যতই বলুক ফিনিগান, তাকিলে দ্বীপে শুরুটা ভালো হল না।
মুড়কির চিঠি নিয়ে এই দ্বীপ থেকে যখন পুন্টু চলে যেতে পারল, তার পরে-পরেই, দ্বীপের মানুষদের অচেনা একজন, নাম বলেছিল চিন্টে, এসে হম্বিতম্বি শুরু করল ওখানকার লোকদের ওপর। এই যে বিনা চেষ্টায়, বিনা পরিশ্রমে একসঙ্গে দ্বীপের সমস্ত বাড়িতে ছ'মাসের হোম-স্টের টাকা অগ্রিম পাওয়া গেল সে কি অমনি অমনি? অচেনা একজন লোক বাইরে থেকে এসে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেই বলতে দেওয়া হবে? তাকিলেরই আর একজন মানুষ, সেরিপ নাম, যার বাড়িতে রাখা হয়েছে মুড়কিকে, সে-ও এই লোকটার সঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচাতে লাগল। তার মূল প্রতিপক্ষ এই দ্বীপে কেচুয়াদের যে নেতা, অ্যাপো যার নাম।
অ্যাপোর বক্তব্য পরিষ্কার। হাজার হাজার বছর ধরে জঙ্গলের জনজাতি এই নিয়ম মেনে এসেছে। ওদের এই নদী-নালা-পাহাড়-পর্বত-সমুদ্র-জঙ্গলের পুত্রকন্যা যারা এ তাদের অলিখিত নিয়ম। একজনের প্রয়োজনে অন্যরা দাঁড়াবে, না হলে পাহাড়ের ওপারে ওদের যে দেবতারা থাকেন তাঁরা রুষ্ট হবেন, ধ্বংস হয়ে যাবে তাদের নিজেদের বাসস্থান, সবকিছু দখল নিয়ে নেবে সমুদ্রের ওপার থেকে আসা শয়তানের দল। এ নিয়ম ভাঙবে কে? দ্বীপের সবাই অ্যাপোর সঙ্গে একমত, এক সেরিপ ছাড়া।
অ্যাপো বলল, মনে রেখো, হোম-স্টের টাকা যারা অগ্রিম দিয়েছে, তারাও আমাদের এই নিয়ম জেনেই আমাদের দ্বীপে অন্য জায়গা থেকে মানুষ নিয়ে আসে, ঘুরিয়ে নিয়ে যায়। ওরা আমাদের বন্ধু, ওরা বলেছে আমাদের পুরোনো জঙ্গল ওরা ফিরিয়ে দেবে, হারিয়ে যাওয়া সব জীবজন্তুদের উদ্ধার করবে আমাদের সঙ্গে নিয়ে। একবারও তো বলেনি, আমাদের পূর্বপুরুষের সব নিয়ম ভেঙে ফেলতে হবে হোম-স্টে ব্যবসার জন্যে। ছোট মেয়েটাকে যখন ওরা দিয়ে গেল – ওরা তখন বলেছিল ওকে যত্ন করে রাখতে – সেরকমই আমরা রাখছি। আর পুন্টুর কথা বলছ? পুন্টুর গলায় ওদের চোদ্দপুরুষের পরিচয় – বাঁদরের দাঁতের মালা – ছিল না? ওদের মাৎসিগোঙ্কাদের সঙ্গে আমাদের কেচুয়াদের যে গোপন কথা তা কি ও বলেনি? আর দেখাই তো গেল মেয়েটার গলাতেও ওদের মালা। তাহলে কেন ওদের দেখা করতে দেওয়া হবে না? – প্রশ্ন করে দ্বীপের সমস্ত কেচুয়াভাষী।
এ সব কথার ঠিক ঠিক সদুত্তর দিতে পারেনি সেরিপ, কথা বলেনি আর, কিন্তু এ কথা কারো বুঝতে বাকি থাকেনি যে সেরিপ মেনে নিতে পারেনি বাকিদের যুক্তি।
ফল্গু উল্কি আর ফিনিগানকে নিয়ে তাকিলে দ্বীপে আসার প্ল্যান যখন করছিল রায়া, তখন চিন্টে আর সেরিপের সঙ্গে দ্বীপের অন্যদের এই মতান্তরের কথাটা জানতে পারে সে। পুনো শহর থেকে আট-দশ কিলোমিটার দূরে তিতিকাকায় যে নলখাগড়ার দ্বীপগুলো আছে, সেখানকার মানুষদের সঙ্গে তার ভালো যোগাযোগ, তারাই জানিয়েছিল ওকে এই মতান্তরের কথাটা। মুড়কিকে উদ্ধার করে আনবার কাজটা খুব সহজ হবে না এমন একটা ধারণা যে ফল্গুর ছিল এবং সে ব্যাপারে তার উদ্বেগ সে জানিয়েছিল ফিনিগানকে, রায়া জানতো না এসব। তবুও, ওদের নৌকো যখন চলেছে তাকিলের উদ্দেশে তখন সে একবার দাঁড়ালো একটা ওইরকম নলখাগড়ার দ্বীপে। চিন্টে আর সেরিপের সঙ্গে তাকিলে দ্বীপের অন্য মানুষদের মতের অমিল নিয়ে ওর কথা হলো এই দ্বীপের মানুষদের সঙ্গে। দ্বীপের মানুষরা আশ্বস্ত করলো রায়াকে যে ওরা নির্বিঘ্নেই মুড়কিকে উদ্ধার করে আনতে পারবে, চিন্টেকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, গণ্ডগোল করলে তার ফল ভালো হবে না।
নৌকো যখন দ্বীপের অনেকটা কাছাকাছি, ওরা দেখল দ্বীপের বেশ কিছু লোক একসঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখছে নৌকোটাকে। নৌকোটা এসে দাঁড়ালো যখন তীরে, তখন প্রথম নামল রায়া, তারপর ফিনিগান। ওদের সঙ্গে দ্বীপের মানুষদের জন্যে কিছু উপহার ছিল, সেগুলো দিল ওরা। তারপর তিন-চারজন মাতব্বর জাতীয় লোক – পরে ওরা জানতে পেরেছিলো ওদের মধ্যে একজনের নাম অ্যাপো আর একজন সেরিপ – এগিয়ে এল রায়া আর ফিনিগানের দিকে। নিজেদের মধ্যে কোলাকুলি করল ওরা, আর রায়া একটা করে ছোট চারা গাছ উপহার দিল ওদের চারজনের প্রত্যেককে। তারপর ডাকা হলো ফল্গু আর উল্কিকে।
যতক্ষণে ফল্গু আর উল্কি উঠে এল নৌকো থেকে, তারই মধ্যে একটা অস্থির ভাব দ্বীপের মানুষগুলোর মধ্যে। মনে হচ্ছে একটা কিছু খুঁজছে ওরা। এবং খুঁজে না-পাওয়ায় স্পষ্টই একটা অস্বস্তির ভাব অনেকের চোখেমুখে। রায়া জানে ওদের ভাষা, কিছুক্ষণ পর খুব সঙ্কোচের সঙ্গে সে বলে ফল্গুকে, আমরা যতক্ষণ নিজেদের মধ্যে পরিচয় করছিলাম, তার মধ্যে মুড়কিকে এখানে নিয়ে আসার কথা। কিন্তু ওকে দেখা যাচ্ছে না, তার মানে ওকে আনা হয়নি। অথচ সেরিপ বলছে ও মুড়কিকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেই এখানে এসেছে।
আরও দু-তিন মিনিট অপেক্ষা করার পর রায়া জিজ্ঞেস করে অ্যাপোকে, মুড়কি কি সেরিপের বাড়িতেই ছিল?
ঠিক সেরিপের বাড়ি নয়, বলে অ্যাপো, একটা আলাদা বাড়ি, সেরিপের বাড়ির পাশেই, কিন্তু দায়িত্ব ছিল সেরিপের।
তাহলে চল না, আমরা সবাই মিলে ওর বাড়ির দিকেই যাই।
একটু এগোতেই দুতিনটে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনতে পাওয়া যায়। একটু দূরে একটা ছোট বাড়ি, সামনেই বন্ধ দরজা। দেখেই বুকের মধ্যে ছাঁৎ করে ওঠে একসঙ্গে উল্কি আর ফল্গুর! কুকুরগুলো একবার আকাশের দিকে মুখ তুলে ডাকছে, প্রায় কান্নার মতো শব্দ, আর দরজায় মুখ ঘসছে একবার! দৌড়িয়ে যায় অ্যাপো, দরজাটায় ধাক্কা মারে জোরে জোরে। কিছুই হয় না, কুকুরগুলো ডেকেই চলে। যখন সবাই মিলে ভাবছে কী করা যাবে, বাড়িটার চারিপাশ একবার ঘুরে আসে ফল্গু। দরজাটা যে দেওয়ালে সেই দেওয়ালটা শেষ হবার পর একটা ঘেরা পাঁচিলের মতো দেওয়াল চলে গেছে, যেটা পুরো এক পাক ঘুরে শেষ হয়েছে দরজাটার অন্য দিকটায়। রায়াকে ডেকে নিয়ে গিয়ে দেখায় ফল্গু। রায়া কথা বলে অ্যাপোর সঙ্গে। অ্যাপো দৌড়িয়ে কোথায় চলে যায়, তারপর কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসে একটা দড়ির মই আর ধারালো একটা কাটারির মতো কিছু নিয়ে। একটু পরেই দেখা যায় মইটা বেয়ে অ্যাপোকে উঠতে। পেছনে ঢালু হয়ে-আসা বাড়ির চালটা নলখাগড়া দিয়ে তৈরি, সহজেই খানিকটা কেটে ফেলে অ্যাপো, তারপর নেমে যায় বাড়ির ভেতরে। একটু পর ভেতর থেকে দরজাটা খোলে অ্যাপো, সামনেই উপুড় হয়ে পড়ে আছে মুড়কি, জড়িয়ে জড়িয়ে ওর শরীরটা একটা পাকানো নলখাগড়ার দড়ি দিয়ে বাঁধা। দরজাটা কী যে আশ্চর্য প্রক্রিয়ায় ভেতর থেকে বন্ধ করা ছিল বোঝা যায়না।
পাঁজাকোলা করে মুড়কিকে নিয়ে আসে অ্যাপো। জল নিয়ে আসে কেউ, ফল্গু গিয়ে পরিচর্যায় হাত লাগায়, কিছু একটা লতার মতো নিয়ে আসে আর একজন, মুড়কির নাকের কাছে সেটা ধরে রাখা হয়। আধ ঘন্টাটাক পর চোখ খোলে মুড়কি, প্রায় নিষ্প্রাণ চোখ। আরও ঘন্টাখানেক পরিচর্যার পর বসতে পারে মুড়কি, ওর চোখ দেখে বোঝা যায় উল্কি আর ফল্গুকে ও চিনতে পারছে। সেই রাতটা উল্কি আর ফল্গু থেকে যায় মুড়কির সঙ্গে, তবে যে বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে মুড়কি, সে বাড়ি আর নয়। অ্যাপোর বাড়িতে নিয়ে আসা হয় ওদের, মুড়কির জন্যে বেশ খানিকটা দুধ নিয়ে আসে অ্যাপো, ফল্গু আর উল্কি কিছুই খেতে রাজি হয়না।
পরের দিন সকালে বেশ সুস্থই লাগে মুড়কিকে, সে মনে করতে পারে না কখন তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে। মনে হয়, কিছু খাইয়ে তাকে অজ্ঞান করে ফেলা হয়েছিল। দড়ি দিয়ে ওভাবে বেঁধে ফেলেছিল কে? কেন? তাকে কি ওই অবস্থায় জলে ফেলে দেবার মতলব ছিল? ক্ষিপ্ত অ্যাপো এই সব প্রশ্নের উত্তর চায়, দ্বীপের সবাইকে ডাকা হয়, ডেকে পাঠানো হয় সেরিপকে। কিন্তু সেরিপ কোথায়? দ্বীপের আনাচে-কানাচে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায় না। রায়া বলে, কোন উপায় নেই সেরিপের। এই দ্বীপ থেকে পালালেও শাস্তি তাকে পেতেই হবে। ওদের সাঙ্কেতিক বার্তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে সব দ্বীপে, সব জায়গায়।
চার-পাঁচ বছর ধরে ট্যুরিস্টদের আতিথেয়তা দিতে দিতে এখানকার অনেক মানুষ শিখে গেছে একটু একটু কথ্য স্প্যানিশ আর ইংরিজি, তাই এদের সঙ্গে কথা চালাতে বিশেষ অসুবিধে হলো না ফল্গু-উল্কিদের। দ্বীপের মানুষদের অনুরোধে আরও একদিন থেকে গেল ওরা তাকিলেতে। সেই যে চাপাদা ডো ভিডীরস ন্যাশনাল পার্ক থেকে এসপিণ্ডোলোর সঙ্গে আকরে যাবার পথে একটা ছোট রেস্টোর্যান্টে খাওয়া হয়েছিল কার্ণে-ডী-সল নামে এক অনবদ্য সুস্বাদু মাংসের ডিশ, সেই ডিশ পরের দিন আরও একবার ওদের খাইয়ে দিল এখানকার মানুষরা। মুড়কিও খেল। এখন তাকে মোটামুটি স্বাভাবিকই লাগছে। যে বিছানায় শুয়েছিল মুড়কি ফল্গু আর উল্কি এই দু'দিন, তার ঢাকনা হিসেবে যে কাপড়টা ছিল, সেটা এখানকার পুরুষদের নিজেদের হাতে তৈরি হেরিটেজ স্বীকৃতি পাওয়া বয়নশিল্প, সেটাও জোর করে মুড়কিকে দিয়ে দিল ওরা, কোনমতেই দাম নিতে রাজি হলো না।
তবে আসল লাভটা হল ফেরার নৌকোয় ওঠার ঘন্টা তিনেক আগে। ফল্গু ওদের জিজ্ঞেস করছিল ট্যুরিজ্মের ব্যবসার আইডিয়াটা ওদের মাথায় এল কী করে। ওদের দ্বীপের একটা জিনিস ওরা দেখায়নি এই ক'দিন। ফল্গুর হাত ধরে দ্বীপের একটা প্রান্তে নিয়ে গেল ওরা। সেখানে একটা টাওয়ার। দেখিয়ে, রায়া বলল এই রকম টাওয়ার প্রায় প্রতিটা দ্বীপেই আছে। নলখাগড়ায় তৈরি খুব সরু একটা টাওয়ার, একসঙ্গে এক জনের বেশি উঠতে পারবে না। এগুলো খুব যত্ন করে রাখে দ্বীপের মানুষরা, নিয়মিত মেরামত করে, একটু বেশি খারাপ হয়ে গেলে আগেরটা ভেঙে আবার নতুন করে তৈরি করে নেয় একটা। ফল্গুদের টাওয়ার দেখতে নিয়ে গিয়েছিল অ্যাপো, তার সঙ্গে একটা বাইনোকুলারও ছিল, সেটা ফল্গুকে দিল সে। বলল, উপরে গিয়ে ভালো করে দেখ চারদিক।
ওঠার পর ঘুরে ঘুরে ভালো করে দেখে ফল্গু। এক জায়গায় চোখ আটকিয়ে যায় তার। বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে আবার দেখে সে। অনেক দূরে একটা ছোট পাঁচিল-দেওয়া দ্বীপে চারধারে একটা পরিখা গোছের কাটা। দূর থেকে দেখে মনে হয় জলে ভর্তি। আর পরিখায় ঘেরা যে ছোট স্থলভূমিটা, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে অতিকায় একটা জন্তু, খানিকটা গণ্ডারের মতো দেখতে, কিন্তু গণ্ডার বলে মনে হয় না। জন্তুটার দুপাশে স্তুপীকৃত লম্বা লম্বা গাছের ডাল আর পাতা, মুখটা তার নড়ছে বলে মনে হলো, খানিকটা জাবর কাটার মতো। ফল্গু দেখতেই থাকে দেখতেই থাকে।
বেশ কিছুটা সময় কেটে গেলে নীচের থেকে আওয়াজ আসে, এখনও দেখা বাকি আছে অনেকের।
এক এক করে দেখে আসে মুড়কি, উল্কি, রায়া, ফিনিগান।
কী জন্তু চিনতে পারলেন? – জিজ্ঞেস করে অ্যাপো।
ফল্গু বলে, অতিকায় কোন গণ্ডার।
ফল্গুর অজ্ঞানতায় হাসে অ্যাপো, বলে গণ্ডার নয়, আমাদের এই জঙ্গলের দেশের প্রাচীন জন্তু। এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না, অনেক কষ্ট করে খুঁজে পাওয়া গেছে এটাকে।
কী করে খুঁজে পাওয়া গেছে? কে পেল?
আসুন, আমরা বসে বসে কথা বলি। খানিকটা হেঁটে এক জায়গায় ঘাসের উপর বসে ওরা। অ্যাপো বলতে থাকে–
কয়েক বছর আগে চার-পাঁচজন মানুষ, শহরেরই মানুষ তারা, আমাদের মতো জঙ্গলের মানুষ নয়, আমাদের এই তাকিলে দ্বীপে আসে একদিন। এসে, কিছু খেতে চায় তারা। খাওয়া হয়ে গেলে আমাদের তিন-চারজনকে ওরা ডাকে ওদের নৌকোয়। নৌকোটা একটু অন্যরকমের দেখতে, লম্বায় অনেকটা বড়, কাঠ কম, স্টীল বেশি। স্টীল, মোটা প্লাস্টিকের মতো একটা কিছু আর কাচ দিয়ে তৈরি। আমরা সবাই তখন পুনো বা পেরু-বলিভিয়ার নানা শহরে মাঝে মাঝে কাজ করতে যেতাম, কাজেই আমাদের নৌকোর সঙ্গে ওদের নৌকোর তফাৎটা চোখে দেখে বুঝতে অসুবিধে হলো না। ওরা বললো, এই নৌকোটা জলের তলা দিয়েও যেতে পারে, তবে আমরা এখন যতটা যাব সেখানে সাধারণ নৌকোর মতো জলের উপর দিয়ে যাওয়াই ভালো। যে ছোট দ্বীপটা আপনারা টাওয়ার থেকে দেখলেন আমরা সেখানে গেলাম। বাইরে যেখানে পাঁচিল, সেখানে একটা স্টীলের দরজা আছে, তালা দেওয়া। চাবি দিয়ে তালা খুলে আমরা ঢুকলাম ভেতরে। এখন যেখানে ওই গণ্ডারের মতো জন্তুটাকে দেখলেন সেখানে তখনও ওটাই ছিল, কিন্তু এত্তটুকু পুচকে তখন। আমরা যখন ফিরে এলাম, ওরা বলল, আমাদের মতো জঙ্গলের মানুষকে ওরা সঙ্গে চায় জঙ্গল ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে। ওরা জঙ্গলের সমস্ত পুরোনো জীবজন্তুকে, পাখিকে, মাছকে, গাছপালাকে ফিরিয়ে আনবে। জঙ্গলের মানুষ আবার তাদের বাপ-দাদাদের মতো জঙ্গলেই বাঁচার মতো বাঁচবে।
আমরা বললাম, আমরা তো তাই-ই চাই। কিন্তু এ কি সম্ভব এখন আর?
ওরা বলল, আমরা যদি ওদের সঙ্গে থাকি, তাহলে সম্ভব। জিজ্ঞেস করল, যে জন্তুটাকে আমরা দেখলাম কিছুক্ষণ আগে, তেমন জন্তু কি আগে দেখেছি কখনো?
মানতে হল, দেখিনি।
ওরা বলল, অথচ জঙ্গল থেকেই ওরা খুঁজে এনেছে ওকে। চেষ্টা করলে এখনও সময় আছে। আমরা কি আমাদের অধিকার ছেড়ে দেব? জঙ্গল আমাদের। এই জল আমাদের। এখানকার জীবজন্তুরা আমাদের বন্ধু। আমরা কি বাঁচাব না আমাদের বন্ধুদের? ওই যে ছোট্ট পাঁচিল-দেওয়া দ্বীপটা ওরা তৈরি করেছে, ওরা বলল, ওই দ্বীপ থেকেই আমাদের অধিকারের লড়াই আমরা শুরু করছি। ছোট, বাচ্চা একটা জন্তুকে দিয়ে শুরু করলাম, ওকে বাঁচাব, আরও অনেক অনেক জন্তুকে বাঁচাব।
আমরাও সবাই মিলে বললাম, বাঁচাব।
স্টীলের দরজার চাবিটা ওরা আমাদের দিয়ে গেল। বললো, ওরা যথেষ্ট খাবার রেখে যাচ্ছে জন্তুটার জন্যে। আমরা যেন মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসি।
সেই থেকে মাসে দুবার ওরা ওই নৌকোটা বোঝাই করে খাবার নিয়ে আসে ওখানে, জলের তলা দিয়ে। ওদের একজন এসে আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। আমরা সবাই মিলে খাবারগুলো তুলে রেখে আসি। তা ছাড়া মাঝে মাঝে গিয়ে দেখেও আসি ওকে।
দু বছরের মধ্যে ওটা এত বড় হয়ে গেল যে মনে হলো ওই জায়গাটা ওর পক্ষে অনেক ছোট হয়ে গেছে। আমরা লক্ষ্য করলাম, ওটা সারাক্ষণই দাঁড়িয়েই থাকে, হাঁটে না একেবারেই। ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ওটা আসলে চরে-খাওয়া প্রাণী, জাবরও কাটে। এভাবে কি ও বাঁচবে? ওর জন্যে অনেক বড় জায়গা চাই। ওদের বলতে, ওরাও একমত হল আমাদের সঙ্গে। বললো, ওদের দেশে নিয়ে গিয়ে ওটার চিকিৎসা করাতে হবে প্রথমেই, পশুদের হাসপাতালে রাখতে হবে। তারপর অন্য ব্যবস্থা। কিন্তু, এত বড় প্রাণীটাকে নিয়ে যাবে কী করে? সেই থেকে শুরু হলো ওটার ওজন কমাবার চেষ্টার। আমাদের এই অঞ্চলে, এই পেরু-বলিভিয়া-কলাম্বিয়া-ইকোয়েডরে প্রচুর কোকা গাছ হয়। ওরা বলল, ওদের ডাক্তার বলেছে, ওকে কোকা খাওয়াতে, তাতে নাকি ওজন কমবে, আর কাজ করার ক্ষমতাও বাড়বে। যে পশু দাঁড়িয়েই আছে সারাদিন, তারও হাঁটতে ইচ্ছে হবে। সেই থেকে মাসে দুবার ওরা জলের তলার নৌকোটায় বোঝা বোঝা কোকা নিয়ে আসে, তাই-ই খায় ও, কিন্তু ওজন তো ওর কমছে না। বাড়ছে না তেমন আর ঠিকই, কিন্তু কমছে তো না। আর হাঁটছেই বা কই!
কোথায় দেশ ওদের? – জিজ্ঞেস করে ফল্গু।
এই রে, নামটা আমি খালি খালি ভুলে যাই। দাঁড়ান, মনে করি, এই কথা বলে ও তাকায় রায়ার দিকে। রায়া, জিজ্ঞেস করে অ্যাপো, টুপি পরা লোক, ওম্ব্রেকন সম্ব্রের-অ – এ কথার ইংরিজি কী?
ম্যান উইদ হ্যাট অন, বলে রায়া।
হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, ম্যানহ্যাটন। ওরা বলেছে ওরা ম্যানহ্যাটনে থাকে, পৃথিবীর নাকি সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ, সেখানে একটা বিশাল বড় বাড়িতে ওরা নানারকমের বিরল পাখি, কীটপতঙ্গ, পশু, গাছ এসব রেখেছে, ডাক্তারও আছে সেখানে, সেখানেই ওরা নিয়ে যাবে আমাদের এই প্রাণীটাকে, শুধু আর একটু ওজন যদি কমানো যায়। তারপর সবাই ফিরে আসবে আমাদের এই জঙ্গলে।
ফল্গু বলে, তা না হয় হল, কিন্তু আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম আপনারা এই ট্যুরিজ্মের ব্যবসায় কী ভাবে এলেন।
সে তো ওদেরই পরামর্শে, প্রথম প্রথম ওদেরই বন্ধুরা আসতো শুধু, আমরা শুধু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতাম, ওরাই ওই পাঁচিল-ঘেরা দ্বীপে ঘুরিয়ে আনতো ওদের। তারপর ব্যবসা বেড়ে গেল, অনেক লোক আসতে শুরু করল, তখন পাঁচিল-ঘেরা দ্বীপে যাওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হল। ওরা বললো, সভ্য সমাজের মানুষরা আমাদের আবেগ বুঝবে না, ওরা যদি জানতে পারে ওই দ্বীপ থেকে আমরা প্রাচীন জঙ্গল ফিরিয়ে আনার আন্দোলন করছি, তাহলে ধ্বংস করে দেবে ওরা এ সব। আমাদের এখন থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে, কোন ট্যুরিস্টের জানার দরকার নেই পাঁচিল-ঘেরা দ্বীপের কথা।
তাহলে আমাদের জানাচ্ছেন কেন? – জিজ্ঞেস করে ফল্গু।
আপনারা তো আমাদের নিজেদের লোক, আপনারা তো অতিথি-মাৎসিগোঙ্কা, আমাদের লড়াইয়ের সহযোদ্ধা।
এ কথার কোন উত্তর দেয় না ফল্গু, সবাইকে বিদায় জানিয়ে নৌকোর দিকে হাঁটতে থাকে।
যেতে যেতে কী যেন মনে পড়ে যায় ফল্গুর, ঘুরে দাঁড়ায়, পিছিয়ে চলে যায় অ্যাপোর পাশে।
মুড়কিকে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম ও এই দ্বীপে এল কী করে। ও বলতে পারেনি, ওর কিছুই মনে নেই। ওকে যখন এই দ্বীপে আনা হয়েছিল তখন সম্ভবত ও অজ্ঞান ছিল। ও আমাদের বলেছে, জ্ঞান ফিরতে ও দেখেছে ও শুয়ে আছে, আর ওর পাশে আছেন আপনারা, জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায়। পরে যখন পুন্টুর সঙ্গে দেখা হয়, তখন পুন্টু ওকে বলেছে জলের তলার এক রকমের নৌকো দিয়ে ওকে নিয়ে এসেছে ওর অপহরণকারীরা।
ঠিকই বলেছে পুন্টু, বলে অ্যাপো, ওই জলের তলা-দিয়ে-আসা নৌকোটাতেই আনা হয়েছিল ওকে। একটা চামড়ার মুখোশে ঢাকা ছিল ওর মুখটা। ওরা আমাদের বলেছিল, এই মেয়েটাকে দেখবে, কোন কষ্ট যেন না হয় ওর। পাঁচ-ছ'মাস থাকবে ও এখানে। ওকে যেন বাইরের কোন লোক দেখতে না পায়। তারপর, ওরা বলেছিল, আমরা ওকে নিয়ে যাব।
তাহলে পুন্টুর সঙ্গে ওর দেখা হল কী করে?
পুন্টু? পুন্টু তো বাইরের লোক নয়, ও তো মাৎসিগোঙ্কা।
আপনারা পুন্টুকে চিনতেন আগে থেকে?
না না, কিন্তু ওর গলায় যে মাৎসিগোঙ্কা মালা ছিল, বাঁদরের দাঁতের। তা ছাড়া, মাৎসিগোঙ্কা জনজাতির গোপন কথা, যেরকমটা সব জনজাতিরই আছে অন্য জনজাতির মানুষদের কাছে নিজেদের পরিচয় দেবার জন্যে, সেটাও তো ও বলেছিল আমাদের কাছে।
ও কী করে এল?
কী করে এল আমরা জানি না। মুড়কি যেদিন এল, তার পরের দিন এসেছিল ও।
আপনার কি মনে হয় ওই জলের তলা-দিয়ে-আসা নৌকোটাতেই ও এসে থাকতে পারে?
জানি না। তবে আমার মনে হয় অন্য কোনরকমভাবেই ওর পক্ষে এখানে পৌঁছোনো সম্ভব ছিল না।
কিন্তু তাহলে একটা গোটা দিন – চব্বিশ-পঁচিশ ঘন্টা – কোথায় থাকল ও?
ফল্গুর চোখে সোজা চোখ রাখে অ্যাপো, মনে রাখবেন ও জঙ্গলের মানুষ, প্রয়োজন হলে চব্বিশ ঘন্টা জলে থাকা ওর কাছে কিছুই নয়, তা ছাড়া পাঁচিল-ঘেরা দ্বীপের পাঁচিলের ওপরেও একটা রাত শুয়ে থাকা কী আর ব্যাপার? অথবা সবাইকে লুকিয়ে এক ফাঁকে আমাদের এই টাওয়ারে উঠে গিয়ে একটা রাত কাটানো?
ঠিক, মাথা নাড়ে ফল্গু, তারপর হেঁটে যায় নৌকোর দিকে।
যে সব আলোচনা করাই যায়নি তাকিলে দ্বীপে, ফেরার পথে সেই কথাই পাড়ল ফল্গু। হ্যাঁ রে মুড়কি, মুড়কিকে সোজা বলে ও সবার মধ্যে, আমি তোর কাছ থেকে কয়েকটা কথা জানতে চাই। তাকিলেতে যখন জ্ঞান ফিরল তোর, তুই দেখলি তোর আশপাশে উদ্বিগ্ন মুখে কয়েকজন মানুষ। ঠিক এই জায়গাটায়, এই মুহূর্ত থেকে, তোর তাকিলের স্মৃতি, তাই তো?
মুড়কি বলে, হ্যাঁ।
এর ঠিক আগের স্মৃতি কোন্টা? কখন থেকে তোর আর কিছু মনে নেই? তোর মনে আছে আমরা শ্যাভেজের সঙ্গে লেকিং সাইটে কক-অব-দ্য-রক দেখতে গিয়েছিলাম?
দেখতে গিয়েছিলাম, বলে মুড়কি, তারপর শ্যাভেজ নিজে আমাদের সঙ্গে না ফিরে আমাদের নৌকোয় তুলে দিয়ে চলে গেলেন প্রজেক্টে। আমাদের ঘুম উড়ে গিয়েছিল, আমরা পাখিদের গল্প করতে করতে ফিরছিলাম। যখন তীরের খুব কাছাকাছি, কামিলা ওপার থেকে আমাদের দিকে হাত নাড়ছিলেন, এমন সময় একটা খুব জোর শব্দ হলো, কে যেন আমার গলাটা চেপে ধরল, ব্যস!
ব্যস মানে? – ধমকে ওঠে ফল্গু – তারপর? গলাটা যে চেপে ধরল সে কী করল তারপর?
মুড়কি কথা বলে না। কথা বলে না নৌকোর আর কেউ। চোখ-বোজা মুড়কির চোয়ালের দুটো পাশ ফুলে গেছে, বোঝা যাচ্ছে সজোরে দুপাটি দাঁত সে চেপে ধরে আছে, সমস্ত শরীর আর মনের ভুলে-যাওয়া-ঘটনা মনে করার প্রবল বাসনার চাপ তার ছোট্ট কচি মুখটাতে। ফল্গু বলে, ভাব। মনে তোকে করতেই হবে।
দর দর করে জল পড়তে থাকে মুড়কির চোখ থেকে, হবে না ফল্গুদি, পারব না। তার পরেই ওই তাকিলে দ্বীপ। মাঝখানে আর কিছু নেই। কিছুই মনে করতে পারি না আর।
ফল্গু বলে, নৌকোটাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরেছিল আরও অনেক শক্তিশালী একটা নৌকো। আমাদের নৌকোর কল বিগড়ে গেল তখন। প্রবল বেগে নৌকোটা আছড়ে পড়ল ঘাটে। সেইটুকু সময়ের মধ্যে যে তোর গলা চেপে ধরেছিল সে তোকে পরিয়ে দিল চামড়ার একটা মুখোশ। সম্ভবত কোকেইন মাখানো। অজ্ঞান হয়ে গেলি তুই। তার পর মনে করতে পারিস?
না।
তোর গলা চেপে ধরার আগেই, নৌকোটা আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই, উল্কি ছিটকে পড়ল ঘাটে, এটা মনে আছে তোর?
চেষ্টা করে মুড়কি। নাঃ। মনে নেই। শুধু শব্দটা, ব্যস। আর কোন স্মৃতি নেই। এর পর তাকিলে দ্বীপ।
ফল্গু এবার তাকায় ফিনিগানের দিকে। ফিনিগানের পাশে রায়া। আপনারা একটু কাছে এসে বসুন না। এগিয়ে আসে ওরা।
রায়া আর ফিনিগানকে লক্ষ্য করে বলতে থাকে ফল্গু, আপনারা মুড়কি আর আমার কথোপকথনে এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝেছেন, যে পেরু অ্যামাজন রেনফরেস্ট প্রজেক্টের ডিরেক্টর মিস্টার শ্যাভেজের সঙ্গে জঙ্গলে পাখি দেখে এক রাত্তিরে প্রজেক্টের নৌকোয় আমরা – মানে মুড়কি উল্কি আর আমি – ফিরছিলাম ম্যালডোনাডো। আমাদের নৌকো যখন পারের কাছাকাছি তখন খুব জোর একটা শব্দ হয়, নৌকোটা প্রবল বেগে আছড়িয়ে পড়ে পারে, ছিটকে পড়ে যায় উল্কি, আর এই গোলমালে চুরি হয়ে যায় মুড়কি। পরে নৌকোর মাঝির সঙ্গে কথা বলে আমি জানতে পারি, আমাদের নৌকোর কার্ব্যুরেটরে অনেক জল ঢুকেছিল, প্রপেলারটায় কাদা জমে প্রায় সিমেন্টের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল, ঘুরছিলই না, আর ভেঙে গিয়েছিল প্রপেলারের একটা ব্লেড। মাঝির মতে পেছন থেকে ভারি কিছু একটা খুব জোরে ধাক্কা মারলেই সম্ভব ছিল এটা। কিন্তু পেছনে কিছুই দেখতে পাওয়া যায়নি। কোন বড় নৌকোও নয়।
এ ছাড়াও, একটা প্রশ্নের উত্তর কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছিল না। মুড়কি চুরি হল কখন? যখন চুরি হল, তখন ও চিৎকার করল না কেন? কাঁদল না কেন? এখন, মুড়কির সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, ও এমনকি উল্কির পড়ে যাওয়ার ঘটনাটাও জানে না। ও শুধু জানে, শব্দের মুহূর্তে একটা হাত ওর গলা চেপে ধরেছিল। তার মানে, ধাক্কাটা যারা দিয়েছিল তারা কাজ করেছিল একেবারে হিসেব করে, আগে-থেকে ঠিক-করা একটা নির্দিষ্ট সময়ে, ফলে যার হাত চেপে ধরেছিল মুড়কির গলা, তারই অন্য হাতে ধরা কোকেইন-মাখানো মুখোশটা মুড়কিকে পরানো আর উল্কির ধাক্কাজনিত পতন হয়েছিল একই মুহূর্তে, ঠিক?
একেবারে ঠিক, বলে রায়া।
এখন কোকেইন-মাখানো মুখোশটার কথা আমি স্বচ্ছন্দে বলছি বটে, উল্কি বলে, কিন্তু ঘটনাটা ঘটার সময় কোকেইনের কথা আসবে কোথা থেকে? তাকিলে দ্বীপে আমরা শুনে এসেছি মুড়কিকে ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একটা চামড়ার মুখোশ-পরা অবস্থায়, তখনও ও অজ্ঞান। এই পর্যন্ত। মুখোশটা পরানোর পরের মুহূর্তেই ও যে অজ্ঞান হয়ে যায় এটা ওর কথা থেকেই বোঝা গেল। কিন্তু কোকেইনের কথাটা এখনও আসেনি। যদিও কথাটা ঠিকই, তবু, সেটা আসবে আরও পরে।
মুড়কি চুরি হয়ে যাবার দিনই পরে আমি আর শ্যাভেজ কথা বলি নৌকোর মাঝি আর তার এক জন সঙ্গীর সঙ্গে। জানা যায়, প্রজেক্টের ঘাটে নৌকো দাঁড় করিয়ে আমরা যখন জঙ্গলের ভেতর ঢুকি পাখি দেখার জন্যে, সেই সময় চার জন মানুষ একটা নৌকোয় চড়ে অপেক্ষমান নৌকোটার পাশে আসে, এবং লাফ দিয়ে নৌকোয় ঢোকে। রিভলভার ঘাড়ে ঠেকিয়ে ওদের মধ্যে তিনজন লোক নৌকোর তিনজন মানুষকে জঙ্গলে নিয়ে যায়, চতুর্থ জন বাকি দুজনকে পাহারা দেবার জন্যে নৌকোতেই থেকে যায়। কিছুক্ষণ পর ওই তিনজন ফিরে আসে, মাঝি আর তার সঙ্গী ধরেই নেয় নৌকোর তিনজনকে ওরা খুন করে জঙ্গলে ফেলে এসেছে। ফিরে আসার পর অবিশ্যি ওদের চতুর্থ সঙ্গীকে ওই তিনজন নৌকো থেকে তাড়িয়ে নিজেরা থেকে যায় নৌকোয়।
পরের দিন আবার প্রজেক্টে যাই আমি আর উল্কি। গিয়ে আমরা খবর পাই নৌকোর যে তিনজনকে আগের দিন জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, অজ্ঞান অবস্থায় তাদের পাওয়া গেছে। প্রত্যেকের চামড়ার মুখোশ পরা ছিল। আজ যেমন আমরা মুড়কির আংশিক স্মৃতিভ্রংশ দেখলাম, প্রায় এরকমই আমরা দেখেছিলাম সেদিন। লোকগুলো শুধু মনে করতে পারল যে ওদের ঘাড়ে রিভলভার ঠেকিয়ে জঙ্গলে নিয়ে আসা হয়েছিল। আর কিছু মনে নেই। আমার তখন তীব্র সন্দেহ হল যে ওদের ড্রাগ দেওয়া হয়েছে, সম্ভবত কোকেইন। মুখোশগুলোকে আমরা ম্যালডোনাডোতে নিয়ে এলাম। পরীক্ষায় বোঝা গেল আমার সন্দেহই ঠিক, মুখোশগুলোতে ছিল ট্রেসেস অব কোকেইন। ঠিক এই সময়েই আমার মনে আইডিয়াটা আসে। মনে হয় নৌকোয় ধাক্কার একটা সমাধান পাওয়া গেছে, সামথিং টু ডু উইদ নার্কো-সাবমেরিনস।
এক গ্লাস জল খায় ফল্গু, তারপর বলে, নার্কো-সাবমেরিন সম্বন্ধে কোন ধারণা আছে আপনাদের?
ওরা জানায় ওদের ধারণা নেই।
সাবমেরিন জানেন নিশ্চয়ই, জলের তলা দিয়ে যায় যে নৌকো, যেমনটার কথা অ্যাপো বললো?
হ্যাঁ, সাবমেরিন শুনেছি, বলে ফিনিগান।
শুধু বেআইনী নেশার উপাদান বহন করে জলের তলা দিয়ে যায় যে জলযান তাকে বলে নার্কো-সাবমেরিন। উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে যে আমেরিকা মহাদেশ, বলতে থাকে ফল্গু, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কোকেইনের ব্যবসা হয় সেখানে, নেশার উপাদান হিসেবে। এর মধ্যে আবার উত্তর আমেরিকাই কেনে বেশি। কিন্তু মজার কথা হলো, বেআইনী কোকেইনের বিরাট ব্যবসাটার প্রাণকেন্দ্র উত্তর আমেরিকা নয়, কলাম্বিয়া থেকে শুরু করে পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী আর কাছাকাছি দেশগুলো, যেমন ইকোয়েডর-পেরু-বলিভিয়া-চিলে-আর্জেন্টিনা হল বেআইনী কোকেইন পরিবহনের প্রধান পথ। সমুদ্র উপকূল ছাড়াও ঘন জঙ্গল আর তার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নানান নদী-উপনদী-শাখানদী ছোট ছোট নার্কো-সাবমেরিন যাতায়াতের সুবিধে করে দিয়েছে। গত পনেরো-কুড়ি বছর ধরে এই নার্কো-সাবমেরিনই প্রধানত বহন করছে পণ্য কোকেইন। ২০০৯ সালে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই অন্তত ষাটখানা নার্কো সাবমেরিনের সন্ধান পায়। তাদের হিসেবে বছরে অন্তত তিনশো তিরিশ টন কোকেইন বহন করেছে এই নার্কোসাবগুলো।
এখনকার হিসেবে, বলতে থাকে ফল্গু, একটা সাব তৈরি করতে খরচ হয় মোটামুটি কুড়ি লক্ষ আমেরিকান ডলার। সাবগুলো অগভীর জলে ঠিক জলতলের নীচ দিয়ে যাতায়াত করে আর প্রধানত গ্লাস-ফাইবার দিয়ে তৈরি, ফলে এমনকি আধুনিক র্যাডারেও এদের ধরা পড়া প্রায় অসম্ভব। এক বছরে একটা নার্কো-সাবমেরিন বহন করবে যতটা কোকেইন, পাইকারি বাজারে তার দাম চল্লিশ কোটি আমেরিকান ডলার। ফলত এক বছর ব্যবহারের পর একটা নার্কোসাব অন্য কাজে ব্যবহার করা যেতেই পারে, বিশেষ করে সাব-এর মালিকের যদি আরও নানা আইনী বা বেআইনী ব্যবসা থাকে যেখানে এটাকে কাজে লাগানো যাবে।
তাকিলেতে গিয়ে একটা নতুন জগতের স্বপ্ন দেখা মানুষদের দেখে এলাম আমরা, ফল্গু বলে, যে স্বপ্ন দেখছে অ্যাপো আর তার আত্মীয়-বন্ধুরা, আর হয়তো অ্যাপোর কাছ থেকে শোনার পর, আপনারাও। হারিয়ে-যাওয়া জীবজন্তুদের নাকি এখনও খুঁজলে উদ্ধার করা যেতে পারে, যেমন অতিকায় যে গণ্ডারটাকে দেখে এলাম আমরা তাকে উদ্ধার করা গেছে। যারা এ কাজে প্রধান উদ্যোগী বোঝা গেল তারা বিপুল ধনী, ম্যানহাটনের লোক, যেখানে তারা জমা করেছে আরও অনেক বিরল পাখি, কীটপতঙ্গ, পশু, গাছ। কী তাদের উদ্দেশ্য জানিনা, তবে দক্ষিণ আমেরিকার বেআইনী মাদক ব্যবসাতেও যে তাদের উৎসাহ এবং অবদান আছে তা বুঝতে খুব বুদ্ধিমান হবার দরকার পড়ে না। অ্যাণ্ডিয়ান অঞ্চল যাকে বলে, যেমন কলাম্বিয়া-পেরু-বলিভিয়া এবং সন্নিহিত অঞ্চল, এখানকার যে বিরাট বেআইনী কোকার চাষ, সেই চাষেও যে তাদের যোগাযোগ আছে তাতে সন্দেহ নেই, মাসে দু'বার করে গত দুবছর ধরে বোঝা বোঝা কোকা নার্কো-সাবে বয়ে বয়ে তিতিকাকার পাঁচিল-দেওয়া দ্বীপে নিয়ে যাওয়াই তার প্রমাণ।
কিন্তু সে কথা যাক, বলে ফল্গু, আমি ভাবছি পুন্টুকে খুন করল কারা আর কেন। ফিনিগানকে বলে ফল্গু, আপনি বলছিলেন, যেদিন মুড়কি উল্কি আর আমি বাটারফ্লাই পার্কে গিয়েছিলাম সেদিনের কথা। সেদিন সকালে ট্যুরিস্ট সেন্টারে এসে খোঁজ-খবর নিয়ে, তারপর আমরা গিয়েছিলাম বাটারফ্লাই পার্কে, সে খবর আপনাকে পুন্টু আগেই দিয়েছে। ফিরে এসে তাম্বোপাতা ট্র্যাভ্লার্স-ইন থেকে চেক-আউট করে আমরা ফিরে আসি ওই ট্যুরিস্ট সেন্টারেই। তারপর আমাদের সঙ্গে শ্যাভেজ আর কামিলার মীটিং শুরু হয়, তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে, সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে। এই খবরটাও পুন্টু দিয়েছে আপনাকে, তারপর আর তার কাছ থেকে কোন টেলিফোন পাননি আপনি। পুন্টুর কাজ ছিল আমাদের লক্ষ্য রাখা, সেইজন্যেই আমাদের খবর ও দিতে পারেনি আপনাকে।
ওই মীটিঙে রাত প্রায় ন'টার সময় ঠিক হয় সেই রাত্তিরেই আমরা রেনফরেস্ট প্রজেক্টে যাব। শ্যাভেজ আমাদের বিশ্রাম নিতে বলেন, আর বলেন নৌকোতে আমাদের খাবার থাকবে। আমাদের বাইরে আর কারো সে কথা জানা সম্ভব নয়। হোস্ট হিসেবে সম্ভবত তখন শ্যাভেজ ড্রাইভারকে দায়িত্ব দেন আমাদের খাবার কোন রেস্টোর্যান্ট থেকে কিনে নৌকোয় পৌঁছিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে, কারণ আরো রাতে আমরা যাব জেটিতে নৌকো ধরতে। আমার মনে হয় ড্রাইভার যখন বেরোয় তাকে অনুসরণ করে পুন্টু, চার প্যাকেট খাবার নিয়ে ড্রাইভার সোজা ট্যুরিস্ট অফিসে না ফিরে যখন নৌকোতে রাখতে যায় খাবারের প্যাকেটগুলো, তখন সে-ও যায় গাড়িকে অনুসরণ করে, এবং খাবার রেখে ড্রাইভারকে খালি হাতে ফিরতে দেখে সে নিশ্চিত হয় যে সেই রাতে শ্যাভেজের সঙ্গে আমরাও যাব প্রজেক্টে। সেই মুহূর্তে তার প্রধান দায়িত্ব হলো আমাদের অনুসরণ করা এবং আমাদের ওপর নজর রাখা। অতএব ট্যুরিস্ট অফিসে আর না ফিরে এসে সে জেটিতেই থাকে, এবং কী করে আমাদের নৌকোর পিছনে পিছনে গিয়ে কীভাবে আমাদের ওপর নজর রাখবে সম্ভবত তারই পন্থা ভাবতে শুরু করে। আপনি বুঝতেই পারছেন ফিনিগান, এই খবরটা ঠিক তখনই আপনাকে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
তাকিলে দ্বীপে গিয়ে আমরা জানতে পারি, যে নার্কোসাবে মুড়কিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওই দ্বীপে, সেই নার্কোসাবেই গিয়েছিল সে-ও। আশ্চর্য নিষ্ঠা আর দুঃসাহস! পুন্টু বুঝতে বা জানতে পেরেছিল, আমাদের তিনজনের মধ্যে মুড়কিই সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত, তাই মুড়কির ওপর নজরদারি সে বন্ধ করেনি, নিজের প্রাণসংশয় করেও মুড়কির কাছে পৌঁছেছিল, নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদের জন্যে সে মুড়কির চিঠিও নিয়ে এসেছিল। যে এতটা ঝুঁকি নিয়ে আর কষ্ট করে মুড়কির চিঠি সংগ্রহ করেছিল, সে কী করে আবার ম্যালডোনাডো ফিরে এসেছিল তা আমাদের জানার দরকার নেই, শুধু আমরা জানি শেষ পর্যন্ত মরতেই হল তাকে: আমরা যে লড়াই করছি সেই লড়াইয়ের শহিদ হল সে।
মুড়কি যেদিন অপহৃত হল সেদিন থেকে পুন্টুর গলা আর আপনি শোনেননি ফিনিগান, ও সেদিন থেকে কী কী কাজে ব্যস্ত ছিল, যুক্তি দিয়ে সেটা আমি, ইংরিজিতে যাকে বলে রিকন্সট্রাক্ট করা, তা করেছি। সেটাই বললাম। এখনও দুটো গ্যাপ আছে। নদীর ওপারে আমাদের নৌকোকে অনুসরণ করে ও যেতে পেরেছিল কিনা আমি জানিনা, কিন্তু ঠিক কীভাবে মুড়কির অপহরণের মুহূর্তে ঘটনাটা ও জানতে পেরেছিল সেটা আমার কাছে প্রথম রহস্য বা গ্যাপ। আর দ্বিতীয়টা, অপহৃত মুড়কির সঙ্গে শত্রুদের নার্কোসাবে ওর ভ্রমণের রহস্য।
শিম্পাটিয়া গ্রামে আশানিঙ্কা-মাৎসিগোঙ্কাদের সঙ্গে যখন আমাদের প্রথম দেখা করিয়ে দেন এসপিণ্ডোলো, আমরা তখন তাদের শুধু বলেছিলুম, আমরা এসেছি জঙ্গলের প্রাণীরা যাতে জঙ্গলেই থাকতে পারে, যেমন থেকেছে চিরকাল, সেই চেষ্টা করতে, এখন একটু ব্যাপারটা স্পষ্ট করি। আপনারা দুজনেই আমাদের সহযোদ্ধা, আপনাদের জানা দরকার। আমরা খবর পেয়েছিলুম, পেরুর জঙ্গল থেকে পেরুর জাতীয় পাখি অ্যাণ্ডিয়ান কক অব দ্য রক চুরি হচ্ছে গত কয়েকবছর ধরে। আমাদের উদ্দেশ্য সেই চোর ধরা। চোরকে প্রায় চিনে ফেলেছি আমরা, আশা করি অচিরেই সফল হব। পুন্টুর ব্যাপারে গ্যাপ দুটোও বোধ হয় সেই সময় পূরণ হবে।
আপনাদের সঙ্গে তাকিলে দ্বীপে রওনা হবার আগের দিন আমি ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারে কামিলার সঙ্গে দেখা করি, আপনারা তা জানেন। কামিলা বলেছিলেন শ্যাভেজ আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। তাকিলে থেকে ফেরবার সময় ওঁকে যদি আমি টেলিফোনে জানাই, উনি শ্যাভেজকে তাহলে আনিয়ে রাখবেন। পুনুতে নেমে ওঁকে আমি জানাব। উনি তাম্বোপাতা ট্র্যাভ্লার্স ইন-এ আমাদের অ্যাকোমোডেশনের ব্যবস্থা করে রাখবেন, কিন্তু তার আগে ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারে আমরা শ্যাভেজের সঙ্গে কথা বলব। তারপর পৌঁছোবো ট্র্যাভ্লার্স ইন-এ। আপনারা কোথায় থাকবেন?
ফিনিগান বলে, আমরা আপনার সঙ্গেই আছি, যেখানেই থাকি পুন্টুর দায়িত্বটা এখন আমাদের উপর বর্তেছে, আমরা নজর রেখে যাব আপনাদের ওপর, ছায়ার মতো। ফোন নম্বর আছে, দরকার পড়লেই ডাকবেন।