যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক একটা খবর পাওয়া গেল প্রজেক্টে পৌঁছোতে-না-পৌঁছোতেই। গতকাল বিকেলে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে এক ফরেস্ট গার্ড তিনজন লোককে একটা গাছের নীচে শোয়া অবস্থায় দেখতে পায়। মুখ ঢাকা চামড়ার মুখোশে। ওরা চিৎ হয়ে শুয়েছিল, অনেক ধাক্কাধাক্কিতেও ওঠেনি। আরও কয়েকজন গার্ডের সাহায্যে লোকগুলোকে প্রজেক্টের অফিসে নিয়ে আসে তারা, প্রাথমিক চিকিৎসার পর সেই লোকগুলো বিশ্রাম নিচ্ছে এখন, আশা করা যায় ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠবে, তখন ওদের প্রশ্ন করা যাবে।
তার মানে, বাইরের লোকরা এসে নৌকোর অন্তত তিনজন লোককে নৌকোর বাইরে যে বের করে নিয়ে গিয়েছিল এ গল্পটা ঠিক! ফল্গু বললো ওই তিনজন লোক সুস্থ হবার আগে ও নৌকোর মাঝি আর তার সহকারীর সঙ্গে আর একবার কথা বলতে চায়।
ফেরবার সময় তোমরা যখন নৌকো চালাচ্ছিলে, ওই তিনজন লোক, বাইরের লোক যারা নৌকোয় ঢুকে পড়েছিল, ওরা তখন কী করছিল? – জিজ্ঞেস করে ফল্গু।
কিছুই করছিল না, বসেই ছিল শুধু, জবাব দেয় মাঝির সহকারী।
আর যখন পারের কাছাকাছি এসে গেলে তোমরা, হঠাৎ যখন তোমাদের নৌকোর স্পীড বেড়ে গেল, সেই সময়?
মাঝি বললো, আমি তো ইঞ্জিন ঘরেই ছিলাম, হঠাৎ যখন জোর আওয়াজটা হলো, কিসের আওয়াজ বোঝবার আগেই খুব জোরে নৌকোটা আছড়ে পড়লো, সেই সময় কয়েকজন দৌড়ে ইঞ্জিন ঘরে আসে, তবে কে কে মনে নেই।
এরকম স্পীড বেড়ে যাওয়ার কী কী কারণ হতে পারে?
সত্যি কথা বলছি হেফা, আমরা একেবারেই বোকা হয়ে গেছি, কী কারণ বুঝতেও পারছি না। তবে ডিরেক্টর সাহেব আর আপনি যখন কাল আমাদের সঙ্গে কথা বলে চলে গেলেন, সাহেব বললেন কালই ফিরে আসবেন প্রজেক্টে, আমরা তখন দুজনে মিলে ইঞ্জিন-টিঞ্জিন সব খুলে দেখলাম। কার্ব্যুরেটরে অনেক জল ঢুকেছে, কনভেয়রটা খুলে গেছে আর প্রপেলারটার দেখলাম ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি, একটা ব্লেড তো ভেঙেই গেছে, তাছাড়া কাদা জমে প্রায় সিমেন্টের মতো শক্ত হয়ে গেছে, ঘুরছেই না ভালোভাবে। আমাদের কাছে স্পেয়ার থাকে, ছোটখাটো যন্ত্রপাতিও থাকে, দুজনে মিলে খানিকটা কাজ-চালানো গোছের সারিয়ে-টারিয়ে নিয়েছি, তা-ও কাল আসতে হয়েছে খুব সাবধানে।
তুমি তো অনেক দিনের অভিজ্ঞ ক্যাপটেন, ফল্গু বলে মাঝিকে, তোমার কী মনে হয়, কী কারণে এরকম একটা অদ্ভুত অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে?
আমাকে ক্যাপটেন বলবেন না হেফা, আমি তো একেবারেই মাঝি-মাল্লা গোছের মানুষ, তবে আমার মনে হয় না পিছন থেকে খুব জোরে কোন ভারী কিছুর ধাক্কা ছাড়া আর কোন রকমেই তীরের এত কাছাকাছি এ রকম হওয়া সম্ভব।
পিছন থেকে ধাক্কা মারা কি সম্ভব ছিল?
কী করে সম্ভব হবে হেফা, হলে তো আমরা দেখতেই পেতাম।
হুঁ, ফল্গু বলে, আচ্ছা একটা অন্য কথা জিজ্ঞেস করি, তোমার বাড়িতে কে কে আছে?
আমার বউ আছে, আর একটা বাচ্চা।
বাবা-মা?
বাবা-মা নেই, মরে গেছে অনেক দিন আগে।
বাড়ি কোথায়?
কাস্কোতে থাকে আমার বউ আর ছেলে, আমার ছেলেবেলায় আমি বাবা-মার সঙ্গে থাকতাম বলিভিয়ায়, কেচুয়া জনজাতির লোক আমরা। জঙ্গল ছেড়ে চলে এসেছিল আমার বাবারও বাবা, সেই থেকে আমরা আর জঙ্গলে ফিরিনি।
মাঝির সঙ্গীর দিকে এবার ফেরে ফল্গু, বলে তোমার বাড়িতে কে কে আছে?
আমার বাড়িই নেই, বলে লোকটা, আমি যে জনজাতির মানুষ তাদের ঠিক আপনাদের মতো নাম থাকে না, নিজেদের মধ্যে আমাদের আলাদা করে চেনার অনেক উপায় আছে। জঙ্গল থেকে উৎখাত হবার পর অবিশ্যি অনেকে আজকাল স্প্যানিশ নাম নিচ্ছে। আমার বাবা-মাকে আমার মনে নেই। এনী নদীর তীরে জঙ্গলের থেকে যে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল পেরু থেকে ব্রাজিলে, একটু বড় হবার পর সে-ই আমাকে এই নৌকোর কাজটা যোগাড় করে দেয়। সেই থেকে আমি এই নৌকোতেই থাকি। ডিরেক্টর সাহেব জানেন আমি নৌকোতেই থাকি, আমাকে বারণ করেননি।
ফল্গু এবার অন্য প্রসঙ্গে যায়, আচ্ছা, তোমাদের ফেরার সময় যে লোকটাকে বাকি তিনজনে মিলে নৌকো থেকে নামিয়ে দিয়েছিল, সে লোকটা নেমে যাবার পর কী করলো?
চালক বললো, আমরা খেয়াল করিনি, আমাদের তিনজন সাথী যে ফিরে এল না, সেটাই আমরা ভাবছিলাম।
সে লোকটাও কি তোমাদেরই মতো জনজাতি, না ইশকুলে স্প্যানিশ- ইংরিজি পড়া লোক? কী মনে হয় তোমাদের?
মাঝির বদলে তার সাথী উত্তর দেয় এবার, ইশকুলে পড়া লোকরা মাঝি-মাল্লার কাজ এখানে করেই না প্রায়, তাদের জন্যে অনেক রকমের কাজ আছে। আমি যদিও লোকটাকে তত ভালোভাবে দেখিনি, তবুও আমি নিশ্চিত যে ও-ও জঙ্গলেরই মানুষ।
সে তো ভালো কথা, ফল্গু বলে, জঙ্গলের মানুষদের যদি শিখিয়ে-পড়িয়ে নানারকমের কাজ দেওয়া হয়, তাহলে তাদের সমস্যার সমাধান তো হয়েই গেল, জঙ্গল ছাড়তে হয়েছে বলে তাদের আর দুঃখের কিছু থাকলো না, তাই না?
না হেফা, আপনি এ দুঃখ বুঝবেন না। জঙ্গলের মানুষ জঙ্গলেরই মানুষ, তাদের সুখ দুঃখ সব কিছু জঙ্গলের সঙ্গে মিশে আছে। জঙ্গল ছাড়বার দুঃখ তাদের কোনদিনও যাবার নয়।
মাঝি কথা বলে এবার, তবে হ্যাঁ, কাঁচা টাকার লোভে জঙ্গলের অনেক মানুষও জঙ্গল যারা ধ্বংস করতে প্রস্তুত, জঙ্গল থেকে পয়সা আয় করতে চায় যারা, তাদের মদতও দিচ্ছে।
ফল্গুর মনে পড়ে যায় এসপিণ্ডোলোর কথা: জঙ্গলকে যারা ধ্বংস করতে চায়, তাদের হাত করতে হয় এই জঙ্গলের মানুষকেই, নানা লোভ দেখিয়ে, ভুল বুঝিয়ে। আর যারা বাঁচাতে চায় জঙ্গলকে, তাদেরও সঙ্গে নিতে হয় জঙ্গলের অধিবাসী মানুষকেই।
ফল্গু বলে, তোমাদের তিন সাথী বোধ হয় এতক্ষণে সুস্থ হয়ে উঠেছে, এখন তাদের সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু তার আগে শেষ একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তোমরা। কাল যখন আমরা সবাই ফিরছিলাম, পারের কাছে এসে যখন অ্যাকসিডেন্টটা হলো, উল্কিকে বাঁচাবার জন্যে আমি লাফিয়ে পড়লুম কাদার উপর, তখন তোমরাও নীচে নেমে এসে খোঁজ করছিলে মুড়কির, জলে কোথাও ও পড়ে আছে কিনা দেখছিলে, সেই সময় নদীতে পারের কাছে কতগুলো নৌকো ছিল?
কতগুলো বলতে পারব না হেফা, তখন তো আমরা অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম, তবে ছিল অনেকগুলো। অনেকগুলোই নোঙর করা ছিল, কিন্তু অনেক নৌকো চলছিলোও; জোরে, আস্তে, অনেকরকমের নৌকো।
তোমাদের কি মনে হয় ওইসব নৌকোগুলোর মধ্যেই কোন একটাতে শুইয়ে রাখা হয়েছিল মুড়কিকে? ওর মধ্যেই কোন একটা নৌকোর সঙ্গে যোগসাজস ছিল অ্যাকসিডেন্টের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পালিয়েছিল যে লোকটা, তার? বাকি দুজন, তোমরা হাত-পা ধুতে ধুতেই যারা পালিয়েছিল, তারাও সময় পেয়েই পরে গিয়ে যোগ দিয়েছিল সেই নৌকোটাতেই?
হতে পারে হেফা, হতেই পারে। তারপর উল্কিকে দেখিয়ে বলে ওরা, আসলে এই হেফা যেভাবে পড়লেন সেটা দেখলাম তো আমরা, ওইটাই আমাদের মাথায় ছিল তখন, অন্য আর কিছু আমরা ভাবতে পারিনি।
অজ্ঞান হয়ে থাকা বাকি তিনজনও তেমন কিছু খবর দিতে পারল না। ওরা বললো, ঘাড়ে রিভলভার ঠেকিয়ে ওদের জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, এটুকুই মনে আছে ওদের। আর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখল ওরা প্রজেক্টে শুয়ে আছে।
ফেরার সময় উল্কি বললো, এখন তো নিশ্চিত হয়েই বলা যায় যে, আমার অ্যাক্সিডেন্টটা ঠিক অ্যাক্সিডেন্ট নয়, সবাইকে অসতর্ক করে মুড়কিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়াটাই ছিল আসল উদ্দেশ্য।
হ্যাঁ ঠিকই, ফল্গু বলে, কিন্তু এই যে মুড়কিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া, এটার প্ল্যানটা হল কী করে? আমরা যে সেই রাত্তিরে জঙ্গলে আসব, সেটা তো কারো জানার কথা নয়। সে খবরটাই যদি না থাকে অপরাধীদের কাছে, তাহলে এত মেটিক্যুলাস প্ল্যান করলো কারা আর করলোই বা কীভাবে?
এ ছাড়া, আর একটা বড় রহস্য আছে, সেটা কী বল্ তো, জিজ্ঞেস করে ফল্গু। নিজেই উত্তর দেয় তারপর, ওই চতুর্থ ব্যক্তিটি। নৌকো যখন দখল নেওয়া হলো তখন বাকি তিনজনের সঙ্গে এসেছিল ওই লোকটাও। রিভলভার দেখিয়ে যখন দুজনকে বসিয়ে রেখে বাকি তিনজনকে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখনও রিভলভার হাতে ওই লোকটাই চালক আর তার সহকারীকে আটকিয়ে রাখছে, পালাতে দিচ্ছে না। কিন্তু ওকেই শেষ পর্যন্ত নৌকোয় নেওয়া হলো না; তবুও বিনা বাক্যব্যয়ে, বিনা প্রতিবাদে ও-ও নেমে গেল নৌকো থেকে। যাবার আগে, এমনকি, রিভলভারটাও ফিরিয়ে দিয়ে গেল, লোকটা কে?
লোকটা কে?– বলে উল্কিও, এই লোকটার রহস্য সমাধান না করতে পারলে এগোনো যাবে না মনে হচ্ছে।