পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্টের স্প্রেডের সামনে ভদ্রলোকের সঙ্গে আবার দেখা, খাওয়া-দাওয়ার তদারকি করছেন। ওদের দেখেই তিনকোনা স্প্রেডের একটা প্রান্তে নিয়ে গেলেন। সেখানে অল্প আগুনে বড় একটা পেতলের পাত্রে যে জিনিসটাকে গরম রাখা হচ্ছে সেটা বড়ো বড়ো কাবলি ছোলার ঘুগনি ছাড়া আর কিছু নয়, পাশে দাঁড়িয়ে একটা লম্বাটে কাঠের পাটাতনে একজন বেলছে একেবারে নির্ভেজাল বেনারসী কচৌরি, আর একটা-একটা করে সেগুলোকে ছাড়ছে একটু নীচে আগুনে-বসানো ফুটন্ত তেলের কড়াইতে। ওরা হাসল, ভদ্রলোক কাল বলেইছিলেন, প্রায় সব রকম টেস্টের লোকের জন্যেই কিছু-না-কিছু থাকে ওঁদের ব্রেকফাস্ট-স্প্রেডে, বোঝা গেল অন্তত উত্তর ভারতের লোকদের পছন্দের খবর ওঁরা রাখেন। ভদ্রলোকের আগ্রহে একটা করে কচুরি খেল ওরা, তারপর অরেঞ্জ জ্যুস, আণ্ডা-বেকন সহযোগে টোস্ট, কয়েকরকমের মাছের স্লাইস, আর চকলেট পেস্ট্রী। ফল্গুদি যখন কফি খাচ্ছে, উল্কিদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে কফি নেবে না চা, ভদ্রলোক এগিয়ে এসে মুড়কিকে বললেন, হট চকলেট আছে ওখানে। উল্কিদি হেসে বলল, তোকে দেখেই বুঝেছে তুই চকলেট খাস, বলতে বলতে নিজের জন্যেও একটা কাপ ভরে নিল।
ওরা যতক্ষণ খাচ্ছিল, ভদ্রলোক অন্য অতিথিদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, নানারকমের খাবারের দিকে এগিয়ে দিচ্ছিলেন তাদের, একেবারে পারফেক্ট হোস্ট! খাওয়ার পর যখন পা বাড়িয়েছে ওরা হোটেলের প্রধান গেটের দিকে – একটুখানি বাইরের থেকে ঘুরে আসবে ভেবে – ভদ্রলোক হাসিমুখে এগিয়ে এলেন ওদের দিকে।
কোথায় চললে? – জিজ্ঞেস করেন ভদ্রলোক।
এই একটু ঘুরে-টুরে আসি।
ঘুরে-টুরে আসবে কোথা থেকে, এখনো তো দোকান-বাজার অফিস-কাছারি খোলেইনি? খোলা আছে লণ্ড্রোম্যাটটা, ওটা চব্বিশ ঘন্টাই খোলা থাকে। তোমরা বরং ওখান থেকেই ঘুরে এসো না, যা যা ধোয়ার আছে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। এই গেট থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে সোজা মিনিট দশেক হেঁটে গেলে পেয়ে যাবে লণ্ড্রোম্যাটটা।
লণ্ড্রোম্যাটটা যে এত বড় হবে তা ভাবেইনি ওরা। গোটা পনের মেশিন পর পর। অবিশ্যি এখনো ভীড় শুরু হয়নি। প্রতিটি মেশিনের পাশেই ছোট ছোট বোর্ডে ব্যবহারবিধি লেখা, নানা ভাষায়, তার মধ্যে ইংরিজিও আছে। নানারকমের গুঁড়ো এবং তরল ডিটার্জেন্ট আর হোয়াইট্নার এক জায়গায় রাখা (মুড়কি বললো, নীলও রেখে দিয়েছে, দেখেছ!), পাশে একটা বাক্স, লেবেল-এ লেখা দাম পড়ে বাক্সে রেখে দিলেই হবে। দোকানটাতে ঢুকে প্রথমে এটা লণ্ড্রোম্যাট না ট্যুরিস্ট অফিস বোঝাই যায় না; এত ছবি, পোস্টার, নানারকমের চার্ট আর ম্যাপ সাজানো চার দেওয়ালে। কোণের দিকে একজন মহিলা বসে আছেন, তিনিই বোধ হয় ম্যানেজার। সঙ্গে এগজ্যাক্ট চেঞ্জ না-থাকলে কাজ হয়ে গেলে টাকাপয়সা তিনিই নেবেন নিশ্চয়।
ব্যবহারবিধি পড়ে উল্কি আর মুড়কি লেগে গেল কাচতে, ফল্গু গেল ম্যানেজার মহিলাটির সঙ্গে গল্প করতে।
কী বিষয়ে গল্প করবে তা ভাবতেই হলো না ফল্গুকে। চট করে আগে বোঝা না গেলেও মহিলা যেখানে বসে আছেন তার ডান দিকের দেয়ালটা কেটে একটা বড়োসড়ো আলমারির মাপের ঘরের মতো, আর সেখানে ঘরের ছাদের থেকে ঝুলছে দুটো স্টীলের খাঁচা। খাঁচা দুটোতে একটা করে কাকাতুয়ার মতো পাখি, ধবধবে সাদা, বুকের মধ্যে ঠোঁট দুটো গুঁজে দিয়ে ঘুমোচ্ছে বোধ হয় দুটোই।
পাখি দুটোকে দেখে খানিকটা অবাক ফল্গু, মহিলাকে জিজ্ঞেস করল ইংরিজিতে, এখানে কাকাতুয়াও পাওয়া যায়?
ভাঙা ইংরিজিতে জবাব দেন মহিলা, না, এগুলো অস্ট্রেলিয়ার পাখি।
মহিলা যেখানে বসে আছেন তার উল্টো দিকের দেয়ালে বিরাট একটা পোস্টার। পোস্টারটার থেকে চোখ-ফেরানো যায় না। একটা উঁচু পাঁচিলের মতো জায়গা জুড়ে, পাঁচিলটার গায়ে যেন পায়ে-আঠা দিয়ে, সেঁটে দেওয়া হয়েছে শ'য়ে-শ'য়ে হাজারে-হাজারে, মাথা উপরে, লেজ ঝোলা নানা রঙের ঝুলন্ত পাখি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ডাকঘর নাটকে ক্রৌঞ্চদ্বীপের নীল পাহাড়ে হাজার হাজার সবুজ পাখির গল্প বলেছিলেন। এখানে শুধু সবুজ নয়, হলুদ-কমলা-লাল-বেগুনি-নীলের ছড়াছড়ি! দেখে মনে হয় ওদের গায়ে হাত লাগলে রঙগুলো লেগে যাবে হাতে!
পোস্টারটার দিকে আঙুল দেখিয়ে ফল্গু জিজ্ঞেস করে, আর ওইগুলো?
ওরা তো আমাদের দেশের! ওদের দেখবে বলেই তো তোমরা এসেছ এত পয়সা খরচ করে।
এমন সুন্দর সুন্দর পাখি নিজেদের দেশে আছে, তোমরা তবুও অস্ট্রেলিয়ান কাকাতুয়া পোষো কেন?
দক্ষিণ এবং মধ্য-আমেরিকার সব পাখিই এ দেশে পোষা বারণ। এখানকার নেচার কনজার্ভেশনের তালিকায় পাখি সবচেয়ে উপরে। কোন পাখিকে কেউ জঙ্গলের থেকে সরাতে চেষ্টা করে যদি ধরা পড়ে যায়, তার প্রাণদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। তাই আমরা অন্য দেশের পাখি পুষি।
নিজের দেশের পাখি জঙ্গল থেকে সরালে প্রাণদণ্ড, ফল্গু অবাক, আর অস্ট্রেলিয়ার কাকাতুয়া খাঁচায় পুরে সর্বসমক্ষে ঝুলিয়ে রাখলেও কোন দোষ নেই!
মহিলা বললেন, তুমি যেমন করে ভাবছ ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। যে কোন রকমের পাখি পোষাই এ দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তারপর বার্ড লাভার্স ইউনিয়নের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত এটাই রফা হয়েছে।
বার্ড লাভার্স ইউনিয়ন? যারা পাখি পোষে তাদেরও ইউনিয়ন?
একটু ভুল বুঝলে, মহিলা বলেন, সব বার্ড লাভার্সই যে পাখি পোষে, ঠিক সেরকম নয় ব্যাপারটা, বরং উল্টোই। বেশির ভাগই পোষে না। কিন্তু যারা পোষে, তাদের ইউনিয়নের মেম্বার হতেই হয়। তাহলে পাখি নিয়ে তারা কী কী করছে, যেমনটা করা উচিত তেমন যত্ন করছে কিনা, এসব খবর রাখার সুবিধে হয়। ফলত, শুধুমাত্র তারাই পাখি পুষতে পারে যারা ঠিক ঠিক মতো যত্ন নেবে পাখির। বার্ড লাভার্সদের এই যুক্তি অবিশ্যি প্রথম প্রথম মানতে চায়নি এদেশের কনজার্ভেশনিস্টরা, কিন্তু ইউনিয়নের যাঁরা মাথা, তাঁদের একটা কথা শেষ পর্যন্ত মানতেই হয়েছে সরকারকে, দিতে হয়েছে পাখি পোষার অনুমতি।
ফল্গু দেখলো কথা বলতে বেশ আগ্রহী মহিলা, সে জিজ্ঞেস করলো, কী কথা? কী কথা মানতে হয়েছে?
মহিলা বললেন, তুমি জেরাল্ড ডারেলের নাম শুনেছ?
হুঁ, শুনেছি তো, ফল্গুর জবাব।
তাঁর চেয়ে বড়ো কনজার্ভেশনিস্ট আর কে আছে? – মহিলা বলতে থাকেন, ডারেল নিজেও দস্তুরমত চিড়িয়াখানা বানিয়েছিলেন, আর তাঁর চিড়িয়াখানায় শুধুই যে লুপ্তপ্রায় প্রাণীই ছিলো তা তো নয়। তিনি মনে করতেন চিড়িয়াখানায় যারা বেড়াতে আসে তাদের মনে নানা প্রাণীর ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি করার কাজটা প্রাথমিক ভাবে চিড়িয়াখানাই করে। আর শুধু তা-ই তো নয়, বনের প্রাণীকে পোষ মানানো মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, সেই গুহাবাসের দিন থেকে মানুষ কোন-না-কোন প্রাণীকে পোষ মানিয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে, কাজেও লাগিয়েছে তাকে। এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে খর্ব করলে ফল ভালো হবে না। এ-কথার যুক্তি মেনে শেষ পর্যন্ত এখানকার আদিবাসী নয় যে পাখি, তাদের পোষার অনুমতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
মহিলার সঙ্গে গল্প করতে ভালোই লাগছিলো ফল্গুর, বিশেষত লণ্ড্রোম্যাটের দেখাশোনা করা যাঁর পেশা, এরকম একজন মহিলা যে জেরাল্ড ডারেলের নামের সঙ্গে শুধু পরিচিত তা-ই নয়, যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে জোরালো সওয়াল করতে পারেন পাখি পোষার স্বপক্ষে, তা দেখে প্রায় মুগ্ধই সে। কিন্তু ততক্ষণে মুড়কি আর উল্কির জামাকাপড় কাচা এবং শুকোনোর কাজ সারা। অতএব বিল মিটিয়ে মহিলাকে টা টা করে বেরিয়ে এল ওরা।
হাঁটতে হাঁটতে ফিরছে ওরা হোটেলে, এমন সময় মুড়কি একটা টান দেয় ফল্গুর হাতে, আঙুল তুলে সামনের দিকে দেখায় সে। ওদের থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বে বেশ দ্রুত হাঁটছে টাকমাথা একজন, পরনে বুশশার্ট। ইনাপারি থেকে ম্যালডোনাডোর বাসে ওঠবার সময় সন্দেহভাজন লোকটার সঙ্গে আর একজনকে দেখেছিল ওরা: পেছন থেকে। টাকমাথা, বুশশার্ট। একটু দ্রুত হাঁটতে শুরু করে ওরা। অনেকটাই লোকটার কাছাকাছি এসে গেছে, এমন সময় রাস্তার বাঁদিকে দুটো বাড়ির মাঝখানের সরু গলিটার মধ্যে ঢুকে গেল লোকটা। বাড়ি দুটো পর্যন্ত পৌঁছোবার পরও যখন দেখা গেল না কাউকে, ফল্গু হেসে বলল, টাকমাথা লোক পৃথিবীতে কত আছে জানিস? আর, এই লোকটাকে তো সামনাসামনি দেখিইনি আমরা, কেমন দেখতে তা-ও জানিনা!
হোটেলে ঢুকে দেখা গেল ব্রেকফাস্টের পর্ব শেষ, যথারীতি রিসেপশনে বসে আছেন ওদের পরিচিত ভদ্রলোকটি। দেখে হেসে বললেন, জামাকাপড় কাচা হল? এখন তবে কী করবে?
কী করব সেই পরামর্শ করতেই তো এলুম আপনার কাছে, বলে ফল্গু।
তোমরা বলছিলে ভলান্টিয়ারিং প্রজেক্টে কাজ করতে চাও, তাহলে তো প্রজেক্টের ম্যালডোনাডো অফিসে যেতেই হবে তোমাদের। সেক্ষেত্রে মেইন স্কোয়ারের জন্যে একটা মোটোট্যাক্সি নিয়ে নাও, মেইন স্কোয়ার থেকেই শুরু কর।
মোটোট্যাক্সি? – প্রশ্ন করে মুড়কি।
মোটোট্যাক্সি জানো না? মোটোট্যাক্সিতেই তো তোমরা এলে কাল রাত্তিরে।
ওঃ, ওইগুলো? আমরা ওগুলোর নাম দিয়েছিলুম মোটর সাইকেল রিকশা।
তা বলতেই পারো, তবে এখানকার লোকরা মোটোট্যাক্সিই বলে। আমাদের মেইন গেট থেকে বেরিয়ে মিনিট পাঁচেক দাঁড়ালেই খালি একটা পেয়ে যাওয়া উচিত।
এইটুকু বলে কী একটা ভাবলেন ভদ্রলোক, বললেন একটু দাঁড়াও তো দেখি। তারপর মোবাইল ফোনটা পকেট থেকে বের করে কার সঙ্গে যেন কথা বললেন, হেসে বললেন মুচাস গ্র্যাতিয়া, তারপর ফোনটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে ওদের বললেন, তোমরা এখানেই বোসো, মোটোট্যাক্সি এখানেই আসবে।
সোফায় বসতে বসতে উল্কি জিজ্ঞেস করে মুড়কিকে, ভদ্রলোক শেষ যে কথাটা বললেন সেটা বুঝলি?
না, মুড়কির জবাব।
মুচাস গ্র্যাতিয়া, ওটা স্প্যানিশ উচ্চারণ। বানানটা অবিশ্যি একটু অন্য রকমের, ইংরিজি উচ্চারণে পড়লে পড়তে হবে মুচাস গ্রেসিয়াস, মানে হচ্ছে থ্যাঙ্ক য়্যু সো মাচ!
তুমি আবার স্প্যানিশ শিখলে কবে?
ফল্গু হেসে ফেলে। উল্কিকে বলে, এবার ধরা পড়ে গেলি তো। তারপর মুড়কির দিকে ফিরে বলে, ও স্প্যানিশ জানে না ঘেঁচু! আসবার আগে কয়েকটা সাধারণ কথা, যেমন গূড মর্ণিং, হাউ মাচ, থ্যাঙ্ক য়্যু, গূড বাই– এসব স্প্যানিশ আর পর্তুগিজ ভাষায় মুখস্থ করে এসেছে, বিস্তর ট্যুরিস্ট বইয়ে এসব পাওয়া যায়।
এইসব কথাবার্তা চলতে চলতেই ওদের মোটোট্যাক্সি হাজির। হোটেলের ভদ্রলোকই ড্রাইভারকে বলে দিলেন কোথায় যেতে হবে, তারপর ফল্গুকে বললেন, ও যেখানে নামাবে তোমাদের, সেটাই আমাদের শহরের মূলকেন্দ্র, প্লাজা বা সিটি সেণ্টারও বলতে পারো, প্লাজা দ্য আর্মাস। নেমেই দেখতে পাবে একটা উঁচু টাওয়ার, আমরা ওবেলিস্কো নামে ডাকি, যদিও পুরো নামটা একটু খটোমটো, অল মিরাদর দ্য লা বায়োডাইভার্সিদাদ, ইংরিজিতে বলতে গেলে বায়োডাইভার্সিটি টাওয়ার। অ্যামাজোনিয়ান জঙ্গলের মধ্যে মাদ্র দ্য দিয়স আর তাম্বোপাতা নদীর পারে আমাদের এই ছোট্ট শহর আর জঙ্গলের বিস্তৃতি একসঙ্গে দেখার জন্যে ওবেলিস্কোর তুলনা নেই। যেখানে তোমাদের নামাবে এই মোটোট্যাক্সি, সেখানে দাঁড়িয়ে ওবেলিস্কোর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডানদিকে যে রাস্তাটা পাবে, সেটা দিয়ে ঢুকে খানিকটা গেলেই দেখতে পাবে একই সঙ্গে পেরু অ্যামাজন রেনফরেস্ট প্রজেক্টের অফিস আর এখানকার ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টার। প্রথমে সেখানেই যেও তোমরা, যা যা জানতে চাও ওখানেই জানতে পারবে ঠিকঠাক। আর ফেরবার আগে, সন্ধ্যের মুখে ওবেলিক্সের উপর থেকে সূর্যাস্ত দেখে আসতে ভুলো না।
সাইনবোর্ড দেওয়া ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারটা চিনতে অসুবিধে হল না। একতলা বাড়িটা একটা ছোট কম্পাউণ্ডের উপর, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ছোট একটা গাড়ি। গেটটা বন্ধ, কিন্তু তালা দেওয়া নয়। গেট খুলে ঢুকে গেল ওরা। খানিকটা এগিয়ে সাইনবোর্ডটার ঠিক নীচে যে দরজাটা, মনে হল সেটাই বাড়িটার প্রবেশপথ, কিন্তু ভিতর থেকে বন্ধ। নক নক নক। তিনবার আস্তে আস্তে নক করে ফল্গু, দরজা খোলে না। একটু অপেক্ষা করে আবার তিনবার। দরজা অনড়।
মুড়কি আর উল্কিকে বলে ফল্গু, মনে হচ্ছে বাড়িটা এই অফিসের কর্তার বাসগৃহও। গাড়িটাও নিশ্চয়ই তার। খোলার সময় হয়নি এখনো। আয়, আমরা গাড়িটার ছায়ায় একটু বসি। সময় হলে তবেই খুলবে।
গাড়িটার দিকে এগোতে গিয়ে পাঁচিলের ওপারে হঠাৎ চোখ যায় মুড়কির। টাকমাথা একটা লোক রাস্তাটা পেরিয়ে যাচ্ছে, পরনে প্যান্ট আর বুশশার্ট। উল্কিকে দেখায় ও। নিঃশব্দে।
উল্কির ইঙ্গিতে লোকটাকে এক মুহূর্তের জন্যে দেখে ফল্গুও। টাকমাথা একটা লোককে বারবারই দেখছি আমরা, বলে ফল্গু, কিন্তু একই লোক কি? মুশকিল হচ্ছে, একই লোক হয়ও যদি, লোকটাকে সামনের থেকে একবারও দেখিনি আমরা, যতবার দেখছি, পেছন থেকেই। কাজেই দেখলেও চিনতে পারব না। আর যদি ধরেই নিই লোকটা সত্যিই আমাদের উপর নজরদারিই করছে, তাহলে বারবার ঐ একই পোশাক – শুধু প্যান্ট আর বুশ-শার্টই বা – পরছে কেন? ওর সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহল জাগিয়ে রাখাই কি ওর উদ্দেশ্য?
এমন তো হতে পারে, বলে মুড়কি, লোকটা কোন একটা কিছুর থেকে, মানে আসল ব্যাপারটা থেকে, আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে দিতে চাইছে। পেছন থেকে দেখা দিচ্ছে বারবার যাতে আমরা চিনতে না পারি ওকে, কিন্তু ওকে নিয়ে আলোচনা আমাদের করতেই হচ্ছে, আর সেই আলোচনাটাকে জিইয়ে রাখবার জন্যেই যেন লোকটা বারবার আমাদের দেখা দিয়েই যাচ্ছে!
হুঁ, ঠিকই, হতেই পারে, একটু সতর্ক থাকিস, বলে ফল্গু।
অফিসের দরজাটা খুলে যায় একটু পরেই। ওরা তিনজন ঢোকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। মিলিটারি কায়দার য়্যুনিফর্ম পরা একজন গার্ড দরজার পাশেই, ভেতরে কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে জীন্স্-টী শার্ট পরা একজন মহিলা। ওদের দিকে চোখ পড়তেই হেসে জিজ্ঞেস করেন, ফ্রম ইণ্ডিয়া?
একেবারে ঠিক, আমার নাম ফল্গু।
ফল্গু ফল্গু ফল্গু – প্রবল চিৎকার করে কাউকে বলতে শোনা যায় হঠাৎ, কণ্ঠস্বর মহিলা না পুরুষের বোঝা যায় না।
একটু অস্বস্তির হাসি হাসেন মহিলা, আঙুল তুলে দেখিয়ে দেন ওদের পেছনেই ঝোলানো বিরাট খাঁচাটাকে। ধপধপে সাদা বেশ বড়োসড়ো একটা কাকাতুয়া মাথার ঝুঁটিটাকে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে একটু তেরছা ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
খুব বেয়াদব কাকাতুয়া, মহিলা বলেন, হঠাৎ হঠাৎ এরকম ডেকে ওঠে।
তাতে বেয়াদবির কী হলো, আমার তো বেশ ভালোই লাগল ওর মুখে নিজের নামটা শুনতে!
সে তুমি হয়তো বার্ড লাভার তাই। পাখি পুষেছ কখনও?
পুষেছি তো ছোটবেলায়, টিয়া।
টিয়া? নাম শুনিনি তো কখনো।
আপনি না-ই শুনতে পারেন। টিয়া একধরণের প্যারট, সবুজ রঙ, লাল ঠোঁট। বৈজ্ঞানিক নাম সিটাক্যুলা ক্রেমারি। দক্ষিণ আমেরিকায় হয়তো দেখা যায় না, কিন্তু আমাদের দেশে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখতে পাবেন, দেখা যায় আফ্রিকাতেও। ভূমধ্যসাগরীয় য়্যোরোপেও বহুদিন টিয়া পোষার চল আছে। কাকাতুয়া যেমন, টিয়াও সেরকম, শেখালে কথা বলে।
তোমরা কি পাখি দেখার জন্যেই পেরুতে এসেছ?
পাখি দেখাটা আমাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আসলে আমার একজন আত্মীয় ব্রাজিলে থাকেন। তাঁর কাছে বেড়াতে এসেছিলুম, তিনিই পেরুতে আসার পরামর্শ দিলেন, এখানে আমরা পেরু অ্যামাজন রেনফরেস্ট প্রজেক্টে ভলান্টিয়ারিং করতে চাই।
ভলান্টিয়ারিং? তুমি করতেই পারো, কিন্তু তোমার এই সঙ্গী দুজনকে বোধ হয় নেওয়া যাবে না। এদের বয়েস কতো?
উল্কির বয়েস উনিশ আর মুড়কির চোদ্দ শুনে মহিলা বললেন, আঠেরোর নীচে ভলান্টিয়ারিং প্রজেক্টে নেওয়াই হয় না। কী করবে তাহলে তোমরা?
কী করব সেটা তো ভাবিনি। এমনিতে আমাদের বাজেট সামান্যই, ভেবেছিলুম এখানে ভলান্টিয়ারিং করে কিছু আয় করে নেব, তারপর মাচুপিকচুতে ঘুরে আসব একটু।
এবার হেসে ফেলেন মহিলা, তোমাদের যিনি আত্মীয়, তিনি বিশেষ খবর রাখেন মনে হচ্ছে না। এই ভলান্টিয়ারিঙে আয় হয় না, ব্যয়ই হয় বরং। আসলে, ট্যুরিজ্ম্ পেরুর প্রধানতম ব্যবসা। আমাদের এই যে ছোট্ট শহর ম্যালডোনাডো, এমনকি এখানেও রাস্তায় বেরোলেই দেখবে, এভ্রি সেকেণ্ড শপ সেল্স্ ট্যুরিজ্ম্ অব সামকাইণ্ড। ভলান্টিয়ারিং প্রজেক্ট একটা অসম্ভব ভালো প্রজেক্ট ঠিকই, কিন্তু বিজনেসের দিক থেকেও খুব সাকসেসফুল প্রজেক্ট এটা। যাদের নেওয়া হয় তাদের কাছ থেকে থাকা-খাওয়ার জন্যে নেওয়া হয় প্রচুর টাকা। বিশেষ করে জঙ্গল দেখার জন্যে নানা খাতে থাকে প্রচুর খরচ। অতএব, এই ভলান্টিয়ারিঙে তোমাদের আয়ের আশা কিছুই নেই। একটু থেমে, ওদের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে এবার বলেন মহিলা, তোমরা কী করবে তাহলে?
আচ্ছা, মাচুপিকচুর খরচ কেমন? – জিজ্ঞেস করে উল্কি।
মাচুপিকচুতে কম্পেয়ারেটিভলি খরচ কম। নাইট বাসে পৌঁছে যাবে কাস্কো, অতএব একদিনের থাকার খরচ কমলো। পৌঁছিয়ে, ওখানে অনেক রকমের বাজেট অ্যাকোমোডেশন পেয়ে যাবে। একটু কষ্ট করলে খানিকটা ট্রেক করে, খানিকটা রেলপথে পৌঁছোনো যায় মাচুপিকচুতে। কিন্তু সেটা তো পরের কথা, এখন জঙ্গলে ঘোরার ব্যাপারটার কী করা যাবে সেটাই আসল প্রশ্ন। আচ্ছা – ভদ্রমহিলার যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেছে – তোমরা এখানে আছো কোথায়? তাম্বোপাতা ট্র্যাভ্লার্স ইন?
কী করে বুঝলেন?– এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেল মুড়কি।
তোমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বোঝা গেল, বাজেট ট্র্যাভ্লার্সদের মধ্যেও প্রথম সারির লো-বাজেট যারা, তোমরা তাদেরই দলে। আর শুধু তা-ই নয়, ফিনানশিয়াল অকওয়ার্ডনেসটাও গোপন রাখার কোন আগ্রহ তোমাদের নেই। কাজেই, ট্র্যাভ্লার্স ইন-এই যে তোমরা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। যা-ই হোক, তোমরা কবে এসেছ, গতকাল?
হ্যাঁ, গতকাল সন্ধ্যেবেলা, বলে উল্কি।
তার মানে আজ সন্ধ্যে পর্যন্ত তোমাদের থাকার মেয়াদ, সন্ধ্যে পেরিয়ে গেলেই ওখানে থাকবার জন্যে চার্জ দু-দিনের, তাই তো? ঠিক আছে, তোমরা আপাতত একটা কাজ কর। আমার একটা ছোট গাড়ি আছে। বাইরেই দেখতে পাবে সেটা। সেই গাড়ির ড্রাইভার তোমাদের নিয়ে যাবে এখান থেকে খানিকটা দূরে এমন একটা জায়গায় যেটা তোমাদের খুবই ভাল লাগবে বলে আমার ধারণা। কথাটা বলে, মিলিটারি কায়দায় দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডটাকে একটা কিছু ইঙ্গিত করেন মহিলা, গার্ডটা দ্রুত বেরিয়ে যায়।
এখান থেকে কত দূর?– জিজ্ঞেস করে ফল্গু।
তা বেশ খানিকটা, বলেন মহিলা, ঘন্টাখানেক লাগবে গাড়িতে।
আপনি যদি কিছু না মনে করেন একটা কথা বলতে পারি তাহলে? – ফল্গু বলে আবার, আমরা কি একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যেতে পারি না?
নিশ্চয়ই পারো, কিন্তু যাবে না। দুটো কারণ। এক, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করলে তোমরা সন্ধ্যের আগে ফিরতে পারবে না, সে ক্ষেত্রে বিনা কারণে তোমাদের একটা দিনের রূম-রেন্টের পয়সা অযথা খরচ হবে। বাজেট ট্যুরিস্টের পক্ষে সেটা নেহাতই অপচয়। দু নম্বর কারণ, আমি চেষ্টা করছি, পেরু অ্যামাজন রেনফরেস্ট প্রোজেক্টের ডিরেক্টরের সঙ্গে তোমাদের আলাপ করিয়ে দেবার, সেটা করতে হলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তোমাদের ফিরতেই হবে এখানে, প্রাইভেট ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা না থাকলে সেটা অসম্ভব।
এই পর্যন্ত বলার পর এক এক করে ওদের তিন জনের দিকেই ধীরে ধীরে চোখ বুলিয়ে নেন মহিলা – মুড়কি থেকে শুরু করে উল্কিকে পেরিয়ে ফল্গু পর্যন্ত – তারপর মৃদু হেসে বলেন, আমি জানি তোমাদের একটু অস্বস্তি হচ্ছে, হয়তো বিশেষ করে অস্বস্তি হচ্ছে আমি স্পষ্ট করে তোমাদের ফিনানশিয়াল অকওয়ার্ডনেসের কথাটা বললাম বলে, কিন্তু আমি স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করে বলতেই ভালোবাসি। শুধু তোমাদের অস্বস্তি কাটাবার জন্যে বলে রাখি, আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের কোন অর্থ সাহায্য করছি না, পেরুর ট্যুরিজম প্রোমোশনের অনেকটা দায়িত্ব আমার, সেই হিসেবে খানিকটা সরকারি পয়সা নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা মতো খরচ করার অধিকারও আমার আছে। সেই অধিকারের জোরে নিজের বুদ্ধি অনুযায়ী আমি স্থির করেছি, তোমাদের খানিকটা সাহায্য করাটা পেরুর ট্যুরিজ্মের পক্ষে ভালই হবে। এর পরেও যদি আর কোন প্রশ্ন তোমাদের থাকে তাহলে তোমরা ফেরবার পর আমরা সেটা আলোচনা করব, এখন আর দেরি কোর না, ড্রাইভার তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।