছিল হাই-সিকিওরিটি প্রিজনে! কিন্তু হয়তো তখন তোমরা বোঝনি যে, অক্ষত প্রাণীটাকে ফেরত পাওনি তোমরা। যারা তখন ভারতথেরিয়ামকে নিয়ে যেতে পারেনি তারা নিয়ে গিয়েছিল তার অঙ্গের ছোট একটা অংশ, তারই কোষ থেকে সম্ভবত চেষ্টা হয়েছিল ক্লোনিঙের।
আপনি কি নিশ্চিত স্যর, যে ওটা ক্লোন?
মোটামুটি নিশ্চিত। ওটার গায়ে হাত দিতে পারিনি, কিন্তু তোমার বর্ণনা অনুযায়ী খুবই কাছাকাছি গিয়ে নিজে দেখে এসেছি। আসলে ওর জন্মেই ত্রুটি ছিল। ডলির ক্ষেত্রে, যার জরায়ুতে এই ভেড়া প্রতিস্থাপিত হবে, সেই ভেড়ার একটা সেলের নিউক্লিয়াসটা সরিয়ে দিয়ে, সেখানে মাদার-সেলের নিউক্লিয়াসটা বসানো হয়েছিল। কিন্তু এখানে ভারতথেরিয়াম তো বিলুপ্ত প্রজাতি। অন্য ভারতথেরিয়ামের সেল তো পাওয়া যাবে না। ওরা তাই সম্ভবত একটা গণ্ডারের সেল আর জরায়ু ব্যবহার করেছে, জন্ম দিয়েছে এমন এক প্রাণীর যে নিজের ক্ষণস্থায়ী জীবনটা দিয়ে শুধু বেঁচে থাকার কষ্টটাই বুঝল আজন্ম। এ কাজ যারা করেছে তারা বিজ্ঞানী নয়, বিজ্ঞান-রাক্ষস। তাই ওকে এখন নির্বাসন দিয়ে পালিয়েছে। হয়তো আরামেই আছে ওরা ওদের রাজপ্রাসাদে। এসব অপরাধ করে আরামেই ওরা থাকে চিরকাল। বিনা বাধায় ওকে দখল করে নিতে পারতুম, কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন আছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের অনুমতি চেয়েছি। পেলেই দখল নেব। তবে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করাটা ঠিক হবে কিনা এখনই বলতে পারছি না। সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, তোমাকে জানাব আমরা।
ওদের দিক থেকে বেশ কিছুক্ষণ কোন সাড়া না পেয়ে এসপিণ্ডেলো বলেন আবার, লাইনে আছ তো?
আছি স্যর, বলে ফল্গু।
তোমাদের এখন প্রোগ্রাম কী?
এখন তো ফিরে যাব স্যর। কাল সন্ধ্যেবেলা ফ্লাইট, চেক-ইন বিকেল চারটেতে।
তাই নাকি, কালকেই? ঠিক আছে তাহলে দেখা হবে কাল এয়ারপোর্টে। লাইন কেটে যায়।
দুটোর মধ্যে ওরা পৌঁছিয়ে গেল এয়ারপোর্টে। আসার সময় যেমন, এবারও পেরীরা স্বয়ং ড্রাইভ করলেন। তবে এবার সঙ্গে আছেন আর একজন, প্রফেসর চন্দ্রশেখর।
এয়ারপোর্টের রেস্টোর্যান্টে বসে ওরা। পেরীরা দুয়েকজন হোমরাচোমরার সঙ্গে কথা বলেছেন নূর-উদ্দিনের ব্যাপারে। তাঁরা একমত, পেরীরার মত মানুষ দায়িত্ব নিলে নূর-উদ্দিনের কোন সাজা হবে না। তবে প্রথম কয়েকবছর মাঝে মাঝেই পেরুর জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডে হাজিরা দিতে হবে ওকে আর পেরীরাকে। ওর সম্বন্ধে যা শুনেছেন, তাতে পেরীরার ধারণা, ও যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। হাই স্কুলের পরীক্ষা পাশ করিয়ে কিছু একটা কারিগরী শিক্ষার ব্যবস্থা, পেরীরা আশা করেন, করিয়ে দিতে পারবেন ওর। তারপর ও যদি চায় তো ব্রাজিলের নাগরিকত্ব।
তিতিকাকার সেই ছোট্ট পাঁচিল-ঘেরা দ্বীপের প্রাণীটার কথা চন্দ্রশেখর বা পেরীরাকে জানায়নি ফল্গু। ওর মনে হলো, ফিরে যাবার আগে ওঁদের জানিয়ে যাওয়া উচিত ওর। ভারতথেরিয়াম ডলির কথা শুনলেন ওঁরা আগ্রহ করে। বিজ্ঞানের মানুষ হিসেবে যথেষ্ট কৌতূহলও দেখালেন ওঁরা এই ক্লোনিংটার ব্যাপারে। ফল্গুরা আগেই বলেছিল এসপিণ্ডোলো এয়ারপোর্টে আসবেন। এসপিণ্ডোলোর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ ওঁদের বেড়ে গেল।
এই রেস্টোর্যান্টটা এয়ারপোর্টের বিশাল চত্বরের একটা কোণে। খানিকটা পরে বসে বসেই দূর থেকে এসপিণ্ডোলোকে আসতে দেখতে পান চন্দ্রশেখর। সুঠামদেহী ভদ্রলোক লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছেন। খানিকটা হেঁটে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন, পকেট থেকে বের করেন তাঁর মোবাইল ফোন। বোধ হয় দেখতে পাননি চেনা কোন মুখ, তাই ফোন করে খোঁজ নেবেন। উঠে দাঁড়ান চন্দ্রশেখর। তাঁর পেছনে অন্যরাও। কিন্তু এসপিণ্ডোলোর হাতে ওটা কী? কী, সেটা প্রথম বুঝতে পারে মুড়কি। একটা খাঁচা। খাঁচায় ছোট্ট একটা পাখি!
দৌড়িয়ে আসে মুড়কি। ওর কিং ভালচার নিয়ে এসেছেন এসপিণ্ডোলো নিজে। বললেন, কাল তোমাদের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হলো তোমার পাখিটা তো তুমি পাওনি! তাই কালই চলে গেলাম চাপাদা ডো ভিডীরস ন্যাশনাল পার্কে। সেখান থেকেই আসছি সোজা। নাও, এই কাগজগুলো ভালো করে পড়ে সই করে দাও।
এক হাতে কাগজগুলো আর অন্য হাতে খাঁচাটা নিয়ে এয়ারপোর্টের অনেক খালি কাউন্টারের মধ্যে একটা কাউন্টারে বসে পড়ে মুড়কি। খাঁচাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখে পাখিটাকে। তারপর কাগজগুলোয় সই করে। কিছুক্ষণ পর একে একে উল্কি ফল্গু আর পেরীরাও হাজির সেখানে। সবাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাখিটাকে দেখে তার রঙের প্রশংসা করে। পেরীরা বলেন, এখানে এসে ফার্স্ট প্রাইজটা মুড়কিই নিয়ে যাচ্ছে। চন্দ্রশেখর এসপিণ্ডোলোর সঙ্গে গল্প করছিলেন এতক্ষণ, এখন পেরীরার সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, একদম ঠিক। কথা বলতে বলতে চেক-ইন কাউন্টারটা খুলে যায়, ওরা সবাই মিলে দাঁড়ায় লাইনে। কাউন্টারের মেয়েটার মুখোমুখি যখন মুড়কি, সে হেসে খাঁচাটা দেখিয়ে বলে, পেপার্স?
একতাড়া কাগজে সই করেছিল মুড়কি, সবটাই মেয়েটার হাতে দেয় সে। বেছে বেছে প্রয়োজনীয় কাগজগুলো সে বের করে নেয়, বাকিগুলো ফেরৎ দেয় মুড়কিকে। একটা ক্যাবিন ট্যাগ দেয় মুড়কির হাতে, বলে টেক দ্য বার্ড উয়িদ য়্যু ইন দ্য ক্যাবিন। ট্যাগটা খাঁচায় লাগায় মুড়কি, একটু দূরে গিয়ে বসে একমনে দেখতে থাকে পাখিটা, আর সবাই মজে থাকে গল্পে।
কিছুক্ষণ পর চেক-ইন কাউন্টারের লাইনটা শেষ হয়ে যায়, ইমিগ্রেশনের ঘোষণা হয়, ইঙ্গিতে ফল্গু ডাকে মুড়কিকে। হাঁটতে হাঁটতে ইমিগ্রেশনের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ পেছন ফিরে চেক-ইন কাউন্টারের দিকে দৌড়োয় মুড়কি। ওখানকার সেই মেয়েটা বেরিয়ে যাচ্ছিল, মুড়কিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। ট্যাগটা খাঁচা থেকে খুলে মেয়েটাকে ফেরৎ দেয় মুড়কি, আই অ্যাম নট টেকিং ইট, প্লীজ রিটার্ণ মাই পেপার্স।
বাট হোয়াই?
কথা বলে না মুড়কি, শুধু মাথা নাড়ে, তার চোখের অবিশ্রান্ত ধারা তার হয়ে যা বলার বলে দেয়। বিভ্রান্ত মেয়েটা কথা না বলে কাগজগুলো ফিরিয়ে দেয় মুড়কিকে।
কাগজ আর খাঁচা নিয়ে দ্রুত পায়ে মুড়কি ফিরে যায় যেখানে এসপিণ্ডোলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন চন্দ্রশেখর আর পেরীরার সঙ্গে। এসপিণ্ডোলোকে সে ফিরিয়ে দেয় খাঁচা আর কাগজ।
কী হল? জিজ্ঞেস করেন এসপিণ্ডোলো।
মুড়কির হয়ে জবাব দেয় তার অবিরল অশ্রু, তাকিয়ে থাকে সে এসপিণ্ডোলোর দিকে।
এসপিণ্ডোলোর চোখও বুঝি ঝাপসা।