দোহা আর সাও পাওলোয় দুবার প্লেন বদলিয়ে প্রায় পঁয়ত্রিশ ঘন্টার পর প্লেনের জানলা দিয়ে নীচে তাকিয়ে মুড়কি বললো, দেখো ফল্গুদি, শহরটা কী অন্য রকমের!
জানলার ধারে সীট পাওয়ার জন্যে উল্কি বসেছে ঠিক ওদের পেছনের সীটটায়, একটু বোধ হয় চোখ লেগে এসেছিল, মুড়কির গলা শুনে জানলা দিয়ে তাকিয়ে বললো, অন্য রকমের, অন্য রকমেরই তো! প্রত্যেকটা বাড়ি একেবারে কাচ আর স্টীল দিয়ে তৈরি অ্যাবস্ট্র্যাক্ট স্কাল্প্চারের মতো, আর পুরো শহরটা কী সবুজ, কী সবুজ, বাড়িগুলো কত দূরে দূরে, আর মাঝখানের ফাঁকাটা শুধু সবুজেই ভরা!
হবে না, বললো ফল্গু, ব্রাসিলিয়া শহরটা যে একেবারেই প্ল্যানমাফিক তৈরি।
সে তো আমাদের নিউ দিল্লী, চণ্ডীগড়, এসব শহরও।
ঠিকই, কিন্তু এ শহরটা তৈরির পেছনে একেবারেই অন্য ধরণের একটা আইডিয়া কাজ করেছে। স্থাপত্যের আধুনিকতম পরাকাষ্ঠা হিসেবে সারা পৃথিবীকে অবাক করে দেবার একটা পরিকল্পনা তো প্রথম থেকে ছিলই, আরো ছিল সেটাকে নষ্ট হতে না দেবার পরিকল্পনা। তাই মূল শহরে কারোকে নিজের বাড়ি তৈরি করতে দেওয়াই হয়নি; থাকতে চাও, তো সরকারের তৈরি বাড়িতে থাক। পরে অবিশ্যি শহর বেড়েছে, কিন্তু তার জন্যেও আগে থেকে প্ল্যান ছিল, বেড়েছে সেই অনুযায়ীই। সেসব, চল্ না, নিজেদের চোখেই দেখব, থাকব তো দুচার দিন। শুধু এইটুকু তোদের বলে রাখি, নগর-স্থাপত্যে আধুনিকতার নিদর্শন হিসেবে সারা পৃথিবীতে একমাত্র ব্রাসিলিয়াই ইউনেস্কো ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি পেয়েছে।
ইমিগ্রেশনের যাবতীয় নিয়ম-টিয়ম অনুযায়ী সই-টই করে বাক্স-প্যাঁটরা দেখিয়ে, চোখ-ধাঁধানো বিরাট এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে বেরোতে যথারীতি ঘন্টাখানেক সময় লাগল। প্রফেসর চন্দ্রশেখরের নির্দেশ অনুযায়ী কার পার্কে পৌঁছে দেখা গেল য়্যুনিভার্সিটি অব ব্রাসিলিয়া লেখা মিনি বাস গোছের একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে। ড্রাইভার ভদ্রলোক ওদের দেখে এমন ভাবে হাসলেন যেন কতদিনের চেনাশোনা। তারপর ইংরেজিতে ফল্গুদিকে জিজ্ঞেস করলেন, য়্যু আর মিজ ফল্গু, আ'ন্ট য়্যু?
ফল্গুদিও হেসে বললো, রাইট স্যর, আয়্যাম ফল্গু।
অবাকের অবাক, তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে হ্যাণ্ডশেক করে মুড়কিকে সোজাসুজি, হাউ আর য়্যু ইয়াং লেডি, হোয়ট শুড আই কল য়্যু, শিঞ্জিনী অর মুড়কি?
এমন বোকা বনে গেল মুড়কি, যে জবাব পর্যন্ত দিতে পারল না, শুধু একটু হেসে ম্যানেজ করার চেষ্টা করল। ফল্গুদি আর উল্কিদির দিকে তাকিয়ে গা জ্বলে গেল মুড়কির, যেন খুবই মজা পাচ্ছে ওর হেনস্থা দেখে।
ভদ্রলোক তারপর মিনিবাসটার বন্ধ দরজাটা খুলে উল্কিদির দিকে তাকিয়ে বললেন, ওয়েলকাম অ্যাবোর্ড উল্কি।
চন্দ্রশেখর বলেই দিয়েছিলেন ব্রাসিলিয়ায় একটু একটু ঠাণ্ডা থাকবে, ওরা যেন হাতে হাতে একটা করে হাল্কা জ্যাকেট নিয়ে আসে। ড্রাইভার ভদ্রলোকের আপ্যায়নের কায়দায় ভ্যাবাচাকা হয়ে তিনজনই হাতে ধরে থাকা জ্যাকেটগুলোর কথা বোধ হয় ভুলেই গেছে। ভদ্রলোকই মনে করিয়ে দিলেন, ইট্স্ র্যাদার কোল্ড হিয়ার, হোয়াই নট য়্যুজ য়্যোর জ্যাকেটস।
বাস ছাড়তেই উল্কি জিজ্ঞেস করল, য়্যুনিভার্সিটি অব ব্রাসিলিয়া কেন, আমাদের ন্যাশনাল অবজার্ভেটরীর গেস্ট হাউসে থাকার কথা না?
ন্যাশনাল অবজার্ভেটিরী তো এ শহরেই নয়, শেষ মুহূর্তে প্ল্যান বদলানো হয়েছে, চল্ গিয়ে শুনবি, ফল্গুর জবাব।
ছোট একটা ফ্লাই-ওভার পেরোনোর পর ছ' লেনের বিরাট চওড়া রাস্তা দিয়ে বেগে ছুটে চলেছে বাসটা। ড্রাইভারের সীট থেকে গলা শোনা গেলো, কাইণ্ড অ্যাটেনশন ম্যাম্স্, অ্যালবার্ট পেরীরা বলছি, আমাদের গন্তব্যস্থল ব্রাসিলিয়া য়্যুনিভার্সিটির গেস্ট হাউজ নাম্বার সিক্স, যাওয়ার পথে দুয়েকটা টিকেব্ল্ সাইট যে দেখাবো তার উপায় নেই, জানলার বাইরে শুধু একটাই দৃশ্য!
সত্যি বটে, দৃশ্য একটাই! রাস্তার দুধারে যতদূর চোখ যায় মাইলের পর মাইল শুধু নারকোল আর বিভিন্ন জাতের পাম গাছ – জঙ্গল কি? জঙ্গল কি এত কেয়ারি করা হয়? – মৃদু হাওয়ায় দুলে দুলে কী তাদের রূপ! পেরীরা বললেন য়্যুনিভার্সিটি ক্যাম্পাস শহরের মাঝামাঝি, প্যারানোয়া নামের একটা লেকের ধারে।
যে গতিতে গাড়িটা চলছিল গন্তব্যস্থলে পৌঁছোতে খুব একটা সময় লাগলো না। পৌঁছোনোর মিনিট দশেক আগে একটা মোড় ঘুরতেই পুরো দৃশ্যটা যেন বদলে গেল হঠাৎ, ডান দিকে বিরাট একটা জলাশয়, সেটা নদীও হতে পারে, সমুদ্র হওয়াও বিচিত্র নয়, আর প্লেনে বসে ওপর থেকে যেমন দেখা যাচ্ছিল, বাঁ দিকে, জলাশয়টার অন্য পারে, আধুনিক বিমূর্ত ভাস্কর্যের মতো দেখতে বিরাট বিরাট সব প্রাসাদোপম অট্টালিকা। সেগুলো দেখে তিনজনেরই মুখ থেকে প্রায় একই সঙ্গে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল। উল্কি বলল, দেখো ফল্গুদি, বাড়িগুলো দেখে কী আশ্চর্য একটা ফীলিং হয়।
কেমন ফীলিং? – প্রশ্ন করল ফল্গু।
দারুণ, বললো মুড়কি। আর তার পরেই নিজেকে যেন শুধরে নিয়ে বললো, দারুণ নয় ফল্গুদি, কিন্তু কী অদ্ভুত, তাই না?
অদ্ভুত? – হ্যাঁ, বলতে পারিস, ভালোও নয়, খারাপও নয়, কেমন একটা ঘোর লাগিয়ে দেওয়া স্বপ্নের মতো, আসলে সমস্ত ব্যাপারটাই এত আর্টিফিশিয়াল!
ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে গেলো গাড়িটা হঠাৎ, সামনেই আদিগন্ত একটা বাগান, আর তার মাঝে মাঝে দূরে দূরে ঐ ভাষ্কর্যের মতোই কতকগুলো বাড়ি, ওরা বুঝতে পারল য়্যুনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের সামনে পৌঁছে গেছে ওরা।
ইংরেজি আর্টিফিশিয়াল শব্দটা কানে গিয়েছিল অ্যালবার্ট পেরীরার, ড্রাইভারের সীটে বসে বসেই মাথাটা ঘুরিয়ে বললেন, ঠিকই বুঝেছ তোমরা, ডান দিকের এই জলাশয়টা আর্টিফিশিয়াল, এটাই লেক প্যারানোয়া। এই শহরের পূব দিকে প্যারানোয়া নদী, সেটাকে বাঁধ দিয়ে তার জল আটকিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই কৃত্রিম হ্রদ, লেক প্যারানোয়া। এই হ্রদের বেড় আশি কিলোমিটার, সবচেয়ে চওড়া যেখানে সেখানটা পঞ্চাশ কিলোমিটার আর সর্বাধিক গভীরতা আটত্রিশ কিলোমিটার।
চমকটা দেবার জন্যেই যেন গাড়িটা হঠাৎ দাঁড় করিয়েছিলেন পেরীরা, এবার আস্তে আস্তে বাগানটার ভেতর ঢুকে পড়লেন। যেভাবে আসা হচ্ছিলো এয়ারপোর্ট থেকে, তার তুলনায় খুবই আস্তে আস্তে বাসটা চলতে শুরু করল দুপাশে লম্বা লম্বা গাছ লাগানো মোরামে বাঁধানো লাল রাস্তা দিয়ে।
এবার একটা কম্পাউণ্ড। এই কম্পাউণ্ডের মধ্যমণি হয়ে বিরাট যে বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, পেরীরা বললেন সেটাই সেন্ট্রাল ইনস্টিট্যুট অব সায়েন্সেস। কম্পাউণ্ডের মধ্যেই একটু অন্য রকমের দেখতে, বেশ বড়সড় পোর্টিকোওয়ালা একটা বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বললেন গেস্ট হাউস নাম্বার সিক্স, ইনস্টিট্যুট অব সায়েন্সের অতিথিদের সাময়িক আবাসস্থল। মুড়কিরা তিনজন গাড়ি থেকে নামার পর একটা একটা করে ওদের যাবতীয় মালপত্তর নামাতে নামাতে চোখের ইশারায় ওদের বললেন স্যুইং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকতে, চোখের ভাষায় এমন একটা কিছু ছিল, ওদের সাহসই হলো না অন্তত ভদ্রতা করেও মালপত্তর নামানোয় হাত লাগানোর কথা বলে।
ভেতরে যথারীতি একটা রিসেপশন কাউন্টার। কাউন্টারের উলটো দিকে বসে আছেন যে বয়স্কা মহিলা, হেসে বললেন, অ্যালবার্ট পেরীরাজ গেস্টস আই সাপোজ। বলতে বলতেই ঠিক ম্যাজিশিয়ানের কায়দায় তিনটে রেজিস্ট্রেশন কার্ড বের করে বললেন সই করতে। আগে থেকেই ওদের নাম-ঠিকানা, বয়েস ইত্যাদি প্রয়োজনীয় যাবতীয় তথ্য কার্ডগুলোতে প্রিন্ট করাই ছিল, সই করা শেষ হলে ভদ্রমহিলা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে একটা দরজা খুলে দিলেন।
এমন ঘরে মুড়কি অন্তত থাকেনি কখনো আগে। ঘর, নাকি একেই বলে সুইট! আর সাইজ কী, যেন একটা হল! ঘর-জোড়া নরম কার্পেটে পা ডুবিয়ে ঢুকতেই বেতের একটা হাফ-পার্টিশনের ডানদিকে সোফা-কৌচ সাজানো ড্রয়িং রূম গোছের, বিশাল একটা ফ্রিজ আর প্রায় দেয়াল-জোড়া টেলিভিশনের পর্দা। দুবছর আগেই তো ওয়র্ল্ড কাপ ফুটবল হয়ে গেল, তখন এই পর্দায় যদি খেলা দেখা যেত! বাঁদিকে পাশাপাশি তিনটে সিঙ্গল বেড, বিছানা-টিছানা একেবারে রেডি, শুয়ে পড়লেই হয়! এক কোণে একটা কাজের টেবিল, সামনে চেয়ার, টেবিলের ওপর একটা কম্প্যুটার। উল্টো কোনায় দেয়াল ঘেঁসে ছোট একটা ডাইনিং টেবিল, তার সঙ্গে তিনটে চেয়ারের ব্যবস্থা।
এইসব দেখতে দেখতেই ওদেরই মালপত্রে ঠাসা একটা এক-চাকার ঠেলাগাড়ি (মুড়কির মনে পড়ে গেল, তৃতীয় শ্রেণীর লিভার!) ঠেলতে ঠেলতে অ্যালবার্ট পেরীরা ঘরে ঢুকলেন। একটা ক্লোজেট খুলে স্যুটকেস-ট্যুটকেসগুলো সাজাতে সাজাতে বললেন, তোমাদের জন্যে একটু রিফ্রেশমেন্টের কথা আমি বলে এসেছি, ওগুলো খেয়ে তোমরা চান-টান সেরে নাও। প্রায় ছত্তিরিশ ঘন্টা অনেকগুলো টাইম জোন পেরিয়ে এসেছ, আজ আর কোথাও বেরোনো নয়। আমি এখন চলে যাব, যাবার সময় মিসেস ফার্ণাণ্ডেজ – রিসেপশনে যে মহিলা আছেন – ওঁকে বলে যাচ্ছি, উনি তোমাদের য়্যুনিভার্সিটি রেস্টোর্যান্টটা দেখিয়ে দেবেন, সেখানে বলা আছে। মেনু দেখে অর্ডার করে খেয়ে দেয়ে ঘুম লাগাও। তোমাদের আজ ঘুমের দরকার হবে। কাল সকালে প্রফেসর চন্দ্রশেখর তোমাদের মীট করবেন। গুড বাই।
দৈ-সন্দেশ জুটল না ঠিকই, কিন্তু হট চকলেটের সঙ্গে যেটা এলো, ওয়েটার বললো সেটার নাম ব্রাজিলিয়ান পামকিন ফ্ল্যান। অপূর্ব! আগ্রার চালকুমড়োর নরম পেঠা যদি কেক হত তাহলে বোধ হয় এমন খেতে হত। আর ওপরটায় ঝুনো ডাবের কচি শাঁসের আইসিং!
শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে ইষদুষ্ণ জলটা মাথায় পড়তে পড়তেই ঘুম এসে গেল চোখে। য়্যুনিভার্সিটি রেস্টোর্যান্টে কোনরকমে দুপুরের খাওয়াটা শেষ করে সেই যে ঘুমোল ওরা, ঘুম ভাঙল প্রায় ঘন্টা পাঁচেক পর। এই যে ওরা ব্রাসিলিয়া য়্যুনিভার্সিটির গেস্ট হাউজে নরম বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে আর চর্বচূষ্য খাচ্ছে, এর রহস্যটা এতক্ষণে উদ্ঘাটন করল ফল্গুদি:
যদিও ব্রাসিলিয়াই ব্রাজিলের রাজধানী, ব্রাজিলিয়ান ন্যাশনাল অবজার্ভেটরীর হেড-কোয়ার্টার কিন্তু ব্রাসিলিয়া শহরে নয়, এই শহরটার পরিকল্পনাই করা হয়েছে এমনভাবে যে সরাসরি সরকারি দপ্তরে কাজ না থাকলে বাইরের লোকজন খুব বেশি এখানে আসবে না। ন্যাশনাল অবজার্ভেটরীর হেড-কোয়ার্টার রিও-ডী-জেনীরোতে। ফুটবলের জনপ্রিয়তার জোরে প্রতি বছরই নানা আন্তর্জাতিক টূর্ণামেন্টের খেলা লেগেই থাকে ব্রাজিলে, এ বছর তো অলিম্পিকের ফুটবলও দেখা যাবে, তাই না? এই সব উপলক্ষে এখন থেকেই নানা ধরণের লোকজন জড় হচ্ছে ব্রাজিলে। এদের ভীড় মূলত সাও পাওলো, রিও, এসব পুরোনো শহরেই। যদিও দুয়েকটা খেলা হবে ব্রাসিলিয়াতেও, বাইরের লোকজনরা, বিশেষত খেলার সঙ্গে যাদের সরাসরি যোগাযোগ নেই, এরকম অবাঞ্ছিত দুষ্কৃতির দল ভীড় করবে পুরোনো শহরগুলোতেই, সে ক্ষেত্রে আমাদের মতো অসমবয়সী তিনটে মেয়ে যদি ন্যাশনাল অবজার্ভেটরীর গেস্ট হাউজে আস্তানা গাড়ে, সেটা চোখে পড়বে অনেকেরই; আমাদের কাজের পক্ষে সেটা একেবারেই বাঞ্ছিত নয়। তাই চন্দ্রশেখর আমাদের ব্রাসিলিয়াতে আসারই ব্যবস্থা করলেন।
রাতের খাবারটা মিসেস ফার্ণাণ্ডেজ ঘরেই আনিয়ে দিলেন, চিকেন কারি আর ভাত।