একেবারে চোখের সামনে এক মুহূর্তে একটা মানুষ নিহত! লোকটার সঙ্গে আগে থেকে কোন পরিচয় ছিল না ঠিকই, কিন্তু অনেকবার লোকটাকে দেখতে হয়েছে নানা অবস্থায় – যদিও পিছন থেকে – কেমন যেন একটা আত্মীয়বিয়োগের মতো কষ্ট হয় ওদের দুজনেরই! কিছুক্ষণ নিথর বসে থেকে ফল্গুই উঠে পড়ে প্রথম, বলে, আমি বাথরূম যাচ্ছি, তৈরি হয়ে নে, বেরোব।
বেরোবার আগে কামিলাকে ফোন করে ফল্গু, ম্যাম, ফ্রী আছেন, আসব?
আপনাদের জন্যে তো সব সময়েই ফ্রী, চলে আসুন না।
ঘন্টাখানেক পর যখন কামিলার অফিসে পৌঁছোয় ওরা, কামিলা তখন ডেস্কে একটা রেডিও রেখে শুনছে সেটা। এই যে ম্যাডাম শ্ল্যুথ, ফল্গুকে দেখেই হাসিমুখে ডাকে কামিলা, হিয়ার ইজ অ্যানাদার কেস ফর য়্যু।
কামিলার ডেস্কে ওরা বসে গিয়ে, রেডিওটা বন্ধ করে দেয় কামিলা, তারপর ফল্গুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কী হয়েছে আপনার, য়্যু লূক আনওয়েল, কী হয়েছে ফল্গু?
ফল্গু ফল্গু ফল্গু... চিৎকার করে ওঠে খাঁচার কাকাতুয়াটা।
হেসে কাকাতুয়াটার দিকে তাকায় ফল্গু, বলে, কিছু নয়, কাল রাতে একটু ঘুমের অসুবিধে হয়েছিল।
শুধুই ঘুমের অসুবিধে? শরীর ঠিক আছে তো?
একদম ঠিক, ফার্স্ট ক্লাস, কোন চিন্তা করবেন না আপনি। কী শুনছিলেন রেডিওয়?
কামিলা বলে, গত আধ ঘন্টা ধরে ক্রমাগত চলছে একটা বুলেটিন, প্রকাশ্য রাস্তায় খুন হয়েছে কোন একজন জনজাতির মানুষ, তার পরিচিত যদি কেউ থাকে সে যেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব যোগাযোগ করে।
পুলিশ জানলো কী করে যে খুন হয়েছে সে জনজাতির মানুষ? – প্রশ্ন করে ফল্গু।
সে সব ডীটেইল কিছু বলছে না, হয়তো চেহারা দেখে ধরে নিয়েছে, বা টিপিকাল কোন অর্ণামেন্ট, যা তার গায়ে ছিল।
যে চেনে সে তো খুনই করেছে, বলে উল্কি, এই বুলেটিন শুনে সে আসবে কেন?
সে আসবে না, কিন্তু সে ছাড়া আরও তো কেউ চেনা থাকতে পারে, বলে কামিলা, আসলে জঙ্গলের পশু-পাখি-উদ্ভিদ যেমন, জঙ্গলের মানুষদের সম্বন্ধেও আজকাল আমরা খুবই সজাগ এবং সতর্ক থাকি। কেউ যদি খুন হয়, তাহলে কেন হলো, কে করলো এসব খবর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংগ্রহ করা আজকাল প্রশাসনের কাজ। এখন থেকে অন্তত এক সপ্তাহ নিয়মিত রেডিও বুলেটিন, খবরের কাগজে এবং ইন্টারনেটে নানা বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়াতে খবর পাঠানো, পুলিশের কাছে মোবাইল ফোনের যত নম্বর আছে সেগুলোতে মেসেজ পাঠানো ইত্যাদি নানা অ্যাক্টিভিটি চলবে – এ ছাড়াও পুলিশের নিজের তদন্ত তো আছেই।
হঠাৎ ফল্গু বলে, এরকম অবস্থায় আমার একটা প্রশ্ন ছিল সেটা করা ঠিক হবে কিনা ভাবছি। কিন্তু ভাবছি যখন, করেই ফেলি। আমাকে যে চার দিনের সময় দেওয়া হয়েছিল মুড়কির ব্যাপারটা সমাধান করার জন্যে, আজই তার শেষ দিন। এখনও পর্যন্ত দেখাবার মতো কোন কাজই আমি করতে পারিনি। কাল সকাল থেকে এই কাজটা একা একা করবার স্বাধীনতা আমার থাকবে কি?
ওটা তো মিস্টার শ্যাভেজ, মানে অ্যালেক্সের ব্যাপার। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্তে কাজ করুন ফল্গু, অ্যারেঞ্জমেন্টে কিছু বদল হলে আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
ফল্গু বলে, থ্যাঙ্ক য়্যু। তারপর কাকাতুয়াটার দিকে তাকায়, বলে, এই কাকাতুয়াটা কতোদিন আছে আপনার কাছে?
বছরখানেক।
বছরখানেক আগে যখন এসেছিল তখনই কি এরকম কথা বলতে পারতো?
পারতো। ঠিক এতটুকুই পারতো। স্কিল বাড়েওনি, কমেওনি।
তার মানে, কথা বলাটা আপনি শেখাননি?
না না, আমার এসব বিদ্যে নেই, যে দিয়েছিল সে এই অবস্থাতেই দিয়েছিল। এক-আধটা কথা পছন্দ হয়ে গেলে সেটাই ক্রমাগত রিপিট করে যাওয়া। এই দেখুন না, আপনার নামটাই শুধু বলে, একবারও তো উল্কি অথবা মুড়কির নাম বলতে শুনলাম না।
কোথা থেকে কিনেছিলেন এটাকে?
সে এক মজার কথা। আমাদের পেরুর প্রেসিডেন্টের এক বন্ধু সপরিবার বেড়াতে এসেছিলেন গত বছর। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ওঁদের ম্যালডোনাডো ঘুরিয়ে দেখাবার। আপনি ওবেলিস্কো চেনেন? ঠিক সন্ধ্যের মুখটাতে ওবেলিস্কোর উপর থেকে সূর্যাস্ত দেখা ম্যালডোনাডো বেড়াতে-আসা ট্যুরিস্টদের পক্ষে একটা মাস্ট। ওঁদের নিয়ে গিয়েছিলাম সূর্যাস্ত দেখতে। ওবেলিস্কো টাওয়ারের গ্রাউণ্ড লেভেলে একটা ছোটখাটো মিউজিয়াম আছে, এখানকার ট্যুরিজম, কমার্শিয়াল আক্টিভিটি, বিজনেস প্রস্পেক্ট, এসব বিষয়ে। মিউজিয়ামটায় আমরা ঢুকতেই একটা কাকাতুয়া ওয়েলকাম টু ম্যালডোনাডো বলে স্বাগত জানালো। প্রেসিডেন্টের বন্ধু তাতে খুব চার্মড। এতটাই চার্মড যে মিউজিয়ামে বেড়ানোটা প্রায় কাকাতুয়া দর্শনে গিয়ে দাঁড়ালো। আমাদের অতিথি জানতে চাইলেন, কাকাতুয়া কি পেরুতে পাওয়া যায়? যখন শুনলেন কাকাতুয়া পেরুতে পাওয়া যায় না, অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা হয় বার্ড লাভারদের অনুরোধে, তখন তিনি অবাক। এই অসাধারণ সুন্দর পাখিদের দেশে বাইরের থেকে পাখি আনা হয়? শুধু কথা বলা শেখানো যায় বলে? আরো গোটা তিনেক কাকাতুয়া ওখানে ছিল, সেগুলো কথা বলতে পারে না, উনি জিজ্ঞেস করলেন, কে ওদের কথা বলা শেখাবে?
যে লোকটা মিউজিয়াম ঘুরে দেখাচ্ছিল আর নানান প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল, সে বললো, বার্ড লাভার্স ইউনিয়নের একজন উপদেষ্টা।
বার্ড লাভার্স ইউনিয়ন? সেটা কী ব্যাপার?
আমাদের দেশে আগে পাখি পোষা বেআইনী ছিল। বার্ড লাভার্স ইউনিয়নের চাপে এখন পাখি পোষার অনুমতি মিলেছে, অবিশ্যি সে পাখি যদি বিদেশী হয়। সেই থেকে এই অস্ট্রেলিয়ান পাখি প্রচুর আসছে। কিন্তু এখানে পাখিকে কথা বলতে শেখাবার কোন লোক নেই শুনে ইউনিয়নের একজন উপদেষ্টা নিজেই এই দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি একটা কথা-কওয়া পাখি নেবেন নাকি স্যর? ব্যবস্থা করব?
আমাদের অতিথি অবিশ্যি পাখি নিতে রাজি হননি, তাঁর দেশে নাকি কথা-কওয়া প্যারটের অভাব নেই। কিন্তু কয়েকদিন পর মিউজিয়ামের লোকটা আমার অফিসে এই পাখিটা নিয়ে এসে জোর করে দিয়ে যায়, পাখিটার সামনে কথা বললে ও নাকি নিজের পছন্দের কথাগুলো সঙ্গে সঙ্গে শিখে নিয়ে বলতে শুরু করবে। তার প্রমাণ তো নিজেই পেয়ে গেছেন আপনি, আপনার নামটা শুনেই কেমন শিখে নিয়েছে!
ইনটারেস্টিং, বলে ফল্গু, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে একবার ওবেলিস্কোর মিউজিয়ামটা ঘুরে আসি।
আপনারা এখনো ওবেলিস্কো দেখেননি? তাহলে তো নিশ্চয়ই যাবেন।
ফেরার পথেই ওবেলিস্কোয়। কাকাতুয়ার দিকে গেলই না ফল্গুদি, দেখে উল্কি খানিকটা অবাক। মিউজিয়মে ঢোকার মুখে রিসেপশনিস্ট গোছের যে মহিলা ছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, এ দেশের কমার্শিয়াল অ্যাক্টিভিটির ব্যাপারে কী প্রদর্শনী আছে আপনাদের?
ভদ্রমহিলা বললেন, আসুন আমার সঙ্গে।
লাইব্রেরীর রিডিং রূমের মতো খানিকটা দেখতে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন মহিলা। চার দেয়ালে ছবির মতো করে বাঁধানো ঠাসাঠাসি করে টাঙানো নানারকমের ফর্ম আর নিয়মাবলী। এ ছাড়া বেশ কিছু ট্রোফি ডিসপ্লেতে। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিলকে ঘিরে কয়েকটা চেয়ার। টেবিলে কিছু বইপত্তর আর ম্যাগাজিন।
ফল্গু বলল, ট্যুরিজ্ম্ তো আপনাদের দেশের প্রধান পণ্য। পেরুর ট্যুরিজ্মের কমার্শিয়াল সাইডটা নিয়ে যদি রিসার্চ করতে চাই, কী কী সাহায্য পাব আপনাদের কাছ থেকে?
একটা কোণের দিকে আঙুলটা দেখিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, আসুন আমার সঙ্গে। ইঙ্গিতে উল্কিকে ওইখানেই বসতে বলে ফল্গু যায় মহিলার সঙ্গে। একরাশ বইপত্র, ডক্যুমেন্টস, জার্ণাল ইত্যাদি দেখিয়ে মহিলা বলেন, যা আছে সব এখানেই।
ঘন্টাখানেক নানা কাগজপত্র ওল্টালো ফল্গু, তারপর উল্কির কাছে এসে বললো, চল্, কাজ হয়ে গেছে। তারপর পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে উল্কিকে বললো, রেখে দিস তো এটা। উল্কি দেখে কাগজটায় লেখা আছে Sergio Ramos!